অপেক্ষার রক্তচোখ পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
11

#অপেক্ষার_রক্তচোখ।
পর্ব:- তিন।(শেষ)
লেখা:- সিহাব হোসেন।

রাতে আসিফ বাসায় ফিরতেই মারিয়া রুবিনার বলা কথাগুলো তাকে খুলে বলল। বাবার ব্যবসা থেকে লাভের ভাগ বুঝে নেওয়া, ভবিষ্যতের জন্য আলাদা করে টাকা জমানোর কথাগুলো শুনে আসিফ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। মারিয়ার মুখে এমন কথা সে আগে কখনো শোনেনি। তাদের চার বছরের সংসারে অর্থ নিয়ে কোনোদিন কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।
আসিফ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “মারিয়া, আজ হঠাৎ করে এসব কথা বলছ কেন?”
মারিয়া নিচু স্বরে বলল,
– “আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে তো।”
আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে মারিয়ার কাঁধে হাত রেখে বোঝানোর সুরে বলল,
– “ভবিষ্যতে কী হবে, তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। ধরো, আমরা অনেক টাকা জমিয়ে রাখলাম, কিন্তু এমন কিছু ঘটল যাতে সব শেষ হয়ে গেল, তখন কী হবে? আর বাবা যা কিছুই করছেন, তা তো আমাদের জন্যই। তার সবকিছুর মালিক তো একদিন আমিই হব। এসব চিন্তা মাথায় এনো না, প্লিজ।”

মারিয়া চুপ করে রইল। তার চোখেমুখে দ্বিধা আর উদ্বেগের ছাপ। আসিফ বুঝতে পারল, শুধু কথায় চিঁড়ে ভিজবে না। সে তার মোবাইলটা হাতে নিয়ে ইন্টারনেট ব্যাংকিং অ্যাপ খুলে মারিয়ার সামনে ধরল। স্ক্রিনে তার অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স দেখে মারিয়ার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেল।
আসিফ শান্ত গলায় বলল,
– “বাবা প্রতি মাসের একটা নির্দিষ্ট তারিখে আমার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেন। এর বাইরেও যখন যা লাগে, আমি পাই। আশা করি, এরপর তোমার মনে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না।”

সত্যটা জানার পর মারিয়ার ভেতরটা লজ্জায় আর অনুশোচনায় দুমড়ে-মুচড়ে গেল। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আসিফের হাত দুটো শক্ত করে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,
– “আমাকে মাফ করে দাও, আসিফ। আমি… আমি আর কখনো কারো কথা শুনে এমন ভুল করব না। প্লিজ, এবারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
আসিফ আলতো করে তার চোখের জল মুছে দিল। তার বুঝতে বাকি রইল না, এই বি-ষের উৎস কোথায়।
– “আমি নিশ্চিত, রুবিনা ভাবিই তোমার মাথায় এই সন্দেহের বীজ বুনে দিয়েছে।”
মারিয়া মাথা নিচু করে রইল, যা তার অপরাধ স্বীকারের শামিল। আসিফ আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “মিরাকে নিয়েও সন্দেহটা সেই-ই ঢুকিয়েছিল, তাই না?”
মারিয়া ফিসফিস করে বলল,
– “হুম।”

আসিফ এবার মারিয়াকে নিজের আরও কাছে টেনে নিল। খুব শান্ত আর কোমল স্বরে বলল,
– “শোনো, আমার নিজের কোনো বোন নেই। আমি মিরাকে সবসময় আমার ছোট বোনের আসনেই বসিয়েছি। তাই তো ওকে ‘দুলাভাই’ না ডেকে ‘ভাইয়া’ ডাকতে বলেছি। মাঝে মাঝে ওর প্রয়োজনে টাকা দিই, কারণ আমি ভাবি, আমার নিজের বোন থাকলেও তো তাকে দিতাম। আমি জানি, তোমার কোনো ভাই নেই। তাই তো আমি চেয়েছি, একজন ভাইয়ের কাছে সে যেভাবে আবদার করতো, ও যেন আমার কাছে সেভাবেই করতে পারে। আর ওকে আমি নিজে আনতে যাই, কারণ আজকালকার রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি ভালো না। ও একটা সরল মেয়ে, সবার মতো চালাক-চতুর নয়। তোমাদের বাড়িও এখান থেকে কম দূরে না। ওর নিরাপত্তার কথা ভেবেই আমি এইটুকু করি। আর তুমি কিনা বাইরের লোকের কথায় আমাকে সন্দেহ করলে? এটা কি ঠিক হলো, মারিয়া?”
আসিফের প্রতিটি কথা মারিয়ার বুকের ভেতরের সন্দেহের কালো মেঘ সরিয়ে দিচ্ছিল। সে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, – “আমার ভুল হয়ে গেছে, আসিফ। আমি বুঝতে পারিনি। আমি বুঝতে পারছি, রুবিনা ভাবি আসলে আমাদের সুখটা দেখতে পারে না।”
– “হুম, ঠিক তাই।”
– “আমি আর কখনো ওর সাথে মিশব না।”
– “না, মেশার দরকার নেই, এমন বলছি না। মিশবে, কিন্তু উনি যখনই এসব উসকানিমূলক কথা বলবেন, তখনই তাকে থামিয়ে দেবে। আর শোনো, আমি আগামী সপ্তাহে গিয়ে মিরাকে নিয়ে আসব। সামনে আরও একটা মেলা আছে, ওটা আমরা একসাথে ঘুরব।”

এই কথা শুনে মারিয়ার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে সাথে সাথেই মিরাকে ফোন করল। বোনের গলা শুনে আর মেলায় আসার খবর পেয়ে মিরার সব রাগ, সব অভিমান যেন এক মুহূর্তে বরফের মতো গলে গেল।

পরের দিন ছিল শুক্রবার। আসিফ ছুটির দিনে বিছানা গোছাতে গিয়ে তোশকের নিচে হাত দিতেই শক্ত মতো কিছু একটা অনুভব করল। বের করে দেখল, কালো কাপড়ে মোড়ানো একটা ছোট্ট তাবিজ। সে অবাক হয়ে গেল। মারিয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। হালিমা বেগমও তাবিজটা দেখে অবাক হলেন।

আসিফের মনটা কু-ডাক ডেকে উঠল। সে দেরি না করে তাবিজটা নিয়ে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে গেল। ইমাম সাহেব তাবিজটা খুলে, ভেতরের কাগজপত্রে লেখা দুর্বোধ্য সংকেতগুলো দেখে আঁতকে উঠলেন।
– “এটা তো সন্তান ধারণে বাধা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। এক ধরনের জাদু।”
আসিফ স্তম্ভিত হয়ে বলল,
– “কী বলছেন!”
– “হ্যাঁ, বাবা। এটা এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে গর্ভে সন্তান না আসে।”
– “কিন্তু… এটা কে করতে পারে?”
– “সেটা তো বলা সম্ভব নয়।”
– “এখন উপায় কী, হুজুর?”
– “উপায় আছে। আমি এই তাবিজটা নষ্ট করে দিচ্ছি। আর কিছু নিয়মকানুন আর দোয়া-দরুদ বলে দিচ্ছি, সেগুলো মেনে চলো। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।”

মসজিদ থেকে ফেরার পথে আসিফের মাথায় একটাই নাম ঘুরছিল, সে হলো রুবিনা। সে শুনেছিল, রুবিনা তার স্বামীকে বশে রাখার জন্য এসব কবিরাজি আর তাবিজ-কবচের সাহায্য নেয়। সব ঘটনা এক সুতোয় গাঁথতেই আসিফের কাছে পুরো ছবিটা পরিষ্কার হয়ে গেল। প্রথমে মিরাকে নিয়ে সন্দেহ তৈরি করা, তারপর টাকা-পয়সা নিয়ে মারিয়ার কান ভারী করা, আর সবশেষে এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র! আসিফ বুঝতে পারল, এই মহিলার মুখোশ খোলার সময় এসে গেছে। তার সাথে সরাসরি কথা বলতে হবে।

পার্কের পুকুর পাড়ে পড়ন্ত বিকেলে জলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল রুবিনা। তার চারপাশে পৃথিবীর কোলাহল থাকলেও, মনের ভেতর ছিল এক গভীর শূন্যতা। এমন সময় তার পেছনে এসে দাঁড়াল আসিফ। তার কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত কিন্তু দৃঢ়।
– “ভাবি, আপনাকে এখানে ডাকার আসল কারণটা তাহলে বলি?”
রুবিনা না ঘুরেই বলল,
– “বলো।”
– “আপনি মিরা আর আমাকে নিয়ে মারিয়ার মনে যে সন্দেহের বি*ষ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, এটা কি ঠিক করেছেন?”
রুবিনার শরীরটা সামান্য কেঁপে উঠল। সে দুর্বলভাবে উত্তর দিল,
– “না।”
আসিফ থামল না।
– “তারপর, আপনি আমাদের বাবা-ছেলেকে আলাদা করার জন্য মারিয়াকে উসকানি দিয়েছেন, সেটা কি ঠিক হয়েছে?”
– “না।”
– “তাহলে কেন করলেন এসব? আমরা তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে কেন আমাদের সাজানো সংসারে এমন অশান্তি তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন?”

এই প্রশ্নের কোনো সোজা উত্তর রুবিনার কাছে ছিল না। সে মুখ তুলে ধূসর আকাশের দিকে তাকাল। তার এতদিন ধরে চেপে রাখা সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা যেন বাঁধভাঙা জলের মতো চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। কান্নাভেজা কণ্ঠে সে বলল,
– “আমি… আমি শুধু একটু ভালোবাসা চেয়েছিলাম, আসিফ। আমি চেয়েছিলাম আমার স্বামী আমাকে ভালোবাসবে, আমার যত্ন নেবে, ঠিক যেমনটা তুমি মারিয়ার জন্য করো। কিন্তু সে কোনোদিন আমাকে বোঝেনি। উল্টো এমন সব আচরণ করত, যা আমাকে মানসিক ভাবে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছিল। তোমাদের সুখী দাম্পত্য জীবনটা যখন দেখতাম, আমার ভেতরটা হিংসায় জ্বলে যেত। সেই জ্বা*লা থেকেই আমি এসব করেছি।”

ঠিক সেই মুহূর্তে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন রুবিনার স্বামী নাসির সাহেব। তার মুখটা ছিল পাথরের মতো কঠিন। তিনি সরাসরি রুবিনার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– “আমার মন তোমার উপর থেকে উঠে গেছে শুধু তোমার নিজের আচরণের কারণে, রুবিনা। বিয়ের পর থেকেই তুমি তোমার মা-বোনের কথা শুনে এই সংসারে অশান্তি তৈরি করেছ। আমার বাবার বাড়িটা নিজের নামে লিখে নেওয়ার জন্য কত নাটক করেছ! তুমি অস্বীকার করতে পারবে না যে, আমি তোমাকে ভালোবাসিনি। কিন্তু তুমি সেই ভালোবাসার মর্যাদা না দিয়ে তাবিজ-কবচের মতো কুফরি কাজে লিপ্ত হয়েছ, আমাকে বশ করার জন্য। ভাগ্য ভালো যে, তোমার সব ষ*ড়যন্ত্রের ফল উল্টো হয়েছে।”

নাসির সাহেবের কথায় রুবিনা লজ্জায়, অপমানে মাথা নিচু করে রইল। তার আর কিছু বলার ছিল না।
আসিফ এবার দুজনের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলল,
– “নাসির ভাই, ভাবি, একটা কথা বলি। যখনই কোনো সংসারে তৃতীয় পক্ষকে নাক গলাতে দেওয়া হয়, সেই সংসারে আর সুখ থাকে না। হোক সে নিজের মা-বোন অথবা পাশের বাড়ির কেউ। ভাবি, আপনি অন্যের কথা শোনা ছেড়ে দিয়ে নিজের সংসারটা মন দিয়ে গোছানোর চেষ্টা করুন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নাসির সাহেবও এবার একটু নরম হলেন। তিনি রুবিনার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– “তুমি নিজেকে শুধরে নাও, রুবিনা। আমি আগেও যেমন তোমাকে ভালোবাসতাম, বিশ্বাস করো, এখনো ঠিক ততটাই বাসি। শুধু তোমার আচরণগুলো আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করেছিল।”

স্বামীর মুখে ভালোবাসার কথা শুনে রুবিনা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,
– “আমি আর কখনো এমন করব না। প্লিজ, আমাকে এবারের মতো মাফ করে দাও।”
নাসির সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– “দিলাম।”

আসিফ আর সেখানে দাঁড়াল না। তাদের ব্যক্তিগত মুহূর্তে একা ছেড়ে দিয়ে সে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। বাসায় ফিরে মারিয়াকে সে সব ঘটনা খুলে বলল। মারিয়া সব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। যে মানুষটিকে সে এতদিন শুভাকাঙ্ক্ষী ভেবেছিল, তার ভেতরের রূপটা দেখে সে শিউরে উঠল।

এরপর থেকে রুবিনা আর কখনো তাদের জীবনে হস্তক্ষেপ করেনি। সে নিজেকে অনেকটাই শুধরে নিয়েছিল। তার সংসারেও ধীরে ধীরে শান্তি ফিরে আসতে শুরু করল।

এভাবে কেটে গেল আরও কয়েক মাস। একদিন সকালে হঠাৎ করেই খুশির এক সংবাদে পুরো বাড়িটা মেতে উঠল। ডাক্তার জানিয়েছেন, মারিয়া মা হতে চলেছে। যে খবরটার জন্য তারা এতদিন ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, অবশেষে সেই অপেক্ষার অবসান হলো। হালিমা বেগমের মুখে ফুটে উঠল অনাবিল হাসি, আকবর সাহেবের চোখে চিকচিক করে উঠল আনন্দাশ্রু। আর আসিফ? সে পরম ভালোবাসায় মারিয়াকে বুকে জড়িয়ে নিল। তাদের চার বছরের শূন্যতা আজ পূর্ণ হতে চলেছে।

শেষ কথাঃ সংসার জীবন এক পবিত্র বন্ধন, যা বিশ্বাস আর ভালোবাসার উপর দাঁড়িয়ে থাকে। এই সম্পর্কে যখন তৃতীয় কোনো পক্ষ, সে যত কাছের মানুষই হোক না কেন, প্রবেশ করে, তখন সন্দেহের কালো মেঘ জমতে শুরু করে। এতে শান্তির বদলে অশান্তির আগুন জ্ব*লে ওঠে। তাই নিজেদের বোঝাপড়া আর বিশ্বাসকে অটুট রাখাই একটি সুখী দাম্পত্য জীবনের মূল চাবিকাঠি।

(সমাপ্ত)