অলকানন্দা ও তিতলি পর্ব-১৪

0
13

#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-১৪(প্রথম অংশ)
#সারা মেহেক

এ মুহূর্তে আপুর রুমে আমি, আপু, ইমাদ ভাই ও আদ্রিশ ভাই আছি। আমি চেয়ারে বসে আছি। আর আপু কাচুমাচু হয়ে বসে আছে বিছানার উপর। আদ্রিশ ভাই বুকে হাত গুঁজে এক পা ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছেন, ওয়ারড্রবে হেলান দিয়ে। আর ইমাদ ভাই তার এ দু বন্ধুর ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন।
আদ্রিশ ভাই আপুর দিকে তীক্ষ্ণ রাগান্বিত চাহনিতে চেয়ে আছেন। ভাবখানা তার এমন যে আপুকে এক্ষুনি ভর্তা বানিয়ে ফেলবেন। আপুও বোধহয় এই ভয়েই কাচুমাচু হয়ে আছে। ওদিকে ইমাদ ভাই চিন্তিত চাহনিতে একবার আপুর দিকে, একবার আদ্রিশ ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছেন। তিন বন্ধুর এহেন কার্যকলাপে আমি পড়লাম দ্বিধাদ্বন্দ্বে। আমাকে এই বন্ধুগুলোর মাঝে কেনো আটকে রাখা হয়েছে তা জানতে নিস্তব্ধ নগরীতে সর্বপ্রথম আমিই কথা তুললাম। জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনাদের তিন বন্ধুর ঝামেলায় আমাকে আটকে রেখেছেন কেনো আদ্রিশ ভাই? ”

আদ্রিশ ভাই সাঁই করে তাকালেন আমার দিকে। কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে শক্ত গলায় বললেন,
” এখন কোনো কথা বলবে না তুমি। একদম সাইলেন্ট মুডে চলে যাও। ”

উনার এহেন দৃষ্টি ও কথায় আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও ত্যাড়ামো করে জবাব দিয়ে বললাম,
” আমি কেনো সাইলেন্ট মুডে যাবো? আমাকে…..”

আদ্রিশ ভাই এবার ধমক দিয়ে চিবিয়ে বললেন,
” বলেছি না চুপ থাকতে?!”

আদ্রিশ ভাইয়ের এহেন ধমকে আমি মৃদু কেঁপে উঠলাম। ফের প্রত্যুত্তরে কিছু বলার পূর্বেই ইমাদ ভাই চোখের ইশারায় আমাকে চুপ থাকতে বললেন। আমিও চুপটি করে বসে রইলাম। অতঃপর আদ্রিশ ভাই আপুর ক্লাস নেয়া শুরু করলেন। পূর্বের চেয়েও শক্ত গলায় আপুকে জিজ্ঞেস করলেন,
” মিমকে যে ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছে, এটা আমাকে তুই জানাসনি কেনো? ”

আপু যে খানিক ভয়ে ভয়ে আছে তা আপুর দৃষ্টি চুরি করা দেখেই টের পেলাম। আদ্রিশ ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে আপু উল্টো আমতা আমতা করে প্রশ্ন করলো,
” জা-জানাবো কেনো? তোকে জানিয়ে কাজ কি?”

আপুর এহেন প্রশ্নে আদ্রিশ ভাইয়ের রাগ আরোও বৃদ্ধি পেলো। কেননা এ প্রশ্ন শোনা মাত্রই উনি হাতের মুঠো শক্ত করে কাঠের ওয়ারড্রবে সশক্তিতে আঘাত করলেন। সমস্ত রাগ নিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
” ড্যাম ইট! তুই জানিস না আমাকে কেনো জানাতে হবে? তুই কি ভেবে ওর বিয়ের কথা আমার কাছ থেকে লুকিয়েছিস?”

আদ্রিশ ভাইয়ের এহেন কাজে আমি ও আপু দুজনই ভয়ে কেঁপে উঠি। এর আগে আপুকে কখনো এভাবে ভয় পেতে দেখিনি, সেটাও আবার আদ্রিশ ভাইয়ের কাছ থেকে! এ আমার দেখা নতুন কেস। শান্তশিষ্ট ইমাদ ভাই এবার এগিয়ে গেলেন। আদ্রিশ ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
” শান্ত হো আদ্রিশ। মাথা ঠাণ্ডা কর৷ বাসায় তোর আর নাফিসার বাবা মা সবাই উপস্থিত আছে। এমন পরিবেশে তোর এভাবে রাগ দেখানোটা মানায় না। ”

আদ্রিশ ভাই রাগের মাথায় চিৎকার করে আরোও কিছু বলতে উদ্যত হলেন। কিন্তু পরক্ষণেই থেমে গেলেন। হয়তো আব্বু, আম্মু ও আংকেল আন্টির কথা ভেবে। এজন্যই উনি চোখ বুজে, দাঁতে দাঁত চেপে, হাতের দু মুঠো শক্ত করে নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা করলেন। এর মধ্যে আপু একবার আমার দিকে তাকালো। আপুর চাহনিতে অসহায়ত্ব, রহস্য ও কষ্টের এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখলাম। আমি আপুকে চোখের ইশারায় কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো, এর পূর্বেই আপু দৃষ্টি হটিয়ে নিলো।
আদ্রিশ ভাই এবার পূর্বের তুলনায় যথেষ্ট শান্ত ও ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
” ইমাদ আমাকে এ ব্যাপারে না জানালে তো জানতেই পারতাম না। তুই তো এক ত্যাড়া। তোর বোন তোর চেয়েও দ্বিগুণ ত্যাড়া। ও বিয়ে করে আমাকে মামা বানিয়ে দিলেও আমাকে বলতো না।”
বলেই তিনি ক্রোধাগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। যেনো এক্ষুনি আস্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন আমাকে। এদিকে উনার এহেন চাহনি ও আমাকে নিয়ে শেষোক্ত কথা দুটো শুনে পিত্তি জ্বলে উঠলো আমার। তাই তো উনার কথার বিপরীতে দু চারটা কথা শুনিয়ে দিতে দাঁড়িয়ে গেলাম। কিন্তু এর পূর্বেই আদ্রিশ ভাই দৃষ্টি হটিয়ে ফের আপুর দিকে তাকালেন। আপু এবার চট করে দাঁড়িয়ে গেলো। পূর্বের সেই ভীত-সন্ত্রস্ত ভাবটা কিছুটা কমে এলো। কণ্ঠে সামান্য তেজ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আচ্ছা আদ্রিশ, আমাকে বল। তোকে জানিয়ে আমার লাভটা কি? মিমের লাভটা কি? আব্বু আম্মু ছেলে চুজ করেছিলো। বিয়ে হলে তোকে দাওয়াত দিতাম। বিয়ের দাওয়াত খেয়ে, গিফট দিয়ে চলে যেতি। সেখানে……”

আদ্রিশ ভাই আপুর কথায় অবাক হলেন, অধৈর্য্য হলেন। বোধহয় শরীরের সমস্ত রাগ আপুর উপর নিক্ষেপ করতে পারলে শান্তি পেতেন। কিন্তু তা করতে পারছেন না বলে ইমাদ ভাইকে বললেন,
” দেখ ইমাদ, তোর বউকে চুপ করতে বল। ও কিন্তু বাড়াবাড়ি করছে। ও কি জানে না মিমের বিয়ের কথা আমাকে কেনো জানানো দরকার?”

ইমাদ ভাই শান্ত গলায় আদ্রিশ ভাইয়ের কাঁধে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
” কুল ডাউন আদ্রিশ, কুল ডাউন। এত রাগ করিস না প্লিজ। নাফিসা হয়তো জানে। কিন্তু এখন হয়তো ওর খেয়াল আসছে না। ”

আদ্রিশ ভাই অবাক হয়ে আপুর দিকে আঙুল তাক করে বললেন,
” খেয়াল হচ্ছে না! তুই ওর চেহারার দিকে তাকিয়েছিস? দেখ তো ওর ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন কেমন? এ দেখে কি আদৌ মনে হচ্ছে ও এই ব্যাপারে কিছু জানে না!”

এতক্ষণে আমি ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়েছি। সবাই শুধু ‘এ কথা’, ‘ও কথা’ শিরোনামে কথা বলছে, ঝগড়া করছে। কিন্তু কেউই ‘এ কথা, ও কথা’র প্রকৃত নামটা উচ্চারণ করছে না। এবার আমিই অধৈর্য্য গলায় প্রায় চেচিয়ে উঠে বললাম,
” কি আশ্চর্য! সেই কখন থেকে আমার সামনে, আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছে। এ কথা, ও কথা, এ ব্যাপার, ও ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু কেউই আসল কথাটা উচ্চারণ করছে না কেনো? কি এমন কথা, কি এমন শব্দ এটা যে আমার সামনে উচ্চারণ করা যাচ্ছে না! ”

আমার এ কথার বিপরীতে তিনজনই ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। আচমকা এভাবে ঘাড় ঘুরানোয়, এভাবে তাকানোয় আমি থতমত খেয়ে গেলাম৷ আমতা আমতা করে বললাম,
” কি-কি হলো? এভাবে তাকানোর কি আছে? ভালো প্রশ্নই তো জিজ্ঞেস করেছি আমি। আমাকে যদি কেউ না-ই বলতে চায়, আমি চলে যাই তাহলে। আমার এখানে কোনো কাজ নেই। ”
বলেই আমি তিনজনের মাঝ দিয়ে চলে যেতে নিলাম। কিন্তু দু কদম যেতেই আদ্রিশ ভাই চট করে আমার কব্জি ধরে বললেন,
” চুপচাপ গিয়ে ওখানে বসো। তোমারও ক্লাস নিবো আমি। তোমাকে তো…..”

আদ্রিশ ভাইয়ের বাকি কথাটুকু শেষ হওয়ার পূর্বেই আপু তেড়ে এসে আদ্রিশ ভাইয়ের হাতের বাঁধন হতে আমার হাত আলগা করে দিলো। ক্রোধাগ্নি দৃষ্টিতে আদ্রিশ ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললো,
” কোন সাহসে ওর হাত ধরেছিস আদ্রিশ! এটা ভুলে যাস না, ওর বোন এখানেই আছে কিন্তু!”

আদ্রিশ ভাইয়ের চাহনি মুহূর্তেই বদলে গেলো। সেই তেজি ভাবটুকু হটে গিয়ে ভীত ও অপরাধবোধের খানিক ছায়া দেখা গেলো উনার দৃষ্টিতে। তবুও কণ্ঠস্বরে তেজিয়ান ভাব বজায় রেখেই খানিকটা নমনীয় গলায় বললেন,
” উম, সরি সরি। আসলে এভাবে হাত ধরাটা উচিত হয়নি। ”

আমি এই ফাঁকে তিনজনের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালাম। এ পর্যায়ে আপু ও আদ্রিশ ভাই দুজনেই কিছুটা নমনীয় হলেন। আদ্রিশ ভাই গা ঝেড়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট গোল করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর বললেন,
” দেখ নাফু, তুই মোটামুটি সবকিছুই জানিস। সে’বার তোর কথামতোই আমি মিমের কাছ থেকে ডিস্টেন্স মেইনটেইন করে চলা শুরু করেছিলাম। তাহলে আজ মিমের বিয়ের কথা এতদূর এগিয়ে যাওয়ার পরও আমাকে কেনো জানাসনি? ইমাদ কি তোকে…………
®সারা মেহেক

#চলবে

#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-১৪(দ্বিতীয় অংশ)
#সারা মেহেক

আমি এই ফাঁকে তিনজনের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালাম। এ পর্যায়ে আপু ও আদ্রিশ ভাই দুজনেই কিছুটা নমনীয় হলেন। আদ্রিশ ভাই গা ঝেড়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট গোল করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর বললেন,
” দেখ নাফু, তুই মোটামুটি সবকিছুই জানিস। সে’বার তোর কথামতোই আমি মিমের কাছ থেকে ডিস্টেন্স মেইনটেইন করে চলা শুরু করেছিলাম। তাহলে আজ মিমের বিয়ের কথা এতদূর এগিয়ে যাওয়ার পরও আমাকে কেনো জানাসনি? ইমাদ কি তোকে আমার সম্পর্কে বলেনি পরে?”
বলেই উনি ইমাদ ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ইমাদ ভাই সাথে সাথে আপুর দিকে চেয়ে দ্রুততার সাথে বললো,
” এ্যাই, তোমাকে বলেছি না আদ্রিশের কথা? এরপরও কেনো তুমি বিয়ের কথা বলোনি ওকে? কেনো মিমের বিয়ে আটকাওনি?”

আপু মুহূর্তেই ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো,
” জানি জানি, সব জানি। এখন ওকে জিজ্ঞেস করো যে মিমের প্রতি ফিলিংস থাকার পরও কেনো ও আগে বিয়েতে রাজি হয়েছিলো? ঐ মেয়ে পালিয়ে না গেলে তো ওকেই বিয়ে করতো আদ্রিশ। এর দ্বারা কি প্রমাণিত হয়? এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে মিমের প্রতি ওর ফিলিংস নিয়ে ও নিজেই শিওর না। আর আদৌ কি এখন ফিলিংস আছে কি না কে জানে!”

আপুর এহেন কথা শুনে আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম। নিজের কানে আদৌ কি ঠিক শুনেছি আমি? আমার প্রতি আদ্রিশ ভাইয়ের অনুভূতি! মানে কি এসবের?
আদ্রিশ ভাইও আপুর গলার সুরে সুর মিলিয়ে বললেন,
” সব তোর জন্য হয়েছে। বিয়ে বিয়ে করে আমার মাথা খাচ্ছিলি তুই। শুধুমাত্র তোকে দেখানোর জন্য বিয়ের নাটক করি আমি। ”

আপু আর আমি একত্রে অবাক গলায় বলে উঠলাম,
” নাটক!”

আদ্রিশ ভাই খানিক থতমত খেলেন। অতঃপর উনি ও ইমাদ ভাই একে অপরের মুখের দিকে চাইলেন। দুজনেই একত্রে হেসে বললেন,
” হ্যাঁ নাটক।”

দু বন্ধুর এই কীর্তিকলাপে অবাক চাহনিতে আমরা দু বোন একে অপরের দিকে চাইলাম। আপু আদ্রিশ ভাইয়ের দিকে চেয়ে ক্রোধিত গলায় বললো,
” আদ্রিশ! তুই আমাকে মিথ্যা বলেছিস! আমার সাথে নাটক করেছিস!”

আদ্রিশ ভাই কোনো জবাব দিলেন না। ইমাদ ভাইকে কি কারণে যেনো চোখের ইশারা দিলেন। উনার ইশারায় ইমাদ ভাই সাথে সাথে আপুকে ধরে রুম থেকে বেরুতে বেরুতে বললো,
” তুমি আমার সাথে চলো নাফিসা। আমি সবটা বলছি। ”

ইমাদ ভাইয়ের জোরাজুরিতেও আপু রুম থেকে যেতে রাজি হলো না। উল্টো আদ্রিশ ভাইয়ের দিকে আঙুল তুলে শাসিয়ে বললো,
” এটা কিন্তু ঠিক করিসনি আদ্রিশ। আর আমি রুম থেকে যাবো কেনো!”

ইমাদ ভাই আপুকে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
” আরে! মিম আর আদ্রিশকে একটু স্পেস দাও। একা কথা বলতে দাও। ”

” একা কথা বলতে হবে কেনো?! যা বলবে, আমার সামনেই বলবে। ”

” দেখো নাফিসা, বেশি জিদ করো না! চলো তো। আমরা পরে আসছি। ”
এই বলতে বলতে উনি আপুকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সেই সুযোগে আদ্রিশ ভাইও গিয়ে রুমের দরজা আটকে দিলেন। এতক্ষণ আমি কিছু বলিনি। অন্য সময় হলে আপুর মতে মত মিলিয়ে আমি নিজেই রুম থেকে বেরিয়ে যেতাম। কিন্তু আজ আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। আদ্রিশ ভাইয়ের মিথ্যে নাটক নিয়ে কথা হচ্ছে। আমার সবকিছুর জবাব চাই। একারণেই আমি চুপচাপ রুমে থেকে গিয়েছি। আজ উনার কাছ থেকে প্রতিটা প্রশ্নের জবাব চাইবো।

আদ্রিশ ভাই দরজা আটকে এসেই প্রায় হাঁপিয়ে উঠে আমার সামনে দাঁড়ালেন। বললেন,
” দেখো, মিশমিশ! ইটস হাই টাইম টু টক এবাউট আওয়ার লাইফ।”

আদ্রিশ ভাই যতটা উতলা হয়ে আছেন, আমি ঠিক ততোটাই শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বুকে দু হাত গুঁজলাম। সুস্থির গলায় বললাম,
” জি জি। আমিও সেই অপেক্ষায় আছি! আপনার কাছ থেকে প্রতিটা ঘটনার বিবরণ চাই। প্রতিটা মিথ্যার পিছনে যে সত্য লুকিয়ে আছে তা জানতে চাই। আপনার করা প্রতিটি আচরণের কারণ জানতে চাই। বলুন। ইচ এণ্ড এভ্রিথিং। ”

আদ্রিশ ভাই কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। অতঃপর প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বললেন,
” আচ্ছা, প্রথমেই আমার বিয়ের ব্যাপারটা বলে নেই। ”

” বলুন। ”

” বিয়েটা নাটক ছিলো। ”

” শুনেছি। তারপর? এ নাটকটা করলেন কেনো? শান্তাও কি আপনাদের নাটকের অংশ ছিলো?”

” না৷ ও সত্যিই পালিয়েছে। ”

আমি ভ্রু কুঁচকে অবাক স্বরে শুধালাম,
” মানে! একবার বলছেন নাটক। আবার বলছেন শান্তা পালিয়েছে। ঘটনাটা আসলে কি? কোনটা সত্য?”

” দুটোই সত্য। আমার তরফ থেকে পুরোটা নাটক ছিলো। কিন্তু শান্তার পক্ষ থেকে সবটাই সত্য ছিলো। ”

এবার বিরক্ত নিয়েই বললাম,
” উফ, এভাবে তালগোল পাকাচ্ছেন কেনো আদ্রিশ ভাই! ডিটেইলসে বলুন। ”

” তুমি তো জানোই নাফিসা আমার পিছনে বিয়ের জন্য কীভাবে পড়ে ছিলো। ওকে কতবার বুঝিয়েছি। কিন্তু ও বুঝে না। সরাসরি কখনও আমার অনুভূতির কথা বলিনি। বলতে চাইনি। এজন্যই নানান বাহানায় ওকে বারবার নিষেধ করতাম। কিন্তু তোমার বোন, তোমার মতোই ত্যাড়া কিসিমের। ”
এটুকু শুনে আমি সরু চোখে কটমট করে তাকালাম। তাতে আদ্রিশ ভাই থোরাই কেয়ার করলেন! উল্টো বললেন,
” ওভাবে তাকিও না। সত্যি বলেছি। বাকি ঘটনাটা শুনো। ”

” আচ্ছা বলুন।”

” বিয়ের জন্য নাফিসা অনেক মেয়ে দেখাতো। কিন্তু আমি রাজি হতাম না। শেষমেশ ও আমাদের বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে শান্তার সাথে দেখা করতে রাজি করালো। আমিও অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেখা করলাম। এবং ঐ দিনই শান্তা ওর বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে আমাকে জানালো। বললো ওর বাসা থেকে ওর বয়ফ্রেন্ডকে মেনে নিচ্ছে না। কারণ ওর বয়ফ্রেন্ড ভালো জব করতো না। ওর বাবা মা’কে অনেকভাবে বুঝিয়েছিলো। নিজের জিদে অটল ছিলো। এজন্য কম মা’ র খায়নি ও। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলো যে ছেলেই ওকে দেখতে আসবে তাকে সবকিছু বলবে। আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে শান্তার সাথে আমার দেখা হলো। ভাগ্যক্রমে আমার লটারি লেগে গেলো। ও নিজের দিকটা বললো। আমিও নিজের দিকটা বললাম। তারপর দুজন সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের কথা হলুদ পর্যন্ত এগুবে। ঐদিনই আমি ওকে পালাতে সাহায্য করবো। এতে ও ওর বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করতে পারবে। আমিও বিয়ে বিয়ে ঘ্যানরঘ্যানর থেকে মুক্তি পাবো। সত্যিই তাই হলো। ”
বলেই আদ্রিশ ভাই লম্বা শ্বাস ফেললেন। উনার এ মস্ত বড় প্ল্যানের এ টু জেড ঘটনা শুনে আমি তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবতেও পারিনি উনি আড়ালে আড়ালে এত বড় প্ল্যান এঁটেছিলেন। আমি বিস্ময় নিয়ে শুধালাম,
” এই সবকিছু আপনি একা করেছেন! মানে আপনার প্ল্যানিং ছিলো এগুলো?”

আমার প্রশ্ন শুনে আদ্রিশ ভাইয়ের চাহনিতে অপরাধবোধের রেশ আশা করলেও তা পেলাম না। বরং উল্টো উনি বেশ গর্বিত হয়ে বললেন,
” হ্যাঁ মেইন প্ল্যান তো আমারই ছিলো। পাশাপাশি ইমাদও আমার হেল্প করেছে।”

” ইমাদ ভাই! উনি আপনার হেল্প করেছে! নিজের সাথে সাথে ঐ ভোলা ভালা লোকটাকেও নষ্ট করছেন। ”

আদ্রিশ ভাই সরু চোখে চেয়ে বললেন,
” কিসের ভোলা ভালা। ওকে তুমি চিনো! মিচকা শয়তান একটা। ”

” আচ্ছা! এত কিছু প্ল্যানিং করলেন,নিজের নিয়ে চিন্তা করলেন,কিন্তু একবারও আংকেল আন্টির কথা চিন্তা করলেন না। ছেলের বিয়ে ভেঙে গেলে যে উনারা কত কষ্ট পাবে, এটা ভাবেননি একবারও!”

এ পর্যায়ে উনার চাহনিতে কিঞ্চিৎ অপরাধবোধের ছায়া পেলাম। বললেন,
” সত্যি বলতে আমি অতদূর ভাবিনি। চিন্তা করিনি যে আব্বুর এ অবস্থা হবে। ভেবেছিলাম সর্বোচ্চ টেনশন করতে পারে। সেটাও আবার ২/৩দিন পর্যন্ত। কিন্তু আব্বু যে এভাবে স্ট্রোক করে বসবে এটা কল্পনাও করিনি। আসলে ঐ সময়ে আমি বড্ড স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে নিয়ে ভাবছিলাম। তোমাকে নিয়ে ভাবছিলাম। ”

পুরো কথাটুকু মনোযোগ দিয়ে শুনলেও উনার শেষোক্ত কথায় অপ্রস্তুত হলাম। মুহূর্তেই দৃষ্টি হটিয়ে আশপাশ দেখতে লাগলাম, যেনো এই পরিস্থিতিটুকু দ্রুত কেটে যায়। এদিকে আমি অপ্রস্তুত হলেও আদ্রিশ ভাই মোটেও অপ্রস্তুত হলেন না। যেনো উনি ইচ্ছে করেই আমাকে এই পরিস্থিতিতে ফেলতে এমনটা বলেছেন। উপরন্তু উনি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েও আছেন। সরাসরি না দেখতে পেলেও একজন মেয়ে হিসেবে আমার সিক্সথ সেন্স বললো আদ্রিশ ভাই নিষ্পলক আমাকে দেখে যাচ্ছেন। এই বোধ হতে আমার ভেতরকার অস্বস্তি বোধটুকু তীব্র হলো। উনার থেকে দু কদম পিছিয়ে দাঁড়ালাম। কয়েক সেকেন্ড বাদে উনি ঈষৎ গমগমে গলায় শুধালেন,
” বাকি ঘটনাগুলো শুনবে না? শুনবে না আমি কেনো তোমাকে নিয়ে ভেবেছিলাম তখন?”

আমার স্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন আকস্মিকভাবেই অস্বাভাবিক হয়ে পড়লো। আমি স্পষ্টত নিজের হৃৎস্পন্দন নিজ কানে শুনতে পেলাম। বুকের ভেতরের এ তোলপাড়,এ অস্বস্তিবোধটুকু কাটাতে আঙুল দিয়ে ওড়না খুটতে শুরু করলাম। এভাবে আদ্রিশ ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। আরেকটু হলেই বোধহয় আমি মাত্রাতিরিক্ত হৃৎস্পন্দনে অজ্ঞান হয়ে পড়বো। তাই আগাম ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কোনো প্রকার কথাবার্তা ছাড়াই আমি এক ছুটে আপুর রুমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

এখানে দাঁড়িয়েও শান্তি পেলাম না। কেননা কয়েক সেকেন্ডের মাঝে আদ্রিশ ভাইও বারান্দায় চলে এলেন। দাঁড়ালেন ঠিক আমার পিছনে, বোধহয় দেয়ালে হেলান দিয়ে। আমার ভেতরকার তোলপাড় তখনও চলমান। মন বলছে, এক্ষুনি আদ্রিশ ভাইকে পেরিয়ে রুম থেকে চলে যাই। কিন্তু আমার যে সবকিছুর জবাব লাগবে! অথচ সেই সবকিছুর জবাব শোনার মতো শক্তিটুকুও আমার নেই। কি এক দুর্বল হৃদয় নিয়ে আমার বসবাস,উফ!
এভাবে অস্থিরতার মাঝে আর থাকতে পারছি না। বড় বড় শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার পূর্ন চেষ্টা চালাচ্ছি। ওদিকে আদ্রিশ ভাই একটা কথাও বলছেন না। সেই যে আমার পিছে এসে দাঁড়িয়েছেন, এখন পর্যন্ত একটা শব্দও বের করেননি মুখ দিয়ে। উনি কি আমার পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন না? বুঝতে পারছেন না উনার ঐ সামান্য কথাটুকুতেই আমি বেহাল দশায় এসে পড়েছি! তাই তো এ পরিস্থিতি থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে বেশ সাহস সঞ্চার করে বললাম,
” আপনার কি আর কিছু বলার নেই?”

আদ্রিশ ভাই সশব্দে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” বলার মতো তো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু তোমার শোনার মতো ক্ষমতা নেই মিশমিশ। ”

নিজের অপারগতা লুকাতে কণ্ঠে মিছে জোর দিয়ে বললাম,
” কে- কে বলেছে এ কথা! কে বলেছে আমার শোনার মতো ক্ষমতা নেই! ”

আদ্রিশ ভাই তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন। বললেন,
” কেউ বলেনি তো! তুমি নিজেই বলছো৷ তোমার কাঁপা গলার স্বরই বলে দিচ্ছে তোমার অ্যাবিলিটি কতটুকু। এই সামান্য কথায় যদি এ অবস্থা হয়, বাকি কথাগুলো বললে কি হবে শুনি!”

উফ, এভাবে নিজের অপমান মেনে নেয়া যাচ্ছে না। তীব্র অস্বস্তি ও অস্থিরতা নিয়েই চট করে ঘুরে উনার দিকে তাকালাম। সমস্ত সাহস সঞ্চার করে আদ্রিশ ভাইয়ের দৃষ্টি বরাবর চাইলাম। উনি এ মুহূর্তে বারান্দার দরজার সাথে বাহু ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ঠোঁটের কোনে বিশ্বজয়ী এক হাসি। আমাকে বিপাকে ফেলে বিজয়ীর হাসি।

কণ্ঠে কম্পিত ভাব আনতে না চাইলেও ঠিকই কথা বলার সময় আমার গলার স্বর কেঁপে উঠলো। মেকি সাহস নিয়ে বললাম,
” ক-কিছুই হবে না। কি হবে হ্যাঁ! আপনি বলুন। আমার কিছুই হবে না।”

আদ্রিশ ভাই ভ্রু তুলে নিচের ঠোঁট উল্টে বললেন,
” বাহ! ব্রেভ গার্ল! ভালো কনফিডেন্স। সত্যিই কিছু হবে না তো? ”

আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে বললাম,
” না। কিছুই হবে না। ”

” সত্যি কিছু হবে না মিশমিশ?”
বলেই তিনি আচমকা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। এবং আকস্মিকভাবে আমার দিকে ধীর পায়ে এগুতে লাগলেন। উনার চাহনি এমন যে শুধু ঐ গভীর চোখ দুটো দিয়েই আমার ভেতরে উথাল-পাথাল করে দিবে সবকিছু। উনার ঠোঁটের কোনেও মৃদু বক্র হাসি। আদ্রিশ ভাইয়ের এহেন রূপ দেখে আমি আর সাহস সঞ্চার করতে না পারলেও সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম শক্ত থাকার। সর্বোচ্চ জোর দিয়ে বললাম,
” কিছুই হবে না। ”

” সত্যি কিছু হবে না?”
বলতে বলতে উনি আমার দিকে এগুচ্ছেন। আমিও উনার বিপরীতে পিছিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু খুব বেশি পিছিয়ে যেতে পারলাম না। চার কদম গিয়েই আমার পিঠ গিয়ে ঠেকলো বারান্দার গ্রিলে। কেননা বারান্দার প্রস্থ কম।
এদিকে আমার কদম থমকে গেলেও আদ্রিশ ভাইয়ের কদম চলমান। উনার ঐ নির্বিঘ্ন চাহনি দিয়ে উনি এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। এ মুহূর্তে আমার চলে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও কোনো এক অদৃশ্য শক্তিতে যেনো আমি স্থির হয়ে রইলাম। পা দুটো অচল হয়ে সেখানেই থমকে রইলো। এ পর্যায়ে আদ্রিশ ভাই আমার অনেকটা কাছে এসে দাঁড়ালেন। উনার দিকে তাকিয়ে থাকার সমস্ত সাহসটুকু এবার নিঃশেষ হয়ে গেলো। উনি আমার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আচমকা নিজের ঠোঁটদুটো প্রায় আমার কানের কাছে নিয়ে এলেন। অতঃপর রাশভরী গলায় ধীর স্বরে বললেন,
” যদি বলি আমাকে নিয়ে অনুভব করা তোমার প্রতিটা কথা আমার জানা আছে? যদি বলি আমাকে নিয়ে লেখা তোমার প্রতিটা বাক্য আমার পড়া আছে?”
®সারা মেহেক

#চলবে