গালিব মির্জা পর্ব-০৩

0
10

#গালিব_মির্জা
#পর্ব_৩
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

সকাল থেকেই মির্জা বাড়িতে ব্যস্ততা লেগে আছে। আজকের দিনটা পেরুলে আগামীকাল নওশিনের বিয়ে। পাত্র রায়ান কানাডায় থাকে, ভালো জব করে। নওশিনকেও সেখানেই নিয়ে যাবে। বলাবাহুল্য রায়ানের বাবা নির্ঝর মির্জার পরিচিত। সেই পরিচিতির সুবাদেই নওশিনকে রায়ানের সাথে সুদূর কানাডায় পাঠাতে ভরসা পেয়েছে মির্জা পরিবার।

সকালবেলা সবাই খাওয়াদাওয়া সেরে শপিংয়ের উদ্দেশ্যে বের হলো। যদিও বিয়ের শপিং আগেই শেষ, তবুও আজকের শপিং আলাদা কারণ গালিব নিজ হাতে সকলকে নতুন পোশাকসহ যাবতীয় জিনিসপত্র কিনে দেবে। এ বাড়ির যে কোনো খরচের ভার প্রথম থেকেই গালিব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। বয়সে তরুণ হলেও দায়িত্ববোধে সে অনেকটাই প্রবীণ।

সাভার ক্যান্টনমেন্ট পেরিয়ে সাই-সাই করে দু’টো গাড়ি ঢাকার উদ্দেশে ছুটে চলছে। প্রথম গাড়িতে আছে রাবিন, তামসী, নওশিন, গালিব ও শুভ। আর পরের গাড়িতে লামিয়া, মেঘলা, সুমাইয়া মির্জা (মির্জা বাড়ির ছোট গিন্নি) আর তৌকির মির্জা। বাকিরা বাড়িতে থেকে গেছে বিয়ের কাজকর্ম সামলাতে। যদিও গালিবের বাবা বলেছিলেন সাভারের সবচেয়ে ভালো শপিংমল থেকে শপিং করতে, কিন্তু গালিব মানেনি। ঢাকায় গিয়ে কেনাকাটা করার পেছনে তার একধরনের আভিজাত্য বোধ কাজ করছিল। সবসময় একটু আলাদা করে সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করে সে।

“তামু?”
গাড়ি চালাতে চালাতে রাবিন হঠাৎ ডেকে উঠলো।

তামসী, রাবিন আর নওশিন পাশাপাশি বসে আছে। গালিব ড্রাইভ করছে, শুভ তার পাশে।

“কী?”
রাবিন মিটিমিটি হেসে বলল,
“আমাদের বিয়েতেও ভাইয়া নিশ্চয়ই এভাবে শপিং করতে নিয়ে যাবে।”

চোখ বড় বড় করে তাকাল তামসী। নেহাৎ তারা পাশাপাশি বসে আস্তে আস্তে কথা বলছে বলেই কেউ শুনতে পাচ্ছে না। তবে রাবিনের এসব দুষ্টুমির খবর নওশিন ভালো করেই জানে।

“রাবিইন্না! আমি তোর মাথা ফাটায়া দেবো। তিন বছরের বড় সেইসব ফালতু কথা আর মানবো না।”

তামসীর রাগী রাগী লুক দেখে রাবিন আরও মজা পেলো। ফিসফিস করে বলল,
“আহারে… কী পাষাণ তোর হিয়া।”

“চুপ! শয়তান পোলা একটা।”

“তুই আমার পুকি শয়তাইন্না মাতারি।”

ভেংচি কাটল তামসী। নওশিন তাদের খুনসুটি দেখে নীরবে হাসলো। কিন্তু গালিবের দৃষ্টিতে রাগ ফুটে উঠলো। লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে সে দু’জনকে দেখছিল।

আকস্মিক গম্ভীর কণ্ঠে বলল গালিব,
“রাবিন?”

ভাইয়ের ডাকে চমকে উঠল রাবিন। ঠিক তখনই ব্রেক কষল গালিব, গাড়ি থেমে গেলো। তামসী ভেবেছিল ঢাকা পৌঁছে গেছে কি না, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর কথা নয়।

“জি ভাইয়া?”

“শুভ, তুই গিয়ে পেছনের সিটে বস। রাবিন সামনে আসুক।”

রাবিন থতমত খেয়ে শুভর দিকে তাকাল। শুভ মাথা নাড়ল, কিছু না বলে নেমে পেছনে গিয়ে বসল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাবিন সামনে এসে বসল গালিবের পাশে। তবে মনে মনে বেশ খুশি হলো তামসী। রাবিনের এমন মজা তার মোটেও ভালো লাগে না।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। তবে এবার আর কোনো কথা নেই। সবাই চুপচাপ। গালিব লুকিং গ্লাসে একবার তামসীকে দেখে নিলো, তারপর গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো। তার চোখে-মুখে এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য থাকে সব সময়।

দুপুরের দিকে ঢাকা এসে পৌঁছাল ওরা। রাস্তায় জ্যামের কারণে গালিবের মেজাজ বিগড়ে আছে। বাংলাদেশের রাস্তায় এতো জ্যাম হয় যে কারোরই মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে অবশেষে ওদের গাড়ি ঢুকে গেলো জামুনা ফিউচার পার্কের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে। চারদিকে গাড়ির ভিড়, সিকিউরিটি গার্ড, হর্নের শব্দ সব মিলিয়ে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। গালিব নিখুঁত ভঙ্গিতে গাড়ি পার্ক করে দিলো নির্দিষ্ট জায়গায়। রাবিন আর তামসী দ্রুত নামতে গিয়ে আবার ঠেলাঠেলি শুরু করলো। দু’জনেই গাড়ি থেকে নেমে বকবক শুরু করাতে ইতিমধ্যেই গালিব চোখ পাকিয়ে তাকালো একবার।

লিফটের সামনে ভিড়, সবাই শপিং করতে এসেছে। লম্বা লাইন পেরিয়ে তারা উঠে এলো মলের ভেতরে। বিশাল লাইট, ঝকঝকে মেঝে, শীতল এসির হাওয়া, আর একটার পর একটা ব্র্যান্ডেড শোরুম দেখে তামসীর চোখ গোল হয়ে গেলো।

“ও মাই গড! এত সুন্দর!”

তামসী মুখ খোলা রেখেই ফিসফিস করলো।
গালিব গম্ভীর দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে সবাইকে বলল,
“সোজা ওঠো। ঘুরাঘুরি করার টাইম নাই। আগে কাপড়, তারপর জুয়েলারি। শেষে ফুড কোর্টে যাব। “
নওশিন হাসিমুখে বলল,
“ ঠিক আছে ভাইয়া। “
রাবিন আরকিছুই বললো না। ও ভালো করে বুঝে গেছে, গালিবটা নিজে যেমন গম্ভীর হয়ে থাকে, কথা কম বলে রাবিনকেও তেমনটা বানাতে চাচ্ছে সে। এজন্যই তামসীর সাথে একটু কথা বলতে গেলেই কেমন গোলগাল করে তাকাচ্ছে গালিব। তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল রাবিন। তামসী, মেঘলা ও লামিয়ার দৃষ্টি কেবল শপিংমলের আনাচে কানাচে। এতো বড়ো শপিংমলে কখনো আসা হয়নি ওদের। তামসীর বয়স আঠারো পেরিয়ে গেলেও এখনও কোথাও যেতে হলে সাথে রাবিনকে নিয়েই যেতে হয় ওর। তাছাড়া সাভার থেকে ঢাকায় কখনো সেরকম আসাও হয়নি ওর।

শপিংমলে ঢুকে প্রথমেই ওরা মেয়েদের জামাকাপড় কিনতে গেলো। গালিব চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, বাকিরা নিজেদের মতো পোশাক দেখছে। গালিবের কাজ শুধু বিল পে করা। এসব পোশাক-আশাক পছন্দের মধ্যে সে নিয়ে।

“ এই তামু! ওই সবুজ রঙের শাড়িটা নিবি? ওটাতে সুন্দর লাগবে তোকে। “
রাবিন বেশ আগ্রহী হয়ে বলল কথাটা। নওশিন অনেকগুলো শাড়ির মধ্যে থেকে সবুজ রঙের চমৎকার একখানা শাড়ি হাতে নিয়ে তামসীর গায়ে ফেলে বলল,
“ আসলেই তো! এটাতে সুন্দর লাগছে তোকে। “
“ ইশ কী বিশ্রী! কেমন ক্যাটকেটে রঙটা তামু আপু। এটা নিও না। “
চোখমুখ কুঁচকে ফেলে বলল মেঘলা। লামিয়া ফিক করে হেসে উঠল। কারণ রাবিন চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে মেঘলার দিকে। শুভ চুপচাপ ওদের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করছে শুধু।
“ আপু বলল সুন্দর, রাবিন ভাইয়াও তো বলল তাই! এটা নেই?”
মেঘলার দিকে তাকিয়ে শুধালো তামসী। ভেংচি কাটল মেঘলা। লামিয়া বলল,
“ হ্যাঁ নাও। তোমাকে সুন্দর লাগবে। “
“ ওকে। “
হেসে বলল তামসী। গালিব আঁড়চোখে সবকিছু দেখছিলো। আচমকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ বিয়ে নওশিনের হচ্ছে। বাকিদের এতো বাছাবাছি করে শাড়ি নেওয়ার দরকার নেই। থ্রিপিস নিক, অন্যান্য পোশাক আছে সেগুলো নাও। এতটুকু এতটুকু মেয়ে, তাদের আবার শাড়ির কী দরকার?”

আকস্মিক গালিবের এমন কথায় হকচকিয়ে গেলো সবাই। তামসী হাত থেকে শাড়িটা রেখে দিলো। কেউ কিছু আর বলল না। সবাই চুপচাপ নিজেদের জন্য জামাকাপড় নিলো শুধু। নওশিনের মনে মনে রাগ হলো। মেয়েগুলো বিয়েতেও শাড়ি পরবে না? শাড়ি হলো নারীদের আবেগ। অথচ গালিব সেই আবেগের দফারফা করে দিলো।

নওশিন, মেঘলা, লামিয়া ও তামসীর কেনাকাটা শেষে রাবিন ও শুভর জন্য কেনাকাটা করা হলো। তারপর বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা শেষ করলো, গালিব । তবে নিজের জন্য কিচ্ছু নিলো না সে। তৌকির মির্জা ও সুমাইয়া মির্জা নিজেদের কাজে অন্য জায়গায় গিয়েছিলেন।

শপিং শেষে সবাই ফুড কোর্ডের দিকে এগোল সবাই। সেখানেই মেঘলা ও লামিয়ার বাবামায়ের সাথে দেখা হলো ওদের। সবাই মিলে হালকা খাওয়াদাওয়া করে, আবারও গাড়িতে চেপে বসলো। এবার বাড়ি ফেরার পালা!

সন্ধ্যা নামতেই মির্জা বাড়ি রঙিন আলোয় ঝলমল করে উঠলো। চারদিক যেন উৎসবের আবেশে ভেসে যাচ্ছে। গেট থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত ঝোলানো ফেয়ারি লাইটে পুরো বাড়িটাই ঝলমলে প্রাসাদ মনে হচ্ছে। আঙিনার মাঝখানে ঝাড়বাতি টাঙানো হয়েছে, তার আলোয় সোনালি ঝিলিক ছড়াচ্ছে প্রতিটি কোণে।

উঠোনে বসানো মঞ্চে গায়ে হলুদের মতোই হালকা সঙ্গীতের আসর চলছে। শিশুরা দৌড়ে বেড়াচ্ছে, বেলুন হাতে লাফাচ্ছে। চারদিকে আত্মীয়স্বজনদের ছড়াছড়ি। পুরো সাভার জেলার মধ্যে এমন বিয়ে বাড়ি কখনো কেউ দেখেনি।

তামসী, লামিয়া ও মেঘলাসহ অন্যন্য কাজিনর ঘরে সাজসজ্জায় ব্যস্ত। কনের হাতের মেহেদি দেওয়া শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই , এখন শুধু শুকিয়ে আসছে। নওশিন আয়নার সামনে বসে আছে, চোখেমুখে একধরনের আবেগ, হাসি ফুটে উঠছে। পরনে তার সুন্দর থ্রিপিস, চুলগুলো খোঁপা করা। যদিও সারাদিন বাইরে থাকার ফলে সবাই একটু ক্লান্ত। কিন্তু তবুও সবাই ভীষণ আনন্দ করছে।

বড় ডাইনিং হলে টেবিলভর্তি মিষ্টি, কেক, ফালুদা সাজানো। বাবুর্চিরা বিরিয়ানির হাঁড়িতে মশলা দিচ্ছে, কাবাব সেঁকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পুরো বাড়ি জুড়ে খাবারের সুগন্ধ ছড়িয়ে আছে। আগামীকাল বিয়ে, তাই রাত থেকেই রান্নাবান্নার আয়োজন শুরু করেছে।

বারান্দা আর উঠোনে রাবিন, শুভসহ আর-ও ছেলেরা মিলে হাসিঠাট্টা করছে। মাঝে মধ্যে রাফি, গান চালাচ্ছে, আবার নিজেও নাচে-গানে মেতে উঠছে। এরমধ্যে আয়মান এসে তাদের বকাঝকা করছিল,
“চুপ কর, নইলে গালিব এসে রাগ করবে।”
রাবিন চুপসে গেলেও গান বন্ধ করেনি। লো ভলিউমে গান চলছে এখনও।

সবচেয়ে আলাদা দৃশ্য হলো গালিবের উপস্থিতি। কালো পাঞ্জাবি আর জিন্স পরে সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারদিক পর্যবেক্ষণ করছে। কে কোথায় কাজ করছে, কার কী দায়িত্ব সবকিছু যেন তার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে না। কাজের ফাঁকে অনেকে এসে তার কাছে অনুমতি চাইছে,
“ভাইয়া, এই জিনিসটা কোথায় রাখবো?”
গালিব মাথা নাড়ছে, আবার ফোনে অতিথিদের ব্যাপারে আলাপ করছে।

আনন্দ আর ব্যস্ততার মাঝেও পরিবারের মায়েরা মাঝে মাঝে একপাশে বসে ফিসফিস করে বলছে,
“কাল নওশিন চলে গেলে ঘরটা ফাঁকা হয়ে যাবে।” সেই নিঃশ্বাস আবারও কান্নায় ভিজে যাচ্ছে।

রাত যত গভীর হচ্ছে, তত বাড়ছে আয়োজনের চাপ। অতিথিদের গাড়ি আসতে শুরু করেছে। রাত এগারোটার বেশি বেজেছে, এখনও গালিবের মামা-মামীদের আসা বাকি। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন। সবাই এরমধ্যেই খাওয়াদাওয়া করতে গেলো। কারণ আগামীকাল সকাল সকাল উঠতে হবে, তাই ঘুমোতেও হবে তাড়াতাড়ি।

মাঝরাতে দরজায় ঠকঠক আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো তামসীর। ঘুম ঘুম চোখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শোয়া থেকে উঠে বসে, বিরক্ত হয়ে বলল,
“ এতরাতে কে?”
“ তামসী, দরজা খোল। “
আকস্মিক এমন পুরুষালি গম্ভীর কণ্ঠে বরফের ন্যায় জমে গেলো মেয়েটা। গালিব ভাইয়া! তা-ও এখন, এতরাতে? কেন! তামসীর ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তবুও সে দ্রুত বসা থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সেন্ডো গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট পরিহিত এক সুদর্শন পুরুষ।
“ ভাইয়া? আপনি এখন.. কিছু হয়েছে? “
গালিব কোনো উত্তর না দিয়ে তামসীর হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ এখান থেকে যেকোনো একটা পরিস আগামীকাল। “
“ কিন্তু…. “
“ অতিরিক্ত কথা বলা অপছন্দ করি আমি। গেলাম। “
গালিব নিঃশব্দে পা বাড়িয়ে চলে গেলো। তামসী হা করে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। কিয়ৎক্ষণ বাদে তার হুঁশ ফিরলো। দরজা আঁটকে দিয়ে ঘরে ঢুকলো সে। ব্যাগের ভেতর কী আছে দেখতে ব্যাগ খুলে দেখলো, চার-পাঁচটা শাড়ি!

চলবে