#গালিব_মির্জা
#পর্ব_১৩
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
মির্জা বাড়ির ড্রইংরুমে ঝাড়বাতির আলোয় জমে উঠেছে গালিব ও তামসীর বিয়ের তারিখ নিয়ে আলোচনা। দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির টিকটিক শব্দের মাঝেই সাইদ মির্জা বললেন,
“বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে ফেলাই ভালো।”
নির্জর মির্জা গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লেন।
“আমিও তাই ভাবছি। দেরি করার কোনো মানেই দেখি না।”
তামসী লাজুক ভঙ্গিতে আঁড়চোখে গালিবের দিকে তাকালো। গালিবও তেমন এক রহস্যময় হাসি ছুঁড়ে দিলো তার দিকে। তারপর হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“আমার ছুটি অর্ধেক কেটে গেছে, বাবা। তাই সবকিছু দ্রুত শেষ করতে হবে। তাছাড়া তামসীর ভিসা পেতে সময় লাগছে। এখনই সাথে নেওয়া সম্ভব না। মাসখানেক পর এসে নিয়ে যাবো।”
কথাটা শুনেই ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসলো তামসী। এই লোক তো বলেছিলো বিয়ের পরই নিয়ে যাবে, এখন আবার মাসখানেক! কী বজ্জাত! মনে মনে ভেংচি কাটলো সে।
সাইদ মির্জা চারপাশে তাকিয়ে প্রস্তাব দিলেন,
“তাহলে দু’দিন পর, শুক্রবার বিয়ের দিন ঠিক করি না? নিজেদের মধ্যেই সব আয়োজন হবে।”
তামসীর বাবা-মাসহ সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। মুহূর্তেই ঘরে আনন্দময় ব্যস্ততা ছড়িয়ে পড়লো। কে কী দায়িত্ব নেবে সেই নিয়ে আলোচনা শুরু হলো।
কিন্তু তামসী ধীরে ধীরে উঠে ড্রইংরুম থেকে নিজের ঘরে চলে গেলো। গালিব তার সেই হঠাৎ সরে যাওয়া খেয়াল করলো। কিছুক্ষণ পর চুপিচুপি তামসীর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা লক করা। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো গালিব। সেদিনের পর থেকে আর কখনো দরজা খোলা রাখে না সে।
“তামসী?”
গালিবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
ভেতরে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে ছিলো তামসী। মুখ ঘুরিয়ে ভেংচি কাটলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গিয়ে দরজা খুললো। গালিব ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। মুহূর্তেই ঘরটা ভারী হয়ে উঠলো।
তামসী নিরব, দু’চোখে ক্ষোভ আর কৌতূহল মেশানো ছায়া।
“কী হয়েছে?” গালিব জানতে চাইল।
“কিছু না।” তামসী মুখ গোমড়া করে বললো।
গালিব তার চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,
“সবকিছু তো মুখের কথায় হয় না, তামসী। পাসপোর্ট-ভিসা করতে সময় লাগে। এজন্যই মন খারাপ করেছিস, তাই না?”
তামসী অবাক। এ লোক আমার মনের কথা বুঝলো কীভাবে!
“না মানে… আপনি বুঝলেন কীভাবে আমি এসব ভেবেছি?”
গালিবের ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি ফুটলো, চোখে দুষ্টুমি ঝলক।
“তোকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি।”
সে বিছানায় বসলো। চোখের ইশারায় তামসীকেও পাশে বসতে বললো। দ্বিধাগ্রস্ত মেয়েটি ধীরে ধীরে বসে পড়লো। ঠিক তখনই গালিব হঠাৎ তার কোমরে হাত রেখে টেনে নিলো কাছে।
ভড়কে গেলো তামসী। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো।
“কি কি বুঝতে পারলি?” গালিবের কণ্ঠ নীচু, কেমন যেন নরম অথচ দুষ্টু।
“আ… আমি কিছুই বুঝিনি। আর সরুন… বিয়ের আগে এসব ইটিশপিটিশ নয়।”
“ ইটিশপিটিশ মানে?”
“মানে ওই… হুটহাট চুমু, জড়িয়ে ধরা, এগুলো।”
গালিব চোখ সরু করে তাকালো। যেন নতুন কোনো মজা পেলো।
“ওহ, আচ্ছা! বুঝেছি। ভদ্রলোক হয়ে যাচ্ছি তবে।”
বসে থাকা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়িস। কাল অনেক কেনাকাটা বাকি আছে।”
তামসী লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। গালিব হালকা হাসি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
ঘর নিস্তব্ধ হয়ে এলো আবার। তামসী বিছানায় বসে জানালার বাইরে তাকালো। মনে মনে ফিসফিস করে বললো–
❝ এ লোকটা আমাকে এত সহজে পড়ে ফেলে কীভাবে? আর কীভাবে এই গম্ভীর লোকটার সাথে জড়িয়ে গেলাম আমি! ❞
পরদিন সকাল থেকে মির্জা বাড়ির পরিবেশ বদলে গেল। ঘরের ভেতর-বাইরে উৎসবের আমেজ। উঠোনে এসে ঢুকতেই চোখে পড়ে সাজসজ্জার জন্য এনে রাখা ফুল, আলো আর কাপড়ের রঙিন প্যাকেট। তামসী সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই সেজে-গুজে বসে রইল। রেডি হয়েই ব্রেকফাস্ট করে গালিবের সাথে বের হলো। প্রথমেই গেল গহনার দোকানে। সোনার সেট থেকে শুরু করে কানের দুল, নাকফুল, চুড়ি– সবই পরখ করে দেখলো। তার চোখে-মুখে আনন্দ আর নার্ভাসনেস মিশে ছিল।
গালিব ভেতরে ভেতরে তামসীর প্রতিটি ভঙ্গিই লক্ষ করছিল। তবে সে খুব একটা কিছু প্রকাশ করেনি। মাঝে মাঝে তাকিয়ে থেকেছে কেবল। তাতেই তামসী নার্ভাসনেস কেটে গিয়েছিল। গহনা কেনাকাটা শেষে তারপর গেল শাড়ির দোকানে। তাকের পর তাক সাজানো রঙিন শাড়ির সমারোহ। লাল বেনারসি তামসীর সামনে মেলে ধরতেই তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল ওর। গাঢ় লাল রঙে সোনালি জরি কাজ করা সেই শাড়ি হাতে নিয়েই আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আয়নায় নিজেকে দেখে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে গেল। যেন ভবিষ্যতের সেই দিনের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
গালিবও পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিল। তামসী আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বে যে লাজুক হাসি দিয়েছিল, সেটি তার চোখ এড়ায়নি।
“ এটা নিবি? দারুণ মানিয়েছে তোকে।”
আয়নার দিকে তাকিয়েই বলল গালিব। তামসীর নজরও সামনের দিকে।
“ ঠিক আছে। “
মুচকি হেসে বলল তামসী। গালিব তবুও দু’টো বেনারসি নিলো। একটা লাল টুকটুকে আরেকটা মেজেন্টা কালারের। তামসী অবশ্য এতো খরচ করতে বারণ করেছিলো কয়েকবার তবে গালিব এ বিষয় কিছু শুনতে নারাজ।
দিনের বাকি সময়টা ওদের হশ কেটেছে প্রসাধনী, জুতো আর অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিস কেনাকাটায়। দোকান থেকে দোকানে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হলেও তামসীর চোখে-মুখে ক্লান্তির কোনো ছাপ পড়েনি। প্রতিটি জিনিস বেছে নেওয়ার সময় তার মুখের উজ্জ্বলতা যেন চারপাশ আলোকিত করে তুলছিল।
শুধু গালিব আর তামসী নয়, মির্জা বাড়ির অন্যরাও কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিল আজ। সকালের নাস্তার পর সবাই ভাগ হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো আলাদা আলাদা তালিকা হাতে নিয়ে।
সন্ধ্যা নামার আগেই সবার কেনাকাটা শেষ হলো। গালিব, তানসীসহ বাকিরা বাড়িতে ফিরে এলো। আগামীকাল গায়ে হলুদ, তারপর বিয়ে!
রাতের খাবার শেষ করে নিজের রুমে এসে বসেছে মেঘলা। দূরে কোথাও নেড়ি কুকুর ডেকে চলেছে, সাথে যানবাহনের শব্দ। এমন সময় দরজার সামনে কারো উপস্থিতি টের পেলো সে। ভ্রু কুঁচকে গলা উঁচিয়ে বললো,
“কে?”
“আমি, শুভ।”
পরিচিত কণ্ঠ শুনেই ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠলো মেঘলার।
“এসো।”
শুভ ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকে দাঁড়ালো। মেঘলা ভেংচি কাটলো একবার।
“আসতে এত দেরি করলে কেন?”
শুভ লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। ভারী কণ্ঠে বললো,
“তুই এমন পাগলামি করিস কেন, মেঘু? বাড়িতে জানাজানি হলে কী হবে ভেবেছিস?”
উত্তরে মেঘলা আরেকবার ভেংচি কাটলো। মুহূর্তেই উঠে গিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে আঁটকে দিলো। শুভ হকচকিয়ে গেলো।
“দরজা বন্ধ করলি কেন!”
ঠোঁট বাঁকিয়ে মেঘলা মৃদুস্বরে বললো,
“বাসর করবো তোমার সাথে।”
শুভর বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠলো। মুখের অভিব্যক্তিতে দ্বিধা, বিস্ময় আর ভেতরের অস্থিরতা স্পষ্ট। কিন্তু মেঘলার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলা করছে। সে ধীরে ধীরে শুভর পাশে এসে দাঁড়ালো।
“বড্ড পেকেছিস তুই।”
“কইছে তোমারে?” ভেংচি কাটল মেঘলা।
শুভ তার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,
“বলেছে তো– তোর হাবভাবেই সব বোঝা যায়। ইঁচড়েপাকা একটা।”
“ তাই না?”
কথা বলতে বলতে মেঘলা হঠাৎ শুভর গলায় হাত জড়িয়ে ধরলো। শুভ প্রথমে একবার ছাড়াতে চেষ্টা করলো, কিন্তু মেয়েটির জেদি আঁকড়ে ধরায় হেরে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলো।
ওদের সম্পর্কের শুরু কয়েক মাস আগেই। মেঘলাই প্রথম প্রপোজ করেছিলো শুভকে। কিন্তু শুভ রাজি হয়নি। মেঘলা হার মানেনি। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, রাতবিরেতে হঠাৎ শুভর ঘরে গিয়ে বসে থেকেছে। শুভ সবাইকে বলে দেবে বলে হুমকিও দিয়েছে তাকে। তবুও মেঘলা ভয় পায়নি একটুও।
শেষমেশ শুভর কঠিন মনও গলে গেলো। ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান ভুলে, মেঘলার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে সে। আজও সেই দুর্বলতাই চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর মেঘলা বুঝে গেছে, যতই এড়িয়ে যেতে চাইুক, শুভ তাকে আর দূরে সরাতে পারবে না।
“ মেঘু! ছাড় প্লিজ। কেউ এসে পড়লে ঝামেলা হয়ে যাবে। ভাইয়া, আপুর বিয়ে পরশু। এখন কোনো ঝামেলা হলে বিষয়টা কি ভালো দেখাবে? “
মেঘলা কিছুটা ভাবুক হয়ে গেলো। শুভর গলা ছেড়ে পিঠে হাত রেখে, বুকে জড়িয়ে ধরলো। শুভর যেন প্রাণ যায়যায় অবস্থা! বুক ধুকপুক করছে খুব।
“ শান্ত হও শুভ ভাই। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলো। “
মেঘলার কথা শুনে হাসলো শুভ। ইতস্তত ভাব নিয়ে সে-ও মেঘলার কোমরে হাত রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
“ হয়েছে? জড়িয়ে ধরেছিস? শান্তি? এখন ছাড়। “
“ আরেকটু থাকি। “
“ না। তুই সারারাতেও ছাড়তে চাইবি না। বারবার এক কথা বলবি। “
মেঘলা বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলো শুভকে। মেয়েটার এমন চেহারার হাল দেখে হেসে উঠল শুভ। কপাল কুঁচকে ফেলল মেঘলা।
চলবে…..