#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-১৬
#সারা মেহেক
” মিশমিশ। আই এম এক্সট্রিমলি সরি……..”
উনার এ ডাকে পিছন ফিরতেই বিস্ময়ে আমার চোখ বড় হয়ে এলো। কেননা উনি সত্যই দু হাঁটু ভেঙে বসে পরেছেন। হাত দুটো হাঁটুতে স্থির, দৃষ্টি নমিত, মাথা নত। সবার সামনে। এতগুলো মানুষের সামনে আদ্রিশ ভাই হাঁটু গেঁড়ে আমাকে সরি বলছেন!
আমি চরম বিস্ময়ে আদ্রিশ ভাইয়ের দিকে চেয়ে আছি। আর রেস্টুরেন্টের মানুষগুলো আমাদের দিকে। তারাও ভারী বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসু চাহনিতে আমাদের দেখছে। আদ্রিশ ভাইকে সরি বলার জন্য অতোটা গুরুত্ব না দিলেও উনি যে সত্যি সত্যি এভাবে সরি বলে বসবে তা আমার জন্য কল্পনাতীত ছিলো। আমি ক্ষণিকের জন্য নিজের করণীয় ভুলে গেলাম। তবে বোধ হতেই রেস্টুরেন্টের এতগুলো মানুষের দৃষ্টির সীমানায় পড়ে ভীষণ লজ্জাবোধ জাগ্রত হলো। মুহূর্তেই আদ্রিশ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। সামান্য ঝুঁকে বললাম,
” আপনি উঠুন আদ্রিশ ভাই। বসে কথা বলছি।”
আদ্রিশ ভাই দৃষ্টি তুলে চাইলো। জেদি সুরে বললো,
” উঁহু। আগে আমাকে ক্ষমা করবে তারপর উঠবো।”
” আচ্ছা আপনি আগে উঠে বসুন তো। তারপর বলছি। রেস্টুরেন্টের সবাই দেখছে। ”
আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাই রেস্টুরেন্টটায় একবার দৃষ্টি ঘুরালেন৷ অতঃপর বললেন,
” দেখলে দেখুক। তুমি তো এটাই চাইছিলে তাই না?”
আমি এবার একটু বিরক্তই হলাম। গলায় জোর দিয়ে কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে বললাম,
” আমি তো আর জানি না যে আপনি সত্যিই আমার কথা শুনে বসবেন!”
আদ্রিশ ভাই ঈষৎ বক্র হাসি দিলেন। বললেন,
” তুমি একটা আবদার করবে আর তা আমি শুনবো না, তা তো হতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি ক্ষমা পাবো না ততক্ষণ এভাবেই থাকবো। বলো, আমায় মাফ করেছো মিশমিশ?”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বিব্রত চাহনিতে একবার সবাইকে দেখলাম। অতঃপর ফের আদ্রিশ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি ওষ্ঠজুড়ে বিস্তৃত হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
” কি হলো? মাফ করবে না আমায়? নাকি আজ সারাদিন এভাবেই বসিয়ে রাখবে? ”
আমি এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালাম৷ খানিক ভ্রু কুঁচকে বললাম,
” আচ্ছা যান, মাফ করেছি আপনাকে। ”
আদ্রিশ ভাই ক্ষণেই এক গাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ ফের জিজ্ঞেস করলেন,
” আর বিয়ের জন্য? বিয়ের জন্য রাজি তো?”
” ওটা নিয়ে একটু ভাবতে হবে। ”
আমার এ কথা শোনা মাত্রই আদ্রিশ ভাই গাল ফুলিয়ে পূর্বের অবস্থানে ফেরত যেতে যেতে বললেন,
” আবার ভাবতে হবে! তুমি রাজি হচ্ছো নাকি আবারও সবার সামনে হাঁটু ভেঙে বসবো?”
বলতে বলতেই উনি প্রায় মেঝে স্পর্শ করে ফেললেন। এবার ভয় ও লজ্জায় আমি দ্রুত উনার হাত চেপে ধরলাম। চোখেমুখে অনুনয়ের ভাব ফুটিয়ে তুলে বললাম,
” প্লিজ, প্লিজ, আর না। একটা আবদার করে যথেষ্ট ভুল করে ফেলেছি। আর না। ”
আদ্রিশ ভাই হাসলেন। বাচ্চারা দুষ্টুমি করে কোনো কিছু হাসিল করলে যেমন করে হাসে, ঠিক তেমনিই হাসলেন উনি। চোখজোড়ায় আদুরে ভাব ফুটিয়ে বললেন,
” তাহলে বিয়ের জন্য রাজি তো?”
আমি এই ‘বড় বাচ্চা’র আবদার ও অনুনয়ের কাছে হার মানলাম। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
” হ্যাঁ রাজি।”
এরপর আদ্রিশ ভাইয়ের খুশি দেখে কে! পারে না আমাকে কোলে নিয়ে নাচতে! আমি সরু চোখে উনার দিকে তাকালাম। কি খুশি উনি! বেশ উৎফুল্ল গলায় বললেন,
” আজই আব্বু আম্মুকে তোমাদের বাসায় পাঠাবো, বিয়ের ডেট ঠিক করাতে। ”
আমি শুধু সরু দৃষ্টিতে উনাকে দেখলাম। কিছুই বললাম না। ব্যাটা এখন বিয়ের জন্য লাফাচ্ছে। অথচ আজ কতগুলো বছর আমাকে কষ্ট দিয়েছে উনি! সমস্যা নেই। বিয়েটা হয়ে নিক। বিয়ের পর সব সুদে আসলে উসুল করবো। তখন বুঝবে আমাকে কষ্ট দেয়ার ঠ্যালা।
আদ্রিশ ভাই উনার বাসায় ফোন করে সব জানালেন। আংকেল কাল সন্ধ্যার সময় ফিক্সড করলেন। আদ্রিশ ভাই ফোন রেখে হঠাৎ করেই উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,
” ওয়েট আ মিনিট। আমরা একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছি। ”
আমি জিজ্ঞাসু চাহনিতে চেয়ে বললাম,
” কি?”
” যে ছেলেটা তোমাকে দেখতে এসেছিলো, ওর নাম কি?”
” রাফিদ। কেনো কি হয়েছে?”
মুহূর্তেই আদ্রিশ ভাই সরু চোখে চেয়ে সন্দিহান গলায় শুধালেন,
” ও তোমাকে পছন্দ-টছন্দ করেনি তো?”
এ পর্যায়ে আমার দুষ্টু মনে দুষ্টুমি উদয় হলো। আদ্রিশ ভাইকে জ্বালানোর জন্য বেশ ভাব নিয়ে বললাম,
” করেছে তো! আপনি জানেন না?”
আদ্রিশ ভাইয়ের চাহনি পরিবর্তন হলো। চোখেমুখে গাম্ভীর্যতা ফুটে উঠলো। চোয়াল দুটো কিঞ্চিৎ শক্তও হলো। দৃষ্টিজোড়া কঠিন করে জিজ্ঞেস করলো,
” সত্যি বলছো নাকি মজা করছো?”
আমি উনার হাবভাব বুঝলাম। এমন মানুষকে রাগিয়ে বেশ মজা পাওয়া যায়। তাদেরকে তিল বললে তারা তাল বানিয়ে নিজের ক্রোধের পারদ সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছিয়ে দেয়। আদ্রিশ ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তাই হলো। উনিও ভেতরে ভেতরে ফুলছেন। উনাকে আরেকটু ফুলাতে হবে। তবেই না মজা পাওয়া যাবে! এবার বললাম,
” আচ্ছা, মজা করবো কেনো বলুন তো? ছেলে দেখতে এসেছে আমাকে। পছন্দ করে যাবে কোথায়? আমি কি কম সুন্দরী নাকি?”
আদ্রিশ ভাই ফুলছেন। রাগে ক্ষোভে বেশ ভালোমতোই ফুলছেন। হাতের মুঠো শক্ত করে পূর্বের ন্যায় জিজ্ঞেস করলেন,
” অনেক সেজেগুজে গিয়েছিলে নাকি ঐ ছেলের সামনে?”
” যতটুকু দরকার ততটুকুই সেজে গিয়েছিলাম। রাফিদ আমাকে ওমন দেখেই পছন্দ করেছে। উনি আমার আসল সৌন্দর্য দেখেছে। নাহলে আজকালকার মানুষ এসব দেখে নাকি! দেখলে কিছু মানুষ কয়েক বছর আগে আমার সাথে ওমন করতে পারতো নাকি! আর এত বছর ধরে আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকতো নাকি!”
আদ্রিশ ভাই ঢের বুঝতে পারলেন, শেষের কথাগুলো আমি উনার উদ্দেশ্যেই বলেছি। উনি কিছু বললেন না। তবে কঠিন দৃষ্টিতেই আমার দিকে চেয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। অতঃপর বললেন,
” আজকের দিনটার হিসাব পরে করবো আমি। ”
” হিসাব? কিসের হিসাবের কথা বলছেন?”
” কিসের হিসাবের কথা বলছি তা তুমিও জানো মিশমিশ, আমিও জানি। সো বি রেডি ফর ইট।”
আমি কিছু বলতে যাবো, এর পূর্বেই আদ্রিশ ভাই ওয়েটারকে ডেকে বিল দিতে বললেন। আমি এদিকে একটু দুশ্চিন্তায়ই পড়ে গেলাম। ব্যাটার মাথা বোধহয় এবার একটু বেশিই গরম হয়ে গিয়েছে। উনাকে খোঁচা দিয়ে কাজটা ভুল করলাম নাকি ঠিক করলাম বুঝতে পারলাম না।
————————–
সন্ধ্যায় আপু বাসায় এলো। গতকাল থেকে আমি আপুর সাথে এক বাক্যও কথা বলিনি। আপু আব্বু, আম্মু, আভা এমনকি ইমাদ ভাইয়ের মাধ্যমেও আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি বলিনি। আপুর সব রকমের ম্যাসেজ, ফোন কল ইগনোর করেছি। আমার অতীত এবং বর্তমানের ভোগান্তির প্রায় ৮০% দায়ভার আপুর উপরই পড়ে। আপুর অতিরিক্ত বুঝের জন্যই আমার কতগুলো দিন নষ্ট হয়েছে! কত রাত আমি কেঁদেছি! কিন্তু আপু কি বুঝে ওমনটা করেছিলো জানা নেই আমার। তবে জানবার ভীষণ ইচ্ছে। কিন্তু এখন নয়। এখন আপুর সাথে কথা বলার মুড নেই আমার। যতবার আপুর কথা মনে পড়ে, ততবারই আদ্রিশ ভাইয়ের করা ঐ ব্যবহারগুলোর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে আমার কিশোরী মনের আঘাতের কথা। এই বয়সে এসে হয়তো এমন কিছুর সম্মুখীন হলে আজকের আমিটা শক্ত থাকতে পারতাম। নিজেকে বুঝ দিতে পারতাম। কিন্তু কিশোরী বয়সের আমিটাকে ঐ সময়ে কিছুতেই বুঝ দিতে পারিনি। অতিরিক্ত আবেগে আবেগী হয়ে পড়েছিলাম। ক্রাশের একটুখানি অবহেলাই তখন অনেক বড় কিছু মনে হয়েছিলো। অথচ এখন আদ্রিশ ভাই ওমন ব্যবহার করলে বোধহয় আমি উনাকে পাত্তাই দিতাম না! কান্না করা তো দূরের কথা।
আমি রুমে বসে পড়ছি। বিগত ক’টা দিন ধরে নানান বাহানায় পড়া হয়নি। ফলস্বরূপ অনেকগুলো আইটেম পেন্ডিং পড়ে গিয়েছে। এসব ঝামেলা মিটে গেলে আমি একনাগারে আইটেম দেয়া শুরু করবো। তাই সেটারই প্রিপারেশন নিচ্ছি।
আমার পড়ার মাঝেই হঠাৎ আপু রুমে ঢুকলো। ঢুকেই প্রায় ধমকের সুরে বললো,
” কি রে মিম! কি হয়েছে তোর! আমার সাথে কথা বলছিস না কেনো?”
আমি আপুকে উপেক্ষা করে বললাম,
” ‘কেনো’র উত্তর তোমার জানা আছে আপু। ”
” আদ্রিশের কারণে?”
” আদ্রিশ ভাইয়ের কারণে হতে যাবে কেনো? যা হচ্ছে সব তোমার কারণেই হচ্ছে। তুমিই দায়ী আপু।”
আপুর চাহনি এবার একটু নরম হলো। চেহারায় অনুনয় ফুটে উঠলো। বললো,
” আমি তোর ভালোর জন্যই করেছিলাম মিম। ”
আমার মেজাজ এবার চট করে গরম হয়ে এলো। গলার স্বর উঁচু করে বললাম,
” ভালোর জন্য! কোনদিক দিয়ে ভালোর জন্য করেছিলে আপু? আমার ভালোর জন্য করলে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলতে পারতে। কিন্তু তা না করে আদ্রিশ ভাইয়ের মাধ্যে আমাকে কষ্ট দিয়ে আমার ভালো চিন্তা করছো! হাসালে আপু আমাকে। ”
আপু দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। তার দৃষ্টিজোড়া ছলছল করছে। অন্য সময় হলে এর আগেই আপুর কাছে গলে যেতাম আমি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। আপু নিজের ভুল তো বুঝছেই না, উল্টা ভুলটা অস্বীকার করছে। কিন্তু এবার অন্তত আপুর ভুলটা স্বীকার করা উচিত। স্বীকার করা উচিত যে আমার সাথে তখন যা করেছিলো ভুল করেছিলো। আমার ভালো’র জন্য কিছু করেনি।
আপু এবার দৃষ্টি তুলে আমার দিকে চাইলো। সিক্ত গলায় বললো,
” তুই কেনো বুঝছিস না মিম? আমি তোর বড় বোন। সবসময় তোর ভালো চাই। ঐদিনও তোর ভালো চেয়েছিলাম৷ তুই যেনো ভুলপথে…….”
®সারা মেহেক
#চলবে,,