অলকানন্দা ও তিতলি পর্ব-০৫

0
12

#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-৫
#সারা মেহেক

আদ্রিশ ভাইকে আপুর বিয়েতে দেখে রীতিমতো আবারও বড়সড় রকমের ক্রাশ খেলাম৷ ছেলেদের গ্লোআপ কি জিনিস তা উনাকে দেখে বুঝলাম, জানলাম। যেমন উনার চেহারায় সৌন্দর্য বেড়েছিলো, তেমনি ফ্যাশন সেন্সেও অনেক উন্নতি এসেছিলো। সবই হয়তো মেডিকেলের কামাল ছিলো। আমি মেডিকেলে আসার পরপরই শুনতাম পড়তে পড়তে কামলা হয়ে যাবার জোগাড় হয়। সেখানে আদ্রিশ ভাই কামলা থেকে কীভাবে কামাল দেখালো বুঝলাম না।

আপুর বিয়ের মধ্যে আমি নানান বাহানায় আদ্রিশ ভাইয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম। উনার সুনজরে থাকার চেষ্টা করতাম। কিন্তু হলুদের দিন সকাল থেকেই উনার আচরণ হুট করেই বদলে যেতে শুরু করে। উনি আগে যা না করতেন হলুদের দিন থেকে ঠিক তা-ই করতে লাগলেন। যেমন, আমার সাথে কথা না বলা, কথা বললেই রুডলি কথা বলা, কথা বলার সময় চোখেমুখে বিরক্তি ভাব আনা, আরোও নানান কিছু। উনার এরূপ হঠাৎ আচরণ বদলে যাবার কারণ আমি আজ অব্দিও উদ্ধার করতে পারিনি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে উনার প্রতি আমার সব সম্মান, ভালোলাগা হাওয়ায় মিশে গিয়েছে। উনার প্রতি আমার বিরক্তি বেড়েছে। একটা মানুষ অকারণে কীভাবে এমন করতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। আজও জানতে পারিনি। কিন্তু আপুর বিয়ের পর থেকে আমি নিজ থেকেই দূরত বাড়িয়ে নেই। কোনোদিন উনার আমাদের বাসায় আসার কথা হলেই আমি সেদিন বাসায় থাকতাম না। এর কারণ অবশ্য কেউ জিজ্ঞেস করেনি। ফলে স্বস্তিও পেয়েছিলাম।

বহু বছর পর এবার আদ্রিশ ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে উনার সাথে আবারও দেখা হয়। এত বছর পর দেখে মনেই হয়নি উনার বয়স বেড়েছে! আগের মতোই সুদর্শন ও দারুণ ফ্যাশন সেন্সে মণ্ডিত আছেন তিনি। শুধু চেহারায় সামান্য ম্যাচুরিটি এসেছে, যা এ বয়সে সবারই হয়ে থাকে। এত বছর আগের সবকিছু অপরিবর্তিত থাকলেও আমার প্রতি উনার আচরণে পরিবর্তন এসেছে। যদিও পরিবর্তনটা খুব বেশি নয়, আবার সামান্যও নয়। উনি এবার ভালোভাবে কথা বলছেন। দেখে মনে হচ্ছে কিছুটা গুরুত্বও পাচ্ছি। কিন্তু সময়ে অসময়ে আবার সুযোগ বুঝে একটু অপমানও করছেন। উনার এই গিরগিটির মতো আচার আচরণ বদলে যাবার কারণ আমি এখনও উদ্ধার করতে পারিনি।

————–

তিনদিন পর গতকাল আংকেল বাসায় ফিরেছেন। আর আজই আমরা সবাই মিলে আংকেলকে দেখতে এসেছি৷ আব্বু অফিস থেকে বাসায় ফিরে কোনোমতে ফ্রেশ হয়েই আমাদের নিয়ে এসেছে। ওদিকে আপু আর ইমাদ ভাই গতকাল এসেছিলো। আজ আমাদের আসার কথা শুনে তারাও আবার এসেছে।
আংকেলের অবস্থা এখন আগের চেয়ে বেশ ভালো। তবে শুধু ডান পাশে হালকা দূর্বলতা আছে। ডাক্তারের পরামর্শ মতো ওটা ফিজিওথ্যারাপিতে ঠিক হয়ে যাবে।

আদ্রিশ ভাইদের বাসায় উনার খালা বাদে আর কোনে আত্মীয় নেই। গতকাল কাছের আত্মীয়রা এসে মোটামুটি দেখা করে গিয়েছে। আন্টির অবস্থা খুব একটা ভালো না। আংকেলের অসুস্থতার পর থেকে আন্টিও অসুস্থই থাকছেন। কখনো বিপি বাড়ছে, কখনোও অস্থিরতা। সবদিয়ে আদ্রিশ ভাইদের পরিবারের অবস্থা শোচনীয়। এদিকে বেচারা আদ্রিশ ভাইয়ের একমাত্র ছোট বোন নদী কেঁদে কেঁদে অস্থির। একে তো ভাইয়ের বিয়ে ভাঙলো, অপরদিকে বাবা-মা দুজনই অসুস্থ। এ কয়দিনে নদী যে কয়বার আমার কাছে ফোন দিয়ে কেঁদেছে! ও আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট। এবার ইন্টার পরীক্ষা দিবে। যেহেতু ওর কোনো বোন নেই এবং ওর সাথে আমার বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না, তাই আমার সাথেই ও অনেক কিছু শেয়ার করে।

আমি বাসায় এসে আংকেলের সাথে দেখা হওয়ার পর নদীর রুমে চলে গেলাম। আভাও আমার সাথে গেলো। আমি গিয়ে বসতেই নদীর হা-হুতাশ শুরু হলো। বিশাল আফসোস নিয়ে বললো,
” জানো মিম আপু! আমি ভাইয়ার বিয়ের জন্য কত কিছু প্ল্যান করে রেখেছিলাম! হলুদে এটা পরবো,বিয়েতে ওটা, রিসেপশনে ওটা। তুমি তো জানতেই! আমার মতো এক্সাইটেড কেউই ছিলো না। কিন্তু এটা কি হলো!”

আমি নদীকে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে বললাম,
” যা হয়ে গিয়েছে তা নিয়ে অত ভেবে লাভ নেই। মেয়ের চরিত্র ঠিক ছিলো না বুঝাই যাচ্ছে। আদ্রিশ ভাই বড় বাঁচা বেঁচেছে! বিয়ের পরে এসব হওয়ার থেকে বিয়ের হওয়ার আগেই সব আসল রূপ সামনে এসেছে। ”

” আমি যখন ভাবীর সাথে…..”
এই বলা মাত্রই জিব কাটলো নদী। নিজেকে শুধরে নিয়ে বললো,
” সরি সরি। ভাবী না। ঐ মেয়েটা, আই মিন শান্তার সাথে যখন কথা বলেছিলাম মনেই হয়নি মেয়েটা এমন। মনে হচ্ছিলো খুশি খুশি মনে বিয়েতে রাজি হয়েছে। বিয়ে নিয়ে খুব এক্সাইটেড। কিন্তু এত খুশি থাকার পরও মেয়ে কীভাবে পালিয়ে যায় বুঝি না। ”

নদীর কথা শুনে আমিও একটু চিন্তায় পড়লাম। একটু অবাক হলাম। শান্তা নামের মেয়েটা কি তবে সত্যিই খুশি ছিলো নাকি খুশি হওয়ার নাটক করছিলো! কি অদ্ভুত! সবকিছু এতো জটিল কেনো!

রাতে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হলো আদ্রিশ ভাইদের বাসায়ই। আদ্রিশ ভাইয়ের খালা, আম্মু আর আপু মিলেই রাতের রান্না করলো। আন্টির অসুস্থতার জন্য তাকে রান্নার ধারের কাছেও ঘেঁষতে দেয়া হয়নি। এখানেই রাতের খাবার খেয়ে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত হলো। কেননা রাতের খাবার খেতেই আমাদের ১টা বেজে গেলো। এত রাতে দুটো অবিবাহিত মেয়েদের নিয়ে বাইরে বের হওয়া ভীষণ বিপজ্জনক বিধায় আদ্রিশ ভাইয়ের অনুরোধে আব্বু থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এই প্রথম আদ্রিশ ভাইদের বাসায় থাকা হচ্ছে আমাদের। এ নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিবোধ কাজ করছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে একটুখানি ভালো লাগাও কাজ করছে। অথচ এ ভালো লাগাটুকু আসা উচিত নয়। আমি ভালোলাগার কারণগুলো আসার সমস্ত পথ বন্ধ করলেও কোথ থেকে যেনো তারা ফের টপকে পড়ে।

একসাথে এতো মানুষ থাকা হচ্ছে বিধায় হুট করেই সিদ্ধান্ত হলো যে আজ রাতটা গল্প করবো, আর মুভি দেখে কাটাবো। যেই ভাবা সেই কাজ। নদী আর আভা মিলে মুভি খুঁজতে লাগলো। আমি আর আপু মিলে গেলাম রান্নাঘরে। মুভি দেখার সময়ে একটু পপকর্ণ না হলে চলে! তাই নদী এসে ভুট্টা আর চিপস বের করে দিয়ে গেলো। আমি আর আপু সেটা ভাজতে লাগলাম। ওদিকে অলস ইমাদ ভাই আদ্রিশ ভাইয়ের রুমের এসিতে শরীর জুড়াচ্ছেন। আর আদ্রিশ ভাই গিয়েছেন গোসল করতে। উনি এই রাত দেড়টায় গোসল করতে গিয়েছেন ভাবতেই আমি অবাক হলাম।

আমি আর আপু রান্নাঘরে কাজের সাথে টুকটাক গল্প করছি। আপু চিপস ভাজছে। আর আমি ভুট্টা চুলোয় দিয়ে বসে আছি পপকর্ণ হওয়ার অপেক্ষায়। এর মধ্যে কখন যে আদ্রিশ ভাই এসে আমার পিছে দাঁড়িয়েছেন,খেয়ালই করিনি। পপকর্ণ করতে করতে হঠাৎ বেখেয়ালে একটু পিছিয়ে এলে আদ্রিশ ভাইয়ের বুকের সাথে ধাক্কা খাই। চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখি সাদা স্যান্ডু গেঞ্জি ও কালো ট্রাউজার পরে গলায় তোয়ালে পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। গোসলের পর মাথার ভেজা চুলগুলোও ভালোভাবে মুছেননি। তাই তো চুল থেকে টপটপ করে উনার কপালে আর ঘাড়ে পানি পরছে। গলা ও হাতও ভালোভাবে মুছেননি। কেননা ওখানকার পানির বিন্দুগুলোও স্পষ্টরূপে দেখা যাচ্ছে। উনাকে এ অবস্থায় দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থম মে’ রে গেলেও ক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। আদ্রিশ ভাইয়ের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে চোখজোড়া কুঁচকিয়ে বললাম,
” কি ব্যাপার? এখানে কি? চুপিচুপি পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?”

আমার এ কথা শুনে আপুও চমকে পিছনে তাকালো। এতক্ষণ যে আদ্রিশ ভাই এসে দাঁড়িয়েছেন তা আপু খেয়ালই করেনি। সে মনের সুখে চিপস ভাজছিলো। আদ্রিশ ভাইয়ের এহেন হাল দেখে আপু মুহূর্তেই উনার অনাবৃত বাহুতে জোরেশোরে গাট্টা মেরে বললেন,
” অভদ্র পোলা! যা গেঞ্জি পরে আয়! এ কি হালে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস! দেখিস না মিম আছে!”

আদ্রিশ ভাই প্রথমত আপুর কথায় হাসলেন। অতঃপর গলার তোয়ালে এপাশ ওপাশ করতে করতে আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে বাঁকা হেসে বললেন,
” ও কি বড় হয়েছে রে নাফু?”

আপু একনজর আমার দিক চেয়ে আদ্রিশ ভাইয়ের দিকে ফের গরম চোখে চাইলেন। বললেন,
” যাবি নাকি গরম খুন্তি ঠেসে ধরবো!”

আদ্রিশ ভাই এবার সরু চোখে আপুর দিকে চেয়ে বললেন,
” উহ! ঢং তো দেখো মেয়ের! মনে হচ্ছে আমার মা। যাহ, সর এখান থেকে!”

” সরবো! সরলে কিন্তু তোর দিকেই সরবো। আর আমার হাতেও কিন্তু খুন্তি আছে!”
বলেই আপু এগিয়ে যেতে লাগলো। আর আদ্রিশ ভাইও সুযোগ বুঝে দৌড় দিলেন। তবে যাবার আগে রান্নাঘরে আবারও উঁকি মে’ রে আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” শোন, নাফু, জোস একটা হরর মুভি খোঁজা হয়েছে। ওটাই দেখবো কিন্তু! ”
বলেই উনি চলে গেলেন। আর এ কথাটা উনি আমার দিকেই চেয়ে কেনো বললেন তা ঢের জানা আছে। উনার এ কথায় আমার অল্পবিস্তর গলা শুকিয়ে এলো।
®সারা মেহেক

#চলবে।