#মধ্য_রাতের_চাঁদ |১৫|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
গ্রীষ্মের দুপুর। গলির রাস্তা ফাঁকা, গাছপালার ছায়া ছড়ানো, হালকা হাওয়া বইছে। কলেজ থেকে বাসায় ফিরছে প্রত্যাশা। স্কুটির হ্যান্ডেলে দুইহাত রেখে হেটে হেটে বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে যাচ্ছে। আর মাঝেমাঝে গালে থাকা সেন্টার ফ্রুট চিবাচ্ছে তো আবার ফুলাচ্ছে। পাশে হ্যাপি চিপস খেতে খেতে হাঁটছে, অপর পাশে নাহিদ সাইকেলে চড়ে। হঠাৎ পিছন থেকে রোহান দৌড়ে আসল। কোনো কিছু না বলেই ঝাঁপিয়ে নাহিদের সাইকেলের পেছনে বসে পড়ল। সাইকেলের ভারে একটু হেলে পড়তে পড়তে, কোনোরকমে নাহিদ সামলে নিলো। পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল,
-” আরেএএএ ব্যাটা, আরেকটু হলেই তো যাচ্ছিলাম। একদম ড্রেনে পড়তাম। সাইকেল তো যেতোই, সাথে এক ডজন সাবান লাগত। গা থেকে ড্রেনের পঁচা গন্ধ দূর করতে।”
ওপাশ থেকে প্রত্যাশা চেঁচিয়ে বলল,
-” নাহিদ সমস্যা ছিলো না, ওর বড়লোক শ্বশুরের থেকে বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে, একটা বাই-সাইকেল আর এক বক্স সাবান নিয়ে তোকে দিতো।”
রোহান বলল,
-” শালার হবু শ্বশুর ঘ্যাড়ত্যাড়া। মেয়েই দিচ্ছে না। মেয়ের সাথে এক টাকার লজেন্স পাব কী না সন্দেহ! সেখানে এসব পাব, ভাবাও বিলাসীতা। ছ্যাহ!”
প্রত্যাশা হাসতে হাসতে স্কুটিতে চেপে বসল। পরপর হ্যাপি পিছনে। গল্প গুজবের মাঝে হঠাৎ প্রত্যাশা নাটকীয় ভাব নিয়ে স্কুটির হ্যান্ডেল থেকে হাত সরিয়ে ফেলল। তারপর ওদের দেখিয়ে চিৎকার করে বলল,
-” এই দ্যাখ দ্যাখ! আমার হাত নেই!”
নাহিদ কপালে বিরক্তির ছাঁট ফেলে, সিরিয়াস গলায় বলল,
-” এ আবার এমন কী? দ্যাখ!”
বলেই সাইকেল চালাতে চালাতে সেও দু’হাত ছাড়ল। প্রত্যাশা মুখ বাঁকাল। নিজেকে আরেক ধাপ উঁচুতে রাখতে দুষ্টু হাসল। দাঁত কেলিয়ে স্কুটির সিটে সোজা হয়ে বসে দু’পাশে একটু পা ছড়িয়ে বলল,
-” এবার দ্যাখ। আমার পা-ও নেই, হুঁ।”
নাহিদ বলল,
-” মেরি বোন, অতো রিস্ক নিতে চাইছি না…”
রোহান উসকানিমূলক সুরে বলল,
-” দেখিয়ে দে না ওকেও। নাহলে কনফিডেন্স কই? আমি পিছে আছি তো মামা। টেনশন নেই।”
নাহিদ হাসতে হাসতে বলল,
-” না মামা! পা নাই বলতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করলে… পরে বলতে হবে; দাঁতও নেই রে!”
হ্যাপি মুখে চিপস পুরে চিবাতে চিবাতে বলল,
-” দোস্ত ফাজলামি বাদ দিয়ে ঠিকঠাক চালা। আমি এখন হেলমেট ছাড়া হ্যাপি সিং। এক্সি’ডেন্ট হলে নাম হবে; লাস্ট স্ন্যাক উইদ হ্যাপি চিপস।”
প্রত্যাশা অনেকটা এগিয়ে গেছে। নাহিদের ম্যাড়মেড়ে শব্দ করা সাইকেলটা যেন হাঁপাচ্ছে। চলছে ধীর গতিতে। পেছন থেকে রোহান বিরক্ত হয়ে জিভে একটা ‘চ’ শব্দ তুলে বলল,
-” তোর এই সাইকেল দেখি, জটিল আর কঠিন রোগে ভুগছে। যেন কোনাে হার্ট পেশেন্ট এক্সারসাইজে নামছে। মামা তাড়াতাড়ি একে নিয়ে কলিকাতা হারবালের শরনাপন্ন হ। এক ফাইলই যথেষ্ট। এর ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে শব্দে আমার মাথা ন’ষ্ট।”
এই বলে রোহান পিছন থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল।
.
তিন রাস্তার মোড়ের কাছাকাছি যেতেই প্রত্যাশার চোখদুটো বিস্ময়ে সরু হয়ে যায়। নীরবের মতো লাগছে। পিছনের দৃশ্য দেখে কপালে চিন্তার ছাপ পরে…ওইতো দেখা যাচ্ছে, কালো বাইকের পিছনে একটা বাচ্চা মেয়ে বসে। পিঠে স্কুল ব্যাগ, দুইহাতে শক্ত করে বাইকারের পেট পেঁচিয়ে ধরে আছে। কালো বাইক, ইউনিফর্ম, পিছনের অবয়ব। মন বলছে ওটা নীরব। তবে বাচ্চা মেয়েটা কে? আনিশা? উঁহু! আনিশা এর থেকে একটু বড়। আর আনিশার চুলগুলো একটু কুকড়ানো। বাইকার সহ, মেয়েটির পিছন সাইড দেখা যাচ্ছে। বাইকটা মূহুর্তেই অপর রাস্তা দিয়ে ছুটে আড়াল হয়ে গেল। কত পুলিশই তো আছে। তাদের কেউ হবে হয়তো! বাচ্চাকে স্কুল থেকে…এসব ভেবে প্রত্যাশা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল! কয়েক সেকেন্ড আগের দৃশ্য আর ভাবনা।
___________
ইচ্ছেকে মনা উপরে নিয়ে যায়। তানিয়া ড্রয়িংরুমেই ছিলেন। নীরবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-” বসো বাবা।”
তারপর সার্ভেন্টকে ঠান্ডা পানীয় আনতে বললেন। নীরব সোফায় বসল। ভেতরে ভেতরে ওর এক ভাবনা চলছে। কীভাবে প্রসঙ্গ উঠাবে ভাবছে। এরমধ্যে হন্তদন্ত পায়ে, একহাতে সাইড ব্যাগ ধরে, অন্যহাতে শাড়ির কুচি আগলে এগিয়ে আসছে প্রীতি। খানিকটা দূর থেকেই বলল,
-” মা, ইচ্ছে আসছে?”
বলতে বলতে দৃষ্টি গেল নীরবের দিকে। তানিয়া বললেন,
-” এই তো একটু আগেই নীরব নিয়ে এল।”
-” ওহ্।”
ছোট করে জবাব দিয়ে সোফায় এসে বসল প্রীতি। তানিয়া বলতে থাকলেন,
-” সার্থ বলল, ড্রাইভার নাকি অসুস্থ। আবার সার্থও তো ক্যাম্পেইনে শহরের বাইরে গিয়েছে। তাই তোকে ফোন দিয়ে ইচ্ছেকে আনতে বলল। তোকে ফোন দিলাম, ফোন বন্ধ দেখাল। তাই শেষমেষ উপায়ান্তর না দেখে নীরবের কাছে ফোন দেই।”
প্রীতি ব্যাগের সাইড থেকে ফোন বের করতে করতে জবাবে বলল,
-” তখন একটা মিটিং এ ছিলাম। মিটিং শেষে ফোন ওপেন করতেই ভাইয়ার কল দেখলাম। ব্যাক করার পর… শুনেই, ছুটে এলাম। স্কুলে এসে ইচ্ছে নেই শুনে মাথা ঘুরে গিয়েছিল। তারপর গেইট পাশের স্বাক্ষর চেক করে; নীরবের নাম দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।”
এরমধ্যে ঠান্ডা পানীয়ের গ্লাসের ট্রে এনে টি-টেবিলে নামায়। তানিয়া খান আদুরে গলায় নীরবকে নিতে বললেন। নীরব গ্লাসটা হাতে তুলল। বলল,
-” আন্টি আমার একটা কথা বলার ছিলো…”
প্রীতি ঝুঁকে একটা গ্লাস হাতে নিচ্ছিল। আড়চোখে ভ্রু কুঁচকে নীরবের দিকে তাকাল। পরপর গ্লাসটা হাতে নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসল। তানিয়া একগাল হেসে বলল,
-” বলো বাবা, এতে জিজ্ঞেস করার কী আছে? একটা কেনো, হাজারটা বলো। কোনো সমস্যা নেই।”
কোমল পানীয়ের গ্লাসে ছোট্ট করে চুমুক দেয় নীরব। তারপর নির্লিপ্ত ভঙিতে বলল,
-” আমি চাইছি খুব দ্রুতই ইচ্ছেকে ওর নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। ওখানে অনেকে আছে, ইচ্ছের দেখাশোনার কোনো সমস্যা হবে না। পরিপূর্ণ একটা পরিবার পাবে। ও যে ধাক্কাটা পেয়েছিলো, মানসিক বিকাশে বিঘ্ন হচ্ছিল; আশাকরি সবার মাঝে থেকে নতুন কোনো আঘাত পেলেও; সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। সবার ভালোবাসায় , আদরে সুন্দর একটা লাইফ পাবে।”
প্রীতি তাচ্ছিল্য হাসল। কৌতুকের সুরে বলল,
-” কী বললে তুমি? হাউ ফানি! ওটা ইচ্ছের নিজের বাড়ি? কবে থেকে শুনি?”
নীরবের চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। গলার স্বর ভারী হয়ে গেল,
-” ইচ্ছের শরীরে আমাদের বংশের র°ক্ত বইছে, এটা অস্বীকার করতে পারবে? ইচ্ছে আমাদের পরিবারের মেয়ে। এটা যেমন মিথ্যে নয়, তেমনি___”
প্রীতি মাঝখানেই থামিয়ে দিল নীরবকে। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের ছাপ নিয়ে ব্যঙ্গ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
-” আগে আমায় বলো, ওটা ইচ্ছের বাবার বাড়ি কখনো ছিলো?”
প্রীতির ত্যাড়া কথায় রাগে নীরবের মাথার মধ্যে দপদপ করতে লাগল। নীরবকে সুযোগ না দিয়ে প্রীতি নিজেই উত্তর দিল,
-” তোমরা তো সেই বাড়িকে ওর বাবার ঠিকানা বানাতে দাওনি কখনো। ইচ্ছে তো ওখানে বেড়ে ওঠেনি। কখনো ওখানে পা ফেলার সুযোগই পায়নি। ইভেন তোমাদের বাড়ির কেউ কখনো দেখতেই আসেনি। তুমি এখন বলছো, ওটা ওর বাড়ি? কবে থেকে, নীরব? টেল মি?”
নীরব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
-” যেটা কাগজে-কলমে বাবার ঠিকানা, সেটা নিয়ে আমি অহেতুক তোমার সাথে তর্ক করতে চাইছি না। ইচ্ছের খোঁজখবর নেয়নি। এখানে শুধু আমার পরিবারেরই দোষ ছিলো না। তোমরা নিজেরাই দূরে থেকেছো। আর যেকোন কিছুর সুযোগ আপনাআপনি বয়ে আসে না, সুযোগ করে নিতে হয়। না নীবিড় কখনো করেছিল, না তো তুমি। তোমাদের বিয়ে মেনে নেয়নি। পরবর্তীতে তোমরা কখনো গিয়েছিলে মানাতে? কখনো গিয়ে ক্ষমা চেয়ে, কাছে থাকার সুযোগটুকু চেয়েছিলে?, আমি যতটুকু জানি তোমরাই কোনো যোগাযোগ রাখনি।”
-” আমাকে ব্লেইম করছো? সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছো। তোমার ভাইকে বলেছিলাম, পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় বিয়ে করতে?”
তানিয়া ব্যাকুল চোখে দুজনের তীব্র দ্বন্দ্ব দেখছেন। পরিস্তিতিটা স্বাভাবিক করতে দু সেকেন্ড ভাবলেন। তারপর একটু দুশ্চিন্তার সুরে বললেন,
-” তোমার মা রাজি হবে তো নীরব?”
-” নীবিড়ের কিছু ভুল ছিলো। মা একটু বেশিই অভিমানী; সেটাও মানছি। তবে মায়ের মনটা খুব নরম। আমি জানি, মা যদি একবার ইচ্ছের চোখে চোখ রাখে, আর না বলতে পারবে না। মা’কে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার। বাবা ফিরলেই দু’জনকে একসাথে বসিয়ে সব বুঝিয়ে বলব। সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন।”
প্রীতি এবার রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠল,
-” মাথা ঠিক আছে তোমার? আমি আমার মেয়েকে দিতে পারব না। আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে।”
নীরব শান্ত কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল,
-” তোমার থেকে ইচ্ছেকে আলাদা করার কথা বলেছি? বলিনি তো। আর না তো এরকম ইনটেনশন আছে। ইচ্ছে যেখানেই থাকবে, ওর মাম্মাও সাথে থাকবে। যদি তুমি চাও। আশাকরি তুমি ব্রেনি।”
আর বাড়তি কথা না বলে নীরব গ্লাসটা টেবিলে নামাল। পরপর তানিয়ার দিকে চেয়ে ভদ্রতা দেখিয়ে বলল,
-” আমি তাহলে উঠি।”
শব্দহীন পায়ে প্রস্থান করে নীরব। যতই প্রীতি মেয়ে-মেয়ে করুক। এ কদিনে নীরব ঢের অনুমান করেছে; প্রীতি মেয়ের প্রতি বড্ড উদাসীন। এমন একটা উদাসীন মায়ের কাছে ইচ্ছে মোটেই সেভ নয়। বিভিন্ন কিছু লক্ষ্য করে নীরব শেষমেষ ইচ্ছেকে নিজেদের বাড়িতে রাখার কথা ভাবে। এখন মা’কে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মানাতে পারলেই হয়।
_____________
পূর্ণিমার রাত। হঠাৎই চাঁদের থালাটা ধীরেধীরে মেঘের আঁচলে ঢাকা পড়ে গেল। এক ঝটকায় দমকা হাওয়া বইতে শুরু করল, সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ব্যালকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশা। হাওয়ার সাথে বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাগুলো এসে গাল ছুঁয়ে দিল। নীরব কফির মগ হাতে এসে সোজাসুজি দোলনায় বসল। আদেশের সুরে বলল,
-” প্রত্যাশা….সরে দাঁড়াও, বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছো তো।”
প্রত্যাশা বিরক্ত মুখে ঘুরে নীরবের দিকে তাকাল। ঠোঁট উল্টে বায়না করে বলল,
-” ভিজি না? দারুণ লাগছে তো!”
-” উঁহু! ঠান্ডা লাগবে, জ্বর আসবে।”
কফির মগে ঠোঁট ছুঁইয়ে নীরব বলল। প্রত্যাশা ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ ভার করে রইল। কিছুপল ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কিছু ভেবে নীরবের পাশে গিয়ে বসল। আলাপ জমাতে পা দুটো দুলাতে দুলাতে বলল,
-” বৃষ্টি আপনার ভালো লাগে না?”
-” হুম।”
উত্তরটা প্রত্যাশার মনোঃপুত হলো না। ও মুখ ভেঙিয়ে বলল,
-” হুম…এই একটা উত্তর হলো। আপনার যায়গায় অন্যকেউ থাকলে, এই ঝুম বৃষ্টির রাতে, আমার মতো একটা কিশোরী মেয়েকে পাশে নিয়ে; নির্ঘাত একটা কবিতা-টবিতা লিখে ফেলত। শুধু কবিতাই নয়, রোমান্টিক গানটানও গাইত, হুম। সাথে বৃষ্টিতেও ভিজতো। আপনি তো সেসব কিছুই করবেন না। ভিজবেনও না। আমাকেও ভিজতে দিবেন না।”
নীরব নিরুত্তর। নীরবের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে প্রত্যাশার রাগ হলো। ও ঝটিকায় উঠে দাঁড়িয়ে তর্জনী আঙুলে নাক ঘষে নিয়ে ঘনঘন বলল,
-” আপনি খুব আনরোমান্টিক। এখানে আপনার সাথে থাকলে রাগ বাড়বে বৈ কমবে না। তারচেয়ে বরং রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ব্যাড নাইট। বোরিং নাইট।”
এই বলে পা চালিয়েছে আর অমনি শাড়ির আঁচলে টান পড়ল। নীরব বাম হাতের কফির মগ নামিয়ে, ডান হাতে শাড়ির আঁচলটা পেঁচাতে পেঁচাতে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
-” কী বললে, আমি আনরোমান্টিক? অন্যকেউ হলে কবিতা তারপর গানও গাইত। তাই বলছিলে, রাইট?”
প্রত্যাশা একহাতে শাড়ির আঁচল টেনে বলল,
-” ছাড়ুন তো।”
আঁচল ছাড়িয়ে প্রত্যাশা পা বাড়াল। আচমকা বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দের সাথে আকর্ষণীয় সুর কানে এল,
-” Kisi shayar ka dil banke, Baristi hain boondein tumpe…”
প্রত্যাশা থমকে দাঁড়ায়। ধীরেধীরে পেছনে ফিরে তাকায়। নীরব ওর দিকেই চেয়ে মুখে স্নিগ্ধ হাসি। প্রত্যাশার ভ্রু কুঁচকে গেল। ও সরু চোখে চাইল।
-” Nazara uff kya hota hai, Guzarti hain jab julfon se…”
তারপর প্রত্যাশার একদম কাছাকাছি এসে চুলের ভাঁজে মুখ ডুবায়। প্রত্যাশা কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল। প্রত্যাশার হাত ধরে নীরব আঁটকে দিল,
-” Doori kahin ab jao na tum….”
পরপর একহাতে বৃষ্টির জল ধরে, আকাশের দিকে মুখ তুলে,
-” Sun sun sun barsat ki dhun sun…”
প্রত্যাশা থেমে স্থির দাঁড়িয়ে। নীরব ওর চোখে চোখ রেখে,
-” Dil mein yahi ek gham rehta hai…”
প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে হাত নেড়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে–কী?
নীরব এবার মুচকি হেসে একহাতে প্রত্যাশার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে। মুখটা অসহায় বানিয়ে,
-” Sath mere tu kom rehta hai..”
প্রত্যাশার মুখে হাসি ফোটে। চোখের ভাষায় বলে,
-” তাই নাকি?”
-” Chhod ke ab hi haaun…”
প্রত্যাশা বিনিময় মিষ্টি হাসল। চোখের ভাষা বলছে– আচ্ছা। বাতাসে বৃষ্টির ছাপটা এসে দু’জনের গায়ে পড়ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দু’জনকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। প্রত্যাশার ঠোঁটে বৃষ্টির জল জমে চিকচিক করছে। সেই চিকচিক আলোয় প্রতিফলিত হয় নীরবের চোখের আকুলতা। নীরব ঘোরলাগা দৃষ্টিতে প্রত্যাশার দিকে চেয়ে। ঠান্ডা বাতাসে প্রত্যাশার শরীর থেকে থেকেই কাঁপছে। বাড়ছে বুকের কম্পনও। নীরবের মুখটা এগিয়ে আসে। দু’জনের ঠোঁট ছুঁইছুঁই। প্রত্যাশা চোখ বুঁজে নেয়। ঠিক স্পর্শের আগ মুহূর্তে, আকাশে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে! তীব্র শব্দ হলো; প্রত্যাশা আঁতকে উঠল। ঠাস করে চোখ মেলে তাকায়। ধড়ফড় করে উঠে বসে। রুমময় নজর বুলিয়ে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে। জানালার বাইরে ঝুম বৃষ্টি, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, মেঘ গর্জে উঠছে। কয়েক মূহুর্ত পর ঠাহর করে এটা স্বপ্ন ছিলো। চোখেমুখে লজ্জার ছায়া ফুটে ওঠে। কপালে হাত রেখে ভাবল,
-” ও মাই আল্লাহ! এমন স্বপ্ন! তাও আবার এএসপি সাহেবকে নিয়ে। ইশশ! কী লজ্জা! কী লজ্জা!”
রাতে প্রিয় সিঙ্গার জুবিন নটিয়ালের এই গানের ভিডিও দেখতে দেখতে শুয়ে ছিলো প্রত্যাশা। আর স্বপ্নে কী না নিজেকে এএসপি সাহেবর সাথে দেখলো। তবে একটা আফসোস থেকে গেল—ইশশ গানটা সম্পূর্ণ হলো না।
একটা বালিশ কোলের উপর নিয়ে আয়েশ করে বসল প্রত্যাশা। সেদিনের কথা ভাবল– সেদিন তো হঠাৎ আব্বুর ডাকে এএসপি সাহেব নিরাপদ দূরত্বে সরে দাড়াল। তারপর বলল; মিষ্টি বিদায়টা পাওনা রইল। পরেরবার সুদসহ নিব।
আজ স্বপ্নের মধ্যেও মেঘের গর্জন ভিলেন হয়ে দাঁড়াল। এএসপি সাহেবের দেখছি পোড়া কপাল। না জানি এভাবে কতবার ব্যর্থ হওয়ার পর….সফল হন। নাকি ব্যাটার কপালে শনি আছে। প্রকৃতিও যে তার রোম্যান্সে বাগড়া দিলো। তাহার কপালে বউয়ের সোহাগ বুঝি নেই।
এইভেবে প্রত্যাশার ভীষণ হাসি পেল। একহাতে মুখ চেপে হাসল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ঘুম আসছিলো না। ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেঞ্জার গ্রুপে গেল। বন্ধুদের গ্রুপে একটা মেসেজ দিল,
-” জেগে আছিস কেউ?”
অনেকক্ষণ হওয়ার পরও মেসেজ delivered হলো না। প্রত্যাশা বিরক্ত হয়ে আবার লিখল,
-” সব কটা গুললায় গিয়েছে।” সাথে একটা অ্যাংরি ইমুজি দিয়ে এফবিতে ঘুরাঘুরি করছিলো। হঠাৎ মেসেজ নোটিফিকেশন এলো। প্রথম মেসেজে নাহিদের রিপ্লাই,
-” নাহ। ঘুমিয়ে আছি, মেরি বোন।”
প্রত্যাশাও সাথে সাথে লিখল,
-” তা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অনলাইনে কী করছিস মেরি ভাই? স্বপ্নে এদেশ ওদেশ পারি দিয়ে আয়।”
নাহিদ হা হা রিয়েকট দিয়ে, চটজলদি মেসেজ সেন্ট করল,
-” আমার আত্মা অনলাইনে, দেহটা চার্জে আছে! তাই আজ আর যেতে পারছি না। চার্জ ফুল হোক।”
প্রত্যাশা হা হা দিয়ে অনলাইন থেকে বেরিয়ে আসলো। হঠাৎ কিছু ভেবে কল লিস্টে গিয়ে উপরে থাকা নম্বরে কল দিলো। খুব বেশি সময় না হলেও, প্রতিদিন রাতে কথা হয় মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবলের সাথে। উনি নিজেই রাতে কল দেয়, ভালো-মন্দ টুকটাক কথা হয়। রিং হয়ে বেজেবেজে অবশেষে রিসিভ হলো। ঘুম জড়ানো স্বর এলো,
-” হ্যালো?”
প্রত্যাশা সাড়া দিলো না। নীরব কয়েক সেকেন্ড পর আবার বলল,
-” হ্যালো… প্রত্যাশা?”
প্রত্যাশা তবুও নিশ্চুপ। এবার এলো,
-” ফোন রেখে দিবো?”
প্রত্যাশা তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
-” এই না না…”
নীরব ঘুমঘুম কণ্ঠেই বলল,
-” হঠাৎ এত রাতে! ঘুমাওনি?”
-” ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম আসছিলো না। তা….”
-” ইটস্ ওকে। নো এক্সপ্লেইন।”
প্রত্যাশা ছোট করে শ্বাস ফেলল। আলতো স্বরে বলল,
-” শুনুন না?”
নীরবের কণ্ঠেও প্রশ্রয় প্রকাশ পেল,
-” হুম, শুনছি তো। বলো।”
-” জানেন….এই প্রথম আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলাম। তাও আবার রোমান্টিক স্বপ্ন।”
নীরবের মাঝে কোনো ভাবাবেগ, এক্সাইটেড প্রকাশ পেল না। ও স্বাভাবিক ভঙিতেই বলল,
-” তাই?”
-” হুম।”
ছোট করে জবাব দিয়ে। নড়েচড়ে বসল প্রত্যাশা। তারপর কণ্ঠে একটু আক্ষেপ মিশিয়ে বলল,
-” ইশশ্! জানেন কী হয়েছে? স্বপ্নটা না সম্পুর্ন দেখতে পারিনি। দেখছেন না আকাশে মেঘের কী তোড়জোড় শুরু হয়েছে। তীব্র মেঘের গর্জনে ঘুম ভেঙে গিয়েছে। রোমান্টিক স্বপ্নটা কমপ্লিট হওয়ার আগেই… যাহ দিল ঘুমটা ভেঙে।”
-” আবার ঘুমিয়ে পড়ো। অসম্পূর্ণ স্বপ্নটা সম্পূর্ণ করো।”
-” ধ্যাত! একবার ঘুম ভেঙে গেলে, পুনরায় আবার সেই স্বপ্ন দেখা যায় নাকি?”
-” যায় না?”
নীরবের প্রশ্নে প্রত্যাশা অল্প-স্বল্প রাগি স্বরে বলল,
-” এই এই আপনি আমার সাথে ফাজলামি করছেন নাকি? আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি, হু।”
নীরব নিঃশব্দে হাসল। বলল,
-” আচ্ছা রেগো না। আর ফাজলামি করবো না। তবে এখন কিন্তু মোটেই ফাজলামি করে নয়। একদম সিরিয়াসলি বলছি; তোমার রোমান্টিক ইনকমপ্লিট স্বপ্নটাকে কমপ্লিট করতে—আসবো কী?”
প্রত্যাশার মুখটা হা হয়ে যায়। দমকা হাওয়ায় জানালার পর্দা উড়ছে। বৃষ্টির পানি জানালার কাঁচ ছুঁয়ে দিচ্ছে অবিরাম। নীরব বিছানায় শুয়ে সেদিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলল,
-” ওয়েদারটা কিন্তু দারুণ রোমান্টিক আছে! ভেবে দ্যাখো।”
প্রত্যাশা গলায় কপট রাগ ঢেলে বলল,
-” আপনি তো দেখছি মশাই, মোটেই সভ্য পুরুষ নন।”
-” বউয়ের কাছে সভ্য হওয়া ঠিকও নয়।”
বর্ষায় ফোঁটা ফুলের মতোন কোমল লাজুক হাসল প্রত্যাশা। লজ্জায় লাল হওয়া থেকে রেহাই পেতে তড়িৎ বলল,
-” ঘুম পাচ্ছে রা….”
-” আমার ঘুম হারাম করে, এখন তোমার ঘুম পাচ্ছে।”
-” বাররে…আমি আবার আপনার ঘুমের কী করলাম?”
-” কিছুই করোনি?”
-” নাহ তো।”
-” আচ্ছা, তাহলে ঘুমিয়ে পড়। আর যদি স্বপ্নটাকে সম্পূর্ণ করতে চাও; তাহলে এখনো সময় আছে। বলো আসব নাকি?”
-” ধ্যাত তেরি!”
এতটুকু বলেই প্রত্যাশা কল কাটে। নীরব নিঃশব্দে হেসে চাদরটা গায়ে টেনে ঘুমিয়ে পড়ে।
___________
কয়েকদিন পর….
আজ তিন-চার দিন হবে নীলা এ বাড়িতে এসেছে। সময়টা এখন গোধূলি। সন্ধ্যা নামনাম ভাব। মাহবুব সাহেব উমরাহ হজ্জ করে গতকাল ফিরেছেন। ওখানে থাকতে প্রত্যাশার হাতের কথা শুনেছিলেন, তারপর নীলাও এখানে। বিকেলে হুট করে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে দেখতে এসেছেন।
অধরা ফোন হাতে মাঝে মাঝে প্রত্যাশার কাছে কল দিয়ে যাচ্ছে। ফোন বন্ধ বলছে। সন্ধ্যা নামছে, অথচ প্রত্যাশা প্রাইভেট থেকে এখনো ফেরেনি। এদিকে নীহারিকা বেগম আসার পর থেকে প্রত্যাশার কথা জিজ্ঞেস করছেন– রোজই এত দেরি হয় আসতে? এটাসেটা প্রশ্ন করছেন। অধরা কিছু বলে সামলে নিবে। তার আগেই নীলা– বন্ধুদের সাথে কোথায় ঘুরছে।
অধরা পড়েছে ফ্যাসাদে। সন্ধ্যার আগেই তো প্রত্যাশা চলে আসে। আজ এত দেরি হচ্ছে কেনো? এদিকে শ্বশুড়-শাশুড়ি এসেছেন। কী একটা জ্বা’লা। জ্বালা মানে বহুত জ্বা’লা। অধরা চিন্তায় চিন্তায় একশা হয়ে পড়ছে। অবশেষে বন্ধুদের নম্বরে কল দিলো।
.
.
সূর্যটা অস্ত যেতে থাকল। ছোট বড় যানবাহনের একপাশে প্রত্যাশার ছোট্ট স্কুটি। প্রাইভেট শেষে বন্ধুদের সাথে শহর থেকে অনেকটা দূরে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে ঘুরতে আসছিলো। হ্যাপি প্রাইভেট থেকেই বাসায় যায়। প্রত্যাশার সাথে কোয়েল ছিলো। রোহানের বাইকে নাহিদ। তারও হঠাৎ কাজ পড়তে, মাঝ রাস্তায় নেমে যায়। ওরা তিনজন আসলেও ফিরছে প্রত্যাশা একা। রোহানের সাথে কোয়েল আবার লং ড্রাইভে গিয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে যাবে দেখে প্রত্যাশা আর যায়নি। তবে কে জানত? ভাগ্য আজ অসহায় হবে। শহরে ঢোকার বিশ কিঃমিঃ দূরে যে ব্রীজ আছে, সেখানে ট্রাকের সাথে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটা বাসের সংঘর্ষ হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, একটা ছাত্র নাকি মা”রাও গিয়েছে। বেশ কয়েকজন গুরুতর আ’হত।
এই রোডে শতশত গাড়ি আটকে আছে। সামনে পু’লিশের ব্যারিকেড। পুলিশের ভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স, মানুষের ভিড়। সব মিলিয়ে এক অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। এদিকে প্রত্যাশা টেনশন করতে করতে অস্থির। ওর পাশে বাইকে দু’টো ছেলে বসে। ওর দিকে বাজে নজরে চেয়ে। একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে, আর ধোঁয়া উড়াচ্ছে।
ফোনটাও বের করতে নিয়ে হাত ফস্কে পড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। খোলার নাম নিচ্ছে না। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে, রাস্তা ক্লিয়ার হতে দেড় দুই ঘন্টা লাগবে। ঘটনা পরিদর্শনে স্বয়ং এমপি আসবে, পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ইতিমধ্যে আসছে। তবে এখান থেকে মূল জায়গাটা বেশ দূরে। সামনে অনেক গাড়ির ভিড়। প্রত্যাশা অনেক পিছে।
চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। চারিপাশের গাড়ির আলোয় জায়গাটা মৃদু আলোকিত। বাইকের ছেলে দুটোর তাকানো কুৎসিত। তারপর সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রত্যাশার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ও উঠে রাস্তার একপাশে যায়। চিন্তায় দরদরিয়ে ঘাম ছুটছে। জোরে জোরে শ্বাস নিল। সামনে তাকাতেই আঁতকে উঠল। বাইকের ছেলে দুটোও নেমে এসেছে। প্রত্যাশার গলা শুকে চৌচির। কোনো রকমে উপরে সাহস দেখিয়ে বলল,
-” এই আপনারা, এভাবে পিছু নিচ্ছেন কেনো? আর কী চাই? হ্যাঁ…”
লাল গেঞ্জি গায়ে অল্প বয়সী বখাটে ছেলেটা হাসতে হাসতে, অপর পাশের ছেলেটির গায়ের উপর পড়তে পড়তে ফের সোজা হয়ে বলল,
-” আরে ভাই মাইয়া দেহি ফিডার খায়। কিছুই বোঝেনা। ভাই উত্তরটা দিয়া দ্যান তো।”
গলায় চেইনসহ লকেট ঝুলানো, হাতে বালা পরিহিত ছেলেটি মুখের ভেতর থাকা সিগারেটের ধোঁয়া প্রত্যাশার মুখের উপর ছেড়ে বলল,
-” তোমাকে চাই ময়না। তোমাকে।”
ঠাস করে চ’ড় পড়ল ছেলেটির গালে। পাশের জন চমকে তাকাল। প্রত্যাশা চড় দিয়ে কলার চেপে ধরল। দাঁত খিচিয়ে বলল,
-” কুত্তা***”বাড়িতে মা বোন নেই। রাস্তায় মেয়ে দেখলেই কুকুরের মতো লালা ঝরে।”
আর কিছু বলতে পারল না প্রত্যাশা। তার আগেই পিছুন থেকে এসে ছাড়িয়ে, ওর হাত দু’টো মুচড়ে ধরল লাল গেঞ্জি পরিহিত ছেলেটি। প্রত্যাশা ব্যথায়–‘আহ’ বলে উঠল। থা”প্পড় খাওয়া ছেলেটি তেতে উঠল। একহাত নিজের গালে ডলল। পরপর বলল,
-” দাঁড়া তোরে তো…”
বলেই প্রত্যাশার কাঁধের উপর থাকা ওড়না একটানে ছুঁড়ে ফেলল। বাতাসে ওড়নাটা গিয়ে বেশ দূরে পড়ল। এগিয়ে বলল,
-” দাঁড়া, শা”___”
বি’শ্রী গালি দিয়ে প্রত্যাশার গাল চেপে ধরল একহাতে। প্রত্যাশা চিৎকার করতে পারছে না। প্রত্যাশার চোখে পানি টলমল করছে। ছেলেটি ওর দিকে এগিয়ে এলো লালসার দৃষ্টি নিয়ে। প্রত্যাশার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আচ্ছা এরা এখন ওর সাথে খা’রাপ কিছু করে মে*রে ফেলবে? নাকি কাল সকালে খবরের পাতায় ছাপা হবে; প্রত্যাশা নামের কিশোরীর ধ”র্ষণের নির্মম খবর। প্রত্যাশার ভেতরটা চিৎকার করে বলছে–ইয়া আল্লাহ! এর আগে আমার মৃ*ত্যু হলেও আমি খুশি হতাম। ইয়া রব! দয়া করো। সামনের ছেলেটা এগোতে থাকল। প্রত্যাশা চোখ বুঁজে নেয়। নিজেকে ছাড়াতে মুচড়ামুচড়ি করতে থাকে।
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |১৬|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
ঢিলেঢালা লাল টি-শার্ট পরা ছেলেটা শক্ত হাতে প্রত্যাশার কবজি মুচড়ে ধরে রেখেছে। প্রত্যাশার ছটফটানি দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-” ভাই, মাইয়াডা তো দেহি কুরবানির গরুর মতো ছটফটানি শুরু করছে! ধইরা রাখা কষ্ট হইতেছে। আশেপাশে গাড়িঘোড়া, লোকজন, সামনে ব্রিজের ওপর পু’লিশ ভ্যানও আছে। এখানে থাকা রিস্ক। তাড়াতাড়ি মুখ বাইন্ধা ফালান।”
গাল চেপে ধরে রাখা ছেলেটা বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে তড়িঘড়ি করে মুখ বাঁধতে লাগল। এক সেকেন্ডের জন্য মুখটা একটু ছেড়ে দিতেই প্রত্যাশা হাঁপাতে হাঁপাতে একটা শ্বাস নিতে চাইল। এতটা জোরে গাল দুটো চেপে ধরেছে যে, দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। কিন্তু শ্বাসটুকু নেওয়ার আগেই মুখটা শক্ত করে বাঁধা হয়ে গেল। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু টপটপ গাল গড়িয়ে পড়তে লাগল প্রত্যাশার। প্রতিটা ফোঁটা মেয়েটার অসহায়তার নীরব সাক্ষ্য হয়ে ঝরছিল।
স্কুটি থেকে নেমে একটু পাশে এসে দাঁড়ানো আরো বেশি বো’কামি ছিলো। কুৎসিত দৃষ্টি আর সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘৃ”ণা আর অস্বস্তিতে গা গুলিয়ে উঠেছিলো। মাথাভর্তি চিন্তায় একটু নিঃশ্বাস নিতে রাস্তার পাশে দাঁড়ায়। ভাবছিলো কীভাবে বাড়িতে জানাব! কে জানত, শকুনেরা ওঁত পেতেই ছিলো?
ছেলেদুটো প্রত্যাশাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল আরও দূরে। যেখানে আলো নেই, কোলাহল নেই, আছে কেবল বড় বড় গাছ আর অন্ধকারে ডুবে থাকা নির্জনতা। একটুখানি আশার যে আলো ছিল, তাও যেন এই অন্ধকারেই নিভে গেল। দপ করে।
____________
ড্রয়িংরুমে বসে থাকা প্রতিটি মুখেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। অধরা ফোনে প্রত্যাশার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করল। জানতে পারল প্রত্যাশা বন্ধুদের সঙ্গেই ঘুরতে গিয়েছিল। কিন্তু কোয়েল বিস্মিত হয়ে জানাল–প্রত্যাশা তো ওদের আগেই রওনা দিয়েছিল! অনেক আগেই তো বাসায় পৌঁছে যাওয়ার কথা।
এই খবরে সবাই আরও উদ্বিগ্ন হয়। শফিক সাহেব মেয়ের সব বন্ধুদের বাসায় ফোন করে খোঁজ নেন, কিন্তু কোথাও প্রত্যাশার সন্ধান মেলে না। আত্মীয়দের কাছেও খোঁজ নেওয়া হয়, সেখান থেকেও মেয়ে সম্পর্কে কোনো খবর পাওয়া যায় না। তবে শোনা গেল; ওই রাস্তায় এক্সি’ডেন্টের কারণে রাস্তা বন্ধ রয়েছে।
এরমধ্যে নিভান আসে। সন্ধ্যায় মা-বাবাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ওর। মাহবুব সাহেব চিন্তিত বদনে নিভানকে বললেন,
-” নিভান, নীরবের কাছে ফোন দাও।”
-” হ্যাঁ, বাবা।”
নীহারিকা বেগম গম্ভীর মুখে চুপ করে বসে আছেন। মনের ভেতরে ক্ষোভ, রাগ আর আফসোস একসাথে নাড়া দিচ্ছে। বেয়াই-বেয়াইনের উপর তার ক্ষোভ কম নয়। মেয়েকে দড়ি ছাড়া গরুর মতো ছেড়ে দিয়ে রেখেছেন। আগে থেকে লাগাম টেনে ধরেননি। উড়নচণ্ডী বানিয়েছেন। আজকের দিন যে আসারই ছিলো। এইজন্য! এইজন্য! কস্মিনকালেও ওই মেয়েকে বাড়ির বউ করতে চাননি। স্বামীকে কম তো বারণ করেননি। কিন্তু কী করার! কপালই খারাপ! তার আদরের পুত্র ছোট দু’জনের ক্ষেত্রেই এরকম হলো। যে মেয়েগুলোকে বউ করতে রাজি ছিলেন না। অথচ তাড়াই ছেলেদের বউ হলো। একজন তো নিজে পা’গল হয়েছিল। আবার এখানে অসুস্থ স্বামীর বিরুদ্ধে যেতে না পেরে রাজি হলেন। এখন টের পাচ্ছেন। রাজি না হলেই বুঝি ভালো হতো। নীরবের উপরও রাগ হচ্ছে। সেদিন বললেন। নীরব গায়ে মাখল না। ওইযে বললেন, অঘটন ঘটলে তখন মায়ের কথার দাম দিবি। সেই কথা যেনো অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে।
নিভান একটু বাইরে এসে কল দিলো। রিং হওয়ার দ্বিতীয় বারের মাথায় কল তুলল নীরব। নীরবের কথার আগেই হৈচৈ আর গাড়ির শব্দ আসতে থাকল। নিভান বলল,
-” হ্যালো, নীরব তুই কই?”
-” হ্-হ্য- হ্যা-লো…ভ-ভাই-য়া।”
কথাগুলো বেঁধে বেঁধে আসল। নিভান বলল,
-” নীরব, এদিকে তো সমস্যা হয়ে গিয়েছে।”
-” হ-হ্যা-লো , ভাইয়া আমি শুনতে পাচ্ছি না। একটু জোরে আর তাড়াতাড়ি বলো। আমি ব্যস্ত আছি।”
-” প্রত্যাশাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ও এখনো বাড়ি ফেরেনি। বন্ধুদের সাথে…..”
আশেপাশে ভিড়, গাড়ির হর্ন সব মিলিয়ে নীরব ঠিকঠাক বুঝতে পারছিলো না। প্রত্যাশা নামটা বুঝল। বাকি কথা স্পষ্ট শোনা গেল না। ডিউটির জন্য ওকে জরুরী এ’ক্সিডেন্ট স্পটে আসতে হয়েছে। বাসটা ক্যান্টনমেন্টের হওয়ায়, উপর মহল থেকেও বেশ চাপ আসছে। ঘটনাস্থলে দুই বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শনে এসেছে। অসুস্থদেরকে উদ্ধার করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
-” ভালো করে বলো, শুনতে পাচ্ছি না।”
বিপদের সময় সবদিক থেকেই যেন একেবারে আঁটঘাট বেঁধে বিপদ নামে। এমনি সময় নেটওয়ার্কে কোনো প্রব্লেম হয় না। কথা তেলতেলে চলে আসে। আর এখন জরুরী মূহুর্তে নেটওয়ার্কও নাটক শুরু করেছে। নীরব এদিকটায় নেমে আসল। একটু রাস্তার পাশে ফাঁকে দাঁড়াল–হ্যালো…হ্যালো করতেই ওপাশ থেকে নিভানের উচ্চস্বর আসল,
-” প্রত্যাশাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ধুদের… এখনো বাড়ি ফেরেনি।”
নীরব এক মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। জোড়াল শ্বাস ফেলে দৃষ্টি জোড়া নিচু করে, কিছু বলবে; তার আগেই পিচের রাস্তার ধারে, সবুজ ঘাসের উপর, ঠিক নিজ পায়ের সামনে দৃষ্টি পড়ল। হালকা আলোয় নীল রঙের ওড়নাটার একপাশ বাতাসে উড়াউড়ি করছে। ওড়নার পাশ দিয়ে থাকা সোনালী সুতোর কারুকাজ চিকচিক করছে। কেমন চেনাচেনা লাগছে। উবু হয়ে ত্রস্ত এক হাতে ওড়নাটা তুলল নীরব। মস্তিষ্ককে চাপ দিয়ে মনে করল। হ্যা সেইম এমন ওড়না প্রত্যাশার জন্য কেনা ড্রেসে ছিল। ওড়নাটা ঝকঝকে নতুন। নতুন জিনিস এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকার কথা নয়।
সেকেন্ডেই মন-মস্তিষ্ক অনেক কিছুই ভেবে নিল। ওপাশ থেকে নিভানের কথা আর একটাও কানে ঢুকছে না নীরবের। মস্তিষ্ক হ্যাং হয়ে আসছে। নিভান হ্যালো…হ্যালো করতে করতে ফোন কাটল।
প্রত্যাশার নম্বরে কল করে বন্ধ পেল। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে নীরবের। কপালের ঘাম মুছে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দ্রুত গুছিয়ে নিল নিজেকে। পরপর কাংখিত নম্বরে ডায়াল করল। রিসিভ হতেই বলল,
-” আমি এক্ষুনি একটা নম্বর সেন্ড করছি। জরুরি ভিত্তিতে লোকেশন ট্রেস করতে হবে। অবিলম্বে। সময় ন*ষ্ট করার সুযোগ নেই। টাইমলাইন, শেষ একটিভ স্পট, সবকিছু। আর হ্যাঁ, এটাকে অফিসিয়াল না, আমার পার্সোনাল হিসেবে ধরো। কিন্তু গুরুত্ব যেন অফিসিয়ালের চেয়েও বেশি হয়। খুব জরুরি।”
-” ওকে স্যার।”
.
.
-” বাবা, নীরব যেখানে আছে সম্ভবত সেখানে নেটওয়ার্কের খুব প্রবলেম। ট্রাই করলাম। ও বোধহয় ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি। আমি আবার ট্রাই করে দেখছি।”
নিভান বলল। শফিক সাহেব আর বসে না থেকে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়লেন। নিভান সবাইকে আশ্বস্ত করে বলল,
-” আমি বাবার সঙ্গে যাচ্ছি। চিন্তার কিছু নেই। প্রত্যাশাকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে। যেহেতু ওখানে এক্সি’ডেন্ট হয়েছে। গাড়ি সব আঁটকে আছে। প্রত্যাশা মেবি ওখানে আছে।”
নীহারিকা উদ্বেগমিশ্রিত আশঙ্কা নিয়ে বলে উঠলেন,
-” খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু সুস্থ অবস্থায় তো? এখন এমনিতেই দিনকাল ভালো নয়। তারপর রাত হয়ে গিয়েছে।”
নীহারিকা কিসের ইঙ্গিত দিলেন সবাই বুঝে নেয়। নিভান কথা না বাড়িয়ে শ্বশুরের সাথে বেরিয়ে গেল। নীহারিকা মুখ গম্ভীর করে নানান কিছু ভাবতে লাগলেন। আজ কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে, ওই মেয়েকে মেনে নিবেন না। আসলে মেয়েটা তার ছেলের যোগ্যই নয়। কোনদিক দিয়েই না। রাগে-ক্ষোভে নানান নেগেটিভ চিন্তা ভাবনাই আসছে মাথায়।
____________
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে যত এগোচ্ছে তত সবার চিন্তা বাড়ছে। রাত আটটা বাজতে চলছে। অধরা চোখে এক প্রস্থ জল নিয়ে দুই হাতে মুখ চেপে বসে। মেয়ের জন্য দোয়া করছেন। মনে হচ্ছে নিজেরও কিছু গাফিলতি আছে। ভালোবেসে বেশি স্বাধীনতা দিয়ে ফেলেছিল প্রত্যাশাকে। সেইজন্য আজ এমন দিন। না জানি মেয়েটা কোথায়? কোন হালে আছে? সন্ধ্যা পেরিয়েছে ঘন্টা খানেক আগে। দিন হলে তাও চিন্তা কম ছিলো। দিনেই যেখানে মেয়েরা সেভ নয়, এখন তো রাত নেমেছে। ভ’য়ে গা শিউরে উঠল অধরার।
এরমধ্যে ডোর বেলের শব্দ আসতেই ছুটে এলেন দরজা খুলতে। নীলা মায়ের পিছুপিছু এলো। এমনিতে প্রত্যাশাকে দেখতে না পারলেও, আজ কেনো জানি একটু হলেও মন খারাপ করছে। ওইযে, যখন কেউ থাকে না। তখন তার কথা মনেহয়।
দরজা খুলতেই দরজার সামনে নীরব দাঁড়িয়ে। অধরার আশার আলো মিইয়ে আসলো। ভেবেছিল সাথে মেয়েকে দেখবে। নীরবকে একা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে একসাথে প্রশ্ন করলেন,
-” নীরব তুমি একলা! প্রত্যাশা…. প্রত্যাশাকে খুঁজে পাওনি? তোমার শ্বশুর, নিভান গেল। ওরা পেয়েছে কী প্রত্যাশাকে?”
নীরব কিছু বলার আগেই অধরা ঘনঘন বলতে থাকে,
-” নীলা তোর আব্বুকে ফোন কর। শোন তো কতদূর? ওরা নিশ্চয় প্রত্যাশাকে খুঁজে পেয়েছে। প্রত্যাশা ওদের সাথেই ফিরছে। তাই না নীরব?”
নীরব জোড়াল শ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলল,
-” আন্টি… চিন্তার কিছু নেই। প্রত্যাশা… প্রত্যাশা আমার সাথেই আছে।”
এই বলে নীরব ডান পাশে একটু সরে দাঁড়াল; পিছনে নত মস্তকে প্রত্যাশা। চোখের পাতা ভার, ঠোঁট চেপে ধরে, শরীরটা গুটিয়ে আছে ভিতরের কোনো ভ”য়ে। পা দুটো একসাথে জড়ো করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। মাহবুব সাহেব আর নীহারিকা এসে দাঁড়িয়েছেন দরজার সামনে। নীহারিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রত্যাশার আপাদমস্তক দেখলেন। পরপর কণ্ঠে চাপা রাগ নিয়ে বললেন,
-” কোথায় ছিলে এতক্ষণ? তোমার কোনো আক্কেল নেই। ফোন বন্ধ করে কোথায় ছিলে, শুনি? আর সবাইকে না বলে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে চলে যাও। বাড়িতে চিন্তা করতে পারে, এতটুকু সেন্স নেই? রাত হয়ে যায় বাড়ি ফেরার নাম নেই?”
প্রত্যাশা মাথাটা নুইয়ে আছে। শাশুড়ির একেকটা কথায় বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সবটা শুনলে, সবাই তো আরো ব”কবে। নীহারিকা এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” নীরব তুই চুপ করে আছিস কেনো? কোত্থেকে আনলি? সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে অনেকক্ষণ। এতটা সময় ও কোথায় ছিলো?”
মাহবুব সাহেব বললেন,
-” আহ্! নিভানের মা থাম তো। মাত্র আসলো। ভেতরে এসে বসুক। বলবে ধীরেসুস্থে।”
অধরা চোয়াল শক্ত করে কঠিন স্বরে মেয়েকে প্রশ্ন করলেন,
-” প্রত্যাশা চুপ করে না থেকে বল। কোথায় ছিলি? কী হয়েছিল বল?”
নীরবের একবাক্যে উত্তপ্ত পরিবেশটা মূহুর্তেই ঠান্ডা হয়ে আসল। বিস্ময়ে সবাই ওর দিকে চাইল! নীরব বলল,
-” প্রত্যাশা আমার সাথে ছিলো।”
প্রত্যাশা সাথেসাথে মুখ তুলে নীরবের দিকে তাকায়। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। কান দু’টোকে অবিশ্বাস্য ঠেকছে। ভাবল–উনি মিথ্যে কেনো বলল। খানিক আগে উনি নিজেই তো কত কড়াকড়া কথা বলল। আর এখন আবার, সবার সামনে আমার জন্য মিথ্যে বলছে।
নীহারিকা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
-” তোর সাথে ছিলো মানে?”
নীরব মাথাটা নুইয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর সাবলীল গলায় বলল,
-” প্রত্যাশা বন্ধুদের সাথে ঘুরে ফেরার সময়, হঠাৎ আমার সাথে ওর দেখা হয়। সন্ধ্যা থেকে ও আমার সাথেই ছিলো।”
অধরা অবিশ্বাস্য বদনে চেয়ে অস্ফুটে বললেন,
-” তোমার সাথে ছিলো?”
নীরব জবাব দেওয়ার আগেই নীহারিকা বললেন,
-” ও তোর সাথে ছিলো! তা বাড়িতে ফোন দিয়ে জানায়নি কেনো? ওর ফোন না হয় বন্ধ বলছে। তোর ফোন দিয়ে কেনো জানায়নি?”
নীরব দু সেকেন্ড ভাবে, কী বলবে! মাহবুব সাহেব প্রশ্ন করলেন,
-” নিভান না তোমাকে ফোন দিলো?”
এরমধ্যে পিছন থেকে কয়েক জোড়া জুতোর মসমসে শব্দ আসলো। খানিকটা দূর থেকেই নিভান এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
-” বাবা তখন বললামই তো নীরবের ফোনে নেটওয়ার্কের প্রব্লেম হচ্ছে। কথা বোঝা যাচ্ছিল না।”
বসার রুমে সবাই বসে। চোখেমুখে স্বস্তির নিঃশ্বাস। তবে সবার প্রশ্নবানে বিদ্ধ নীরব। প্রত্যাশাকে পাওয়ার পর নীরব নিভানকে জানিয়ে দেয়। ওর সাথে প্রত্যাশা আছে। বাড়ি ফিরছে। নিভান আর শফিক সাহেব মাঝরাস্তা থেকে ব্যাক করে। নিভান ধারণা করে নেয়, নীরব যখন বলছে, কোনো না কোনো কারন আছে। আর মাকে তো ভালো করেই চেনে। তাই হয়তো! সেইজন্য নিভান পা রাখতেই নিজ থেকে নেটওয়ার্কের কথাটা বলল।
প্রত্যাশা রুমে ঢুকে দরজার পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। ড্রয়িংরুমের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। মাহবুব সাহেব বললেন,
-” নীরব, প্রত্যাশা না হয় ছোট, তুমি তো ছোট নও। ওর বুঝ কম। তুমি তো অবুঝ নও। তুমি যথেষ্ট বুঝদার। তবে তুমি হঠাৎ এরকম বো’কামি কী করে করলে? একবার ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলেই হতো। আমরা চিন্তা করতাম না। প্রত্যাশার বাবা-মা কতটা চিন্তা করছিলো তুমি বুঝতে পারছো? তোমার থেকে আমি এমনটা আশা করিনি।”
নীহারিকা ছেলের দিকে তেরছা চোখে চাইলেন। অতীষ্ঠ গলায় বললেন,
-” তুইও কী ওর সাথে থেকে ওর মতো হচ্ছিস। তোর কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। এক মিনিটের একটা কল দেওয়ার সময় তোদের হলো না। একটা কল দিয়ে জানিয়ে দিলেই হয়ে যায়। সবাই হয়রানি হয় না।”
অধরা বললেন,
-” আপা বাদ দিন না। নীরব ভেবেছিলো প্রত্যাশা হয়তো জানিয়েছে। প্রত্যাশাটা নিজেই তো বেখেয়াল।”
ভেতর থেকে সব কথাশুনে প্রত্যাশার নিজেকে আরো বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে। সবটা শুনলে আর কেউ না হলেও নীহারিকা অনেক কিছুই বলবে। এমনিতেই বাবা-মায়ের শিক্ষা নিয়ে আগেও বলেছেন। নীরব আজ সবটা নিজের গায়ে নিয়ে প্রত্যাশাসহ আব্বু-আম্মুর সম্মানও বাঁচিয়ে দিল।
” প্রত্যাশা আমার সাথে ছিলো” এই কথাটার ভার কত তা প্রত্যাশা টের পাচ্ছে। এই একটি কথার জন্য ওর সম্মানে, ওকে নিয়ে কোনো সন্দেহ হয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ পায়নি। যখন শুনতো, দু’টো বাজে ছেলের খপ্পরে পড়েছিল; তখন নিশ্চয় চিন্তা হতো– প্রত্যাশাকে বাজেভাবে ছুঁয়েছে। ওরকমটা না হলেও, কেউকেউ ভেবে নিতো, অনেক কিছুই হয়েছে। কিন্তু নীরবের একটা বাক্যে, কেউ সেই সুযোগটা পায়নি। নীরব দেয়নি। চায়নি অন্যের কাছে প্রত্যাশা এতটুকু ছোট হোক। নীরবের প্রতি প্রত্যাশার সম্মান শ্রদ্ধা হাজারগুণ বেড়ে যায়। প্রত্যাশা চোখদুটো বুজতেই ঝরঝরিয়ে পানি পড়ল। চোখের সামনে ভেসে উঠল; সেই দৃশ্য। আর সাথে সাথে গায়ে কাঁ*টা দিয়ে উঠল।
.
টেনেহিঁচড়ে অন্ধকারে নেওয়ার সময় লাল টিশার্ট পড়া ছেলেটি প্রাকৃতিক ডাকে সারা দিতে একপাশে যায়। প্রত্যাশার হাত দু’টো অন্যজন ধরে। ডেকে বলল,
-” এই তাড়াতাড়ি কর বেডা। কাজের সময় তোর হাগা-মুতা চাপে।”
প্যান্টের জিপার তুলতে তুলতে বলল,
-” আইছি, ভাইজান আইছি।”
ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়াল। বলল,
-” ভাই বাংলা মা’ল আছে তো?”
-” সব আছে। তয় আজ বাংলা মা’ল না। অত গুলান চকচকে নোট পাইলাম। তাই দিয়া বিদেশি মা’ল খাবো।সাথে এই চিকনা-চিকনি ময়না। আহা…”
-” ভাই তাড়াতাড়ি চলেন। এই মাইয়া হাত ছাড়া হলে, সব দিক দিয়াই লস। বাকি টাকা পাব নানে। কয়দিন ধরে সুযোগ খুঁজতে খুঁজতে পাখিরে ধরছি। আমাগো খাঁচায় বন্দী। এহন তো মজাই মজা।”
প্রত্যাশা স্তব্ধ হয়। মনের ভেতর প্রশ্ন চলছে একের পর এক। প্রত্যাশা চোখ বুঁজে বাঁচার জন্য বুদ্ধি খোঁজে। নিজেকে রক্ষার শেষ চেষ্টা আর ঘৃ’ণা এক করে দাঁতে দাঁত চাপল; সামনেরটার মেইন পয়েন্ট বরাবর গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে লা’থি দেয়। সারা জীবনের সুড়সুড়ি শেষ করবে। এতটা রাগ নিয়ে লাথি মা”রে। সামনের ছেলে দু’কদম পিছিয়ে যায়। ব্যথায় কুকিয়ে ওঠে। পিছনের জন হকচকাল। পায়ের তলায় বালু। প্রত্যাশা এবার খিচে চোখ বন্ধ করে। নিজের মাথা একপাশে নুইয়ে নিল। বালুর মাঝে পা ডুবিয়ে দেয়। তারপর পায়ের উপর বালু তুলে পিছন দিকে মা’রে। পিছনের জনের এক চোখে কিছু বালু ঢোকে। ছেলেটা প্রত্যাশার হাত ছেড়ে চোখ ডলতে থাকে। প্রত্যাশা এক মূহুর্ত দেরি না করে দৌড় লাগায়। রাস্তার দিকে। ওইযে আলো দেখা যাচ্ছে, সেদিকে।
চোখের বালু ঢলতে ঢলতে ছেলেটাও পিছু নিলো। আরেকজন ব্যথা নিয়েই পিছুপিছু ছুটছে। এই মেয়ে গেলে খবর আছে। অতগুলো টাকা হাত ছাড়া হবে। টাকা দিয়ে ব্যথা সারানো যাবে। তবুও এই মেয়েকে ছাড়া যাবে না।
প্রত্যাশা ছুটছে… হঠাৎ সামনে থাকা শুকনো ভাঙা ডালে উষ্টা খায় প্রত্যাশা। টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পরে বালুর উপর। ছেলে দু’টো ওইতো দৌড়ে আসছে। প্রত্যাশার ঘাম ছুটছে কপাল, মুখ বেয়ে। তবুও ক্লান্ত শরীর নিয়ে উঠার চেষ্টা করে। উঠার শক্তি এক চুল নেই শরীরে। হাঁপাতে হাঁপাতে একহাতে টেনে মুখের কাপড় সরিয়ে ফেলে। চিৎকার করে,
-” ক-কেউ আছেন?”
গলা দিয়ে কথাও যেন বেরোচ্ছে না। এরমধ্যে ছেলে দুইটা সামনে চলে এসেছে। ইশশ্! মনে হচ্ছে; বাঁচার একটা সুযোগ পেয়েও হারিয়ে ফেলল। এবার হতাশ প্রত্যাশা একদম ভেঙে পরল। ছেলে দু’টো সামনে দাঁড়িয়ে গা’লি দিয়ে বি’শ্রী হাসল। পরপর প্রত্যাশার দিকে উবু হয় গাল চেপে ধরল। বলল,
-” আরে “”” তোর সাহস তো কম না।”
প্রত্যাশার ঠোঁটের দিকে নজর যায়। সেদিকে এগোতে এগোতে বলে,
-” ভাবছিলাম, ধীরেসুস্থ ভোগ করব। এতো সেই সুযোগই দিতাছেই না। এখানেই শুরু করি।”
এই বলে মুখ এগিয়ে আনতে থাকে। ঠিক এমন সময় কারো লা”থিতে সামনের ছেলেটি ছিটকে দূরে সরে পরে। বুট পায়ে লা:থিটা গাল বরাবর পড়ল। ফিনকি দিয়ে র”ক্ত গড়িয়ে পরতে থাকল। প্রত্যাশা পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবে, তার আগেই একটা হাত ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো। প্রত্যাশা মুখ দেখেনি, তারপরও আগন্তুককে ওর জন্য সাহায্যকারী হিসেবে ধরে নিয়ে কাঁপাকাঁপা হাতটা রাখল; রুক্ষ, শক্ত হাতে। আগন্তুক শক্ত করে হাত ধরল। একটানে প্রত্যাশাকে তুলল। প্রত্যাশা দাঁড়িয়ে থমকে যায়। ও কিছুই বলতে পারে না। আচমকা বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল। দুই হাতে পিঠের কাছের আয়রণ রঙা ইউনিফর্মটা শক্ত করে ধরে রেখেছে প্রত্যাশা।
উফ্! প্রশস্ত বুকটা নিজের জন্য সেফ মনে হচ্ছে। এতক্ষণে একটু শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে। প্রত্যাশা আঁকড়ে ধরে ব্যক্তিগত মানুষটিকে। এটাই মনে হচ্ছে ওর জন্য একমাত্র নিরাপদ, শান্তির আশ্রয় স্থল।
নীরব নিজের থেকে প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর বাম হাতে থাকা ওড়নাটা প্রত্যাশার গায়ে জড়িয়ে দিল।একজন তো এক লা’থিতেই মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আরেকটা পালিয়ে যাচ্ছিল। নীরব পা দিয়ে ভাঙা ডালটা তুলল, হাতে এসে পড়ল। তারপর ছুঁ’ড়ে দিতেই, লাঠিটা গিয়ে ছেলেটির ঘাড়ের দিকে বা’রি লাগতেই অমনি ছেলেটি মাটিতে পরে গেল ।
ছেলে দুটোর মুখ বরাবর একের পর এক ঘু*ষি দেয়। তারপর দু’টোর মাথা ধরে একসাথে বারি দিল। কপাল গড়িয়ে র”ক্ত পড়ছে। দু’টো মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। আর আর্তনাদ করতে থাকল। নীরবের রাগ কমেনি, দুইজনের হাতের উপর বুট পায়ে চেপে ধরে রাখে। এইহাত দিয়ে প্রত্যাশার গাল চেপে ধরছিলো না, ইচ্ছে করছে এই হাত কে”টে ফেলতে।
প্রত্যাশার গা থরথরিয়ে কাঁপছে। এরমধ্যে তানভীর আসতেই নীরব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
-” ব্লা”ডি বিচ দুটোকে নিয়ে যাও। কী কেস দিবে, আমি বলে দিবো।”
ওকে স্যার বলে তানভীর দায়িত্ব পালন করে। আড়চোখে একবার প্রত্যাশার দিকে চাইল। মেয়েটি কে? স্যারের পরিচিত? জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না।
ফোনে লোকেশন ট্রেস করার কথা বলে, আরেকটু নিচে নামতেই হঠাৎ দূরে কাউকে দৌড়তে দেখা যায়, পিছুনে আরো কেউ। এই দেখে নীরব তানভীরকে মেসেজ দিয়ে এগিয়ে আসে। তারপর যা দেখল… মাথায় খু*ন চেপে যায়। নিজে হাতে দু’টোকে খু*ন করতে ইচ্ছে করছে।
.
.
প্রত্যাশার সামনে দাঁড়াল নীরব। মুখটা খুব ঠান্ডা। প্রত্যাশা কম্পিত পল্লব তুলে তাকাল। প্রত্যাশার মাথার পিছে হাত দিয়ে বাঁধা রোমাল খুলে দিল নীরব। প্রত্যাশার বুকটা এখনো কাঁপছে। এক দন্ড স্বস্তি পেতে সামনের মানুষটার বুকে মুখ গুজতে ইচ্ছে করছে। যেটুকু ভ’য়, দুরুদুরু কম্পন আছে, সব ওই বুকে মাথা রেখে উবে দিতে মনটা খুব করে চাইছে। প্রত্যাশা অসহায় মুখ করে অস্ফুটে বলল,
-” নীরব..নীরব আপনি না__”
আর বলতে পারল না। প্রত্যাশার গলার স্বর ভারী হয়ে আসল। কাঁদতে কাঁদতে নীরবের দিকে আরেক পা এগোল। নীরব শান্ত চোখে চেয়ে তৎক্ষণাৎ একহাত সামনে ধরে বজ্র কণ্ঠে বলল,
-” স্টপ।”
এক শব্দেই প্রত্যাশার পুরো দুনিয়া যেন থেমে গেল। নীরব দুই আঙুলে কপাল স্লাইড করে রাগটা কমানোর চেষ্টা করল।
#চলবে