অলকানন্দা ও তিতলি পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
13

#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-২০ (শেষ পর্ব)
#সারা মেহেক

.
.

কাজী সাহেব এসে বিছানার কোনায় বসে কাবিননাম পড়া শুরু করলেন। অমনিই আমার গলায় কান্নার দলা পাকিয়ে এলো। আব্বু আম্মুর উদাস অশ্রুভরা মুখখানা দেখে আমার দমবন্ধ হয়ে এলো। সত্যিই আমি এই মানুষগুলো থেকে দূরে চলে যাবো? সত্যিই আমাদের মাঝে অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরী হবে? কেনো প্রতিটি মেয়ের জীবনে এই মুহূর্তটা আসে। কেনো তাদেরকে বাবা মায়ের আগলে রাখা ভালোবাসা থেকে দূরে চলে যেতে হয়? কেনো তারা সারাজীবন বাবা মায়ের ছায়াতলে থাকে না?

আমার চারপাশ ঘিরে সকল আত্মীয়স্বজন রয়েছে। আমার মামা,চাচা,ফুফু,খালা,কাজিন,সবাই আমার রুমে অবস্থান করছে। এ পর্যায়ে আম্মু, আভা ও আপু এসে আমার পাশে বসলো। আব্বু বসলো ঠিক আমার সামনে। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। তিনি একেকটা লাইন উচ্চারণ করছেন, আর এদিকে অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পাচ্ছে আমার। হাত দুটো প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। আপু ও আভা আমার দু পাশে বসে দু হাত ধরে আছে। আমি মৃদু কাঁপছি। কাজী সাহেব কাবিননামা পড়া শেষে ❝কবুল❞ বলতে বললেন। অথচ আমার গলা দিয়ে টু শব্দটুকুও বের হচ্ছে না। এ পর্যায়ে আমি অনুভব করলাম আমার দু চোখ বেয়ে নীরবে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মন বলছে এক্ষুণি আমি আব্বু আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বসে পড়ি। হুট করেই সেই বাচ্চা মেয়েটি হয়ে যাই, যার বাবা মা’কে ছেড়ে যাওয়ার কোনো চিন্তা নেই। যার বিয়ে নামক নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
কাজী সাহেব এ নিয়ে আমাকে চার বার কবুল বলতে বললেন৷ আশপাশ থেকে সবাই আমাকে ঐ একটি শব্দ বলার জন্য জোর করতে লাগলো। আব্বুও সিক্ত ও কম্পিত গলায় বললো,
” কবুল বল মা। দেরি করিস না। ”
আমি ছলছল দৃষ্টিতে আব্বুর দিকে তাকালাম। আব্বু কান্না করেনি এখনও। কিন্তু চোখমুখ লাল হয়ে এসেছে। আপুও আমাকে সাহস দিয়ে বললো,
” কি রে,কবুল বল। কাজী সাহেব অনেকবার জিজ্ঞেস করছেন। ”
আমি আরোও সময় নিলাম। বুকের উপর শক্ত পাথরের ন্যায় কিছু অনুভূত হওয়ার পরও সাহস সঞ্চার করে বললাম,
” আলহামদুলিল্লাহ কবুল। ”
এরপর সাথে সাথেই আমি হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। চারপাশে কি হচ্ছে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই আমার। আমি কাঁদতে কাঁদতে আপুকে জড়িয়ে ধরলাম। এর মাঝে কতক্ষণ কেটে গেলো জানা নেই। হঠাৎ পাশে আদ্রিশ ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম৷ আপুর কাঁধ থেকে মাথা তুলে দেখলাম আদ্রিশ ভাই আব্বুর হাতে হাত রেখে বলছেন,
” আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন আংকেল। আজ থেকে আপনার মেয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার উপর। সে আপনার মেয়ে হওয়ার পাশাপাশি আমার বউও। ”
আব্বু সিক্ত গলায় বললো,
” তোমার উপর বিশ্বাস আছে বাবা। কিন্তু কখনও জেনে বা না জেনে আমার মেয়েকে কষ্ট দিও না। কখনো বিরক্ত মনে হলে আমাকে বলবে। আমি ওকে নিয়ে আসবো।”
” আমার বিরক্ত হওয়ার কোনো সুযোগই নেই আংকেল। ও নিজেই হয়তো আমার উপর বিরক্ত হতে পারে,কিন্তু আমি হবো না। ”
এই বলার পর আদ্রিশ ভাই আমার পাশে বসার অনুমতি নিলেন। আব্বুর তরফ হতে অনুমতি পাওয়ার পর আম্মু,আপু ও আভাসহ বিছানার উপর থেকে সবাই সরে গেলো। আদ্রিশ ভাই এসেই পকেট থেকে রুমাল বের করে আমার চোখের নিচে চেপে ধরলেন। মৃদু হাসিতে বললেন,
” মেকআপ ধুয়েমুছে একাকার হয়ে যাচ্ছে ম্যাডাম৷ চোখের পানি মুছে নিন। ”
আমি অল্পবিস্তর কাঁদতে কাঁদতে উনার হাত থেকে রুমাল নিয়ে চোখ মুছে নিলাম৷ অতঃপর আদ্রিশ ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
” বলেছিলাম কবুল বলার পরপরই আমাকে পাশে পাবে৷ এখন আমাকে পাশে পেয়ে কি করতে চাও করো। ”
উনার এহেন কথায় আমি বেশ লজ্জা পেলাম। উপরন্তু আমার লজ্জা আরোও বৃদ্ধি পেলো যখন আমার কাজিনরা এ নিয়ে মজা করতে লাগলো। আমার লজ্জায় তখন যায় যায় অবস্থা।
আদ্রিশ ভাই এবার পাঞ্জাবির পকেট থেকে আংটি বের করে আমার সামনে ধরে বললেন,
” আংটি দিয়ে বিয়ের জন্য প্রপোজ করার সুযোগ আর হলো না। তাই এবার আংটি দিয়ে বাকিটা জীবন জ্বালানোর জন্য প্রপোজ করছি। ”
আদ্রিশ ভাইয়ের এহেন কথায় রুমে উচ্চ হাসির রোল পড়ে গেলো। আমি কিছুক্ষণ উনার দিকে চেয়ে রইলাম। অতঃপর মৃদু হেসে বাম হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। উনি খুব সযত্নে আমার অনামিকা আঙুলে আংটি পরিয়ে দিলেন। এ পর্যায়ে আম্মুও আমার দিকে আদ্রিশ ভাইয়ের জন্য বানিয়ে রাখা আংটিটা এগিয়ে দিলো। আমি আংটিটা নিয়ে অতি সন্তর্পণে উনার আঙুলে পরিয়ে দিলাম। সাথে সাথেই করতালির ধ্বনিতে মেতে উঠলো আমার রুমটা। এরপর বড়দের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে আভা আর আমার কাজিনরা মিলে আমাদের ছবি তুলতে লাগলো।
ছবি তোলার এক পর্যায়ে আদ্রিশ ভাই ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন,
” কথা তো এটা ছিলো না মিশমিশ! তুমি কথার বরখেলাফ করলে।”
উনি ঠিক কি ব্যাপারে কথা বলছেন তা আমার জানা নেই। তাই ক্যামেরার দিকে চেয়ে রয়েই ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
” কোন কথার বরখেলাফ করলাম?”
“এই যে, বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে। জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখবে।”
এই সবার সামনে আদ্রিশ ভাই এ কথা বলে বসবে এটা ভাবিনি। ভাগ্যিস জোরে বলেননি। নচেৎ আজ কাজিন গোষ্ঠীর সামনে আমার মান সম্মান কিছুই থাকতো না। আমি ক্যামেরার দিকেই দৃষ্টি রেখে মেকি হাসি ধরে রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,
” অসময়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে আমার মাথা গরম করবেন না আদ্রিশ ভাই। তখন যা বলেছি তা কি সবার সামনে করা সম্ভব! গোপন জিনিস গোপন রাখতে শিখুন। ”
” বিয়ের পর আবার গোপন কিসের! জড়িয়ে ধরবে, সবার সামনেই ধরবে। এটা কোনো গোপন কাজ না।”
কথাটা ইচ্ছে করেই জোরে বলে ফেললেন আদ্রিশ ভাই। উনার কথায় কোলাহলপূর্ণ রুমটা মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। আমি চরম বিস্ময় নিয়ে উনার দিকে ফিরে তাকালাম। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ রইলো পুরো রুম। আমার মতো আমার কাজিনগুলোও সব বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলো। আদ্রিশ ভাই এমন ভাব ধরলেন যেনো উল্টাপাল্টা কিছুই বলেননি উনি। স্বাভাবিক গলায় বললেন,
” কি হলো? সবাই চুপচাপ হয়ে গেলে কেনো? ভুল কিছু বলেছি আমি? বিয়ের পর জড়িয়ে ধরা তো কোনো গোপন কাজ না তাই না? তোমাদের আপু আমাকে…… ”
পরবর্তী কথাটুকু কি হবে তা আমার জানা আছে বিধায় দ্রুত পাশ থেকে উনার সামনে এগিয়ে খপ করে আদ্রিশ ভাইয়ের মুখ চেপে ধরলাম৷ আশেপাশে কে কি ভাবলো তা চিন্তা করে এ মুহূর্তে সময় অপচয় করা উচিত না। কেননা আজ আদ্রিশ ভাইয়ের জবান বুলেট ট্রেনের গতিতে ছুটছে। বিয়ের আগে যে বেহায়া ছিলেন তা এই কয়েক মিনিটের মধ্যে বেড়ে দ্বিগুণ হলো। মস্ত বড় বেহায়া হয়ে উঠলেন তিনি। আমি মুখ চেপে ধরে চোখ গরম করলাম৷ অতঃপর চিবিয়ে বললাম,
” কন্ট্রোল আদ্রিশ ভাই, কন্ট্রোল৷ নিজের বুলেট ট্রেনের মতো জবানটাকে একটু রেস্ট দিন।”
আমার এহেন কান্ডে কাজিনমহল সকল অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেও আদ্রিশ ভাই বেশ মজা পেলেন। আমাকে পঁচিয়ে যে উনি ভীষণ মজা পাচ্ছেন তা উনার চাহনি দেখে স্পষ্ট টের পেলাম।
এ পর্যায়ে উনি আমার হাত সরিয়ে আবারও কিছু বলতে গেলেন৷ কিন্তু আমি মুহূর্তেই আবারও উনার মুখ চেপে ধরলাম। তন্মধ্যে আমার এক কাজিন মজা করে বললো,
” এই যে বিয়ের পর আদ্রিশ ভাইয়ার মুখ বন্ধ হলো, এ আর খুলবে না। এখানে দেখছি আপুই রাজত্ব করবে!”
বলেই সকলে আবারও হেসে ফেললো। এতক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকার পর এ কথাটা শুনে আত্মায় প্রশান্তি পেলাম যেনো। আদ্রিশ ভাইয়ের দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে বাঁকা হেসে বললাম,
” শুনলেন? শুনলেন তো কথাটা? আমাদের এ সম্পর্কে রাজত্ব চলবে আমার। মাইন্ড ইট মিস্টার আরসালান আহমেদ আদ্রিশ।”
আমার এ কথায় উনি এতে বাঁধা দিলেন না। হাসলেন শুধু, উনার চাহনি দেখে যা বুঝলাম৷ এবার উনি আমার হাতটা আলতো করে সরিয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
” রাজত্ব তো আপনারই চলছে, আপনারই চলবে ম্যাডাম। আমার মন, মস্তিষ্ক, এমনকি এই দেহতে।”
বলেই উনি চোখের ইশারায় আমাকে দেখালেন, যে আমি উনার এতোটা কাছে চলে এসেছি।
” ঐ সব বাইরে চল। নিউলি ম্যারিড কাপলের রোমান্স চলছে। ডিস্টার্ব করা যাবে না। ”
বলতে বলতে আমার কাজিনরা সব একযোগে বেরিয়ে গেলো৷ আমিও ক্ষণেই সরে বসলাম উনার কাছ থেকে। আদ্রিশ ভাইও সুযোগ বসে মুহূর্তেই আমাকে টেনে বসালেন নিজের পাশে। কোমড়ে হাত রেখে শক্ত করে চেপে ধরলেন নিজের সাথে। বললেন,
” এখন তো পালানোর সুযোগ নেই মিশমিশ। দরজা বন্ধ, সুযোগও আছে। যা ইচ্ছে এই সুযোগে করে ফেলো।”
আদ্রিশ ভাইয়ের হাতের বাধন আলগা করে সরে আসলাম আমি। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভেঙচি কেটে বললাম,
” আমি আপনার মতো লুজ ক্যারেক্টারের না বেশ। সবসময় ওসব আমার মাথায় ঘুরে না। ”
আমার কথায় আদ্রিশ ভাই উঠে দাঁড়িয়ে যেই না আমার হাত ধরতে যাবেন, অমনি কেউ দরজা খুলে ফেললো বাইরে থেকে। দরজায় আমার খালামনি দাঁড়িয়ে আছে। বললো,
” এই যে নতুন বর বউ, খেতে চলো। রাতের খাবার খেতে হবে না! তোমরা খেয়ে গেলে তবেই বড়রা খেতে বসবে। ”
আমি সুযোগ পেয়ে তৎক্ষনাৎ খালামনির পিছু পিছু রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। যাওয়ার আগে আদ্রিশ ভাইয়ের হার স্বরূপ একটা ভেঙচি দেখিয়ে গেলাম।

.

খাবার শেষে গল্পে মশগুল হলো সবাই। আমি রুমে চলে এলেও আদ্রিশ ভাই গল্পে ব্যস্ত হলেন৷ আজ রাতটা উনি আমাদের বাসায় কাটাবেন বলে বড়রা সিদ্ধান্ত নিলো। সেই খুশিতেই মন ভরে গল্প করলেন উনি। এদিকে আমাকে কখন রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে তা উনার খেয়াল নেই। একা ঘোমটা দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে চরম বিরক্ত হলাম আমি। উনি রুমে এলে যে মস্ত বড় এক শিক্ষা দিবো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমাকে একা বসিয়ে রাখারও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর আদ্রিশ ভাই রুমে ঢুকলেন৷ ঢুকেই আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন৷ অতঃপর ফিরে দরজা আটকিয়ে দিলেন৷ আমার দিকে এক কদম এক কদম করে তিন কদম আগাতেই আমি হাত উঁচিয়ে বললাম,
” ওখানেই থামুন। আর এক কদমও আমার দিকে আগাবেন না৷ ”

আদ্রিশ ভাই প্রশ্নাতুর চাহনিতে চেয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য৷ অতঃপর ফের আগাতে নিলেই আমি তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠলাম। বললাম,
” বলেছি না আর এক কদমও আগাবেন না! এদিকে এলেই আমি চিৎকার দিবো!”

আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাই বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। হতভম্ব কণ্ঠে শুধালেন,
” এসব কি বলছো মিশমিশ! হঠাৎ কি হলো?”

আমি উনার প্রশ্ন শুনেও না শোনার ভান করলাম। অগ্রাহ্য করে বললাম,
” হয়েছে হয়েছে। অনেক কিছু হয়েছে। আপনার তো এখনও অনেককিছু দেখা বাকি, সহ্য করা বাকি। এত সহজে ছাড় দিবো আপনাকে ভাবলেন কি করে?!”

আদ্রিশ ভাই আমার কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। বললেন,
” কি সমস্যা মিশমিশ? হঠাৎ কি হলো? কিছুক্ষণ আগেও তো সব ঠিক ছিলো। ”

আমি গটগট করে গিয়ে উনার সামনে দাঁড়ালাম৷ তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম,
” কিছুক্ষণ আগের মানে জানেন আপনি? সেই যে গল্পে মজলেন তো মজলেনই! আমার কোনো খেয়ালই নেই! আমার বাসায় আমাকেই টানা পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে বসিয়ে রেখেছেন। ঘোড়ার ডিমের বাসর করতে এসেছেন। এক্ষুণি বেরিয়ে যান আমার রুম থেকে।”

আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাই দাঁত চেপে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
” এই আস্তে বলো মিশমিশ। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।”

” সবার পরোয়া করি না আমি। এক্ষুণি আপনার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হোন।”

” আচ্ছা বাবা,সরি। এই যে কান ধরলাম।”
বলেই উনি দু হাতে দু কান ধরে চেহারায় নিরীহ ভাব ফুটিয়ে তুললেন। আমি ওদিকে পরোয়া না করে লোকটাকে আচ্ছা শাস্তি দেয়ার জন্য বললাম,
” এসব কান ধরায় আপনার গুনাহ মওকুফ হবে না। আমি যা শাস্তি দিব তা মেনে নিতে হবে। ”

” ওকে ম্যাডাম, আপনি যা শাস্তি দিবেন, এই বান্দা বিনা প্রশ্নে তা স্বীকার করে নিবে। ”

” যতক্ষণ আমি অপেক্ষা করেছি, ঠিক ততক্ষণ আপনিও অপেক্ষা করবেন। কিন্তু ব্যালকনিতে। ”

ভেবেছিলাম আদ্রিশ ভাই ইতি-উতি করবেন। কিন্তু তা না করে উনি ‘ওকে ম্যাডাম’ বলে গটগট করে ব্যালকনিতে চলে গেলেন৷ আমিও গিয়ে মুহূর্তেই ব্যালকনির দরজা আটকে দিলাম৷ বললাম,
” এবার বসে থাকুন পয়তাল্লিশ মিনিট। আমাকে শুধু শুধু অপেক্ষা করানোর শাস্তি এটা।”

আদ্রিশ ভাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ফোনের টাইমার অন করলেন। আমিও উনাকে পাত্তা না দিয়ে বাসায় পরার সাধারণ থ্রি পিছ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। বেশ রয়েসয়ে সময় লাগিয়ে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম৷ পাক্কা চল্লিশ মিনিট পর আমি ওয়াশরুমে কাটিয়ে বের হলাম। রুমের জানালা থেকে ব্যালকনিতে উঁকি দিয়ে দেখলাম আদ্রিশ ভাই মেঝেতে বসে একটা অলকানন্দা ফুল হাতে নিয়ে ঘুরাচ্ছেন। আর গুনগুন শব্দে গুঞ্জন তুলছেন।
উনার গুনগুন সুর তোলা শব্দটুকু ভালোই লাগছিলো৷ এর মধ্যে উনি আমার উপস্থিতি টের পেয়ে থামলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” এতক্ষণ ধরে গোসল করলে তো আমাকে বাসায় একটা সুইমিংপুল বানাতে হবে৷ নাহলে রোজ আমি হসপিটালের জন্য লেট হয়ে যাবো। ”

আমি সে কথায় না গিয়ে বললাম,
” সময় যাচ্ছে না আপনার? কেমন লাগে এমন ফাউ ফাউ অপেক্ষা করতে?”

” ভালোই লাগে তো। নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশে একা একা বসে সময় কাটাচ্ছি। বেশ ভালোই সময় কেটেছে। ”
বলতে বলতে উনার টাইমারের ‘বিপ বিপ’ শব্দ শোনা গেলো। উনি উঠে দাঁড়ালেন। জানালায় হাত বাড়িয়ে ফোন দেখিয়ে বললেন,
” আমার টাইম আপ হয়ে গিয়েছে। এবার দরজা খোলো। ”

আমিও আর কথা না বাড়িয়ে দরজা খুললাম৷ গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলে পেঁচিয়ে রাখা তোয়ালে খুলে ফেললাম৷ ভেজা চুলগুলো আবারও সেই তোয়ালে দিয়ে মুছে তোয়ালে ছাড়িয়ে দিলাম।
কাজ শেষে হঠাৎ পিছে ফিরে দেখলাম আদ্রিশ ভাই আমার অনেকটা কাছে দাঁড়িয়ে আছে। চমকে উঠলাম আমি। আদ্রিশ ভাই আলতো হেসে বললেন,
” তুমি মাঝে মাঝে খুব সহজেই চমকে উঠো মিশমিশ। এজন্য তোমাকে ভয় পাওয়ানে অনেক সহজ।”
বলেই তিনি হেসে ফেললেন৷ আমি ভেঙচি কেটে বললাম,
” এভাবে ভূতের মতো পিছনে দাঁড়ালে যে কেউ ভয় পাবে।”

” হুম।”
আদ্রিশ ভাই আর কথা বললেন না। একনাগাড়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। উনার এ চাহনিতে আমি কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
” এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? যান, রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। ”

আদ্রিশ ভাই ঈষৎ নড়ে দু হাত আড়াআড়িভাবে বুকে রাখলেন। বললেন,
” ভাবছি,রোজ সকালে বা রাতে তোমাকে এরূপে দেখলে আমি নির্ঘাত হার্টের রোগী হয়ে যাবো। বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে আমার জন্য। ”

উনার এহেন কথায় লজ্জায় ফিরে গ্রিলের দিকে তাকালাম আমি৷ খানিক বাদে আদ্রিশ ভাই আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন। আচমকা আমার কানের পিছে ফুল গুঁজে দিয়ে বললেন,
” জানো? আমার হলুদ রঙ ভীষণ পছন্দের? ”
উনার এ প্রশ্নে বুঝতে বাকি রইলো না যে আমার কানে অলকানন্দা ফুল গুঁজে দিয়েছেন উনি। আমি জবাব দিতে যাবো, এর পূর্বেই আদ্রিশ ভাই আমার ভেজা চুলগুলো সামনে দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন আমাকে। জড়িয়ে ধরে বললেন,
” আমার হলুদ রঙ পছন্দ বলে কি এই ফুলটা লাগিয়েছো?”

আপাতত অলকানন্দা ফুলের রহস্য উনার সামনে উদঘাটন করা যাবে না বিধায় আমি মুহূর্তেই নাকচ করে বললাম,
” উঁহু। মোটেও না। আপনার পছন্দে আমার বাগানে ফুল লাগাতে যাবো কেনো। এটা আমার এক বান্ধবী জন্মদিনে গিফট দিয়েছিলো আমাকে। ”

” তাই!”

” হুম। কেনো, বিশ্বাস হচ্ছে না?”

” হয়েছে তো!”
বলেই আদ্রিশ ভাই মৃদুস্বরে হাসলেন৷ আমার মিথ্যে বলাটা টের পেয়েছেন কি না কে জানে!
আদ্রিশ ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার কানে আলতো চুমু এঁকে বললেন,
” আমার অলকানন্দা তুমি। হলুদিয়া অলকানন্দা ফুল।”

🌼💛সমাপ্ত💛🌼