আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব-৪৩+৪৪

0
11

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_43
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

🚫 হ্যাশট্যাগ ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫

কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। মায়ার চিকিৎসা শুরু হয়েছে পুরোদমে, অন্যদিকে আরমানও চিকিৎসাধীন, তবে ভিন্নতর যন্ত্রণায়। মায়াকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিভিন্ন টেস্টের জন্য, আরমানও গিয়েছিল সঙ্গে—চুপচাপ, নিঃশব্দে, কিছু পা দূরে দাঁড়িয়ে। এখন আরমান মায়াকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করে না। সবসময় নিরব পাহারায় থাকে, কিন্তু দূর থেকে, কারণ মায়া তাকে দেখে মাঝেমধ্যে অজানা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে।

আর এই অকারণ ভয়, এই চোখের ভাষাহীন আতঙ্ক, যেন আরমানের সমস্ত হৃদয় ছিঁড়ে ফেলে। নিজেকে ওর কাছে অপরাধীর মতো মনে হয়—একটি পরাজিত সৈনিক, যে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকেই নিরাপদ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আর সেই হারানোর তালিকায় যোগ হয়েছে আরও একটি ক্ষত—নিজের প্রথম সন্তানকে হারানোর মর্মান্তিক যন্ত্রণা, যা একা একাই বহন করে যাচ্ছে সে, নিঃশব্দে, নিঃসঙ্গভাবে। মায়া তো জানেই না সে আর মা হতে চলেছিল…

মায়া যেন এখন এক অবুঝ শিশুর রূপ নিয়েছে। কোনো কথা মনে থাকে না তার, পরিচিত মুখগুলোও যেন অচেনা ধোঁয়াশায় ঢেকে যায় হঠাৎ করে। আজ যা ঘটছে, কাল সকালেই তা মুছে যায় তার স্মৃতি থেকে। আচরণেও এসেছে ভয়াবহ পরিবর্তন—হঠাৎ রেগে যাওয়া, অকারণে জেদ করা, নিজের আবেগ সামলাতে না পারা।

ডাক্তার ক্যামেলিয়া ডিসুজা সমস্ত রিপোর্ট দেখে শান্তভাবে জানিয়েছেন—ভয়ের কিছু নেই। মস্তিষ্কে এক ধরনের চাপ ও ব্যথা থেকে এই অস্বাভাবিক আচরণ হচ্ছে, কিন্তু ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে মায়া নতুন স্মৃতি রাখতে পারবে, পুরনো কিছুই আর মনে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ওর মধ্যে এখন যে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে, তা স্বাভাবিক, সাময়িক। ঠিক মতো মিডিসিন নিলে, সময়ের সাথে সাথে মাথার ব্যথাও কমে যাবে।

এই সামান্য আশ্বাসে আরমান যেন একটু প্রশান্তি খোঁজে, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে জমে থাকে এক বিষাদ—মায়া তাকে ভুলে গেছে। তার মায়াবতী, যে একদিন নিরবে, নিঃশব্দে, গভীর ভালোবেসেছিল আরমানকে, আজ আর কিছুই মনে রাখে না। বিয়ে, স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক, সব যেন ভেসে গেছে। আরমান জানে, মায়া কখনোই আর সেগুলো মনে করতে পারবে না।

ডাক্তার একথাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন—মায়াকে কোনোভাবেই পুরনো কথা মনে করাতে চেষ্টা করা যাবে না। এতে ক্ষতি হবে ওর মানসিক অবস্থার। এখন মায়ার মতো করে, ওর ইচ্ছের মতো করেই চলতে দিতে হবে। সে এখন যতই রাগ করুক, যত জেদই করুক, তা মেনে নিতে হবে শান্তভাবে। কোনো ধরনের বিরূপ আচরণ মস্তিষ্কে আরও খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। এখন মায়াকে সত্যিই একটি শিশুর মতো করে যত্ন নিতে হবে।

আরমান তাই পিছু হটেছে। মায়ার সামনে আর যায় না। শুধু দূর থেকে দেখেই সন্তুষ্ট থাকে। ছেড়ে দিয়েছে তাকে তার মতো, কিন্তু ভালবাসাটা ছাড়তে পারেনি। চোখের আড়ালে হলেও, আরমান নজর রাখে মায়ার—তাকে তো কোথাও ছেড়ে যাওয়া যায় না…মায়া ঘুমিয়ে পড়লে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে ওর মাথার কাছে—পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে মায়ার স্নিগ্ধ সরল মুখটার দিকে…

————-

মায়া প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বসে আছে খাটের উপর। কিছুই ভালো লাগছে না। সব সময় কেউ না কেউ ওর সাথে থাকে, গল্প করে ওরা, গেমও খেলে। কি যেনো নাম ওদের, যাহ আবার ভুলে গেছে। আর এই জন্যই প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে নিজের উপরেই।

মায়া বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে গেলো ব্যালকনির দিকে। নজর পড়লো সুন্দর সুন্দর বিভিন্ন গাছ পালা দিয়ে ঘেরা বাগান টার উপর, আর বাগান থাকা ফুল ঘেরা দোলনা টার উপর। ইচ্ছে করলো এক ছুটে ওখানে চলে যেতে, কিন্তু ও নিরুপায়। ঘরের দরজা বন্ধ করা আর ও তো জানেনই না ওখানে কোন দিকে দিয়ে যাবে। হ্যাঁ যাওয়া যেত, যদি এই ব্যালকনিতে রেলিং দিয়ে ঘেরা না থাকতো, তাহলে এখান দিয়ে এক লাফ দিয়ে নিচে পৌঁছে যেতে ও। কিন্তু বোকা মায়া কি আর বোঝে? যদি ও এখান থেকে লাফ দেয় তাহলে ওর হাত পা গুলো আর আস্ত থাকবে না।

এখন ওর এই রেলিং গুলোর উপড়েও প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে ভেঙে ফেলতে। অবুঝ মায়া হাত দিয়ে রেলিং গুলোকে টানাটানি শুরু করলো, কিন্তু কিছুতেই ছাড়ছে না এগুলো। রাগে দুঃখে, হাত মুঠো করে জোরে ঘুষি মারলো ও রেলিং এর উপর আর সাথে সাথে প্রচন্ড ব্যাথা পেলো ও। চামড়া ছিলে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। ব্যাথায় চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলো।

তখনো শোনা গেলো সামিরার বিচলিত গলার আওয়াজ, “একি ভাবী মনি নিজেকে ব্যাথা দিচ্ছো কেনো? দেখি দেখি হাত টা দেখি।”

বলেই সামিরা ছুটে এসে মায়ার হাতটা টেনে নিয়ে দেখতে লাগলো।

সামিরা— “অনেক টা কেটে গেছে তো। ভাইয়া দেখলে আমাই আস্ত রাখবে না।”

মায়া কান্না ভুলে তাকালো সামিরার দিকে। বোকা বোকা গলায় প্রশ্ন করলো, “কোন ভাইয়া? আর কিসের ভাবী মনি? তুমি আমাকে ভাবী মনি বলে ডাকো কেনো? আর ভাবী মনি কাকে বলে?”

মায়ার এতোগুলো প্রশ্নে সামিরা ভেবাচেকা খেয়ে গেলো। কোনটার কি উত্তর দেবে বুঝতে পারলো না। এদিকে ডক্টর মানা করেছে, আগের কোনো কিছু মায়াকে জানানো যাবে না। তাহলে এখন কি উত্তর দেবে ও।

সামিরা বোকা বোকা হেসে বলল, “কোন ভাইয়া বলতে আমার আমার বড়ো ভাইয়া। আর ভাবী মনি ডাকি কারন তুমি আমার ভাবী মনি হও। আর ভাবী মনি ভাইয়ার বউকে বলে।”

মায়া গভীর ভাবনায় ডুবে গেলো যেনো, “ভাইয়ার বউ! বউ কাকে বলে?”

সামিরা— “বিয়ে হলে মেয়েরা বউ হয়ে যায়।”

মায়া— “বিয়ে! কিন্তু সেটা আবার কি?”

সামিরা— “উফফ! ভাবী মনি তুমি কত প্রশ্ন করো। তোমার প্রশ্নে শেষই হয়না। অনেক হয়েছে প্রশ্ন উত্তর এখন চলো হাতে ওষুধ লাগাতে হবে, তোমার খাওয়ার টাইম হয়ে গেছে খেতে, এরপর মেডিসিনও খেতে হবে। আবার নিয়ে এসেছি।”

কথা গুলো বলেই সামিরা মায়াকে টানতে টানতে ব্যালকনি থেকে রুমে নিয়ে আসলো। মায়া যেতে যেতেই বিরক্ত গলায় বলল, “কিন্তু আমি তো তোমার বলা একটা কথাও বুঝতে পারলাম না।”

সামিরা বলল, “ওই কথা গুলো পরে বুঝবে এখন খাবে চলো।”

মায়া বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল, “ কিন্তু আমার খাবার আর ওই তেঁতো মেডিসিন গুলো খেতে একদম ভালো লাগে না।”

সামিরা— “ভালো লাগে না বললে হবে না, তোমার শরীর এখন ভীষণ উইক। আর এতো পাওয়ারের মেডিসিন খাবার না খেলে সহ্য করবে কিভাবে?”

মায়া— “মেডিসিন খাওয়ার দরকার নেই তাহলে সহ্য করতেও হবে না, আর না তো খাবার খাওয়ার দরকার পড়বে।”

“এগুলো কোনো কথা হলো আম্মু? তুমি এখন অসুস্থ, খাবার বা মেডিসিন কোনোটাই মিস দেওয়া যাবে না এখন।”

মিসেস সাবিনা বেগম কথা গুলো বলতে বলতে রুমে প্রবেশ করলেন। মায়া তাকালো উনার দিকে। এরপর সামিরার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলো, “ওটা আম্মু তাই না? আমি না বারবার সবকিছু ভুলে যাই।”

সামিরা অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে সাই জানালো। মিসেস সাবিনা বেগম ওদের কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “সামিরা কই আমার আম্মুর খাবার টা? দাও দেখি, আমি নিজে হাতে আমার আম্মু টাকে খাইয়ে দেবো।”

সামিরা— “ওই তো মম, টেবিলে রাখা আছে খাবার টা। আমি একটু আগেই নিয়ে আসলাম। আর দেখো ভাবী মনির হাতটাও কেটে গেছে, তুমি খাইয়ে দাও আর আমি হাতে মেডিসিন লাগিয়ে দিই।”

মিসেস সাবিনা বেগম আতঙ্কিত গলায় বললেন, “সেকি আম্মু? হাত কিভাবে কাটলো?”

সামিরা অসহায় গলায় বলল, “ভাবী মনি আবার নিজেকে আঘাত করছিল ওই ব্যালকনির রেলিং এ।”

মিসেস সাবিনা বেগমও অসহায় চোখে তাকালো, “আবার?? এমন কেনো করছিলে আম্মু?”

মায়া মাথা নিচু করে মিনমিন করে, বোকা বোকা গলায় বলল, “আমি ওইখান যেতে চাই, কিন্তু আমি জানি না তো, কোনদিক দিয়ে যাবো। তাই ওগুলো খোলার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পারলামই না। খুলতে পারলে লাফ দিয়ে চলে যেতাম।”

মায়ার এমন কথায় সামিরা, সাবিনা বেগম সহ বাইরে দরজার কাছে পর্দা আড়ালে থাকা আর এক ব্যাক্তি আঁতকে উঠলো। এই মেয়ের ধারণা আছে ও কি বলছে? দু তলা উপর থেকে লাফ দিয়ে বাগানে যাবে, এটা কোনো কথা? তাহলে এই মেয়েকে কি ওরা আর জ্যান্ত অবস্থায় ফিরে পাবে? ভাগ্যিস ব্যালকনিতে রেলিং দেওয়া ছিল, না হলে নিশ্চিত এই মেয়ে আজ কোনো না কোনো দূর্ঘটনা‌ ঘটিয়ে ছাড়তো।

মিসেস সাবিনা বেগম বললেন, “তুমি বাগানে যেতে চাও সেটা বললেই তো নিয়ে যাবো আমরা। এর জন্য বারান্দার রেলিং ভেঙে লাফ দিয়ে যেতে হবে? খবরদার আর কোনো দিন এমন ভাবনা মাথায় এনো না আম্মু, তুমি যদি অতো দুর থেকে লাফ দাও তাহলে তো হাতে পায়ে ব্যাথা পাবে তো।”

(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/

মায়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কিন্তু আমার যে ওখানে যেতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।”

সাবিনা বেগম— “আচ্ছা চলো আগে খেয়ে নাও তারপর নিয়ে যাবো তোমায়।”

মায়া— “খেতেই হব?”

মিসেস সাবিনা বেগম— “হুম খেতেই হবে। কোনো বাহানা নয় চলো।”

বলেই সাবিনা বেগম মায়াকে সোফায় নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলো। এরপর খাওয়াতে শুরু করলো। আর একদিক দিয়ে সামিরা মায়ার হাতে মিডিসিন লাগিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করতে লাগলো।

মায়া ধীরে ধীরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুই লোকমা মুখে দিলো। এরপর আর খেতে চাইলো না। মিসেস সাবিনা বেগম অনেক জোড় করার পরেও খাওয়াতে পারলো না। এদিকে মায়া এমনিতেই কম খাই, কিন্তু ওর মেডিসিন গুলো অনেক হাই পাওয়ারের।‌ ঠিক মতো না খেলে হবেই না।

মিসেস সাবিনা অসহায় গলায় বললেন, “এমন করলে হবে আম্মু? এতো অল খেলে তুমি তোমার হাই পাওয়ারের মেডিসিন গুলো সহ্য কিভাবে করবে? তখন শরীর টা আরো খারাপ করবে।”

কিন্তু না মায়া এখন আর কারোর কোনো কথা শুনতে রাজি নয়। ও আর খাবে না মানে খাবে না। এক জেদ ধরে মুখটা দুই হাত দিয়ে ধরে বসে রইল। মিসেস সাবিনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অসহায় চোখে তাকালো সামিরার দিকে। সামিরাও ওর মমের দিকে একই ভাবে তাকিয়ে আছে।

ঠিক তখনি শোনা গেলো এক গম্ভীর গলার আওয়াজ। আর সেই আওয়াজে কেঁপে উঠলো মায়া।

“কি হয়েছে মম?”

আরমান এতোক্ষণ দরজার কাছে পর্দার আড়ালে থেকে ভেতরের পুরো দৃশ্যটাই দেখছিলো। মায়াকে খেতে না দেখে ও নিজের হুইল চেয়ারের চাকা এক হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।

সামিরা অসহায় গালয় বলল— “ভাইয়া দেখো না, ভাবী মনি কিছুতেই খেতে চাইছে না।”

সামিরার কথা শুনে মায়ার মাথায় প্রথমেই যেটা এলো, ভাইয়ার বউকে ভাবী মনি বলে। আর সামিরা এই গম্ভীর ভয়ংকর মানুষটাকে ভাইয়া বলছে। তার মানে এটাই কি সেই ভাইয়া? ও এই লোকটার বউ?

মায়ার ভীষণ ভাবে ইচ্ছা হলো মনে থাকা প্রশ্ন গুলো জিজ্ঞাসা করতে। কিন্তু এই ভয়ংকর লোকটার সামনে ওর গলার আওয়াজই বের হয় না। কেনো জানি দেখলেই প্রচন্ড ভয় লাগে এই লোকটাকে। মায়া ইতিমধ্যেই নিজেকে সোফার এক কোনে গুটিয়ে নিয়েছে। যা আরমানের দৃষ্টি এড়ায়নি

শোনা গেল আরমানের গম্ভীর গলার আওয়াজ, “তোমরা খাবার টা এখানে রেখে দিয়ে চলে যাও। আমি দেখছি।”

মায়া যেনো এবার আঁতকে উঠলো আরমানের কথাটা শুনে। ও ভাবলো আম্মু হাতেই খেয়ে নেবেন পুরো খাবার টা। কিন্তু ও মুখ দিয়ে আর একটা আওয়াজও বের করতে পারলো না।

মিসেস সাবিনা বেগম, “কিন্তু আব্বু…”

আরমান— “কোনো কিন্তু নয় মম। বললাম তো তোমরা যাও আমি দেখছি।”

মিসেস সাবিনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, “আব্বু তুই তো জানিস ডক্টর কি বলেছে। মায়ার উপর বেশি প্রেশার দিস না, এমনিতেই মেয়েটা তোকে দেখলে ভয় পাই।”

আরমান ছোটো করে উত্তর দিলো, “হুম।”

মিসেস সাবিনা বেগম চলে যেতে নিলেই, নিজের শাড়ির আঁচলে টান অনুভব করলো। পিছনে ফিরে দেখলেন মায়া তার শাড়ির আঁচলের এক অংশ দুই হাতে মুঠো করে ধরে আছে।

সাবিনা বেগম মায়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আগেই আমি খেয়ে নিতে বললাম, শুনলে না আমার কথা। এখন আটকাচ্ছো কেনো আমায়? আঁচল ছাড়ো, যেতে দাও।”

কেনো জানি মায়ার প্রচন্ড অভিমান হলো মিসেস সাবিনা বেগম এর উপর। চোখ ছলছল করে উঠলো ওর, অভিমান আঁচল ছেড়ে দিলো। সবার দৃষ্টি এড়ালো না মায়ার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ার দৃশ্যটা। সাবিনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “কাঁদছো কেনো আম্মু? আরমানকে ভয় পাচ্ছো? ওকে আমি বলে দিয়েছি, তোমায় একটুও বকবে যেহেতু না। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।”

মায়া একটাও কথা বলল না, শুধু চুপচাপ চোখের পানি ফেলতে লাগলো। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মায়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে রুম দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পিছু সামিরাও গেলো।

উনারও যে কিছু করার নেই। এই ভাবে আর কতদিন চলবে? উনার ছেলেটাও যে কষ্ট পাচ্ছে মায়ার এমন অবহেলায়। মায়কেও তো এবার ধীরে ধীরে আরমানের সাথে সহজ হয়ে উঠতে হবে। নতুন স্মৃতি তৈরি করতে হবে আরমানের সাথে। তবে এই স্মৃতি গুলো হবে মিষ্টি, মধুর।

এগুলো ভেবেই উনি মায়ার এমন করুন ভাবে তাকানো কেও ইগনোর করে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। উনি খুব ভালো ভাবে বুঝে গেছেন, এই মায়াই হচ্ছে উনার ছেলের ভালো থাকার কারণ। তাই আস্তে আস্তে যেভাবেই হোক ওদের দুজনকে এক করতেই হবে।

———–

আয়ানের রুমে….

আয়ান ওর রুমের ব্যালকনিতে বসে আছে। সামনে ল্যাপটপ চালু রাখা, হয়তো কোনো কাজ করছিল। হাতে ধরা থাকা সিগারেট টা একটু একটু করে পুড়ে শেষ হচ্ছে, কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই ওর। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, দূরে কোথাও।

হঠাৎ একটা মেয়েলি আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো আয়ানের।

“সিগারেট এর নেশা কবে থেকে ধরলে আয়ান?”

আয়ান তাকালো সেই আওয়াজ অনুসরণ করে, দেখলো মাইশা দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক ওর পাশেই।

আয়ান তাকালো একবার সিগারেটার দিকে। পুড়ে যাওয়া অংশের ছাই টুকু অ্যাশট্রেতে ফেলে দিলো। তারপর চেয়ারে শরীর টা এলিয়ে দিয়ে সিগারেট টা মুখে নিয়ে একটা লম্বা টান দিলো। ধোঁয়া গুলো ছেড়ে দিলো, ঠিক মাইশার মুখ বরাবর। সেই ধোঁয়া উড়ে গিয়ে মাইশার মুখে লাগতেই কেশে উঠলো ও।

আয়ান গম্ভীর গলায় বলল, “সেটা তোমার না জানলেও চলবে। কিন্তু কারোর রুমে প্রবেশ করলে আগে নক করতে হয় জানো না বুঝি?”

মাইশা— “হুম জানি। তবে, ওই নিয়মটা অন্য কারোর রুমে প্রবেশ করতে প্রযোজ্য। আমার জানামতে একজন ওয়াইফকে তার হাসবেন্ডের রুমে প্রবেশ করতে কোনো অনুমতির দরকার পড়ে না।”

আয়ান হাসলো, তাচ্ছিল্যের হাসি, “বাহ! হাসব্যান্ড? ওয়াইফ? ইমপ্রেসিভ! জানতাম খুব তাড়াতাড়ি তোমার খেলা ঘুরে যাবে, তবে এতো তাড়াতাড়ি সেটা বুঝতে পারিনি। যখন দেখলে আরমানকে আর কোনো ভাবেই পাওয়া সম্ভব নয় তখন ঠিক নিজের খেলা ঘুরিয়ে নিলে তাই না?”

মাইশা অসহায় গলায় বলল, “হুম জানি আমি ভুল করেছি, এই কথা গুলো আমাকে শুনতেই হবে। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি, এখনো তোমাকেই ভালোবাসি আমি। আল্লাহর কাছে এখন আমি শুকরিয়া জানাই, যে সেদিন তোমার সাথে আমার বিয়েটা হয়েছিল।”

আয়ান— “এখনো ভালোবাসো আমাকে? তুমি বলবে আর আমি বিশ্বাস করে নেবো? তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছো? বাহ? খুব সুন্দর নাটক শুরু করেছো তুমি। তোমার এই নাটকে একশোর মধ্যে একশো দেওয়াই যাই। তবে তোমার এই নাটকে এই আয়ান শাহরিয়ার আর গলবে না। খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্স দিয়ে দেবো আমি তোমায়। সেই দিনের সেই রেজিস্ট্রি ম্যারেজ টা ছিল তোমাকে ছোট্ট করে একটা শাস্তি দেওয়ার জন্য। ভেবেছিলাম তোমাকে নিজের কাছে রেখে আরো কঠিন কঠিন শাস্তি দেবো, বোঝাবো একজন মানুষের হৃদয়ে আঘাত দেওয়ার মূল্য। কিন্তু এখন আর এসবের কোনো ইচ্ছে নেই। খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি দিয়ে দেবো তোমায়। খুব তাড়াতাড়ি।”

মাইশার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো টপটপ করে, সোজা গিয়ে ও আয়ানের পায়ের কাছে বসে পড়লো।

“প্লিজ আয়ান, প্লিজ এমন টা করো না। তাহলে যে আমি শেষ হয়ে যাবে। বিশ্বাস করো আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি। হ্যাঁ আমি জানি আমি ভুল করেছিলাম। আমি আমার ভুল গুলো বুঝতে পেরেছি। সব, সবকিছু আমি আমার আম্মুর কথায় করেছিলাম। আম্মু আমায় অতিরিক্ত লোভ দেখিয়ে ছিল, আমার ভুল, আমিও তাতে সাই জানিয়ে ছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো আরমানকে আমি পেতে চেয়েছি লোভে পড়েই। কিন্তু মন থেকে ভালো তোমাকেই বাসি। আমি আমার ভুল গুলো বুঝতে পেরেছি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

কথা গুলো বলতে বলতেই মাইশা কন্নায় ভেঙে পড়লো। আয়ান প্রচন্ড বিরক্ত হলো। মাইশা আয়ানের দুই পা ধরে আছে, আয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “বিশ্বাস করো মাইশা তোমার এই কুমিরের কান্না আর নাটক একদম সহ্য হচ্ছে না আমার। বিরক্ত লাগছে।”

কথা গুলো বলেই আয়ান ওর পা ঝাড়া দিয়ে মাইশাকে ফেলে দিলো। মাইশার মাথা গিয়ে পড়লো পাশেই থাকা ছোটো টেবিল টার উপড়। কপালটা কিছুটা ফুলে গিয়ে কেটে গেলো। কিন্তু আয়ানের আর একবারও ফিরেও তাকালো না মাইশার দিকে। সোজা বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

আর মাইশা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই দিকে। চোখে অপরাধ বোধের অশ্রু।

—————-

অন্যদিকে অজানা কেউ….

পুরো রুমে এলোমেলো। চারিদিকে কাঁচের টুকরো পড়ে। পুরো রুমের সমস্ত জিনিস একের পর এক ভেঙে চলেছে। চিৎকার করছে রাগে।

“নাহ!! নাহ!! নাহ!! এটা কিছুতেই হতে পারে না। হেরে যাচ্ছি আমি। হেরে যাচ্ছি আমি। এতোকিছুর পরও আরমান আর মায়া ধীরে ধীরে এক হয়ে যাচ্ছে। এটা কিছুতেই হতে পারে না। কিছুতেই আরমান সুখে থাকতে পারে না। কিছুতেই না। আমি থাকতে দেবো না। ওদেরকে যেভাবেই হোক আলাদা করতেই হবে। করতেই হবে। ওই মায়াকে, আরমানের মায়াবতীকে কেড়ে নেবোআমি, হ্যাঁ। ওই মায়াবতীকে কেড়ে নেবো আমি। ওই মায়াবতী শুধু আমার হবে, শুধু আমার হবে….”

চলবে….

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_44
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

🚫 হ্যাশট্যাগ ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫

মিসেস সাবিনা বেগম এবং সামিরার রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আরমান ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো মায়ার ঠিক সামনে। মায়া মনে এক রাশ ভয় নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে, কোলের উপর রাখা দুই হাত একে অপরের সাথে কচলাচ্ছে। চোখ তখনো ছলছল। আরমান টেবিলে রাখা খাবারের প্লেট টা তুলে নিয়ে নিজের কোলে রাখলো। তারপর কিছুটা খাবার নিয়ে মায়ার মুখের সামনে ধরলো। গম্ভীর গলায় উচ্চারণ করলো আরমান—“হাঁ করো।”

মায়ার কোনো ভাবান্তর নেই, ও এক ভাবেই বসে আছে নির্বাক ভঙ্গিতে। আরমান এবার ধমকে উঠলো, “কি হলো? কথা কানে যায়া না?”

আরমানের ধমকে কেঁপে উঠলো মায়া। চোখ থাকা পানি টুপ করে হাতের উপর পড়লো। যা নজর এড়ালো না আরমানের।

মায়া মাথা নিচু রেখেই ছোটো করে মুখ খুলল। আরমান ওর হাতের খাবার মায়ার মুখে দিলো। এভাবেই ধীরে ধীরে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে আরমান মায়াকে পুরো খাবার টা খাইয়ে দিলো। খাবার খাওয়ানো হয়ে গেলে, আরমান প্লেট টা টেবিলে রেখে, ওখানে থাকা মায়ার মেডিসিনের বক্সটা তুলে নিলো। তারপর মায়ার এই সময়ের মেডেসিন গুলো পাতা থেকে ছাড়াতে শুরু করলো।

মায়া আরমানকে মেডিসিন নিতে দেখে মিনমিন করে বলল, “আমি ওগুলো খাবো না, ভীষণ তেঁতো। গলায় আঁটকে যায়।”

আরমান— “আমি খাইয়ে দিচ্ছি, দেখো তেঁতো ও লাগবে না আর গলায় আঁটকেও যাবে না।”

আরমানের বলা কথার প্রতিউত্তরে মায়া আর কিছু বলার সাহস পেলো না। লোকটাকে দেখলেই প্রচন্ড ভয় লাগে ওর, ওর থেকে অনেক উঁচু পুরো স্বাস্থ্যবান এই পুরুষটার সামনে নিজেকে এক বাচ্চা মেয়ের মতো লাগে। আর মুখে তো কোনো সময় হাসি নেই, সব সময় গম্ভীর হয়ে থাকে।‌ মায়া নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে উঠলো, “গম্ভীর মুখো, গম্ভীর সাহেব।”

মায়ার বিড়বিড় করে বলা কথাটা আরমানের কানে গেলো কি? মনে হয় গেলো, আর তার জন্যই হয়তো আরমানের হাত থেমে গেলো। আরমান অনেক কষ্টে এক হাতে করেই মেডিসিন গুলো ছাড়াচ্ছিল, মায়ার বলা কথাটা কানে যেতেই ওর হাত থেমে গেলো। হৃদয়ে বয়ে গেলো এক শীতল হাওয়া।

মায়ার ব্রেন থেকে সমস্ত স্মৃতি মুছে গেলেও, হয়তো মায়ার হৃদয়ে কোথাও এখনো রয়ে গেছে আরমান শাহরিয়ার নামক মানুষটি, মায়ার ভাষায় মায়ার ‘গম্ভীর সাহেব’। আরমানের মনে আশা জাগল, তার মায়াবতী তাকে চিনতে না পারুক কিন্তু সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে দোষ কোথায়? হ্যাঁ ও আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করবে, নতুন ভাবে।

ওদের প্রথম শুরুটা ছিল বিষাদে মোড়া। শুরুটা হয়েছিল ওর নিষ্ঠুরতা দিয়ে, তুচ্ছতাচ্ছিল্যভরা ব্যবহার দিয়ে। একটা নিরপরাধ হৃদয়কে উপেক্ষা করে গড়ে উঠেছিল অহংকারের প্রাসাদ। তবু সেই প্রাসাদের দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়েছিল এক অব্যক্ত প্রেম, যা হয়তো তখন ও স্বীকার করতে পারেনি, কিন্তু সময় জানে—ওদের প্রথম শুরুটা ছিল বিষাক্ত ময়, তবুও ভালোবাসায় গাঁথা। ওদের প্রথম পরিচয়টা ছিল ভুলে ভরা, কিন্তু হৃদয়ে ছিল সত্য— যা ও বুঝেও বুঝতে পারেনি।

এসব ভাবনার শেষে, আরমানের অন্তরে জন্ম নিল এক গভীর অথচ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা—
“এই বারের শুরু টা হবে নুতন ভাবে, যেখানে থাকবে না কোনো নিষ্ঠুরতা—
আমার ভালোবাসা এবার আর ক্ষত নয়, মলম হবে।
আমার ভালোবাসা এখন আর কাঁটা নয়, বরং নরম ছোঁয়া।
এবারের ভালোবাসা আর শাসন নয়, শুধু নীরব সঙ্গী হওয়া।
আগের ভালোবাসা ছিল দাবির, এবার শুধু দেবার।
‘আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা’ এবার হবে ‘আমার যত্নময় ভালোবাসা’।”

এখান থেকেই সূচনা হলো এক নতুন গল্প….
আরমানের ভাষায় “আমার যত্নময় ভালোবাসা”

আরমানের মনে কিছুটা শান্তির ছোঁয়া থাকলেও মুখটা ওর স্বভাব সুলভ ভাবেই গম্ভীর। আরমান মেডিসিন হাতে নিয়ে মায়াকে আগে মুখে পানি নিতে বলল। মায়া মুখে পানি নিলে আরমান ওকে মুখটা একটু তুলে হাঁ করতে বলল, এরপর মায়া হাঁ করলে আরমান মায়ার মুখে মেডিসিন দিয়ে দিলো। আর মায়া তা টুক করে গিলে নিলো পানির সাথে, কোনো রকম তেঁতো লাগলো না।

আর বিষয়টা মায়ার মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল। ও উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলো, “আরে বাহ! তেঁতোই তো লাগলো না। আপনি খুব ভালো গম্ভীর সাহেব, সামিরা খাওয়াতে পারে না তাই তেঁতো লাগে। এবার থেকে আমি প্রতিদিন আপনার হাতেই খাবো। খাইয়ে দেবেন তো আমায়?”

মায়া শেষের কথাটা কিউট ফেস করে আরমানকে জিজ্ঞাসা করলো। আর আরমান? ওর মনের অনুভূতি মুখে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। মায়া ওর সাথে সাথে ধীরে ধীরে সহজ হয়ে উঠেছে, এই বিষয়টা ওর হৃদয়কে প্রশান্তি দিচ্ছে। আরমান মায়ার কথার উত্তরে ছোটো করে বলল, “হুম দেবো।”

—————

মায়া এখন বাগানের মাঝখানে দোলনাটায় বসে আছে। সামিরার সাথে অনেকক্ষণ আগেই সে এখানে এসেছে। চারপাশের ঘন সবুজে ভরা গাছপালা, বাতাসে দুলতে থাকা ফুলের নরম সুবাস—সব কিছুতেই মায়ার মনে আজ এক অদ্ভুত রকম আনন্দ। অবুঝ শিশুর মতো পুরো বাগানটা সে ঘুরে ঘুরে দেখেছে, কখনো ছুটে বেড়িয়েছে ঘাসের উপর দিয়ে, কখনো থেমে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে দেখেছে পাখিদের কোলাহল।

এখন সন্ধ্যা নামতে চলেছে। আকাশের রঙ হালকা কমলা ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে, অথচ মায়া এখনও বাগান ছাড়তে চাইছে না। সামিরা তাকে অনেকবার বুঝিয়েছে, বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে—কিন্তু মায়া আজ যেন নাছোড়বান্দা। সে থাকতে চায় এই সবুজের মাঝে, আকাশের নিচে, প্রকৃতির নরম হাওয়ায়।

সামিরা নিজের ফোনটা রুমে ফেলে এসেছিল, তাই বাড়ির ভেতরে ফিরে গেছে সেটা আনতে। মায়া এখন একাই দোলনায় বসে আপন মনে দোল খাচ্ছে। হঠাৎ দোলনার গতি একটু বেড়ে গেলো। মায়ার মনে এক বিন্দুও ভয় জন্মাল না, বরং চোখেমুখে হাসি ফুটে উঠলো—ভীষণ ভালো লাগছে তার। মনে হচ্ছে যেন কেউ খুব আদর করে, খুব যত্ন করে পেছন থেকে দোলাচ্ছে তাকে। দোলনাটা ধীরে ধীরে এক ছন্দে দুলে উঠলো, ঠিক যেন মায়ার মনের আনন্দের তালে।

কিছুক্ষণ পর, সেই ব্যাক্তির হাত দোলনার গতি আস্তে আস্তে থামিয়ে দিলো। এরপর একজোড়া পা এসে থামলো মায়ার পাশের ফাঁকা জায়গাটায়। ব্যাক্তিটি ধীরে ধীরে বসল—একটু দূরত্ব রেখে, মুখে এক সহজাত মৃদু হাসি।

“কি ব্যাপার মায়া পরী? খুব খুশি মনে হচ্ছে?”—আবেগমাখা কণ্ঠে বলল আসিফ।

মায়া কোনো উত্তর দিলো না। সে শুধু চুপচাপ চেয়ে রইলো তার মুখের দিকে, চোখে একরাশ ভাবনা। চেনার চেষ্টা করছে যেন। চেনা, আবার অচেনা—এই দুইয়ের মাঝে দোল খাচ্ছে তার দৃষ্টিপাত।

আসিফ বিষয়টা বুঝে নিয়ে হেসে বলল, “আরে, আবার ভুলে গেলে? আমি তোমার ডক্টর সাহেব! মনে নেই সেই দিন আমরা চারজন—তুমি, আমি, সামিরা আর রুবি একসাথে লুডু খেলছিলাম? তখন তুমি আমায় নাম দিলে ‘ডক্টর সাহেব’…”

মায়া— “হ্যাঁ মনে পড়েছে, আপনি তো সেই ডক্টর সাহেব। আচ্ছা আমি শুধু বার বার ভুলে যাই কেনো?”

আসিফ— “ভুলে গেলেও সমস্যা নেই মায়া পরী, আমি আছি তো তোমায় সব কিছু মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।”

মায়া ওর কিছু হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভাবে বলল, “আচ্ছা জানেন, আমার কোমরে না অনেক সুন্দর একটা জিনিস আছে, চকচক করে, অনেক সুন্দর দেখতে ওটা। আপনি কি জানেন ওটা আমাকে কে দিয়েছে? কিভাবে পেলাম ওটা আমি? আমার তো মনে নেই।”

(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/

আসিফ মায়ার বলা কথাটা শুনে কিছু একটা ভাবলো, তারপর বলল, “আরে ওটা তো আমিই দিয়েছিলাম, ভুলে গেলে? তুমি আর আমি তো দুজন খুব ভালো বন্ধু ছিলাম, অনেক আগে থেকেই। তখন তোমাকে আমি ওটা দিয়েছিলাম।

মায়া— “আপনি দিয়েছিলেন? আপনি আমার বন্ধু? সামিরা আর রুবির মতো?”

আসিফ মাথা নাড়িয়ে সাই জানাল, “হ্যাঁ তো। তুমি আমি খুব ভালো বন্ধু।”

মায়ার আবার কিছু মনে পড়েছে এমন ভাবে জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা আপনি জানেন আমি সামিরার ভাবী মনি। ভাইয়ার বউ। আচ্ছা বিয়ে মানে কি? আর বউ কাকে বলে?”

আসিফ হালকা হেসে বলল, “বিয়ে মানে তো একটা প্রতিজ্ঞা… সারা জীবন পাশে থাকার। আর বউ? একটা পুরুষ মানুষ যেই নারীকে বিয়ে করে সেই নারী হচ্ছে বউ। বউ তো সেই নারী, যাকে একটা পুরুষ প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, যাকে রক্ষা করার জন্য সে দুনিয়ার সব কিছু ত্যাগ করতেও প্রস্তুত থাকে। যেমন আমি—যদি কোনোদিন বিয়ে করি, তবে ঠিক এমন কাউকে চাই, যাকে আমি সব ভুলে, সব হারিয়ে ভালোবাসতে পারি।”

একটু থেমে মায়ার চোখে তাকিয়ে…

“আর তুমি তো জানোই না… তোমার জীবনের অনেক কিছু আমি জানি, এমন অনেক মুহূর্তের সাক্ষী আমি… তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছো, আমি তো ভুলিনি মায়া… তোমারও বিয়ে হবে, তুমিও কারোর না কারোর বউ হবে। তোমার সাথে বিয়ে হওয়া মানুষটা তোমাকেও ভালোবাসবে, আগলে রাখবে… তাই না?”

আসিফের কথা গুলো শুনে মায়া যেনো গভীর ভাবনায় ডুবে গেলো। আসিফ হঠাৎই মুখে একটা বাঁকা হাসি নিয়ে বলল, “আর মায়া পরী তুমি কি জানো? আমি সামিরার ভাইয়া হয়।”

মায়া কি বুঝলো জানা নেই, তবে হঠাৎ করে বলে উঠলো— “ডক্টর সাহেব! আমার কি আগেও বিয়ে হয়েছিল? আমার মনে পড়ছে না কেনো? আচ্ছা ডক্টর সাহেব, আপনি বিয়ে করবেন আমায়?”

আসিফ চমকে উঠলো মায়ার কথাটা শুনে। মায়ার দিকে তাকালো ও। মায়ার মুখ দেখে মনে হচ্ছে না যে এখন ও ওর বাচ্চামো থেকে কথাটা বলেছে। মায়ার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে এক অদ্ভুত অসহায় আকুতি।

আসিফের মুখে ফুটে উঠলো বিজয়ের হাসি। ও বলল, “না তোমার বিয়ে হয়নি। তবে তুমি চাইলে অবশ্যই আমি তোমাকে বিয়ে করবো। বউ হবে তুমি আমার। অনেক যত্ন করবো আমি তোমার, ভালোবাসবো, আগলে রাখবো, আর তুমি যেটা চাও সেটাই দেবো।”

মায়া উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলো, “তাহলে চলুন আমারা এখনি বিয়ে করবো। কিন্তু বিয়ে কিভাবে করে?”

আসিফ— “বিয়ে তে অনেক লোকজন আসে, অনেক সুন্দর করে ঘর বাড়ি সাজানো হয়। বিয়ে করলে তোমাকে বউ সাজতে হবে। আর বউ সাজলে অনেক সুন্দর লাগে মেয়েদেরকে।”

কথাটা বলেই আসিফ নিজের ফোন পকেট থেকে বের করে, তাড়াতাড়ি ফোনে ঘাটাঘাটি করে কিছু ছবি বের করলো। তারপর মায়াকে দেখাতে লাগল, “এই দেখো, বিয়ে করলে এমন ভাবে বউ সাজে সবাই। আর এই দেখো, এইভাবে ঘর বাড়ি সাজানো হয়।”

বলতে বলতেই বেশ কিছু ছবি আসিফ মায়াকে দেখালো। মায়া আসিফের হাতে হাত দিয়ে বলল প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে বলল— “ডক্টর সাহেব? আমিও বউ সাজবো, চলুন আমরা এখনি বিয়ে করবো।”

আসিফ মুখভঙ্গি নিরাশ করে বলল, “কিন্তু বিয়ে করতে গেলে তো সবাইকে লাগে। আর আমাদের বাড়ির কেউ রাজি হবে না তোমার আমার বিয়েতে। কেউ দেবেই না আমাদের বিয়ে।”

মায়া কৌতুহল চোখে চেয়ে প্রশ্ন করলো, “কেন? কেন? কেন রাজি হবে না সবাই? কেন আমাদের বিয়ে দেবে না?”

আসিফ— “কেনো সেটা তো জানিনা। তবে একটা উপায় আছে বাড়ির সবাইকে রাজি করানোর।”

মায়া— “কি উপায়?”

আসিফ— “তুমি যদি অনেক জোড় করো সবাইকে তাহলে সবাই রাজি হতে পারে। তবে তোমাকে অনেক অনেক জোড় করতে হবে, জেদ করতে হবে। তুমি যদি খুব কান্নাকাটি শুরু করো তাহলে সবাই রাজি হয়ে যাবে।”

“সবাইকে কিসে রাজি হয়ে যাবে ভাইয়া?”

আসিফ কিছুটা চমকে উঠলো সামিরার গলার আওয়াজ শুনে। তাড়াতাড়ি ওর হাতে থাকা ফোনটা পকেটে ভরে নিলো। তারপর ও কিছুটা হাসার চেষ্টা করে বলল, “ মায়া সবার থেকে কিছু চাই। হঠাৎ ওর মনে একটা ইচ্ছা জেগেছে, আর সেটাতেই সবাইকে রাজি করানোর কথা বলছিলাম।”

সামিরা— “আচ্ছা তাই বুঝি? তা কি সেই ইচ্ছা শুনি।”

মায়া কিছু বলবে তার আগেই আসিফ বলল, “আরে এখন সেটা বলা যাবে না? মায়া একেবারে সবার সামনে বলবে।”

মায়া বাচ্চামো গলায় বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ সবার সামনে বলবো। ইচ্ছা আছে, অনেক বড়ো একটা ইচ্ছা।”

আসিফ বলল, “আচ্ছা চলো তাহলে ভিতরে। সবাইকে বলবে।”

মায়া— “হুম চলো।”

বলেই মায়া উঠে দাঁড়ালো। তারপর হাঁটা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।‌ পিছু পিছু সামিরা আর আসিফও গেলো।

আর এই দিকে, সমস্ত দৃশ্যটা আরমান দাঁড়িয়ে দেখছিল ওর রুমের ব্যালকনি থেকে—নিঃশব্দ, অথচ চোখ দুটো জ্বলছিল আগুনে। তার সেই মায়াবতী, যাকে ঘিরে ওর সমস্ত জীবনবোধ, স্মৃতি আর কল্পনার সূক্ষ্ম আবরণ—সেই মেয়েটি আজ কারও সামনে এতো সহজে হাসছে, কথা বলছে, যেন সে-ই ওর জীবনের অংশ নয়, অন্য কারও…

দূরত্বের কারণে কথাগুলো কানে আসছিল না ঠিকই, কিন্তু মায়ার হাসিমুখ, চোখের দীপ্তি, আর আসিফের দিকে ঝুঁকে কথোপকথনের ভঙ্গিমা—এই দৃশ্যগুলো স্পষ্ট ফুটে উঠছিল ওর চোখে।

মায়ার এমন সহজ সরল আচরণ, অসংকোচ হাসি আর আসিফের উপস্থিতিতে ওর সেই প্রাণবন্ততা যেন আরমানের বুকে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিল। যে আগুন অনেকক্ষণ ধরে নিভে ছিল ভেতরে, এখন যেন আবার দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।

হঠাৎই কোনো ভাবনা ছাড়াই, পকেট থেকে ফোনটা বের করল আরমান। দ্রুত আঙুল চালিয়ে ডায়াল করল রুবির নাম্বারে। ফোন রিসিভ হতেই নিচু গলা, অথচ শীতল ও কঠোর স্বরে বলল,
“রুবি, আমি নিচে যাবো। নিয়ে যাও আমায়।”

ব্যাস এতোটুকুই। রুবির উত্তরের অপেক্ষা না করেই কল কেটে দিলো আরমান। এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই রুবি এসে আরমানকে নিয়ে যেতে শুরু করল।

নিচে ড্রয়িংরুমে…

বাড়ির সকলেই সোফায় বসে আছে। বিয়ে উপলক্ষে আসা আত্মীয় স্বজন সবাই অনেক আগেই নিজ নিজ বাসস্থানে ফিরে গেছে। রয়ে গেছে শুধু আরমানের ফুপি আর আসিফ। মায়া খুশি মনে প্রবেশ করলো ড্রয়িং রুমে। ওকে দেখে আনোয়ার সাহেব বললেন, “আরে মায়া মামনি যে, শরীর কেমন আছে এখন? আর বাগান ঘোরা হলো?”

মায়া উনার পাশে বসে বলল, “হুম ড্যাড বাগান ঘোরা হয়ে গেছে। আর শরীর এখন ভালো আছে।”

সামিরা আনোয়ার সাহেবকে ড্যাড বলে, তাই মায়াও সেটা শুনেই ড্যাড বলা শুরু করেছে। মিসেস সাবিনা বেগমকে মাঝে মাঝে মম তো আবার মাঝে মাঝে আম্মু বলে।

আসিফ গিয়ে ওর মায়ের পাশে বসলো। সামিরা বলল, “ড্যাড, ভাবী মনি সকলকে কিছু বলতে চাই। ভাবী মনির খুব বড়ো একটা ইচ্ছা জেগেছে মনে, আর সেটাতে তোমাদের সবাইকে রাজী করাতে এসেছে ভাবী মনি।”

ঠিক তখনি শোনা গেল এক গম্ভীর গলার আওয়াজ, “আর সেই বড়ো ইচ্ছাটা ঠিক কি?”

কেঁপে উঠলো মায়া, ভয় ভয় চোখে তাকালো সামনের দিকে। আরমান বসে আছে হুইলচেয়ারে, পিছনে রুবি দাঁড়িয়ে আছে।

মিসেস সাবিনা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন, “আব্বু তুই সব সময় এমনভাবে কথা বলিস কেন হ্যাঁ? দেখছিস তো মেয়েটা এমনিতেই ভয় পায় তোকে। মায়া আম্মু তুমি বলো তো, কি ইচ্ছা তোমার?”

মায়া একবার তাকালো আরমানের দিকে, আরমান ওর দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এরপর মায়া মিসেস সাবিনা বেগম দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল, “তোমরা সবাই রাজি হবে তো? আমার কিন্তু ওটা চাই মানে চাই।”

আরমানের ফুপি বলে উঠলো, “আরে মামনি তুমি আগে কি চাও সেটা তো বলো। আমরা সবাই রাজি হয়ে যাবে, আমাদের মায়া মামনি কিছু চাই আর আমরা সেটা দেবো না, এটা কখনো হতেই পারে না।”

উনার কথায় মায়ার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে উঠলো মায়া….

.

চলবে…