আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব-৩৫+৩৬

0
11

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_35
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫

আরমানের মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। নিঃশব্দে, স্থির এক মনোযোগে সে গাড়ি চালিয়ে চলেছে। পাশেই বসে থাকা মায়ার মনে গুমোট এক অস্বস্তি জমে আছে, ক্রমশ সেটা বিরক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
এই গাড়িটা তো আবিরের, তাই প্রথমে সে ভেবেছিল আবিরই হয়তো ওর জন্য রয়ে গেছে। তাই সে কিছু না বুঝে, না ভেবেই উঠে পড়েছিল গাড়িতে। কিন্তু যদি জানতো ভেতরে বসে আছে আরমান—তবে জীবনেও পা রাখতো না এই গাড়িতে।

কেনো জানি মানুষটাকে আর একটুও সহ্য হচ্ছে না মায়ার। ভেতরে ভেতরে রাগে, ক্ষোভে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে সে। আজ বাদে কাল লোকটার বিয়ে। তাও আবার… ওরই চাচাতো বোনের সাথে। বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠছে ওর, যেনো আগুনের উত্তাপ ছড়াচ্ছে প্রতিটি নিঃশ্বাসে। আর এই জ্বলন্ত কষ্টের উৎসটা মায়া খুব ভালো করেই জানে।
ভালোবেসে ফেলেছিল সে এই মানুষটাকে। হ্যাঁ… ভালোবেসেছিল। মনেপ্রাণে, বিশ্বাসে, ভরসায়।

কিন্তু কী ভুল করেছিল সে? যে তার শাস্তি হলো এতটা নির্মম? অন্যায় তো করেনি সে। নিজের স্বামীকে ভালোবাসা কি অন্যায়? তবুও, ভুল করেছিল বটে। অনেক বড়ো ভুল। স্বামীকে ভালোবেসেই হয়তো ও নিজের জন্য তিক্ত পরিণতি ডেকে এনেছে।

কারণ, ওর স্বামীর হৃদয়ে যে আগেই অন্য কেউ ছিল! আর সেই সম্পর্কের মাঝখানে ‘থার্ড পারসন’ হয়ে এসেছিল সে। ভেবেছিল—হালাল সম্পর্ককে সে হৃদয়ে জায়গা দিতে শিখবে। ভেবেছিল—সময় গেলে হয়তো মানুষটা একদিন তাকে ভালোবাসবে। কিন্তু না… সে দিন কোনোদিন আসেনি। বরং একদিন হঠাৎ করেই, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই, ঘরে চলে আসে ডিভোর্স পেপার।

মায়া নিজের মনকে ধমক দিতে চায়। না, এসব ভাবা এখন ঠিক নয়। ডিভোর্স হয়ে গেছে।
আরমান কখনোই ওর ছিল না। সে তো প্রথম থেকেই অন্য কারোর ছিল।

তবু, তবু কেন মনটাকে বোঝানো যায় না?
বারবার কেন পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়?
মনের এই অবাধ্যতায়, এই বেহায়াপনায় ক্লান্ত মায়া আজ। কেনো যেনো এখনো মনে হয়—যদি মানুষটা একবার… একবার শুধু হাত বাড়িয়ে দিত! যদি ওদের ডিভোর্স না হতো!
যদি মানুষটা একটিবার শুধু বলতো—“চলো, আবার সব শুরু করি…”

পৃথিবীতে ওর আপন বলতে আর কেউ নেই।
বাবাকে হারিয়েছে, আর বাবার পর যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতো, সেই মানুষটাও ওকে ছেড়ে দিয়েছে। ভরসার প্রতিটা দেয়াল ভেঙে পড়েছে।

অজান্তেই, দু’ফোঁটা জল ঝরে পড়ে মায়ার চোখ থেকে। নিঃশব্দে, একাকীত্বে, তা পড়ে কোলে রাখা হাতের ওপর। চোখের সেই নোনতা জল যেনো ওকে হঠাৎ করে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

না! ও আবারও দূর্বল হয়ে পড়ছে। এটা চলবে না।
এই স্বার্থপর পৃথিবীতে ও একা। একদম একা।
নিজেকেই ওকে শক্ত হতে হবে।

চোখের জল মুছে নিয়ে, সমস্ত কষ্ট, রাগ আর অবহেলাকে গলায় মিশিয়ে মায়া হঠাৎ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “আপনি তো নিজের গাড়ি ছাড়া অন্য কারো গাড়ি ব্যবহার করেন না। আর নিজের গাড়িতে তো কাউকে উঠতেও দেন না। তাহলে আজ কী হলো? নিজের গাড়ি ছেড়ে অন্যের গাড়িতে উঠলেন?”

আরমান তাকালো না ওর দিকে। দৃষ্টি জমে রইলো সামনের রাস্তায়। স্টিয়ারিং হালকা ঘোরাতে ঘোরাতে গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো—
“কিছু কিছু কাজ পছন্দ না করলেও করতে হয়… শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য।”

মায়া— “হুম, আপনি তো নিজের স্বার্থ‌ ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। তবে হবু বৌকে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে, তারপর নিজে আন্যের গাড়িতে উঠার পিছনের স্বার্থ টা বুঝলাম না।”

আরমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ আমি নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝি না, নিজেকে ভালো রাখার জন্য আমি স্বার্থপর হতেও রাজি। আমার স্বার্থ যদি কারো চোখে নিষ্ঠুরতা মনে হয়, তবে হ্যাঁ আমি নিষ্ঠুর। আর ‘আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা’। যেটা বোঝার সাধ্য সবার নেই।”

মায়া—“যেখানে স্বার্থ থাকে, সেখানে ভালোবাসা নয়—চাহিদা বাস করে। আর যেখানে ভালোবাসার নামে কষ্ট দেওয়া হয়, সেখানে প্রেম নয়, আধিপত্য জন্মায়। ভালোবাসা মানে, প্রিয়জনের সুখের জন্য নিজের খুশিকেও নিঃশব্দে বিসর্জন দিতে পারা।”

আরমান—“তুমি তো দেখছি, আমার দেওয়া ভালোবাসার পুরো সংজ্ঞাই পাল্টে দিলে… তা, কার জন্য এমন নিঃস্ব ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছো মনে?”

মায়া কিছুটা তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “কার জন্য এমন নিঃস্ব ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছি, তা আপনাকে জানাতে বাধ্য নয় মিস্টার আরমান শাহরিয়ার।‌ আপনি আপনার নিজের চরকায় তেল দিন, আজ বাদে কাল আপনার বিয়ে। আমাকে নিয়ে নিয়ে না ভেবে নিজের হবু বৌকে নিয়ে ভাবুন।”

কথাটা শেষ হতে না হতেই, গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে আরমানের আঙুল চেপে উঠল। হঠাৎ করেই সে জোরে ব্রেক কষে ধরল। মায়া সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সিটবেল্টের কারণে কোনো আঘাত লাগেনি।

তারপর… মুহূর্তেই বদলে গেল পরিবেশ।
আরমান ঝুঁকে এলো মায়ার দিকে। চোখ দুটো রাগে জ্বলে উঠেছে—শব্দহীন আগুনের মতো।
ঠোঁটের কোণ চেপে ধরে, থুতনির কাছে হাত বাড়িয়ে তার মুখটা শক্ত করে চেপে ধরে হিসহিসিয়ে উঠল, “বাধ্য! বাধ্য! বাধ্য!
তুমি আমাকে জানাতে বাধ্য, মিস মায়া! একশোবার বাধ্য। তুমি কি ভুলে গেছো? তুমি এখনো আমার কেনা সম্পত্তি। হ্যাঁ! এক মাসের জন্য অনেক গুলো টাকা দিয়ে কিনেছিলাম তোমায়! সে কথা এত সহজে ভুলে যাও কেন তুমি?”

মায়ার চোখে আতঙ্ক নয়, ছিল আগুন। চোখের দিকে ঠাণ্ডা অথচ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে, গলার স্বর ভারি করে কোনো রকমে বলল, “হ্যাঁ, আমি আপনার কেনা সম্পত্তি—এক মাসের জন্য। কিন্তু আপনি এটা কেনো ভুলে যান মিস্টার আরমান শাহরিয়ার? আপনি আমার দেহকে টাকার বিনিময়ে কিনেছেন, মনকে নয়। আপনি চাইলে আমার এই শরীরটাকে বাধ্য করে যেকোনো কাজ করিয়ে নিতে পারেন… কিন্তু আমার মনটাকে আপনি বাধ্য করতে পারবেন না। আর সেই কারণেই আমি আপনাকে আমার মনের কোনো কথা জানাতে একটুও বাধ্য নই।”

আরমান মায়ার কথার উত্তরে একটিও শব্দ উচ্চারণ করল না। শুধু মুখটা আরও কাছে এনে, আগের অবস্থানে স্থির হয়ে রইল। ঠিক মায়ার মুখের সামনে, নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের দূরত্বে। তীক্ষ্ণ, তীব্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার চোখে—যেন ওই চোখের ভেতরেই খুঁজে নিতে চাইছে সব প্রশ্নের উত্তর।

মায়ার থুতনিতে আরমানের আঙুলের চাপ তখনও দৃঢ়। ব্যথা হচ্ছিল নিঃসন্দেহে, কিন্তু সেই ব্যথার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই তার মুখে।
তাতে আছে কেবল একরাশ অনড় দৃঢ়তা।
চোখে ফুটে উঠেছে এক অজানা, বেপরোয়া রাগ। সেই রাগের গভীরে লুকিয়ে আছে প্রকাশ না পাওয়া কিছুটা অভিমান—একগুচ্ছ না-বলা অভিযোগ, যেগুলো শব্দ হতে পারেনি কোনোদিন।

চোখে চোখ রাখার এই অসম লড়াইয়ে, দুজনেই বোঝে… কেউ হারছে না, তবু কেউ জিতছেও না।

জানালার কাঁচে ঠকঠক আওয়াজে ঘোর কাটলো দুজনের। আরমান সরে এলো মায়ার কাছ থেকে। তারপর কোনো কিছু না বলেই গম্ভীর মুখে বের হয়ে গেলো গাড়ি থেকে।

মায়া জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলো, সামিরা দাঁড়িয়ে আছে। মায়া বুঝলো ওরা পৌঁছে গেছে নিজেদের গন্তব্যে। মায়াও গাড়ির দরজা খুলে বের হলো।

সবাই সপিং মলের বাইরে দাঁড়িয়ে আরমানের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সবাই মায়াকে আরমানের গাড়ি থেকে নামতে দেখে কিছুটা অবাক হলো। একে অপরের সাথে ফিসফিস করতে শুরু করলো।

মাইশা, মায়াকে আরমানের গাড়ি থেকে নামতে দেখে জলন্ত চোখে তাকালো মায়ার দিকে, যেটা মায়া খেয়াল করলো না।

সামিরা কান ধরে মায়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “সরি আপু, আমি ভেবেছিলাম তুমি ওই গাড়িতে উঠে পড়েছো। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম তুমি ওই গাড়িতে নেই। আমি আবির ভাইয়াকে আবার পাঠাচ্ছিলাম তোমাকে আনার জন্য। কিন্তু আবির ভাইয়া বলল, তুমি নাকি বড়ো ভাইয়ার সাথে আসছো।”

মায়া একটু হেসে বলল, “ঠিক আছে সামিরা, এর জন্য সরি বলতে হবে না।”

মায়া কথাটা হেসে বললেও, সেই হাসিতে যেনো প্রাণ নেই। সবার মধ্যে যেই উচ্ছাস দেখা যাচ্ছে তার ছিটেফোঁটাও মায়ার মধ্যে নেই।

সবাই একে একে প্রবেশ করলো সপিং মলের ভিতর। আরমান তার গাড়ির চাবি গেটে থাকা দারোয়ান হাতে ধরিয়ে নিজেও প্রবেশ করলো। সপিং মলের কিছু বড়ো পদের কর্মচারী সহ ম্যানেজার ছুটে এলো আরমানকে ওয়েলকাম জানাতে।

এদিকে বাকি সবাই অবাক, কারণ এই মুহূর্তে ওরা ছাড়া এই সপিং মলে আর একটাও কাস্টমার নেই।‌ পুরো সপিং মল ফাঁকা। নেই কোনো গুঞ্জন, নেই কোনো কোলাহল। সবাই বুঝলো এটা আরমানের কাজ, কারণ এই সপিং মলের মালিক আরমান। এই সপিং মল আরমানের।

(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/

সামিরা বিরক্ত হয়ে আরমানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ভাইয়া, এটা কি হলো? গোটা মল ফাঁকা করে দিলে! এখানে তো একটা প্রাণও নেই—এমন নির্জনতা নিয়ে কি সপিং হয় নাকি? একটা সাড়া-শব্দও নেই… খুব অস্বস্তিকর লাগছে।”

আয়ান— “আর এতে তো তোদেরই সুবিধা হবে সামিরা। ইচ্ছে মতো সপিং করতে পারবি, না আছে ভীড়, না হবে হুটুপটি। কেউ ডিস্টার্ব করার জন্য নেই তোদেরকে।”

এরপর আরমান সবাইকে যে যার ইচ্ছা মতো সপিং করতে বলল। সবাই যে যার মতো চলে গেলো। আরমান ব্যাস্ত হয়ে গেলো ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে।

মায়া একপাশে, বড়ো কাঁচের দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে। সবাই যে যার মতো ঘুরে ঘুরে জামা কাপড় পছন্দ করতে ব্যস্ত। কিন্তু এইসবে মায়ার কোনো খেয়াল নেই।

কিছুটা দূরেই আরমান একটা সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। দৃষ্টি তার মায়াতে আবদ্ধ।

হঠাৎ একটা মেয়ে কর্মচারীর আওয়াজে ঘোর কাটলো মায়ার। মেয়েটি বলছে, “ম্যাম ওই দিকে আপনাকে সামিরা ম্যাম ডাকছে।”

মায়া ছোটো করে উত্তর দিলো, “হুম যাচ্ছি।”

কর্মচারীটি চলে গেলো, মায়াও এগিয়ে গেলো মেয়েটির দেখিয়ে দেওয়া পথ অনুসরণ করে।

কিন্তু প্রচন্ড অবাক হয়ে গেলো। কারণ হঠাৎই মনে হলো সপিং মলের এই ফ্লোর টা পুরোই ফাঁকা। ও অনুভব করলো, এই ফ্লোরে ও ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানুষ নেই। ভয়ংকর নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে পুরো ফ্লোর জুড়ে। এরপর হঠাৎই পুরো জায়গাটা অন্ধকার হয়ে গেলো। হয়তো লোডশেডিং হয়েছে। কিন্তু লোডশেডিং হলেও সপিং মলের বড়ো বড়ো কাঁচের জানালা গুলো তো খোলা ছিল, তা দিয়ে আলো ঢোকার কথা। কিন্তু না, কোথাও থেকে কোনো আলো আসছে না। হয়তো বড়ো বড়ো কাঁচের জানালা গুলোতে পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে। মায়া প্রচন্ড ভয় পেলো এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে। ভয়ে ঘামতে শুরু করলো ও।

মায়া চিৎকার করে ডাকতে যাচ্ছিল সামিরাকে। কিন্তু তার আগেই ও অনুভব করলো, একটা শক্ত পুরুষালী হাত ওর মুখ চেপে ধরেছে। আর তার পরপরই আর এক হাতে সেই পুরুষটি মায়ার পেট সহ কোমর জড়িয়ে ধরে তুলে নিলো মেঝে থেকে। মায়া নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটপট শুরু করলো। কিন্তু পারলো না, সেই ব্যক্তি কোথায় যেনো নিয়ে আসলো মায়াকে। এরপর মায়াকে নামিয়ে দিয়ে, সেই ব্যক্তি মায়ার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই মায়া আবারও চিৎকার করতে চাইলো। কিন্তু তার আগেই ব্যাক্তিটি নিজের পুরুষালী ঠোঁট মায়ার নরম ঠোঁটের সাথে মিশিয়ে দিলো। যার ফলে মায়া আর কোনো আওয়াজ করতে পারলো না। কিন্তু ধস্তাধস্তি শুরু করলো ব্যাক্তিটির সাথে।

ব্যাক্তিটি মায়ার ঠোঁট গভীর ভাবে চুষতে থাকলো, যেনো কোনো অমৃত সুধা পান করছে। আর এক দিয়ে মায়ার শরীরে থাকা ওরনা খুলে নিয়ে মায়ার হাত, কোনো একটা স্টিলের স্ট্যান্ড এর সাথে শক্ত করে বেঁধে দিলো। এরপরেই ব্যাক্তিটি মায়ার মুখ থেকে নিজের মুখ সরিয়ে আনলো। আর সাথে সাথেই রুমাল জাতীয় কিছু একটা দিয়ে মায়ার মুখটাও বেঁধে দিলো যাতে মায়া কোনো আওয়াজ না করতে পারে। এরপর পা টাও বেঁধে দিলো মায়ার।

এদিকে মায়া ওর সাথে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রচন্ড ভয়ে ঘামতে শুরু করেছে ও। চোখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে অশ্রু। মায়ার পরনে ছিল থ্রিপিস। এরপরই মায়া অনুভব করলো, ওর পেটের কাছের কাপড় টা সরিয়ে, গুটিয়ে দিয়ে উন্মুক্ত করে দিলো পেট ও কমোড়। মায়া ভয়ে গুটিয়ে গেলো। দ্বিগুন হারে বেড়ে গেলো ওর ছটফটানি।

মায়া অন্ধকারের মধ্যেও অনুভব করলো ব্যাক্তিটি ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। এরপর মায়া ওর পেটে ও কোমরে অনুভব করলো ঠান্ডা কিছু একটা জড়িয়ে যাচ্ছে। ওই ব্যাক্তিটি, কোমর বন্ধনীর মতো কিছু একটা পরিয়ে দিচ্ছে মায়াকে।

মায়া হঠাৎ তার ছটফটানি থামিয়ে দিয়ে স্ট্যাচু হয়ে গেলো। এখন আর মায়ার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না। অতিরিক্ত অবাক হওয়ার কারণে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে ফেললো। ব্যাক্তিটির ঠান্ডা হাতের স্পর্শ নিজের পেটে অনুভব করলো মায়া। আর এই ঠান্ডা স্পর্শে কিছুটা কেঁপে উঠলো মায়া।

এরপর ব্যাক্তিটির কাজ শেষ হতেই, পরিয়ে দেওয়া জিনিসটির উপর হালকা স্পর্শে ঠোঁট ছোঁয়াল। সেই স্পর্শ কিছুটা পেটেও পরলো। আরো একবার কেঁপে উঠলো মায়া।

এরপর ব্যাক্তিটি মায়ার জামা গুটানো থেকে খুলে দিয়ে, ঢাকা দিয়ে দিলো পেট। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে, মায়ার মুখেল বাঁধন খুলে দিলো। হালকা করে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দিলো মায়ার কপালে। তারপর মায়ার হাতের বাঁধনও খুলে দিয়ে, ওরনাটা সুন্দর করে জড়িয়ে দিলো মায়ার গায়ে। এরপরই ব্যাক্তিটি চলে গেলো।

আর এদিকে মায়া যেনো এই দুনিয়ায় নেই। পুরো হতভম্ব হয়ে আছে ও। ওর ঘোর কাটলো হঠাৎ চারপাশ আলোকিত হয়াই। অবাক হয়ে দেখলো চারিদিক। কিচ্ছু বুঝতে পারছে না ও। এখন এই মুহূর্তে ও একটা ট্রায়াল রুমে আছে। ওর হাত দুটো বাঁধা ছিল কাপড় রাখা স্টিলের স্ট্যান্ডে।

মায়া তাড়াতাড়ি ওর পেটের কাছের কাপড়টা সরিয়ে দেখলো, আর ওর কোমরে থাকা জিনিসটি দেখে অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলো ও।

ডায়মন্ড ও গোল্ডের অসম্ভব সুন্দর কারুকার্যের চকচক করা কোমর বন্ধনী। অসম্ভব সুন্দর ওই কোমড় বন্ধনী, আজ পর্যন্ত মায়া চখে দেখেনি। চারিপাশে গোল্ডের উপর ছোটো ডায়মন্ড বসানো, এবং মাঝখানে, মানে ঠিক মায়ার নাভির কাছে বড়ো একটা গাঢ় লাল রঙের চোখ ধাঁধানো রুবি পাথর।

মায়া যেনো ওর মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে কোমর বন্ধনীটি দেখে। মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। মাথায় ঘুরছে, কে ছিল লোকটি? কেনই বা ওকে এতো দামি একটা কোমর বন্ধনী পরিয়ে দিলো? কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। সব কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

মায়া হাত দিয়ে আলতো হাতে স্পর্শ করলো কোমর বন্ধনী টিকে। তারপর দুই হাত দিয়ে চেষ্টা করলো ওটাকে খোলার, কিন্তু পারলো না। মায়া খেয়াল করে দেখলো ওটাতে কোনো কড়া জাতীয় কিছু নেই, ভালো করে দেখে বুঝলো ওটা লক সিস্টেম। নিশ্চয় এটার কোনো চাবী আছে। আর কোমর বন্ধনী টি একবারে মায়ার কোমরে ঠিকঠাক বসে গেছে। যেনো ওটা ওর কোমরের মাপেই বানানো হয়েছে।

মায়া অনেক চেষ্টা করেও ওটা খুলতে পারলো না। হাল ছেড়ে দিলো। হঠাৎ মনে পড়লো, সেই ব্যাক্তিটির দেওয়া ওর কপালে স্পর্শ। মায়া ঠিক ওই জায়গাতেই হাত ছোঁয়ালো। মনে হলো স্পর্শ টা ওর খুব চেনা।

মায়া এখনো হতবাক। কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না ওর। সামিরাদের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে বাইরে থেকে। মায়া তাড়াতাড়ি নিজের পায়ের বাঁধন ও খুলে ফেললো।

_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..

অন্যদিকে….

এক ব্যাক্তি ফোনে কথা বলছে।

অজনা ব্যাক্তি— “খোঁজে লাগাও। আজ রাতের মধ্যেই অল ডিটেইলস চাই আমার। ওই মাইশা মেয়েটা কি আদেও সেই মেয়ে? যে আরমানের জান বাঁচিয়েছিল। নাকি ওই মেয়েও কোনো ছলনাময়ী?”

কল এ থাকা অপর পাশের ব্যাক্তিটি বলল, “হ্যাঁ বস। আজ রাতের মধ্যেই আমি আপনাকে সঠিক খবর দিচ্ছি।”

অজনা ব্যাক্তি— “হ্যাঁ আজ রাতের মধ্যেই খবর চাই আমার। আর যে সময় নেই হাতে। কাল ওদের বিয়ে। ওই মাইশাই যদি আরমানের সেই প্রাণ ভোমরা হয়, তাহলে ওই মেয়েকে আমি কিছুতেই আরমানের জীবনে আসতে দেবো না। কিছুতেই আমি আরমানকে সুখী হতে দেবো না। আমি ওর প্রাণ ভোমরার প্রাণ কেড়ে নেবো। নিঃস্ব করে দেবো ওকে।”

কথা গুলো বলেই লোকটা ফোন কেটে হাসতে শুরু করলো। ভয়ংকর এক হাসি। যেনো ওই হাসি তছনছ করে দেবে আরমানের জীবন।

_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..

এদিকে মায়া নিজেকে গুছিয়ে ট্রায়াল রুম থেকে বেরোতে যাবে তখনি দেখলো একটা টুলের উপর চিরকুট রাখা। মায়া সেটা হাতে তুলে নিয়ে ভাঁজ খুলল।‌ সেখানে লেখা আছে, “ওই ছোট্ট মাথায় এতো চাপ নেওয়ার দরকার নেই। একটা ছোট্ট উপহার দিয়ে আবদ্ধ করলাম আমার ভালোবাসায়। এটা খোলার চেষ্টা করো না, তাতে লাভ নেই। কেননা, এটা খোলার চাবি আমারই কাছে, আর তোমার—আমার থেকে পালানোর কোনো পথ নেই।”

বেরিয়ে এসেই অবাক হলো ও। আবারো সবকিছু আগের মতোই আছে। কর্মচারী গুলো নিজের কাজে ব্যাস্ত। সামিরা দের বাড়ির সবাই যে যার মতো সপিং করতে ব্যস্ত। কিন্তু কিছুক্ষন আগেই কেউ ছিল না এই ফ্লোরে। অন্ধকার আর নিস্তব্ধতায় ঘেরা ছিল চার পাশ। মায়া দেখলো, বড়ো বড়ো কাঁচের জানালা গুলো থেকে এখন পর্দা সরানো।

মায়া বুঝলো, ওর সাথে যেটা হলো সেটা পুরোপুরি প্ল্যান করে সাজানো হয়েছিল। কিন্তু কে করলো এমনটা? কি লাভ পেলো মায়াকে একটা এতো দামি জিনিস এই ভাবে দিয়ে।

চলবে….

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_36
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫

কিছুদিন ধরেই অদ্ভুত এক অস্থিরতা গ্রাস করছে মায়াকে। হঠাৎ হঠাৎ মাথা ভার হয়ে আসে, যন্ত্রণায় চোখের পাতা ঝাঁপসা হয়ে যায়। মনটা যেন সর্বদা কোথাও হারিয়ে থাকে, চারপাশের কোনো কিছুর সাথেই আর সংযোগ স্থাপন করতে পারে না। মাঝে মাঝে এমন কিছু কথাও ভুলে যায়, যা মুহূর্ত খানেক আগেই বলেছিল বা শুনেছিল। নিজের ভেতরেই এক অচেনা শূন্যতা অনুভব করছে ও—সবকিছু যেন ধোঁয়াশা, অগোছালো, আর অবুঝ। নিজেকে যেন একটা পাগল, বেপরোয়া সত্ত্বা বলে মনে হয় তার। এমনিতেই কোনো কিছুই ভালো লাগছে না, তার উপর আবার এসব অদ্ভুত অনুভূতি যেন মনের মধ্যে বিষ ছড়াচ্ছে ধীরে ধীরে।

হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছে একটা ছোট্ট চিরকুট। পাতাটির স্পর্শেই যেন কোনো এক অজানা সংবেদন জেগে ওঠে মায়ার মনে। কোমরে বাঁধা কোমর বন্ধনীটা হঠাৎই ভারী মনে হচ্ছে, যেন কে একজন নিঃশব্দে এসে ওর শরীর জড়িয়ে ধরেছে—ঠান্ডা অথচ ব্যাকুল এক স্পর্শ যেন ছড়িয়ে পড়ছে ওর সারা সত্ত্বায়।

হঠাৎ করেই কানের খুব কাছ থেকে ভেসে এল এক স্বর, “কি ব্যাপার মায়া পরি? শপিং মলে এসেও শপিং না করে মুখ লটকে দাঁড়িয়ে আছো যে?”

ভয়ে চমকে উঠল মায়া। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে এক ঝটকায় ঘুরে তাকাল পিছনে। চেনা মুখ—আসিফ।
আসিফ বলল, “হেই, রিল্যাক্স! এমন করে চমকে উঠলে কেনো? মনটা কোথায় ছিল তোমার?”

মাথা নিচু করে ভগ্ন কণ্ঠে মায়া উত্তর দিল, “ওহ… কিছু না ভাইয়া, মানে… আমি খেয়াল করিনি, হঠাৎ এত কাছে থেকে বললেন, ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

আসিফ খানিকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আহ! ‘ভাইয়া’ বলে তো মনটাই ভেঙে দিলে!”

লোকটার আচরণে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল মায়া। সকালেও সে খুবই গম্ভীর ভঙ্গিতে ‘আপনি’ সম্বোধনে কথা বলছিল, আর এখন যেন এক লাফে অনেকটা কাছে চলে এসেছে। এতটা দ্রুত ব্যবধান কমিয়ে ফেলার চেষ্টা, তাও আবার ওর মতো একজনের সঙ্গে—অস্বস্তিতে গুটিয়ে গেল মায়া।

প্রথমবার দেখা মাত্রই লোকটার ব্যক্তিত্বে একধরনের সম্মোহন অনুভব করেছিল মায়া। স্নায়ুর মতো টানটান গম্ভীর এক রূপে দেখা দিয়েছিল সে, কিন্তু এই মুহূর্তে তার আচরণে কোথাও যেন একটা খামখেয়ালিপনা, একধরনের অবাঞ্ছিত স্পর্শের গন্ধ।

মায়া হঠাৎ অনুভব করল, কেউ যেন ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চুপিচুপি অনুসরণ করছে, কিংবা দূর থেকে অনুভব করিয়ে দিচ্ছে নিজের উপস্থিতি। চারপাশে চোখ ঘোরালো ও। এই অস্থিরতা বুঝে ফেলে আসিফ জিজ্ঞেস করল, “কি হলো মায়া রানি? কাউকে খুঁজছো বুঝি?”

মায়া সোজাসুজি বলল, “কাউকে না। আর দয়া করে আমাকে এই নামে ডাকবেন না। খুব অস্বস্তি লাগে।”

আসিফ হেসে উঠল, “আরে, এতে আবার অস্বস্তি লাগার কী আছে—”

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই একটি মেয়ে কর্মচারী এগিয়ে এসে বলল, “ম্যাম, আপনাকে সামিরা ম্যাম ডেকেছেন, ওইদিকে।”

মেয়েটির কথায় যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মায়া। মনে হলো, এখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলে বাঁচে। মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “হ্যাঁ, চলুন। আমার আপনার সাথেও একটু কথা আছে।”

মায়া দ্রুত পা ফেলল সেদিকে। সঙ্গে সেই মেয়েটিই, যে আগেও এসে ডেকে নিয়েছিল ওকে। এবং তারপরই ঘটেছিল সেই অদ্ভুত ঘটনাটা।

চলতে চলতে মায়া প্রশ্ন করল, “আচ্ছা আপু, তখনও তো আপনি বলেছিলেন সামিরা ম্যাম ডেকেছেন। কিন্তু আমি তো কোথাও ওদের দেখতে পেলাম না?”

মেয়েটি তখন থেকেই কেমন যেন কাঁচুমাচু করছিল। ওর মুখের অস্বস্তি মায়ার চোখ এড়াল না।

মেয়েটি বলল, “হ্যাঁ ম্যাম, তখন সামিরা ম্যাম আপনাকে উপরের ফ্লোরে ডেকেছিলেন। এই ফ্লোরে একটু বিদ্যুৎ সমস্যা হয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য আলো ছিল না। মানুষজনও ছিল না প্রায়। ওই যে সামিরা ম্যাম… আমি এখন যাই, আমার একটু কাজ আছে।”

এই কথা বলে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল মেয়েটি। মায়া স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল ওর পিছুপানে। মনে হলো, কিছু একটা লুকোচ্ছে সে। আবার সেই চেনা ঝিমঝিমে অনুভূতি, মাথার ভেতর যেন দপদপ করে কিছু পুড়ে যাচ্ছে। সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। মায়া চোখ মুদে মাথাটা দুহাতে চেপে ধরল—প্রতিদিনই যেন নিজের সঙ্গে এক নতুন যুদ্ধ শুরু হয় ওর ভেতরে।

সামিরা— “আপু কি হয়েছেন তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?”

সামিরা মায়াকে ধরে জিজ্ঞাসা করলো।

মায়া নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল, “না আমি ঠিক আছি। তুমি ডেকেছিলে আমায়?”

সামিরা— “হ্যাঁ আপু। তুমি তো কিছুই সপিং করলে না। এই দেখো এটা বড়ো ভাইয়া…না মানে আবির ভাইয়া আর আমি পছন্দ করে নিয়েছি তোমার জন্য।”

মায়া নিজের ধ্যানে থাকায় ভালো করে খেয়াল করলো না সামিরার কথাটা। খেয়াল করলে হয়তো বুঝতে পারতো, সামিরা আবিরকে বড়ো ভাইয়া বলে ডাকে না।

মায়া— “আরে এটার কি দরকার ছিল বলো তো।”

সামিরা— “কি বলো আপু? সপিংএ এসেছো আর সপিং না করেই ফিরে যাবে? ধরো তো এটা।‌ সবার সপিং শেষ। এখন কিছু খাওয়া দাওয়া করে বাড়ি ফিরবো।”

কথাটা বলেই সামিরা একটা বড়ো সপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলো মায়ার হাতে।

এরপর সবার সপিং শেষ হলে ওরা গেলো এই সপিং মলেই থাকা রেস্টুরেন্টে। দুপুর হয়ে গেছে, খুব জোড় খিদে পেয়েছে সবার। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে একেবারে খাওয়া দাওয়া করে তারপরই বাড়ি ফিরবে।

_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..

বিয়ের দিন… সন্ধ্যা বেলা…

আজ মাইশা ও আরমানের বিয়ে। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ তাই, অনুষ্ঠানটি রাতেই হবে। দিনটিকে ঘিরে যেন এক অদ্ভুত উত্তেজনা, অজানা কাঁপন ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। কাল সপিং এ নিজের ও আরমানের জন্য কাপল ড্রেস নিয়েছিল মাইশা—দুটি মেরুন রঙা পোশাক, লেহেঙ্গা আর তার সাথে একে সেট করে বানানো স্টাইলিশ কুর্তা। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য মিশে আছে প্রতিটি সেলাইয়ে, প্রতিটি ডিজাইনে।

মাইশার লেহেঙ্গাটি ছিল দুর্লভ সৌন্দর্যের এক নিদর্শন। ভারী কাজ করা, চকচকে পাথরের ছটায় যেন জ্যোৎস্নার ছায়া পড়েছে কাপড়ের গায়ে। এমন পোশাক শুধু গায়ে দেওয়া নয়—মনে একরাশ রাজরানীর অনুভূতি এনে দেয়। বিখ্যাত মেকআপ আর্টিস্টকে আনা হয়েছে ওকে সাজিয়ে তোলার জন্য—একেবারে নিখুঁত, অপার্থিব রূপে।

প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল, বিয়েটা হবে নিরালায়, খুব গোপনে—শুধু ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষকে নিয়ে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সব পাল্টে গেল। হঠাৎ করেই আরমান বদলে ফেলল তার সিদ্ধান্ত। বড়জোর কয়েকটা অতিথি নয়, বরং সমগ্র দুনিয়াকে জানিয়ে দিল তার এই বিশেষ দিনের কথা। দেশের-বিদেশের সব বড় ক্লায়েন্ট আর ব্যবসায়িক পার্টনারদের ইনভাইট করল সে। এমনকি মিডিয়াকেও প্রবেশাধিকার দিয়ে দিল নিজ হাতে।

যে বিয়ে একান্তই ব্যক্তিগত রাখতে চেয়েছিল ও নিজেই, সে বিয়েই যেন রাতারাতি রূপ নিল এক জাঁকজমকপূর্ণ রাজকীয় আয়োজনে। নিজ বাড়িতেই জানিয়ে দিল আরমান—আর কোনো গোপনীয়তা নয়। এবার সকলে জানবে, দেখবে, চিনে নেবে—আরমান শাহরিয়ার-এর অর্ধাঙ্গিনীকে। চোখের সামনে উপস্থিত হবে সেই নারী, যাকে সে এই জীবনের সবচেয়ে বড় পরিচয় দিতে চলেছে—‘মিসেস আরমান শাহরিয়ার’।”

এদিকে মায়া যেন ভেঙে পড়েছে ভীষণভাবে। মনে হচ্ছে, শরীরের প্রতিটি রক্তকণায় কান্না জমে আছে, অজানা এক যন্ত্রণায় ছটফট করছে ওর বুকের ভেতরটা। সত্যিই কি এই কষ্ট অজানা? নাকি নিজেই জানে সব, তবু না জানার ভান করে চলেছে বারবার? সকাল থেকে কতবার যে চোখের পানি ঝরেছে, তার কোনো হিসেব নেই। মনকে বারবার বুঝিয়েছে, এই কান্না ওর বাবার জন্য। পিতৃহীন হবার যন্ত্রণায় বুকটা ভার হয়ে আছে, এটাই যেন বিশ্বাস করাতে চাইছে নিজেকে। কিন্তু ওর মন জানে—এই যন্ত্রণার উৎস অন্য কোথাও।

এই ক’দিনে মায়া নিজেকেই চিনতে পারছে না। ভিতরটা কেমন অচেনা লাগছে—অজানা, ভীতিকর। কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে ভিতরে, কিন্তু ঠিক কী—তা কি সত্যিই বুঝতে পারছে না ও?

“একি আপু! তুমি এখনো রেডি হওনি? আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তো সবাই বেরিয়ে পড়বে ইভেন্ট হলের উদ্দেশ্যে!”

সামিরার কণ্ঠস্বর ওর মন থেকে ছিটকে পড়া চিন্তাগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দিল।

মায়া তখন জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল—শূন্য দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে। চোখে তখনো অশ্রুর রেখা। শব্দ শুনে তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে নিল দু’হাতের আড়ালে। তারপর পিছন ফিরে সামিরার দিকে তাকিয়ে এক কৃত্রিম হাসিতে মুখ ঢাকল—“তোমরা যাও সামিরা। আমি যাবো না।”

সামিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মায়ার দিকে। এতোটা বিধ্বস্ত, এতোটা ভেঙে পড়া চেহারা শেষ কবে দেখেছিল ও? হ্যাঁ, তখন… যেদিন মায়ার বাবা মারা গেলেন, সেদিনও ঠিক এমনই দেখেছিল তাকে। চোখ ফোলা, মুখ থেমে থাকা, এলোমেলো চুল, যেন নিজের ভেতরে নিজেই লড়ছে কেউ একজন।

সামিরা মনে মনে বলে উঠল, “জানি আপু, খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার। তুমি এখনো ভাইয়াকে ভালোবাসো। নিজের চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য কারো হতে দেখাটা সহজ নয় কারো পক্ষেই। কিন্তু চিন্তা কোরো না। আবির ভাইয়া কথা দিয়েছে—এই বিয়ে হতে দেবে না কিছুতেই।”

এইটুকু ভেবে সে এগিয়ে এল মায়ার দিকে। “একি আপু! তুমি কাঁদছো কেন?”

নিজেকে অনেক বুঝিয়েও আজ যেন আর পারছে না মায়া। বুকের ভিতরটা জ্বলছে, এক আগুন লেগে আছে সেখানে, “ও কিছু না সামিরা। পাপার কথা মনে পড়ছে খুব। তাই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি না।”

কণ্ঠস্বরটি কেমন নিস্তেজ, তবু কঠিন আবরণে মোড়া।

সামিরা মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আপু, কষ্ট পেয়ো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আজকের অনুষ্ঠানে তোমাকে যেতেই হবে। না গেলে সবাই ভাববে তুমি কষ্ট পাচ্ছ ওদের বিয়ের জন্য। মানুষ ভুল ব্যাখ্যা দেবে—এটুকু বোঝার চেষ্টা করো।”

মায়া একরাশ ক্লান্তির সঙ্গে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “কে কেমন ভাববে তাতে কিছু যায় আসে না সামিরা। আমি কারো কাছে এতোটাও গুরুত্বপূর্ণ না যে কেউ আমাকে মনে রাখবে।”

সামিরা গাল ফুলিয়ে বলল, “তা হলে আমিও যাচ্ছি না। তোমাকে একা রেখে যাবো না। তুমি না গেলে আমিও যাবো না।”

বলেই ধপ করে খাটের উপর বসে পড়ল সে। মায়া পাশে বসে ওর মাথায় হাত রেখে বলল, “এটা ঠিক না সামিরা। তুমি তোমার ভাইয়ার একমাত্র আদরের বোন। তুমি না গেলে চলবে? আর তোমাকে তো আমি খেয়ালই করিনি এতক্ষণ, কী সুন্দর লাগছে তোমাকে। মাশাআল্লাহ, একেবারে পরির মতো লাগছে। লেহেঙ্গাটা খুবই সুন্দর।”

সামিরা মুখ ফিরিয়ে বলল, “হয়েছে! এত পাম দিতে হবে না। আমি বলেই দিয়েছি, তুমি না গেলে আমিও যাবো না। এবার বলো, রেডি হবে? না হলে আমি কিন্তু আমার সাজই নষ্ট করে ফেলব।”

মায়া কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। কেবল এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। যেন সমস্ত দুনিয়া ওর কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে এক বিশাল ভার। কেউ বুঝতে চায় না তাকে, কেউ শুনতে চায় না তার হৃদয়ের গোপন বেদনার শব্দ।

ওয়াশরুমে ঢুকে গেল মায়া। এদিকে সামিরা আলমারির দিকে এগিয়ে গিয়ে বের করল কালকের সেই শপিং ব্যাগ। সেখানে রাখা ছিল একটি অনিন্দ্যসুন্দর সবুজ জামদানি শাড়ি, যার উপর সূক্ষ্ম গোল্ডেন সূতোর কাজ। সাথে ছিল মানানসই নানা জুয়েলারি।

কিন্তু জুয়েলারিগুলো দেখে সামিরা যেন এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রতিটি গয়না নিখাদ ডায়মন্ডের। চোখ কপালে ওঠার মতো দামি। কাল সে ব্যাগটা খুলেও দেখেনি—আর এই ব্যাগটিই তো আরমান ওকে দিয়েছিল, বলেছিল মায়াকে যেন নিজের নাম করে এগুলো দিয়ে দেয়, কারণ মায়া কিছুই নেয়নি।

মাথা যেন চক্কর দিয়ে উঠল সামিরার। আবার সেই অদ্ভুত প্রশ্ন—আরমান যদি সত্যিই মাইশাকে ভালোবাসে, তবে মায়ার জন্য এই অসামান্য উপহার কেন? দিনের পর দিন ও দেখেছে, মাইশার প্রতি কোনো মোহ নেই তার। কিন্তু ওর ভালোবাসা, ওর পিচ্চি মায়াবতী তো মাইশা।

সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ভাবল, এবিষয়ে আবিরকে জানাবে। কিন্তু ঠিক তখনই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো মায়া। আর ওর ভাবনার স্রোত ছিন্ন হয়ে গেল।

সময় খুব বেশি নেই। আবির ভাইয়া স্পষ্ট করে বলেছে—আজ যেভাবেই হোক মায়াকে অনুষ্ঠানে পৌঁছাতেই হবে। তাই আর কিছু না ভেবে, সামিরা এগিয়ে এল মায়াকে সাজাতে।

মায়া তখনো যেন অচেতন ভাবনায় ডুবে। ওর দৃষ্টি নেই, রঙ নেই, জ্যোতি নেই—শুধু একটি নির্বাক অস্তিত্ব। চোখ ধাঁধানো শাড়িতে, মাথা ঘোরানো ডায়মন্ডের জুয়েলারিতে সেজেও সে যেন কেবল এক প্রাণহীন পুতুল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে থাকলো নিশ্চলভাবে। সামিরা এক এক করে সাজিয়ে দিতে লাগল ওকে।

আর ঠিক তখনই আয়নার প্রতিফলনে যদি একবার তাকাত মায়া—দেখতে পেত নিজেকে, দেখতে পেত এক অপার সৌন্দর্যের ছায়া। কিন্তু না—ওর সমস্ত অনুভূতি আটকে আছে ভিতরের এক জটিল, অভেদ্য যন্ত্রণায়।

_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._

বাড়ির সকল আত্মীয়স্বজন এবং পরিবারের সদস্যরা একে একে রওনা হয়ে গেছেন ইভেন্ট হলের উদ্দেশ্যে। শুধু থেকে গেছে পাঁচজন—মাইশা, আরমান, আবির, সামিরা এবং আয়ান। মাইশা জানিয়ে দিয়েছিল, সে আরমানের সাথেই যাবে। আর আরমানও সেই কথাতেই সায় দিয়ে বলেছিল, সে নিজেই মাইশাকে নিয়ে যাবে, বাকিরা যেনো আগেই বেরিয়ে পড়ে।

অনেকক্ষণ ধরেই মাইশা গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে। নীরব, অপেক্ষারত। কিছুক্ষণ পর সামিরা এসে বসলো ওর পাশে। এরপর গাড়ির ড্রাইভিং সিটে এসে বসল আবির, আর তার পাশে—শান্ত মুখে, সানগ্লাস পরা অবস্থায় বসে পড়ল আয়ান।

মাইশা হঠাৎ থমকে গেল। চমকে উঠে অবাক গলায় বলল,
“একি! তোমরা এই গাড়িতে কেনো? আর আরমান কোথায়?”

সামিরা হালকা সুরে বলল,
“ভাইয়া তো অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে, আপু।”

মাইশার চোখে ক্ষণিকের হতাশা, কণ্ঠে ভেজা ভাঙা শব্দ—
“কিন্তু… আমার তো ওর সাথেই যাওয়ার কথা ছিল।”

আবির হালকা হাসিতে বলল, “আরমানের হঠাৎ একটা জরুরি কাজ এসে পড়েছে। জানোই তো, কতটা ব্যস্ত মানুষ ও।”

মাইশা ছোট্ট করে বলল,
“ওহ… আচ্ছা।”

শব্দগুলোর মধ্যে ছিল অনুচ্চারিত অপমান, চাপা অভিমান।

চোখের কোণে একবার তাকালো আয়ানের দিকে। গাঢ় রঙের শেরওয়ানিতে, চোখে সানগ্লাস আর হাতে ম্যাচিং ঘড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকা আয়ান যেন অন্য কেউ—অপরিচিত এক অভিজাত পুরুষ। মুখে অচেনা গম্ভীরতা, চোখে চাপা অভিমান।
ব্রেকআপের পর থেকে এই নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে সে—আর আশ্চর্যজনকভাবে, এই পরিবর্তিত আয়ানকে ভীষণ মানাচ্ছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে মাইশার, অথচ বুকের মধ্যে কী এক চাপা অস্বস্তি।

_________

এদিকে মায়া—নিঃশব্দে বসে আছে গাড়ির অন্য প্রান্তে, আরমানের পাশে। সামিরা এই গাড়িতেই ওকে বসিয়ে গিয়েছিল। কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আরমান এসে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়েছিল। স্রেফ ইঞ্জিন চালিয়ে সামনে তাকিয়ে রইল—নিঃশব্দ, নির্লিপ্ত।

মায়াও আজ আর কিছু বলেনি। এমনিতেই ভিতরে কিছুই ভালো লাগছে না। অকারণেই বিরক্ত লাগছে। নিজের মনকে প্রশ্ন করে লাভ নেই, কারণ সে নিজেই জানে না—কেন এই মানুষের সঙ্গেই আজ ওর পথ এক হয়েছে, যে মানুষটা আজ অন্য কাউকে নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছে। এত ভাবনায় মাথার যন্ত্রণা বাড়ছে কেবল।

চোখ সরিয়ে নিল বাইরের দিকে, চলমান জানালার ধারে তাকিয়ে রইল শূন্য দৃষ্টিতে।

হঠাৎই এক শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
“শেষবারের মতো একটা জিনিস চাইবো… দিবেন আমায়?”

আরমান গম্ভীর গলায় বলল,
“হুম। বলো।”

মায়ার কণ্ঠে ছিল নিঃস্ব, নিঃশেষ হওয়া এক নারীস্বর—
“মুক্তি। আপনার কাছ থেকে মুক্তি চাইছি। জানি, এখনো পুরো এক মাস যায়নি। চুক্তির কিছুদিন বাকি। কিন্তু আমি আর এক মুহূর্তও চাই না। আজ, এই মুহূর্ত থেকে… আমি মুক্তি চাই। দিবেন আমায়?”

আরমান নিঃসাড় মুখে, একটুকরো নির্লিপ্ততা মিশিয়ে বলল,
“হুম। আজকের পর থেকেই তুমি মুক্তি পাবে। সেই চুক্তি আর তোমাকে মানতে হবে না। কারণ আজ আমার জীবনে আমার অর্ধাঙ্গিনীর প্রবেশ ঘটবে। তাই আমার আর কোনো পার্সোনাল মেইডের প্রয়োজন পড়বে না।”

মায়া একটিবারের জন্যও তাকালো না ওর দিকে। শুধু ঠোঁটের কোণে নিস্তরঙ্গ এক শব্দ—
“ধন্যবাদ।”

তারপর নেমে এল নিঃশব্দতা। গাড়ির ভিতর নিঃসাড় নিস্তব্ধতা যেন ওদের মনের ভিতরের স্তব্ধ কান্নার প্রতিচ্ছবি। দুই পাশে বসা দুটি প্রাণ—একজন এগিয়ে চলেছে নতুন এক জীবনের পথে, আর আরেকজন বিদায় নিচ্ছে সেই জীবনের সবটুকু স্বপ্ন ছুঁয়ে।

মায়া এক গভীর শ্বাস টানল। জানালার পাশে বসে থাকা সেই মানুষের শরীর থেকে আসা পরিচিত গন্ধটা শেষবারের মতো বুক ভরে নিতে চাইল। শেষবারের মতো… যেন হৃদয়ে জমা রাখতে চায়—একটি জীবনের অনুপস্থিত সঙ্গীস্মৃতি।

আরমানের গাড়ি এসে থামল ইভেন্ট হলের একটি নিরিবিলি দরজার সামনে। সেখানে গার্ড ছাড়া আর কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। বিপরীতে, মেইন গেটের কাছে চলছে তীব্র কোলাহল—অনেক মানুষের আনাগোনা, গাড়ি থামার শব্দ, ফটোগ্রাফারদের হাঁকডাক।

গাড়ি থেকে নেমে এলো মায়া। এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল দরজার দিকে। আরমানও নামল, তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে দ্রুত কাকে যেনো একটি মেসেজ পাঠিয়ে দিল। মায়া কিছু না ভেবে, না কিছু জিজ্ঞেস করে, নির্ভার পায়ে এগিয়ে গেল সেই দরজার দিকে।

দরজা পেরিয়েই মুহূর্তে চারদিক যেন আলোর ঝলক জ্বলে উঠল।

সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেল বেলুন ও ফুলের বর্ষন। উপর থেকে ঝরে পড়ছে লাল গোলাপের পাঁপড়ি ও রঙিন লাভ-শেপ বেলুন। মেঝেতে ধোঁয়ার আস্তরণ গড়িয়ে যাচ্ছে ধীর গতিতে, আর তার ওপরে সাজানো রয়েছে অপূর্ব কার্পেট, কার্পেটের ওপর বিছানো ফুলের পাঁপড়ি—একটি নিখুঁত স্বপ্নময় পথ।

মায়ার পাশে এসে দাঁড়াল আরমান। সেই মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল কনফেটি ফাটার শব্দ, এক মুহূর্তে আকাশ রঙিন কাগজের ঝলকে ঢেকে গেল। মায়ার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে চিকচিক করা রঙিন কাগজের কণা, ঝিলিক দিচ্ছে আলোর ঝলকে।

মিডিয়ার ক্যামেরাগুলোর ফ্ল্যাশ একসঙ্গে জ্বলে উঠল। চারদিক থেকে ভেসে আসছে ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক আওয়াজ। চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে এতসব ঝলমলে আলো আর ভিড়ের মধ্যে। যেন পুরো ভুবন তাকিয়ে আছে একজন নারীর দিকে—যার আগমন আজকের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য।

আর ঠিক তখনই—মায়া হতবাক। একেবারে নিঃশব্দে, নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে। কী হচ্ছে তার সঙ্গে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল চারপাশে।

এমন সময় হঠাৎ কারও ধাক্কায় টলে উঠল মায়ার শরীর। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে যাচ্ছিল সে, ঠিক তখনই শক্ত অথচ স্নিগ্ধ এক হস্তে কোমর ধরে ওকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আরমান। কেঁপে উঠলো মায়া।

মুহূর্তের মধ্যে মায়া ফিরে তাকাল সামনের দিকে—মাইশা দাঁড়িয়ে আছে রাগে ফুসতে থাকা চোখে। সেই দৃষ্টি ঠিক যেন ওর বুকের ভেতরে আগুন ছুঁড়ে দিচ্ছে।

তারপর ধীরে তাকালো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরমানের দিকে। গম্ভীর মুখ, নিঃশব্দ চোখ—তবুও সেই চোখের ভাষা স্পষ্ট। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাইশার দিকেই।

মায়ার মাথাটা হঠাৎ কেমন যেন ঘুরে উঠল। পা থেকে শরীর আলগা হয়ে এলো, চোখে অন্ধকার। চারদিকের কোলাহল যেন থেমে গেল এক নিমিষে। শরীরটা ঢলে পড়ল, আর ঠিক তখনই আরমান দুই হাতে জড়িয়ে ধরল তাকে। আগলে রাখল পরম যত্নে, যেন তার সবচেয়ে প্রিয় কিছু হারিয়ে যেতে বসেছে।

আরমানের মুখে ফুটে উঠল এক তীব্র উদ্বেগ। বুকের ভিতর তোলপাড় করে উঠল—মায়ার নিঃশব্দ জ্ঞান হারানো যেন তার ভিতরটাকে ছিন্ন করে দিয়ে গেল।

চলবে….