#বড় গল্প
#ফেরারী বসন্ত
পর্ব -পনেরো
মাহবুবা বিথী
অনেকদিনপর সিতারা ছাদে পা রাখলো। পুরো ছাদে গোলাপের পাপড়ি বিছানো রয়েছে। আকাশে ঝরছে চাঁদের আলো। একটা মিষ্টি সুবাস নাকে এসে লাগছে। মনে হলো গোলাপের সুবাস। একসময় এই ছাদটা ওর পৃথিবী ছিলো। পুরো ছাদটা যেন নন্দন কাননে সেজে উঠেছে। সিতারা ঘোর লাগা আখিতে দৃষ্টি মেলে ভাবছে, এসব কি হচ্ছে ওর সাথে? হঠাৎ মনে হলো ছাদে হেলে পড়া নারিকেল গাছের চিরল চিরল পাতার আড়ালে সাদা শেরওয়ানি পরে কে দাঁড়িয়ে আছে? সিতারা নিজের দিকে তাকিয়েও অবাক হয়। ওর পরনে তো টুকটুকে লাল বেনারশী। কখন পরেছে মনে করতে পারছে না। কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো,
এতো সেই পরিচিত দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা। এখন সব মনে পড়েছে। আজই তো এই মানুষটার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে। সিতারা আস্তে আস্তে ধীর পায়ে মানুষটার পিছনে দাঁড়ালো কিন্তু ঐ মানুষটা ওর দিকে ফিরেও তাকালো না। উনাকে সিতারার স্পর্শ করতে ইচ্ছে হয়। সে কারণে যখন ছুঁতে গেল তখনি মানুষটা সরে দাঁড়াতে গেলেই ছাদের উপর থেকে নীচে পড়ে যেতে থাকে। সিতারা জোরে চিৎকার দেয়। অমনি ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়।
ঘুম ভাঙ্গতেই বুকের ভিতরটা ব্যথায় মোঁচড়াতে থাকে। রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। প্রতিটি রুমে গিয়ে হাসেমকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও হাসেমকে খুঁজে পায় না। এরমাঝে মীরা এসে বলে,
—ঘুম ভাঙ্গলো তোমার? কি গভীর ঘুমরে বাবা,কতক্ষণ ধরে দরজা নক করছিলাম।
—এই হাসেম ভাইকে দেখেছিস?
—-ভাইয়া তো চলে গেছে। আর এখন ভাইয়া ভাইয়া না করে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেরে নাও। একটুপর ছেলেপক্ষ চলে আসবে।
—-মানে কি?
—মানে হচ্ছে,ছেলে পছন্দ হয়ে গেলে চাচা তোমার কাবিন করে ফেলবে।
—কে বলেছে তোকে?
—ড্রইংরুমে সবাই কথা বলছিলো তখন আমি শুনে ফেলেছি।
এমন সময় মীরার মা রুবা হাতে একটা শাড়ির প্যাকেট নিয়ে এসে সিতারার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
—এখন গোসল করোনি? ওরা তো রওয়ানা দিয়েছে।
—চাচী,আমি এই বিয়ে করবো না।
—-কোনো ঝামেলা পাকিও না। মনে রেখো তোমার বাবার শরীর খারাপ। এমন কোনো কাজ করো না যাতে তোমার বাবার শরীর আবার খারাপ হয়।
সিতারা ওর চাচীর সাথে কথা না বলে কিচেনে গিয়ে ওর মাকে বলে,
—মা আমি এই বিয়ে করবো না,
—-ঠিক আছে তোকে বিয়ে করতে হবে না। শুধু শাড়ি পরে ছেলেপক্ষের সামনে গিয়ে একটু বসবি।
—বিয়ে করবো না তাহলে ওদের সামনে যাবো কেন?
—-সিতারা তোর বাবার শরীর কিম্তু ভালো না। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত শাড়ি পরে সাজুগুজু কমপ্লিট কর।
ও কিচেন থেকে বেরিয়ে আসে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। একদিকে স্বপ্নের বিষয়টা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অন্যদিকে এই বিয়ের ধাক্কা কিভাবে সামলাবে? নিজের রুমে এসে সিতারা হাসেমকে ফোন দেয়। কিন্তু মোবাইল সুইসস্টপ বলছে। ওর দুচোখ ভরে বাঁধভাঙ্গা অশ্রু ঝরতে শুরু করে।
হাসেম ইচ্ছে করেই মোবাইল বন্ধ রেখেছে। ও জানে,সিতারা ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করবে। তখন হাসেমের মনটা আরো বেশী খারাপ হবে। রাজশাহী পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে গেল। হাসেম বাস থেকে নেমে সোজা পদ্মা পাড়ে চলে যায়। সেখানে বালির উপর বসে পড়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে ধরে। আকাশটা যেন আজকে অন্যরকম নীল হয়ে আছে। এম্নিতে হাসেমের কখনও আকাশ দেখতে ভালো লাগে না। আজ বালির উপর শুয়ে পুরো দৃষ্টিটা আকাশের দিকে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু আকাশটা আজ বড় বেশী বিষন্ন হয়ে আছে। বুকের ভিতরটা ব্যথায় মোঁচড়াতে লাগলো। ভীষণ কষ্ট অনুভব হচ্ছে। সিতারার কথা খুব মনে পড়ছে। ওর কি এতোক্ষণে আকদ হয়ে গেছে? মোবাইলটা খুলে হাসনাকে ফোন দেয়। রিং হতেই ওপাশ থেকে হাসনা ফোন রিসিভ করে বলে,
—তোর সমস্যাটা কি? হঠাৎ আসলি আবার চলেও গেলি। কিছ বুঝলাম না।
—সিতারার খবর কিছু জানো?
—-আমার শরীরটা ভালো লাগছিলো না তাই যাইনি। আমি যাইনি বলে রাজও যায়নি। সেকারণে বলতে পারছি না আকদ হলো কিনা?তুই সিতারাকে ফোন দিলেই তো সব জানতে পারতিস।
—-তা পারতাম,
—-তুই কি সিতারাকে পছন্দ করিস?
—না না সেসব কিছু না। এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম।
হাসেম দ্রুত ফোন রেখে দিলো। এরপর একটা অটো ভাড়া করে হলের দিকে রওয়ানা দিলো। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। হলের কাছে পৌঁছাতে ভাড়া মিটিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। রুমে এসে আগে শাওয়ার নিয়ে নেয়। পেটের ভিতর শব্দ হচ্ছে। ক্ষিদা লাগলে ওর পেটে কেমন অদ্ভুত শব্দ হতে থাকে। ঘরে বিস্কুট আর চানাচুর আছে। বের করে মুখে দিতেই ভীষণ তিতা লাগলো। মুখে কোনো স্বাদ নেই। ফোনটা বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে সিতারা ফোন দিয়েছে। হাসেম ফোন রিসিভ করে না। সিতারা একের পর এক কল দিতেই থাকে। কিন্তু হাসেম রিসিভ করে না। একসময় ফোনটা মিউট করে রাখে। তারপর নিজের থিসিস পেপার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ওদিকে হাসেম ফোন রিসিভ করেনি দেখে অভিমানে সিতারাও আর ফোন দেয়নি। একটানা সাতদিন পরিশ্রম করে থিসিস পেপার জমা দেয়। তবে রুমে আসার পর শরীর কেঁপে জ্বর আসে। জ্বরের ঘোরে হাসেম সিতারার নাম ধরে ডাকতে থাকে। একসময় ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ওর রুমমেট আসিফ ওকে রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি করে।
সিতারা এসে বারান্দায় বসে। একটা দাঁড়কাক কখন থেকে কা কা করেই যাচ্ছে। ঘরে সকালে বানানো একটা রুটি ছিলো। সিতারা রুটিটা এনে বারান্দার গ্রীলে রাখতেই কাকটা ছোঁ মেরে রুটি নিয়ে চলে যায়। যাক কাকের চেঁচামেঁচি থেকে রক্ষা পাওয়া গেলো। সিতারা বারান্দায় পেতে রাখা চেয়ারটায় বসে। আজ সকাল থেকে হাসেমের কথা ওর খুব মনে পড়ছে। ওর কথা ভাবতেই দুচোখ জলে টইটম্বুর। হাসেমের কথা মনে হলে কেন চোখ ভর্তি করে অশ্রুর ঢল নামে সিতারা বুঝতে পারেনা। অথচ সাতদিন আগে হাসেমের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে। যেভাবেই বিয়েটা হোক না কেন তিন কবুল বলে আল্লাহপাকের কালাম স্বাক্ষী রেখে বিয়ে হয়েছে। অথচ এই সাতদিন ঐ মানুষ ফোন দিয়ে একটা খবর নিলো না। এমনকি ওর ফোনও রিসিভ করলো না। তার জন্য ওর চোখে পানি কেন আসে ও বুঝতে পারে না। হঠাৎ অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে। ধরবে না ভেবেও সিতারা ফোন রিসিভ করলো। সাথে সাথে ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠে একজন বলে,
—আপনি কি সিতারা বলছেন?
—-জ্বী,
—-আপনাদের বিয়েতে স্বাক্ষী হয়েছিলাম। আমি আসিফ বলছি,
—-বলুন কি বলতে চান?
—-হাসেমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জ্বরের ঘোরে ও আপনার নাম ধরে ডাকছে। আপনি কি আসতে পারবেন?
—ঠিক আছে, আমি আসছি।
সিতারা রাজশাহীতে হাসেমের কাছে যাচ্ছে। এই কথাটা একটা কাগজে লিখে পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা রাখলো। তারপর কিছু টাকা ব্যাগে ভরে একটা অটো নিয়ে বাসস্টান্ডের দিকে রওয়ানা দিলো। সামনে বাসটা পেলো সেটাতেই উঠে বসে। ঘন্টাখানিক পর ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে ওর মা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কর্কশ কন্ঠে সায়মা বলে,
—তুই কার অনুমতি নিয়ে রাজশাহী রওয়ানা দিয়েছিস?
—-আমার নিজের অনুমতি নিয়ে রওয়ানা দিয়েছি।
—-ওর সাথে তোর এতো খাতির কবে থেকে হলো যে জ্বরের কথা শোনা মাত্রই লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে রওয়ানা দিয়েছিস?
—হাসেম আমার কেমন খাতিরের মানুষ তুমি রাজশাহী আসলে জানতে পারবে। আর কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মাথাটা ব্যথা করছে। ফোন রাখলাম।
—-এই ফোন রাখবি না,কথা এখনও শেষ হয়নি।
—-বলো কি বলবে?
—-তুই এতো নির্লজ্জ কবে থেকে হয়েছিস? একটা সোমত্ত মেয়ে আর একটা সোমত্ত ছেলের কাছে ছুটে যাচ্ছে। দেখতে ভীষণ খারাপ লাগছে। লোকে কি বলবে?
—-লোকে কি বলবে সেটা পরেও ভাবা যাবে। কিন্তু এই মুহুর্তে আমি না গেলে হাসেম ভাইয়ের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
চলব
#বড় গল্প
#ফেরারী বসম্ত
পর্ব- ষোলো
মাহবুবা বিথী
সিতারা মোবাইল সুইসস্টপ করে রেখে দিলো। ও জানে ওর মা ওকে এখন একটানা বকে যাবে। এই মুহুর্তে আম্মুর বকবক ওর ভালো লাগছে না। হাসেমভাই কেমন আছে কে জানে? হাসেমভাই বলে সিতারা মনে মনে শুধরে নিলো। আসলে হাসেম এখন ওর হাজবেন্ড। আর যাই হোক হাজবেন্ডকে ভাই বলাটা মনে হয় শোভন দেখায় না। ওদিকে সায়মা সিতারাকে মোবাইলে বার বার ফোন দিতে থাকে। কিন্তু মোবাইল সুইচস্টপ বলছে। সিতারার চাচী সহ সবাই তখন ড্রইংরুমে বসে আছে। সায়মাকে বার বার ফোন করতে দেখে রুবা মানে সিতারার চাচী ফোড়ন কেটে বলে,
—-আর ফোন দিয়ে লাভ নেই। যা ঘটার তাতো ঘটেই গিয়েছে। তবে হাসেম তোমার বোনপো হলে কি হবে ওকে আমার বরাবর ধান্ধাবাজ মনে হতো। এই ধরনের ছেলেরা গাছেরও খায় তলারটা কুড়ায়।
রুবার কথা শুনে সায়মার মনে মনে সিতারার উপর প্রচন্ড রাগ হলো। আজ সিতারার কারণে ওকে এই কথাগুলো শুনতে হলো। তবে রুবার উপরও চটে গিয়ে মনে মনে বললো,
“নিজের ঘর আগে সামলাও। তোমার মেয়ে স্কুলের গন্ডি এখনো পেরোয়নি তাতেই প্রেম করা শিখে গিয়েছে। আর এমন ছেলের সাথে প্রেম করে যে প্রতি ক্লাসে ফেল করে পরের বছর পাশ করে। আমার মেয়ে কিংবা বোনপোকে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।”
রুবার কথা শুনে সিতারার বাবা ফিরোজ রেগে গিয়ে বলে,
—-এখানে হাসেমের দোষটা কোথায়? দোষ যা করেছে সেটা সিতারাই করেছে।
রুবা ফোস করে উঠে বলে,
—-আপনার মতো ভালো মানুষের চোখে ঐসব বদমায়েশ ছেলেদের ত্রুটি ধরা পড়বে না।
ফিরোজ এবার রেগে গিয়ে বলে,
–রুবা,কিসব বলছো? হাসেম খুবই ভদ্র একজন ছেলে। তুমি আর ক’দিন দেখেছো? আমি ছোটোবেলা থেকে হাসেমকে ভদ্র ছেলে হিসেবে জানি।
সায়মা রেগে গিয়ে বলে,
—এসব আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়ে আমার সাথে রাজশাহী চলো।
ওদিকে সিতারার রাজশাহীতে পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে যায়। একটা অটো নিয়ে রাজশাহী মেডিকেলের দিকে রওয়ানা দেয়। হাসপাতালে পৌঁছে আগে রিসিপশনে একটা কেবিনের জন্য চেষ্টা করে। তবে খুব তাড়াতাড়ি কেবিন পেয়ে যায়। আসলে জেলা শহর গুলোতে কেবিন খালি পড়ে থাকে। এরপর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখে সিতারা হাসেমের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। হাসেমের চোখের নীচে কালো দাগ পড়েছে বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে। চেহারা হয়েছে কাকের মতো। মুখ ভর্তি দাড়িগোঁফ। স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। সিতারাকে দেখে আসিফ হাসেমের কাছ থেকে ছুটে এসে সিতারাকে বলে,
—আপনার হাসপাতালে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
—না তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। হাসেম এখন কেমন আছে?
—দুপুরের পর জ্বর আর আসেনি।
সিতারা লক্ষ্য করে আসে পাশের রুগীর বেড থেকে তাদের এটেনডেন্টরা উঁকি ঝুঁকি মারছে। আসলে পুরুষ ওয়ার্ডের সামনে এরকম এক সুন্দরী তরুনী দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখার জন্য উঁকি মারবে এটাই স্বাভাবিক। আসিফ সিতারার দিকে তাকিয়ে বলে
—আপনি এখানে কিভাবে থাকবেন? ওয়ার্ডের অবস্থা ভালো নয়। তাছাড়া বাথরুমের অবস্থা বেশী খারাপ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি রুগীর সাথে যারা থাকতে আসে তারাই মনে হয় বাথরুম ব্যবহার করতে জানে না। আসিফের কথা শুনে সিতারার বিরক্ত লাগলো। সেটা গোপন রেখে আসিফকে বলে,
—আসার সময় কেবিন ঠিক করে এসেছি। আপনি শুধু ওকে কেবিনে শিফট করার ব্যবস্থা করুন।
আসিফ সিতারার আপাদমস্তকে চোখ বুলিয়ে মনে মনে বলে,
—-হাসেম তোর কপাল বটে। এরকম একটা নারী তোর জীবনে জোটাতে পেরেছিস। যে তোর সেবার করার জন্য ছুটে এসেছে। মনে হচ্ছে তোর কপালের সাথে আমার কপালটা ঘষে নেই।
সিতারা আসিফের দিকে তাকিয়ে বলে,
—এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে রোগী তো শিফট করা যাবে না তাই না?
—ওহ্ সরি,এখনি সব ঠিক করে দিচ্ছি।
আসিফ সাথে সাথে ওয়ার্ড বয় ডেকে ঘুমন্ত হাসেমকে স্টেচারে করে কেবিনে নিয়ে বেডে শুয়ে দিলো। সিতারা তখন করিডোরে দাঁড়িয়েছিলো। আসিফকে নিষেধ করে দিয়েছে ওর আসার খবর যেন হাসেমকে না জানায়। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে হাসেমের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আসিফের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-ওয়ার্ডে তো ভালোই ছিলাম,কেবিনে আনলি কেন? তাছাড়া কেবিনের খরচ এখন কে বহন করবে? এমনি আমার পকেট খালি হয়ে আছে।
—সেসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।
আসিফ চলে যাবার পর হাসেম বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। সিতারা কেবিনে ঢুকে বেডের পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়ে। এরপর হাসেমের কপালে হাত দিয়ে বলে,
—কেমন আছো?
হাসেম চমকে উঠে পাশ ফিরে সিতারার দিকে তাকিয়ে বলে,
—তুমি এসময় কোথা থেকে আসলে?
—যেখান থেকে আসা দরকার সেখান থেকেই এসেছি।
—তোমার হাজব্যান্ড জানতে পারলে বিষয়টা খারাপ হবে। তাছাড়া—-
—থামলে কেন? তাছাড়া কি?
—-আমার বোনের ডিভোর্স হওয়াতে আমি বুঝি একজন ডিভোর্সী মেয়েকে এই সমাজ কি চোখে দেখে? তাই আমি চাই না তোমার এমন কিছু হোক।
—আমিও চাই না বলেই তোমার কাছে চলে এসেছি। আমার সেদিন বিয়ে হয়নি। ছেলেপক্ষ আংটি পরিয়ে চলে গিয়েছে। ওরা চলে যাওয়ার পর আমি আংটি খুলে রেখে দিয়েছি। আর আজ পুরোপুরি তোমার কাছে চলে এসেছি।
—-কিন্তু খালা খালু কি এই বিয়েটা মেনে নিবেন?
—-না নিলে সমস্যা নেই। তোমারও গ্রাজুয়েশন শেষ আর আমারও সামনে শেষ হয়ে যাবে। তুমি একটা চাকরি যোগাড় করতেই পারবে। আমিও দুটো টিউশনি করবো। এতে আমাদের টেনাটুনির সংসার ভালোই চলবে।
—কিন্তু আমি খালা খালুকে কষ্ট দিতে চাই না।
হাসেমের কথায় সিতারার প্রচন্ড অভিমান হলো। নিজের অভিমান প্রকাশ না করে হাসেমকে বলে,
—ঠিক আছে, তোমাকে কাউকে কষ্ট দিতে হবে না। রাতটা পার হলে আমি কাল সকালে চলে যাবো।
এরমাঝে দরজায় নক করার শব্দ হলো। সিতারা দরজা খুলে দেখে আসিফ হোটেল থেকে খাবার কিনে এনেছে। সিতারার হাতে খাবার বুঝিয়ে দিয়ে ও হলে চলে যায়। সিতারা খুব স্বাভাবিকভাবে হাসেমকে খাবার দেয়। নিজেও একটুখানি খিচুড়ী আর ইলিশমাছের ভাজি আর বেগুন ভাজি দিয়ে খেয়ে নেয়। হাসেম খাওয়া শেষ করে ওষুধ খেয়ে নেয়। সিতারা খাওয়া শেষ করে কেবিনের বাইরে চলে আসে। রাত বারোটা বাজে। পুরো হাসপাতাল আস্তে আস্তে নিরব হয়ে যাচ্ছে। করিডরের কিছু লাইট অফ করে দেওয়া হলো। হাসেমের কেবিনটা এক পাশে থাকাতে সিতারার ভালোই হলো। ও পেতে রাখা চেয়ারটায় বসে নিজের দৃষ্টি বাইরে মেলে ধরে আর মনে মনে ভাবে,
“কি মানুষকে ও ভালোবেসেছে? যে কিনা ওর ভালোবাসার গভীরতা অনুভব করতে পারলো না।”
ওর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তবে কিছুক্ষণ পর নিজের চোখের পানি মুছে মনে মনে বলে,একজন কাপুরুষের জন্য চোখের পানি ফেলা উচিত নয়।
আকাশে আজ চাঁদের ফকফকা জোছনা ঝরছে। সিতারা দৃষ্টিটা বাইরে মেলে ধরে। দূরে ঘন বৃক্ষরাজী দেখে ওর মনে হলো ঐ জায়গাটা যেন বৃক্ষের দুর্গ। অনর্গল ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে। সিতারা এখানে ঘুমিয়ে পড়তে মন চাইছে। তবে সেটা মনে হয় ঠিক হবে না। সিতারার মন আজ বড় শান্ত। কারণ ও আজ বুঝে গিয়েছে আর যাই হোক জোর করে কারো ভালোবাসা আদায় করা যায় না।
—সিতারা,
সিতারা পাশ ফিরে তাকিয়ে হাসেমকে বলে,
—দেখো, বাইরে আজ কি সুন্দর জোছনা,আমি আজ সারারাত এখানে বসে কাটিয়ে দিবো।
এরপর কিছুক্ষন নিরব থেকে হাসেমকে বলে,
—তুমি আমাকে নিয়ে কোনো প্যারা নিও না। আমি খুব দ্রুত তোমাকে মুক্ত করে দিবো।
হাসেমের বুকের ভিতরটা মোঁচড় দিয়ে উঠে। ও তো সিতারাকে অনেক ভালোবাসে। হাসেম কেবিনে এসে একটা চাদর নিয়ে সিতারাকে দিয়ে বলে,
—এটা গায়ে জড়িয়ে নিও। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।
সিতারার কিছু কঠিন কথা হাসেমকে শোনাতে মন চাইছিলো। ওর বাঁচামরাতে কার কি এসে যায়। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নেয়।
খুব ভোরে সায়মা আর ফিরোজ চলে আসে। সিতারা তখন ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হচ্ছিলো। সায়মা আর ফিরোজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, হাসেমের সাথেই সিতারাকে বিয়ে দিবে। ঘরের ছেলেমেয়ে ঘরেতে থেকে যাবে। ফিরোজ রুমে এসে হাসেমকে দেখে বলে,
—-এখন কেমন আছো?
—-ভালো,আঙ্কেল আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
সিতারা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে হাসেমের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। আর মনে মনে বলে, বোবার মুখে দেখি কথা ফুটেছে।”ও জানতো ওর বাবা মা চলে আসবে। সে কারণে উনারা আসাতে সিতারা অবাক হয় নাই। তবে হাসেম কি বলবে সেটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো।
—-আঙ্কেল আমি সিতারাকে অনেক ভালোবাসি।
—তাতো বুঝতেই পারছি। তা,না হলে আমার মেয়ে এভাবে ছুটে আসে?
এবার হাসেম মাথা নিচু করে বলে,
—-আমি একটা অপরাধ করে ফেলেছি।
একথা শুনে তিনজনই ওর মুখের দিকে তাকালো।
—-আপনাদের না জানিয়ে আমি ওকে বিয়ে করে ফেলেছি।
একথা শুনে সিতারা রেগে গিয়ে বলে,
—না, তুমি আমাকে বিয়ে করোনি। বরং আমি তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছি।
চলবে