#গালিব_মির্জা
#পর্ব_২
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
সাই-সাই করে গাড়ি চলছে। মুখ গোমড়া করে গালিবের পাশে বসে আছে রাবিন। কিছুক্ষণ আগেই এয়ারপোর্ট থেকে ভাইকে রিসিভ করেছে সে। কিন্তু আট বছর পর ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ার আনন্দে কোলাকুলি করার বদলে কয়েকটা ধমক খেতে হলো বলে রাবিনের মনটা একেবারেই খারাপ হয়ে আছে।
গালিব মির্জা চুপচাপ স্টিয়ারিংয়ে মনোযোগী। পাশের সিটে বসা রাবিনের দিকে তার তেমন খেয়াল নেই। বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছে সে অনেক বছর পর। গ্রাজুয়েশন শেষ করে বিদেশে স্কলারশিপ পেয়েছিল, সেখানেই মাস্টার্স আর পরের পড়াশোনা শেষ করে চাকরিও পেয়েছে। দেশে যতই দূরে থাকুক, বাড়ির খবর সবসময় তার নখদর্পণে। কেউ কোথায় যায়, কে কী করছে সবকিছুই সে জানে।
ছোট থেকেই মেধাবী গালিব, পড়াশোনার মাঠে তার অবস্থান সবসময়ই সবার উপরে। কিন্তু রাবিন একেবারেই তার উল্টো। ছেলেটা এক নম্বরের পড়া চোর। কোনোরকমে লেখাপড়া করে যাচ্ছে। আর সেই কারণেই রাবিনকে সামনে পেয়েই তাকে শিক্ষকের মতো ধমকে দিয়েছে গালিব।
রাবিন পরপর দু’বার গালিবের দিকে তাকাল। ভাইয়ের মুখ গম্ভীর, ঠোঁটে কোনো হাসির রেখা নেই। তারপর হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে টিপতে শুরু করল।
গাড়ির ভেতরে শুধু ইঞ্জিনের শব্দ। গালিব আঁড়চোখে একবার রাবিনের দিকে তাকাল। চোখে-মুখে বিরক্তি না থাকলেও, নির্লিপ্ত একটা ভাব যেন স্পষ্ট। মুহূর্তখানেক তাকিয়ে আবার চোখ ফেরাল সামনে। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ ফোন কম কম ব্যবহার করবি। এই ফোনের পেছনে যতটুকু সময় নষ্ট করিস তার অর্ধেক যদি পড়াশোনার পেছনে ব্যয় করিস তাহলে রেজাল্ট ভালো হবে। “
রাবিন ফোনটা তাড়াতাড়ি পকেটে ঢুকিয়ে রেখে, মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল কেবল। বাড়িতে জাদরেল মার্কা ভাইকে নিয়ে যাচ্ছে ভেবে মনে মনে নিজেকেই গালমন্দ করতে লাগলো।
গালিব মির্জা – বত্রিশ বছর বয়সী এক ভদ্রলোক। লম্বায় প্রায় ছ’ফুট, দেহের গড়ন সুঠাম কিন্তু বাড়তি নয়। ঘন কালো চুল সবসময় সুন্দরভাবে ছাঁটা থাকে, মাঝে মাঝে কপালের ওপর এসে পড়ে কয়েকটা গোছা, যা তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। চোখদুটো গভীর আর চিন্তাশীল । নাকে চিকন ফ্রেমের চশমা বেশ মানায়, তবে চশমা খুললে তার চাহনি আরও তীক্ষ্ণ হয়। মুখে সবসময় হালকা দাড়ি থাকে, বেশি না কম। যেটা তার ব্যক্তিত্বে একধরনের প্রজ্ঞা আর পরিণত ভাব এনে দেয়।
“ ভাইয়া তুমি কি আমার জন্য ফোন নিয়ে এসেছো? তুমি তো বলেছিলে, আমার জন্য আইফোন সিক্সটিন প্রো ম্যাক্স নিয়া আসবা?”
কথাটা বলেই লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল রাবিন। আঁড়চোখে ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করেও বিশেষ লাভ হলো না। আকস্মিক গালিব রাবিনের থুতনিতে হাত রেখে তার মাথাটা নিজের দিকে ফেরাল। চোখে চোখ রেখে গভীর স্বরে বলল,
“ কাউকে দেখার হলে সরাসরি তাকিয়ে দেখতে হয় রাবিন। এভাবে নয়। আর ফোন তোর জন্য এনেছি তবে সেটা গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার পর পাবি। আপাতত ফোন মায়ের কাছে গচ্ছিত রাখবো। ক্লিয়ার? “
রাবিন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি টাইপের একটা হাসি দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ একদম ক্লিয়ার। “
“ ভেরি গুড। “
পুরো পথে রাবিন আর কোনো কথা বললো না। গালিব নিজের মতো ড্রাইভ করতে থাকলো।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে প্রতিদিন ভাত ঘুম দেওয়া তামসীর অভ্যাস বলা যায়। তবে আজকে মির্জা বাড়ির পরিবেশ বড্ড হৈচৈ পূর্ণ হওয়াতে ঘুমটা ঠিকঠাক হচ্ছে না তার। বিয়ে বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের পাশাপাশি, বাড়ি সাজানোর লোকজন, কাজের লোকজন সবাই গটগট করছে। তারমধ্য বাড়ির লোকজনগুলো তো আছেই! সবমিলিয়ে তামসীর মন মেজাজ ভীষণ খারাপ। বিছানায় শুয়ে কানের ওপর বালিশ চাপা দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে সে। লামিয়া আর মেঘলা এসেছিল আড্ডা দেওয়ার জন্য কিন্তু তামসী ওদেরকে ভাগিয়ে দিয়েছিলো। ইশ! কেনো যে ভাগিয়ে দিলো সেই ভেবেও এখন আফসোস হচ্ছে তামসীর।
“ তামু? এই তামু? “
নওশিনের কণ্ঠস্বর শুনে নড়েচড়ে উঠল তামসী। তবে নিজের জায়গা থেকে একচুলও সরলো না। আগের মতোই চোখ বন্ধ করে রইলো। নওশিন ঘরে ঢুকে তামসীকে এমন উপুড় হয়ে পা ছড়িয়ে রাখা অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
“ তামু? আরে এখন একটু ওঠ না বোন। মাগরিবের আজান হলো বলে! গালিব ভাইয়ারাও এসে গেছে। নিচে সবাই ভাইয়ার সাথে দেখা করছে। তুই যাবি না?”
গালিব ভাইয়া আসার কথা শুনেই চটপট শোয়া থেকে উঠে বসলো তামসী। চোখেমুখে আচমকাই একটা খুশির ঝিলিক দেখা গেলো তার। কিন্তু পরমুহূর্তেই কী একটা ভেবে আবারও বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লো সে। ওর এমন কান্ডে হকচকিয়ে গেলো নওশিন।
“ কী রে? কী হলো তোর? এমনভাবে শুয়ে পড়লি কেন!”
“ তুমি যাও গো আপু৷ আমার ভাল্লাগছে না। “
“ তাহলে যে লাফিয়ে উঠে বসেছিলি?”
তামসী ভেংচি কাটল। বলল,
“ বিদেশ থেকে ফিরেছে, তাই ভেবেছিলাম চকলেট, গিফট আনবে হয়তো। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়লো তোমার ভাইটা কতটা বদের হাড্ডি। “
তামসীর কথায় হেসে উঠল নওশিন। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। বলল,
“ চকলেট আনেনি ভাইয়া। দরকারি কিছু জিনিসপত্র ছাড়া কিছুই আনেনি। হয়তো এখান থেকে শপিং করে দিবে। “
তামসী ফের ভেংচি কেটে মুখের ওপর বালিশ রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো।
“ ভালো। তুমি যাও। আর শোনো কেউ যেনো আমার কাছে না আসে। আমার ঘুম হয়নি ঠিকমতো। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। রাতে খাবার খেতে যাবো একেবারে। “
নওশিন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ ঠিক আছে। “
তামসী চেঁচিয়ে বলল,
“রাবিন্নাও যেন আসে না, বলে দিও। “
নওসিনও কিছুটা উচ্চস্বরে, আসবে না বলে জানালো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো তামসী।
মির্জা বাড়ির বসার ঘরে যেনো চাঁদের হাট বসেছে। এতগুলো বছর পর গালিবকে পেয়ে সবাই ভীষণ খুশি। একে একে সবাই ছেলের সাথে আলাপচারিতা শেষে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে। গালিবও নিজের রুমে চলে গেছে। সাইদ মির্জা, নির্জর মির্জা ও তৌকির মির্জা সবাই তাদের বড়ো ছেলের অবস্থান নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। গালিব কতটা কঠোর পরিশ্রম করে লেখাপড়া করেছিল সেসব নিয়েই আলোচনা আরকি। অন্যদিকে গালিবের মা আয়মান ছেলের জন্য স্পেশাল রান্না করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। রাবিন গিয়েছে নিজের ঘরে। লামিয়া, মেঘলা, শুভ আর রাফি নিজেদের মতো করে নওশিনের বিয়েতে কী কী করবে, পরবে সেসব প্ল্যান করতে বিজি। তামসী আর নওশিন যে যার মতো নিজেদের রুমে আছে। বাকি আত্মীয়রা এখন নিজেদের রুমে, বিয়ে নিয়ে আলোচনায় মশগুল।
গভীর রাত। অনেকক্ষণ ধরে পেটের ভেতর গুরগুর করাতে অবশেষে ঘুম ভেঙে গেলো তামসীর। খিদেটা বড্ড জ্বালাচ্ছে ওকে। ঘুম ঘুম ভাবখানা উবে যেতেই ওর মনে পড়লো রাতে কিছু খায়নি সে। সন্ধ্যায় এমন গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল যে আর রাতে খাওয়াদাওয়া হয়নি। রুমের দরজাও লক করা ছিলো বলে কেউ এসে ধাক্কাধাক্কি করার সুযোগ পায়নি সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছে তামসী। আড়মোড়া ভেঙে ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসলো তামসী। খিদের চোটে মাথা ভনভন করছে। মেয়েটা খিদে সহ্য করতে পারে না তেমন। তাই কোনোমতে বিছানা থেকে উঠে চোখেমুখে পানির ছিট দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো তামসী। পরনে কেবল একটা ঢিলেঢালা গেঞ্জি আর প্লাজু।
দোতলার সিড়ি বেয়ে ওঠার পর একটা রুম বাদেই তামসীর ঘর। তার পাশের ঘরটা ছিলো গালিবের। তবে এতোগুলো বছর ঘরটা খালি থাকলেও আজ সে ঘরে বাতি জ্বলতে দেখে আঁড়চোখে একবার তাকালো তামসী পরক্ষণেই মনে পড়লো গালিব ভাইয়া ফিরেছে বাড়িতে। গোপনে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে গুটিগুটি পায়ে সে সিড়ি বেয়ে বসার ঘরে এসে পোঁছাল। চারদিকে অন্ধকার। তামসীর হাতে ওর ফোন, ফোনের স্ক্রিনের ব্রাইটনেসের আলোতে আবছা আবছা সবকিছু দেখা যাচ্ছে। সেই আবছা আলোতে রান্নাঘরে ঢুকতে যাওয়ার সময়, কারো সাথে ধাক্কা লাগলো তামসীর। আচমকা এমন ধাক্কা খেয়ে কিছুটা হলেও আঁতকে উঠল সে। ফোনের লাইট অন করার আগেই চট করে রান্নাঘরের বাতিটা জ্বলে উঠলো। চমকাল তামসী। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছয় ফুটের এক সুদর্শন যুবক, যে কি-না সম্পর্কে ওর চাচতো ভাই হয়। গালিবের হাতে একটা পানির বোতল, হয়তো ফ্রিজ থেকে নিয়ে এসেছে।
“ তামসী…. “
পুরুষালি গম্ভীর কণ্ঠে নিজের নাম শুনতেই ওর ভাবনার ছেদ ঘটলো। চকিতে সামনে তাকিয়ে বলল,
“ কেমন আছেন ভাইয়া? “
“ রাত দুইটার সময় কুশলাদি জানতে চাওয়া কোন ম্যানার্সের মধ্যে পড়ে? “
গালিবের চোয়াল শক্ত। চোখের দৃষ্টিতেও কেমন রাগী রাগী ভাব। তামসী মাথা চুলকে এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে বলল,
“ না মানে মাত্র দেখা হলো তো। সেজন্য জিজ্ঞেস করলাম। আপনি না চাইলে আর জিজ্ঞেস করছি না। “
তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল গালিব। তামসীকে আপাদমস্তক দেখে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ তোর বাবার টাকায় মনে হয় কম পড়েছে। ঠিকমতো জামাকাপড় কিনতে পারছিস না মেবি। “
তামসী গালিবের বলা কথাটা পরপর দু’বার আওড়ে, নিজের দিকে তাকাল একবার। জামাকাপড় তো ঠিকই আছে! কিন্তু পরক্ষণেই নিজের দিকে ভালো করে তাকতেই লজ্জায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলল সে। ওড়না ছাড়া চলে এসেছিল, তারমধ্য ইনারও পরেনি। লজ্জায় তামসী রান্নাঘরের দেয়ালের সাথে মিছিমিছি দু’বার মাথা ঠুকল।
“ তামসী রে… তুই কবে বড় হবি? হায়! হায়! গালিব ভাইয়া ওভাবে তাকিয়েছে তোর দিকে! উনার নজরেরও বলিহারি। সবদিকে কেন যেতে হবে! “
আপনমনে কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো তামসী। ফ্রিজ থেকে তরকারি বের করে, গরম করার পর– রাইস কুকারে রাখা ভাত প্লেটে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোল।
চলবে