গালিব মির্জা পর্ব-০৮

0
11

#গালিব_মির্জা
#পর্ব_৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

তামসীকে ওভাবে রাগিয়ে দেওয়াতে অশান্তি অশান্তি লাগছে রাবিনের। তামসীর যা রাগ আর ত্যাড়ামি তাতে কয়েকদিন ঠিকমতো কথাই বলবে না– ভেবে অস্থির হয়ে উঠেছে রাবিন। রাফি নিজের মতো টিভি দেখতে ব্যস্ত। রাবিন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গিয়ে তামসীর রুমের সামনে দাঁড়াতেই দেখল দরজা বন্ধ। মনে হলো, রাগ করে তামসী দরজা আটকে দিয়েছে। ওর মনে হলো – না, তামসীর রাগ ভাঙাতেই হবে।

হবু বউ কথাটা শুনেই যে মেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, বিয়ের দিন তার কী অবস্থা হবে সে কথা ভেবেই বদ্ধ ঘরে বসে মিটিমিটি হাসছে গালিব। তানসীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, নিজে পাশে বসে আছে সে। আকস্মিক দরজায় ঠকঠক আওয়াজে কানখাড়া করে ফেললো গালিব।

“ তামু? ওই তামু! তোর সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। দরজা খুলে দে, তো। “

গালিব উত্তর দিলো না। রাবিনও থামলো না। তামসীর সাড়াশব্দ না পেয়ে ফের বলল,
“ তুই আমার পুকি শয়তাইন্না মাতারি। প্লিজ, দরজা খোল। “

গালিবের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল, ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। তারপর দরজা খুলে দিলো। রাবিন রুমের ভেতরে গালিবকে দেখেই শক খেলো যেন।

“ ভা…ভা….”
“ ভাইয়া. বল, ভ্যা ভ্যা করিস না। সবগুলোর এক সমস্যা, তোতলানো। “
গালিবের ধমকে নড়েচড়ে উঠল রাবিন। তড়িঘড়ি করে বলল,
“ ভাইয়া তামু কোথায়? আর তুমি এখানে? “

গালিব ভেতরের দিকে এগোল। রাবিন উঁকি দিয়ে দেখলো, তামসী বিছানায় শুয়ে আছে। তা-ও চোখ বন্ধ, অর্থাৎ চেতনাহীন। আঁতকে উঠল ছেলেটা। তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে তামসীর পাশে বসলো রাবিন। গালিব পাশের টেবিলের ওপর রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে আরেকবার চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিলো তামসীর।

“ তামুর কী হয়েছে? “

“ সেন্সলেস হয়ে গেছে। গুরুতর কিছু নয়৷ ঠিক হয়ে যাবে। “

রাবিনের মনে অনেক প্রশ্ন। বন্ধ ঘরে তামসীকে গালিব কী এমন করেছে বা বলেছে যাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল? ভাইয়া কি তামুকে মেরেছে না-কি খুব বকেছে সেটা ভেবেই সময় চলে যাচ্ছে রাবিনের ।

“ আচ্ছা। “
“ আমি আছি তামসীর কাছে, তুই নিজের কাজে যা। এখানে থাকতে হবে না। ‘
গালিবের কড়া কথাগুলো রাবিনের মোটেও ভালো লাগলো না। তামু অসুস্থ আর রাবিন নিজের ঘরে গিয়ে বসে থাকবে সেটা তো হয় না। রাবিন অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল,
“ আমিও থাকবো এখানে । তামুর জ্ঞান ফিরুক, তারপর চলে যাবো, ভাইয়া।”

কথাগুলো বলা শেষ হতেই মাথা নিচু করে ফেলল ছেলেটা। এই বুঝি গালিব ধমক দিলো সেই ভেবেই বুকটা দ্রিম দ্রিম শব্দ করে যাচ্ছে ওর । কিন্তু না, গালিব রাবিনের ধারণা ভুল প্রমাণিত করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“ জ্ঞান ফিরলেই চলে যাবি?”
“ হু। “
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল রাবিন। বাড়ির কাউকে না ডেকে এভাবে ঘরে দরজা আঁটকে কেন যে ভাইয়া বসে আছে সেই প্রশ্নটা রাবিনকে বড় খোঁচাচ্ছে।
“ ঠিক আছে। “
গালিব তামসির কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বললো। তবে রাবিন তা শুনতে পেলো না। খুব চেষ্টা করেও শোনার ক্ষমতা হয়ে উঠলো না তার৷ কিন্তু অজ্ঞান মানুষের কানে ফুসমন্তর দিলে কি তার জ্ঞান ফিরে? রাবিন এই প্রশ্নরও উত্তর খুঁজে পেলো না।

কিন্তু অবাক হলো সে। আচমকাই তামসী চোখ মেলে তাকাল। সেই চোখে যেন আতংক। আশেপাশে তাকিয়ে গালিব ও রাবিনকে দেখতে পেলো তামসী। ওর জ্ঞান ফিরেছে দেখে খুশি হলো রাবিন।
“ তামু? কী হয়েছিল তোর? এভাবে অচেতন হয়ে গিয়েছিলি কেমনে? “
তামসী শোয়া থেকে উঠে বসেছে কেবল৷ গালিবের দিকে আর দৃষ্টিপাত করেনি৷ লোকটা ফিসফিস করে কী দুষ্ট কথাটাই না বলল একটু আগে– “কিস করে দেবো, তামসী? না-কি চোখ খুলে তাকবি?” এই কথা শোনার পর তামসীর অবচেতন মস্তিষ্ক এমনি সজাগ হয়ে গেছে।

রাবিনের দিকে তাকিয়ে ভীরু কন্ঠে বলল তামসী,
“ তেমন কিছু না। এমনি মাথা ঘুরে গিয়েছিল। “
গালিব রাবিনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়াল রাবিন।
“ ঠিক আছে। আমি গেলাম। নিজের খেয়াল রাখিস একটু। “

গালিবকে পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো রাবিন।

তামসী এখনও ঝিম মেরে বসে আছে। গালিবের বউ হবে সে? হ্যাঁ, গালিব যখন বলেছে তখন এটাই সত্যি। মজা করার মতো মানুষ না সে। তামসীর ভাবনার ছেদ ঘটলো গালিবের হাতের স্পর্শে। তামসীর পাশে বসে ওর ডান হাতটা নেড়েচেড়ে দেখছে সে। তামসীর শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চলছে বোধহয়। ওর মনে হচ্ছে গলার কাছে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে। গলা দিয়ে হৃদপিণ্ডটা বের হয়ে আসতে চাইছে।
“ হবু বউয়ের কথা শুনেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললে, বউ হওয়ার পর কী করবি?”
চোখ ফিরিয়ে এক ঝলক গালিবের দিকে তাকাল তামসী । কিন্তু গালিবের মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলোনা। সে নির্লিপ্ত ভাব বজায় রেখেই তামসীর হাত খানা দেখছে এখনও। তামসী এতটাই হতভম্ব হয়ে গেছে যে হাতটা সরিয়ে ফেলবে সেটাও মনে নেই।
“ ওভাবে তাকালে সমস্যা হয়, আমার। চোখ নিচে নামা। “
শুকনো ঢোক গিলল তামসী।
“ কী সমস্যা? “
“ আমি ভদ্রলোক, আপাতত দৃষ্টিতে গম্ভীর মানুষ। আমি যদি বলি, ওভাবে তাকালে আমার অভদ্র হতে ইচ্ছে করে – তাহলে সেটা আমার পারসোনালিটির সাথে যায় না। কিন্তু তবুও এটাই সত্যি। “

গালিবের কথাগুলো কেমন প্যাঁচানো লাগলেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি তামসীর। হাত খানা ঝটকায় দূরে সরিয়ে ফেলল তামসী। চোখে চোখ রেখে বলল,
“ আপনি এরকম মানুষ কখনো বুঝতে পারিনি। আমি এক্ষুনি বাবার সাথে গিয়ে কথা বলবো, আপনার মতো হুতুমপেঁচাকে বিয়ে করবোনা। “

নিজেকে হুতুমপেঁচা বলায় বড় অবাকই হলো গালিব। হুট করে তামসী নিজের রণচণ্ডী রূপে ফিরে এসেছে ভেবেই হাসি পেলো ওর। কিন্তু হাসলোনা। হাসলে যদি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়! তামসী ইতিমধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। গালিব মনে মনে ভাবলো, আজকেই আংটি কিনতে যাবে তামসীর জন্য। এতক্ষণ হাত নাড়াচাড়া করে আংটির মাপ বোঝার চেষ্টা করছিলো ভদ্রলোক….

রাত গভীর। চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল দূরে কুকুরের হালকা ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে রাত গুনছে।
মির্জা বাড়ির বসার ঘরে সকলে উপস্থিত। কারো মুখে কোনো কথা নেই, নীরবতা যেন দেয়াল ভেদ করে ছড়িয়ে পড়েছে। কিয়ৎক্ষণ আগে তামসী নিজের বাবার সাথে গালিবের সাথে ওর বিয়ের সত্যতা কতটুকু সেই বিষয় কথা বলেছিলো। তামসীর বাবা মেয়ের কাছে অকপটে স্বীকারও করেছেন। কিন্তু তামসী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, সে গালিবকে বিয়ে করতে চায় না। সেই বিষয় গালিবের সাথে কথা বলার জন্যই এখন, এই মাঝরাতে মির্জা বাড়ির ড্রইংরুমে পিনপতন নীরবতা নেমে এসেছে।
রাবিনের চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। আকস্মিক ঘটনায় আহত সে। যাকে বউ করতে চেয়েছিল সে এখন ভাবি হতে চলেছে। এই ভেবে কিছুক্ষণ পর পর রাবিন চোখমুখ কুঁচকে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদার চেষ্টাও করছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় চোখ জল আসছে না। তামসীকে কি তাহলে সে সত্যি বউ করতে চাইতো না? রাবিন কনফিউজড, খুব কনফিউজড।

“ তামসী তুই এমন করছিস কেন? গালিবের সাথে বিষয়তে কী সমস্যা তোর?”
আয়মান মির্জা শুধলেন। তামসী গালিবের দিকে তাকাল একনজর, ভদ্রলোক ওর দিকেই তাকিয়ে বসে আছে। অস্বস্তি হচ্ছে ওর।
“ বড়ো আম্মু আমার উনাকে অপছন্দ নয়, তবে আমি নিজেদের পরিবারের মধ্যে বিয়ে করতে চাই না। “
মেয়ের কথায় চোখ বড়ো বড়ো করে ফেললেন নির্ঝর মির্জা। বিয়ে না করার পেছনে এটা কোনো কারণের মধ্যে পড়ে?

“ এটা কেমন কথা তামসী?”
বাবার প্রশ্নে চুপ করে গেলো সে। গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো গালিব। সবাই তার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তামসীও তাকালো।
“ আমাকে অপছন্দ না করলে, বিয়ে না করার কোনো কারণ দেখছি না আমি। “
“ আমার মতামতের দাম নেই?”
তামসীর স্পষ্ট কথা। লামিয়া আর মেঘলা ঢুলুঢুলু চোখে সব দেখছে কেবল। শুভ চুপচাপ দাঁড়িয়ে, রাবিনের অবস্থা দেখে যাচ্ছে।
“ অবশ্যই আছে। আমি তোকে ভালোবাসি তামসী। তাই বিয়ে করতে চাইছি। যদি তোর মনে হয় আমার ভালোবাসা উপেক্ষা করে তুই অন্য কোথাও বিয়ে করবি, ইট’স ওকে। তোর যা ইচ্ছে সেটাই হবে। আমার যা বলার ছিলো বললাম। যদি আমাকে গ্রহণ করতে আপত্তি না থাকে, সকালে শপিংয়ে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে আমার রুমে আসিস। “

গালিব কথাগুলো বলেই গটগট করে চলে গেলো। সবাই হা করে তাকিয়ে রইলো তামসীর দিকে। বাড়ির গম্ভীর ছেলেটা তামসীকে ভালোবাসার কথা জানালো, তা-ও এভাবে! তামসী বরফের মতো জমে গেছে। গালিব তাকে ভালোবাসে! এতগুলো মানুষের সামনে গালিবের প্রপোজালে তামসী লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে। বাকিরাও চুপচাপ। এভাবে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সবাই এক এক করে নিজেদের বেডরুমের দিকে এগোতে লাগলো। নির্জর মির্জা মেয়ের ওপরেই সবকিছু ছেড়ে দিয়েছেন। তামসী যা চাইবে তাই হবে।

চলবে….