#বড় গল্প
#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-এগারো
মাহবুবা বিথী
আরশী আসার পরদিনই হাসনার প্রচন্ড ব্লিডিং শুরু হলো। প্রথমে হাসনা বুঝতে পারে নাই ওযে কনসিভ করেছে। পরে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর টেস্ট করে জানা যায় ও কনসিভ করেছিলো। কারণ গতমাসেই ওর পিরিয়ড হয়েছিলো। যাইহোক দীর্ঘ একমাস ও অসুস্থ ছিলো। এই সময়টাতে আরশী ওর সেবা করেছে। সায়েরাকে সামলিয়েছে। এছাড়া কিছু করার ছিলো না। কাজের হেলপার আকলিমা ওর বাবার অসুস্থতার কারণে কুড়িগ্রাম চলে গিয়েছে। জারা থাকলে হয়তো আরশীকে এতোটা চাপ নিতে হতো না। জারা আর পাভেল এর মাঝে আমেরিকাতে পাড়ি জমিয়েছে।
হাসনা একটু সুস্থ হলে কামাল কাছনায় আরশী আর সায়েরাকে নিয়ে বেরাতে যায়। আর এই সুযোগে জারার চাচী রুবা হাসনাকে বলে,
—সুস্থ হতে একমাস লাগলো তাই না?
—-জ্বী চাচী,তবে আরশী আমাকে খুব সাহায্য করেছে। আমার যখন যা লাগে হাতের কাছে এনে দিয়েছে। আমি আসলে মাথা তুলে বসতে পারছিলাম না।
—সায়েরাকে কে দেখেছে?
—আরশী সামলে নিয়েছে।
—রাজের বুদ্ধি আছে বলতে হবে। বিনা পারিশ্রমিকে কি সুন্দর তোমাকে একটা কাজের লোক এনে দিয়েছে।
হাসনা প্রতিবাদ করে বলে,
—চাচী আপনার কথাটা ঠিক নয়। রাজ আরশীকে অনেক ভালোবাসে।
সায়মা ডাইনিং রাস্তা রেডী করছিলো। রুবার কথা শুনে এই রুমে এসে বিরক্ত হয়ে বলে,
—না জেনে শুনে কারো সম্পর্কে এমন মন্তব্য করা উচিত নয়। রাজ ওকে ওর বাবার কাছ থেকে কিভাবে এনেছে সবই আমি জানি। এজন্য রাজকে অনেক টাকা গুনতে হয়েছে।
রুবা সাথে সাথে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
—ভাবী আপনি কথাটা এতো সিরিয়াসলি নিয়েছেন,কিন্ত আমি তো ঠাট্টা করে বলেছি।
—এমন ঠাট্টা করা কখন উচিত নয় যে ঠাট্টায় বুকের ভিতর ব্যথা শুরু হয়। মানুষের সাজানো সংসারে সন্দেহের বীজ রোপিত হয়।
কথাগুলো বলেই হাসনা আরশী আর সায়েরাকে খাবার টেবিলে নিয়ে যায়। হাসনার যদিও রাতে ডিনার করে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো কিন্ত জারার চাচী রুবার কথাগুলো শোনার পর ওখানে আর থাকতে মন চাইলো না। দ্রুত বাসায় চলে আসে। সেদিন রাজ বাসায় এসে হাসনাকে বলে,
—আরশীর সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। তবে ওকে পরীক্ষা দিতে হবে না। ওর বাকি দুই টার্মের উপর নির্ভর করে পর্যাপ্ত মার্ক দিয়ে পাশ করিয়ে দেওয়া হবে। আগের স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলেছি। ওর টিচার ঠিক করেছি। জেলা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে।
রাজের কথাগুলো শুনে আরশী ভীষণ খুশী হলো। জেলা স্কুলে পড়ার ওর বহুদিনের শখ ছিলো। খুশীতে হাসনার দুচোখের পাতা সিক্ত হয়ে উঠলো।
সবই ঠিকঠাক চলছিলো। আরশী ক্লাস ফোর আর সায়েরা নার্সারীতে ভর্তি হয়েছে। বিয়ের দুবছর পার হয়ে গেল কিন্তু হাসনার আর কনসিভ করছিলো না। সেটা নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে নানারকম কথা উঠছিলো। প্রথমে হাসনা কথাগুলোর তেমন পাত্তা দেয়নি। ভেবেছে আজ না হোক কাল কনসিভ করলে সবাই এই বিষয়টা নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রাজের মা প্রথমে ঐ বিষয়টাকে নোটিশ করলেন। সেটা হলো আরশী। কারণ আরশী আসার দুদিন পর হাসনার মিসক্যারেজ হয়েছিলো। সুতরাং এই মেয়েটা অলুক্ষণী অপয়া। হাসনার কানে কথাটা আসা মাত্রই ভীষণ কষ্ট পেলো। কিন্তু কিছু তো করার নাই। তবে কেন যেন মনে হলো এই কথাটা কেউ উনার কানে তুলে দিয়েছে। দুদিন আগে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় মরিয়ম বেগম মোবাইলটা ডাইনিং টেবিলে রেখে যান। হাসনা মোবাইল ওপেন করে কল লিস্ট চেক করে দেখে ওর দুই মামী আর জারার চাচী রুবার সাথে ওর শাশুড়ীর মাঝে মাঝে কথা হয়। ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে হাসনা ফোনটা টেবিলে রেখে দেয়। ওকে এখুনি বের হতে হবে। আরশী আর সায়েরাকে স্কুল থেকে আনতে হবে। শাশুড়ী মরিয়ম বেগমকে হাসনা বলে,
—মা, আরশী আর সায়েরাকে আনতে যাচ্ছি।
—যাও,আমার ছেলের ঘরে সন্তান এখনও পয়দা করতে পারলে না। তা কি আর করা। অন্যের জিনিস বয়ে বেড়াও। বসে তো থাকা যাবে না। আপাতত এই কাজটাই মনোযোগ দিয়ে করো।
হাসনা মুখে কিছু বললো না। আর কিইবা বলার আছে। বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে। হাসনা চলে যাবার পর রাজের দাদী এসে বলে,
—হাসনাকে তোমার এভাবে বলা উচিত হয়নি। মেয়েটা কষ্ট পেলো।
—কষ্ট পেলে পাবে। আমার কিছু করার নেই। আমি বুঝতে পারছি ও ইচ্ছে করেই সম্তান নিচ্ছে না।
–তা কি করে হয়?
—হয় মা,নিজের সন্তানের আদর কমে যাবার ভয়ে ও বাচ্চা নিতে চাইছে না।
এরমাঝে জারার শাশুড়ী এসে বলে,
—তোমার কথা ঠিক নয় ভাবী। বাচ্চা হবার বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে না। আজ না হয় কাল হবে।
—সে জন্য তো ইচ্ছা থাকতে হবে। ওর তো সেই ইচ্ছাটাই নাই। সবই আমার ছেলের দুর্ভাগ্য।
জমিলা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। নিজের কাজে মন দিলেন। এর মাঝে হাসনা আরশী আর সায়েরাকে নিয়ে বাসায় চলে আসে। ওদেরকে খাইয়ে দেয়।টেবিলে সবার জন্য খাবার বেড়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে আসে। যোহরের নামাজ আদায় করে নেয়। এরপর ডাইনিং টেবিল থেকে সবার এঁটোবাসনগুলো রান্না ঘরের সিংক এ রেখে নিজে মুখে কিছু খাবার তুলে নেয়। এরপর সব কিছু ধুয়ে রুমে চলে আসে। সায়েরা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। আরশী ওর রুমে হোম ওয়ার্ক করতে থাকে। হাসনা ছাদে চলে যায়। পেতে রাখা স্টিলের চেয়ারটায় বসে পড়ে। ছাদে শুকনো পাতা এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে। ধুলোর আস্তরণ পড়ে আছে। আসলে মনটা ভালো না থাকায় এদিকে নজর দিতে ইচ্ছে করছে না। টবের মাটিগুলো শুকিয়ে চৌচির। অবহেলা অযন্তে গাছগুলো যেন কোনো রকমে বেঁচে আছে। অনেকটা ওর মতোন। ইদানিং রাজও ওকে সময় দেয় না। যদিও হাসনা কোনোদিন রাজকে কোনো অভিযোগ করেনি তারপরও রাজ হয়তো বুঝে যে হাসনা ওকে অনুভব করে। সে কারণে নিজ থেকেই বলে,
—ইদানিং ব্যস্ততা একটু বেড়েছে। তাই তোমাদের সময় দিতে পারছি না। তবে এটা ক্ষণিকের জন্য। এরপর তোমাদের নিয়ে দেশের বাইরে ঘুরতে যাবো।
হাসনা রাজের কথাগুলো বিশ্বাস করতে চায়। তবে সেদিন রাজের মোবাইলের কল লিস্টে রশ্নির নাম্বার দেখেছিলো। রশ্নির কথা মনে হতেই বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা তীব্র ব্যথার স্রোত বয়ে গেল। গোধুলীর আবীর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। হাসনা গাছগুলোতে পানি দিতে থাকে। দূরের মসজিদে মাগরিবের আজান শোনা যায়। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে প্রচন্ড অবসাদ নেমে আসে। কখন যে মাথা ঘুরে ছাদে পড়ে যায় ও নিজেই বুঝতে পারে না। একসময় একটা ছোটো ছেলে এসে ওকে হাত ধরে টেনে উঠায়। হাসনা ওর হাত ধরে নদীর ঘাটে চলে যায়। সেখানে একটা নৌকা বাঁধা রয়েছে। ছেলেটার হাত ধরে নৌকাতে উঠে পড়ে। হাসনা অবাক হয়ে যায় এতোটুকু ছেলে নৌকাটা কিভাবে চালাতে পারে। একসময় প্রবল ঝড় উঠে। নৌকাটা দুলতে থাকে। মনে হচ্ছে এখুনি ডুবে যাবে। এসময় হঠাৎ আরো একটা নৌকা নিয়ে রাজ চলে আসে। রাজ হাসনাকে ডাকতে থাকে। হাসনা ধড়মড় করে উঠে বসে বলে,
—বাবুটা কোথায়?
রাজ রেগে গিয়ে বলে,
—কিসের বাবু আর তুমিই বা এখানে কিভাবে আসলে?
হাসনা কিছুই মনে করতে পারে না। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হলে আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে। এরপর রাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
—গাছে পানি দিতে এসেছিলাম।
মরিয়ম বেগম রেগে গিয়ে বলেন,
—ন্যাকামি করার জায়গা পাওনা? তোমাকে ভরসন্ধায় কে গাছে পানি দিতে বলেছিলো।
জমিলা বেগম মরিয়মের দিকে তাকিয়ে বলে,
—বাদ দাও না ভাবি এসব রাগারাগি। দেখছো না ওর পুরো শরীরে ধুলো মেখে আছে।
জমিলা হাসনার দিকে তাকিয়ে বলে,
—উঠে দাঁড়াতে পারবে?
হাসনা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পেরে উঠে না। মাথা ঘুরে আবার পড়ে যেতে থাকে। রাজ সাথে সাথে ওকে ধরে ফেলে। রাজের বাবা আরশাদ চৌধুরী রাজকে বলেন,
—তুই হাসনাকে পাঁজাকোলা করে নীচে নিয়ে আয়। আমি ডাক্তারকে কল করছি।
রাজ হাসনাকে পাঁজাকোলা করে নীচে নামিয়ে নিয়ে আসে। হাসনা রাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
—সায়েরা আর আরশী কোথায়?
–ওরা ঘুমিয়ে আছে।
—-ওদের ডেকে দেননি কেন? হোম ওয়ার্ক শেষ করেছে কিনা কে জানে?
—ওদের ভাবনা না ভেবে নিজের শরীরের কথা ভাবো। তাছাড়া কাল শুক্রবার। সুতরাং হোমওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই।
রাজ হাসনাকে নিয়ে নীচের ওয়াশরুমে চলে যায়। ক্লসেট থেকে ম্যাক্সি বের করে ওর হাতে দেয়। হাসনা হালকা করে শাওয়ার নিয়ে ম্যাক্সি পড়ে রুমে চলে আসে। রাজ ওকে বিছানায় শুয়ে পড়তে বলে। এরমাঝে ডাক্তার চলে আসে। পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বলে হাসনা কনসিভ করেছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রেগনেন্সি কিড রেখে যায়
সকালে পরীক্ষা করতে বলে। এখন কিছু ভিটামিন ওষুধ দিয়ে ডাক্তার চলে যায়। মরিয়ম বেগম একথা শুনে আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করে বলে,”আমার দোয়া তুমি কবুল করে নাও মালিক। এবার যেন আমার ছেলের ঘরে সন্তান আসে।”
হাসনাকে রাতে জমিলা বেগম গরম সুপ এনে দিয়ে বলে,
—-এটা খেয়ে নাও। তোমার শরীর খুব দুর্বল।
হাসনা মুখে দেওয়ার সাথে সাথে বমি করে ঘর নোংরা করে ফেলে। একটু সামলে নোংরা পরিস্কার করতে ও শোয়া থেকে উঠে বসে। কিন্তু রাজ ওকে বিছানা থেকে নামতে দেয় না। নিজেই নোংরাগুলো সব পরিস্কার করে। মায়ের অসুস্থতা দেখে সায়েরা আরশী জ্বালাতন ছাড়াই দ্রুত ভাত খেয়ে নেয়। সারা রাত উত্তেজনায় হাসনা ঘুমাতে পারে না। আধো ঘুম আধো জাগরণে পুরোটা রাত পার হয়ে যায়।
চলবে
#বড় গল্প
#ফেরারী বসন্ত
পর্ব- বারো
মাহবুবা বিথী
একসময় হাসনার চোখে একটু ঘুম নামে। হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে হাসনার চোখের ঘুম টুটে যায়। ও ধড়মড় করে বিছানার উপর উঠে বসে। এরমাঝে রাজ ওজু করে এসে নামাজে বসে । হাসনা খুব সাবধানে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে যায়। বাথরুমে রাখা প্রেগনেন্সি কীডটা কাঁপা কাঁপা হাতে ইউরিনে ডুবিয়ে দেয়। সাথে সাথে স্ট্রিপে দুটো লাল দাগ ভেসে উঠে। হাসনার হাতের আঙ্গুলগুলো থরথর করে কাঁপতে থাকে। ওয়াশরুম থেকে স্ট্রীপটা হাতে নিয়ে বের হয়ে আসে। রাজ তখন কেবল নামাজ শেষ করে জায়নামাজ ভাঁজ করে রেখে হাসনার দিকে তাকায়। দৌড়ে এসে ওর হাত থেকে স্ট্রীপটা নিয়ে নিজেও ভালো করে দেখে নেয়। পাশাপাশি এক হাত দিয়ে হাসনাকে জড়িয়ে ধরে। স্ট্রীপটা বিনে ফেলে দিয়ে হাসনার কপালে চুমু খায়। এরপর অশ্রুসজল চোখে হাসনার দিকে তাকিয়ে বলে,
—আল্লাহপাক আমাদের দোয়া কবুল করেছেন। তোমার গর্ভে অবশেষে আমার সন্তান আসছে। ভাবতেই আমি শিহরিত হয়ে যাচ্ছি।
হাসনার আজ যেন কিছু বলার ভাষা নাই। চোখ ছাপিয়ে শুধু আনন্দঅশ্রু অঝোরে গড়িয়ে পড়তে থাকে। কি রিয়্যাক্ট করবে ও বুঝতে পারছে না। এই খবরটা পেয়ে ও যেন অনুভূতি হীন হয়ে পড়েছে। বিয়ের তিনবছর পার হতে চললো। সন্তান না হওয়াতে কতো মানুষের কত কটুকথা ওকে হজম করতে হয়েছে। যদিও ঐসব দিনের কথা ও মনে করতে চাইছে না তবুও যেন মনের পর্দায় ভেসে উঠে। প্রথমে যখন লাল দাগ দুটো চোখে পড়ে ও যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। প্রথম সন্তান জন্মের প্রায় বারোবছর পর আল্লাহপাকের অমুল্য উপহার ওর জীবনে আবারো এসেছে এটা ভাবতেই হাসনা যেন ভাষা হারিয়ে ফেলে। হাসনাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রাজ কাঁদতে থাকে। রাজের কান্না দেখে হাসনার দুচোখে বাঁধভাঙ্গা জোয়ার নেমে আসে। দরজা নক করার শব্দে হাসনা আর রাজ সম্বিত ফিরে পায়।
রাজ হাসনার কাছ থেকে সরে এসে দরজা খুলে দেখে ওর মা দাঁড়িয়ে আছে। উদভ্রান্তের মতো রাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-হাসনা কি কনসিভ করেছে?
রাজ মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে সিক্ত চোখে বলে,
—হা মা আল্লাহপাক আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি।
মরিয়ম বেগম ঘরে ঢুকে হাসনাকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
—আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করো। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহপাক আমার ঘরে নতুন অতিথি পাঠিয়েছেন। তুমি একটু পর তোমার দাদীকে গিয়ে খবরটা জানাবে। তোমাকে এখন আর কিচেনে যেতে হবে না। সাবধানে থাকো। আগের বারের মতো ভুল করো না।
কথাগুলো বলে মরিয়ম বেগম চলে গেলেন। হাসনা ওর শাশুড়ীর দোষ দেয় না। বাচ্চা এবরশন হওয়ার পর কনসিভ না করতে পারার কারণে উনি অনেক কটু কথা হাসনাকে বলেছেন। না,হাসনা এতে কিছু মনে করেনি। শুধু ওর এটাই মনে হতে থাকে মানুষ খুব স্বার্থপর প্রাণী। নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলেই তার স্বরুপ প্রকাশ পেয়ে যায়। যাইহোক হাসনা আজকে এই সুখের দিনে সেসব আর মনে করতে চায় না।
বুকের মাঝে এতোদিন ধরে সন্তান না হওয়ার জন্য জমে থাকা বেদনার পাথরটা বোঝা হয়ে ছিলো। তা আজ এই প্রাপ্তির আনন্দে এক লহমায় সরে গেল। এই ক’বছর শাশুড়ী মায়ের কাছে ভালোই গালমন্দ শুনতে হয়েছে। হাসনা অবশ্য সেগুলো মনে রাখেনি। রাশেদকে ভালোবাসতে চেয়েও হাসনা ওর আচরণে পারেনি মন প্রাণ উজাড় করে ওকে ভালোবাসতে। কেননা ওর ব্যবহার ছিলো পশুর মতোন। অপরদিকে রাজ একজন ভালোবাসার মতোন মানুষ। যে কোনো মেয়েই ওর সঙ্গ ধারণ করলে ওকে ভালোবাসতে চাইবে। সেদিক থেকে হাসনাও এর ব্যতিক্রম নয়। ও তো এই সুসংবাদ শোনার জন্য উম্মুখ হয়েছিলো। হাসনা প্রথমে প্রেগনেন্সির স্ট্রীপে লালদাগ দুটি দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। ওর ধাতস্থ হতে সময় লেগেছে। কেনই বা হবে না কেননা এই দুবছর ওতো এই সংবাদটার জন্য তীর্থের কাকের মতোন অপেক্ষা করে থেকেছে। অপয়া অলক্ষী থেকে শুরু করে হেন কথা শুনতে এই সংসার বাকী রাখে নাই। সে কারণে মাঝে মাঝে নিজের কাছে নিজেকে অপাংতেয় মনে হতো। হাসনা সাজগোজ করতে ভুলে গিয়েছে। ও অগোছালো থাকা শুরু করে। যদিও রাজ ওর মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরেছিলো সে কারণে ওকে কখনও কিছু বলেনি।
হাসনা নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করে। আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করে। কেননা পরমকরুনাময় আল্লাহপাক ওকে এমন একজন স্বামী দান করেছেন। ভালোস্বামী পাওয়া আল্লাহপাকের বিশেষ রহমত। রাজ বুঝতো মরিয়ম বেগম ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করে। বিশেষকরে আরশী আসার পর আগের বাচ্চাটস এবরশন হওয়ার কারণে হাসনার উপর খুব ক্ষিপ্ত ছিলো। কিন্তু এখানে হাসনারই বা কি করার ছিলো। কিন্তু রাজ কখনও হাসনাকে গালমন্দ কিংবা কটু কথা বলেনি। বরং পাশে থেকে ভালোবেসে জীবন এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। হাসনার শরীরটা খুব দুর্বল। বিছানা থেকে উঠে বসতেই পারছে না। মাথাটা প্রচন্ড ঘুরছে। হাসনা বিছানায় শুয়ে পড়লো। এমন সময় সায়েরা এসে হাসনার কাছে বায়না করে বলে,
—,আম্মু আমি তোমার হাতে খাবো।
আরশীও চলে আসে। হাসনা সায়েরাকে আদর করে বলে,
—আজ একটু কষ্ট করে নিজের হাতে খেয়ে নাও। মামনির শরীরটা বেশী খারাপ।
সাথে সাথে আরশি বলে,
—ঠিক আছে আমি তোমাকে খাইয়ে দিবো।
রাজ সে সময় ঘরে ঢুকে বলে,
—আরশী,তোমাকে খাওয়াতে হবে না। টেবিলে নাস্তা দেওয়া আছে। খেয়ে নিয়ে পড়তে বসো। মনে রেখো সামনে তোমার পরীক্ষা।
আরশীর প্রতি রাজের কেয়ারিং দেখে হাসনার ভীষণ ভালো লাগে। সাইট টেবিলে হাসনার সুপটা রেখে সায়েরাকে বলে,
–আজ আমি তোমাকে খাইয়ে দিবো।
রাজ আরশী আর সায়েরাকে নিয়ে চলে যায়। সুপটা গরম থাকাতে সাইট টেবিলে ঢেকে রাখে। রাতে ঘুম না হওয়াতে এখন যেন দুচোখ ভরে ঘুম নামতে চাইছে।
বসার ঘরে সিতারা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ওর মা ওকে মিথ্যা কথা বলে ডেকে এনেছে। বলেছে ওর বাবার খুব অসুখ। কিন্তু বাড়ী এসে দেখতে পায় ওর বাবা বহাল তবিয়তে আছে। বরং ওর কপালে শনি লেগেছে। আগামীকাল ওকে নাকি পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। ওর প্রচন্ড মেজাজ খারাপ। না ওকে এখুনি বাড়ি থেকে পালাতে হবে। ওর পক্ষে কিছুতেই এ বিয়ে করা সম্ভব নয়। সিতারা শোবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। বাবা মা দুজনে দুপুরের ভাতঘুম দিচ্ছে। ফ্যানটা মাথার উপর শোঁ শোঁ করে ঘুরছে। মায়ের চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ গভীর ঘুম। সিতারা বাবা মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ঘরে চলে আসে। একটা চিরকুটে লিখে,”আমার পক্ষে এই বিয়ে করা সম্ভব নয়। সুতরাং আমি চলে যাচ্ছি। যদি তোমরা সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলো তাহলে ফোনে আমাকে জানিয়ে দিও। সিতারা বাড়ীর চর্তুদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। চাচীও বাড়ীতে নেই। মীরা আনতে স্কুলে গিয়েছে। চাচী ওকে নিজেই আনা নেওয়া করে। মীরা এখন ক্লাস এইটে পড়ে। ক’দিন আগে একজন ছেলের সাথে ভিন্নজগতে ঘুরতে গিয়েছিলো। এই খবর বাড়ীর ড্রাইভার ওর বাবাকে জানিয়েছিলো। সেই থেকে চাচী একমুহুর্ত মেয়েকে চোখের আড়াল করে না। বাসা থেকে বের হয়ে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসে। রাজশাহী গামী একটা বাসে উঠে পড়ে। বাসের জানালা দিয়ে শীতল বাতাস পুরো শরীরটাকে শীতল করে দিচ্ছে। কাল বৃষ্টি হওয়াতে আজকে আকাশটা বেশ পরিস্কার। কোথাও এক ফোঁটা মেঘ জমে নেই। এখন বেলা তিনটা বাজে। রাজশাহী পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে যাবে।
হাসেম খুব মনোযোগ দিয়ে থিসিস পেপার রেডী করছে। সামনে থিসিস জমা দিতে হবে। এটার উপর ভিত্তি করে ও বাইরে পিএইচডির জন্য স্কলারশিপের জন্য আবেদন করবে। সুতরাই থিসিসটা নিঁখুত হওয়া চাই। দরজায় কে যেন নক করছে। হাসেম নিজের মনে লিখতে থাকে। দরজা নক করার শব্দে বিরক্ত হয়ে বলে,
—কে?
—ভাইজান,আমি জহির
—ভিতরে আসো,
জহির ভিতরে এসে হাত কঁচলাতে কঁচলাতে বলে,
—আপনার সাথে একজন মেহমান দেখা করতে আসছেন।
জহিরের আচরণে হাসেম বিরক্ত হয়ে বলে,
—কথাটা স্বাভাবিকভাবে বললেই তো পারো। এতো হাত কঁচলানোর কি দরকার? চামড়া উঠে যাবে।
—একজন মেয়ে মানুষ আসছে।
জহিরের মুখে মেয়ে মানুষ কথাটা শুনে ও অবাক হলো। এই রাতে কোন মেয়ে ছেলেদের হোস্টেলের সামনে এসে ওর সাথে দেখা করতে চাইছে। গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে তাড়াতাড়ি হল থেকে বেরিয়ে আসে। আলো আঁধারিতে প্রথমে বুঝতে পারেনি মেয়েটা কে? তাছাড়া মেয়েটা পিছনদিক করে দাঁড়িয়েছিলো। কাছে গিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
—কে আপনি?
সিতারা সামনে ঘুরে হাসেমের দিকে তাকিয়ে বলে,
—হাসেম ভাই, আমি সিতারা।
—তুমি এসময় এখানে কেন?
—আমি এসময় কেন আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি আপনি বুঝতে পারছেন না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করছেন। হাসেম হয়তো কিছু আন্দাজ করতে পারছে। কিন্তু ও সেই প্রসঙ্গে না গিয়ে বলে,
—আসলেই বুঝতে পারছি না তুমি কেন আসছো?
—কাল আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।
—-এতো খুব ভালো খবর।
—একথা বলতে আপনার খারাপ লাগলো না?
সিতারার মনের অবস্থা হাসেম বুঝতে পারছে। কিন্তু ওর কিছু করার নেই। প্রথমতো ও আর সিতারা সামাজিক অবস্থান রাত আর দিনের তফাৎ। সে কারণে সিতারাকে ভালো লাগলেও তা ও অন্তরে সযতনে গোপন রেখেছে। হৃদয়ের অন্তপুর থেকে তা কখনও বাইরে আসতে দেয়নি। তাছাড়া খালা খালু দুজনেই ওকে অনেক স্নেহ করেন। ও কিছুতেই উনাদের মনে কষ্ট দিতে পারবে না। এদিকে সিতারার বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে যা মনে হলো, ও নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি অবিচল। ওকেই বা এখন ফিরিয়ে দিবে কিভাবে?
চলবে