গালিব মির্জা পর্ব-০৪

0
11

#গালিব_মির্জা
#পর্ব_৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

ভোরের আলো ফুটতেই মির্জা বাড়ি যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেলো। সারারাত সাজসজ্জা, রান্নাবান্নার প্রস্তুতি চলার পর আজকের দিনটা আলাদা। কারণ আজ নওশিনের বিয়ে।

সকালে হতেই মির্জা বাড়িতে কোলাহল শুরু হয়ে গেলো। ইতিমধ্যে সকল আত্মীয় স্বজনরা এসে গেছে। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিয়ে বাড়ির বিভিন্ন দিক সামলাচ্ছে। দুপুরে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে ফিরে এসে গালিব বাড়ির চারদিক একবার ঘুরে দেখলো। কর্মচাঞ্চল্যে ভরা এই দুপুরটা যেন তাকে আরও গম্ভীর করে তুললো। মাথায় দায়িত্ব, চোখে এক ধরনের অদৃশ্য টেনশন। নিজের বোনের বিয়ে বলে কথা! সবকিছু ঠিকঠাক হওয়া চাই তার। তাই বাবা চাচাদের থেকে নিজেই বেশি দায়দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে।

রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে মশলার ঘ্রাণ। বাবুর্চিরা বিশাল হাঁড়িতে বিরিয়ানি বসিয়েছে, কাবাবের সিকগুলো গরম কয়লার উপর সাজানো। ডাইনিং হলে লম্বা টেবিল সাজানো হচ্ছে– মিষ্টি, ফালুদা, পায়েস, নানা রকম খাবার দিয়ে ভরে উঠছে জায়গাটা। আসরের নামাজ শেষে বিয়ে। সেই অনুযায়ী সবকিছু গোছগাছ হচ্ছে।

সময়টা এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে। নওশিনের ঘরে এখন সাজসজ্জার ব্যস্ততা। কাজিনরা সবাই মিলে নওশিনকে ঘিরে রেখেছে। । মাত্র নওশিনের সাজগোজ কমপ্লিট হয়েছে। লাল টুকটুকে বেনারসি পরে ভীষণ মিষ্টি লাগছে তাকে। নওশিন আয়নার সামনে বসে আছে। চোখে যেন একসাথে আনন্দ আর বিষণ্ণতা। একদিকে যেমন নতুন জীবনের উদ্দীপনা অন্য দিকে আপনজন ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার বেদনা! এসব ভেবেই মাঝে মধ্যে মন খারাপ লাগছে ওর।

তামসী, লামিয়া ও মেঘলার সাজগোছও আগেই শেষ হয়েছিলো। মজার কথা হলো গতকাল রাতে গালিব লামিয়া ও মেঘলার ঘরেও শাড়ি দিয়ে এসেছিলো। কিন্তু ওদের জন্য মাত্র দু’টো শাড়ি বরাদ্দ ছিলো, আর তামসীর বেলায় ছিলো পাঁচটা! নওশিনের বান্ধবী মল্লিকা মাঝে মধ্যে ফিসফিস করে কিছু একটা বলছে ওকে। তাতে বেশ লজ্জা পাচ্ছে নওশিন। বিষয়টা দৃষ্টিগোচর হতেই গলা খাঁকারি দিয়ে বলল মেঘলা,
“ তোমরা এতো কী বলছো, হ্যাঁ? “
মল্লিকা হেসে বলল,
“ ওসব ১৮+ কথাবার্তা, তোদের শোনার বয়স হয়নি।”
ভেংচি কাটল মেঘলা। তামসী ফিক করে হেসে উঠল।
“ তাহলে আমাকে বলো, কারণ আমার বয়স ১৮+.. “
নওশিন হেসে বলল,
“ বেশি পেকেছিস তুই। এরপর তো তোরই সিরিয়াল, তবে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট না করা পর্যন্ত বিয়ে দিচ্ছে না। “

তামসী মুখখানা গোমড়া করে বলল,
“ বিয়ে করার এক আকাশ পরিমাণ শখ আমার। সেখানে গ্রাজুয়েশন নামক উটকো ঝামেলার কোনো হস্তক্ষেপ আমি মানবো না। তার আগেই বিয়ে করতে চাই, আমি। “

ওর কথা শুনে লামিয়া, মেঘলা শব্দ করে হেসে উঠল। নওশিন তামসীর মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“ বিয়ে করবি?”
“ হ্যাঁ। “
“ বিয়ে করে করবি কী?”
“ সবাই যা করে, তাই করবো। দিনেরবেলা ঝিগিরি আর রাত হলে বরের সাথে রোমান্স… ধ্যাৎ! আমার শরম করে। “

তামসীর কথায় ঘরজুড়ে হাসির রোল উঠলো। এরমধ্যে রাফি, রাবিন ও শুভও এলো। রুমে ঢুকেই এমন হাসাহাসি দেখে রাবিন বলল,
“ কী হয়েছে গো?”
“ তোমার বোনের বিয়ে হবে। “
তামসীর কথায় আবারও হেসে উঠল সবাই। রাবিন চোখ টিপ্পনী কাটলো।
“ তুই চাইলে তোরও বিয়ে হতে পারে। “
“ থাম তোরা। আগে আমার বিয়ে হোক তারপর তোদেরও সিরিয়াল আসবে। সবগুলো এতো পাকা!”
তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল নওশিন। রাফি, শুভ নওশিনকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলো এতক্ষণ। শুভ বলল,
“ তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে, আপু। মাশা-আল্লাহ! “
ভাইয়ের প্রশংসায় মাথা নিচু করে ফেলল নওশিন। হেসে বলল,
“ দোয়া করিস ভাই। “
“ তোমার জন্য দোয়া চেয়ে নিতে হবে? “
নওশিন হেসে শুভর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

আসরের আজান দিচ্ছে। চারদিকে আজানের ধ্বনি মুখরিত হচ্ছে । মির্জা বাড়িতে এখন শেষ মুহুর্তের ব্যস্ততা। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি-না সেসব দেখে নিচ্ছেন নির্জর মির্জা। আয়মান, সমাইয়া মিলে রান্নাবান্নাসহ ঘরের যাবতীয় কাজকর্মের তদারকি করলেন আরেকবার। বরপক্ষ কল করেছিলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে তারা।

গালিব কালো পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে। অতিথিদের অভ্যর্থনা করছে নিখুঁত ভদ্রতায়। সবাই গালিবকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছে যেন। বত্রিশ বছরের এই ভদ্রলোক যেন মির্জা পরিবারের আসল কর্ণধার।

এদিকে নওশিন ঘরে একা বসে আছে। লামিয়া, মেঘলা, তামসী, রাফি, রাবিন, শুভ সবাই বর আসার অপেক্ষায় গেটের মুখে অপেক্ষা করছে। এমনকি নওশিনের বান্ধবীরাও গেছে, সেখানে। নওশিনের মনটা খারাপ। বিয়ে করেই সূদুর কানাডায় পাড়ি জমাতে হবে তাকে। একদিকে নতুন জীবনের আনন্দ অন্য দিকে প্রিয়জনদের থেকে দূরে চলে যাওয়ার বেদনা– সবকিছু মিলে মিশ্র অনুভূতি অনুভব হচ্ছে তার।

“ শরীর দেখানোর ইচ্ছে থাকলে সবটা দেখাবি, একটু-আধটু বের করে লোকের মাথা নষ্ট করবি না। “
এতো এতো লোকজনের মধ্যে আচমকা এমন কথা শুনে চমকাল তামসী। চারপাশে সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। গালিব দাঁড়িয়ে আছে তামসীর পিছনে। তামসী ওর দিকে তাকালো। গালিবের বলা অপমানজনক কথাটা কানে বাজছে শুধু।

“ এটা কেমন কথা, ভাইয়া?”
“ নিজের দিকে তাকা। “
তামসী নিজের দিকে তাকাল, সবকিছুই ঠিকঠাক লাগছে। তবুও কেন গালিব ভাইয়া এমন কথা বললেন সেটাই বুঝলো না সে।
“ কী হয়েছে?”
গালিব কোনো কথা না বলে তামসীর হাত ধরে টানতে টানতে দোতলায় নিয়ে গেলো। দোতলার দ্বিতীয় ঘরটা গালিবের, সেখানেই গিয়ে ঢুকলো দু’জন। তামসী এতটাই অবাক হয়েছে যে গালিবকে কোনো বাঁধা পর্যন্ত দেয়নি।

রুমে ঢুকে খুব জোরেশোরে দরজাটা আঁটকে দিলো গালিব। তামসীকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে হিসহিসিয়ে আওড়াল,
“ শাড়ি পরলে কোমর দেখা যাবে কেন? যদি কোমর দেখাতেই ইচ্ছে করে তবে ভালো করে দেখা, সবাই হা করে দেখুক। “

সহসাই তামসীর চোখ ছলছল করে উঠলো। অপমান, লজ্জা ঘিরে ধরেছে তাকে। গালিব থামলো না। শক্ত হাতে তামসীর চুলগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে বলল,
“ ব্লাউজের গলা এমন যে পুরো পিঠ দেখা যাচ্ছে। তাহলে এই ব্লাউজ পরার দরকার কি? বিনা ব্লাউজে শাড়ি পরতিস? আরো আকর্ষণীয় লাগতো। “
তামসী মাথা নিচু করে, নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে শুরু করেছে। সত্যি বলতে তামসী কখনো বিষয়গুলো এভাবে দেখেনি। ওর কাছে এগুলো জাস্ট ফ্যাশনের অংশ। তাছাড়া বাড়ির লোকজনও কখনো এসব নিয়ে কিছু বলেনি।

“ কী রে? কথা বলছিস না কেন? গায়ে লাগলো? “

তামসী চুপ করেই রইলো। সত্যি বলতে অপমানের থেকেও লজ্জা বেশি লাগছে। গালিব যে তাকে এভাবে দেখেছে সেটা ভেবেই অস্বস্তি হচ্ছে ওর। তামসীকে চুপ করে থাকতে দেখে গালিব ওকে নিজের থেকে ফেরালো। শক্ত করে থুতনিতে হাত রেখে, মুখটা উঁচিয়ে ধরলো তামসীর।

“ লিসেন, ভবিষ্যতে যদি তোকে কখনো এভাবে চলাফেরা করতে দেখি তাহলে ওইদিন মেরে সিধে করে দেবো। এক থাপ্পড়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দেবো তোর। এখন চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়িয়ে দিবি আর শাড়ি ঠিকমতো পরে, বাইরে আসবি। বরপক্ষ এসেছে, বাইরে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আমি গেলাম। “

তামসীকে ছেড়ে দিলো গালিব। তামসী আগের মতোই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। গালিব দরজার দিকে এগোল, তারপর আবার পেছন ফিরে তামসীকে দেখলো– মেয়েটা কাঁদছে। বিরক্তিতে চ জাতীয় শব্দ করে, তামসীর কাছে এগিয়ে গেলো গালিব।

“ তামসী! আমার দিকে তাকা। “

তামসী খুব অস্বস্তি নিয়ে গালিবের দিকে তাকাল। গালিব দুই হাত দিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিলো। তাতেই আরও পেয়ে বসলো মেয়েটা। শব্দ করে কেঁদে উঠলো। গালিবের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলোনা তাতে। তামসীকে আহ্লাদ দিলেই যে পেয়ে বসে তা ওর অজানা নয়।
“ কাঁদিস না। আগামীকাল অনেকগুলো বেলুন কিনে দেবো আর সাথে আইসক্রিম, চকলেটও। “
“ সত্যি দিবেন?”
এতক্ষণে মুখ খুললো তামসী। গালিব যদিও হাসে না খুব একটা, তবে এখন তার ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসির রেখা দেখা দিলো। তামসীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে।
“ হ্যাঁ সত্যি, তিন সত্যি। “
“ ঠিক আছে। “
“ যা বললাম তাই করিস। তারপর গেটের কাছে চলে আসিস। যাচ্ছি। “

“ আমি পাঁচ মিনিট পর রুমে গিয়ে শাড়ি ঠিক করে আসতেছি।!

“ এখানেই কর, রুমে গেলে লেট হবে। “
“ ওকে ওকে। “
“ হুম। “
গালিব এতটুকু বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তামসী দরজা আঁটকে শাড়ি ঠিক করে পরতে শুরু করলো। গালিব ভাইয়া বরাবরই এমন। তামসীকে বকবে তারপর আবার ঘুষও দেবে। তবে বকা খেয়ে লাভই হলো। কতকিছু পাওয়া যাবে এখন! এসব ভাবতে ভাবতে শাড়ি ঠিকঠাক করে ঘর থেকে বেরুলো তামসী।

বর এসেছে। সবাই সেই নিয়ে ব্যস্ত। কাজী সাহেবও উপস্থিত। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ের কার্যক্রম শুরু হবে। ওরা সব কাজিনরা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। রাবিন অনেক সময় ধরে তামসীকে দেখছিলো। হুট করে দুজনের চোখাচোখি হতেই ভেংচি কাটল তামসী। ওদিকে রাফি আছে, খাবারের অপেক্ষায়। কখন বিয়েটা শেষ হবে আর কখন ও খেতে বসবে এটাই ওর একমাত্র চিন্তার বিষয় এখন। মেঘলা বিষয়টা ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। তাই রাফিকে জ্বালাতন করার সুযোগ মিস করতে চাইলো না মেঘলা। লামিয়াকে অন্য দিকে সরিয়ে দিয়ে ও নিজে গিয়ে রাফির পাশে দাঁড়াল।
“ ভাইয়া?”
ফিসফিস করে ডাকলো মেঘলা। রাফি ভ্রু কুঁচকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কী?
“ খিদে পেয়েছে? “
“ কেন খাবার দিবি?”
“ তুমি এতো ছুঁচো! “
চোখ পাকাল রাফি। বলল,
“ এই কটকটি! চুপ। সব সময় শুধু আমার খাওয়া নিয়ে কথা বলে.. “
“ খাওয়াদাওয়া ছাড়া কী আছে তোমার জীবনে? কলেজে পড়তেছ, কোনো গফও তো নাই। “
রাফি মেঘলার পিঠে এক ঘুষি মেরে বলল,
“ আমার তো জিএফ নাই। কিন্তু তুই চাইলে আমি গালিব ভাইয়াকে বলে তোর জন্য ভালোমন্দের ব্যবস্থা করাতে পারি। ভাইয়াকে বলবো? তুই কীসব বলছিস আমাকে? “
শুকনো ঢোক গিলল মেঘলা। লামিয়াকে আবারও ঠেলে রাফির পাশে এনে দাঁড় করিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল সে। আর কোনো কথাই বললো না।

❝ যখন পরেছিস শাড়ি
মনে হলো আমিও হতে পারি –
তোর জন্য রোমিও, জুলিয়েট
আর যা যা বাকি।
তুই একবার বল রাজি
করবোনা দেরি,
ডাকবো আমি তাড়াতাড়ি কাজী।
তামু রে… তামু…❞

রাবিন আর একটু গান গাইবার আগেই তামসী ওর মুখ চেপে ধরলো। রাগে কটমট করে তাকিয়ে বলল,
“ তোর ভাইকে বলে তোর হাত-পা ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো আমি। শয়তান পোলা! সবসময় ফাইজলামি। “

“ না ময়নার মা, না। তুই এমন করিস না। আমি জানি তুই এতো পাষাণ না। দয়া করে ওই জল্লাদকে কিছু বলিস না। “

তামসীর হাত ধরে বিনীতভাবে বলল রাবিন। তাতে যেন বেশ মজাই পেলো তামসী। ও কিছু বলতে যাবে এরমধ্যেই বিয়ের কাজ শুরু হলো। রাবিনের হাত সরিয়ে দিয়ে সেদিকে মনোযোগ দিলো তামসী।

কিছুক্ষণের ব্যবধানে নওশিনের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো। সবাই নবদম্পতির জন্য মুনাজাত ধরে, তাদের জন্য দোয়া করলেন। গত কয়েকদিনের আনন্দ যেন হঠাৎ করেই বিরহে রূপ নিলো। মির্জা বাড়ির সকলের মন এখন ভারাক্রান্ত। সকলের চোখ ছলছল করছে। খাওয়াদাওয়া শেষ হলেই নওশিনকে নিয়ে চলে যাবে জামাই। তবুও এই সত্যি মেনেই চলতে হবে। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর সকলে খাওয়াদাওয়ার জায়গার দিকে গেলো।

চলবে