গালিব মির্জা পর্ব-১৪

0
9

#গালিব_মির্জা
#পর্ব_১৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

মেঘলার কথা শুনে হাসলো শুভ। ইতস্তত ভাব নিয়ে সে-ও মেঘলার কোমরে হাত রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

“ হয়েছে? জড়িয়ে ধরেছিস? শান্তি? এখন ছাড়। “
“ আরেকটু থাকি। “
“ না। তুই সারারাতেও ছাড়তে চাইবি না। বারবার এক কথা বলবি। “

মেঘলা বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলো শুভকে। মেয়েটার এমন চেহারার হাল দেখে হেসে উঠল শুভ। কপাল কুঁচকে ফেলল মেঘলা।
“ যাও যাও। ধরলেই পালাই পালাই করে। “
শুভ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ঝুঁকে মেঘলার কপালে আলতো করে কিস করলো একটা। তাতেই শান্ত হয়ে গেলো মেয়েটা। সমস্ত অভিমান, রাগ ভুলে হেসে উঠল মেঘলা।
“ আসি?”
“ যাওও। গুড নাইট বেবি। “
শুভ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
“ বেবি! “
“ হুহ্। “
“ গুড নাইট। “

শুভ রুমের দরজা খুলে এদিকওদিক তাকিয়ে দেখলো লামিয়া আসছে, এদিকেই। যদিও মেঘলা আর লামিয়া আলাদা রুমে থাকে তবে অনেক রাত পর্যন্ত দুজনে খুব গল্প করে । বলাবাহুল্য, মেঘলা ও শুভর বিষয় একমাত্র লামিয়া আর নওশিনই জানে।

“ শুভ ভাইয়া? মেঘলা কি ঘুমিয়ে গিয়েছে?”
শুভকে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো লামিয়া। শুভ শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“ না, জেগেই আছে। “
লামিয়া মুচকি হেসে মেঘলার রুমে ঢুকলো। শুভ আর কালক্ষেপণ না করে নিজের রুমের দিকে এগোল।

মির্জা বাড়ির উঠোনটায় সকালে থেকেই সাজসাজ রব। মাঝারি আকারের উঠোন, চারপাশে আলো ঝোলানো হয়েছে। হলুদ-সবুজ রঙের কাগজের ফানুস আর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বারান্দা আর দরজাগুলো। ঘরের ভেতরে চলছে নানান প্রস্তুতি। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে পোলাও আর মাংসের গন্ধ।

তামসীর রুমে মেয়েরা ব্যস্ত তাকে সাজাতে। হলুদ রঙের সরল শাড়ি, হাতে-পায়ে আলতা আর গা ভরা হলুদের প্রলেপ – তাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। চারপাশে বোনেরা আর বান্ধবীরা হাসি-ঠাট্টা করছে। মাঝে মাঝে গান তুলছে, আবার হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

গালিব বসেছে উঠোনের একপাশে। তাকে ঘিরে বন্ধুবান্ধবরা হাসাহাসি করছে, মাথায়-গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে। গালিব ভদ্রভাবে সব সহ্য করছে, তবে তার চেনা গম্ভীর ভাবটা লুকাতে পারছে না। সবার মজা চলতেই থাকে।

একপর্যায়ে তামসীকে আনা হলো উঠোনে। চারপাশে শোরগোল বেড়ে গেলো। খালাতো-ফুফাতো বোনেরা দৌড়ে এসে তার গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিলো। হাসির রোল উঠল সবার মুখে। গালিব আর তামসীর চোখ দু’টো মাঝেমধ্যে মিললো, তবে দুজনেই চুপচাপ নিজেদের মতো বসে থাকলো।

আস্তে আস্তে চারপাশে হলুদ, হাসি আর খুশির আবহ ছড়িয়ে পড়লো। সবাই মিলে ছবি তুলল।
রাবিনের বন্ধুরাও এসেছিল। সবাই অনেক আনন্দ করলো। তবে সবকিছুর মাঝে রকির নজর ছিলো কেবল লামিয়ার দিকে। লামিয়ার প্রতি ভীষণ আকৃষ্ট হচ্ছে ছেলেটা। কিন্তু সে কথা কি রাবিনকে বলা উচিত হবে?

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে, সন্ধ্যার পর খাওয়াদাওয়া শেষ করে তামসী রুমে ফিরেই একটু আরাম করছিল। হঠাৎ ফোনে ভনভন শব্দে মেসেজ এল। গালিবের নামটা স্ক্রিনে ভেসে উঠলো।

“ছাদে আয়।”

মেসেজটা পড়েই বুকের ভেতর কেমন ধক করে উঠলো তামসীর। গালিব ছাদে কেন ডাকলো? তামসী এসব ভাবতে ভাবতে নিঃশব্দে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলো । পায়ের শব্দ যতটা সম্ভব কমিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ছাদের দিকে উঠতে লাগলো।

ছাদে পা রাখতেই মুখে ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগলো। চারপাশে শহরের আলো, দূরে উড়ে যাওয়া ফানুস সব মিলিয়ে এক অন্যরকম আবহ। ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গালিব, ছাই রঙা টি-শার্ট গায়ে, হাতে হালকা ফোনের আলো জ্বলছে।

তামসী থমকে দাঁড়াল কিছুটা দূরে। গালিব মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখেমুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। হাতে ইশারা করে কাছে ডাকলো তাকে।

তামসীর বুকের ভেতর আবারও ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে, তবুও ধীরপায়ে এগিয়ে গেল সে গালিবের দিকে। চারপাশের কোলাহল যেনো ছাদের এই নির্জনতায় এসে একেবারে মিলিয়ে গেল। তামসী কাছে আসতেই গালিব ফোনটা পকেটে রাখল। কেবল নরম চোখে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে।
“ কী হলো হঠাৎ? এখানে ডাকলেন কেন?”
“ এমনি। “
“ এমনি?”
“ হুম এমনি। “
“ ঢং। “
গালিব মৃদু হাসলো।
“ মোটেও না। “
“ তাহলে কী?”
“ রাত পেরোলে আমাদের বিয়ে। “
তামসী মাথা নেড়ে বলল,
“ হ্যাঁ। “
“ তারপর বাসররাত। “
“ হ্যাঁ তো?”
কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় বসালো তামসী। লজ্জায় অন্য দিকে ঘুরে তাকালো। গালিব ওর অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে।
“ তো কিছুই না। “
“ আপনি… আপনি হলেন মিচকে শয়তান। “
“ কী বললি?”
“ হ্যাঁ ওটাই। এমন হাবভাব করে থাকেন যেন কিচ্ছু জানেন না। “
“ তাহলে কি সারাক্ষণ সবকিছু জানার ভান করবো?”
গালিব কথাটা বলেই তামসীর কোমরে হাত রেখে বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলল। তামসীও গালিবের গলা জড়িয়ে ধরে দাঁড়াল।
“ তা বলিনি। “
অন্যদিকে তাকিয়ে বলল তামসী।
গালিব ফু দিয়ে ছোটো চুলগুলো সরিয়ে
একহাতে তামসীর এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিলো। আবেশে চোখ বন্ধ করে রাখলো তামসী।
“ যেটুকু লজ্জা অবশিষ্ট আছে সেটুকুও সাইডে রেখে দে আজ। আগামীকাল রাতে লজ্জা পেলে চলবে না। আমার রেসপন্স চাই, এভাবে লজ্জায় মুখ ফেরানোর দরকার নেই। “

তামসী চোখ-মুখ খিঁচিয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে ফেলল। বলল,
“ ছিহ! আপনি একটা পাজি৷ ছাড়ুন। “
গালিব হেসে উঠল এবার। ততক্ষণে তামসী দৌড়ে চলে গেলো।

বহু বছর পর মির্জা বাড়িতে আবার বিয়ের আনন্দ। বাড়ির বড় ছেলে গালিব মির্জার বিয়ে হচ্ছে তার নিজের চাচাতো বোনের সঙ্গে। এই খবর ঘিরে সাভারের বিভিন্ন এলাকায় চলছে নানা আলোচনা। কারণ, মির্জা পরিবার দীর্ঘদিন ধরেই সাভারের অন্যতম ধনী ও প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে পরিচিত।

সকাল থেকে একটু-আধটু নার্ভাস ছিলো তামসী। বিকেল হতেই সেটা আরেকটু বেড়ে গেলো। মেজেন্টা কালারের বেনারসি পরার শখ থাকলেও সবার কথামতো লাল টুকটুকে বেনারসি পরে বউ সেজে বসে আছে সে। কাজী সাহেবও পৌঁছে গেছেন। গালিবও বর সেজে তৈরি, বিয়ের জ। নওশিন তার পরিবার নিয়ে এসেছে, রাবিনের সব বন্ধুরাও আছে। মেঘলা, লামিয়া ও রাফিরও দু’একজন বন্ধু এসেছে। মির্জা বাড়ির পরিবেশই আজ আলাদা। সবাই অপেক্ষা করে আছে কখন বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবে।
“ সাইদ সাহেব তাহলে বিয়ের কাজ শুরু করছি?”
কাজী সাহেব মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করতেই সাইদ মির্জা তাড়া দিয়ে বললেন,
“ হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই। শুরু করুন, প্লিজ! “

কাজী সাহেব নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তামসীর বুক ধুকপুক করছে, গালিবেরও অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। সবাই আনন্দে হাসছে। তামসীর মায়ের চোখের কোণে জল টলমল করছে। এরমধ্যে তামসী ও গালিবের শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেলো। সবাই সমস্বরে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলেন। রাফি, মেঘলার আনন্দ যেন একটু বেশিই দেখা যাচ্ছে। শুভ, নওশিনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।

বিয়ে শেষে সকলে খাওয়াদাওয়ার জায়গায় চলে গেলো। তামসী আর গালিবকেও খেতে বসানো হলো। গালিব তামসীর খাওয়ার দিকে তেমন তাকালো না কারণ ভাবিরা অনেক মশকরা করছে। গালিবের মামাতো ভাইয়ের বউ এসেছে। তাছাড়াও লতাপাতায় অনেক আত্মীয় আছেন, তারাও এসেছে বিয়েতে।

“ আরে ভালো করে খাও দেবর সাহেব। রাতে প্রচুর শক্তিব্যয় করতে হবে তো। “

বৃষ্টির কথায় লজ্জা পেলো তামসী। গালিব গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো। তাতেই হাসির রোল পড়লো সেখানে। ভাবিদের এমন দুষ্টমি সহ্য করতে করতেই ওরা দু’জন খাওয়া শেষ করলো। তারপর একে একে সবাই খেয়েদেয়ে নিলো। রাত গভীর হতেই কিছু আত্মীয়স্বজন চলে গেলেন আর কিছু আত্মীয় থেকে গেলেন।

মির্জা বাড়ির ভেতর আজ এক অদ্ভুত নীরবতা। সারাদিনের হৈ-চৈ, হাসি-আনন্দ, গান আর মশকরা মিলিয়ে চারদিক জমজমাট ছিলো। কিন্তু এখন চারপাশ নিস্তব্ধ। শুধু দূরে কোথাও মাঝে মাঝে কুকুর ডাকছে, গাছের পাতায় বাতাসে সোঁ সোঁ শব্দ হচ্ছে।

তামসীর ঘরটা আলোকিত হয়ে আছে। মৃদু সুগন্ধি মিশে আছে বাতাসে। বিছানার চাদর, বালিশ, আর চারদিকে ফুলের সাজ। বিছানায় বউ সাজে বসে আছে তামসী। লাল বেনারসির আঁচল মুখের কিছুটা ঢেকে রেখেছে। বুকের ভেতর ধুপধুপ শব্দে গলা শুকিয়ে আসছে তার। আঙুল দিয়ে আঁচল ঘুরাচ্ছে, চুপচাপ বসে আছে। দরজার বাইরে ধীরে ধীরে গালিবের পায়ের শব্দ শোনা গেলো। মনে হলো পুরো পৃথিবী যেন দাঁড়িয়ে আছে সেই শব্দ শোনার অপেক্ষায়। দরজা হালকা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো গালিব। পরনে সাদা শেরওয়ানি, মুখে গম্ভীর অথচ প্রশান্ত এক হাসি। দরজা বন্ধ করতেই কক্ষটা আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।

কিছুক্ষণ শুধু দাঁড়িয়ে রইলো গালিব, চুপচাপ তামসীর দিকে তাকিয়ে। মেয়েটার চোখ নামানো, গাল লালচে হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে বসল সে। তামসীর নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। ঠোঁট কাঁপছে সামান্য। গালিব হালকা স্বরে বলল,
“আজ থেকে তুই শুধু আমার… চিরদিনের জন্য।”

“ সেইম টু ইউ।”

গালিব হাসলো। এই প্রথম, হাসার মতো করে হাসলো সে। তামসীও হাসলো।
“ তামসী ভালোবাসি, তোকে। তুইও কি…..”
“ ভালোবাসা কি তা জানি না। এটুকু বলতে পারি আপনার নামেই হৃদয় থমকে যায় আমার৷ আপনার উপস্থিতিতেই সবকিছু সুন্দর মনে হয়। আপনিই আমার জীবনের প্রথম ও শেষ পুরুষ। “

গালিব তামসীর হাতের মেহেদি রঙা আঙুলগুলো নিজের হাতে নিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ালো। তামসী চোখ বন্ধ করে নিলো। মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাটা এটাই গালিবের হাতের মাঝে।
“ এটাই ভালোবাসা, তামসী। “
“ তবে আমিও ভালোবাসি। “
“ সেটা তো এখুনি বুঝবো কে কাকে কতটা ভালোনাসে!”
তামসী হালকা লজ্জা পেলো। আস্তে আস্তে কাছে টেনে নিলো গালিব তামসীকে। প্রথমে ভয়ে তামসী একটু পিছিয়ে গেলো, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই বুকের সাথে ঠেসে ধরলো মেয়েটাকে। চারপাশের ফুলের গন্ধ, মোমবাতির আলো, আর তাদের হৃদস্পন্দনের শব্দ সব মিলে যেন এক অদ্ভুত আবেশ ছড়িয়ে পড়লো। গালিব তামসীর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তামসী কেঁপে উঠলো, তারপর আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো গালিবের দিকে। দুজনের দৃষ্টি মিললো, আর সেই দৃষ্টির ভেতরেই ছিলো হাজারো না-বলা কথা, প্রতিজ্ঞা আর ভালোবাসার প্রতিফলন।
তামসীর বুকের ধুকপুকানি থামছেই না, কিন্তু সে আর সরে গেলো না। গালিবের বাহুর মাঝে নিজেকে ছেড়ে দিলো নিঃশব্দে। রাত আরও গভীর হলো… ফুলের সুবাস, অন্ধকারে মিশে যাওয়া আলো, আর দুটি মানুষের অটুট ভালোবাসায় মির্জা বাড়ির সেই কক্ষ যেনো এক স্বপ্নের পৃথিবী হয়ে উঠলো।

চলবে….