#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_13
#লেখিকা_সালমা_খাতুন
🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫
মায়া প্রথমেই আবিরকে সাথে নিয়ে হসপিটালে গেলো ওর বাবাকে দেখা করতে। মায়ার মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো ওর বাবাকে দেখার পর, কারণ ওর বাবার শরীর টা আরো বেশি খারপ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ডক্টরও বলেছে ওনার আর সুস্থ হওয়ার কোনো চান্স নেই। তবুও মায়া ওর বাবাকে হসপিটালেই রাখতে চাই। এভাবে যতোদিন থাকে আরকি। মায়া ভীষণ কান্নাও করেছে আজ, ওর বাবাকে দেখার পর। ও খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে ওর বাবা আর বেশি দিন থাকবে না এই দুনিয়ায়।
আবির মায়াকে জোড় করে ডক্টর দেখিয়ে কোমড়ে ব্যাথার লগার জন্য ওষুধ নিয়েছে। তারপর মায়া ওর বাবার সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে ওরা রওয়ানা দিয়েছে অফিসের উদ্দেশ্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা অফিসে পৌঁছে যাই। অফিস টাইম ১০:৩০ এ আর এখন বাজে, ১০:৪০। ওরা অফিসে ঢুকেই প্রথমে লিফটে উঠে সব থেকে উপরের ফ্লোরে যাই। ওখানেই আছে আরমান আর আবিরের কেবিন। লিফট থেকে বেরিয়েই কিছুটা গিয়েই দেখা যাই ওখানে অনেকে নিজের ডেস্কে বসে যে যার কাজ করছে।
আবিরকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গুড মর্নিং জানালো। আবিরও কোনো দিকে না তাকিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে যেতে যেতেই বলল, “গুড মর্নিং এভরিওয়ান।”
আবিরের সাথে মায়াকে দেখে সবাই অবাক হলো। কালকে যখন সবাই আবির আর মায়াকে একসাথে যেতে দেখেছিল তখনো অবাক হয়েছিল। কারণ এই প্রথম আবিরকে কোনো মেয়ের সাথে দেখলো। তাছাড়া আবিরকে কোনো দিনও কোনো মেয়ের সাথে দেখেনি। আর না তো আবির কাজ ছাড়া এই অফিসের কোনো মেয়ের সাথে কোনোদিনও দুটো ভালো করে কথা বলেছে। কোনো মেয়ের দিকে ভালো করে তাকায় না পর্যন্ত। তাই মায়াকে ওর সাথে দেখে সবাই অবাক হয়েছে। আর আবির এমনিতে ওদের সবার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণই করে। যদি কেউ কোনো ভুল করে তবেই আবির তার সাথে রুক্ষ ব্যবহার করে তাছাড়া না।
আর আবিরের সাথে মায়াকে দেখে ওদের দুজনকে নিয়ে অফিসে গসিপও শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ তো বলছে ওই মেয়েটা হয়তো ওদের আবির স্যারের গার্লফ্রেন্ড। আর উনার এই গার্লফ্রেন্ড এর জন্যই হয়তো ওদের আবির স্যার অন্য কোনো মেয়ের দিকে ভালো ভাবে তাকায় না।
আবির গিয়ে আরমানের কেবিনে নক করলে আরমান ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। আরমান ওদের দুজনকে আগেই দেখেছে আস্তে। কারণ আরমানের কেবিনের সামনে টা কাঁচের তৈরি। আর তাই পুরো ফ্লোরটা ওর নিজের চেয়ারে বসেই দেখতে পাই ভেতর থেকে, বাইরে কি কখন কি চলছে। আর এই কারণেই ওই ফ্লোরের কেউ কাজে ফাঁকি দিতে পারে না। কারণ ওরা সবাই খুব ভালো করেই জানে যে ওদের বসের নজর সব সময় ওদের উপরেই আছে। আরমান কাজের ব্যাপারে ভীষণ স্ট্রিক্ট। কাজে ফাঁকি দেওয়া আরমান একদম পছন্দ করে না। ওর ভয়ে পুরো অফিস তটস্থ হয়ে থাকে। কারণ আরমান সব সময় গম্ভীর ও রাগী গলায় কথা বলে। যেনো মেজাজ সব সময় মাথার উপড়েই আছে। তবুও এই গম্ভীর কাঠখোট্টা মানুষটার জন্য এই অফিসের অনেক মেয়ে পাগল।
আবির আর মায়া ভেতরে ঢুকতেই আরমান গম্ভীর গলায় বলল, “10 মিনিটস লেট।”
আবির ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল, “আসার সময় হসপিটালে গিয়েছিলাম মায়ার বাবাকে দেখতে তাই লেট হয়ে গেছে।”
বলতে বলতে আরমানের সামনে থাকা চেয়ারে গিয়ে বসলো আবির। মায়া তখনো দাঁড়িয়ে আছে। আরমান আড় চোখে একবার তাকালো মায়ার দিকে। মায়ার চোখ মুখ এখনো ফুলে আছে, কান্না করার ফলে। চোখ দুটো এখনো লাল হয়ে আছে। আরমান মায়ার এই অবস্থা দেখে কিছু জিজ্ঞাসা করবে ভেবেও কি জিজ্ঞাসা করবে সেটাই বুঝতে পারলো না। তাই আবিরকে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছে আঙ্কেল এখন?”
আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “কোনো ইমপ্রুভমেন্ট নেই। অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।”
আবিরের এই কথায় আরমান বুঝলো মায়ার মুখের এই অবস্থার কারণ। ও নিজেও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মায়ার উদ্দেশ্য বলল, “দাও তোমার ডকুমেন্টস গুলো।”
মায়া ওর ব্যাগে থেকে সমস্ত ডকুমেন্টস বের করে আরমানকে দিলো। আরমান সমস্ত ডকুমেন্টস, কোর্সের সার্টিফিকেট দেখলো। সবকিছুই ঠিক ঠাকই আছে। আগের কোম্পানিতেও মায়ার কাজের রিভিউ ভালো। মায়া নিজের কিছু করা ডিজাইনও সাথে করে নিয়ে এসেছিল সেগুলোও দেখালো। সবকিছুই ঠিক আছে, একদম প্রফেশনাল ডিজাইনারদের মতোই। কিন্তু মায়াকে দেখলে বোঝাই যাবে না যে ও এতো ভালো একজন ডিজাইনার। আরমান মায়াকে পেপার পড়ে নিয়ে সাইন করতে বলল। এবং অফিসের সব কিছু রুলস গুলোও পড়ে নিতে বলল। মায়া দেখলো কাগজে লেখা আছে, ও কাজে জয়েন করলে এক বছরের আগে এই কাজ ছাড়তে পারবে না। এটাই এখানকার নিয়ম। সব কিছু পড়ে মায়া আবিরের দিকে তাকালে, আবির বুঝলো মায়ার মনের কথা। আবির বলল, “এগুলোই এখানকার নিয়ম। তুমি জয়েন করলে এক বছরের আগে এই জব ছাড়তে পারবে না। আর আপাতত তোমাকে মাসিক 60,000 বেতন দেওয়া হবে। পড়ে বাড়তে পারে। আর যেহেতু মিস্টার ড্যানিয়েল শুধু মাত্র তোমার বানানো ডিজাইন চাই তাই তোমাকে এই প্রজেক্টের জন্য হেড ডিজাইনার বানানো হবে।”
মায়া আবিরের বলা বেতনের পরিমাণ আর ওকে হেড ডিজাইনার বানানো হবে শুনে ভীষন অবাক হলো। ও এতোটাও আশা করেনি। ও কি সত্যিই পারবে এতো বড়ো কাজের দায়িত্ব নিতে? এই নিয়ে চিন্তিত হলো মায়া। তখন পেপারটা ও হাতে ধরে আছে সাইন করেনি।
আরমান মায়ার অবাক ও চিন্তত মুখ দেখে বলল, “কি হলো মিস মায়া? ভয় লাগছে? পারবে তো এতো বড়ো কাজের দায়িত্ব নিতে। এখন কিন্তু কিছু করার ও নেই, মিস্টার ড্যানিয়েল কিন্তু বলেই দিয়েছে তোমার ডিজাইন ছাড়া অন্য কারোর ডিজাইন নেবেন না।”
মায়া এই কথার প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। পেপার টা টেবিলে রেখে সাইন করে বুঝিয়ে দিলো ও এই দায়িত্ব নিতে রাজি। পেপারে সাইন করা হয়ে গেলে মায়া পেপারটা আরমানের দিকে এগিয়ে দিলো।
আবির:- “Welcome to our office miss Maya Talukder. আজ থেকে তুমি আমাদের কম্পানির একজন মেম্বার হলে।”
ঠিক তখনি আরমানের কেবিনে নক হওয়ার আওয়াজ হলো। আরমান ভেতরে আসার অনুমতি দিলে একজন ছিমছাম গড়নের 24-25 বছর বয়সী ছেলে রুমে প্রবেশ করলো। আবির তাকে দেখে বলে উঠলো, “ওহ মিরাজ তুমি এসেছো! আসো আসো। তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি।”
তারপর আবির আরমানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এই হচ্ছে তোর নতুন P.A মিরাজ। অনেকের ইন্টারভিউ নিয়ে ছিলাম আমি। তার মধ্যে একেই আমার যোগ্য মনে হয়েছে। অনেক করেছি তোর অ্যাসিস্ট্যান্ট এর কাজ। এবার থেকে ও করবে। এতে আমার কাজ কিছুটা কমবে। দুই দিকে সামলাতে পারছি না আমি।”
আরমানের আগে একজন মেয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। কিন্তু সে ছিল খুব গায়ে পড়া স্বভাবের। তাই তাকে বাদ দিয়ে দিয়েছে আরমান। আর সেই জায়গায় কিছুদিনের জন্য আবির ছিল ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে।
মিরাজ বলে ছেলেটার কাজে থেকে জয়েনিং লেটার নিয়ে একই প্রক্রিয়াই সাইন করিয়ে নিলো। আরমানও কিছু প্রশ্ন করলো ছেলেটাকে। ছেলেটি সব উত্তর ঠিক ঠাক দেওয়াই আলমানের ভীষণ পছন্দ হলো। আবির জানালো ও আজকের মধ্যে মিরাজকে সব কাজ বুঝিয়ে দেবে।
এরই মধ্যে ১১ টা বেজে গেছে। এই নতুন প্রজেক্ট নিয়ে একটা মিটিং অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে। একজন এসে জানালো সকল ডিজাইনার মিটিং রুমে উপস্থিত হয়েছে। তাই ওরা চারজন বেরিয়ে গেলো মিটিং রুমের উদ্দেশ্যে।
মিটিং রুমে প্রথমেই আরমান প্রবেশ করলো। পিছনে পিছনে আবির, মিরাজ আর মায়াও গেলো। আরমান নিজের অ্যাটিটিউড বজায় রেখে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো। আরমানকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালে আরমান সবাইকে হাতের ইশারায় বসতে বলল। আবির, মায়া, মিরাজ আরমানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
এই রুমে কিছু ছেলে এবং মেয়ে আবার মধ্য বয়সী কজনও আছে। মেয়ে গুলোর পরনে আছে আধুনিক পোশাক। তার উপর আবার মেকআপ করা। আর মায়া পরনে আছে সিম্পল কুর্তি, মাথায় ওরনা। আর মুখে কোনো মেকআপ নেই। ওর কানে আছে হালকা দুল, চোখে একটু কাজল আরে ঠোঁটে হালকা লিপ গ্লস। এতেই যেনো ওকে সব মেয়েদের থেকে বেশি সুন্দর লাগছে।
মায়া এইসব আধুনিক পোশাক পড়া মেয়েদের দেখেও ঘাবড়ালো না। ওর এই সবের অভ্যাস আছে। আগের কম্পানিতেও ও হেড ডিজাইনার হিসেবেই কাজ করতো। তাই ও একদম একজন প্রফেশনাল ডিজাইনারের মতোই ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/
আর এদিকে সকলে তো মায়ার ব্যাপারে জানার জন্য উতলা হয়ে উঠছে। কিন্তু মুখে কেউ কিছু বলতে পারছে না কারণ এখানে আরমান আছে। সবাই মায়ার ব্যাপারে জানার জন্য উসখুস করছে। এখানে আবার আগের হেড ডিজাইনার দিশাও আছে। ও তো মায়াকে দেখে রাগে ভিতরে ভিতরে ফুঁসছে। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছে না।
আবির সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল, “হেই গাইস, ওহ হচ্ছে মিরাজ, আজ থেকে স্যারের পি.এ।”
তারপর মিরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আর মিরাজ? এনারা হচ্ছে আমদের ডিজাইনার। উনারাই আমাদের কম্পানির সমস্ত ড্রেস ডিজাইন করে।”
সকলে মিরাজকে হাই, হেলো জানালো। তারপর আবির মায়ার পরিচয় দিয়ে বলল, “আর ওর নাম মায়া, আজ থেকে আপনাদের হেড ডিজাইনার হয়ে কাজ করবে।”
তৎক্ষণাৎ একজন ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার কিন্তু আমাদের হেড ডিজাইনার তো দিশা ম্যাম।”
আবির:- “আমি এখনো পুরো কথা শেষ করেনি, আমাকে আগে পুরোটা বলতে দিন।”
এটি শুনে ছেলেটি নিজের জায়গায় বসে পড়লো। আবির আবারও বলতে শুরু করলো, “আপনারা সবাই জানেন কাল একজন বিদেশী ক্লাইন্টে মিস্টার ড্যানিয়েল এর সাথে মিটিং ছিল। আর মিস দিশার বানানো কোনো ডিজাইনই উনার পছন্দ হয়নি। উনার মনে হয়েছে এই ডিজাইন এখন অনেক চলতি। উনি কিছু আনকমন ডিজাইন চেয়েছিলেন। আর সেই আনকমন ডিজাইন মিস মায়া দিতে পেরেছে। উনার মিস মায়ার বানানো ডিজাইন ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আর উনি এটাও বলেছেন, যে উনি একমাত্র মায়ার ডিজাইনই নেবেন। অন্য কারো না। তাই আপনাদের সকলকে এই প্রজেক্টের জন্য মিস মায়ার আন্ডারে কাজ করতে হবে। মিস মায়া যেমন ডিরেকশন দেবেন আপানাদের সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এতে কারোর কিছু বলার আছে?”
সকলে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। তার মানে এতে কারোর কোনো আপত্তি নেই। ঠিক তখনি মিস দিশা উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো, “আমার সকলকে কিছু বলার আছে। এই মিস মায়া হচ্ছে আমাদের স্যারের….”
আর বলতে পারলো না দিশা। ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে আবির রেগে বলল, “মিস দিশা!! এখানেই থামুন। এখানে কাজের কথা চলছে। তাই এমন কিছু বলবেন না যাতে আপনাকে আপনার কাজটা হারাতে হয়। তাই ভালো হবে নিজের মুখটা বন্ধ রাখুন।”
আরমান আবিরকে রেগে যেতে দেখে ওর দিকে তাকালো। আরমান, মায়া এবং আবির ভালোই বুঝতে পেরেছে দিশা কি বলতে চাইছিলো। কালকে আরমান মিস্টার ড্যানিয়েলকে প্রথমে মায়ার পরিচয় হিসাবে জানিয়ে ছিল মায়া ওর সার্ভেন্ট। আর সেটা দিশাও শুনেছিল। আর এমনিতেও দিশা মায়ার উপরে রেগে আছে। রেগে থাকারই তো কথা, মায়া যেহেতু ওর জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে তাই ও মায়ার প্রতি হিংসায় জ্বলছে। কিন্তু ও বুঝতে পারেছে না যে মায়া ও ওর যোগ্যতাই ওর জায়গাটা পেয়েছে। আর দিশা নিজের কাজের জন্য নিজের জায়গাটা হারিয়েছে।
দিশা রাগে অপমানে নিজের কথা শেষ না করেই বসে পড়লো। আবির দিশাকে উদ্দেশ্য করে আবারও বলে উঠলো, “মিস দিশা! আপনাকেও মিস মায়ার আন্ডারেই কাজ করতে হবে। মিস মায়ার সাথে আপনাকে কোঅপারেট করে চলতে হবে। এটা একটা অনেক বড়ো একটা ডিল। তাই আমরা চাই না এই প্রজেক্ট টাতে কোনো রকম ভুল বা ত্রুটি থাকুক। আশা করি কথা গুলো সবার মাথায় ঢুকেছে।”
সকলে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। আবার কেউ “ইয়েস স্যার” বলে উঠল।
মিস দিশা মায়ার প্রতি ক্ষোভ নিয়ে মনে মনে বলল, “কক্ষনো না। এই মেয়ের আন্ডারে কাজ করা তো দূরে থাক এই মেয়ে কিভাবে এই ডিল সাকসেস করে তাই আমি দেখবো। খুব শক না আমরা পোস্ট ছিনিয়ে নেওয়া। ওর এই শক আমি ঘুচিয়ে দেবো। আমিও দেখবো এই মেয়ে আমি থাকতে কিভাবে এই কোম্পানিতে কাজ করে। এই মেয়েকে যদি আমি না তাড়িয়েছি তাহলে আমার নামও দিশা নয়।
এতোক্ষণ আরমান চুপ ছিল। এবার ও নিজের অ্যাটিটিউড বজায় রেখে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো, “আবির তো সব কিছু বলেই দিলো। আমি শুধু এটুকু বলবো, সবাই এই প্রজেক্টে নিজেদের বেস্ট টা দিবেন। আর মিস মায়া নতুন তাই উনার সাথে ভালোভাবে মিলেমিশে কাজ করবেন। এটা কোটি কোটি টাকার ডিল। আর এই ডিলটা সাকসেস হলে আমাদের কম্পানি আরো কিছুটা উপড়ে উঠে যাবে। তাই আমি চাইনা এই প্রজেক্টে কোনো রকম সমস্যা হোক। এই ডিলটা সাকসেসফুল হলে আপানাদের মাইনের কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া হবে সাথে বোনাস তো আছেই। আশা করছি সবাই নিজের বেস্ট টা দিয়ে কাজ করবেন।”
সকলে সমস্বরে ইয়েস স্যার বলে উঠলো। এরপর আরমান মিশ দিশাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মিস দিশা! জানি হয়তো আপনার খারাপ লাগছে, যেহেতু আপনার পোস্ট অন্য কাউকে দেওয়া হলো তাই খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আপনার চিন্তা নেই। আপনাকে যেই মাইনে দেওয়া হতো সেটাই দেওয়া হবে। আর আশা করি আপনি আমাদের কম্পানির খারাপ চাইবেন না? আর আপনি তো জানেনই, মিস্টার ড্যানিয়েল উনার বানানো ডিজাইন চেয়েছেন। তাই আশা করছি আপনিও আমাদের কম্পানির ভালোর জন্য মিস মায়ার সাথে মিলেমিশে কাজ করবেন।”
দিশা কিছুটা ঘাবড়ে গেলো আরমানের কথা শুনে। আচ্ছা স্যারের কি মন পড়ার ক্ষমতা আছে নাকি? নাহলে ওকে হঠাৎ এভাবে বললো কেন? না না কি সব ভাবছে ও? স্যার কিভাবে ওর মনের কথা জানবে? ওর মাথাটাই গেছে মনে হচ্ছে।
মনে মনে এগুলো ভেবে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে উঠলো দিশা,“ইয়েস স্যার।”
আরমান আবারও গম্ভীর গলায় বলে উঠলো, “আজ থেকে সবাই মিস মায়ারও অর্ডার মেনে চলবেন এটাই আমার অর্ডার।”
সকলে আবারও সমস্বরে “ইয়েস স্যার” বলে উঠলো।
এরপর আবির মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, “মায়া! তুমি কিছু বলতে চাও? চাইলে বলতে পারো।”
মায়া সায় জানিয়ে বলল, “আমি আমার কাজ বুঝে নিয়ে সকল ডিজাইনারের সাথে মিটিং করতে চাই। আর সকলকে কাজ বুঝিয়ে দিতে আমার এই মিটিং রুমটা প্রয়োজন হবে।”
আরমান:- “মিস মায়া! আপনি আপনার সকল কাজের আপডেট দিয়ে আপনি আপনার মতো কাজ করতে পারেন কোনো অসুবিধা নেই।”
মায়া:- “ঠিক আছে স্যার। আমি আজকের দিনটা সময় চাই। আমি আমার কাজ আজকেই শুরু করবো। আর কালকে সকলের সাথে মিটিং সেরে কালকেই সকলের কাজ বুঝিয়ে দেবো।”
আবির:- “ঠিক আছে? সবাই শুনে নিয়েছেন? তো অফিস টাইম ১০:৩০ এ তো সবাই ঠিক ১১ টা সময় মিটিং রুমে উপস্থিত থাকবেন। কাল মিস মায়া আপনাদের সকলকে আপনাদের কাজ বুঝিয়ে দেবে। আজকের মিটিং এখানেই শেষ হলো। আপনারা সবাই যে যার কাজে যেতে পারেন।”
আবিরের কথা শেষ হতেই সবাই একে একে বেরিয়ে গেলো মিটিং রুম থেকে। মিস দিশা বেরোনোর সময় মায়ার দিকে ঘুরে একবার জলন্ত চোখে তাকালো। তা কারোর চোখে না পড়লেও আরমানের চোখে ঠিকই পড়লো।
সবাই বেরিয়ে যেতেই মিটিং রুমে এখনো রয়ে গেলো আবির, আরমান, মিরাজ আর মায়া।
চলবে….
#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_14
#লেখিকা_সালমা_খাতুন
🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫
আরমান:- “আবির! মায়ার জন্য আমার কেবিনের সামনে যেই কেবিনটা আছে ওটা রেডি করতে বল। আর মিরাজকে আজকের মধ্যেই সব কাজ বুঝিয়ে দে। আর মায়া! তুমি তোমার কাজের প্রতিটা আপডেট আমাকে দেবে।”
মায়া:- “ঠিক আছে স্যার।”
আরমান ওর কথা শেষ করে উঠে চলে গেলো। আবির, মায়া আর মিরাজের উদ্দেশ্য বলল, “চলো আপতত মায়ার কেবিন রেডি করতে বলে তোমাদের পুরো অফিস ঘুরিয়ে দেখাই।”
ওরা সায় জানিয়ে আবিরের সাথে বেরিয়ে গেলো। আবির প্রথমে আরমানের কেবিনের সামনের ছোটো কেবিনটা খুলে দিলো মায়ার জন্য। তারপর ওদের অফিস যারা পরিস্কার করে তাদের একজনকে বলল, পরিস্কার করে দিতে। এরপর ওদেরকে নিয়ে পুরো অফিস ঘুরতে শুরু করলো।
আবির কিছুটা অবাক হলো, আরমান মায়াকে তার সামনের কেবিন টা দেওয়াই। মিস দিশাও হেড ডিজাইনার হলেও ওকে সকল ডিজাইনারের সাথে বসেই কাজ করতে হয়েছে। মিস দিশাকে কোনো পার্সোনাল কেবিন দেওয়া হয়নি। কিন্তু আরমান মায়াকে পার্সোনাল কেবিন দিলো। আর সবথেকে বড়ো কথা হলো, আরমান আর মায়ার কেবিনের মাঝের দেওয়ালটা কাঁচের তৈরি। যার কারণে আরমান চাইলে নিজের কেবিনে বসে মায়ার কেবিনের পুরো দৃশ্য দেখতে পাবে। কিন্তু মায়ার কেবিন থেকে আরমানের কেবিনের দৃশ্য দেখা যাবে না। আর এই বিষয়টা এই অফিসের কেউ জানে না। কারণ আরমানের কেবিনে ওই কাঁচের দেওয়ালটা সব সময় পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে।
আর এটাই আবিরের মাথায় ঢুকছেনা যে মায়াকে ওই কেবিনটা কেন দিলো। আরমান ওই কেবিনটা এমনিই স্পেশাল ভাবে বানিয়ে ছিল। আজ পর্যন্ত ওই কেবিনটা কাউকে দেয়নি আরমান। তাই বিষয়টা আবিরকে ভীষণ ভাবাচ্ছে।
পুরো অফিস ওদেরকে দেখাতে দেখাতে লাঞ্চ এর সময় হয়ে গেলো। তাই আবির ওদের নিয়ে ক্যান্টিনে গেলো। তারপর যে যার মতো লাঞ্চ অর্ডার দিয়ে খেতে শুরু করলো। খাওয়ার মাঝেই আবিরের ফোন বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকাতেই দেখলো স্ক্রীনে আরমানের নাম ভেসে উঠছে। আরমান কল করেছে দেখে, আবির জিভ কাটলো। আরমান নিশ্চয় ওকে খেতে ডাকার জন্য কল করেছে। কারণ ওরা অফিসে প্রতিদিন দুজন আরমানের কেবিনে বসেই লাঞ্চ করে। আজ মায়াদের সাথে থাকায় ওর মাথা থেকে একদম আরমানের কথা বেরিয়ে গেছিল।
মায়া আবিরকে জিভ কাটাতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “কি হলো ভাইয়া? কোনো সমস্যা? কে কল দিয়েছে?”
আবির:- “না কোনো সমস্যা না। আরমান কল দিয়েছে।”
আবির কল রিসিভ করতেই আরমান গম্ভীর গলায় বলল, “আমাকে ছাড়াই লাঞ্চ শুরু করে দিলি?”
ওরা ক্যান্টিনে কোনার দিকে বসে ছিল। আবির উপড়ে দিকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় তাকিয়ে বোকা বোকা হেসে বলল, “সরি ভাই, আসলে তোর কথা মনে ছিল না।”
আবির ওই দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে বলল যেনো আরমান ওইখান দিয়ে ওকে দেখতে পাচ্ছে। মায়া আর মিরাজ অবাক হলো এটা দেখে। ওরাও আবিরের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো, কিন্তু একটা খুব সুন্দর ডিজাইনের লাইট ছাড়া কিছু দেখতে পেলো না।
মিরাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “স্যার ওখানে কি আছে?”
আবির তাড়াতাড়ি ওখান থেকে চোখ সরিয়ে বোকা হেসে বলল, “কোই কিছু না তো।”
মিরাজ:- “আপনি এমন ভাবে ওইদিকে তাকিয়ে কথা বলছেন যেনো মনে হচ্ছে ওইখান স্যার আছে।”
আবির:- “ওহ কিছু না। আমি এমনিই ওইদিকে তাকিয়ে বললাম।”
আরমান গম্ভীর গলায় বলল, “আমার লাঞ্চ এখনো আসেনি। তাড়াতাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা কর।”
এরপর আবির কলে থাকা আরমানকে বলল, “সরি স্যার, আমি আপনার লাঞ্চ এখনি পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।”
এদিকে আরমান নিজের কেবিনে বসে ওর ল্যাপটপ দিয়ে ক্যান্টিনের ফুটেজ দেখছিল জলন্ত চোখে। এই অফিসের প্রতিটি কোনায় হিডেন ক্যামেরা আছে, যা কেউ জানে না। জলন্ত চোখে দেখার কারণ, মায়া। মায়া আর মিরাজ এমন ভাবে গল্প করছে যেনো ওরা কতদিনের চেনা। মায়াকে ওর ভীষণ গায়ে পড়া স্বভাবের মনে হচ্ছে। তা নাহলে সব ছেলেদের সাথেই এমন হেসে হেসে কথা বলতে হবে কেন? আবির কি কম ছিল যে এখন এই মিরাজ এসে হাজির হলো।
এদিকে আবির কল কেটে একজন ওয়েটারকে ডেকে বলল, আরমানের লাঞ্চ টা ওর রুমে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। অনেক দেরি হয়ে গেছে, এখনো আরমানের লাঞ্চ দেওয়া হয়নি।
এরপর ওরা তিনজন আবারও গল্প করতে করতে খাওয়া শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর ওই ওয়েটার এসে জানালো আরমানের লাঞ্চ আজকে বাড়ি থেকে আসেনি। আবির কিছুটা অবাক হলো এটা শুনে। ও তাড়াতাড়ি কল লাগালো রুবিকে। রুবিকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে ও বলল, আরমান স্যার ওকে তো এক মাস কাজ থেকে ছুটি দিয়েছিল। তাই ও ছুটিতে বাড়ি গেছে, স্যারের অনুমতি নিয়েই। আর ওর জায়গায় তো মায়া কাজ করছিল তাই এই দায়িত্ব টা তো মায়ারই ছিল।
আবির কাকে কি বলবে বুঝতে পারলো না। মায়ার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো। মায়া সেটা দেখে বলল, “কি হয়েছে ভাইয়া? খাবার আসেনি কেন বাড়ি থেকে?”
আবির:- “রুবি নেই ও ওর গ্রামের বাড়ি গিয়েছে। আর এই দায়িত্ব নাকি তোমার ছিল।”
মায়া অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু আমি তো এই বিষয়ে কিছু জানতাম না ভাইয়া। শুধু আমাকে কালকে বলেছিল রান্না করে অফিসে আনতে। আর আজ তো আমি অফিসে আছি।”
আবির কি বলবে বুঝতে পারলো না। এতে মায়ার ও কোনো দোষ নেই। মায়াও এতো কিছু জানেনা।
আবির আরমানকে যে প্রতিদিন খাবার দেয় তাকে ক্যান্টিন থেকে খাবার নিয়ে দিতে বলল। এরপর মায়াকে ওর কেবিন দেখিয়ে দিয়ে ওকে ওর কাজ শুরু করতে বলল। তারপর ও মিরাজ কেও একটা ডেস্ক দেখিয়ে দিয়ে ওকে ওর কাজ করতে বলল। তারপর ও গেলো আরমানের কেবিনে।
(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/
তখন খাবার নিয়ে আসা ব্যাক্তি খাবার সার্ভ করছে। খাবার সার্ভ করা হয়ে গেলে সে চলে গেলো। আর আরমান আবিরকে ঢুকতে দেখে ওর দিকে তাকিয়েও কোনো রকম এক্সপ্রেশন দিলো না। চুপচাপ গিয়ে সোফায় বসল। তারপর কোনো রকম এক্সপ্রেশন ছাড়াই আবিরকে বলল, “আজকে বাড়ি থেকে খাবার আসেনি তাই তো?”
আবির মুখে কিছু না বলে শুধু উপড় নীচ মাথা নাড়ালো। আরমান আর কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজের খাওয়াই মন দিলো। আবির কি করবে বুঝতে না পেরে বেরিয়ে গেলো।
_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._
রাত আটটা….
সন্ধ্যা ৬ টার সময় অফিস ছুটি। সকলের সব কাজ সেরে বেরোতে সাতটা বেজে যাই। মানে সাতটার মধ্যেই পুরো অফিস ফাঁকা হয়ে যাই। আবির নিজের কেবিনে বসে কাজ এতোটাই মগ্ন ছিল যে কখন আটটা বেজে গেছে দেখেনি। ও ওর কাজ শেষ বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। দেখলো পুরো অফিস এখন ফাঁকা। ও আরমানের কেবিনে যাওয়ার সময় দেখলো মায়া এখনো এক ধ্যানে কাজ করছে। কোনো দিকে খেয়াল নেই। হয়তো কোনো ড্রেসর ডিজাইন করছে। আর ড্রেস ডিজাইনের কাজ এমনই। একবার শুরু করলে শেষ করা না পর্যন্ত অন্য কোনো দিকে খেয়াল থাকে না। আবিরের মাথায় একটা কুবুদ্ধি খেলে গেলো। ও জানে আরমান এখনো অফিসে আছে। তাই ও আর কাউকে না সারিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো অফিস থেকে।
তারপর একাই নিজের গাড়ি নিয়ে রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিছুদূর গিয়ে কল লাগালো আরমানের নাম্বারে। আরমান রিসিভ করতেই ও বলল, “বলছি শোন না। মায়া এখনো কাজ করছে অফিসে, তুই আসার সময় ওকে একটু সাথে করে নিয়ে আসবি প্লিজ। আমার অনেকক্ষন কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই চলে এসেছি। ও তখনো কাজ করছিল না হলে আমি আমার সাথে করেই নিয়ে আসতাম।”
আরমান:- “তুই তো এই একটু আগে গেলি। আমি স্পষ্ট দেখেছি তুই আমার কেবিনে আসছিলি কিন্তু মাঝপথ থেকে ফিরে গেলি। আর এখন নাটক করছিস?”
আবির:- “আরে নাটক কেন করবো? আমি মায়াকেই দেখতে গিয়েছিলাম। ও তখনো কাজ করছিল। তাই ওকে আর সারাইনি। প্লিজ ওকে একটু তোর সাথে করে নিয়ে আসিস, একা একটা মেয়েকে এই রাতে এইভাবে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তুই তো জানিস বল।”
আবিরের কথা শেষ হতেই আরমান ফোন কেটে দিলো। আর আবির “ইয়েস” বলে চিৎকার করে উঠলো। আবির জানে এখন আরমান কিছুতেই মায়াকে একা ছাড়বে না। আর ও এটাই চাইছিল।
এদিকে আরমান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার সামনের কেবিনে কর্মরত মায়ার দিকে। মায়া কাজ করতে এতোই ব্যাস্ত যে তার কোনো দিকে খেয়াল নেই। আরমান জানে না ও এইভাবে কেন তাকিয়ে আছে। শুধু জানে ওর ইচ্ছে করছে তাই এইভাবে তাকিয়ে আছে। ওই কাঁচের দেওয়ালের পর্দা টা সরানোর পর থেকেই কেন জানি একদম নিজের কাজে মন বসাতে পারছিল না ও। শুধু বার বার মায়ার দিকেই নজর চলে যাচ্ছিল। তাই এখন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
অনেকক্ষন পর আরমান ওই দেওয়ালের পর্দা টা টেনে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ওর ল্যাপটপ ও জরুরি কিছু ফাইল একটা ব্যাগে ভরে নিয়ে, রুমের লাইট অফ করে দিয়ে, দরজা লক করে বেরিয়ে গেলো। তারপর মায়ার কেবিনের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিলো।
দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে মায়া মুখ তুলে তাকালো দরজার দিকে। দেখলো সেখানে আরমান দাঁড়িয়ে আছে।
আরমান মায়াকে ওর দিকে তাকতে দেখে বলে উঠল, “কাজের দায়িত্ব নিয়েছো বলে কি সারারাত কাজ করবে? বাড়ি যাবার ইচ্ছে নেই?”
মায়া তাড়াতাড়ি ওর ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ৮:৫০ বাজে। ও অবাক হয়ে বলল, “আল্লাহ এতোটা সময় হয়ে গেছে? আর আমি খেয়ালই করেনি। আজ আর পাপাকে দেখতে যাওয়া হলো না।”
আরমান:- “তাড়াতাড়ি আসো মিস। অনেক লেট হয়ে গেছে আজ, আবার বাইরের আবহাওয়াও ভালো না।”
মায়াও তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ বন্ধ করে মোবাইল টা ব্যাগে ভরে উঠে এলো। ও আসতেই আরমান ওর ব্যাগটা “ধরো” বলেই মায়ার হাতে ধরিয়ে দিলো। আর মায়া তাড়াহুড়োই ব্যাগটা সামলে নিয়ে বলল, “এই আপনার ব্যাগ আমি কেন নেবো?”
আরমান সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আমি বলেছি তাই নেবো।”
মায়া চেতে গিয়ে আরমানের পিছনে পিছনে যেতে বলল, “বয়েই গেছে আমার আপনার ব্যাগ বোয়াতে। ধরুন আপনি আপনার ব্যাগ।”
আরমান দাঁড়িয়ে গিয়ে পিছনে ঘুরে রাগী গলায় বলল, “একদম চুপ। বেশি কথা বলা আমার একদম পছন্দ না। তাই চুপচাপ আসো।”
মায়া আরমানের রাগী গলার আওয়াজ শুনে একদম চুপসে গেলো। আরমান আবারও সামনের দিকে ঘুরে হাঁটা ধরলো। মায়াও আর কিছু না বলে চুপচাপ আরমানের পিছু নিলো। কিছুটা আসার পর যখন মায়া দেখলো অফিসে ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই পুরো অফিস ফাঁকা তখন মায়া কিছুটা ভয় পেলো। কিন্তু তা নিজের চেহেরায় প্রকাশ করলো না।
মায়া:- “আবির ভাইয়া কোথায়? উনাকে তো দেখছি না?”
আরমান লিফটে প্রবেশ করতে করতে বলল, “আবির অনেকক্ষণ হলো চলে গেছে।”
মায়া অবাক গলায় বলল, “আমাকে না নিয়েই চলে গেলো?”
মায়া তখনো লিফটের বাইরে দাঁড়িয়ে আর আরমান লিফটে। লিফটের দরজা বন্ধ হতে যাচ্ছিল কিন্তু আরমান হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ তোমার আবির ভাইয়া তোমাকে না নিয়েই চলে গেছে। এখন তোমার কি এখানেই থাকার ইচ্ছে আছে?”
মায়া তাড়াহুড়ো করে লিফটে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “নাহ!! এই তো আসছি।”
বলেই লিফটে উঠে গেলো। তারপর নিচে এসে আরমান একজন সিকিউরিটিকে বলল পুরো অফিসের লাইটা অফ করে সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে তালা দিয়ে দিতে। এই অফিসেও অনেক গার্ড আছে গার্ড দেওয়ার জন্য। তাদের মধ্যে বিশ্বস্ত একজনের কাছে এই অফিসের চাবি থাকে। দুইজন আরমানের কথা মতো গেলো সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে। এটা ওদের রোজকার কাজ।
আরমান মায়াকে দাঁড়াতে বলে গাড়ি আনতে গেলো। আরমান গাড়ি নিয়ে এসে মায়াকে উঠতে বললে মায়া বললে, “আমি আপনার সাথে যেতে পারবো না।”
আরমান রেগে বলল, “আমার সাথে একদম নাটক করবে না। অনেক টা দেরি হয়ে গেছে। আকাশের অবস্থাও ভালো না।”
মায়া আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেঘ গুরগুর করছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। আর আলমানের অফিস থেকে মেন রোড যেতে অনেকটা। এখানে কোনো ক্যাবই পাবে না। তাছাড়া ক্যাবের ড্রাইভারের থেকে আরমানই বেশি বিশ্বস্ত।
মায়া এসব ভাবতে ভাবতে আবারো আরমানের ধমকানো আওয়াজ শুনতে পেলো, “এই মেয়ে তোমার কানে কথা ঢোকে না? এসো বলছি!!”
মায়া আরমানের ধমকে চমকে উঠে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসলো। মায়া উঠে বসতেই আরমান গাড়ি স্টার্ট দিলো। এরপর ওরা রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
কিছুদূর যেতে না যেতেই বৃষ্টি শুরু হলো। সাথে ঝোড়ো হাওয়া। আস্তে আস্তে বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগলো। সাথে প্রচন্ড জোড়ে বজ্রপাতে। ওরা অর্ধেক রাস্তা চলেই এসেছে। আর অর্ধেক টা গেলেই বাড়ি পৌঁছে যাবে। ঠিক তখনি ওদের গাড়িটা জোড়ে আওয়াজ তুলে বন্ধ হয়ে গেলো। আর এদিকে মায়া ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। রাস্তার ধারের গাছ গুলো এতো দুলছে যেনো মনে হচ্ছে ভেঙে ওদের গাড়ির উপর পড়বে। এদিকে আরমান অনেক চেষ্টা করার পরও গাড়ি স্টার্ট নিলো না। তখনি কিছুটা দূরে জোড়ে বজ্রপাত হল। আর ওদের সামনেই একটা গাছ মরমর করে আওয়াজ তুলে ভেঙে পড়লো। মায়া ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। অতিরিক্ত ভয় পেয়ে মায়া কাঁপতে শুরু করলো। এমন পরিস্থিতিতে কখনো পরেনি। আর এমনিতেও বজ্রপাতে ভীষণ ভয় পাই মায়া। আগে যখন বজ্রপাত হতো তখন মায়া ওর পাপার একদম বুকের কাছে বসে থাকতো। ছোটো থেকেই বজ্রপাতে ভীষণ ভয় পাই মায়া। এখন তো আবার ওরা মাঝ রাস্তায় আছে। চারিদিকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আসেপাশে গাছ ভেঙে পড়ছে। এতোকিছু দেখে ভয়ে মায়ার প্যানিক অ্যাটাক শুরু হলো। কেমন থরথর করে কাঁপতে লাগলো ও। মুখ দিয়েও আর কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না।
এদিকে আরমানও মায়ার এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলো। মায়া সামনের সিটে আরমানের পাশেই বসেছিল। আরমান তাড়াতাড়ি মায়ার কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে টেনে নিলো। তারপর বলতে লাগলো, “মায়া প্লিজ রিলাক্স। ভয় পেয়ো না। কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো।”
আরমান বলতে বলতেই মায়া জ্ঞান হারালো।
আরমান:- “ওহ নো। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ও। ড্যাম ইট!! এখন কি করি?”
এখনো চারিদিকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি থামার বদলে বাড়ছে। আরমান কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মাথার উপরের গাছ গুলো মনে হচ্ছে ভেঙে পড়বে গাড়ির উপড়ে। না গাড়িতে থাকাটা রিস্কি হয়ে যাবে। দূরে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় একটা ছোটো চায়ের দোকানের মতো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দোকান টা ভিতরে থেকে বন্ধ। আসেপাশে আর কোনো ঘরবাড়ি নেই। চারিদিকে গাছপালা। আরমান আর কিছু না ভেবে মায়াকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে অনেক কষ্টে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো। তারপর হাঁটা ধরলো ওই চায়ের দোকানের মতো ছোট ঘরটির দিকে। মায়ার মাথা টা ভালো করে বুকে চেপে ধরলো। ঝড়ের এতোটাই বেগ যে হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে আরমানের। অতো স্বাস্থ্যবান মানুষটাকেও মনে হচ্ছে উড়িয়ে ফেলে দেবে।
চলবে….