অপেক্ষার রক্তচোখ পর্ব-০১

0
10

#অপেক্ষার_রক্তচোখ।
পর্ব:- এক।
লেখা:- সিহাব হোসেন।

“বার বার মনে হচ্ছে তোমার বোন এক সময় তোমার সংসার ভাঙার কাল হয়ে দাঁড়াবে। কারণ সে তোমার বরের সাথে যেভাবে মেশে, এতে ব্যাপারটা সুবিধার মনে হয় না।”

কথাটা বিষাক্ত তীরের মতো মারিয়ার বুকে এসে লাগল। সে কোনোমতে মুখে এক চিলতে হাসি রেখে বলল,
– “না না ভাবি, এসব কী বলেন? আসিফ তো মিরাকে নিজের ছোট বোনের মতোই দেখে।”
রুবিনা যেন এই উত্তরের জন্যই প্রস্তুত ছিলেন। তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
– “যতই বলো, পুরুষ মানুষের বিশ্বাস নেই। তার উপর তোমার বোন সবে ক্লাস নাইনে পড়ে। আবেগে ভরপুর এখন সে। ওর মগজ ধো*লাই করা কোনো ব্যাপার না।”
মারিয়ার জিভের ডগায় কোনো উত্তর এলো না। রুবিনার প্রতিটি শব্দ যেন তার মনের গভীরে সন্দেহের বীজ বুনে দিচ্ছিল। রুবিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
– “যাই, বাসায় অনেক কাজ আছে। তুমি আমার কথাটা ভেবে দেখো।”

রুবিনা চলে যাওয়ার পর রান্নাঘরের নীরবতা যেন মারিয়াকে গ্রাস করতে এলো। হাতে ধরা ছু-রিটা বড্ড ভারী মনে হতে লাগল। রুবিনার কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো নয়। সত্যিই তো, আসিফ মিরার প্রতি একটু বেশিই দুর্বল। মিরা যখনই আসতে চায়, আসিফ নিজে গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। সারাক্ষণ দু’জনের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা লেগেই থাকে। যে বিষয়গুলো এতদিন স্বাভাবিক মনে হতো, আজ সেগুলোই কেমন অস্বাভাবিক ঠেকছে। আসিফ প্রায়ই মিরার ছোটখাটো প্রয়োজনে টাকা দেয়। এই অকারণ উদারতার পেছনে কি অন্য কোনো কিছু লুকিয়ে আছে? ওদের মধ্যে কি সত্যিই কোনো গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠছে?
চিন্তার ডুবে থাকা মারিয়াকে দেখে তার শাশুড়ি হালিমা বেগম বললেন,
– “চুপ করে বসে আছিস কেন? কী চিন্তা করছিস?”
মারিয়া চমকে উঠে বলল,
– “না মা, কিছু না।”
কিন্তু তার মন জুড়ে তখন সন্দেহের কালো মেঘ জমে গেছে।

বিকেল বেলা বেলকনিতে বসে ছিল মারিয়া। রুবিনা ভাবির কথাগুলো বারবার কানের কাছে বাজছিল। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল মিরার নাম। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো নরম কণ্ঠ,
– “কেমন আছো আপু?”
– “ভালো। তুই কেমন আছিস?”
– “ভালো। আপু, আমার পরীক্ষা তো শেষ। তুমি বলেছিলে তোমাদের এলাকায় প্রতি বছর এই সময় মেলা বসে। আমার না মেলা দেখার অনেক শখ। আগের বছর তো নিয়ে যাওনি। কিন্তু এবার কিন্তু আমি আসবই।”
মিরার নিষ্পাপ আবদারটা এই মুহূর্তে মারিয়ার কাছে অসহ্য মনে হলো। মনের ভেতর জমে থাকা সমস্ত ক্ষোভ আর সন্দেহ যেন আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল। সে কঠিন স্বরে বলল,
– “একদম না। খবরদার তুই আসার জন্য বায়না ধরবি না।”
মিরা অবাক হয়ে বলল,
– “তুমি এমন করছো কেন বলো তো?”
– “যা করেছি বেশ করেছি। আর একবার এখানে আসতে চাইলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

কথাটা বলেই মারিয়া ফোন কেটে দিল। বুকের ভেতর একটা তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। ছোট বোনটার সাথে এভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি, কিন্তু মনের ভেতরের ভয়টা তাকে দিয়ে এটা করিয়ে নিল। সে তার সংসারকে বাঁচাতে চায়, যে কোনো মূল্যে।
রাতে আসিফ কাজ থেকে ফিরল। ফ্রেশ হয়ে মারিয়ার পাশে বসতেই তার মুখে ফুটে উঠল চেনা হাসি।
– “মিরা ফোন করে খুব কাঁদছিল। বলল, সে মেলায় আসতে চায়, কিন্তু তুমি নাকি অনেক ব*কা দিয়েছ।”
মারিয়া মুখ ঘুরিয়ে নিল। শীতল কণ্ঠে বলল,
– “হুম। ওর এখানে আসার কোনো দরকার নেই।”
আসিফ অবাক হলো না, বরং বোঝানোর সুরে বলল,
– “আহা, মেয়েটা শখ করেছে, আসুক না। আমি গিয়ে নিয়ে আসব।”
এই কথাটাই যেন আগুনে ঘি ঢালল। মারিয়া ঘুরে বসল, তার চোখ দুটো জ্বলছে।
– “কেন আসতে হবে, হ্যাঁ? আর তুমিই বা আনতে যাবে কেন? এত দরদ কিসের?”
আসিফ হতভম্ব দৃষ্টিতে মারিয়ার দিকে তাকাল। রাগে কাঁপছে তার প্রিয় মানুষটা। আসিফ তার কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বলল,
– “তোমার কি শরীর খারাপ? তুমি ঠিক আছো তো?”
মারিয়া এক ঝটকায় আসিফের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
– “হ্যাঁ, আমি একদম ঠিক আছি। আমার বোনের আসার কথা শুনে তোমার এত আনন্দ হয় কেন? সে আসতে চাইছে, আর তুমি সাথে সাথে তাকে আনার জন্য রাজি হয়ে গেলে! তোমাদের মধ্যে কী চলছে, সত্যি করে বলো তো?”
আসিফের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল।
– “মারিয়া, এসব কী বা*জে কথা বলছো? তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?”
– “ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা করবে না। আমি সব বুঝি।”
– “মারিয়া, তুমি ভুল ভাবছো। আমি তাকে সবসময় ছোট বোনের চোখেই দেখেছি। এর বেশি কিছু না।”
মারিয়া তীব্র স্বরে বলল,
– “ভুলে যাবে না, তুমি ওর নিজের ভাই নও। তাই ওর সাথে বেশি ভাইগিরি দেখাতে যাবে না। ওর নিজের ভাই নেই তো কী হয়েছে, তোমার ওর ভাই সাজার দরকার নেই। মিরা আসবে না, এটাই ফাইনাল। এর বেশি একটা কথাও বলবে না।”
ঘরের ভেতর নেমে এলো এক অস্বস্তিকর নীরবতা। আসিফ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে বুঝতে পারছিল, এখন তর্ক করে কোনো লাভ নেই। সন্দেহের বি*ষ একবার মনে ঢুকলে তা বের করা কঠিন। সে আবার মারিয়ার কাঁধে হাত রেখে শান্ত গলায় বলল,
– “ঠিক আছে। তুমি যা বলবে, তাই হবে।”

আসিফের এই কথায় মারিয়া শান্ত হলো কিন্তু সন্দেহের যে কাঁটা তার মনের মধ্যে রয়েছে, তা কি এত সহজে উপড়ে ফেলা যাবে? সম্পর্কটা আগের মতো সহজ থাকবে তো?

মারিয়া আর আসিফের সংসারটা দেখতে দেখতে চার বছর পার করে ফেলল। এই দীর্ঘ সময়ে তাদের ভালোবাসায় কোনো কমতি না থাকলেও, একটা শূন্যতা যেন নিঃশব্দে বাসা বাঁধছিল। তাদের ঘর আলো করে এখনো কোনো সন্তান আসেনি। ডাক্তার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা—সবই হয়েছে। রিপোর্টে কোনো সমস্যা নেই, তবুও ভাগ্য যেন বিমুখ।
আশেপাশের মানুষের কানাঘুষা। নানান জন নানা কথা বলতে থাকে। এগুলো শুনে মারিয়ার বুকটা ফেটে যায়। মাঝে মাঝে একা নিরবে কান্না করে। তার কান্নার শব্দ দেয়ালের বাইরে যায় না। আসিফ তখন শক্ত করে তার হাত ধরে, কপালে চুমু খেয়ে বলে,
– “মানুষের কথায় কান দিও না, মারিয়া। ওদের কাজই হলো অন্যের জীবন নিয়ে কথা বলা। আজ হয়নি, কিন্তু একদিন নিশ্চয়ই হবে। কত মানুষের তো বিয়ের দশ-বারো বছর পরও সন্তান হয়।”
আসিফের এই কথাগুলোই মারিয়ার ভেতরের কষ্ট কমিয়ে দেয়। সে নিজেকে বোঝায়, ধৈর্য ধরতে হবে।

আর মাত্র দুটো দিন পরেই মেলা। কত শখ ছিল, ছোট বোন মিরাকে নিয়ে একসাথে মেলায় ঘুরবে, নাগরদোলায় চড়বে, কাঁচের চুড়ি কিনবে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। সন্দেহের যে কাঁটা মনে ঢুকেছে, তা উপড়ে ফেলার আগ পর্যন্ত কোনো আনন্দই যেন পূর্ণতা পাবে না। নিজের সাজানো সংসারকে বাঁচানোর জন্য কিছু শখ নাহয় অপূর্ণই থাকল।
হঠাৎ মায়ের ফোন আসায় চিন্তায় ছেদ পড়ল।
– “তুই মিরাকে আসতে নিষেধ করেছিস কেন?”
মারিয়া নিচুস্বরে উত্তর দিল,
– “ও তুমি বুঝবে না, মা। আর শোনো, ভালো ছেলে দেখে যত তাড়াতাড়ি পারো, মিরার বিয়ে দিয়ে দাও।”
ওপাশ থেকে মায়ের অবাক কণ্ঠ ভেসে এলো,
– “এসব কী বলছিস তুই? মেয়েটা সবে নাইনে পড়ে, আর এখনই ওর বিয়ের কথা বলছিস?”
মারিয়ার ভেতরের সব চাপা ক্ষো*ভ যেন একসাথে বেরিয়ে এলো। সে প্রায় চিৎকার করে বলল,
– “হ্যাঁ, দিয়ে দাও! কোনো অঘটন ঘটার আগেই যা করার করো।”
– “তোর বিয়ে হয়েছে অনার্সে পড়ার সময়। তুই তো জানিস, ও কতটা বোকা আর সরল। এখন কীভাবে…”

মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই মারিয়া রাগে ফোনটা কেটে দিল। তার মনে হচ্ছিল, কেউ তাকে বুঝতে চাইছে না।
আজ মেলার দিন। সকাল থেকেই পুরো এলাকা জুড়ে উৎসবের আমেজ। মানুষের কোলাহলে, মাইকের শব্দে আর আনন্দের হল্লায় চারপাশ গমগম করছে। অনেকের বাড়িতেই আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনা। মারিয়াদের বাড়িতেও আজ আসিফের খালা আর তার কাজিনরা আসবেন। তাই সকাল থেকে শাশুড়ি-বউমা মিলে রান্নার বিশাল আয়োজনে নেমে পড়েছে।

তাদের শাশুড়ি-বউমার সম্পর্কটা ঠিক মা-মেয়ের মতো। একে অপরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসা। কিন্তু মাঝে মাঝে হালিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাতি-নাতনির জন্য আফসোস করেন। তখন শ্বশুর আকবর হোসেন শান্ত গলায় বলেন,
– “সময় হলেই হবে। সৃষ্টিকর্তা যখন চাইবেন, তখনই হবে। এটা তো আর আমাদের হাতে নেই।”

রান্না শেষে গোসল সেরে মারিয়া ঘরে এলো। আলমারি থেকে বের করল তার প্রিয় টকটকে লাল রঙের শাড়িটা। শাড়িটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন ভেজা চুল আঁচড়াচ্ছিল, তখন আয়নার প্রতিবিম্বে দেখতে পেল, আসিফ দরজায় দাঁড়িয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। তার চোখে-মুখে মুগ্ধতা এক মায়াবী ঘোর। মারিয়ার গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।
হঠাৎ আসিফ এগিয়ে এসে পেছন থেকে মারিয়ার কো*মর জড়িয়ে ধরল। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস মারিয়ার ঘাড়ে এসে পড়তেই সে কেঁপে উঠল। আসিফ কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
– “বাহ! আমার বউটা তো দেখছি দিন দিন আরও বেশি সুন্দর হয়ে যাচ্ছে।”
মারিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
– “ধুর! নাটক করো না তো। আজ বাদে কাল বুড়ি হব, আর উনি বলছেন সুন্দর হচ্ছি।”
আসিফ তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
– “বুড়ি হও কিংবা যাই হও, প্রথম যেদিন দেখার পর তোমাকে ঠিক যেমন লেগেছিল, আমার কাছে তুমি আজও ঠিক তেমনই আছো।”
মারিয়ার মনটা ভালোবাসায় ভরে গেল। সে মৃদুস্বরে বলল, – “হয়েছে, এখন ছাড়ো। কেউ দেখে ফেলবে।”

আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে মেলার দিকে রওনা হলো। আসিফ আর মারিয়া হাতে হাত রেখে ভিড়ের মধ্যে হাঁটছে, হাসছে, কথা বলছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দম্পতি।

ঠিক সেই মুহূর্তে, তাদের বাড়ির পাশের ছাদে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল রুবিনা ভাবি। তার দৃষ্টি ওই সুখী দম্পতির দিকে স্থির। হঠাৎ তার চোখের কোণ বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর নিজের পাঁচ বছরের ঘুমন্ত ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে একাই মেলার ভিড়ের দিকে পা বাড়াল। তার চোখেমুখে ছিল এক গভীর বিষাদের ছায়া একাকীত্বের নাকি অন্য কোনো না বলা গল্পের, তা শুধু সে-ই জানে।

আপনাদের কি মনে হয়?

চলবে……!