অলকানন্দা ও তিতলি পর্ব-১৯

0
13

#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-১৯
#সারা মেহেক

অদ্ভুত ও তীরের মতো তীক্ষ্ণ চাহনিতে আমার দিকে চাইলেন। বা চোখের ভ্র উঁচিয়ে আমাকে নিজের কাছে আরোও টেনে নিয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে ভারী গলায় শুধালেন,
” কি? এত দ্রুত সব তেজ শেষ? আমার কাছে এলেই সিংহী থেকে ভেজা বেড়াল হয়ে যাও কেনো? ”

আমি কিছু বলতে উদ্যত হলাম। কিন্তু গলা দিয়ে একটি শব্দও বেরুলো না। আদ্রিশ ভাই কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। অতঃপর আচমকা উনার বাঁধন হতে আমাকে আলগা করলেন। আমি কয়েক কদম দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। দৃষ্টিজোড়া নত। আদ্রিশ ভাই বললেন,
” সরি ফর দিস। ”

আমি মাথা তুলে তাকালাম উনার দিকে। কিসের জন্য সরি বলছেন বুঝতে খানিকটা কষ্ট হলো৷ উনি মৃদু হেসে আঙুলের ইশারায় কিছুক্ষণ পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বললেন। আমি নিরুত্তর চাহনিতে চেয়ে রইলাম উনার দিকে।
আদ্রিশ ভাই এবার লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। দেয়ালে হেলান দিয়ে দু হাত বুকে গুঁজলেন। বললেন,
” আমি সত্যিই জানতাম না আব্বু এমন কাজ করে বসবে। আমি বাসা থেকে বের হওয়ার আগে জানতে পেরেছি যে আজই আব্বু বিয়ে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনকি আংকেলকেও জানায়নি। আই নো, আব্বু একা এ ডিসিশনটা নিয়ে মস্ত বড় ভুল করেছে। কিন্তু যখন আমি জানতে পেরেছি তখন আসলে করার কিছুই ছিলো না৷ আব্বুকে বেশ কয়েকবার বলেছি আজ যেনো বিয়েটা না হয়। তোমার কথাও বলেছি। কিন্তু আব্বু শুনেনি। আংকেলকে বলেছে আমাদের রওনা দেয়ার পর। আংকেল নিজেও অবাক হয়ে যায় আব্বুর সিদ্ধান্তে৷ কিন্তু শুধু এঙ্গেজমেন্টের বদলে বিয়ের মাধ্যমে আমাদের সম্পর্কের পূর্ণতার ব্যাপারে বুঝানোর পর আংকেলও রাজি হয়ে যায়। আর তোমাকে আমি এ নিয়ে ম্যাসেজও করেছি। দেখোনি? প্রথমে ম্যাসেঞ্জারে নক করেছি। তারপর ফোনও করেছি। কিন্তু ফোনও যখন উঠালে না তখন আবার ফোনে ম্যাসেজ দিয়েছি। সেটাও দেখোনি নিশ্চয়ই? ”

আমি মৃদু তালে মাথা দোলালাম। আদ্রিশ ভাই ফের বললেন,
” নাফিসাকেও যে বলবো তোমাকে জানাতে সে সুযোগ পাইনি। আমার কাজিনরা এমনভাবে হৈ-হুল্লোড় শুরু করলো!”
বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন৷ অতঃপর আমার চোখে চোখ রেখে বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন,
” আমার হাতে এসবের নিয়ন্ত্রণ থাকলে, বিশ্বাস করো, কখনই বিয়ের উদ্দেশ্যে আসতাম না৷ আমি তোমার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করতে চাই না মিশমিশ। তোমার পূর্ণ মতামত নিয়ে, রাজি-খুশি থাকলে তবেই কবুল বলবো আমি।”

আমার দু চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলো। কিন্তু আমি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। প্রচণ্ড মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিলো। কেননা এমন হুটহাট বিয়ে আমার চরম অপছন্দের লিস্টে। বিয়ে হবে রয়েসয়ে। আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমে বিয়ে হবে। এমন আচমকা বিয়ে হওয়াটা আমি কখনো প্রসেস করতে পারি না৷ অনুভূতিরা সব দলা পাকিয়ে আসে। হ্যাঁ, আমি আদ্রিশ ভাইকে ভালোবাসি। কিন্তু কখনও এমন হঠাৎ বিয়ে চাইনি। আমার যেসব বান্ধবীদের এমন দেখতে এসে বা আংটি পরানোর কথা বলে বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলো তাদেরকে নাক সিঁটকে বলেছিলাম, ‘তোরা রাজি হলি কি করে? আমি হলে জীবনেও রাজি হতাম না। তোরা দেখে নিস আমি এমন হুটহাট বিয়ে করবো না৷’ অথচ আজ কি না আমার সাথেই এমনটা হচ্ছে!

আদ্রিশ ভাই ব্যথিত চাহনিতে আমার দিকে চাইলেন৷ মুষড়ে পড়া গলায় বললেন,
” তুমি যদি বিয়েটা না করতে চাও তাহলে নির্দ্বিধায় বলতে পারো আমাকে। আমি গিয়ে আব্বুকে বুঝাবো৷ ”

আমি তৎক্ষনাৎ জবাব দিলাম না। মেঝেতে চেয়ে রইলাম নির্নিমেষ। আদ্রিশ ভাই আচমকা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। বললেন,
” আচ্ছা, আমি গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি। বিয়েটা আজ হবে না। কাজী সাহেবকে বিদায় করে দিয়ে আসি।”
বলেই আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলেন। মুহূর্তেই আমি উনার কব্জি চেপে ধরলাম৷ দৃষ্টি তুলে ঠিক উনার করুণামশ দৃষ্টিজোড়ার দিকে চেয়ে বললাম,
” দাঁড়ান! কাউকে বিদায় করতে হবে না। আমি এ বিয়েতে রাজি। আজই বিয়ে করবো। ”

মুহূর্তেই আদ্রিশ ভাইয়ের দু চোখ খুশিতে ছলছল করে উঠলো। ওষ্ঠজুড়ে বিস্তৃত হাসির দেখা মিললো। উনার হাসির প্রত্যুত্তরে আমিও মৃদু হাসলাম৷ অতঃপর উনার কব্জি ছেড়ে বললাম,
” যাবার আগে শুনবেন না কেনো আমি হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে ওমন রিয়্যাক্ট করেছিলাম?”

আদ্রিশ ভাই জিজ্ঞাসু চাহনিতে চাইলেন। বললেন,
” কেনো? ”

আমি নিরুত্তর বিছানায় গিয়ে বসলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
” বিয়ে একটা মেয়ের জীবনের সবচেয়ে কঠিন একটা মুহূর্ত। হোক সে তার সবচেয়ে পছন্দের মানুষটা। তবুও একটা মেয়ে কবুল বলার পূর্বে, কাবিননামায় সই করার পূর্বে কাঁদবে, থমকাবে। কেননা এই একটা সইয়ের মাধ্যমে সে তার বাবা, মা, ভাই, বোন থেকে চিরতরে দূরে সরে যাবে। যে যতই বলুক না কেনো, এটা সত্য যে বিয়ের মাধ্যমেই মেয়েরা তার বাবা মায়ের থেকে দূরে সরে যায়। জন্ম থেকে আপন মানুষ নামে চিনে আসা মানুষগুলোও তখন পর হয়ে যায়। সে নতুন এক দুনিয়ায় পা রাখে। নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হয়। এসব একটা মেয়ের জন্য মোটেও সহজ নয় আদ্রিশ ভাই। শ্বশুরবাড়ি গেলে মেয়েটাকে সবার মন জুগিয়ে চলতে হয়। নতুন নতুন নানান দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। আমি এসবের ভয়েই ছিলাম। ইভেন এখনও আছি। আমি মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড না ছিলাম না আদ্রিশ ভাই। এত বড় সিদ্ধান্ত হুট করে শুনলে যে কারোর মাথা খারাপ হয়ে যাবে। কেননা আমি পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই কাবিন নামায় সই করতে চেয়েছি, যেনো আমার কষ্টটা কম হয়। ঐ মুহূর্তের কথা যখনই ভাবি, তখনই মনে হয় আমি সই করার আগেই কান্না করতে করতে মরে যাবো৷ আমি যে আমার আব্বু আম্মু আর আভাকে ছেড়ে চলে যাবো এসব ভাবতেই আমার বুকটা ভার হয়ে আসে। আমি আর কিছুই ভাবতে পারি না। এই ভয়েই আমি আসলে আমি এতোটা হাইপার হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে ভুল বুঝবেন না আদ্রিশ ভাই। আমার আসলে কিছু সময়ের দরকার ছিলো, নিজেকে সামাল দেয়ার জন্য। কিন্তু…….. ”
বলতে বলতে আমার দু চোখ বেয়ে অঝোরে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। আদ্রিশ ভাই ক্ষণেই দু হাঁটু গেঁড়ে আমার সামনে বসে পড়লেন। আমার থুতনি তুলে পরম মমতায় দু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের পানিগুলো মুছে দিলেন। সান্ত্বনার সুরে বললেন,
” কান্না করো না মিশমিশ। তোমার কান্না দেখলে আমার বুকে অসহ্য ব্যাথা হয়। বুকটা ভার হয়ে আসে। মনে হয় এই বুঝি চিৎপটাং হয়ে যাবো৷ ”

আদ্রিশ ভাইয়ের কথায় আমি কান্নার মাঝেও মৃদুস্বরে হেসে দিলাম। উনিও হাসলেন। অতঃপর বললেন,
” আমি জানি, একটা ছেলের জীবনে বিয়ে যতটা না প্রভাব ফেলে তার চেয়ে দ্বিগুণ, উঁহু, বহুগুণ প্রভাব ফেলে মেয়ের জীবনে৷ মেয়েটা তার চিরপরিচিত মানুষগুলো ছেড়ে হুট করে নতুন মানুষদের সাথে থাকতে শুরু করে। মেন্টালি যেকোনো মেয়েই বিয়ের পর বেশি প্রেশারাইসড হয়৷ তোমার এমনটা ভাবা অস্বাভাবিক কিছু না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিয়েটা আজ হবে না৷ আজ শুধু আংটি পরিয়ে রাখবো তোমাকে। আমি এ সিদ্ধান্তটা সবাইকে জানিয়ে আসি। তুমি ততক্ষণে মুখটা ধুয়ে হালকা একটু সাজ দাও। ”
বলেই উনি উঠে যেতে নিলেন। কিন্তু আমি মুহূর্তেই উনাকে বাধা দিয়ে বললাম,
” মোটেও না। বিয়ে আজই হবে। ”

আদ্রিশ ভাই আমার কথায় কিঞ্চিৎ অবাক হলেন। বললেন,
” কিন্তু তুমি…..”

” আমি কি? এ সিদ্ধান্তটা আমাদের বড়রা নিয়েছে আদ্রিশ ভাই। তাদের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কি আমরা সুখী হতে পারবো? আর শুভ কাজে দেরি করতে নেই তাই না? তাই সবার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আজই বিয়ে হবে। ”

” কিন্তু মিশমিশ, তুমি প্রিপেয়ার্ড না। তোমার…..”

আমি আশ্বাসের সুরে বললাম,
” হুম। প্রিপেয়ার্ড না। কিন্তু এতক্ষণে প্রিপেয়ার্ড হয়ে গিয়েছি।”
বলেই হেসে ফেললাম৷
” আমি জানি ঐ সময়টা ভীষণ কষ্ট হবে আমার। কিন্তু কবুল বলা শেষেই আপনি আমাকে সামলে নিবেন। কি সামলে নিবেন তো?”

আদ্রিশ ভাই অত্যুজ্জ্বল হাসলেন। আমার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে আশ্বস্ত করে বললেন,
” আমি সবসময় তোমাকে সামলে রাখবো মিশমিশ। তুমি নিশ্চিন্তে কবুল বলবে। কারণ ঠিক ঐ মুহূর্তেই তুমি আমাকে তোমার পাশে পাবে৷ ”

আমি মৃদু হাসলাম। হঠাৎ অকপটে বলে ফেললাম,
” আর বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। কেননা আপনাকে জড়িয়ে ধরার ভীষণ ইচ্ছা আমার। আপনার বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছাটা বহুদিনের।”

আমার কথায় আদ্রিশ ভাই অদ্ভুত চাহনিতে তাকালেন। উনার এ চাহনিতে আমার লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার জোগাড় হলো। আমি মুহূর্তেই দৃষ্টি হটিয়ে নিলাম। উনার বাধন হতে হাত সরিয়ে কাচুমাচু হয়ে বসলাম। উনি আমার এ কান্ডে মুচকি হাসলেন। অতঃপর দাঁড়িয়ে বললেন,
” যাই, সবার সামনে ইস্তেহার দিয়ে আসি, আজ আমার ও আমার বেগমের বিয়ে।”
বলেই উনি এক মুহূর্তের জন্যও অপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়লেন। উনি বেরিয়ে যেতেই আমার কাজিনরা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লো। সবাই আমাকে ঘিরে ধরলো, এতক্ষণ কি হয়েছে তা জানার জন্য। আমি অবশ্য বললাম না। ওরাও আমাকে জ্বালাতে লাগলো বলার জন্য। এর মাঝে হঠাৎ আপু রুমে ঢুকলো। ঢুকেই সবাইকে বললো,
” তোরা একটু বাইরে যা, আমার মিমের সাথে জরুরী কথা আছে।”

আপুর গম্ভীর গলার আদেশ শুনে সবাই দ্বিতীয় কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে গেলো। আমি আপুকে দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। আপু দরজা আটকে ঠিক আমার সামনে দাঁড়ালো। কণ্ঠে খানিকটা নমনীয়তা প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলো,
” আদ্রিশের সাথে সব মিটমাট হয়েছে? বিয়েতে রাজি হয়েছিস নিশ্চয়ই? ”

” হুম। ”

” তাহলে আমাকে এখনও কষ্ট দিচ্ছিস কেনো মিম? এখনও আমার সাথে কথা বলছিস না কেনো?”
বলেই আপু আচমকা কান্নায় ভেঙে পড়লো। দু হাঁটু গেঁড়ে মেঝেতে বসে পড়লো। আপুর অকস্মাৎ কান্নায় আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম৷ আমিও ক্ষণেই আপুর সামনে বসে পড়লাম। আপু আমার দু হাত চেপে ধরে মিনতিরে সুরে বললো,
” বিশ্বাস কর মিম। আমি কখনও তোর খারাপ চাইনি। সবসময় তোর ভালো ভেবে এসেছি। তুই যেসময় আদ্রিশকে পছন্দ করতি, ঐ সময়টা আসলে সঠিক ছিলো না। তোর ভালোমন্দ বুঝার ক্ষমতা ছিলো না। আমি ভীষণ ভয়ে ছিলাম, এই পছন্দের জোরেই যদি তুই উল্টাপাল্টা কিছু করে বসিস! আমাকে ভুল বুঝিস না মিম। টিনএজে সব ছেলেমেয়েরা প্রেম ভালোবাসার চক্করে পড়ে খারাপ হয়ে গিয়েছে। বিপথে গিয়েছে। খুব কম ছেলেমেয়েই নিজেকে ঠিক রাখতে পেরেছে। তুই ঐ বয়সে অনেক আবেগী ছিলি৷ আমি ভয়ে ছিলাম যে যদি তুই পালিয়ে যাস তাহলে?!”

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম আপুর কথায়। বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” এসব কি বলছো আপু? তোমার সত্যিই মনে হয়েছিলো আমি পালিয়ে যাবো! এমনটা মনে করতে আমাকে!”

” না না আমি কখনও তোকে এমনটা ভাবিনি। কিন্তু অতি আবেগে, বন্ধু-বান্ধবের প্ররোচনায় যদি এমন কিছু করে বসতি তখন!”

” তাই বলে এই ভয়ে তুমি আদ্রিশ ভাইকে ব্যবহার করে আমাকে কষ্ট দিয়েছো! তুমি নিজে বুঝাতে আমাকে।”

” আমি অনেক টেনশনে ছিলাম রে। ভেবেছিলাম আমার বুঝানোয় যদি ভুল হয়? যদি আমাকে ভুল বুঝে তুই পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিস তাহলে! তুই তো আমার বান্ধবী রিক্তার বোনের কথা জানিস তাই না? রিক্তাও ওকে অনেক বুঝিয়েছিলো। বন্ধুর মতো বুঝিয়েছিলো, বিশ্বাস করেছিলো। কিন্তু ঠিকই ওর বোন সুযোগ বুঝে বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে যায়। সে সময়টায় তোকে নিয়েও আমি ভয়ে ছিলাম। আদ্রিশকে আমি বিশ্বাস করি। তবুও ভয়ে ছিলাম৷ বিশ্বাস কর মিম। আমি সত্যিই ভয়ে ছিলাম তখন। নানান উদ্ভট চিন্তা মাথায় ঘুরতো। এজন্যই আমি আদ্রিশকে বলেছিলাম তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে। যেনো ওর ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে তুই ওকে ভুলে যাস। ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে পড়াশোনায় সম্পূর্ণ মনোযোগ দিস। আমি আজীবন তোর ভালোই ভেবে এসেছি মিম। বিশ্বাস কর আমাকে। অতীতের সমস্ত ঘটনার জন্য আমাকে মাফ করে দে বোন। আমাকে মাফ করে দে। ”
বলতে বলতে আপু দু হাত জোড় করে ধরলো। আমি সাথে সাথে আপুর হাত ধরে নামিয়ে দিয়ে আপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম৷ আপুও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আপুর কথাগুলো ভেবে, আপুর কান্নায় আমারও দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সত্যিই তো আপু আমার ভালো চায়। সে কখনও আমার ক্ষতি চায়নি। আমিই অতিরিক্ত বুঝে আপুকে ভুল বুঝেছি। আজ আভাও এমন কিছু করলে আমিও ওকে বাধা দিবো। ওকে সঠিক পথে আনবো, যেমনটা আপু করেছে। কিছু ভুল বুঝাবুঝির কারণে আসলেই সম্পর্কে ভাটা পড়ে। সঠিক সময়ে সে ভুল বুঝাবুঝির সমাধান না হলে সম্পর্ক ভেঙে যেতে সময় নেয় না।

——————

আমাকে পুনরায় সাজিয়ে বিছানার মধ্যখানে বসানো হলো। এবারের সাজটা আরেকটু গর্জিয়াস করে দিয়েছে। দু হাতে আদ্রিশ ভাইয়ের দেয়া চুড়ির সাথে আন্টির দেয়া দুটো সোনার বালাও পরানো হয়েছে। গলায় ও কানে আন্টির দেয়া হার ও দুল পরিয়ে দিয়েছে। মাথার উপরে কিছুক্ষণ আগে শাড়ির আঁচলে ঘোমটা দেয়া থাকলেও মাত্রই মামি এসে আদ্রিশ ভাইয়ের আনা বিয়ের ওড়না পরিয়ে দিয়ে গেলো। শুনেছি, আসার পথে এক বন্ধুর দোকানের শাটার ইমার্জেন্সি খুলিয়ে নিজ পছন্দে ওড়নাটা কিনে এনেছেন। উনার এ পাগলামির কথা শুনে আড়ালে হাসলাম আমি।

বাইরে আদ্রিশ ভাইয়ের বিয়ে পড়ানোর কার্যক্রম শেষ হয়ে গিয়েছে। এবার কাজী সাহেব দরজা খুলে আমার দিকে কাগজ নিয়ে এগিয়ে আসছেন৷ উনাকে দেখে আমার ভেতরকার চাপা অস্থিরতাটুকু তীব্র আকার ধারণ করলো। বুকের মধ্যে যেনো তুমুল শব্দে দামামা বেজে চলছে। হাত দুটোও অসম্ভব ঠাণ্ডা হতে শুরু করছে। গলা শুকিয়ে এলো আমার।
কাজী সাহেব এসে বিছানার কোনায় বসে কাবিননাম পড়া শুরু করলেন। অমনিই আমার গলায় কান্নার দলা পাকিয়ে এলো। আব্বু আম্মুর উদাস অশ্রুভরা মুখখানা দেখে আমার দমবন্ধ হয়ে এলো। সত্যিই আমি এই মানুষগুলো থেকে দূরে চলে যাবো? সত্যিই আমাদের মাঝে অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরী হবে? কেনো প্রতিটি মেয়ের জীবনে এই মুহূর্তটা আসে। কেনো তাদেরকে বাবা মায়ের আগলে রাখা ভালোবাসা থেকে দূরে চলে যেতে হয়? কেনো তারা সারাজীবন বাবা মায়ের ছায়াতলে থাকে না?
®সারা মেহেক

#চলবে,