আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব-২৩+২৪

0
11

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_23
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫

নির্বিকার, সদাহাস্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ আবিরের গলায় হঠাৎ করে এক গম্ভীর সুর ধ্বনিত হলো। গোটা কনফারেন্স রুম মুহূর্তেই যেন থমকে গেল।

আবির বলল, “আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, এই ডিলটা আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দীর্ঘ এক সপ্তাহ ধরে আমাদের ডিজাইন টিম, বিশেষ করে সব ডিজাইনার, দিন-রাত পরিশ্রম করে ফাইনাল ফাইলটি তৈরি করেছিল। প্রতিটি ডিটেইলে ছিল নিখুঁত যত্ন। সেই ফাইলটাই আজ হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল। যেটা ছিল আমাদের হেড ডিজাইনার মায়ার কেবিনে।”

তার চোখদুটো কঠিন হয়ে উঠল। কথার ধার যেন আরও তীক্ষ্ণ হলো।
“গত রাতে মিস মায়া এবং মিস তানিশা মিলে সবকিছু চেক করে কেবিনটি নিজ হাতে লক করেছিলেন। নিশ্চিন্ত ছিলেন, ফাইল নিরাপদে আছে। আর আজ মিটিংয়ের সময় যখন ফাইলটি খোলা হলো, দেখা গেলো তার ভেতরে কেবল সাদা কাগজ। ডিজাইনের নামগন্ধ নেই। অথচ ফাইলটা দেখতে ছিল ঠিক আগের মতোই। তার মানে স্পষ্ট—কেউ ইচ্ছে করে আসল ফাইল সরিয়ে, একদম একই রকম দেখতে ফাইল রেখে গেছে। এই কাজ বাইরের কেউ করতে পারে না, অফিসের কারো পক্ষেই এটা সম্ভব।”

এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর আবিরের কণ্ঠে শুনতে পাওয়া গেল দৃঢ় সতর্কবাণী—
“তাই বলছি, যিনি এটা করেছেন, অনুগ্রহ করে নিজে থেকেই সামনে আসুন। তাতে হয়তো কিছুটা ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ থাকবে। কিন্তু যদি আমাদের খুঁজে বের করতে হয়, তাহলে তার শাস্তি হবে ভয়াবহ। আমরা কোনো আপোস করবো না।”

আবিরের এই রূপ কেউ কখনো দেখেনি। গোটা হল ঘর জুড়ে এক অদ্ভুত ভারী নীরবতা। নীরবতা ভেদ করে কেবল ফিসফিস শব্দ—
“কে হতে পারে?”
“কেনই বা করবে এমন কাজ?”
“এই ডিলটা তো আমাদের সবার ভবিষ্যতের প্রশ্ন…”

সবার চোখে স্পষ্ট ভয়। তারা জানে, আরমান স্যারের রাগ কতটা ভয়ানক হতে পারে, বিশেষ করে এমন একটি সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে। পুরো অফিসের এক সপ্তাহের অমানুষিক পরিশ্রম, একেকটা ডিজাইনের প্রতিটি লাইনের পেছনে ছিল নির্ঘুম রাত, চাপ, এবং এক অদম্য ইচ্ছা—এই ডিলটা জেতার।

আর আজ, যখন সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম, তখন আশার আলো হয়ে উঠলেন মায়া।

হ্যাঁ, মায়ার বুদ্ধিমত্তার জন্যই আজ বেঁচে গেছে দলটি। প্রতিটি ডিজাইনের কপি ও আলাদা করে সংরক্ষণ করেছিলো—একটি ফাইলে। আর হারিয়ে যাওয়া ফাইল টা ছিল সেই কপি ফাইল।‌ ঠিক সময়ে মায়া তুলে ধরে আসল ফাইল, যার জন্য কাস্টমারদের সামনে তারা তুলে ধরতে পেরেছে প্রকৃত কাজটি।

ডিলটি তারা পেয়েছে, ঠিকই। কিন্তু সেই বিজয়ের আনন্দে নেই উচ্ছ্বাস, নেই হাসির ছোঁয়া। আছে কেবল শঙ্কা, সন্দেহ আর এক ভয়াবহ প্রশ্ন—
“দলটার মধ্যেই কেউ একজন বিশ্বাসঘাতক!”

মায়া এতোক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। হল রুমের প্রতিটি মানুষের ফিসফিস আওয়াজ যেনো সেই মুহূর্তে ধারাল ছুরির মতো মায়ার শরীরে এসে বিঁধছিল। আবিরের কথাগুলো যেন চারদিকের বাতাসকে ঘন করে তুলেছিল, ঘরটা ভারী হয়ে উঠেছিল সন্দেহ, শঙ্কা আর চাপা উত্তেজনায়।

তবে তার বুকের ভেতর চলছিল একেবারে ভিন্ন এক যুদ্ধ। হেড ডিজাইনার মায়া—চিরশান্ত, কাজপাগল, ঠাণ্ডা মাথার মানুষ—এই মুহূর্তে নিজের ভেতরে অনুভব করছিল এক অদ্ভুত রকম চাপ।

হ্যাঁ, ডিলটা তারা পেয়েছে। নিজের সেই শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্ত—প্রতিটি ডিজাইনের ব্যাকআপ আলাদা করে রাখা—তা আজ তাদের রক্ষা করেছে। কিন্তু এতে কি হৃদয়ের ভার কিছুটা হালকা হয়েছে? মোটেই না।

তার ভেতরে এক জ্বালা জ্বলছিল। যন্ত্রণার সেই নাম ছিল “বিশ্বাসভঙ্গ”।

এই অফিস, এই টিম—এখানে প্রতিটি মানুষকে মায়া জেনেছে, বুঝেছে, ভালোবেসেছে। সবার সাথে শেয়ার করেছেন প্রতিটি সৃষ্টির আনন্দ। অথচ এই টিমের মাঝেই লুকিয়ে আছে কেউ, যে কিনা সবকিছুকে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে।

মায়ার চোখ পড়লো আশেপাশে থাকা সহকর্মীদের দিকে। সকলেই মাথা নিচু করে একে অপরের সাথে ফিসফিস করে কথা বলতে ব্যস্ত, সবার মুখেই আছে কিছুটা ভয়, আতঙ্ক। প্রত্যেকেই যেন নিষ্পাপ, আবার প্রত্যেকেই যেন সম্ভাব্য সন্দেহভাজন।

মায়া অনুভব করল, এক গভীর শূন্যতা বুকের ভেতর জমাট বাঁধছে। তার সবচেয়ে আপন জায়গাটা—তার টিম, তার সহযোদ্ধারা—তাদের মধ্যেই আজ একটা দেয়াল তৈরি হয়ে গেল। সেই দেয়ালের ও পার থেকে আর সহজে কারো চোখে চোখ রাখা যাবে না।

কিন্তু তবুও…

মায়া জানে, এখন ভেঙে পড়ার সময় নয়। এখন নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রেখে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার সময়। কারণ সেই বিশ্বাসঘাতক যদি ধরা না পড়ে, তবে এই বিষ একদিন পুরো দলটাকেই নিঃশেষ করে দেবে।

(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/

মায়ার চোখদুটো ছিল স্থির, কণ্ঠস্বর শান্ত, কিন্তু তাতে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যা প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয়ে ধাক্কা দিলো। ও কাউকে উদ্দেশ্য করে কথা বলেনি, অথচ প্রত্যেকেই বুঝে গেল—এই কথা তার জন্যও।

মায়া বলল—“আমি জানি, আমরা সবাই একসঙ্গে খুব কঠিন একটা সপ্তাহ পেরিয়েছি। রাত জেগে, চাপ সহ্য করে, একসঙ্গে কাজ করেছি আমরা। কারণ আমরা একটা টিম। একটা স্বপ্ন নিয়ে আমরা এগিয়েছিলাম, যেন নিজেদের সেরাটা দিতে পারি।”

ওর কণ্ঠ কিছুটা থেমে গেল, চোখ বুলিয়ে নিলো চারপাশে থাকা চেনা মুখগুলোর দিকে। তারপর আবারও বলল—

“কিন্তু আজকে যা ঘটেছে, সেটা শুধু একটা ভুল নয়। সেটা একটা ইচ্ছাকৃত আঘাত। কোনো বাইরের মানুষ এসে ফাইল বদলে দেয়নি। কেউ একজন—আমাদের ভেতর থেকেই—এটা করেছে। সেই মানুষটা শুধু একটা ডিজাইন চুরি করেনি, সে চুরি করেছে আমাদের বিশ্বাস। আমাদের একে অপরের ওপর নির্ভর করার জায়গাটা।”

মায়ার চোখের দৃষ্টিটা তখন যেন একটু কঠিন হয়ে উঠল। ও সরাসরি কারোর দিকে তাকালো না, তবু যেন তার কথাগুলো এক অদৃশ্য ছায়ামূর্তির দিকে সোজা ছুটে গেল—

“আপনি জানেন আপনি কে। আপনি জানেন, আপনি এটা ইচ্ছা করেই করেছেন। আমি জানি না, আপনি কাকে আঘাত করতে চেয়েছেন—আমাকে? টিমকে? না পুরো কোম্পানিকে। কিন্তু যেটাই হোক, আপনি হয়তো ভুলে গেছেন, আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করি, আপনারও হয়তো পরিশ্রম ছিল ওই ফাইল রেডি করার পেছনে। আপনি এক হিংসার নেশায় হয়তো নিজের পরিশ্রমের কথাটাও ভাবলেন না।
মনে রাখবেন বিশ্বাস কিন্তু একবার ভাঙলে, সেটা আর আগের মতো জোড়া লাগে না।”

এক মুহূর্ত থেমে মায়া নিঃশ্বাস নিলে, তারপর শেষ কথাগুলো উচ্চারণ করল গম্ভীর সুরে—

“আপনি যদি সাহস দেখাতে চান, তাহলে সামনে এসে সত্যি বলুন। ভুল মানুষই করে, কিন্তু নিজের দায়িত্ব স্বীকার করার সাহস সবাই রাখে না। আপনি সেই সুযোগ এখনও হারাননি। এখনো সময় আছে—নিজেকে সরিয়ে না রেখে, সত্যিটা স্বীকার করার। নইলে মনে রাখবেন, সত্য কোনোদিনও চাপা পড়ে না। ঠিকই বেরিয়ে আসে। আর সেদিন আপনার মুখটা যেমন আমাদের সামনে আসবে, তেমনি আপনার আসল চেহারাটাও।”

পুরো হল রুম তখন পাথরের মতো স্তব্ধ। যেন প্রত্যেকেই নিজের ভেতরটা ছুঁয়ে দেখছে—আমি কি তবে সেই সন্দেহের ছায়ায় আছি? আর যিনি সত্যিই দোষী, তার হৃদয়ে তখন হয়তো এক কাঁপুনি, এক অস্থিরতা, সে ভাবছে—“মায়া কি জানে?… কিছু না কিছু সে ঠিকই জানে।”

নাহ… এত কিছু ঘটার পরেও সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি সামনে এলো না। যেনো কোনো কিছুর তোয়াক্কা নেই তার। হয়তো তার আত্মবিশ্বাস এতটাই প্রবল, সে ভাবছে—কাজটা সে এমন নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করেছে যে তাকে চিহ্নিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতই হুমকি ধামকি আসুক, যতই প্রশ্ন উঠুক—কেউ কখনো জানতে পারবে না, এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে সে রয়ে গেছে।

রুমজুড়ে থমথমে এক নিঃশব্দ পরিবেশ। হলঘরে একদিকে সবাই নীরব, অন্যদিকে গাঢ় চিন্তায় ডুবে থাকা আরমান পায়ের ওপর পা তুলে গম্ভীর মুখে বসে আছে। তার চোখেমুখে স্পষ্ট এক ধরনের জেদ ও দৃঢ়তা। মায়া যখন দৃঢ় কণ্ঠে নিজের বক্তব্য রাখছিল, তখন আরমানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন রেডারের মতো একেকজনের মুখের উপর দিয়ে সরে যাচ্ছিল—ধীরে ধীরে, নিখুঁতভাবে। রুমে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ সেই দৃষ্টি টের পাচ্ছিল। আর সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির স্পর্শ যার চোখে লাগছিল, সে যেন কেমন করে মাথা নিচু করে ফেলছিল; এক ধরনের অপরাধবোধ অথবা আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিতে। যেন বোঝাতে চাইছিল—“আমি নই, আমি নির্দোষ… আমি কিছুই জানি না।”

মায়ার কথা শেষ হতেই, আরমান আবার একবার রুমজুড়ে চোখ বুলিয়ে নিলো। তার দৃষ্টি এবার আরও দৃঢ়, আরও অনড়। হঠাৎ করেই সে আবিরের দিকে তাকিয়ে মৃদু একটা ইশারা করলো। সেই ইশারার ভাষা আবির ভালো করেই বুঝে নিলো। গম্ভীর কণ্ঠে সে দাঁড়িয়ে বলল,
“ঠিক আছে… এত কিছু বলার সত্ত্বেও অপরাধী যদি সামনে না আসে, তাহলে এবার আমাদের নিজের পথেই হাঁটতে হবে। আমরা আমাদের মতো করেই খুঁজে বের করবো—কে এর পেছনে আছে।”

আবিরের কণ্ঠে কোনো উত্তেজনা ছিল না, ছিল কেবল দৃঢ়তা। কথা শেষ করেই সে ঘুরে দাঁড়িয়ে অফিসের সিকিউরিটি রুমের দায়িত্বে থাকা দুইজন কর্মীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ টা বের করুন। এখনই আপনারা আপনাদের কাজ শুরু করুন।”

ঘরজুড়ে আবারও ছড়িয়ে পড়ল এক অদৃশ্য আতঙ্কের স্রোত। চাপা উত্তেজনা যেন হঠাৎই নিঃশব্দ বিস্ফোরণের মতো আঘাত হানলো উপস্থিত সকলের মনে। কারও মুখে আর কোনো শব্দ নেই—শুধু হৃদস্পন্দনের শব্দ যেন ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠছে। কেবল অনুভব করা যাচ্ছে, সময় থমকে গেছে এক অজানা রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে। কারণ, এখন খেলার নিয়ম আরমান ও তার টিমের হাতে। বাকিরা কেবল দর্শক।

অল্প কিছু সময় পর, সিকিউরিটি রুমের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজ খুলে দেখায় বিশাল স্ক্রিনে। সকলের দৃষ্টি আটকে গেল সেই দৃশ্যের ওপর।

ফুটেজে দেখা গেল—রাতের কোনো এক নিস্তব্ধ সময়, এক নারী—শাড়ি পরা, অথচ সারা শরীর চাদরে মুড়ে রাখা—চুপচাপ প্রবেশ করছে সিকিউরিটি কন্ট্রোল রুমে। তার চলনে ছিল অসাধারণ সাবধানতা, যেন প্রতিটি পদক্ষেপ আগে থেকেই হিসেব করে রাখা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট দেখা যায়—রুমের দায়িত্বে থাকা দুইজন নিরাপত্তাকর্মী অচেতন হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। নিঃশব্দে ছায়ার মতো নড়াচড়া করতে করতে নারীটি এগিয়ে গেল কম্পিউটার টার্মিনালের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে, নিখুঁত দক্ষতায় তার আঙুলগুলো চলতে লাগলো কিবোর্ডে। তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়—সে নির্দিষ্ট কিছু সিকিউরিটি ফুটেজ, বিশেষ করে নিজের প্রবেশের মুহূর্তগুলো, একে একে মুছে দিচ্ছে। যেন কখনো সে সেখানে ছিলই না।

তবে এখানেই শেষ নয়।

কাজ শেষ করেই, কোনোরকম তাড়াহুড়ো ছাড়াই সে আবার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়। চাদরে মোড়া মুখটি তখনো অদৃশ্য—একটুকুও দৃশ্যমান নয়, যেন ছায়া হেঁটে যাচ্ছে করিডোরজুড়ে।

পরবর্তী ফুটেজে দেখা যায়—সে সোজা গিয়ে দাঁড়ায় মায়ার কেবিনের সামনের করিডোরে। মুহূর্তের মধ্যেই সে করিডোরের লাইট সুইচ অফ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ ডুবে যায় গাঢ় অন্ধকারে—এক রহস্যময় কুয়াশা যেন সমস্তটা ঢেকে ফেলে। এরপর আর কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। সবকিছু যেন নিঃশেষ হয়ে যায় অন্ধকারের চাদরে।

রুমের মধ্যে নিস্তব্ধতা চেপে বসে আরও গভীরভাবে। কারও নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও যেন কানে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। শুধু মাত্র আরমান বাদে রুমে থাকা প্রত্যেকটি ব্যাক্তি গভীর মনোযোগে ফুটেজের প্রতিটি ফ্রেম পর্যবেক্ষণ করে।

ফুটেজের সেই রহস্যময় দৃশ্য শেষ হতেই রুমজুড়ে আবারও ছড়িয়ে পড়লো এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। কেউ কিছু বলছে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন সবার মনে একটাই প্রশ্ন ঘূর্ণি তুলে দিচ্ছে—কে সেই নারী?

ধীরে ধীরে, মায়ার টিমে কাজ করা প্রতিটি ডিজাইনারের চোখ একে একে ঘুরে গেল রুমের এক কোণায় থাকা হুইলচেয়ারে বসে থাকা দিশার দিকে। যেন অজান্তেই সকল সন্দেহের তীর ঠিক তাক করল তার দিকেই।

দিশা প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিল না কী ঘটছে। কিন্তু যখন টের পেল যে একে একে সবার চোখ তার দিকেই নিবদ্ধ, তখন তার শরীরটা মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখলো, আবার নিজের হাত জড়ো করে বসে রইলো—কিন্তু সেই দৃষ্টি থেকে রেহাই নেই।

তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো, কপাল বেয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়তে লাগল। ওর চোখে তখন একটা ভীত-ভীত ভাব—যেন কেউ ওকে অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, আর আলোটা একদম ওর মুখের ওপর ফেলে রেখেছে।

হাত কাপছে, ঠোঁট কাঁপছে—একটা রুমাল বের করে হাত কাঁপতে কাঁপতেই কপালের ঘাম মুছে নিলো সে। তারপর আমতা আমতা করে, গলায় আতঙ্ক মেশানো এক ব্যাকুলতায় বলল,
“তো… তোমরা… আমার দিকে এভাবে তা… তাকাচ্ছো কেন? ওটা… ওটা আমি না… আমি না…”

তার কণ্ঠে ছিল না কোনো জোর, বরং ছিল ভাঙা বিশ্বাস আর প্রচণ্ড অস্থিরতা। কথাগুলো যেন তার নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছিল না—বা হয়তো, সে চাইছিল সবাই বিশ্বাস করুক, যে সে নির্দোষ।

রুমজুড়ে তখনও কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। শুধু দিশার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ আর অনিশ্চিত দৃষ্টি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল চারপাশে।

চলবে….

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_24
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫

সিকিউরিটি কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকা দুইজন নিরাপত্তাকর্মী, যারা ঘটনার রাতে রাত্রিকালীন ডিউটিতে ছিলেন, তাদের চা পৌঁছে দিয়েছিল যে ছেলেটি, সেই ক্যান্টিনবয়ের নাম সমীর। তাকে ডেকে আনা হয়েছে প্রশ্নের মুখোমুখি করার জন্য। পুরো হলরুম তখন স্তব্ধ, টানটান উত্তেজনায় ভর্তি।

আরমান ধীরে চোখ তুলে তাকাতেই, সমীরের শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। তার কণ্ঠে দারুণ ভীতি—স্নায়ু যেন এক মুহূর্তেই ভেঙে পড়েছে। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলে উঠল,
“স..সরি স্যার… আ…আমার ভু…ভুল হয়ে গেছে। দি…দিশা ম্যাম আমায় ও…ঔষধ চায়ের সা…সাথে মিশাতে ব…বলেছিলেন। ভু…ভুল হয়ে গেছে স্য…স্যার…”

কথাগুলো বলতে বলতে সমীর ভেঙে পড়ে আরমানের পায়ের কাছে। ভয়ে, লজ্জায়, অপরাধবোধে—সব কিছুতে যেন তার মনোজগৎ একসাথে চূর্ণ-বিচূর্ণ। সে দুহাতে আরমানের পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। কিন্তু আরমান কেবল একবার শান্তভাবে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো। কোনরকম চিৎকার বা রাগ নয়, শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে—তবে সেই দৃষ্টিতে এমন এক শীতল দৃঢ়তা, যেন শীতল আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কেউ।

সমীর চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়াল, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল একপাশে। আর হলরুমে নেমে এলো নিস্তব্ধতা।

তখন আরমানের দৃষ্টি চলে গেল দিশার দিকে। গভীর, নিরব, স্থির এক দৃষ্টি। যেন চোখের ভাষাতেই সে সবকিছু বলছে—‘তুমি ধরা পড়ে গেছো।’
আর দিশা? আতঙ্কে তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেও তার কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘামের ফোঁটা। কাঁপা কাঁপা গলায় সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল,
“মি…মিথ্যে! এই সব কিছু মিথ্যে! ফা…ফাঁসানো হচ্ছে আমাকে!”

তানিশা তখন একটু এগিয়ে এসে বলল,
“কিন্তু ম্যাম, ওই সিসিটিভি ফুটেজে থাকা মেয়েটি দেখতে ঠিক আপনার মতো। আর কালকে আপনার পরনে যেই শাড়িটা ছিল, সিসি টিভি ফুটেজে মেয়েটির পরনেও ঠিক সেই শাড়িটাই ছিল।”

দিশা ব্যাকুল গলায় সাফাই দিল, “এই ধরনের শাড়ি আমি একা পরি না, তানিশা। এই অফিসে কম মেয়ে কাজ করে না। অনেকেই পড়ে এই রকম শাড়ি। আর ফুটেজে মেয়েটির মুখ তো স্পষ্ট না। তাহলে কিভাবে প্রমাণ হলো মেয়েটি আমি?”

দিশার এই কথার কোনো উত্তর খুঁজে পেল না তানিশা। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তভাবে চুপ করে গেল। আর দিশা সেই মুহূর্তে মনে মনে একটুখানি বিজয়ের হাসি হাসলো—যেন সে ভাবছে, এই যাত্রাই বেঁচে গেল।

কিন্তু আবির চুপ থাকেনি। গলার রাগ চেপে রেখেও দৃঢ় স্বরে বলল,
“মিস দিশা, এখনো প্রমাণ চাই আপনার? সমীর তো বলল—আপনি তাকে গার্ডদের চায়ে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিতে বলেছেন।”

দিশা তখন আরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে উত্তর দিল,
“মিথ্যে বলছে। ওর কাছে কোনো প্রমাণ আছে? আমি ওকে এমন কিছু করতে বলেছি তার কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ?”

সমীর তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, কণ্ঠে গভীর লজ্জা আর গ্লানি।
“স্যার… উনি আমায় বাইরে দেখা করতে বলেছিলেন। প্রথমে বলেছিলেন একটা কাজ দেবেন, যদি ঠিক মতো শেষ করি, তাহলে মোটা অঙ্কের টাকা পাবো। পরে দেখা করতে গেলে উনি এই কাজের অফার দেন। আমি প্রথমে না করি। বাড়িতে আমার অসুস্থ মা আছেন, অনেক টাকা লাগে চিকিৎসায়। উনি সেটা জানতেন। আর সেটার সুযোগ নিয়ে আমাকে রাজি করাই।‌ তারপর আমিও অনেক ভেবে রাজি হয়ে যাই… কিন্তু আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই স্যার…”

আরমান তখনো চুপ। শুধু দিশার দিকে তাকিয়ে আছে এক অনড় দৃষ্টিতে। কোনো কথা বলেনি, কিন্তু সেই চোখে ছিল হাজার কথা। অপরাধের প্রতিটি স্তর যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে বেরিয়ে আসছে দিশার শরীর থেকে।

তবুও, দিশার দম্ভে কোনো ভাঙন নেই। সে চেয়ারে বসে আছে হুইলচেয়ারে, মাথা তুলে—মনে হচ্ছে, যেন কিছুই ঘটেনি। যেন সে একেবারে নির্দোষ।

তখন আবির ডেকে আনালো আরেকজন গার্ডকে। সেই গার্ড জানালো,
“স্যার, আমি গতরাতে যখন টহল দিচ্ছিলাম, তখন দেখি অন্ধকার করিডোর থেকে দিশা ম্যাম বেরিয়ে আসছেন। তখন অফিসে আর কেউ ছিল না।”

ঘরে আবারো চাপা গুঞ্জন। কিন্তু দিশা এবারও পিছপা নয়। চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিল,
“এই অফিসে আমাদের সবারই যেকোনো জায়গায় যাওয়ার পারমিশন আছে। আমি ওই করিডোর দিয়ে যাচ্ছিলাম আরমান স্যারের কেবিনে দেখা করতে। কিন্তু করিডোর থেকেই বুঝি, কেবিনে আলো নেই, মানে উনিও নেই। তাই আমি সোজা চলে যাই নিজের বাসায়। আর এই গার্ড কি বলতে পারবে, আমি কোনো ফাইল বা কাগজ হাতে নিয়ে যাচ্ছিলাম কিনা?”

গার্ড কিছুটা দ্বিধায় মাথা নাড়ল।
“না ম্যাম, কোনো ফাইল বা কাগজ ছিল না।”

এই কথায় দিশার মুখে একটু নিশ্চিন্তের ছায়া। মনে হলো, যেন তার কৌশলী প্রতিরক্ষা কাজ করছে। কিন্তু পুরো হলরুম তখন গা ছমছমে উত্তেজনায় থমথমে। একপাশে সত্যের আতঙ্ক, অন্যপাশে সত্যকে ঢাকার শেষ চেষ্টা। আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আরমান—চুপচাপ, স্থির, কিন্তু ভেতরে যেন বজ্র নেমে আসছে।

আরমান তখনো চুপচাপ বসে ছিল, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিতে ক্রমশ জমে উঠছিল এক ধরণের আগুন। আশেপাশের সবাই বুঝতে পারছিল—ঝড় ওঠার আগের নিস্তব্ধতা এটা। অবশেষে, সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে গম্ভীর, থমথমে কণ্ঠে আরমান বলে উঠল,

“মিস দিশা… আমি নিজেই আপনাকে দেখেছি—মায়ার কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে। আপনি ভেবেছিলেন, আমার কেবিন অন্ধকার ছিল মানে আমি ছিলাম না। কিন্তু আপনি ভুল ভেবেছিলেন। আমি তখনও কেবিনে ছিলাম। শুধু আলো নিভিয়ে চুপ করে বসেছিলাম কিছু জরুরি কাজ নিয়ে। এবং সেই অবস্থাতেই আমি আপনাকে স্পষ্ট দেখতে পাই—আপনি কীভাবে মায়ার কেবিনে ঢুকলেন এবং কিছুক্ষণ পর কেবিন থেকে ফাইল হাতে বেরিয়ে এলেন।”

ঘর যেন এক মুহূর্তের জন্য নিশব্দে জমে গেল। কেউ নড়ল না, কেউ বলল না কিছু।

আরমান থেমে গেল না, তার গলা গম্ভীর থেকেও যেন আরও ভারি হয়ে উঠল।
“আপনি বুঝতে পেরেছিলেন যে গার্ড আসছে। তাই তাড়াহুড়ো করে আপনি ফাইল দুটি—হ্যাঁ, ঠিক আসল ফাইল দুটি, আপনি মায়ার কেবিনের পাশের বন্ধ রুমের দরজার নিচ দিয়ে গলিয়ে দিয়েছিলেন। আপনি হয়তো জানেন, আমার কেবিনের দরজাটা কাঁচের তৈরি। আমি ভেতর থেকে সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি—আপনার একেকটা কাজ, আপনার ভঙ্গিমা, এমনকি আপনার হাতে ধরা ফাইল পর্যন্ত।”

এই কথাগুলো বলতেই দিশার মুখে যতটুকু আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়তা ছিল, সেটা এক মুহূর্তে যেন মিলিয়ে গেল। তার চোয়াল ঢিলে হয়ে এলো, চোখের দৃষ্টি অস্থির হয়ে উঠল। গলার কাছটা শুকিয়ে গেল বলে মনে হলো। ফ্যাকাশে মুখে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরমানের দিকে।

তবুও—অপমান, ভয় আর সত্য প্রকাশের চাপে বিধ্বস্ত হলেও, দিশা সহজে দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। এক মুহূর্ত পরে আবারও কণ্ঠে জোর এনে বলল,
“স্যার, সিসিটিভি ফুটেজের মেয়েটির মুখ তো চাদরে ঢাকা ছিল। আর করিডোরে আলোই ছিল না—সব ছিল অন্ধকার। সেই অন্ধকারে আপনি কিভাবে আমাকে দেখলেন? কীভাবে বুঝলেন ওই মেয়েটি আমি? শুধু শাড়ির মিল থাকলেই কি আমি দোষী হয়ে গেলাম? আমার মতো শাড়ি তো আরও অনেকেই পড়ে। আর আমি তো আগেই বলেছি—আমি এসেছিলাম আপনার সাথে দেখা করতে। কিন্তু কেবিনে আলো না দেখে, মাঝপথ থেকেই ফিরে গেছি। প্লিজ, স্যার… আমার নামে এইভাবে মিথ্যা অপবাদ দেবেন না।”

দিশার গলা কেঁপে উঠলেও, তার মুখভঙ্গিতে ছিল একরকম জেদের ছাপ। কিন্তু তার সেই আত্মরক্ষার চেষ্টা মুহূর্তেই মুখ থুবড়ে পড়ল, যখন আরমানের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। তার হাতের মুঠো এমনভাবে শক্ত হয়ে উঠলো, যেন কোনোভাবে নিজেকে সংবরণ করে আছে। গলার পেশিগুলো টানটান, চোখের দৃষ্টিতে ঝলসে উঠল ক্রোধ।

(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/

আরমানকে এতটা রাগান্বিত রূপে কেউ কখনো দেখেনি। হলরুমে থাকা সবাই মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ নিঃশ্বাস নিতেও সাহস করল না যেন। এমনকি দিশাও ভীত হয়ে উঠেছিল—তার বুকের ধুকপুক শব্দ যেন সে নিজেই শুনতে পাচ্ছিল। কিন্তু মুখে সে কোনো ভয় প্রকাশ করল না। বরং ঠোঁট চেপে ধরে, চোখের ভাষা দৃঢ় রাখার শেষ চেষ্টা করল। কিন্তু সেই মুহূর্তে সবারই বোঝা হয়ে গেল—ভেতরে ভেঙে পড়েছে দিশা।

আরমান ধীরে ধীরে, নিশ্চুপ এক গম্ভীরতায় তার সামনে রাখা ছোটো টেবিল থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। চারদিক তখন নিঃশব্দ—শুধু সেই ফোনের স্ক্রিনে ওর আঙুলের নড়াচড়া। যেন সেই নীরবতাই ছিল ঝড়ের পূর্বাভাস।
কিছু মুহূর্ত ফোনে ঘাঁটাঘাঁটি করে, আরমান সেটা এগিয়ে দিলো আবিরের দিকে। কণ্ঠে দৃঢ় সংকল্প ঝরে পড়লো গম্ভীর স্বরে,
“ভিডিওটা ওই স্ক্রিনে দেখানোর ব্যবস্থা কর।”

আবির চোখে এক ঝলক রাগ আর কৌতূহল নিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলো সিকিউরিটি রুমের দায়িত্বে থাকা দুই ব্যক্তির দিকে। তাদের মধ্যে একজনের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এই ভিডিওটা ওই স্ক্রিনে চালাও। সবাই যেন দেখতে পায়।”

হলরুমে তখন নিস্তব্ধ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই, নিঃশ্বাস ফেলার আওয়াজটাও যেন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সবাই অপেক্ষায়—ঠিক এখন কী সামনে আসতে চলেছে।

এদিকে দিশার হৃদস্পন্দন যেন কানে কানে গর্জন করছে। বুকের ভেতরটা হঠাৎ করেই খালি খালি লাগছে। ও জানে, কিছু একটা ভয়ংকর সামনে আসতে চলেছে। আর তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে সেই আশঙ্কায়।

মায়া, পুরোটা সময় ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক হয়ে। মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই, চোখ দুটো শূন্যতার দিকে তাকিয়ে। যেন এই মুহূর্ত তার কাছে কোনো বাস্তব নয়—একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র।

হঠাৎই বড়ো টিভি স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠলো। আর তাতে ফুটে উঠল সেই ভিডিও—যেটা কারো কল্পনা নয়, বাস্তবের নির্মম দলিল। ভিডিওতে দেখা গেল, দিশা—চাদরে নিজেকে জড়ানো অবস্থায়—মায়ার ডেস্কে রাখা ফাইলের পাশে দুইটি হুবহু একরকম দেখতে ফাইল বার করে আলতো করে রেখে দিলো। এরপর নিখুঁতভাবে আসল ফাইলগুলো উল্টে-পাল্টে দেখে, নিজের আনা ফাইলদুটো সেই জায়গাতেই রাখলো—একটুও ব্যতিক্রম না রেখে। তারপরে চাদরটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে, আসল ফাইলদুটো বুকের কাছে চেপে ধরে ধীরে ধীরে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।

এই সবকিছু এতই নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে যে ভুল করার কোনও অবকাশই রইলো না। কারণ, সেই মুহূর্তে দিশার মাথা থেকে চাদর সরে গিয়েছিল, এবং তার মুখ—পুরোপুরি স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে ক্যামেরার চোখে।

দিশা নিশ্চিন্ত ছিল, মায়ার কেবিনের ক্যামেরা বন্ধ। আর তাই সে একটুও নিজেকে ঢাকার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু তার সেই হিসেবে একটু ভুল ছিল। কেবিনের ভিতর আলো জ্বলছিল। আর সেই জন্যই আরমানের ফোনে ভিডিওটা যেন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, মুখ, হাবভাব, ফাইল পাল্টানোর পুরো প্রক্রিয়া, সব।

হলরুমে যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে ছিল সবাই। কারো চোখ এক মুহূর্তের জন্যও টিভি স্ক্রিন থেকে সরেনি। আগেও অনেকে মনে মনে বিশ্বাস করেছিল, এই কাজ দিশারই। কিন্তু আজ সেই বিশ্বাস পেলো অমোঘ সত্যতার শীলমোহর। এখন? এখন আর কোনো ব্যাখ্যা, অজুহাত কিংবা অস্বীকার করার জায়গা নেই দিশার সামনে।

তার ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। চোখে একরাশ আতঙ্ক—আর যেন বুঝতে পারছে, এবার তার শেষ রক্ষাও আর হলো না।

কিন্তু আবির ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারলো না ভিডিও টা ঠিক কোথা থেকে কিভাবে করা হয়েছে। এই নিয়ে আর কেউ মাথাও ঘামালো না। সবাই এখন এটা দেখতে চাই মিস দিশা এখন কি করে।

কাল রাতে মায়া এসেছিলো আরমানের কেবিনে। হাতে ছিল সেই গুরুত্বপূর্ণ আসল দুইটি ফাইল, যেগুলো পরদিন সকালে প্রেজেন্টেশনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু কেবিনে ঢুকে দেখে, আরমান সেখানে নেই—ওয়াশরুমে ছিল সে সময়। আর এদিকে আবির ওর জন্য নীচে অপেক্ষা করছে। সেই কারণেই মায়া কিছু না বলেই আলমারিতে ফাইলগুলো রেখে নীরবে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। আরমান সেই মুহূর্তের কোনো কিছুই জানতে পারেনি।

ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে, আরমান পুরো রুমের সকল লাইট অফ করে দেয়, তারপর অন্ধকারে নিজের চেয়ারে এসে বসে পড়ে। এক দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে দেয়। বাইরে যেনো নীরব রাত, আর ভেতরে তার অন্তর্দহন।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে, ওর মনটা ডুবে ছিল একটাই নামেই—পিচ্চি মায়াবতী।

যাকে সে ওই অ্যাক্সিডেন্টে এর পর আর কোনোদিন চোখে দেখেনি, যার কণ্ঠ আর কখনো শোনেনি, যার সাথে আর অন্য কোনো স্মৃতির বাঁধন গাঁথা হয়নি—তবুও সেই মেয়েটাই ওর হৃদয়ে ঝড় তুলে চলেছে প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
কে সে মায়াবতী? শুধু একবার…একটিবার চোখে দেখলেই কি এই দীর্ঘ ব্যাকুলতা শান্ত হবে?
সেই অচেনা মেয়েটি এখন যেন তার জীবনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বুকের ভেতরে যেন আগুন জ্বলছে, যা নিভবে শুধু তখনই—যখন একবার, মাত্র একবার সে নিজের পিচ্চি মায়াবতীকে নিজের বুকে চেপে ধরতে পারবে।

ঠিক তখনই হঠাৎ করেই কিছু একটা অস্বাভাবিক ঠেকলো ওর। চোখ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও যেন টের পেলো—আলো নিভে গেছে করিডোরের। তৎক্ষণাৎ চেয়ারে সোজা হয়ে বসে পড়ে আরমান। সতর্ক চোখে তাকিয়ে রইলো কেবিনের কাঁচের দরজার ওপারটায়।

ধীরে ধীরে একটা ছায়ামূর্তি করিডোর দিয়ে এগিয়ে এলো মায়ার কেবিনের দিকে। নিঃশব্দে, সুনিপুণভাবে। তারপর সেই ছায়া চাবি দিয়ে মায়ার কেবিনের লক খুলে ভিতরে প্রবেশ করল।

আরমানের মুখে তখন এক বিন্দু শব্দ নেই, কিন্তু চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে। ও নিঃশব্দেই টেবিলের ওপর রাখা রিমোটটা তুলে নিলো। এক মুহূর্তও দেরি না করে, সেটা নিশানা করে একটি নির্দিষ্ট বোতামে চাপ দিলো।

সাথে সাথেই ওর কেবিন ও মায়ার কেবিনের মাঝের কাঁচের দেয়ালে টানা থাকা ভারী পর্দাটা সরে গেলো। অন্ধকারের পেছনে লুকিয়ে থাকা সেই মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো ওর চোখের সামনে।

মিশ দিশা….দিশা তার চাদরের নিচে লুকানো মুখ আর হাতের সাবধানে ধরা ফাইল—সব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আরমানের চোখে।

আরমান এক মুহূর্তও দেরি না করে নিজের মোবাইলে রেকর্ডিং চালু করে দেয়। ঠাণ্ডা মাথায়, নিখুঁতভাবে সেই সমস্ত অনুচিত কর্মকাণ্ডের প্রত্যেকটা মুহূর্ত ধারণ করে রাখে সে।

মায়ার কেবিনে আলো জ্বলায় চোখের সামনে সব কিছু দিনের মতো পরিষ্কার। দিশা মায়ার কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই আরমানও সাথে সাথে উঠে এসেছিল চেয়ার ছেড়ে। তারপর দিশাকে হঠাৎ করে ফাইল দুটো পাশের রুমের দরজার নীচ দিয়ে ভরে দিতে দেখে থেমে যাই।‌ আরমানও তারপর বুঝতে পারে কেউ একজন হঠাৎ করে চলে আসায় দিশা এমনটা করেছে। কি মনে করে আর যাই না আরমান। ঘুরে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে বাঁকা হাসি হাসে শুধু।

_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..

একদিন পর
সকাল ৮ টা….

স্নিগ্ধ শান্তির আবরণে মোড়া এক নিঝুম সকাল। আকাশের রোদ যেমন কোমল আর মৃদু, তেমনি আরমানের মনেও আজ এক অদ্ভুত প্রশান্তি খেলা করছে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে মনোরম, ফুরফুরে এক বাতাস, যা যেন তার মনের আবেগগুলোকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে নরম পরশে।

আরমানের বিএমডব্লিউ- গাড়িটা ড্রাইভ করছে ড্রাইভার। পিছনে বসে থাকা আরমানের চোখে মুখে খুশির আলো খেলা করছে। পাশে বসে থাকা বিরাটও যেন তার আনন্দে শরিক। ড্রাইভারকে বিরাট অ্যাড্রেস দিয়ে দিয়েছে। রাতেই কথা হয়েছিল বিরাটের সাথে—আজই তারা মাইশার কাছে যাবে। অনেকদিনের এক অদেখা স্বপ্ন আজ বাস্তব রূপ নিতে যাচ্ছে।

আরমানের হৃদয়ে তোলপাড় করা এক উত্তেজনা। অবিশ্বাস আর বিশ্বাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে যেন বোঝার চেষ্টা করছে—সবটা কি সত্যি? এতদিনের প্রতীক্ষা, এত হৃদয়ের ব্যাকুলতা—সব কিছুর পর আজ সে দেখতে পাবে ওর পিচ্চি মায়াবতীকে। চোখের সামনে, একেবারে জীবন্ত রূপে। মনে হচ্ছিল, এই অনুভূতিটা হয়তো কোনো রূপকথার চেয়ে কম নয়। সব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে ওর।

পিচ্চি মায়াবতীর কথা মনে হতেই আরমানের চোখের সামনে ভেসে উঠলো মায়ার সেই নিষ্পাপ মুখটা—স্নিগ্ধ, সরল, কোমল। মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা, যেদিন অফিসে ধরা পড়েছিল দিশার কুচক্র। তীব্র রাগে ফুসে উঠেছিল আরমান। চেয়েছিল, দিশাকে এমন এক শাস্তি দিক যাতে সে শুধু অফিস থেকেই না, পুরো কর্মজীবন থেকেই একরকম নির্বাসিত হয়। কারণ, কোনো সাধারণ ভুল ছিল না সেটা—তা ছিল হিংসা আর প্রতারণার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।

দিশা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে স্বীকারও করেছিল—তার এই অপকর্মের একমাত্র কারণ ছিল মায়ার প্রতি তার হিংসা। দিশা চেয়েছিল, মায়ার ডিজাইন সময়মতো জমা না দিতে পারার সুযোগে তাকে অপদস্থ করা হোক, আর আরমান তাকে অফিস থেকে বের করে দিক। কিন্তু মায়া, যার হৃদয় ছিল দয়ায় পরিপূর্ণ, সে কি আর পারলো কঠোর হতে? নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়ের পরও দিশার অনুশোচনায় গলে গিয়েছিল তার কোমল মন। বহুবার অনুরোধ করেছিল আরমানকে—দিশাকে যেন এই কঠিন শাস্তি না দেওয়া হয়।

আরমানের মনে দ্বন্দ্ব ছিল। সে জানত, ন্যায়ের খাতিরেই উচিত ছিল দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া—যাতে আর কেউ এমন সাহস না পায়। কিন্তু মায়ার কাতর অনুরোধ, দিশার বারবার ক্ষমা চাওয়া—সব মিলিয়ে সে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়েছিল। শেষে শুধু অফিস থেকেই দিশাকে বহিষ্কার করা হয়।

এইসব ভাবতে ভাবতেই আরমানের মুখে ফুটে উঠলো এক শান্ত, স্নিগ্ধ হাসি। আজ সে যাচ্ছেই তো তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মুখটিকে দেখতে—পিচ্চি মায়াবতীকে। স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে দাঁড়িয়ে, হৃদয়ে এক অজানা আবেগের ঢেউ নিয়ে…

চলবে….