#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-৮
#সারা মেহেক
” লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা…..”
আদ্রিশ ভাইয়ের এহেন কথায় আমি থতমত খেলাম। কি হলো এটা! যে লাইনটা আমার বলার দরকার ছিলো, সেটা উনি বললেন কেনো! আমার লাইন চুরি করলেন কেনো! আশ্চর্য!
আমি বিস্ময় নিয়ে আদ্রিশ ভাইয়ের মুখপানে চেয়ে আছি। উনি পূর্বের ন্যায়ই আচরণ বদলে আমার দিকে তেরছাভাবে চেয়ে বললেন,
” একটা যুবক ছেলের ঘরে পারমিশন ছাড়া ঢুকলে কি করে! তার উপর আবার আমার ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকেও দেখে যাচ্ছো! চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছো!”
আমি আদ্রিশ ভাইয়ের কথায় ও কান্ডে বারংবার অবাক হচ্ছি। মানুষটা কি ঠাট্টা শুরু করেছে! এখন কি আমিও উনার এ মশকরার সাথে যুক্ত হবো! আমার বিস্ময়ে পূর্ণ নিষ্পলক চাহনি দেখে আদ্রিশ ভাই ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
” কি হলো? অত বড় বড় চোখ করে আছো কেনো? আগে বুঝি কখনো ছেলে দেখোনি? নাকি এমন সুন্দর বডিওয়ালা ছেলে দেখোনি?”
নাহ, এবার আমার দৃষ্টি দুটো সত্যিই সরিয়ে নেয়া দরকার। এমন অপমান আর নেয়া যাচ্ছে না। উনি ভাবছেন আমি উনার শরীর দেখছি! অথচ আমি উনার কথায় ও কাজে অবাক হয়ে উনার চেহারার দিকে তাকিয়ে আছি।
এবার আমি চট করে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে বললাম,
” দেখেছি। অনেক হ্যান্ডসাম হ্যান্ডসাম ছেলে দেখেছি। কিন্তু আপনার মতো এমন শেমলেস ছেলে দেখিন। আপনিও বড্ড বেহায়া। মেয়ে মানুষের সামনে যে শরীর ঢেকে রাখতে হয় জানেন না?”
আদ্রিশ ভাই এবার তার চিরাচরিত রূপে ফিরে এলেন। মাঝেমধ্যে যে কি হয় উনার, বুঝে উঠতে পারি না। এক মানুষ দু ধরণের আচরণ করে কি করে! উনার কি তবে বাইপোলার ডিসঅর্ডার আছে বা মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার আছে? বড়ই চিন্তার বিষয়।
আদ্রিশ ভাই ওয়াশরুমের সামনে থেকে সরে নিজের রুমে পায়চারী করতে লাগলেন। হাতে থাকা তোয়ালে দিয়ে আধ ভেজা শরীর মুছতে মুছতে বাঁকা হেসে বললেন,
” সব মেয়ের সামনে তো শরীর ঢেকে রাখতে হয় না। তুমি এই জিম করা বডি দেখতে না চাইলেও অনেক মেয়ে কিন্তু ঠিকই দেখতে চায়।”
” তারাই দেখতে চায় যারা আপনার মতো বেহায়া। আমি অত বেহায়া না। ”
” অত না হলে কি একটু বেহায়া? ”
” উঁহু, একটুও না। আমি একটুও বেহায়া না।”
আমার এটুকু বলতে দেরি হলো, কিন্তু অকস্মাৎ আদ্রিশ ভাইয়ের নিকটে আসতে দেরি হলো না। উনি চট করে আমার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সামান্য ঝুঁকে এলেন। অতঃপর আমার হৃদস্পন্দন ১০০ তে নিয়ে দাঁড় করিয়ে বাঁকা ঠোঁটে মুচকি হেসে বললেন,
” বেহায়া না হলে এখনও আমার রুমে আছো কেনো? তুমি শুধুই বেহায়া নও মিশমিশ। তুমি আপাদমস্তক একজন লাজুক প্রকৃতির বেহায়া মেয়ে। ”
আদ্রিশ ভাইয়ের এহেন কথায় আমি আর এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। কোনো রকমে পা জোড়া তুমুল বেগে চালিয়ে উনার রুম থেকে প্রায় পালিয়ে এলাম। পিছে যে উনি আমার উপর হাসলেন তা শতভাগ জানা আছে।
আমি এসেই নদীর রুমে বসলাম। আমার হাত পা মৃদু কাঁপছে। হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিকের তুলনায় অধিক হারে বেড়েছে। ভেতরে অদ্ভুত এক অস্থিরতা অনুভব হচ্ছে। এর আগে কখনও আদ্রিশ ভাই আমার এতোটা কাছে আসেননি। এমনটাও অনুভব হয়নি যেমনটা আজ হয়েছে৷ উনি যখন ঠিক আমার সামনে ঝুঁকে দাঁড়ালেন, ক্ষণিকের জন্য মনে হলো আমার সময় থমকে গিয়েছে। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে এসেছে। শরীরের ভেতরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। এই যদি হয় উনার এই সামান্য কাছে আসার পরিণাম!
ভাগ্যিস উনি আসেননি। তা না হলে আমি অতিরিক্ত বুক ধরফরানিতেই ম’ রে যেতাম।
লোকটা মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন। দিনকে দিন তাঁর এ সুদর্শনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁর উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের গায়ের রং তার উজ্জ্বল দ্যূতি যেনো আমার অব্দি ছাড়িয়ে দিচ্ছেন। আজকাল মুখের চাপ দাঁড়িগুলোও সুন্দরমতো সাইজ করে ছেটে রাখছেন। চুলগুলোও পরিপাটি রাখছেন। আপুর সাথে আদ্রিশ ভাই প্রথম যখন আমাদের বাসায় আসেন তখন উনার চুলের অবস্থা ছিলো ভয়াবহ। পুরো বাবুই পাখির বাসার মতো উনার চুলের অবস্থা ছিলো। সেই অগোছালো ছেলেটি আজ সময়ের ব্যবধানে বড্ড গোছালো হয়ে গিয়েছে। এমতা যেকোনো মেয়ে দেখলেই হয়তো ক্রাশ খাবে। আমিও হয়তো আবারও ক্রাশ খেতাম। কিন্তু উনার কিছু কিছু আচরণের কথা মনে পড়লেই আমি নিজেকে সামলে নেই। লোকটা সুদর্শন হতে পারে, তবে সুশীল নয়। এবং শুধুমাত্র আমার সাথেই সুশীল নয়। যত রুষ্টতা সব যেনো আমার উপর খাটাতে পারলেই শান্তি!
—————–
এক সপ্তাহ পর,
আইটেমের চরম যন্ত্রণায় দিনকাল আমার দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। প্রফ যত এগিয়ে আসছে ততই আমার দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বারংবার মনে হচ্ছে, কোনো অঘটন ঘটবে। কেননা মেডিকেল সেক্টরের এতো চাপে, এতো পড়াশোনার সাথে আমার মানিয়ে নিতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে। যখন সবকিছু ধীরেধীরে মানিয়ে নিয়েছি তখনই একের পর এক পরীক্ষা এসে ধাক্কা দিচ্ছে আমাকে।
আজ ফিজিওলজির বিশাল এক আইটেম আছে। লেকচার ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আইটেমটা পড়েছি। ভেবেছিলাম আজ এই আইটেমটা যেকোনো মতো ক্লিয়ার করে ছাড়বো। কিন্তু ডিপার্টমেন্টে গিয়ে শুনি এক মহা দুশ্চিন্তার খবর। ফিজিওলজিতে নতুন এক স্যার এসেছেন। আজই জয়েন করেছেন। আর আমাদের ক্লাস টিচার মান্নাত ম্যাম ম্যাটারনাল লিভে চলে গিয়েছেন। মূলত উনার স্থলেই নতুন স্যার এসেছেন। বেশ ক’দিন যাবত শুনছিলাম,মান্নাত ম্যাম ছুটিতে চলে যাবেন, প্রেগন্যান্সিতে কমপ্লিকেশনের জন্য। কিন্তু এভাবে যে হঠাৎ আমাদের বিদায় না জানিয়েই চলে যাবেন তা ভাবিনি।
ক্লাস গিয়ে এ ঘটনা শুনে দোয়া করছিলাম যেনো নতুন স্যার আমাদের ব্যাচটিচার না হোন৷ কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সপই নতুন স্যারই আমাদের ব্যাচ টিচার হলেন। এখন এই নতুন স্যারের নাম, পরিচয় কিছুই জানি না। দু একজনকে জিজ্ঞেস করার পরও তারা বলতে পারেনি। তাই অগত্যা বিগড়ে যাওয়া মনমেজাজ নিয়ে স্যারের অপেক্ষায় বসে রইলাম।
আমি আর সামিহা ফার্স বেঞ্চে বসেছি। এমন সময় আমাদের পিছন হতে দরজা দহয়ে নতুন স্যার ক্লাসরুমে প্রবেশ করলেন। আর এই নতুন স্যার আর কেউ নন, বরং আপুর প্রাণপ্রিয় বন্ধু আদ্রিশ ভাই। স্যার হিসে আদ্রিশ ভাইয়ের এ অভিষেক দেখে আমি ও সামিহা যেনো আকাশ হতে পড়লাম। কখনও কল্পনা করিনি যে এই খাটাশ লোকটাকে এখন স্যার হিসেবে ডাকতে হবে! সমািহা বিস্ময় নিয়ে আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
” কি রে মিম! আদ্রিশ ভাইয়া এখানে কেনো!”
আমিও রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে ফিসফিস করে জবাব দিলাম,
” জানি না রে দোস্ত। আচ্ছা, বল তো, তুই আজকে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলি?”
সামিহার বিস্ময়ের সহিত আদ্রিশ ভাইয়ের দিকে এক ধ্যানে চেয়ে বললো,
” সিলিং ফ্যানকে দেখে দোস্ত। ”
সামিহার কথায় নিরুত্তাপ চাহনিতে আঁড়চোখে চাইলাম। নাহ, মেয়েটা কখনও সিরিয়াস হলো না। এই মুহূর্তে এমন মজা করার কি দরকার! যদিও সত্য বলেছে। তবে আমার প্রশ্নের প্রেক্ষিতে উত্তরটা এমন হওয়া উচিত না। এই ভেবে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম৷
আদ্রিশ ভাই এসে বসলেন টিচার্স টেবিলের চেয়ারে। ঠিকঠাক আমার সামনে। দুজনে মুখোমুখি বসেছি প্রায়। এবং আশ্চর্যজনকভাবে উনার বাঁকা দৃষ্টি সব ছেড়ে আমার উপরেই নিবদ্ধ। উনার এ চাহনির অর্থ ঢের বুঝতে পারছি আমি। যেনো আমার বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন উনি। আদ্রিশ ভাইয়ের এ চাহনি যে আমার মধ্যে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে তা উনি বুঝতে পারছেন ঠিক।
আমার দিকে তাকিয়ে বিজয়ী হাসি হেসে অতঃপর উনি সমস্ত ক্লাসের সামনে নিজের পরিচয় দিলেন। এর মধ্যে পাশ থেকে সামিহা টিপ্পনী কেটে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
” দোস্ত, সত্যি বল তো! আদ্রিশ ভাই আর তোর বিয়ে হয়েছে তাই না? তাই তো উনি তোর টানে আমাদের ক্লাসে ছুটে এসেছেন। ”
আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,
” বাজে বকা বন্ধ কর সামিহা। নাহলে পিঠের উপর এমন দুমদাম বসাবো যে বিয়ে শাদির কথা জানালা দিয়ে পালাবে। সামনের বেঞ্চে…….. ”
আমার কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার পূর্বেই আদ্রিশ ভাই প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
” এই যে মিস! কথা বলছেন কেনো! ”
বলেই তিনি সামিহা ও আমার দিকে আঙুল তাক করে বললেন,
” এই যে, আপনারা দুজন দাঁড়ান। খুব গল্প করতে মন চাইছে! যান, বাইরে গিয়ে গল্প করুন। আমার ক্লাসে এসব কানাকানি, ফিসফিস হবে না। যান, ক্লাসের বাইরে যান। ”
®সারা মেহেক
#চলবে