দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
14

#দ্বিতীয়_বসন্ত (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

ছয় মাস কেটে যায়। মুন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। এরই মাঝে তার বাবা, মা তাকে দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চায়। এটা শুনতে মুন তখনই এসব ভাবতে বারণ করে দেয়। মুন তার বাবা, মাকে বলে,“আমি এখন কিছু একটা করতে চাই। দ্বিতীয় বার বিয়ে করার ইচ্ছা আমার নেই৷”

“মানে? জীবনটা এভাবে শেষ করবি?
দেখ মা, সবার জীবনেই কিছু না কিছু ঘটনা থাকে। তাই বলে সেই একটি ঘটনা মনে রেখে জীবনটাকে এক জায়গায় থামিয়ে রাখা ঠিক না।”
মুনের বাবার কথা শুনে মুন চুপ হয়ে যায়। তার মা বলে,“তোকে সবসময় মনমরা দেখতে আমাদের ভালো লাগে? একজনের কথা ভেবে তুই যদি সবসময় অন্য দুনিয়ায় পড়ে থাকিস। নিজের ক্ষতি করিস তা দেখতে আমাদের ভালো লাগে।”

“আমি ভালো আছি মা।
আমার জীবনে আর কিছুর প্রয়োজন নেই।”

“আছে। তুই কেন বুঝতে পারছিস না, আমরা যা চাচ্ছি বা করছি সবটাই তোর ভালোর জন্য।”
বাবা, মায়ের সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে মুন ঘরের মধ্যে চলে যায়। তার বাবা, মা হতাশ হয়ে যায়। তারা মুনের একটি গতি করে মিতুর কথা ভাবতে চাচ্ছিলো। কিন্তু মুন তো রাজি হচ্ছে না। মুনের বাবা তার মাকে হাল ছাড়তে বারণ করে। তিনি বলেন,“মুনকে ধীরে ধীরে বোঝাও। দেখবে ঠিক রাজি হবে।”

মুনের মা মাথা নাড়ায়। রাতে মুনের পাশে শুয়ে তার হাত ধরে তাকে খুব ভালোভাবে বলে তার মা। সে বলে,“তুই আর মিতু। তোরাই আমাদের সব। তোদের ভালো থাকা আমাদের কাছে অনেককিছু। দেখ আমাদের মিতুর কথাও ভাবতে হবে।”

”তাহলে মিতুর বিয়ের ব্যবস্থা করো।”
মুনের মুখে এই কথা শুনতে প্রস্তুত ছিলো না তার মা। নিজেকে সামলে বলে,“আমরা তোর আগে মিতুর কথা ভাবতে পারছি না।”

“আমার কথা তো ভেবেছিলে। এখন আবার কেন? বিয়েটাই কি সব? একবার তো করলাম। আর কত?”

“একবার বিয়ে হলে। সেটা ভেঙে গেলেই তো সব শেষ নয়। মানুষের জীবনে বিয়ে যে একবার আসে তা তো নয়। তাছাড়া মাত্র আটাশ দিন ছিলো তোর ঐ সংসারের বয়স। এত কম সময়ে তো তুই আদৌ বুঝলিই না সংসারটা ঠিক কী? জীবনসঙ্গী মানে কি? একসাথে সারাজীবন হাঁটার আনন্দ কেমন?”
মুনের মা এভাবেই তাকে বোঝাতে থাকে। মুন বুঝেও বুঝতে চায় না। তার কানে আজও বাজে দাদী শাশুড়ীর বলা কথা,“অপয়া অলক্ষী। আমাদের পোলারে খাইলি।”

মুনের মাথায় আজও সেই কথা ঘুরে। রানার সঙ্গে স্বল্প সময়ের পথ চলাটা যেমন তার স্মৃতিতে রয়েছে। তেমনই তাদের তীক্ত কথাগুলো রয়েছে। মুনের মনে হয় এখন সে আবার বিয়ে করলে যদি এমন কিছু আবার হয়। তাহলে তো সে অপয়া সেটাই প্রমাণ হবে। এখানেই মুনের ভয়। ভীষণ ভয়।

___

মুনকে কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে বাবা, মা মিতুর জন্য পাত্র দেখা শুরু করে। তবে এখানেও সমস্যা। মুনের বিধবা হওয়ার বিষয়টি এখানেও কাল হয়ে দাঁড়ায়। কিছু কিছু মানুষ এই কথা শুনে এক কথায় বলে,“বড় বোনটা স্বামী ধরে রাখতে পারলো না। ছোট বোনটা কী পারবে?”

এসব কথা মুনের কানে আসলে সে বিয়েটা ভেঙে দেয়। এমনটা বারবার হওয়ায় মুনের বাবা, মা কিছুটা বিরক্ত হয়। মুন তাদের বলে,“এমন পরিবারের হাতে পায়ে ধরে তোমরা কেন মিতুকে তাদের ঘরে তুলে দিবে বলো? যারা বিয়ের আগেই এমন সব কথা বলতে পারে। এমন চিন্তাধারার। তারা বিয়ের পর মিতুকে কথার বিঁষে পুরো ধ্বংস করে দিবে। এসব পরিবারে মিতু ভালো থাকবে? থাকবে না। তাহলে এমন জায়গায় বিয়ে দিতে কেন হবে বলো? মেয়ে কি ভেসে আসছে?”

“আমিও আপার সঙ্গে একমত। আমি এমন নিম্ন চিন্তা ধারার পরিবারে আমিও বিয়ে করতে চাই না। যতদিন না ভালো পরিবার আসছে ততদিন আমি বিয়ে করবো না। যদি তোমাদের সমস্যা হয় তাহলে বলো।”
মিতুর মুখে এটা শুনে বাবা, মা চুপ হয়ে যায়। তারাও চিন্তা করে আসলেই। এমন পরিবারে বিয়ে হলে মিতু ভালো থাকবে না। তাই সঠিক সময় এবং সঠিক মানুষের অপেক্ষা করে তারা। এভাবে সময় কেটে যায়। আরও ছয় মাস কেটে যায়। মিতুর বিয়ে হয়। খুব ভালো পরিবারে মিতুর বিয়ে হয়। যেই বিয়েতে সবাই খুব খুশি। তবে মুনের বাবা, মা মুনকে নিয়ে চিন্তিত। মুনের একটি গতি না করতে পারলে যে তারা শান্তি পাচ্ছে না। মুন অবশ্য এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে না। সে এখন একটি জব করছে। সেখানেই নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে।

কাজ শেষে আপনমনে হেঁটে মুন বাড়ি ফিরছিলো। প্রচন্ড গরম হওয়ায় সে কিছুটা ঘেমে যাচ্ছিলো। তাছাড়া রোদের তাপও প্রচুর। কড়া রোদে হেঁটে বাড়ির দিকে আসছিলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিচ্ছে। সেই মূহুর্তে কেউ একজন মুনের মাথায় ছাতা ধরে। মুন অবাক হয়ে পাশে তাকায়। নিজের পাশে সুদর্শন এক যুবককে দেখে বিরক্ত হয়। এই ছেলেটিকে সে চিনে। ইদানীং প্রায়ই তার পিছু নিতে দেখা যায়। মুন ছেলেটার সাহস দেখে রেগে বলে,“খুব সাহস বেড়েছে?”

“রোদে পুড়ে মুখটা নষ্ট হয়ে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে।”
ছেলেটির কথা শুনে মুন রাগী চোখে তার দিকে তাকায়। ছেলেটি ম্লান হেসে বলে,“যদি চান আমরা একই ছাতার নিচে না থাকি তবে ছাতাটা ধরুন এবং এটা নিয়ে বাড়ি চলে যান।”

“আমাকে ফলো করছেন কেন?”
মুনের এই প্রশ্নের জবাবে ছেলেটি ছাতাটা এগিয়ে দেয়। মুন না চাইতেও ছাতাটা ধরে। ছেলেটি সুন্দরভাবে হেঁসে বলে,“যদি বলি আপনার মলিন মুখের মায়ায় পড়েছি তবে বিশ্বাস করবেন।”

“যতসব।”
মুন বিরক্তি নিয়ে বলে। ছেলেটি হাসে। সে জবাব দেয় না। তার হাসিই যেন জবাব। এটা বুঝতে পেরে মুন আরও বিরক্ত হয়। ছেলেটি শান্ত গলায় বলে,“আমার জন্য নাহয় একটু বিরক্ত হলেন। আপনার বিরক্তিতেই আমি খুশি। কারণ বিরক্তির ছলে হলেও আপনি তো আমার কথা ভাববেন।”

“আমি বিধবা।”
এটা বলে মুন ছেলেটির দিকে তাকায়। ছেলেটি অবাক হয় অবশ্য। মুন ম্লান হেসে বলে,“আমার মতো বিধবা মেয়ের পিছু নেওয়া যায়। কিন্তু তাকে সম্মানের সঙ্গে ঘরে তোলা যায় না। অবশ্যই একজন অবিবাহিত ছেলের দ্বারা তো সম্ভব নয়।”

এটা বলে ছাতাটা ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে মুন বাড়ি ফিরে। ছেলেটি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
__

শুক্রবার। ছুটির দিন। মুন ঘরে বসে ছিলো। সেই সময়ে মুনের মা মুনকে ডাকে। মুন বের হলে বসার ঘরে লোকজন দেখে অবাক হয়৷ মুনের মা বলে,“তোকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসছে।”

“কী!”
মুন অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। বিরক্তি নিয়ে বলে,“তোমরা আমাকে না জিজ্ঞেস করে পাত্রপক্ষ কেন ডেকেছো?”

“আমরা ডাকিনি। তুই নাকি ছেলেকে আসতে বলেছিস। ছেলেটা সেটাই বললো।”
মায়ের মুখে এই কথা শুনে মুন হতবাক হয়ে যায়। মুনের মা বলে ছেলেটা ছাদে আছে। এটা শুনে মুন হন্তদন্ত হয়ে ছাদে আসে। ছাদে এসে ছেলেটিকে দেখে অবাক হয়ে বলে,“আপনি?”

“হ্যাঁ। আমার নাম মাহবুব আলম।”
ছেলেটির নাম প্রথম শুনলেও তাকে অনেকবার দেখেছে মুন। সেদিন রাস্তায় তো কথাও হলো। ছাতা দিচ্ছিলো। তবে মাহবুবের আচরণে সে অবাক হয়। কিছুটা অবাক গলায় বলে,“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

“আপনিই তো বললেন সম্মানের সঙ্গে ঘরে তুলতে। আমি আপনাকে সেই সম্মান দিতে চাই মুনতাহা।”
মুন হতভম্ব হয়ে যায়। সে সেই অর্থে কথাটি বলেনি। সে মাহবুবকে বোঝানোর চেষ্টা করে। তবে মাহবুব বলে,“আমার আপনাকে ভালো লাগে মুনতাহা। আমি আপনাকে ভীষণ পছন্দ করি। আমি জানি আপনার জীবনে প্রথম পুরুষ অন্যকেউ। আমি তার জায়গা নিতে আসিনি। আমি শুধু আমার জন্য আপনার কাছে জায়গা যাচ্ছি। আপনি তো এখন একা। আপনার এই একাকী জীবনে আমাকে কী জায়গা দেওয়া যায় না?”

“আপনার পরিবার? তাদের নিশ্চয় জেদ দেখিয়ে রাজি করেছেন? তাই হবে। নয়তো অবিবাহিত ছেলের জন্য বিধবা মেয়ে কেউ চাইবে না।”

“আপনি এত অন্যের কথা কেন ভাবছেন?
আপনি নিজের কথা ভাবুন। আপনি কী চান সেটা ভাবুন। আপনার আমাকে অপছন্দ হলে সেটা বলুন।”
এই কথা শুনে মুন চুপ করে যায়। মাহবুব তার অপছন্দের নয়। এক নাগাড়ে এতদিন অনুসরণ করায় কোথাও গিয়ে মুনের মস্তিষ্কে মাহবুব ছেলেটা গেঁথে গিয়েছে। মাহবুব তাকে বোঝায়, সবসময় অন্যের নয় মাঝে মাঝে নিজের কথা ভাবা উচিত। সবকিছুর উধ্বে মুন মাহবুবকে যদি চায় তাহলে এই সম্পর্ক এগিয়ে যাবে। তবে অবশ্যই সেটা মুনের সিদ্ধান্ত হবে। অন্য কেউ তাকে মানতে পারবে না বলে সে না করবে সেটা হবে না। এসব বলে একটা সময় মাহবুব হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,“আমি আপনার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। এবার আপনি সিদ্ধান্ত নিন আপনি আমার হাতটি ধরবেন কি-না।”
মুন চুপ হয়ে যায়। সে ভাবতে শুরু করে। জীবনে আসা এই সুযোগটা সে নিবে নাকি ফিরিয়ে দিবে। অন্যদিকে মাহবুব বলে,“আমি আপনার দ্বিতীয় বসন্ত হতে চাই মুনতাহা। প্লীজ না করবেন না।”
মুন মাহবুবের চোখের দিকে তাকায়। অতঃপর হাত বাড়িয়ে দিতে এগিয়ে দেয়। অর্থাৎ সে তার দ্বিতীয় বসন্ত হিসাবে মাহবুবকে স্বীকার করছে। মুন ভেবেচিন্তে হাত বাড়িয়ে দেয়। অতঃপর…

(সমাপ্ত)