#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_25
#লেখিকা_সালমা_খাতুন
🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫
ভাবনার অতল গহ্বরে ডুবে থাকা আরমান হঠাৎই টের পেল গাড়ির গতি ধীরে ধীরে কমে আসছে। বাস্তবে ফিরে এল সে। বাইরের দৃশ্যপটে চোখ ফেলতেই তার ভ্রু কুঁচকে উঠল—গাড়ি এসে থেমেছে এক ভীষণ চেনা, অথচ এই মুহূর্তে অপ্রত্যাশিত জায়গায়।
চোখে পড়লো বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে থাকা শতাধিক মানুষের ভিড়। শোকস্তব্ধ মুখ, ফিসফাস কথোপকথন, কারো চোখে অশ্রু, কারো মুখে গভীর বিষাদ। কেউবা নিঃশব্দে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, দৃশ্যটা যেন জানাজার আগে শেষ অপেক্ষার মুহূর্ত—আকাশে যেমন থমকে থাকা বিকেল, তেমনি নিঃশব্দ চারপাশ, ভারী বাতাসে মিশে থাকা ইন্নালিল্লাহির সুর।
আরমানের বুকের ভেতর যেন হঠাৎই এক অজানা আশঙ্কার কাঁপুনি বেজে উঠল। চোখ কুঁচকে সে তাকাল আশপাশে—এত ভিড়, এত শোকের ছাপ… কিন্তু কেন? কী হচ্ছে এখানে?
গাড়ি থেমে গেছে। ড্রাইভার জানালার কাঁচ নামিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করল পথচারী এক ভদ্রলোককে। ভদ্রলোক নিচু গলায় কী যেন বললেন। আরমান শুনতে পেল না—সে তখন পুরোটাই অবাক হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে তার ভাবনার ভেতর।
পাশে বসা বিরাটের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল সে। বিরাট স্থির মুখে জানাল, “এখানেই আছে আপনার মাইশা।”
শুনেই বুকের মধ্যে কেমন এক ঝাঁকুনি খেয়ে উঠল আরমান। “মাইশা? মানে… আমার পিচ্চি মায়াবতী?” মনে-মনে নিজেকে প্রশ্ন করল সে। এক মুহূর্তের জন্যে যেন গলার স্বর হারিয়ে ফেলল।
গাড়ির দরজা খুলে ধীরে ধীরে নামল সে। আশপাশের দৃশ্যগুলো যেন ধোঁয়ার মতো ছায়া হয়ে ঘিরে ধরেছে তাকে। বাতাস ভারী, ভারি নিঃশ্বাসের মতো। গেট পেরিয়ে পা বাড়াতেই অদ্ভুত এক চেনা গন্ধে কেঁপে উঠল তার ভেতরটা। এই গন্ধটা… এই দেয়ালের ধুলো… এই উঠোনের ধূসর ছায়া…—সব কিছুই যেন বলে দিচ্ছে, সে ভুল ভাবেনি। হ্যাঁ, এটা মায়াদের…বাড়ি।
তবুও, তবুও যেন বিশ্বাস হতে চায় না। সে তো ওর পিচ্চি মায়াবতীর কাছে যাচ্ছিল—একটা নতুন জীবন, এক নতুন শুরুর আশায়। তাহলে এখন এই মৃত্যুর বাতাবরণ কেন?
আরমান থমকে দাঁড়াল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাড়ির সদর দরজার দিকে—সেখানে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। এই নিস্তব্ধতা যেন সমস্ত শব্দ শুষে নিয়েছে।
বিরাট এবার আরমানের কাঁধে আলতো হাত রাখল। বলল, “চলুন… ভেতরে চলুন। আপনার মাইশা… ও ভেতরেই আছে।”
আরমান ধীরে ধীরে এগোল, বুকের ভেতর ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করছে আবেগের জলোচ্ছ্বাস। পা যেন ভারী, দৃষ্টি ঝাপসা। উঠোন পেরিয়ে ঘরের ভেতরে পা রেখেই, তার চোখে পড়ল সেই দৃশ্য… যা কোনো ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
ঘরের মাঝখানে একটি মৃতদেহ শায়িত। মাথার কাছে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে এক নারী—মাটির মত নিঃশব্দ, পাথরের মত স্থির। চোখে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ, কাজল গলে গাল বেয়ে নেমেছে নিচে। এলোমেলো চুল, বিবর্ণ চেহারা, স্তব্ধ দৃষ্টি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের শূন্যতার দিকে—যেন কিছুরও হিশেব নেই, কোনো হিসেব রাখাও যেন জরুরি নয় এখন।
আরমানের পা থেমে গেল।
বিরাট এবার সামনে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দেখাল—”ওই যে… আপনার মাইশা।”
বিরাটের হাতের আঙ্গুল অনুসরণ করে তাকালো আরমান। তারপর চোখ পড়ল মেয়েটির উপর। আর তাতেই যেনো ওর পায়ের নীচে থেকে মাটি সরে গেলো ওর। চমকে উঠলো ও। যেনো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। থমকে গেলো আরমানের হৃদয়। এটা..এটা কিভাবে সম্ভব?? বিরাটের হাতের আঙ্গুল এর সোজাসুজি থাকা মেয়েটি আর কেউ নয়…মায়া…হ্যাঁ মেয়েটি মায়া। মায়া তালুকদার। যে এখন নিজের বাবার লাশের মাথার কাছে বসে আছে।
তবে আজ, সেই চিরচেনা কোমল মুখে নেই হাসি, নেই আলোর ঝিলিক। আছে শুধুই নিঃশেষ এক শোক, এক গভীর বিষণ্নতা। যেন পৃথিবীর সব আলো, সব শব্দ থেমে গেছে এই মুহূর্তে, এই বাড়িটায়।
আরমানের মনে হলো, কোনো স্বপ্ন নয়… এ যেন দুঃস্বপ্নও নয়—এ এক নির্মম, কষ্টদায়ী বাস্তবতা, যার মুখোমুখি হওয়ার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না, একেবারেই না। মায়া…মায়া ওর পিচ্চি মায়াবতী…এটা কিভাবে সম্ভব? আর মায়ার বাবা…কিভাবে কি হলো কিছুই বুঝতে পারছে না আরমান। কাল পর্যন্ত তো সবই ঠিকঠাক ছিল। আর হ্যাঁ, কাল রাতে তো মায়া আর বাড়ি ফিরেনি পার্টি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাওয়ার পর। মাইশার সাথে দেখা করার খুশিতে ওর মায়ার কথা আর মনেই ছিল না।
কাল রাতে অফিসে আরমান একটা পার্টি রেখেছিল ডিল ফাইনাল হওয়ার খুশিতে। সবই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ পার্টি চলাকালীন মায়া তাড়াহুড়ো করে অফিস থেকে বেরিয়ে যাই।
_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..
কাল সন্ধ্যায়…..
নিজের প্রাইভেট কারের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরমান। দৃষ্টি তার একহাতে স্ক্রল করতে থাকা ফোনে। পরনে কালো ছোঁয়া আভিজাত্য—কালো ফুল-স্লিভ শার্টটি প্যান্টে নিখুঁতভাবে ইন করা, পায়ে চকচকে কালো লেদার জুতো, কব্জিতে মানানসই কালো রিস্টওয়াচ। জিমে গড়া সুঠাম দেহে পোশাকটা যেন ঠিক তার মতোই—দৃঢ়, রুচিশীল, আর নিঃশব্দে আধিপত্য বিস্তারকারী।
আজ অফিসে ডিল ফাইনাল হওয়ার খুশিতে পার্টি রাখা হয়েছে—থিম ‘ব্ল্যাক’। সেই অনুযায়ী সবাইকেই কালো পোশাকে দেখা যাবে আজ।
পরিবারের বড়ো সদস্যরা আগেই একটি গাড়িতে রওনা দিয়েছে। বাকি শুধু পাঁচ জন—সামিরা, মায়া, রুবি, আবির এবং আরমান। আর রুবি? সে প্রথমে যেতে চায়নি, কিন্তু আরমান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে—”এই বার আর তোমার ইচ্ছে নয়, এটা আমার অর্ডার।”
রুবি জানে, আরমান তাকে কী চোখে দেখে। স্নেহে গড়া এক নিঃস্বার্থ বন্ধন, যেনো আপন বোনের চেয়েও কম কিছু না।
গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আবির হঠাৎ বিরক্ত সুরে বলে উঠল, “এই মেয়েরা এতো দেরি করে কেনো বুঝি না। এত আটা-ময়দা মুখে মেখে কি হবে? শেষে তো সব মুছেই ফেলতে হবে!”
পিছন থেকে সামিরা এসে তার পিঠে হালকা ধাক্কা দিল। চোখে-মুখে রাগ নিয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আবির ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ কপালে তুলে ভয় পাওয়ার অভিনয় শুরু করল—
“আল্লাহ্! ভূত! পেত্নী!”
সামিরা ও রুবি তখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, দু’জনেই কালো গাউনে সেজে উঠেছে অনন্য রূপে। আবির ইচ্ছা করেই তাদের খেপাতে চেয়ে, চোখ টিপে সামিরাকে উদ্দেশ্য বলে,”তুই কি সামিরা? নাকি সামিরার রুপে কোনো পেত্নী?”
শুরু হলো তর্ক—একটা বাক্যর পর আরেকটা। খুনশুটি মিশ্রিত ঝগড়ায় গড়াচ্ছে পরিস্থিতি। ঠিক তখনই আরমান বিরক্ত মুখে ফোন নামিয়ে গলা কাঁপিয়ে বলে উঠল—”চুপ কর দুজনেই। সব এভাবে ফালতু বিষয় নিয়ে ঝগড়া না করলেই নয়?”
হঠাৎ সন্ধের হালকা বাতাসের সাথে একটা মিষ্টি গন্ধ এসে নাকে বারি খেলো আরমানের। মুখ তুলে সামনে তাকাল ও। আর সাথে সাথেই আরমানের দৃষ্টি আঁটকে গেলো—কিছুটা দূরে, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে মায়া। যেনো সময় থেমে গেছে ওখানেই।
কালো রঙের সূক্ষ্ম কাজ করা শাড়িতে মোড়ানো মায়ার উপস্থিতি যেন এক অপার্থিব সৌন্দর্যের আবরণ। কোনো গাঢ় সাজ নয়, কোনো কৃত্রিমতা নয়—একটি নিখাদ, স্বাভাবিক, পরিপূর্ণ নারীসুলভ সৌন্দর্য নিয়ে সে এগিয়ে আসছে। চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে নিঃশব্দ এক কোমলতা, কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ। গলায় চেনের সাথে ছোট্ট একটা লকেট, কানে কালো পাথরের ছোটো ছোটো দুল। আর কানের পাশে চুলে গোঁজা একটা কৃত্রিম লাল গোলাপ। যা মায়ার সৌন্দর্য দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। চুলগুলো হালকা ঢেউ খেলানো, খোলা রেখে যেনো আবছা বাতাসে মায়ার পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
মায়ার শাড়ির ঝলক আর মুখাবয়বের স্থিরতার মধ্যে এক ধরনের মায়াবী ছায়া—যা চোখ সরাতে দেয় না। পুরো দৃশ্যটা যেনো সাদা-কালোর ক্যানভাসে আঁকা এক নিঃশব্দ কবিতা।
আরমানের ভিতরে বাজতে থাকা ছন্দ হঠাৎ থেমে গেল। ও অবাক হয়ে তখনো মায়ার দিকে তাকিয়ে। এদিকে মায়া এসে তখন সামিরা দের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। কিন্তু আসেপাশে কোনো আওয়াজ আরমানের কানে পৌঁছাচ্ছে না। যেনো থমকে গেছে সবকিছু। শুধু ওর চোখে ভাসছে মায়ার মিষ্টি হেসে ঠোঁট নাড়ানো।
আরমানের ঘোর কাটে আবিরের আকস্মিক ধাক্কায়। ধাক্কা খেয়েই যেন বাস্তবে ফেরে সে। চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্ত ভঙ্গিতে আবিরকে জিজ্ঞেস করে— “কি? ধাক্কা দিচ্ছিস কেন?”
আবিরের মুখ থমথমে। গলায় গম্ভীরতা স্পষ্ট। ধীর স্বরে জবাব দেয় সে— “ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন ওর দিকে? তোর কি সেই অধিকার আছে?”
ততক্ষণে মেয়েরা তিনজনই গাড়িতে উঠে বসেছে। আবিরের কথায় আরমানের মনটা যেন ঝাঁকুনি খায়। মুখটা গম্ভীর হয়ে আসে। সত্যিই তো… কেন তাকিয়ে ছিল সে মায়ার দিকে? ও তো ভালোবাসে তার পিচ্চি মায়াবতীকে— একমাত্র সেইই তো তার হৃদয়ের ঠিকানা।
এই মায়ার সৌন্দর্যে ভুলে গেলে চলবে না। মায়া তো সেই, যাকে সে স্পষ্ট করে না জেনেই ডিভোর্স দিয়েছিল, শুধু তার মায়াবতীর জন্য। আজ সে কীভাবে এভাবে তাকাতে পারে মায়ার দিকে? এই দৃষ্টিই তো মানায় না তাকে।
নিজের ভেতরের এই টানাপোড়েনে নিজেকেই ধিক্কার দিতে থাকে আরমান। গুমরে ওঠে মন। বিরক্তি আর রাগে মুখটা আরও কঠিন হয়ে ওঠে ওর। নীরবে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে।
আবির একপাশে দাঁড়িয়ে বাঁকা হাসি দেয়। যেন ধীরে ধীরে ওর পরিকল্পনা বাস্তবের রূপ নিচ্ছে। তারপর দরজা খুলে আরমানের পাশের সিটে উঠে বসে ও।
আরমান গাড়ি স্টার্ট দেয়, গাড়ি ধীরে ধীরে ছুটে চলে অফিসের পথে।
তবুও— না চাইলেও— মিররের দিকে চোখ চলে যায় আরমানের। আর সেখানে ধরা দেয় মায়ার মুখ। সেই মায়ার সহজ সরল হাসি, কথার মাঝে মিষ্টি ভঙ্গি, সামনে আসা ছোটো চুল গুলো হাতের সাহায্যে কানের পাশে গোঁজা— সবকিছু মিলিয়ে এক অপূর্ব দৃশ্য যেন।
কিন্তু ঠিক তখনই আবিরের বলা কথাগুলো বিদ্যুতের মতো কানে ঝনঝনিয়ে বাজে— “তোর কি সেই অধিকার আছে?”
আরমানের ভিতরে ক্ষোভ জেগে ওঠে— নিজের প্রতি, মায়ার প্রতিও। ছলনাময়ী মনে হচ্ছে ওর মায়াকে—হ্যাঁ ছলনাময়ী। তা নয়তো কি? কেন মায়া এল আবার তার জীবনে? কেন সবকিছু আবার এভাবে এলোমেলো করে দিচ্ছে সে?
ভাবনার গভীরে ডুবে থাকা অবস্থাতেই অফিসের সামনে এসে গাড়ি থামায় আরমান। এক মুহূর্ত বসে থাকে চুপচাপ। তারপর ধীরে দরজা খুলে নেমে পড়ে। পেছনের সিট থেকে বাকিরাও নামছে তখন।
চোখের কোণে একবার মায়ার দিকে তাকায় আরমান—চট করে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়। গাড়ির দরজা বন্ধ করে সে চাবিটা বাড়িয়ে দেয় পাশে দাঁড়ানো নিরাপত্তাকর্মীর দিকে। সংক্ষেপে বলে,
— “গাড়িটা পার্ক করে দিন।”
সঙ্গে সঙ্গেই আবির ব্যস্ত হাতে ফোন বের করে মেসেজ টাইপ করতে থাকে। মিরাজকে জানিয়ে দেয়, তারা এসে গেছে।
সবাই মিলে অফিস ভবনের ভিতরে প্রবেশ করে। পাঁচষজনে একসাথে লিফটে উঠে উপরের তলার দিকে রওনা দেয়।
লিফটের ভিতরে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা। মায়া আর আরমান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। পেছনে আবির, রুবি ও সামিরা।
উপরে পৌঁছে হল রুমের দরজার সামনে এসে থামে তারা। আরমান মৃদু ঠেলায় দরজা খুলে দেয়।
এরপর আরমান আর মায়া দুজনে একসাথে যখন ভেতরে পা রাখে, তখনই—
ফটাস!
আচমকা রঙিন কনফেটির বৃষ্টি নেমে আসে উপরের দিক থেকে। ঝলমলে কাগজের টুকরো আর ফুলের পাপড়ি যেন তাদের অভ্যর্থনার জন্য অপেক্ষায় ছিল। চারপাশে করতালি, উচ্ছ্বাস।
চারপাশের সবার চোখে একরাশ উজ্জ্বলতা। মায়া আর আরমানকে ঘিরে যেন তৈরি হয়েছে এক আনন্দময় আবহ।
এই গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস ডিল সফল করার পেছনে মায়ার ভূমিকা কেউই অস্বীকার করতে পারে না। বরং সবার বিশ্বাস—আরমানের এই সাফল্যের পেছনে মায়ারই সবচেয়ে দৃঢ় অবদান রয়েছে।
আর তাই, আজ সবার কাছেই মায়া আরও সম্মানীয়, আরও গুরুত্বপূর্ণ।
সবাই একে একে এগিয়ে এসে আরমান ও মায়ার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করতে থাকে। উষ্ণ অভ্যর্থনায় মুখর হয়ে ওঠে পরিবেশ। মিস্টার ড্যানিয়েলও বাদ যান না; তিনিও উপস্থিত সেখানে। আরমানের সঙ্গে সামান্য কথা বলে তিনি ধীরে ধীরে মায়ার দিকে এগিয়ে আসেন। কিন্তু মায়া যেন তাকে দেখেও দেখেনি—চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য দিকে চলে যায়, যেন তার উপস্থিতি সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।
এই আচরণে মিস্টার ড্যানিয়েল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আবির তার অস্বস্তিকর অবস্থাটি লক্ষ করে মৃদু হেসে ফেলে। আবিরের এই চাপা হাসি সামিরার দৃষ্টিসীমা এড়িয়ে যায় না। সে সঙ্গে সঙ্গে আবিরকে কনুই দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “হাসছো কেন?”
আবির রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু বলে, “পরে বলব।”
এরপর কেক কাটা শুরু হয়। সবাই রিকোয়েস্ট করে আরমান আর মায়াকে একসাথে কেক কাটার জন্য। প্রথমে মায়া কিছুটা না না করে তারপর রাজি হয়ে যাই। মায়া গিয়ে আরমানের পাশে দাঁড়ায়, ওদের সামনে একটা টেবিলে কেক রাখা। আরমান টেবিল থেকে চাকুটা হাতে তুলে নেয়, তারপর অপেক্ষা করে মায়ার হাত দেওয়ার।
মায়া তার কাঁপা কাঁপা হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে দেয় আরমানের হাতের দিকে। আরমানের হাতের কাছে হাত রাখতেই কিছুটা কেঁপে উঠে মায়া। সেই কম্পন আরমান নিজেও অনুভব করে। ও একবার আরচোখে তাকায় মায়ার দিকে। মায়া তার মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
মায়ার হাত আরমানের হাতে স্পর্শ করতেই আবারও খুব চেনা লাগে এই স্পর্শ আরমানের। যেনো খুব কাছের কেউ, খুব নিজের আপন কেউ। যেনো ও এই স্পর্শই হন্নে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে, যেটা একমাত্র ওর পিচ্চি মায়াবতীর কাছেই গেলেই পাবে। তবে মায়ার এই স্পর্শে কেনো এমন অনুভূতি হয়? মায়া কাছে থাকলে, পাশে থাকলে, কেন মনে হয়, যে ওর পিচ্চি মায়াবতী ওর কাছেই আছে?
সামিরা:- “কি হলো ভাইয়া? কেকটা কাটো!”
সামিরার কথায় ঘোর কাটলো আরমানের। ও নিজের মাথা থেকে সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে কেক কাটাই মন দিলো। ধীরে ধীরে চাকু বসালো কেকের উপর, কেক কাটা শেষ হতেই মায়া তাড়াহুড়ো করে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। এরপর আরমান একটু কেক নিয়ে প্রথমেই ওর মা কে খাইয়ে দিলো। এখানে আরমানের মা, চাচী, বাবা, চাচা, সবাই আছে। আরমান একে একে ওর বাড়ির সবাইকে কেক খাইয়ে দিলো, তারপর একটু কেক নিয়ে মায়ার দিকে এগিয়ে গেলো আরমান। বলল— “থ্যাঙ্কস মায়া, এই ডিলটা তোমার জন্যই পাওয়া সম্ভব হয়েছে। তার জন্য সত্যিই তোমাকে মন থেকে থ্যাঙ্কস জানাচ্ছি। এইভাবেই আরো এগিয়ে যাও।”
(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/
কথা গুলো বলে আরমান তার হাতে থাকা কেকটা মায়ার মুখের সামনে তুলে ধরলো। মায়া আরমানের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে, শুধু একটু মিষ্টি হেসে ছোট্ট করে মুখ খুলে কেকটা মুখে নিলো। তখনি সামিরা ওদের কাছে এসে হালকা কাশি দেওয়ার নাটক করে বলল— “উহুম! উহুম! বলছি ভাইয়া, আমারও কি একটু সৌভাগ্য হবে তোমার হাতে কেক খাওয়ার।”
আবির হঠাৎ করে ওখানে উদয় হয়ে সামিরার ঘাড়ে এক হাত রেখে উদাষ হওয়ার ভান করে হতাশ গলায় বলল—“আমাদের সেই সৌভাগ্য নেই রে শামুক। সেই সৌভাগ্য নেই।”
সমিরা চট করে রেগে গিয়ে, ঝাড়ি মেরে আবিরের হাত নিজের ঘাড় থেকে সরিয়ে রাগী গলায় বলল— “তোমাকে বলেছি না, যে আমাকে শামুক বলবে না। তাও আবার এই এতো লোকের মাঝে।”
কথাটা বলেই সামিরা মুখ ঝামটা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। এদিকে আবির একজন ওয়েটারের থেকে একটা প্লেটে কেক নিয়ে সামিরার কাছে গিয়ে বলল, “আরে আমার শামুক সোনা…ওহ সরি সরি আমার সামিরা সোনা রাগ করে না। আমাদেরকে কেক খাওয়ানোর মানুষ নেই তাই চল আমরা একে অপরকেই খাওয়ায়।”
এই বলে আবির কিছুটা কেক নিয়ে সামিরার মুখে তুলে দিলো। সামিরাও কেক খেয়ে নিজে কিছুটা কেক প্লেট থেকে তুলে নিয়ে আবিরকে খাইয়ে দিলো। আবির সামিরার দেওয়া কেক মুখে নিয়ে চোখ বন্ধ করে উপভোগ করছিল। এই ফাঁকে সামিরা, কিছুটা দুষ্টু হেসে প্লেট থেকে বাকি কেক টুকু নিয়ে আবিরের পুরো মুখে লেপে দিলো। তারপর দুষ্টু হেসেই বললো— “এটা আমাকে শামুক বলার শাস্তি।”
বলেই সামিরা দুই হাতে নিজের গাউন তুলে মারলো ছুট। ওকে আর পাই কে? ও খুব ভালো ভাবে জানে, আবির ওকে পেলে ওরও অবস্থা খারাপ করে দেবে।
আরমান সামিরাকে ছুটতে দেখে ওর উদ্দেশ্য চিল্লিয়ে বলল— “ছুটকি আস্তে, পড়ে যাবি তো।”
এদিকে মায়া প্রথমে সামিরার কথায় লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু পরে আবির আর সামিরার কান্ড দেখে জোড়ে জোড়ে হেসে ফেললো। এদিকে আরমান সেই হাসির দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো। আর নিজের মুখেও ফুটে উঠল মৃদু হাসি।
আর এদিকে আবির তো পুরো বোকা বনে গেলো। ও অবাক হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো সামিরার যাওয়ার পানে। নিজের সাথে কি হলো বিষয়টা বুঝতে পারলো না ও। রুবি এগিয়ে এসে মুখ টিপে হেসে আবিরের দিকে টিস্যু পেপার এগিয়ে দিয়ে বলল— “মুখটা পরিষ্কার করে নিন, সবাই হাসছে আপনাকে দেখে।”
আবির বোকার মতো রুবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো— “কিন্তু কেন হাসছে সবাই?”
রুবি আবিরের এমন বোকা বোকা ভাব দেখে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল—“কারণ এই মাত্র সামিরা আপনার মুখে কেক লেপে দিয়ে গেছে।”
আবির— “ওহ হ্যাঁ তাই তো।”
এই বলে ও রুবির থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে নিজের মুখ পরিষ্কার করতে শুরু করলো। একটা পেপারে হলো না। রুবি আরো কয়েকটা টিস্যু পেপার এগিয়ে দিলো। আবির কিছুটা দুষ্টু হেসে রুবিকে উদ্দেশ্য করে বলল— “টিস্যু পেপার না দিয়ে, তোমার ওই গায়ে থাকা ওরনার আঁচল টা দিলে ভালো হতো। একদম ফিল্মি ফিল্মি রোমান্টিক ব্যাপার হয়ে যেতো।”
রুবি মুখ বেঁকিয়ে বলল— “ বয়েই গেছে আমার আপনাকে ওরনার আঁচল দিতে। খেতে পেলে শুতে চাই। হুঁ।” 😏😏
কথা গুলো বলেই রুবি আবিরকে উদ্দেশ্য করে মুখ বেঁকিয়ে অন্য দিকে চলে গেলো। এদিকে আবির বাঁকা হেসে বলল— “আজ না দিলেও একদিন তো দিতেই হবে রুবি ডার্লিং। সেদিন নিজে তুমি আমার মুখ মুছিয়ে দেবে তোমার ওই আঁচল দিয়ে।”
পার্টিতে সবাই যে যার মতো আনন্দ করতে ব্যস্ত। চারিদিক কালো সাজে সজ্জিত। কিছুটা অদ্ভুত হলেও ভীষণ সুন্দর লাগছে পুরো হলরুম টা। তার উপর এই পার্টিতে থাকা প্রতিটা ব্যাক্তিও কালো সাজে সজ্জিত। চারিদিকে ঝিলিমিলি লাইট, হালকা মিউজিক, সাথে ড্রিংকের গ্লাসের টুংটাং শব্দ, মানুষের গুঞ্জন, সব মিলিয়ে ভীষণ অদ্ভুত রকমের সৌন্দর্য খেলা করছে পুরো রুমটাতে।
আরমান মাইক হাতে নিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে কিছু বক্তব্য দিলো। তার মধ্যে ছিল মায়াকে নিয়েও কিছু কথা। যে মায়ার বুদ্ধিমত্তার জোড়ে ওর এই ডিলটা ফাইনাল হয়েছে। মায়াকে সবার সামনে স্পেশাল থ্যাঙ্কস জানালো আরমান। সাথে সকল ডিজাইনারকেও, যার যারা এই প্রজেক্টে কাজ করেছে। এরপর আরমান নিজের বক্তব্য শেষ করতেই আবির মাইক হাতে নিলো। তারপর বলতে শুরু করল— “হ্যালো এভরিওয়ান! পার্টিটা কেমন যেনো মরা মরা লাগছে। চলুন আমরা সবাই একটা ডান্স+গেম খেলে পার্টিটা একটু মাতিয়ে তুলি। কি বলেন সবাই??”
সকলে সমস্বরে ইয়েস বলে চিল্লিয়ে উঠলো। আবির আবারও বলতে শুরু করলো— “চলুন তাহলে শুরু করি। এখানে ডান্স হবে। তবে সবাই যে যার মতো পার্টনার চুস করতে পারবে না। এটাই হচ্ছে মেন টুইস্ট। মেয়েরা সবাই, মানে যারা যারা পার্টিসিপেট করত চাই তারা তারা একটা টেবিলে নিজের নিজের কোনো জিনিস রাখবে। সাথে সেই জিনিসের সাথে একটা কাগজে নিজের নামটাও লিখে রাখবে। নাহলে মেয়েরা ঝগড়া শুরু করে দিতে পারে যে, এটা আমার আর ওটা আমার না। আর রাখার সময় কোনো ছেলে দেখতে পাবে না। তারপর ছেলেরা গিয়ে টেবিল থেকে একটা করে মেয়েদের রাখা জিনিস তুলে নেবে। সেটা যেই মেয়ের হবে সেই মেয়ে হবে তার ডান্স পার্টনার। কি সবাই বুঝেছেন তো।”
আবারও সবাই একসাথে চিল্লিয়ে উঠলো হ্যাঁ বলে। একজন মেয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠলো— “আর এই ডান্সে আমাদের বস আরমান স্যারকেও জয়েন করতে হবে। কি বলো সবাই?”
সকল ময়েরা হ্যাঁ বলে চিল্লিয়ে উঠলো। আবির ভয়ে ভয়ে তাকালো আরমানের দিকে। আরমানের মুখ কিছুটা গম্ভীর। তবে সবাই একসাথে অনেক রিকোয়েস্ট করাই আরমান গম্ভীর মুখেই মাথা নাড়ালো। আরমানকে রাজি হতে দেখে সব মেয়েরা খুশি চিল্লিয়ে উঠলো। সবাই চাই তার ডান্স পার্টনার যেনো আরমান হয়। এই নিয়ে সবাই মনে মনে দোয়া করতে লাগলো। সবাই ভীষণ এক্সসাইটেড।
মায়া প্রথমে রাজি হয়নি এতে পার্টিসিপেট করার জন্য। কিন্তু রুবি, আবির, সামিরা আর তানিশার জোর জবরদস্তিতে ওকেও রাজি হতে হলো। সকল মেয়েদের সাথে নিজেও গেলো ওর একটা জিনিস রাখতে। তারপর ফিরে এসে আবারও নিজের জায়গায় দাঁড়ালো। এদিকে মিস্টার ড্যানিয়েল মায়াকে পার্টিসিপেট করতে দেখে উনি নিজেও দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে পার্টিসিপেট করতে চাইলো। উনি এখনো পর্যন্ত একবারো মায়ার সাথে কথা বলার সুযোগ পাইনি। আসলে সেই সুযোগ মায়া নিজে থেকেই দেয়নি। ড্যানিয়েল এর পিএ বলল, হিন্দি গানে ডান্স হবে। কিন্তু উনি তো হিন্দি তেমন একটা বুঝেন না। কিন্তু তবুও উনি এই ডান্সে পার্টিসিপেট করবেই করবে। বাই চান্স যদি মায়াকে পার্টনার হিসেবে পেয়ে যাই তাহলে উনার ভাগ্য খুলে যাবে। উনি মায়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে মায়াকে উদ্দেশ্য করে আস্তে আস্তে বলল, “হেই মাইহা। ঠুমি খি রেকেচো?”
আবির হঠাৎ করে মাইকের মধ্যেই ড্যানিয়েল কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, “এটা চিটিং মিস্টার ড্যানিয়েল। এভাবে তো বলা যাবে না। যান যান মেয়েদের সবার রাখা হয়ে গেছে। আপনি গিয়ে এবার নিয়ে আসুন কিছু একটা। যান”
আবিরের এই ভাবে মাইকের মধ্যে বলায় সবাই শুনতে পেলো। আর এতে সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো, মায়া এবং ড্যানিয়েল এর উপর। এতে মিস্টার ড্যানিয়েল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।
এদিকে আরমান রাগী চোখে তাকালো মায়ার দিকে। মায়া আরমানের রাগী দৃষ্টি নিজের উপর পরতে দেখে ঝটপট ওখান থেকে কেটে পড়লো।
আরমান মা, বাবা, ছোটো আব্বু, ছোটো আম্মু ওরা সবাই চলে গেছে ইতিমধ্যেই। আরমানের মায়ের মনে হয়েছে সবাই মায়াকে নিয়ে একটু বেশি বেশি করছে। কিন্তু উনি কিছু বলতেও পারছে না। কারণ উনি নিজেও জানেন এই ডিল ফাইনাল হওয়ার পিছনে মায়ার অনেক বড়ো হাত আছে। তাই উনি বিরক্ত হয়ে চলে গেছে। সাথে ছোটো আম্মু, ছোটো আব্বু, এবং আরমানের ড্যাডও চলে গেছে। ছোটোরা নিজেদের মতো আনন্দ করুক এইভেবে।
এরপর শুরু হলো আসল খেলা। সবাই প্রথমেই আরমানকে যেতে বলল টেবিল থেকে একটা জিনিস তুলতে। আরমান ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো টেবিলের দিকে। আর এদিকে সকল মেয়েদের হার্টবিট বেড়ে গেছে। তারা চাই যেনো তাদের জিনিস আরমান তুলুক। সবাই টান টান উত্তেজনা নিয়ে তাকিয়ে আছে এটা দেখার জন্য যে আরমান কি তোলে।
আরমান ধীরে ধীরে টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে, টেবিলে থাকা কৃত্রিম লাল গোলাপ এর ক্লিপ টা তুলে নিলো। সাথে একটা ছোট্ট কাগজও আছে। আর সেই কাগজে এই ক্লিপ এর মালিকের নাম লেখা। আরমানকে ওই গোলাপ এর ক্লিপ টা তুলতে দেখে অনেক মেয়ে হতাশ হলো। কারণ তাদের জিনিস আরমান তুলেনি।
আবির আরমানের কাছে গিয়ে কাগজের টুকরা টা নিয়ে নিয়ে নিলো। তারপর সেটা খুলে দেখতেই ওর মুখ খুশিতে চকচক করে উঠলো। মাইকে অ্যানাউন্স করলো সেই মেয়ের নাম— “আপনারা হয়তো অনেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন এটা জানার জন্য যে কে সেই ভাগ্যবতী যে আরমান স্যারের ডান্স পার্টনার হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তো চলুন বলেই দিই, সেই ভাগ্যবতী হলো, মিস মায়া তালুকদার। আপনাদের হেড ডিজাইনার।”
সবাই তালি দিয়ে হই হই করে চিল্লিয়ে উঠলো। কিছু মেয়ে তো রাগে হিংসায় জ্বলে উঠলো। আর এদিকে মায়া আবিরের মুখে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলো। থমকে গেলো ওর চারিপাশ। ওর হার্টবিট এতোটাই বেড়ে গেলো, যেনো নিজেই শুনতে পাচ্ছে ও। ও এতোক্ষণ দেখেনি আরমানের হাতে থাকা জিনিসটা, ও এবার চোখ তুলে তাকালো আরমানের হাতের দিকে।
আবির:- “মিস মায়া প্লিজ এগিয়ে আসুন। আপনার জন্য আমাদের স্যার অপেক্ষা করছে। আর স্যারের হ্যাঁ হাতে থাকা গোলাপের ক্লিপটা নিজে হাতে পড়িয়ে দিতে হবে স্যারকে। আর তার পর শুরু হবে ডান্স।”
আবারও সবাই একসাথে ইয়েস বলে চিল্লিয়ে উঠলো। আরমান সেই গোলাপের ক্লিপ হাতে ধরে মুখে কোনো এক্সপ্রেশন ছাড়াই ডান্স ফ্লোরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে ভয়ে মায়ার বুক কাঁপছে। সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। আর বাকিরা সবাই মায়া মায়া ধ্বনি তুলেছে নিজেদের মুখে। তানিশা আর সামিরা মায়াকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে আরমানের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। মায়ার মাথা তখনো নিচু। লজ্জায় সংকোচে দুই হাত এক জায়গায় করে মুচড়া মুচড়ি করছে ও।
আরমান ধীরে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মায়ার পিছনে একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। এরপর বাঁ হাত দিয়ে মায়ার কানের কাছের চুল আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে ক্লিপ লাগিয়ে দিলো।
মায়া আরমানের স্পর্শ পেতেই চোখ বন্ধ করে নিলো। কেঁপে উঠলো ও। সেই কম্পন আরমানও ভালোভাবেই টের পেলো।
ক্লিপ পড়ানো শেষ হতেই আরমান মায়ার কোমরে হাত দিয়ে এক টান দিয়ে নিজের বুকর সাথে মিশিয়ে নিলো। চারিপাশের উজ্জ্বল লাইট অফ হয়ে গেলো। শুধু একটা স্পট লাইট গিয়ে পড়লো আরমান আর মায়ার উপর। সকলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। মিউজিক সিস্টেমে বেজে উঠলো রোমান্টিক গান।
(গান)
Teri meri meri teri prem kahani hai mushkiqul
Do lazon mein ye bayaan naa ho paae
Ek ladka aur ek ladkee kee ye kahaani hai naee
Do lazon mein ye bayaan naa ho paae
আর সেই গানের তালে নাচ শুরু করলো আরমান ও মায়া। মায়া তো পুরো ঘোরের মধ্যে আছে। কি হচ্ছে ওর সাথে ও কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। আরমান মায়ার অবস্থা বুঝে ওকে এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়লো না। নিজের মতো করে গানের তালে নাচিয়ে নিলো ওকে। নাচ শেষ হলো এমন এক দৃশ্যে যেখানে, মায়া আরমানের হাতে পড়ে আছে। আরমানের দুই হাত মায়ার কোমরে। মায়ার এক হাত আরমানের গলায় পেঁচিয়ে। ওরা দুজনেই নিচের দিকে কিছুটা ঝুঁকে আছে। দুজনের দৃষ্টি এক অপরের চোখে আঁটকে। যেনো দুজনেই ঘোরের মধ্যে আছে।
ওদের দুজনের ঘোর কাটলো সকলের করতালি ও চিল্লাচিল্লির আওয়াজে। ওদের নাচ দেখে সবাই মুগ্ধ। একেবারে যেনো কোনো কাপেল নাচ করলো। মায়া তাড়াতাড়ি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে গিয়ে একটা চেয়ারে বসলো। ওর বুক ধড়ফড় করছে এখনো। ভীষণ হাঁপিয়ে গেছেন। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি পান করলো।
মায়ার কাছে তানিশা, রুবি, সামিরা এগিয়ে গেলো। ওরাও ওই টেবিলে গোল হয়ে বসে পড়লো। তারপর শুরু করলো নাচের প্রশংসা।
এদিকে আরমানও নিজের অ্যাটিটিউড বজায় রেখে ডান্স ফ্লোর থেকে গিয়ে নিজের বরাদ্দকৃত সোফায় গিয়ে বসে পড়লো পায়ের উপর পা তুলে। তারপর ও ওখান থেকেই খেয়াল করলো, মায়া সামিরার থেকে নিজের ফোনটা নিয়ে দেখতেই চমকে উঠলো। তারপর কাউকে কিছু না বলেই হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো হল রুম থেকে।
এদিকে আবিরও পরবর্তীতে যারা ডান্স করবে তাদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ও নিজেও হঠাৎ মায়াকে এভাবে দৌড়ে যেতে দেখে মিরাজের হাতে মাইক ধরিয়ে দিয়ে মিরাজকে অনুষ্ঠান কন্টিনিউ করতে বলে মায়ার পিছু পিছু ছুটে গেলো। আরমান নিজেও দেখতে চেয়েছিল বিষয় টা কি হলো। তবে তখনি বিরাটের কল আসায় ও অন্য দিকে চলে যাই।
_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..
বর্তমান….
বিরাটের হাতের আঙ্গুল অনুসরণ করে তাকিয়ে আরমান বিরবির করে উঠলো— “মায়াই…মাইশা। আমার পিচ্চি মায়াবতী।
চলবে….
#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_26
#লেখিকা_সালমা_খাতুন
🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫
বর্তমান….
বিরাটের হাতের আঙ্গুল অনুসরণ করে তাকিয়ে আরমান বিরবির করে উঠলো— “মায়াই…মাইশা। আমার পিচ্চি মায়াবতী।
তৎক্ষণাৎ আবারও বিরাট হাতের আঙ্গুল তুলে আরমানের ভুল শুধরিয়ে বলে উঠলো— “নাহ স্যার। আপনার বুঝতে ভুল হচ্ছে….মায়ার পাশে মায়াকে আগলে ধরে বসে থাকা মেয়েটি হচ্ছে মাইশা…মাইশা তালুকদার। মায়ার চাচাতো বোন.. যাকে আপনি এতো বছর ধরে খুঁজছেন।”
এটা শুনে আরমান একবার বোকা চোখে বিরাটের মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের আঙুল অনুসরণ করে আবার তাকালো মায়ার পাশে থাকা মেয়েটির দিকে। চোখে ধাক্কা মারল সেই দৃশ্য।
পাথরের মত নির্জীব হয়ে বসে থাকা মায়া তার পিচ্চি মায়াবতী নয়, বরং তার পাশে বসে থাকা অন্য এক মেয়ে—যে মায়াকে জড়িয়ে ধরে চোখে অশ্রু নিয়ে বসে আছে..সে ওর পিচ্চি মায়াবতী। আবারও একবার আরমানের পায়ের নিচের মাটিটা দুলে উঠল—মায়া মাইশা নয় এটা জেনে।
বিরাটের বলা কথাটা আবারও কানে বাজলো— “মায়ার পাশে মায়াকে আগলে ধরে বসে থাকা মেয়েটি হচ্ছে মাইশা…মাইশা তালুকদার। মায়ার চাচাতো বোন.. যাকে আপনি এতো বছর ধরে খুঁজছেন।”
মাইশা! যার নাম সে হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছে বছরের পর বছর— যার জন্য সে নিজে থেকে মায়াকে না জেনে, না ভালোভাবেই দেখেই ডিভোর্স দিয়েছে, যেই নামটি ছিল ওর হৃদয়ের এক অংশ…এই কি সেই মেয়ে?
কোই চোখে চোখ পড়তেই তো কিছু ভাঙল না? কাঁপল না তার হৃদয়? কোই একবারও তো মনে হচ্ছে না যে ওই মাইশা নামের মেয়েটি ওর পিচ্চি মায়াবতী? ওর যে আগে অনুভূতি হতো, যে ওর পিচ্চি মায়াবতীকে খুঁজে পেলে এক ছুটে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরবে, তবে কোই এখন তো সেই ইচ্ছা হচ্ছে না…মাইশা নামের মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরতে।
বরং একটা ফাঁকা অনুভূতি… যেন এই মাইশা নামের মেয়ের মধ্যে কোথাও নেই সেই পিচ্চি মায়াবতী, সেই অনুভূতি, সেই চোখ।
ওর তো এই সময় ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে মায়াকে জড়িয়ে ধরতে, সান্তনা দিতে, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে যে, তোমার বাবা চলে যাচ্ছে তো কি হয়েছে? আমি তো আছি। সারা জীবন আগলে রাখবো তোমায়।
কিন্তু না.. ও পারছে না। ওর যে এই অধিকার নেই। এই অধিকার ও নিজেই হারিয়েছে। কিন্তু মাইশা.. মাইশা কি আদেও সেই মেয়ে যে ওর জান বাঁচিয়েছিল। সেই পিচ্চি মায়াবতী। কোই তার সাথে তো কোনো মিল পাচ্ছে না ও।
আরমান স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে।
চেহারায় বিষণ্নতা, শোক, ক্লান্তি—সবই আছে।
কিন্তু তবুও… কোথাও যেন কিছু নেই।
“এই মেয়েটি কীভাবে হতে পারে সেই পিচ্চি মায়াবতী?”
মন বলছে, না।
হৃদয় আরও জোরে বলে উঠল—না।
কিন্তু যুক্তি? নাম, বয়স, পরিচয়, আর সেই নেম প্লেট—সব মিলিয়ে বলে দেয়, এ-ই সেই মাইশা। তবুও… তবুও মন মানতে চায় না।
একটু দূরে বসে থাকা মায়ার দিকে এক ঝলকে তাকাতেই বুকের ভিতর কেঁপে উঠল কিছুটা।
আশ্চর্য! এই চোখ… মুখের গঠন…এত চেনা…
একদম সেই দিনের মতো, যেদিন এক ছোট্ট হাত তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে ছিল।
তখনো ওর বুকের গভীরে এমন কাঁপন উঠেছিল,
যেমনটা এখন হচ্ছে… মায়ার দিকে তাকিয়ে।
আরমান নিজের মনে চমকে উঠল।
“কি ভাবছি আমি? মায়া কি…”
নিজের চিন্তা নিজেই তাড়িয়ে দিতে চাইল।
কিন্তু তা যেন একবার ঢুকে গেলে আর যায় না।
ভিতরে ভিতরে আরমান একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল। তবে এটা জানে—এই মেয়েটির সামনে দাঁড়ালে তার বুকের ভিতরে একরকম অদ্ভুত ঢেউ ওঠে, ঠিক যেমনটা ওঠে সেই মায়াবতীর কথা মনে পড়লে। কোই সেই ঢেউ তো মাইশাকে দেখে উঠছে না….
বিরাটের কণ্ঠে ঘোর কাটলো আরমানের
“স্যার, আমি এবার যাই। আমার কাজ শেষ। পৌঁছে দিয়েছি আপনাকে আপনার মাইশার কাছে। এখন আমাকে যেতে হবে।”
আরমান দ্বিধান্বিত গলায় কিছুটা আমতা আমতা করে বলল— “আচ্ছা বিরাটা তুমি সিউর তো যে এটাই মাইশা? না মানে, ওই নেম প্লেট এর অধিকারী মাইশা আর এই মাইশা এক তো?”
বিরাট— “হ্যাঁ স্যার! আমি একশো পার্সেন্ট সিউর। আর সিউর এর কথা আসছে কোথা থেকে? আমি সব ভালো ভাবে খোঁজ লাগিয়েছি, আর আমার কাছে সব প্রমাণও আছে যে ওই নেম প্লেট এর মাইশাই এই মাইশা। আমার এই কেসের পুরো ফাইল প্রমাণ সহ রেডি আছে, আমি আপনাকে পাঠিয়ে দেবো। এখন আমাকে যেতে হবে স্যার। আমার আরো অন্য কেস আছে। আর হ্যাঁ দরকার হলে আপনি একবার মিস মাইশার সাথে কথা বলে নিন। এখন আমি যাই।”
আরমান ঠিক আছে বলে বিরাটকে বিদায় দিলো। কিন্তু ও তখনো বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে ওর সাথে। মাথার ভিতর সব কিছু যেনো গুলিয়ে যাচ্ছে। এলোমেলো লাগছে সবকিছু। আজ যেনো ওর পিচ্চি মায়াবতীকে পেয়েও পেলো না। অথচ সেই মেয়েটা ওর সমানেই আছে, কিন্তু তাকে মানতে পারছে না ও কিছুতেই। আরমান দুই হাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরলো। ঠিক তখনি ওর কাঁধে কেউ একজন হাত রাখলো। পিছন ফিরে দেখলো আবির দাঁড়িয়ে আছে।
আবির আরমানকে এতোটা বিচলিত, বিদ্ধস্ত দেখে ওর কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো— “কি হয়েছে তোর? ঠিক আছিস? আর এখানে কখন এলি?”
আরমান নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল— “ঠিক আছি আমি। এই একটু আগেই এসেছি। কিভাবে হলো এসব?”
আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “কাল রাতে পার্টি চলাকালীন হসপিটাল থেকে কল করা হয়েছিল মায়াকে। ওর বাবার অবস্থা হঠাৎ করেই ভীষণ খারাপ হয়ে যাই। মায়া প্রথমে পার্টিতে ব্যস্ত থাকায় কল এসেছিল সেটা হয়তো খেয়াল করেনি। পরে হসপিটাল থেকে ওকে ম্যাসেজ দেওয়া হয়েছিল, ‘ওর বাবার অবস্থা খারাপ তাই যেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ও হসপিটালে পৌঁছায়।’ মায়া ওই ম্যাসেজ দেখেই পার্টি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসি। ওকে ওভাবে যেতে দেখে আমিও ওর সাথে বেরিয়ে আসি। আইসিইউতে নেওয়া হয়েছিল উনাকে। সারারাত মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ভোরের দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন উনি।”
(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/
আরমান কী বলবে, বুঝে উঠতে পারল না। বুকের ভেতরটা কেমন জ্বলে যাচ্ছে—মায়ার কথা মনে পড়তেই। এতো কষ্ট, এতো যুদ্ধ করেও বাবাকে শেষরক্ষা করতে পারল না মেয়েটা। একবার তাকালো মায়ার দিকে। বাবার মাথার পাশে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে আছে সে। মুখটা নিঃশব্দ, চোখ দুটি শূন্য দৃষ্টিতে বাবার মুখের উপর স্থির। গাল বেয়ে শুকিয়ে যাওয়া জলরেখার দাগ এখনো স্পষ্ট। চোখদুটো ফুলে লাল হয়ে উঠেছে, ঘুমহীন দীর্ঘ রাতের মতো ক্লান্ত আর বিষাদে ভরা। চুলগুলো এলোমেলো, অবিন্যস্ত—যেন নিজের খেয়ালই নেই। মাথায় সেই লাল গোলাপের ক্লিপটা আর দেখা যাচ্ছে না। হয়তো কোথাও পড়ে গেছে, কিংবা নিজের হাতে খুলে ফেলে রেখেছে… কে জানে!
হঠাৎ বাইরে থেকে ভেসে এলো চেঁচামিচির আওয়াজ। আরমান ও আবির চমকে তাকাল সদর দরজার দিকে। গার্ডরা একজোট হয়ে মিডিয়ার লোকদের আটকে রাখার চেষ্টা করছে। রিপোর্টাররা জেনে গেছে, আরমান শাহরিয়ার এসেছেন এখানে। একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একজনের মৃত্যুতে দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন ব্যবসায়ীর উপস্থিতি—সেটা তাদের কাছে বড়ো খবর।
আরমান খেয়াল করলো, ওর বাবা… উনিও এখানে উপস্থিত। একপাশে নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, মুখে একরকম বিক্ষিপ্ত ক্লান্তি, চোখে চাপা বিস্ময় আর ভার। এই দৃশ্য দেখে আরমান নিজেই কিছুটা অবাক হয়ে গেল। ধীর কণ্ঠে আবিরকে জিজ্ঞেস করলো,
— “ড্যাড এখানে কখন এসেছে?”
আবির ধীরে বললো, “আংকেল ভোরের দিকেই হসপিটালে পৌঁছে গিয়েছিলেন। শুনেছি, অনেকদিন ধরেই উনি হসপিটালের কিছু মানুষকে বলে রেখেছিলেন—মায়ার বাবার অবস্থা সম্পর্কে সব খবর যেন উনাকে জানানো হয়। তুই তো জানিস, তোর দাদু আর মায়ার দাদু এক সময়কার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সেই সূত্রে তোর ড্যাড আর মায়ার বাবার মাঝেও ছিল এক গভীর বন্ধুত্ব। তুই তো বেশিরভাগ সময় বিদেশে ছিলিস, এসব জানার সুযোগই হয়নি তোর।”
একটু থেমে নিঃশ্বাস নিলো আবির, তারপর আবার বললো, “তুই মায়াকে ডিভোর্স দেওয়ার পর থেকে মায়ার বাবার ভীষণ অভিমান হয় আংকেলের উপর। যোগাযোগ পুরো বন্ধ করে দেন। আর আংকেলও… লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেননি ওনাকে। কিন্তু আজ, ভোরের দিকে যখন শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন মায়ার বাবা, তার আগেই ভেঙে যায় দুই পুরনো বন্ধুর মান-অভিমান। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে উনিও বুঝে নেন—তোর ড্যাডের কোনো দোষ ছিল না তোর আর মায়ার সম্পর্কের ভাঙনে। সবটা তো তুই-ই ঠিক করেছিলি। তবু… শেষ সময়ে, নিজের মেয়েকে আর একা রেখে যেতে চাননি তিনি। আর পাশে ছিল না কোনো আপনজনও। সেই মুহূর্তে নিজের জীবনের একমাত্র বন্ধুকে পাশে পেয়ে, তোর ড্যাডকেই তিনি নিজের সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব দিয়ে যান। বলেন, ‘মায়াকে যেনো তিনি দেখে রাখেন।’”
এই কথাগুলো শোনার সময় আরমানের চোখ স্থির হয়ে থাকে এক বিন্দুতে, মন পড়ে থাকে অনেক দূরে—অতীতের এক ধুলোঝরা কোণে।
এদিকে, বাড়ির ভেতরে থাকা মানুষজন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলো, আরমান শাহরিয়ার এখানে উপস্থিত। এখনো পর্যন্ত কেউ খেয়াল করেনি তাকে, কিন্তু মিডিয়ার চেঁচামিচি ও গার্ডদের ব্যস্ততায় এক ধরনের অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। সবার দৃষ্টি ধীরে ধীরে গিয়ে স্থির হয় আরমানের ওপর। কে যেন কানে কানে কিছু বলে, কেউ ফিসফিস করে—কৌতূহল, বিস্ময় আর সন্দেহ মেশানো এক অদ্ভুত দৃষ্টি ঘিরে ফেলে পুরো ঘরটাকে।
এ দেশের নামকরা একজন শিল্পপতি, সেই মানুষটা হঠাৎ এমন এক সাধারণ পরিবারের শোকবাড়িতে? কী সম্পর্ক তার মায়াদের সঙ্গে?
আর ওর বাবাও তো এসেছেন! যদিও শুরুতে কেউ বিশেষ খেয়াল করেনি উনাকে।
মিডিয়ার হট্টগোল সামাল দিতে কোনোভাবে রিপোর্টারদের বুঝিয়ে আরমানের বাবা তাদের নিয়ে বেরিয়ে গেলেন রাস্তায়, কারণ এমনিতেই মায়া দের বাড়িটা ছোটো। বারান্দাতেই শুইয়ে রাখা হয়েছে মায়ার বাবার নিথর দেহ। উঠোনে জড়ো হতে শুরু করেছে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা। কেউ কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কেউ বা চোখ মুছে দেখছে আর চলে যাচ্ছে।
“দেশের টপ বিজনেস ম্যান আরমান শাহরিয়ার… আপনি এখানে? আমি তো ভাবতেই পারছি না!”
একটা মেয়েলি উচ্ছ্বাসে ভরা কণ্ঠস্বর কানে আসতেই আরমান আর আবির একসাথে ঘুরে তাকালো। আরমান মুহূর্তেই থমকে গেল—চোখের সামনে দাঁড়িয়ে মাইশা তালুকদার। সেই মাইশা, বিরাট ভাষায় তার “পিচ্চি মায়াবতী”। অথচ মন এখনো মানতে নারাজ—এই মেয়েটিই কি সত্যিই সেই মেয়ে?
আবারও ভেসে এলো সেই উচ্ছ্বসিত স্বর,
“আমি আপনার অনেক বড়ো ফ্যান! কতবার ভেবেছি সামনে থেকে একবার আপনাকে দেখবো। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে, এমনভাবে আপনাকে দেখতে পাবো—স্বপ্নেও ভাবিনি!”
আরমান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো মাইশার দিকে। কীভাবে সম্ভব! এইমাত্র যে মেয়েটিকে সে দেখেছে মায়ার পাশে বসে, গাল ভেজানো চোখে কান্নায় ভেঙে পড়তে—তার মুখে এখন যেন আলো ফুটে উঠেছে। চোখের কোণে এখনো অশ্রুর রেখা, কিন্তু তাতে কোনো বিষাদের রঙ নেই—বরং যেন বিজয়ের এক অদ্ভুত দীপ্তি। মুখে ফুটে আছে একরকম উচ্ছ্বাস, যা ভেতর থেকে আলো ছড়াচ্ছে।
আরমান বুঝে উঠতে পারছিল না, এই পরিবর্তন কীভাবে এত দ্রুত সম্ভব হলো। মেয়েটি যেন কিছু পেয়ে গেছে—অনেক দিনের কাঙ্ক্ষিত, স্বপ্নের মতো কিছু। এমন এক মুহূর্তে, যখন চারপাশে শোকের ছায়া, মাইশার মুখে এই খুশির ঝলক তাকে গভীরভাবে বিস্মিত করলো।
মাইশা কিছুটা অনুরোধের সুরে বলল, “প্লিজ স্যার আমি কি আপনার সাথে একটু আলাদা ভাবে কথা বলতে পারি।”
আরমান এখনো অবাক, ও এই কথার উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারলো না। এই কথার উত্তর আবির দিলো, “মিস এটা একটা শোকের পরিবেশ। তাই এই পরিস্থিতির গুরুত্ব টা একটু বোঝার চেষ্টা করুন। উনি এখানে কোনো মেয়েদের সাথে আলাদা কথা বলতে আসেননি।”
মাইশা আবিরের এই কথায় কিছুটা অপমানিত বোধ করলো। মুখটা ছোটো হয়ে গেলো ওর। আরমান মাইশার দিকে তাকিয়ে মাইশার মধ্যে সেই পিচ্চি মায়াবতীকে খোঁজার চেষ্টা করছে।
_______________________
মায়ার বাবাকে খাটিয়ায় শুইয়ে ধীরে ধীরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে উঠোন পেরিয়ে। মায়ার বুক ফাটা কান্না বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে—”পাপা! আমার পাপা!” আরমানের ছোটো আম্মু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন, কিন্তু সে বাঁধন ছিঁড়ে ছুটে যেতে চাইছে বাবার দিকে। সামিরা একপাশ থেকে ধরে আছে তাকে, নরম করে শান্ত করতে চাইছে, কিন্তু সে যেন কিছু শুনতে পাচ্ছে না। সেই কান্নার শব্দে, সেই আহাজারিতে, বাড়ির উঠোনজুড়ে নেমে এসেছে নীরব অথচ ভারী এক অশ্রুপ্রবাহ। একে একে অনেকের চোখেই জল।
খাটিয়ার একপাশ ধরে আছে আরমান, তার পাশে আবির। আরেক পাশে আরমানের বাবা এবং মায়ার চাচা মোশারফ তালুকদার—যিনি সকালেই খবর পেয়ে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছেন। তাঁর চোখেও যেন জমে উঠেছে না বলা অনেক কথা, আর তার মাঝখান থেকে গড়িয়ে পড়ছে নীরব অশ্রু। আরও দুজন প্রতিবেশী সহায়তা করছেন খাটিয়া ধরে।
চলন্ত অবস্থায় হঠাৎ মায়ার কান্নার তীব্রতা বুক চিরে পৌঁছে গেল আরমানের হৃদয়ে। সে একবার চোখ বন্ধ করে ফেলল, যেন নিজেকে সামলাতে চাইছে। কিন্তু পরক্ষণেই টের পেল—এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে তার চোখ বেয়ে। শক্ত কাঠখোট্টা মুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষটাকে যেন নিজেই চিনতে পারল না সে। নিজের অজান্তে ভেঙে পড়ার এই মুহূর্তে, নিজেকেই অবাক করে দিল আরমান।
চলবে….