অলকানন্দা ও তিতলি পর্ব-০৩

0
12

#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-৩
#সারা মেহেক

নিজের ইচ্ছেগুলো দমিয়ে রেখে দাঁতে দাঁতে চেপে বললাম,
” আমার বয়সের দিকে একটু খেয়াল তো রাখবেন আদ্রিশ ভাই। আমি ছোট মানুষ। বয়স খুব বেশি না।”

আদ্রিশ ভাই ভ্রু কুঁচকে এমনভাবে তাকালেন যেনো আমি কোনো অবাস্তব ও হাস্যকর কথা বলে ফেলেছি। উনি সরাসরি চাহনিতে আমাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
” দেখে তো মনে হয় না ছোট। ছোট হওয়ার সংজ্ঞা জানো?”

আমি আর কথা বাড়ালাম না। কেননা কথা বাড়ালেই নিশ্চিত ঝগড়া লেগে যাবে আমাদের। আর হসপিটালে বসে ঝগড়া করা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাজ নয়। তাই আমি লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললাম,
” আংকেলের সকালে ওষুধ দেয়া হয়েছে?”

আদ্রিশ ভাইও ওদিকে আর কথা না বাড়িয়ে শান্ত হলেন। বললেন,
” হুম। সকালের ডোজ শেষ। ডাক্তার আরোও কিছু ওষুধ দিয়েছিলো। সেটাই আনতে গিয়েছিলাম। এখন চলো, যাই। ”

উনার শেষোক্ত প্রস্তাবে আমি বেশ অবাক হলাম। হঠাৎ কোথায় যেতে বললেন উনি! জিজ্ঞেস করলাম,
” যাবো? কোথায় যাবো?”

আদ্রিশ ভাই বেশ স্বাভাবিক সুরেই বললেন,
” কেনো ক্যান্টিনে!”
বলেই মুখের ভাব এমন করলেন যেনো এ প্রস্তাবটা খুবই স্বাভাবিক এবং সাধারণ বিষয় উনার জন্য। আমার বিস্ময়ের মাত্রা এবার পূর্বের চেয়েও বৃদ্ধি পেলো। আদ্রিশ ভাই খাবার প্রস্তাব দিচ্ছেন! এ যেনো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পাবার মতো। আমি একটু অবাক দৃষ্টিতে অন্য দিকে চাইলাম। অতঃপর ঠোঁট উল্টে বিরবির করে বললাম,
” এত উন্নতি! হজম হয় না।”

আদ্রিশ ভাই যে কীভাবে আমার কথা শুনে ফেললেন কে জানে! আমাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,
” আপাতত খাবার হজম করলেই চলবে। ”

আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। এত জোরেও কথাটা বলিনি যে উনি শুনে ফেলবেন। তবে এখন কি আর করার! উনার পিছু পিছু কেবিন থেকে বের হলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি ক্যান্টিনে গেলে আংকেলের কাছে কে থাকবে?”

আদ্রিশ ভাই পকেট থেকে ফোন বের করে কিপ্যাড ডায়াল করতে করতে বললেন,
” চাচু থাকবে। আসছেন উনি। ”

বলেই ফোন করলেন চাচুকে। ওপর পাশ থেকে চাচু কি বললো শুনিনি। কিন্তু এপাশ থেকে আদ্রিশ ভাই বললেন,
” আচ্ছা চাচু, আসেন তাহলে। আমি কেবিনের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছি। ”

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই চাচু চলে এলেন। তিনি কেবিনে ঢুকলে আমি ও আদ্রিশ ভাইও চলে এলাম সোজা ক্যান্টিনে। আমাদের মেডিকেলের ক্যান্টিনটা বেশ বড়ও নয় আবার ছোটও নয়। ৯টার দিকে ক্যান্টিনে বেশ ভীড় থাকে। সে তুলনায় এখন বেশ খালি খালি। আমাদের ক্যান্টিনের সার্বিক অবস্থা দেখে আদ্রিশ ভাই ভ্রুজোড়া উঁচু করে বললেন,
” বাহ। আমার এক্সপেকটেশনের চেয়ে বেশ ভালোই আছে তোমাদের কলেজের ক্যান্টিনটা। ”

আমিও উনার কথায় একটু ভাব নিয়ে বললাম,
” দেখতে হবে না কার কলেজ!”

আদ্রিশ ভাই কিছু বললেন না। তবে হাসলেন। একটা খালি টেবিলে গিয়ে আমরা দুজন বসলাম। এ সময়টাতে পরোটা ও ডাল পাওয়া বেশ দুষ্কর হলেও আজ পেলাম। আমি অর্ডার দিয়ে এসে চেয়ারে বসলাম। আদ্রিশ ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
” আজ ক্লাস ছিলো না?”

” ছিলো তো। আমি ক্লাস বাদ রেখে এসেছি। শুধুমাত্র আংকেলকে দেখবো বলে। দেখেছেন আমার ডেডিকেশন!”

আদ্রিশ ভাই মৃদু হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” কিসের এতো ডেডিকেশন? কার জন্য এতো ডেডিকেশন?”

আমি ভ্রু কুঁচকালাম। বললাম,
” কার জন্য হবে আবার? আংকেল অসুস্থ, তাই দেখতে আসবো না! আপনি তো উনার খোঁজ খবরই দেন না। ফোনটা একটু চেক করে দেখবেন, রাতে আপনাকে অনলাইন, অফলাইন দু জায়গাতেই ম্যাসেজ করেছি। কিন্তু আপনি জবাব দেননি। ”

” তাই? ওয়েট। আমি ফোনটা চেক করি তো। ”
বলেই উনি ফোন বের করলেন। এরপর আমার ম্যাসেজগুলো দেখে ছোট্ট করে ‘সরি’ বললেন৷ এতক্ষণে আমাদের খাবারও চলে এলো। দুজনেই কথাবার্তা ছাড়া খাবার শেষ করলাম। কেননা দুজনেই অভুক্ত ছিলাম৷ তাই খাবার দেখে আর নিজেদের সামলাতে পারিনি। গপাগপ খেয়ে উঠলাম দুজনেই। খাবার বিল পে করলেন আদ্রিশ ভাই। খাবার শেষে ঐ চেয়ারে বসেই কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম দুজন।
আমি চেয়ারে বসে ফোন চালাচ্ছি। আদ্রিশ ভাইও একই কাজ করছেন। হঠাৎ, উনি বলা-কওয়া বাদে টেবিলের উপর দিয়ে ঝুঁকে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। উনার আকস্মিক এ আচরণে আমি থমকে গেলাম৷ চোখ বড় বড় করে উনার এ দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি আরেকটু ঝুঁকে হাতটা এগিয়ে দিলেন। উনি যতই কাছে এগুচ্ছেন ততই আমার হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবার আমাকে প্রায় অজ্ঞান করার পর্যায়ে নিয়ে উনি হাত এগিয়ে আমার মাথার উপরে রাখলেন। হিজাবের উপর থেকে কি যেনো ঝেড়ে ফেলে তৎক্ষনাৎ নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন। আমি শঙ্কিত ও বিস্মিত চাহনিতে আদ্রিশ ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম। এ মুহূর্তে ঠিক কি হলো, কেনো হলো তা প্রসেস করতেই আমার সময় লাগলো। উনার এই এগিয়ে আসা যতটা ধীরস্থির ছিলো, পিছিয়ে চেয়ারে বসে পড়াটা ঠিক ততটাই দ্রুত গতিতে ছিলো। আদ্রিশ ভাই নিজের এ আকস্মিক কাজের ব্যাখ্যা দিলেন না। বরং নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে ফোন চালাতে লাগলেন, যেনো কিছুই হয়নি। যেনো উনি এই যুবতী মেয়েটার হৃৎস্পন্দন বাড়াননি। ঠিক যেমন কিশোরী মেয়েটার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়েছিলেন!
আমি নিজেকে স্থির করলাম, শান্ত করলাম। অতঃপর বুকের অসহ্যকর ধুকপুকানি থামানোর চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করলাম,
” আদ্রিশ ভাই? কি করলেন এভাবে?”

আদ্রিশ ভাই দৃষ্টি তুলে চাইলেন। অবলীলায় শুধালেন,
” কই? কি করলাম আমি?”

” এই যে সামনে এগিয়ে এসে আমার হিজাবে হাত দিলেন। কেনো?”

” ওহ আচ্ছা… ময়লা ছিলো। ময়লা সরিয়ে দিলাম।”

” আমাকে বলতে পারতেন। আমি নিজেই ঝেড়ে ফেলে দিতাম। এভাবে এগিয়ে কাছে এসে আপনার উপকার করার কোনো দরকার ছিলো না।”
একটু শক্ত গলায় বললাম আমি। আদ্রিশ ভাই চট করে ফোন রাখলেন টেবিলের উপর। দু হাত টেবিলে ঠেকিয়ে ভ্রু তুলে সন্দিহান গলায় শুধালেন,
” তোমার সমস্যা কোথায় ছিলো মিশমিশ? আমি এভাবে এগিয়ে তোমার কাছে আসায়? নাকি পারমিশন না নিয়ে হিজাবের উপর থেকে ময়লা ফেলে দেয়ায়?”

আমি শুকনো একটা ঢোক গিললাম। আমার যে দুটোতেই সমস্যা এটাও গলা দিয়ে বের হলো না।তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা আমার দিকে ঝুঁকে আসায়। উনি যেভাবে আমার দিকে এগিয়ে আসছিলেন, আরেকটু হলেই আমি নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করতাম। তখন আংকেলের মতো আমিও হসপিটালে ভর্তি হতাম। এর দায়ভার কে নিতো!

আদ্রিশ ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
” কি হলো? বলো? কোনটাতে সমস্যা তোমার? ”

আমি একটু সময় নিয়ে আমতাআমতা করে বললাম,
” দু-দুটোতেই সমস্যা। ”

আদ্রিশ ভাই ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে পিছিয়ে গেলেন। আয়েশ করে চেয়ারে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে বেশ সাবলীল গলায় বললেন,
” ঠিক আছে। নেক্সট টাইম পারমিশন নিয়ে কাছে আসবো। ”

আমি ভূত দেখার মতো চমকে উঠা গলায় বললাম,
” কি! কি বললেন?”

উনি পূর্বের ন্যায় বললেন,
” বললাম যে নেক্সট টাইম পারমিশন নিয়ে তোমার হিজাব থেকে ময়লা ফেলবো। কেনো? তুমি কি শুনেছিলে?”

আমি এবার দ্বিধায় পড়লাম। সত্যিই কি উনি এ কথা বললেন? নাকি কিছুক্ষণ আগে কাছে আসার সময়ে পারমিশন নেয়ার কথা বললেন? আমি কি তবে কানে বেশি শুনছি? নাকি আদ্রিশ ভাই-ই মিথ্যে কথা বললেন?
এসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে হঠাৎ আমার বান্ধবী সামিহার আগমন ঘটলো। সামিহা আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো,
” কি রে দোস্ত? ক্লাসে আসিসনি কেনো? ”

” আমার এক আংকেল অসুস্থ, হসপিটালে ভর্তি। উনাকে দেখতে এসেছিলাম। তুই এখন এখানে কেনো? ক্লাস নেই আর?”

” না। পরের ক্লাসটা আজ আর হবে না।”

পরের ক্লাস না থাকায় আমি ভীষণ খুশি হলাম। বিস্তৃত হেসে সামিহাকে পাশে বসতে বললাম। ও বসতে বসতে সামনে আদ্রিশ ভাইয়ের দিকে তাকালো। অতিরিক্ত মাত্রায় এক্সট্রোভার্ট সামিহা আদ্রিশ ভাইকে দেখে আমাকে উনার পরিচয় জিজ্ঞেস না করেই সোজাসুজি উনাকে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনাকে চিনলাম না ভাইয়া। আপনার পরিচয়?”

আদ্রিশ ভাই মৃদু হেসে বললেন,
” আমি নাফিসার বন্ধু। ”

” ওওও, নাফিসা আপুর বন্ধু আপনি!”

” জি। আপনার পরিচয়?”

” আমি? আমি মিমের মোস্ট ক্লোজ ফ্রেন্ড, মানে বেস্টফ্রেন্ড সামিহা। আর ভাইয়া,আমাকে আপনি করে না বলে তুমি করে বলবেন। আপনার অনেক ছোট আমি।”

আদ্রিশ ভাই মৃদুহাস্যে বললেন,
” আচ্ছা। ”

সামিহা এবার বেশ খোশ মেজাজে বললো,
” জানেন ভাইয়া, আমি দূর থেকে আপনাকে দেখে ভেবেছি, আমাদের কলেজে এত হ্যান্ডসাম ছেলে আসলো কোথ থেকে! তারপর মিমকে আপনার সামনে বসে থাকতে দেখে ভাবলাম, ‘আরে, মিম কি আমাকে দাওয়াত না দিয়েই এত হ্যান্ডসাম একটা জামাই বিয়ে করে কলেজে চলে এসেছে! ”
®সারা মেহেক

#চলবে