গালিব মির্জা পর্ব-০৭

0
11

#গালিব_মির্জা
#পর্ব_৭
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

দুপুরের রোদ মাথার উপর ঝলসে উঠেছে। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই, চারপাশ যেন তপ্ত আগুনে মোড়ানো। রাস্তায় ধুলো উড়ছে, নিস্তব্ধতার ভেতর মাঝে মাঝে কুকুরের হাহাকার শোনা যাচ্ছে।

“ কী রে মামা? খোঁজ নাই কেন? নতুন মাল পাইলি না-কি? “
ক্যান্টিনে বসেছিল রাবিন, অয়ন, ও অন্যান্য বন্ধুুরা। এরমধ্যেই সেখানে এসে উপস্থিত হলো রকি। ছেলেটার মুখে যেন লাগাম নেই। রাবিন ঢং করে বলল,
“ নাউজুবিল্লাহ! নাউজুবিল্লাহ! কীসব বলিস! মাল আবার কী বেটা? “
“ আহা গো! সোনা আমার, তুমি তো কিছুই বোঝো না। গফ থাকলে তো ফিডার খা……”

রকির কথা শেষ হওয়ার আগেই রাবিন ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
“ চুপ কর শালা। তোর মুখে কোন লাগাম নেই। বোনের বিয়ে ছিলো, সেজন্য কিছুদিন এদিকে আসা হয়নি। “
“ তাই বল! আচ্ছা বল কী খাবি।”
রাবিনের পাশেই বসেছে রকি।
“ তুই কি খাবি সেটা বল। “
রকি ফিচেল হেসে ভ্রু উঁচিয়ে কিছু একটা ইশারা করতেই সবাই হেসে উঠল। রাবিন ওর কাঁধে ঘুষি মেরে বসলো একটা। বলল রাবিন,
“ লুচ্চা একটা। খাবারের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, অন্য কিছু না। “
“ পেট আমার ভরা আছে, মনটা খালি। “

অয়ন বলল,
“ তোর মন খালি! গত সপ্তাহেই তো টিনাকে পটিয়ে, ডেটিংয়ে গেলি। এরমধ্যেই, সব শেষ? “

রকি নড়েচড়ে উঠল। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে, খুব আয়েসি ভঙ্গিতে একটা সিগারেট ঠোঁটে গুঁজল। তারপর লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে, ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“ ওই বেডির ভাব বেশি। ঢং এর তো শেষ নেই। যাবে ডেটিং তারমধ্যে বলবে, আমি এসবে অভ্যস্ত নই। আরে বেডি তোকে তো রুম ডেট করতে নিয়ে যাইনি৷ জাস্ট ঘুরতে গিয়েছিলাম। তাতেই কথা প্যানপ্যানানি! “

বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল রকি। তাতেই হেসে উঠল সবাই।

রকি নিজের মতো বসে আছে। চুলগুলো ঘাড় ছুঁইছুঁই তার, কপালেও বেয়ে আছে। ছাই রঙা শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খুলে রাখা, হাতটাও গুটিয়ে রাখা – কনুইয়ের ওপরে। সবসময় চোখে কেমন দুষ্ট একটা ভাব খেলে যায় রকির। ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে রকিকে সবাই ভবঘুরে, পাগল বলে ডাকে। ছেলেটা সারাক্ষণ এখানে, ওখানে ঘুরে বেড়ায়। যাকে বলে ভ্রমণপিয়াসী মানুষ।

“ বুঝলাম। আচ্ছা তোরা থাক, আমি গেলাম। জানিসই তো, ভাইয়া দেশে ফিরেছে। দেরি করে বাড়ি ফিরতে পারবোনা। “

রাবিন কথাগুলো বলতে বলতে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। রকি বলল,
“ তোর ভাই তো জাদরেল। ভবিষ্যতে তোর প্রেমের পথে যেন ঝামেলা না করে সেটাও দেখিস। তোর কাজিনকে তো পছন্দ করিস, তাই বললাম। “

কথাটা শুনে চিন্তায় পড়ে গেলো রাবিন। রকি ভুল কিছু বলেনি। গালিব ভাইয়া কি তামসীর সাথে ওর সম্পর্কটা মেনে নেবে? অবশ্য সম্পর্ক হলো কই? তামসী তো ওকে পাত্তাই দেয় না। কী আর করার! তামসী পাত্তা না দিলেও রাবিন দেয়, একশো পার্সেন্ট এ একশো পার্সেন্টই পাত্তা দেয় ওকে।

“ ভয় দেখাস না তো। যাচ্ছি আমি, টাটা। “

রাবিন কথাগুলো বলেই হনহনিয়ে চলে গেলো। রকি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো কেবল।

সারাদিন পুরনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া আর শহর ঘুরে গালিব যখন বাসায় ফিরলো তখন রাত নেমে এসেছে। অনেক বছর পর দেশে ফিরে শৈশব-কৈশরের বন্ধুদের সাথে সময় কাটাবে না এমনটা তো হয় না।

গেট পেরিয়ে ড্রাইভওয়ে দিয়ে হেঁটে এসে ড্রইংরুমে ঢুকলো সে। আজ গালিবের সাজ একেবারে ভিন্ন। কালো রঙের ফিটেড শার্ট, হাতা গুটানো, সাথে ডার্ক ব্লু ডেনিম। পায়ে লোফার, আর কব্জিতে স্টিলের ঘড়ি। চুলগুলো হালকা সেট করা, মুখে সারাদিনের ক্লান্তি থাকলেও তার গম্ভীর ব্যক্তিত্বকে ঢাকতে পারেনি।

লাল টুকটুকে ওয়ানপিসের ওপর নীল জিন্সের প্লাজু, খোলা চুল এলোমেলোভাবে কাঁধে ছড়িয়ে আছে। সেজে না উঠলেও স্বভাবসিদ্ধ ভরাট সৌন্দর্যে মুহূর্তে দৃষ্টি কাড়লো মেয়েটা। টিভিতে কার্টুন দেখায় এতটাই ব্যস্ত মেয়েটা যে গালিবের উপস্থিতি টের পায়নি। তবে আচমকাই গালিবের নজর গেলো তামসীর ওড়না বিহীন বক্ষদেশের দিকে। মেজাজ বিগড়ে গেলো ওর। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, রাবিন আসছে এদিকেই। তবে গালিবকে দেখে মুচকি হাসল রাবিন। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেই বললো,
“ কিছু লাগবে ভাইয়া? “
রাবিনের কথায় সামনে তাকাল তামসী। গালিবকে দেখেই শুকনো ঢোক গিলল একবার। লোকটার সামনে আসতে না চাইলেও আসতে হয় কেন?
“ কিছু লাগবে না। “
গালিব সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে, দ্রুত পা চালিয়ে দোতলার দিকে এগোল।

রাবিন এসে বসলো তামসীর পাশে। তামসী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“ মতলব কী?”
রাবিন মিষ্টি করে হেসে বলল,
“ প্রেম করা। “
“ তো করো গিয়ে। মানা করে কে?”
তামসী টিভির স্ক্রিনে তাকালো এবার। মটু- পাতলু একসাথে চা-ওয়ালা মামার দোকানে এসে বসেছে। মটু সমুচা অর্থাৎ সিঙ্গাড়া খাবে বলে জেদ করছে কিন্তু আগের টাকা বাকি থাকায় চা-ওয়ালা মামা সমুচা দিতে নারাজ।
“ ঢং করিস না, মাতারি। “
তামসী কোনো জবাব দিলো না। এরমধ্যে সেখানে রাফি এলো। রাবিনের পাশে বসেই টিভির রিমোটটা হাতে নিলো রাফি। তবে তামসী তৎক্ষণাৎ রাফির হাত থেকে রিমোটটা কেড়ে নিয়ে বলল,
“ খবরদার চ্যানেল পাল্টাবি না। এখন আমার কার্টুন দেখার সময়। “
রাফি তেতে উঠে বলল,
“ সব সময় টিভি দেখতে এলেই এমন করো। “
“ তুই আমার কার্টুন দেখার টাইমে না এলেই পারিস। “
“ তুমিও অন্য সময় কার্টুন দেখলেই পারো। “
তামসী চট করে রাফির কানমলে দিলো একবার। ব্যথায় আহত দৃষ্টিতে রাবিনের দিকে তাকাল রাফি।
“ ছোট, ছোটর মতো থাক। বড় বোনের মুখ মুখে কথা বলে! বেয়াদব একটা। “

তামসী ভেংচি কাটল। রাফি মুখ ফুলিয়ে ফেলল তাতে। রাবিন বলল,
“ এই তামু তুই তো বুড়ী হয়েছিস, বড় মানুষ। তাহলে তোর আবার কার্টুন দেখার কী দরকার? এগুলো তো বাচ্চারা দেখে। “

“ তুমি চুপ করো। ফাজিল একটা। “

রাফি ভেংচি কাটল। আরেকদিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো,
“ বড়দের সাথে এভাবে কথা বলা কি বেয়াদবি হয় না?”
চোখ ছোট ছোট করে ফেলল তামসী। দুই ভাই মিলে মেজাজই খারাপ করে দিলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। হাতে থাকা রিমোটটা সোফায় ছুঁড়ে মারলো। সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলল,
“ জন্মের টিভি দ্যাখ তোরা। অজাতের বংশ। “

রাবিন হাঁক ছেড়ে বলল,
“ তুই বুঝি আরেক বংশের অজাত?”
তামসী আরও রেগে গেলো। রাগের ঝড়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলো। বুক ধড়ফড় করছে, পায়ের শব্দ যেন পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে দিচ্ছে। একা একা বিড়বিড় করতে করতে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো সে। ঘুরে দাঁড়াতেই নিঃশ্বাস আটকে গেলো তার। চেয়ারে বসে আছে গালিব। চোখমুখ বেশ গম্ভীর। তার চারপাশে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে, যেন সময় থমকে গেছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কিছু একটা ঘটেছে… তামসীর বুক ধক করে উঠলো, এই বুঝি গালিব বকাবকি শুরু করে সেই ভেবে।
“ এদিকে আয়। “
গালিবের এমন কণ্ঠস্বর শুনে আরও ভয় পেলো তামসী।
“ কী!”
“ বাংলায় বলেছি। তাছাড়া তুই ইংরেজিতেও কাঁচা না, যে বললে বুঝবি না। “
তামসী শুকনো ঢোক গিলে, গালিবের কাছে এগিয়ে গেলো। পাশে চুপ করে দাঁড়াল। গালিব তামসীর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“ শালীনতা বুঝিস?”
আচমকা এরকম প্রশ্নে থতমত খেলো মেয়েটা। কী বলবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না যেনো। গালিব ওর নীরবতা উপেক্ষা করে ফের বলল,
“ ওড়না ছাড়া চলাফেরা করলে আকর্ষণীয় লাগে, তবে শালীন না। তুই কি চাস ছেলেরা তোর দিকে সেভাবেই তাকাক?”

শব্দগুলো ছুরির মতো কেটে গেলো তামসীর বুকে। মাথা নিচু করে ফেলল সে । মুহূর্তেই রাজ্যের লজ্জা এসে ভর করলো ওর ওপর। এভাবে গালিবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও অস্বস্তি হচ্ছে। লোকটা সবসময় অজায়গায় নজর দেয় কেন?

“ লজ্জা পাওয়ার ঢং করবি না, তামসী। লজ্জা থাকলে এভাবে চলাফেরা করতিস না। হ্যাঁ এটা আধুনিকতার অংশ, তবে আমার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। আমি চাই না তুই এভাবে চলাফেরা করিস। “

“ আপনি শুধু আমাকেই কেন বলেন এসব? বাকি….”

তামসীর কথা শেষ হওয়ার আগেই গালিব ওর হাত ধরে, হেঁচকা টান মারলো। ফলশ্রুতিতে তামসী গালিবের কোলে বসে পড়লো। অবাক হলো তামসী।
“ বাকিরা আমার হবু বউ না, তুই আমার হবু বউ। “

তামসী যেন চারশো বিশ ভোল্টের একটা শক খেলো। কী বললো লোকটা! বউ? না, হবু বউ!

“ ব…..ব…”
তামসীর অবস্থা দেখে ধমকে উঠলো গালিব।
“ কী ‘ ব…ব’ করে তোতলানো শুরু করেছিস? বউ, হবু বউ। “
তামসী কিছু বলতে পারলোনা আর। চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে আসছে ওর। কিছু বোঝার আগেই গালিবের বুকে লুটিয়ে পড়লো সে। গালিব ভয় পাওয়ার বদলে হেসে ফেললো। তামসীর আপাতত কোনো হুঁশ নেই.. …

চলবে