ফেরারী বসন্ত পর্ব-০৯

0
10

#বড় গল্প
#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-নয়
মাহবুবা বিথী

বিয়ের ছ,মাস পার হয়ে গেল। স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনে রাজ আর হাসনা ফিরতে পারলেও ওদের সম্পর্কটা একটু অন্যরকম। কেউ কারো ব্যক্তিগত জীবন কারো কাছে শেয়ার করে না। তাই বলে দুজন দুজনকে অবহেলা করছে একথা বলা যাবে না। হাসনার মাথার চিরুনী থেকে শুরু করে যখন যা প্রয়োজন রাজ ঠিক এনে দেয়। বাড়ীর অন্যান্য সদস্যরাও ওকে ওর প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়। হাসনাও এ বাড়িতে এসে রান্নার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। প্রায় প্রতিদিন রাজের পছন্দের কোনো আইটেম রান্না করে।বাড়ীর সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি রাজের দাদীর দিকেও খেয়াল রাখে। মাথায় তেল দিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে হাতে পায়ে লোশন মাখিয়ে দেয়। ওকে পেয়ে ও বাড়ীর মানুষগুলো খুব খুশী। কিন্তু হাসনা এই সুখকে দুহাত ভরে নিতে পারছে না। আরশীর জন্য মনটা খুব পুড়তে থাকে। আজ পর্যন্ত মেয়ে আরশির কথা বলি বলি করে হাসনা কাউকে অবশেষে বলতে পারেনি। হাসনার মুখে হাসি নেই এ বিষয়টা মরিয়ম বেগম লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু কারণটা অনুসন্ধান করতে পারছেন না।এর মাঝে আরশি হাসনার বাবার বাড়িতে এসে মাকে না পেয়ে খুব কেঁদেছে। মা ছিলো ওর অক্সিজেন। যে কটা দিন মায়ের কাছে থাকতো সে কটাদিন ওর ঈদের মতো লাগতো। যদিও হাসনার মা মানে আসমা বেগম নাতনীকে বুঝিয়ে বলেছিলেন,
—তোর মায়ের তো বয়স কম। সারাজীবন তো এভাবে একা থাকা যায় না। বাধ্য হয়েই ওকে বিয়ে করতে হয়েছে। তুই যখন বড় হবি তখন ঠিক বুঝতে পারবি।
নানী যা কিছুই বলুক আরশীর মন মানতে চায় না। মাকে দেখার জন্য ওর চোখ দুটো অস্থির হয়ে আছে। ওর কান্নাকাটিতে অস্থির হয়ে হাসেম হাসনাকে ফোন দিয়ে বলে,
—আপু,তুই কি একটু মেডিকেল মোড়ে আসতে পারবি?
—কেন?
—আরশি অনেক অস্থির হয়ে আছে। খুব কান্নাকাটি করছে।
–ঠিক আছে নিয়ে আয়। তবে মেডিকেল মোড়ে নয় খালার বাসায় নিয়ে আয়।
হাসনা ফোনটা রেখে মনে মনে ভাবে,বিয়ের সিদ্ধান্ত ঠিক হলো কি ভুল হলো কে জানে। না জানি ওর নিজের জীবনের স্থায়িত্ব ভাবতে গিয়ে মেয়েটার জীবন হুমকির মুখে পড়ে। এর মাঝে খবর পেয়েছে জামশেদ বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা থাকে। এদিকে রাশেদ আর ওর মায়ের ফুটফরমাশ খেটেই আরশীর দিন চলে যায়। হাসনা খুব ভালো করে জানে, ওখানে থাকলে আরশীর পড়াশোনা, বিয়ে শাদী কিছুই হবে না। ওকে আজীবনের বান্দী হিসাবে ওর দাদী আর বাবা ব্যবহার করবে। আবার মেয়েটাকে যে কিভাবে ঐ বাড়ী থেকে উদ্ধার করবে তারও কোনো পথ জানা নেই। হাসনা জারাকে ডেকে সব কাহিনী খুলে বলে। পরে জারা আর হাসনা ম্যানেজ করে সায়েরাকে নিয়ে কামালকাছনায় চলে আসে। হাসনা বিমর্ষ থাকে বলে বাড়ীর মানুষগুলো সাথে সাথে রাজী হয়। হাসেম আগে থেকেই আরশীকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়। হাসনার দুই মামা মামী ও বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। হাসনাকে দেখার সাথে সাথে জারার চাচী রুবা বলে,
—হাসেম তো আরশীকে নিয়ে সেই সকালে চলে এসেছে। মেয়েটা খুব কাঁদছিলো। তা ওকে তোমার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে বলতে। নাকি তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন জানে না তোমার আগের ঘরের একটা মেয়ে আছে? অবশ্য মেয়ের কথা না জানিয়ে ভালোই হয়েছে। ভাবীর ঘটে বেশ বুদ্ধি আছে বলা যায়।
হাসনা কি বলবে বুঝে পায় না। সাথে সাথে জারা বলে,
—চাচী,কারো ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানো টা ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না।
সাথে সাথে রুবা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,
—বিয়ের বছর না পেরোতেই চাচীকে ভদ্রতা শেখাতে এসেছো? অথচ আমার হাতের উপর তোমরা বড় হলে।
ড্রইংরুমে হট্টগোল শুনে সায়মা আর ওর দুই ভাইয়ের বউ এসে হাজির হয়। রুবার দিকে ঝোল টেনে হাসনার বড়মামী বলে,
—জারা, রুবা আপুর সাথে তোমার এরকম ব্যবহার করা একদম উচিত হয়নি। যাইহোক সে তোমার চাচী হয়।
জারা কিছু বলতে যাবে অমনি সায়মা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
—জারা,তুমি সায়েরাকে নিয়ে তোমার ঘরে যাও। আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি।
জারা চলে যাবার সাথে সাথে সায়মা সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
—একটা তুচ্ছ ঘটনাকে কিভাবে অতি বড় ঘটনাতে রুপান্তরিত করতে হয় তা তোমাদের কান্ড কারখানা না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
এরপর হাসনার দিকে তাকিয়ে বলে,
—হাসনা,আরশী আর হাসেমকে নিয়ে তুই ছাদে গিয়ে গল্প কর।
হাসনা ওদেরকে নিয়ে চলে যেতেই হাসনার ছোটো মামী রত্না বলে,
—আপা, ছোটো মুখে একটা বড় কথা বলছি। আপনি কি আসলেই আরশীর কথা ও বাড়ির কাউকে জানাননি?
সায়মা মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিলো না। এই পৃথিবীতে উপকার করার মানুষের অভাব হলেও ক্ষতি করার মানুষের অভাব নেই। এদের সবার কাছে জারার শ্বশুর শাশুড়ীর ফোন নাম্বার রয়েছে। কেউ একজন ফোন করে ঘোট পাকালে বিষয়টা ঘোলাটে হয়ে যেতে পারে। সে কারনে রাগ ও বিরক্তি গোপন রেখে বলে,
—আমাকে কি তোমার কাছে কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ মনে হয়?
ড্রইংরুমে অযাচিত এসব আলাপে অংশ নিতে হাসনার দুই মামাও চলে আসে। ওর বড় মামা সাবের সায়মার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-রত্না কিন্তু আপা একটা যৌক্তিক কথা বলেছে।
সাবেরের বউ লিলি সাথে সাথে বলে,
—জানিয়ে বিয়ে দিলে তো কোনো সমস্যাই নেই। আর না জানিয়ে বিয়ে দিলে ওরা যদি হাসনাকে মেনে না নেয়? তখন মেয়েটাকে আবারও ডিভোর্সের তকমা লাগাতে হবে। কথাটা এ কারণে বলা হয়েছে। তাছাড়া —
সায়মা বিরক্ত হয়ে বলে,
—-তাছাড়া বলে থামলে কেন?
—-হাসনা কোন এঙ্গেল থেকে জারার ভাসুরের বউ হবার যোগ্যতা রাখে আমি বুঝলাম না?
—তোমার চোখে যোগ্যতার মাপকাঠি কি তা তুমিই জানো। হাসনাকে রাজের মা নিজের ছেলের বউ হবার যোগ্য মনে করেছিলেন বলেই পছন্দ করেছিলেন।
জুবায়ের সাথে সাথে উত্তর দিয়ে বলে,
—একারণে তোমার নিজ থেকে সবটা জানানো উচিত ছিল।
—কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত তা এখন তোদের কাছে শিখতে হবে?
—-আপু কিছু মনে করো না। তোমার ভালোর জন্যই বলছিলাম।
—থাক জুবায়ের,আমার ভালো দয়া করে তোমাদের ভাবতে হবে না।
সায়মার প্রচন্ড রাগ হয়। অবাক হয়ে ভাবে,কিভাবে ওরা মানুষকে অপমান করে। নিজেদের কি ভাবে? আর একটা সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্কে ডিভোর্সের কথাটা অবলীলায় নিয়ে আসে। এই ছ’মাস হাসনা তো ভালোই আছে। হা ওর সন্তানের কথা বলা হয়নি বলে কখনও বলা হবে না এমনতো নয়? সত্য কখনও চাপা থাকে না। হাসনার বিয়ে হয়েছে। সুতরাং সন্তান হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। সায়মা মনে মনে ভাবে, রাজের মা মানে মরিয়ম আপা তো জানতে চাননি হাসনার আগের ঘরে সন্তান আছে কিনা? সে কারণে আগ বাড়িয়ে সায়মার জানানো হয়নি। এটাতো কোনো দোষ নয়। এমন তো নয় হাসনা অবৈধ সন্তান জন্ম দিয়েছে। সায়মার সবার দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বললো,
—হাসনার বিষয়টা যেহেতু আমার একান্ত বিষয় তাই ঐ বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দাও। তোমাদের “মাছের মায়ের পুত্রশোক ” দেখাতে হবে না।
এরপর রুবা আর রত্নার দিকে তাকিয়ে বলে,
—তোমরা দু’জনে গিয়ে টেবিলে খাবার বেড়ে দাও। ফিরোজ এখনি চলে আসবে। ও আসার পর বাড়িতে এই বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলবে না।

সন্ধার দিকে আরশীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে জারা আর হাসনা কামাল কাছনায় চলে আসে। দুই বউ একসাথে বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে রাজের দাদী আমেনা বেগম বলেন,
—এভাবে দুই বউ একসাথে বাসা থেকে যাবে না। বাড়ীটা বড্ড খালি খালি লাগে।
দাদী শাশুড়ীর এই কথাটা হাসনার ভীষণ ভালো লাগে। নিজের রুমে এসে দেখে রাজ বিছানায় শুয়ে আছে। হাসনা কাছে এসে বলে,
—আপনার শরীর ঠিক আছে?
—আমি ঠিক আছি। হঠাৎ ও বাড়িতে তোমরা দুজনে চলে গেলে কোনো সমস্যা হয়নি তো?
—নাহ্ খালামনি এমনিতেই ডেকেছিলেন।
রাজ সায়রার দিকে তাকিয়ে বলে,
—তুমি তো পাপ্পাকে ভুলেই গিয়েছো। ইদানিং আমার কাছে একদম আসো না।
তারপরও সায়েরার কোনো হেলদোল নেই। হাসনাকে জড়িয়ে ধরে ওর কোলে বসে আছে। মেয়েটা মায়ের স্বাধ পাচ্ছে। একথা ভেবে রাজের ভীষণ ভালো লাগা অন্তরে বিরাজ করে। মনে মনে ভাবে মেয়েটা অবশেষে মায়ের ভালোবাসা পাচ্ছে। যদিও হাসনার কিছু ঘাটতি আছে কিন্তু সায়েরার প্রতি ওর যত্ন রাজকে ওর প্রতি দুর্বল করে তুলে।কারণ সায়েরার আসল মা ক্যারিয়ারের কথা ভেবে কম্প্রোমাইজ করলো না অথচ বাইরের একটা মেয়ে এসে মাতৃত্বের বন্ধনে এক লহমায় বেঁধে ফেলে। রাজ ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এদিকে সন্তানের জন্য হাসনার মাতৃত্ব কেঁদে উঠে। আজকে আরশীকে দেখে হাসনার মনটা ভীষণ খারাপ হয়। মেয়েটা অনেক শুকিয়ে গিয়েছে। নিশ্চয় ওর বাবা দাদী ওকে ঠিকমতো খেতে দেয় না। মেয়েটা এবার ক্লাস থ্রীতে উঠেছে। রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি। হাসনার মনটা আজ ভীষণ খারাপ। সায়েরাকে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আকাশজুড়ে মেঘ করেছে। মেঘের বজ্রনিনাদে সায়েরা বার বার কেঁপে উঠছে। হাসনা ওকে বুকে জড়িয়ে নেয়। আরশীও মেঘের শব্দে প্রচন্ড ভয় পায়। হাসনার অন্তরে উথাল পাথাল কান্নার ঢেউ উথলে উঠে। মানুষ বড়ই অদ্ভুত। হাসনার ইদানিং আরশির কথা বেশী মনে পড়ে। হয়তো নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ অজান্তে আরশীর কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানে বিয়ের আগে বাবার সংসারে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করেছে। তখন ওর মনে হতো আরশী ওর বাবার বাড়িতেই ভালো থাকবে। কারণ হাসনার বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। আজ যখন হাসনা নিজের সুখের চাবিকাঠি হাতে পেয়েছে তখন মেয়েটার কথা ওর বেশী মনে পড়ছে। আসলে এখন হাসনার কিছুই করার নেই। সবই ওর ভবিতব্য।

চলবে