গালিব মির্জা পর্ব-১৬

0
9

#গালিব_মির্জা
#পর্ব_১৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

“ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
তামসীর কপালে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো গালিব। ভদ্রলোকের স্পর্শে হালকা শিহরণ বয়ে গেলো ওর ভেতরটায়। তবু কিছু না বলেই গালিবের বাহু থেকে নিজেকে আলগা করল তামসী। দাঁড়িয়ে চুলগুলো পেছনে সরিয়ে নিয়ে দ্রুত হাতেই একটা খোঁপা বেঁধে ফেলল।
“ঠিক আছে, যান।”

মেয়েটার কণ্ঠে স্বাভাবিক ভঙ্গি, কিন্তু চোখেমুখে যেন মিষ্টি এক লজ্জার ছায়া।

গালিব তখন আর কোনো কথা না বলে সোজা ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। দ্রুত পা ফেলার ভঙ্গিতে বোঝা যায়, বাইরে থেকে ফিরেই গোসল না করা পর্যন্ত শান্তি মেলে না ভদ্রলোকের। সারা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার জন্য তার এটাই নিয়মিত অভ্যাস।

তামসী দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, যেখানে মিলিয়ে গেলো গালিবের দৃঢ় পদক্ষেপের শব্দ। হঠাৎ নিজের ঠোঁটে হাত রেখে অনিচ্ছায় হাসলো সে। কপালে এখনও যেন রয়ে গেছে গালিবের ছোঁয়ার উষ্ণতা, যা তামসীর বুকের ভেতর আলাদা কাঁপুনি জাগিয়ে তুলছে।

সকাল সকাল সাজগোজ করে ডাইনিং রুমে এসে বসল লামিয়া। কানে দুল, হাতে পাতলা ব্রেসলেট, চোখেমুখে হালকা লাজুক উজ্জ্বলতা। সেটাই চোখে পড়লো সবার আগে। শুভ মুখ ভার করে তাকিয়ে রইলো। কারণ ও জানে, আজ রকির সাথে দেখা করতে যাবে লামিয়া।

মেঘলা পাশ থেকে ইশারা করে শুভকে চুপ করিয়ে দিলো। নিজে যতই প্রেম করুক, ভাইয়েরা বোনের প্রেম সহজে মেনে নিতে পারে না– এই অদ্ভুত অভ্যাস শুভর মধ্যেও আছে। লামিয়ার প্রতি তার ভালোবাসা ঠিক বোনের মতোই, তাই চিন্তাটাও বেশি।

“কী রে লামু? এতো সেজেগুজে কোথায় যাবি আজ?”
রাফির প্রশ্নে মুচকি হাসলো লামিয়া। চোখ নামিয়ে নিলো প্লেটের দিকে। রাবিন তখনো নিজের মতো খাচ্ছে, মাঝে মাঝে ফিজাকে মেসেজ দিচ্ছে ফোনে।

“একটু বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবো।”
“বন্ধু?” মেঘলা ঠোঁট টিপে হাসলো, দুষ্টামি ভরা ভঙ্গিতে।
লামিয়া আমতা আমতা করে বললো, “হু।”

“যেখানেই যাবি, সাবধানে। বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবি। শুভকে সাথে যেতে বলেছিলাম, কিন্তু শুভর কাজ আছে নাকি! রাবিন আর রাফি তো ফাঁকিবাজ।”
লামিয়ার মায়ের কথায় রাফি অন্যদিকে তাকিয়ে রইল, আর রাবিন শুনেও শুনলো না।

“আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো।”
“ওকে। তোদের খাওয়া হলে প্লেটগুলো রান্নাঘরে রেখে আসিস, মেঘলা।”
“ঠিক আছে, মা।”

এটুকু বলে ড্রইংরুমের দিকে চলে গেলেন মা। চারপাশ শান্ত হয়ে গেলো। সবাই চুপচাপ ব্রেকফাস্ট সারলো।

লামিয়া ভেতরে ভেতরে দম ফেলে রাখছে উত্তেজনায়। খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লো। সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর আজকে রকির সাথে প্রথম দেখা। বুকের ভেতরে কেমন যেন কাঁপুনি কাজ করছে। সে একরকম ছুটেই বেরিয়ে গেলো, শহরের ভিড়ভাট্টা পেরিয়ে রকির কাছে পৌঁছানোর জন্য।

সারা পথ ধরে রকি বারবার কল করছিলো লামিয়াকে, কতদূর এসেছে সেটার আপডেট চাইছিলো। লামিয়াও প্রতিবার কোথায় আছে সেটা বলে যাচ্ছিলো। অবশেষে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছলো সে।

কালো রঙের শার্ট, প্রথম দুটো বোতাম খোলা, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি– সেই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে রকি। ওর দিকে এগিয়ে আসছে লামিয়া। পরনে সাদা-গোলাপি রঙের থ্রিপিস।

“হাই মিশমিশ।”
মুচকি হেসে অভিবাদন জানালো লামিয়া।

“হাই।”
রকিও মুচকি হাসলো।

পাশাপাশি দাঁড়ালো দু’জন। লামিয়ার হাত-পা যেন কাঁপছে, ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড নার্ভাস লাগছে ওর। রকি সেই কাঁপা হাতটা নিজের হাতে জড়িয়ে নিলো। মুহূর্তেই কেঁপে উঠলো লামিয়ার ভেতরটা।

“নার্ভাস লাগছে?”
“না… আ তো।”
“তোমার চোখেমুখেই লেখা আছে সব।”

লামিয়া মাথা নিচু করলো। এভাবেই হাঁটতে শুরু করলো দু’জন। সামনে থাকা একটা রেস্টুরেন্টে বসার সিদ্ধান্ত নিলো।

“তেমন কিছু না… আসলে একা একা বাইরে বের হই না তো, সেজন্য।”
“হুম, বুঝলাম।”
“হুমম।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে রকি হঠাৎ বললো,
“লামিয়া?”
“জি?”
“বিয়ে করবে?”

প্রথম দিনেই এমন সহজ-সরল প্রস্তাবে একেবারে থমকে গেলো লামিয়া।
“কি!”
“করবে, বিয়ে? আমাকে?”

কিছু বলতে না পেরে হকচকিয়ে গেলো লামিয়া। মুখের অভিব্যক্তি দেখে রকি হেসে ফেললো। ভ্রু কুঁচকালো লামিয়া।

এমন সময় ওরা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লো। বসে কফি আর হালকা খাবার অর্ডার দিলো রকি। টুকটাক গল্পের মাঝে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠলো লামিয়া।

“ সময় না, তারপর জবাব দিও। তোমার উত্তর পেলে রাবিনকে বলবো সব। তারপর যা হওয়ার হবে। “

“ আচ্ছা। “

লামিয়ার কথায় মুচকি হাসল রকি। মেয়েতা ভীষণ নাজুক, তাই রকি নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিচ্ছে। বেচারার ইচ্ছে করছে এক্ষুণি লামিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, কষিয়ে একটা চুমু দিতে। কিন্তু এসব করতে গেলে নিশ্চিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে সে। তাই নিজের ইচ্ছেকে দাবিয়ে রেখেই সারাদিন ঘোরাঘুরি করতে থাকলো রকি।

রাতের শহরের অলিগলিতে তখনও লেগে আছে ব্যস্ততার ছাপ। গাড়ির হর্ন, মানুষের কোলাহল– সব মিলিয়ে শহর যেন এক মুহূর্তের জন্যও থামে না।
“গালিবের সাথে কথা হলো, বুঝলে?”
চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন সাইদ মির্জা।

মশারী টানানো শেষ করে আয়মান স্বামীর দিকে তাকালেন।
“কী কথা বললেন?”

“বললাম, দেশে থেকে যেতে। এখানেও তো ভালো চাকরির সুযোগ আছে। ইচ্ছে করলে থেকে যাওয়া যায়।”

আয়মান একটু ভেবে নিলেন।
“কথা মন্দ বলেননি। আমি তামসীকে ধরবো সকালে, বুঝাবো। গালিব তামসীকে খুব ভালোবাসে। ও বললে, গালিব ঠিক থেকে যাবে।”

সাইদ মির্জা মুচকি হেসে উঠলেন। ছেলের ভালোবাসার কথা শুনে নিজের তারুণ্যের দিনগুলো মনে পড়ে গেলো। হাত বাড়িয়ে আয়মানের হাতটা ধরলেন।
“ঠিক বলেছো।”

আয়মান হেসে ফেললেন।
“তা তো বুঝলাম। তবে আপনার কী হলো? হাবভাব দেখে সুবিধার ঠেকছে না।”

কথাটা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলেন সাইদ মির্জা।
“বদনাম করিও না আয়মান। আমার হাবভাব তো সবসময়ই ভালো।”

“হ্যাঁ, তা তো জানি। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমান এবার।”
“হ্যাঁ।”

সাইদ আয়মানের হাতটা নিজের হাতের মাঝে রেখেই শুয়ে পড়লেন। বাইরে শহরের ব্যস্ততা চলতেই থাকলো, আর ঘরটা ভরে গেলো একটুখানি শান্তিতে।

পরেরদিন দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে আয়মানের কথামতো তামসী সাহস সঞ্চয় করে গালিবের পাশে গিয়ে বসল। চারপাশে হালকা রোদে ঘরটা যেন উষ্ণ হয়ে আছে। একটু ইতস্তত করেই সে বলল,

“আপনি প্লিজ দেশেই থেকে যান, গালিব ভাইয়া।”

গালিব কপাল কুঁচকে তাকাল।
“চুপ! আগে ঠিকমতো বল।”

ধমক শুনে তামসীর ঠোঁট ফুলে গেল। অভিমানী চোখ নামিয়ে নিলো সে। গালিব হেসে তাকে বুকে টেনে নিলো।
“তুমি করে বলবে। আর ভাইয়া বাদ দিয়ে। তারপর ভেবে দেখবো।”

তামসী এক লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল। গলার স্বর নরম করে বলল,
“তুমি দেশে থেকে যাও। আমার তোমাকেও দরকার, আবার পরিবারের লোকজনের সঙ্গও দরকার। বুঝেছো?”

গালিব ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে তামসীর কপালে নরম চুমু খেল।
“সেই ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে আমার। ওখানে সব কথা বলেছি গতকাল। নতুন জবও ঠিক হয়ে গেছে।”

তামসী আনন্দে লাফিয়ে উঠতে চাইলো, চোখ দুটো ঝিলমিল করছে।
“সত্যি?”

“হ্যাঁ, তিন সত্যি।”

“থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ… সো মাচ!”

গালিব হেসে মাথা নাড়ল।
“তারচেয়ে অন্য কিছু বলো, ভালো লাগবে।”

তামসী ভ্রু কুঁচকালো।
“কী?”

“আই লাভ ইউ।”

ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল তামসী। অভিমান গলে গেল এক নিমিষে। গালিবের বুকে মুখ গুঁজে নরম স্বরে বলল,
“আই লাভ ইউ টু।”

গালিব মুচকি হেসে তামসীর ঘাড়ে মুখ লুকাল। আর একটু দুষ্টুমি করতে যেতেই তামসী কড়া কণ্ঠে থামাল।
“দুপুরবেলা এসব কী, হ্যাঁ?”

“কীসব?”

“ঢং!”

“চুপ কর।”

ঠোঁট উল্টে তামসী বলল,
“তুমি কিন্তু আবারও ধমকালে…”

গালিব হেসে উত্তর দিলো,
“ঠিক আছে। আজকে আর ধমকাবো না, আগামীকাল থেকে।”

তামসী কিছু বলল না। বলার কিছু ছিলো না। শুধু বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে দিলো। বাইরের রোদ যেন একটু নরম হয়ে তাদের মুহূর্তটাকে আরও উজ্জ্বল করে দিল।

শহরের ব্যস্ত রাস্তায় সন্ধ্যার আলো ম্লান হয়ে এসেছে। দোকানপাটের সাইনবোর্ডে ঝিকমিক করছে লাইট, বাতাসে ভেসে আসছে ভাজাপোড়ার গন্ধ। ফুটপাত ভরে আছে মানুষের আনাগোনায়, তবু সেই ভিড়ের ভেতর আলাদা এক জগৎ তৈরি করেছে রাবিন আর ফিজা।

ফিজা আজ হালকা কালো-নীল কুর্তি পরে এসেছে, হাতে একটা ছোট ব্যাগ। রাবিন তার পাশে হাঁটছে গা ঘেঁষে। হঠাৎ ফিজার হাতটা ধরে নিলো ও। প্রথমে একটু চমকে উঠেছিল মেয়েটা, তারপর হেসে তাকালো তার দিকে।

“এভাবে কেন হাত ধরলে?”
ফিজার কণ্ঠে রাগের ভান।

রাবিন গম্ভীর মুখে বলল,
“ভিড় বেশি, হারিয়ে গেলে খুঁজে পাবো না তো।”

ফিজা হেসে ফেললো এবার, চোখে দুষ্টুমি খেলে গেলো।
“ভিড় না থাকলেও ধরতে, তাই না?”

রাবিন মাথা নিচু করে হাসলো। মুখ লাল হয়ে গেছে। ফিজা ভালো করেই টের পেলো ছেলেটার অস্বস্তি, অথচ তার ভেতরে অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করছে।

রাস্তার পাশে হকারের কাছে থামলো দু’জন। গরম গরম ভুট্টা কিনলো ফিজা। ভুট্টার দানা খেতে খেতে বলল,
“তুমি জানো, আমি অনেক দিন ধরে চাইছিলাম এমন হাঁটতে… এভাবে, তোমার হাত ধরে।”

রাবিনের দৃষ্টি ফিজার মুখেই আটকে গেলো। রাস্তার ব্যস্ততা, শব্দ, ভিড়– সবকিছু যেন মিলিয়ে গেল মুহূর্তেই। তার মনে হলো, পৃথিবীতে এখন কেবল একজনই আছে, ফিজা।

হালকা বাতাসে ফিজার চুল উড়ে এলো রাবিনের মুখে। সে হাত বাড়িয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিলো আলতো করে। দু’জনের চোখে চোখ পড়তেই সময় যেন থেমে গেল।

ফিজা ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল,
“রাবিন, তুমি না হলে… আমি এভাবে বাঁচতে পারতাম না।”

রাবিন কোনো উত্তর দিলো না। শুধু ওর হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলো। দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে থাকলো, শহরের ফুটপাত তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে রইলো।

চলবে