#মধ্য_রাতের_চাঁদ |১৯|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
ঘরটা আধো অন্ধকার। ম্লান আলোয় ঘুমন্ত নীবিড়ের মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। বেডে নিঃসাড় পড়ে আছে দেহটা। ইনজেকশনে দেওয়া ঘুম। জীবনের সাথে কৃত্রিম একটা শান্তি।
ডক্টর খানের সাথে নীরব কেবিনে। ফোনকলের পর যেরকম ছিলো, সেরকমই ছুটে আসে। ত্রস্ত ওয়ালেটটা ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে, ফোন আর বাইকের চাবি নিয়ে– ‘ইমার্জেন্সি বেরোতে হবে’ বলে চলে আসে। ভেবেছিল–নীবিড়ের পা’গ’লামী বেড়েছে, সামলাতে পারছে না; তাই হয়তো ডাকছে। এর আগেও একদিন মাঝরাতে আসতে হয়েছিল। তবে এবারের সিচুয়েশন আলাদা।
ডক্টর খান মৃদুস্বরে বললেন,
-” মিস্টার নীরব, আপনার ভাইয়ের কন্ডিশন খুব একটা ভালো নয়। কিছুক্ষণ আগেই হঠাৎ করে পেশেন্টের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। চটজলদি অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেওয়া হয়। পেশেন্ট Prolonged Pulmonary Toxicity এ আক্রান্ত। যা অতিরিক্ত ড্রা’গ গ্রহণের ফলে হয়েছে।”
দুইহাত ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে মাথাটা নুইয়ে দাঁড়িয়ে নীরব। কথাগুলো শোনার সাথেসাথে বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোল। ডক্টর এক মূহুর্ত থেমে নীরবের দিকে তাকিয়ে ফের বলেন,
-” আমি বুঝি এটা বলা সহজ না। তারপর এ কদিনে পেশেন্টের অবস্থা, রিপোর্ট সব দেখে মনে হচ্ছে; পেশেন্টকে খাবারের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে কোনো সাইকোঅ্যাক্টিভ সাবস্ট্যান্স দেওয়া হতো।”
নীরব তৎক্ষণাৎ মাথাটা তুলে প্রশ্নাতুর চোখে তাকাল। ঝট করে বলে উঠল,
-” ড্রা’গ?”
-” হ্যাঁ। সম্ভবত মেথামফেটামিন বা এর কোন সিস্টেমেটিক ডেরিভেটিভ। তার মেটাবোলিক রিডিং, নিউরোটক্সিন লেভেল; সবই ইঙ্গিত করে সেদিকেই। প্রথমে পেশেন্ট হয়তো বুঝতে পারেনি। কিন্তু আ’স’ক্তি গড়ে ওঠে খুব দ্রুত। এরপর শরীর নিজে থেকেই চাহিদা তৈরি করতে থাকে। এবং সে নিজে থেকেই ড্রাগ খুঁজতে শুরু করে।”
নীরব চোখদুটো বুঁজে নিল। পরপর দপ করে তাকাল, চোখদুটো রাগে লাল হয়ে উঠেছে। চোয়াল শক্ত করে বলল,
-” আমি ওকে ভালো করে চিনি। ও কখনো…কখনো এসব কিছু ছুঁয়ে দেখারও মানুষ ছিলো না। হঠাৎ ওর পরিবর্তনের খবর শুনে, আমার এরকম কিছুই মনে হয়েছিল।”
ডক্টর নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
-” তাই তো বলছি, এটা পিয়োর ম্যানিপুলেশন। ইনডাকটিভ সাবস্ট্যান্স-ড্রিভেন অ্যাডিকশন; আমরা এরকম কেস মাঝে মাঝে দেখি, কিন্তু নীবিড়ের মতো মস্তিষ্কে ড্যামেজসহ কেস খুব বিরল। সিম্পটম গুলা খুব ক্লাসিক। Substance-Induced Psychotic Disorder-এর মধ্যে আছে নীবিড়।”
নীরবের গলাটা একটু কাঁপল বোধহয়,
-” ম-মানে….ও আর আগের মত হবে না?”
ডক্টর কিছু মূহুর্ত চুপ থাকল। তারপর বলেন,
-” পেশেন্টের পার্মানেন্ট নিউরোনাল ড্যামেজ হয়ে গেছে। ব্রেনের কিছু অংশ যেগুলা; ইমোশন, ডিসিশন, রিয়ালিটি সেন্স ধরে রাখে, সেগুলা আর ঠিকভাবে রেসপন্স করছে না। ওর আগের মতো হওয়ার চান্স…..”
কয়েক সেকেন্ড থম মে”রে থেকে এক নিঃশ্বাসে বললেন,
-” ওর আগের মতো হওয়ার চান্স…..প্রায় নেই।”
নীরবের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল। চোখের কোণ ভিজে গেল। ডক্টর আশ্বাসের সুরে বললেন,
-” তবে হ্যাঁ, আমরা নিউরোলজিক্যাল স্ট্যাবিলাইজেশন থেরাপি দিয়ে চেষ্টা করছি কিছুটা রিগেইন করানোর। বাকি সবটা উপরওয়ালার ইচ্ছে।”
[তথ্য সংগৃহীত]
শেষের ‘ইচ্ছে’ শব্দটা যেন লহমায় বাচ্চা মেয়েটার কথা মনে করিয়ে দিল। পাপা বলতে পা’গল মেয়েটা তার পাপাকে কী সত্যিই ফিরে পাবে না? তার পাপার আদর পাবে না? নীরব তো চেয়েছিল–তার পাপাকে আগের মতো সুস্থ, আগের মতো তাকে আদরে রাখতে, তার কাছে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু ভাগ্যে না থাকলে, কী করার!
নীরবের কণ্ঠনালীতে সব কথা আঁটকে গেছে। ও কিছুই বলতে পারল না। ধীরেধীরে এগিয়ে যায় ভাইয়ের মাথার কাছে। হাত ছুঁয়ে দেয় কপালে। নীবিড় ঘুমোচ্ছে, মুখে অদ্ভুত এক নিরীহ, নিষ্পাপ শিশু সুলভ ভাব। অযত্নে মাথার চুল, দাঁড়ি গোঁফ বড়বড় হয়ে গিয়েছে। চুলগুলো কেমন জটলা পেকে আছে। নীরবের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল। ভেতরটা নীল বেদনায় মুষড়ে উঠছে।
আজ প্রীতির উপর যতটুকু ক্রোধ হচ্ছে ততটা রাগ-ক্ষোভ নিজের বাবা-মায়ের উপরও হচ্ছে। ভেতরে একের পর এক প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। যার উত্তর সঠিক মিলাতে পারছে না। মা যদি বিয়েটা মেনে নিতো, তাহলে হয়তো আজ এদিন আসতো না। মায়ের সমস্যাটা কী ছিলো? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগে, প্রেম করে বিয়ে করে না কেউ? অনেকে করে। তাই বলে মেনে নিবে না। প্রীতিকে নিয়ে সমস্যা? মায়ের প্রীতিকে নিয়ে কী এমন সমস্যা? আর বাবা, বাবা কেনো মায়ের এই ব্যাপারে বিরুদ্ধে গেলেন না। বাবা তো যথেষ্ট বুঝদার , একজন সৎ মানুষ। মায়ের ছেলেমানুষীকে কেনো চুপ থেকে সম্মতি দিলেন? আজকেই বাবা-মায়ের সাথে এ নিয়ে কথা বলবে বলে স্থির করে নীরব।
প্রীতি…. প্রীতি….প্রীতি….এই নামটা ভুল করে মনে উঠলেও তীব্র ঘৃ”ণা হচ্ছে। নীবিড়ের এই অবস্থার জন্য যদি প্রীতি দায়ী হয়! তবে প্রীতির উদ্দেশ্যটা কী? প্রেম….লাভ ম্যারেজ….এসব কিছু লোক দেখানো। বিয়ের পর পাঁচটা বছর তো দু’জনের ভালোই কেটেছে।
মায়ের মুখে শুনেছে, নীবিড় মিনিট দুয়েকের বড় নীরবের। তবে জমজ হওয়ায়, দু’জনের ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক ছিলো। বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ না হলেও, নীরবের সাথে ফোনে কথা হতো। কখনো তো ওদের দাম্পত্য কলহের কোনো কথা বলেনি। যতটুকু শুনেছে, ভালোটাই। তারপর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়া দু’জনের ছবি, দেখে তো হ্যাপি কাপলই মনে হতো। তবে আমরা যা ব্যহ্যিক দেখি, আর শুনি….. সেটা বেশি ক্ষেত্রেই থাকে শো অফ। প্রত্যেকের ভেতরের খবর শুধু তারাই জানে। আপাত দৃষ্টিতে অমুককে দেখে মনেহয়, কত সুখি! কতই না তাদের শান্তি!
আমরা বলেও ফেলি; আহা! ওর মতো যদি আমার লাইফটা হতো। আবার দেখা যায়, সেইম লোকও ওরকম আফসোস করে বলে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গা থেকে কোনো না কোনো অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতায় ভোগে। যে মানিয়ে নেয়, সেই প্রকৃত সুখি।
___________
নীরব ভোর রাতে ফেরে। এক্সট্রা চাবি দিয়ে লক খুলে ভেতরে ঢোকে। ফ্রেশ হয়ে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ধপ করে বিছানার একপাশে বসে নীরব। চোখ যায় এলোমেলো, জুবুথুবু হয়ে ঘুমিয়ে থাকা প্রত্যাশার দিকে। হাত দু’টো গলার সাথে চেপে জড়সড় হয়ে শুয়ে। ভোর রাতের দিকে আবহাওয়া একটু ঠান্ডা ঠান্ডাই থাকে। প্রত্যাশার শীত করছে বুঝতে পেরে নীরব চাদরটা ছাড়িয়ে টেনে দেয় প্রত্যাশার গলা অবধি। পরপর শুয়ে কপালের উপর ডান হাতটা ভাঁজ করে রেখে নানান চিন্তা-ভাবনা করতে করতে এক পর্যায়ে চোখ লেগে যায় নীরবের।
.
.
প্রত্যাশা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এলোমেলো চুল পরিপাটি করতে থাকে। ভেতরে কৌতুহল হচ্ছে, রাতে কী এমন ইমার্জেন্সি কল আসল? কোথায় গিয়েছিল? তবে ঘুমন্ত মানুষকে তুলে এসব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না। নীরব কখন ফিরেছে প্রত্যাশা জানে না। যে ঘুম ওর; ভাবে তাড়াতাড়িই ফিরেছে হয়তো। ও তো চোখ বোজার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পরে। ঘুমের মধ্যে চু’রি করে নিয়ে গেলেও টের পাবে না।
হঠাৎ আয়নার মধ্যে গলার বা পাশে লালচে একটা দাগ নজরে এল। আপনাআপনি প্রত্যাশার আঙুল ছুঁয়ে গেল দাগটায়। সাথে সাথে শিরশির করে উঠল সমস্ত কায়া। রাতের ওই মূহুর্তটুকু জ্বলজ্বল করে উঠল চোখের তারায়। লজ্জায় রাঙা হলো মুখখানা। আড়চোখে বিছানায় ঘুমন্ত নীরবকে দেখল প্রত্যাশা; ঘুমন্ত ফেসটা ইন্নোসেন্ট দেখাচ্ছে। প্রত্যাশা ভাবল– তবে জাগ্রত মানুষটা প্রত্যাশার কাছাকাছি থাকলে মোটেই ইন্নোসেন্ট নয়।
প্রত্যাশা ফেস পাউডারের কৌটা হাতে নিয়ে, দাগটা আড়াল করতে সামান্য পাউডার লাগিয়ে রাখল। চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকাতে গিয়ে, মাথাটা বাঁকা করে পিছনে কিঞ্চিৎ ঘুরাতেই গলার পেছনের দিকে থাকা জন্ম দাগটা নজরে আসল। ক্লিপটা চুলে গেঁথে বিড়বিড় করল,
-” ওয়াও! প্রত্যাশা…. ওয়াও! শরীরে তো দাগের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দু’টো জন্ম দাগ ছিলো। এখন আবার অন্য দাগ পড়া শুরু হলো।”
প্রত্যাশার ডান বাহুতে, কনুইয়ের থেকে একটু নিচে, নজরে পড়ার মতো জন্ম দাগ আছে। প্রত্যাশা তো মাঝেসাঝে বলত– তোমাদের মেয়ে যদি ছোটবেলায় হারিয়ে যেতো না, এই দাগগুলো দেখে খুঁজে পেতে। ঠিক বলেছি না আম্মু? অধরা উত্তর না দিয়ে, শুধু চোখ রাঙিয়ে চাইত।
.
শফিক সাহেবের অফিস থাকায় যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছেন। প্রত্যাশা বাবার সাথে হালকা কিছু মুখে দেয়। নীরব ঘুম থেকে জাগেনি। প্রত্যাশা ত্রস্ত রেডি হয়ে রুম থেকে বেরোনোর আগে বিছানার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মনেমনে বলল,
-” মহাশয়, সারারাত চো’রের পিছুপিছু দৌড়ে এখন পড়েপড়ে ঘুমুচ্ছেন। আর অন্যরা হয়তো ভেবে বসবে, না জানি কতকিছু! বউকে পেয়ে সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়ে, এখন বেলা করে ঘুমুচ্ছে।”
নীরবকে জাগালো না প্রত্যাশা। ঘুমিয়ে আছে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। নীরবের দিকে তাকালেই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। ঠোঁটে, গলায় এখনো মনে হচ্ছে স্পর্শটুকু লেগে আছে। সামনাসামনি কথা বলতে অস্বস্তি হবে। এইভেবে আর ডাকল না। আর পুলিশ মানুষ; সিভিলে, তারপর ছদ্মবেশে যেকোন সময় বাইরে যেয়েই থাকে। দরকারি কেসের প্রমাণ-ট্রমান যোগাড় করতে। তাই প্রত্যাশা আর অতশত মাথা ঘামাল না। অফিশিয়াল কাজে গিয়েছিল ভেবে নেয়।
____________
-” তোদের দু’জনের কী হয়েছে?”
এক হাতে ফোন, আরেক হাতে কফির মগ। চুমুক দিতে গিয়ে মায়ের কথায় এক মুহূর্ত থেমে যায় প্রীতি। উত্তর না দিয়ে ধীরে সুস্থে কফিতে চুমুক দেয়। তানিয়া আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
-” প্রীতি, আমি আজ ক’দিন লক্ষ্য করছি; তোরা দুইভাই বোন কথা বলছিস না। কী হয়েছে কী তোদের আবার? নিজেদের মধ্যে শুধু শুধু কী নিয়ে ঝামেলা বাধালি?”
-” আমি কোনো ঝামেলা বাঁধাইনি। তাই প্রশ্নটা আমাকে না করে তোমার ছেলেকে করো।”
তানিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এমন সময় কাঁকনের মতো ঝনঝন শব্দ হলো। ইচ্ছে ছুটে এলো নুপুরের টুংটাং শব্দ নিয়ে। ছোট ছোট পায়ে ছুটে এসে আনন্দে লাফিয়ে বলল,
-” মাম্মা! মাম্মা কেমন লাগছে? প্রিটি?”
পরনে স্কুল ড্রেস, চুলগুলো ছোট্ট রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। পায়ে নতুন নুপুরজোড়া। যার রিনরিনে শব্দ খুশির ঘণ্টাধ্বনি হয়ে বাজছিলো। পা দুটো সামনে বার করে ইচ্ছে দুলতে দুলতে দাঁড়ায়। প্রীতি না তাকিয়েই বলল,
-” হুম। ভালো লাগছে।”
ইচ্ছে তানিয়াকেও জিজ্ঞেস করে। তারপর আচমকা ইচ্ছে বলে উঠল,
-” জানো নানু, পাপা বলেছে…পাপা বলেছে আমাকে পাপার বাসায় নিয়ে যাবে। যেখানে পাপা থাকে, পাপার পাপা, পাপার মাম্মা….আরোওও অনেকে থাকে।”
দুইহাত ছাড়িয়ে চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে বলে ইচ্ছে। দম ফেলে আহ্লাদী স্বরে বলতে থাকে,
-” ওখানের সবাই আমাকে আদর করবে, আমার সাথে খেলবে। আমার আর মন খারাপ করবে না, পাপাকে মিস লাগবে না। সব্বাই থাকবে।”
তানিয়া একহাতে ইচ্ছের গাল ছুঁয়ে দিলেন। বললেন,
-” তুমি যেতে চাও দাদুর বাসায়?”
ইচ্ছে মুখে টলটলে হাসি মেখে ঘাড় কাত করে বলল,
-” আমি পাপার কাছে থাকতে চাই।”
তানিয়া জিজ্ঞেস করলেন,
-” এখান থেকে চলে গেলে নানুকে ভুলে যাবে কী? মনে রাখবে কী নানুকে?…..বেইমান, বিশ্বাসঘাতক বংশের র*ক্ত তোমার শরীরে। ভুললেও অবাক হবো না।”
শেষের কথা দুটো মনেমনে বললেন। প্রীতি কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে মনাকে ডেকে বলল,
-” স্কুলের সময় হয়ে গেছে। ড্রাইভার নিচে আছে। ইচ্ছেকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসো।”
ইচ্ছে মায়ের কাছে এসে গালে চট করে চুমু খেয়ে হাত নাড়িয়ে বলে,
-” বাই মাম্মা।”
হাতটা নাড়াতে গিয়ে প্রীতির বাহুতে ধা’ক্কা লেগে প্রীতির হাত খসে ফোনটা নিচে পড়ে যায়। মাম্মা ব’ক’বে এইভেবে ইচ্ছে ভ’য় পেল। মুখটা শুকনো করে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
-” স্যয়ি মাম্মা… তোমার নতুন ফোনটা পড়ে গেল। এটাও ভেঙে গেল। তোমায় আবার নতুন ফোন…..
প্রীতি কথার মাঝেই বলল,
-” ঠিক আছে। তুমি স্কুলে যাও।”
মাম্মা ব’কেনি জন্য ইচ্ছের আনন্দ হলো। প্রীতি ফোনটা ফ্লোর থেকে তুলল। গ্লাস ফাটার আশংকা করেছিল তবে দেখল ফাটেনি।
.
কিছুক্ষণ পর….
প্রীতি অফিস যাওয়ার জন্য বেরোবে। হঠাৎ নীরবকে দেখে থমকে গেল। এই সময় নীরবের উপস্থিতিতে অবাক হলো! ড্রয়িংরুমে নীরব মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বিস্মিত প্রীতি জিজ্ঞেস করল,
-” এই সময় হঠাৎ? না কোনো ফোন, না কোনো বার্তা… কী ব্যাপার?”,
ভেতরের ক্রোধ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল নীরব। শক্ত গলায় বলল,
-” তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে এসেছি। আশা করছি এবার সত্যিটা বলবে।”
প্রীতির মুখে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেল। সেই হাসিতে নীরবের গায়ে কাঁ’টা দিল। ওর আঙুল মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠল রাগে। প্রীতি কণ্ঠে ব্যঙ্গ মিশিয়ে বলল,
-” দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বসো না। চা নাকি কফি? কিছু খেতে খেতে শুনি তোমার অভিযোগপত্র।”
নীরব ঠান্ডা স্বরে বলল,
-” আমি তোমার সাথে গল্প করতে আসিনি।”
-” সেটা আমি জানি। তাহলে তোমার কথা তাড়াতাড়ি বলো। অহেতুক সময় ন’ষ্ট করছো।”
নীরব সরাসরি বলল,
-” নীবিড় নিজের ইচ্ছায় ড্রাগে আ’স’ক্ত হয়নি। ওকে আ’স’ক্ত করা হয়েছে। ওর খাবারের ভেতর দিয়ে। তুমি কেনো এসব করলে? তোমার উদ্দেশ্য কী?”
নীরবের কপালের রগ ফেঁপে উঠেছে। ফর্সা মুখ রাগে লাল, চোখদুটো আ’গুন ছড়াচ্ছে। প্রীতি হেসে উঠল। মনে হলো শুনেছে কোনো রসিকতা। গা দুলিয়ে হেসে বলল,
-” ওয়াও! নাইস জোকস্!”
-” সাট আপ।”
নীরবের বজ্র গলার ধমক ঘরের প্রতিটি কোণে প্রতিধ্বনিত হলো। মুহূর্তেই স্তব্ধতা। প্রীতির মুখে রাগ। চোয়াল শক্ত করে বলল,
-” আমার উপর এইভাবে অভিযোগ তুলবে না, নীরব! এতদিন ইনডিরেক্ট বলেছো। সহ্য করেছি। কিন্তু এবার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো। আমি কেনো এসব করব?”
-” সেটা তুমিই জানো ভালো করে। উত্তর তোমার কাছেই আছে।”
-” তুমি তো আইনের লোক, তাই না? প্রমাণ ছাড়া একজনকে দোষারোপ করো কীভাবে? শুধু সন্দেহ করলেই কেউ অপরাধী হয় না। এটা কেমন বিচার?”
-” নীবিড় তোমার কাছেই ছিলো, বাইরের কেউ এভাবে কিছু করতে পারত না।”
প্রীতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-” আমরা যখন চট্টগ্রামে ছিলাম, তখন ওর অফিসের এক সহকর্মীর সঙ্গে নীবিড়ের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শোনা যায় সেই লোক গোপনে ড্রা’গ ব্যবসায় জড়িত ছিলো। ধীরে ধীরে নীবিড় নিজেই তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তারপর ও নি…”
নীরব ধ’ম’ক দিয়ে উঠল,
-” মিথ্যে! বানানো কথা বন্ধ করো!”
প্রীতি জোরে চেঁচিয়ে উঠল,
-” প্রমাণ ছাড়া গলার জোরে আমাকে অপরাধী বানানোর চেষ্টা করো না!”
তন্মধ্যে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল সার্থক। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল,
-” বাহ! ওয়েল, ওয়েল… এএসপি সাহেব! তুমি বোধহয় ভুলে গিয়েছো এটা একজন ভদ্রলোকের বাসা!”
নীরব কপালে আঙুল ডলে রাগ সংবরণ করতে থাকে। সার্থক এগিয়ে এসে শক্ত গলায় বলল,
-” এটা একজন ভদ্রলোকের বাড়ি। এটা তোমার পুলিশ স্টেশন না। কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়? এতটুকু ম্যানারস নেই দেখছি তোমার মধ্যে। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়েই আমার বোনের সাথে মিস বিহেভ করছো, ক্লেইম করছো। জানো, এইজন্য আমি তোমার নামে মামলা করতে পারি।”
নীরব হেসে ফেলল। বলল,
-” আমাকে মামলা দিয়ে ভ’য় দেখাচ্ছো?”
সার্থক শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁ’ড়ল,
-” কেনো? পুলিশের বিরুদ্ধে কি মামলা হয় না? হয়নি কখনো?”
-” নিশ্চয় হয়। আমিও জানি। কিন্তু মনে রেখো, যেদিন আমি কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাব; সেদিন তার পায়ের নিচে মাটি থাকবে না। কারণ সেদিন শুধু সন্দেহ করেই না। সাথে থাকবে প্রমাণ।
এক মুহূর্ত থেমে প্রীতির দিকে তাকিয়ে বলল,
-” সময় নিচ্ছি কারণ নিয়ম আছে।”
এইবলে আর একটাও বাড়তি কথা না বলে নীরব চলে যায়। কাজের মেয়েটা কিচেন থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিল। বিড়বিড় করে,
-” ভাবাগো বাবা….দুই ভাইবোনির সেকি মিল। আবার এইতো দু’দিন আগে; কী নিয়া! সে কী রাগারাগি। কথা কওন বাদ। এক টেবিলে খাওন বাদ। এহন সেই বোনের পক্ষ নিয়ে স্যার কতা কইতাছে। বড়লোকেরা পারেও বাপু নাটক করবার। বিনে পয়সায় নাটক দেহি খালি।”
____________
পৌর পার্কের সবুজ ঘাসের উপর প্রত্যাশা আর হ্যাপি বসে। প্রত্যাশা কোলের উপর থাকা ব্যাগের উপর খাতা রেখে হ্যাপির খাতা থেকে ম্যাথ তুলছে। গতকাল ও বাড়ি থাকায় ম্যাথ প্রাইভেট মিস যায়। বিকেলে ফিজিক্স পড়তে এসে হাতে সময় থাকায় পার্কে বসে অংক তুলছে। আশেপাশে বাচ্চারা খেলা-ধূলা করছে, কেউ দোল খাচ্ছে, বড়রা কেউ বসে গল্প করছে, হাঁটছে, দৌড়াচ্ছে।
হঠাৎ গা ঘেঁষে বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে গেল। ঝুমঝুম করে শব্দ হলো। প্রত্যাশা লেখা বাদ দিয়ে তাকাল। মেয়েটা গোলগোল ঘুরছে, কোলের সাথে একটা টেডি ধরে। মেয়েটাকে দেখেই প্রত্যাশার মুখে হাসি ফুটল। ত্রস্ত কলম, খাতা হ্যাপির কোলের উপর দিয়ে বলল,
-” আমার হাত লেগে গিয়েছে রে। তুই একটু তুলে দে না।”
হ্যাপি–না..না করেও লাভ হলো না। হ্যাপির ঘাড়ে দিয়ে প্রত্যাশা বাচ্চা মেয়েটাকে ডাকল,
-” হেই ইউ? হেউ কিউটিপাই! তোমাকে…তোমাকে বলছি। এদিকে আসো।”
ইচ্ছে গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে থাকে। কিছুপল পর গম্ভীর মুখে আসল। ইচ্ছের গাল ছুঁয়ে বলল,
-” আমাকে চিনতে পেরেছো?”
দুদিকে মাথা নাড়িয়ে -” নাহ” বোঝায়। প্রত্যাশা বলতে থাকল–কিছুদিন আগেই তো এই পার্কে দেখা হয়েছিল। ইচ্ছের মনে পড়ল না। এছাড়া ছবিতে একবার দেখেছে। ছোট মানুষ, ছবির দেখায় মানুষকে সঠিক চিনতে পারে নাকি! প্রত্যাশা মন খারাপ করার অভিনয় করল,
-” এই রে তুমি চিনতে পারছো না। আমার তো দুঃখ লাগছে। সেদিন তোমার সাথে খেললাম।”
খেলার কথা বলতেই ইচ্ছে বিজ্ঞের মতন বলল,
-” ও..ও।”
-” তোমার নামটা যেনো কী? উমম! আমার নামের মতোই ছিলো তোমার নামটা। কী যেনো চাওয়া-পাওয়া।”
-” চাওয়া-পাওয়া নয়। ইচ্ছে। আমি ইচ্ছে।”
মুখটা গম্ভীর করে সুধরে দেয় ইচ্ছে। প্রত্যাশা হেসে ফেলল। হ্যাপি অংক তুলছে আর কটমট চোখে চাইছে–যত জ্বা’লা আমার। ওদিকে উনি হাত-পা ছাড়িয়ে একটা বাচ্চার সাথে খেজুরে আলাপ জুড়ে দিয়েছে।
প্রত্যাশা সেদিনের ন্যায় মিশে যায় ইচ্ছের সাথে। মনা পিছে দাঁড়িয়ে। প্রত্যাশার পাশে বসে ইচ্ছে কুটুস কুটুস করে গল্প করছে। প্রত্যাশা ব্যাগ খুঁজে লিচি ক্যান্ডি বের করে ছিঁড়ে দিল। গল্প করার মাঝে ইচ্ছের পাশে রাখা টেডির বড়বড় কান নেড়ে প্রত্যাশা বলল,
-” তোমার টেডি টা সো কিউট!”
-” হুম। মামা দিয়িছে।”
-” ওহ্, এটা মামা গিফট করেছে। আমি ভেবেছিলাম তোমার পাপা।”
-” পাপা খেলনা দেয়। অনেক…।”
তারপর আচমকা পা-টা দেখিয়ে বলল,
-” এই এই… পাপা দিয়েছে, সুন্দর?”
-” হুম, খুব সুন্দর!”
নুপুর জোড়া দেখতে দেখতে মনেহলো–ইয়া আল্লাহ! সেইম এই ডিজাইনের নূপুর তো নীরবও এনেছে। আনিশার জন্য।
মনা তাড়া দেয়। ইচ্ছে ‘বাই’ বলে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর প্রত্যাশারাও উঠে। দাঁড়িয়ে পিছুনে ঘুরতে নিয়ে হ্যাপি চেঁচিয়ে উঠল,
-” এইরে মেয়েটা তো ওর টেডি ফেলে গিয়েছে।”
প্রত্যাশা হাতে তুলল,
-” হুম। তাই তো দেখছি। কী করব এবার?”
-” কী করবি আবার। রেখে দে। পরের প্রাইভেটের দিন এসে মেয়েটাকে খুঁজে ফেরত দিবি।”
-” টেডিটা মেয়েটার খুব প্রিয়। প্রিয় জিনিস না পেলে মন খারাপ করবে।”
-” তা ঠিক…. কিন্তু ফেরত দিবি কীভাবে?”
প্রত্যাশা কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল,
-” মেয়েটার সাথে থাকা মনা নাকি ফনা…কথা বলার সময় কী বলল, শুনলি না? গলির মোড়ে খান ম্যানশন নাকি ওদের। চল ফট করে দিয়ে আসি। ওদিক দিয়েই স্যারের বাসায় যাব।”
হ্যাপি ঠোঁট উল্টে বলল,
-” চল…তোর তো আবার দয়ার শরীর। দেখিস উপকার করতে গিয়ে আবার বাঁশ না খেতে হয়।”
প্রত্যাশা মোটামোটা চোখে তাকাল,
-” এখানে বাঁশ খাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং একটা বাচ্চা মেয়ে খুশি হবে। আমার তো ছোটখাটো কিছু হারিয়ে গেলেও, না পাওয়া অবধি কিছুই ভালো লাগে না।”
-” দেরি হলে স্যার বকবে। সেটাও তো এক প্রকার বাঁশ।”
দুজনে পার্কের গেট দিয়ে বেরোচ্ছিল। হঠাৎ ছেঁড়া, ময়লা মাখা গেঞ্জি গায়ে একটা বাচ্চা ছেলে ডাকলো,
-” আপা ফুল নিবেন ফুল।”
প্রত্যাশা বলল,
-” নাহ।”
হাতে কয়েকটা ফুল। তাও শুকিয়ে গিয়েছে। না করার সাথে সাথে ছেলেটির মুখ ম্লান হয়ে আসলো। প্রত্যাশা পা চালিয়েও ফিরে এল। মায়া হলো। ব্যাগ খুঁজে দুইশো টাকার একটা নোট পেল। বাকি টাকা রিকশা ভাড়ার জন্যে রেখে দিল। ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে বলল,
-” এটা রাখো। ফুল লাগবে না।”
ছেলেটার মুখ চকচক করে উঠল। ছেলেটা আবার বলে এক প্রকার জোর করেই দু’জনকে দু’টো লাল গোলাপ দিল। হ্যাপি বলল,
-” ফুল তোর ভালো লাগে না?”
-” হ্যাঁ লাগে তো।”
-” তাহলে টাকা দিলি, তবুও নিতে চাইলি না যে।”
-” মনে করলাম, আমার থেকে লাল গোলাপগুলো প্রেমিক প্রেমিকাদের বেশি দরকার হতে পারে। আমি কাকে দিবো ভাই? ফুলের অভাবে কতজন প্রপোজ করতে পারছে না। তাদের কথা ভেবে রেখে দিচ্ছিলাম।”
প্রত্যাশা মজা করে বলল। হ্যাপি বলল,
-” কেনো তোর বরকে দিবি।”
-” ধূর! বরের সাথে দেখা হতে হতে ফুল শুকিয়ে নাই হয়ে যাবে।”
-” শুকনো ফুল দিয়ে প্রপোজ করার আলাদা ব্যাপার। বলবি; ফুলটা হয়তো শুকিয়ে গেছে, কিন্তু ভালোবাসা শুকায় না। ভালোবাসা সময়ের সাথে প্রগাঢ় হয়। এই শুকনো ফুলটা প্রমাণ; ভালোবাসা শুধু রঙে গন্ধে নয়, টিকে থাকার নামও। শুকিয়ে গেলেও, ফুরিয়ে গেলেও থাকব তোমার পাশে। শ্বাসের সাথে মিশে।”
হ্যাপির বাহুতে চাপড় মে”রে হেসে বলল প্রত্যাশা,
-” বাহ! ভালোই তো কবি কবি ভাব তোর।”
মোড়ের উপরের একটা দোকান থেকে খান ম্যানশন কোন পাশে জিজ্ঞেস করে নেয় ওরা। অল্প একটু যেতেই বাড়ির তরণে নামফলক দেখে বেগ পোহাতে হয় না। সমস্যা বাঁধল, গেট খোলা দারোয়ান, বা গার্ড কেউ নেই। ওদিকে প্রাইভেটের সময় হওয়ায় দেরি না করে ভেতরে ঢোকে। কলিং বেল চাপল। কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। প্রত্যাশা বলল,
-” এখানে ইচ্ছে বলে একটা বাচ্চা মেয়ে থাকে?”
মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” হ..”
-” এই টেডিটা ওকে দিয়ে দিয়েন। পার্কে ফেলে আসছিল।”
টেডিটা হাতে নেয় মেয়েটা। এমন সময় তানিয়ার গলার স্বর আসলো,
-” কে এসেছে রে। কার সঙ্গে কথা বলছিস।”
মেয়েটা ঝটপট বলল। তানিয়া ভেতরে আসতে বলল। ওরা ইতস্তত করতে থাকে। এরমধ্যে ওপাশ থেকে ইচ্ছে দৌড়ে এল। দরজার সামনে প্রত্যাশাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল। বুয়ার হাত থেকে টেডি নিয়ে প্রত্যাশার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিল। বয়স্ক মানুষ ডাকছিলো বিধায় ওরা ভেতরে আসল। তানিয়া ধন্যবাদ দেয়। বসতে বলে। তবে ওরা ভদ্রভাবে না করে। প্রাইভেট আছে বলে চলে যেতে নেয়। তানিয়া চশমা ছাড়া ঝাপসা দেখে। মেয়ে দু’টোকে দেখলেও ধরতে ব্যর্থ হয়, একদিন ছবিতে এই মেয়েটাকে দেখেছিলেন। প্রত্যাশা হাসিমুখে বলল,
-” আন্টি আমরা আসছি।”
এই বলে ঘাড় ঘুরাতে গিয়ে ড্রয়িংরুমের একপাশে থাকা ফ্রেমে দৃষ্টি আটকায় প্রত্যাশার। বেশ কিছু ছবির মাঝে একটা ছবিতেই ওর নজর আঁটকে গেল। মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। ও ত্রস্ত ঘুরে দাঁড়াল। ছবির দিকে আঙুল তাক করে কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
-” ও-ওই ছবিটা কার?”
হঠাৎ প্রত্যাশার এমন প্রশ্নে তানিয়া অবাক হলো। তবুও বলল,
-” আমার মেয়ে প্রীতি আর মেয়ের জামাই এর।”
ইচ্ছে ঝুমঝুম করে বলল,
-” আমার মাম্মা আর পাপা।”
প্রত্যাশার পুরো পৃথিবী দুলে উঠল। হাতের ফুলটা খসে মাটিতে পড়ল। শরীরটা যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২০|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
ছবিটিতে হাস্যজ্জ্বল দুটো মুখ। কাছাকাছি বসে, মেয়েটির কাঁধ পুরুষালী এক হাতে জড়ানো। দু’জনের গালের এক পাশ একে অপরের স্পর্শে মিশে আছে। প্রত্যাশার বুকের ভেতর কালবৈশাখীর ঝড় ওঠে। তানিয়ার বলা কথাগুলো এখনও স্পষ্ট হয়ে বারবার কানে বাজছে–“আমার মেয়ে প্রীতি আর মেয়ের জামাই।” ইচ্ছের ঝমঝমে কণ্ঠে–“আমার মাম্মা আর পাপা!”
চোখের দেখা, কানের শ্রবণ অবিশ্বাস্য লাগছে। অদৃশ্য হাতে কান চেপে ধরতে চায় প্রত্যাশা। চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ওর ছোট্ট নরম-কোমল হৃদয়টা দুমড়েমুচড়ে নিঃশব্দে ছিঁড়ে পড়ছে।
বইয়ের পাতা উল্টানোর মতো আচমকা কিছু দৃশ্য মন মস্তিষ্ককে ভেসে ওঠে–বইয়ে পাওয়া ছবি, সেদিন বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে বাইকার নীরবই, নুপুরজোড়া, তারপর কাল মাঝরাতে অমন মূহুর্তে ইমার্জেন্সি বেরিয়ে যাওয়া। সব মিলে এক হচ্ছে এক মারণ সমীকরণে। মানতে মনটা নারাজ। তবুও সবকিছুই আঙুল তুলে প্রমাণ দিচ্ছে। যা দেখল আর শুনল সব সত্যি। এসব সত্যি হলে, ওকে বিয়ে করার কারন কী? আর বাড়ির লোকই বা জানে না কেনো?
উত্তর অজানা। তবে মন নিজেই উত্তর খুঁজে নেয়। আছে না কিছু খারাপ চরিত্রের মানুষ। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা, বাড়তি খাওয়া। প্রত্যাশার গা গুলিয়ে আসছে তীব্র ঘৃ’ণা’য়। উপরে ভদ্রতার লেবাস ধরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঠক, প্রতারক, চিটারের ট্যাগ নীরব মাহবুবের নামের পাশে বসে যায় আপনাআপনি। গলার চেইনটাও যেন তীব্র বিদ্রুপ করে বলছে–পি ফর মানেই প্রত্যাশা নয়, প্রীতিও হতে পারে। প্রত্যাশার মনে পৃথিবীর সমস্ত ঘৃ”ণা নীরবের প্রতি জমা হতে থাকে।
প্রাইভেটের সময় হয়ে যাওয়ায় হ্যাপি কোনোদিকে না তাকিয়ে সরাসরি প্রত্যাশাকে তাড়া দিয়ে বলল,
-” অ্যাই প্রত্যাশা, কী হলো? এভাবে সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”
প্রত্যাশার কোনো সাড়া না পেয়ে হ্যাপি হাত ধরে ঝাঁকি দিল। প্রত্যাশা সম্বিৎ ফিরে পেতেই অপ্রস্তুত গলায় বলল,
-” হ-হু।”
-” কী হ্যা-হু করছিস? চল তাড়াতাড়ি। লেট হলে স্যার ব’কবে।”
প্রত্যাশার হাত ধরে টান দিয়ে হ্যাপি গো করে হাটা ধরল। প্রত্যাশা এখনো অসাড়। মাথা হ্যাং। কী করবে বুঝতে পারছে না? এত বড় প্র’তারণা মেনে নেওয়া যায়? সবার সামনে লয়্যাল সেজে থাকা লোকটার মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। পা জোড়া থামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল প্রত্যাশা। বলল,
-” তুই প্রাইভেটে যা। আমি বাসায় যাব।”
হ্যাপি বিরক্তি নিয়ে বলল,
-” বাসায় যাবি মানে? কেনো? হঠাৎ তোর আবার কী হলো?”
হতাশ শ্বাস ফেলে উত্তরে বলল প্রত্যাশা,
-” আমার ভালো লাগছে না। বেশি প্রশ্ন করিস না, প্লীজ।”
পড়তে এসেও প্রত্যাশার হুটহাট না পড়ে চলে যাওয়া, আজ নতুন নয়। তাই হ্যাপি আর বেশি কিছু বলল না। তবে আজ লক্ষ্যণীয় বিষয়; প্রত্যাশার মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, স্বাভাবিক লাগছে না। হ্যাপি কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করল,
-” তুই ঠিক আছিস? না মানে প্রত্যাশা তোর কী শরীর খারাপ লাগছে? বল আমায়? আমি তোর সাথে যাই!”
বন্ধুর উদ্বেগ প্রকাশ দেখে প্রত্যাশা ম্লান মুখেও জোর করে হাসার চেষ্টা করল। ওকে চিন্তা মুক্ত করতে বলল,
-” আরে না, আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু হয়নি। এমনি পড়তে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুই আমার জন্য কেনো শুধু শুধু পড়া বাদ দিবি। তুই সবকিছু ঠিকঠাক বুঝে তুলে নিস, আমি পরে পাছে তোর খাতা থেকে তুলে নেব।”
-” তোর তো আবার বিদ্যুতের হলুদ বাল্বগুলোর মতোন পড়ার মুড! যখন-তখন ফুস করে ফিউজ হয়ে যায়।”
এই বলে হ্যাপি ঠোঁট চেপে হেসে এগিয়ে যায়। অন্যদিন হলে প্রত্যাশা পাল্টা দুষ্টুমি করত। আজ তা আর হয় না। ভিড়ের শহরেও ওর ভেতরটা আজ কেমন ফাঁকা, নিঃসঙ্গ। চারপাশে গাড়ি-ঘোড়া, মানুষের কোলাহল সবই যেন অনাহুত। পিচঢালা রাস্তায় নির্বাক মূর্তির মতো হাঁটছে প্রত্যাশা। রিকশার বেল, হর্ন, চিৎকার কিছুই কানে ঢুকছে না। এক রিকশাওয়ালা যেতে যেতে চিৎকার করে বলে,
-” আফা, ম’র’তে চান নাকি? নাকি চোহে দেহেন না, সাথে ঠসাও হইছেন?”
প্রত্যাশা শ্বাস ফেলে রাস্তা পার হতে যায়। হঠাৎ চারপাশে গাড়ির মাঝে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে ও। এদিক-ওদিক দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। এক বাইকার তীব্র গলায় বলে ওঠে,
-” আরে পা’গল নাকি? এভাবে রাস্তা পার হয়। এখনি তো নিজেও যেতো, সাথে আমাকে থানায় পাঠাতো। দোষ তো হতো ড্রাইভারের। যত্তসব!”
হতভম্ব প্রত্যাশা দিকভ্রান্ত। আরেক পা বাড়াতেই সিএনজি ঘেঁষে চলে যায়। পিছন থেকে আসা মাইক্রোবাসের শব্দে শরীরটা জমে যায়। কী করবে ঠাওর করার আগেই একটা বলিষ্ঠ হাত ওর বাহু চেপে ধরে রাস্তার পাশে টেনে আনে। প্রত্যাশা পড়ে যেতে যেতে সামলে নেয়। পাশে দাঁড়ানো মানুষটি আ’তঙ্কে, রাগে, উদ্বেগে চিৎকার করে বলে উঠল,
-” আর ইউ ক্রেজি? হোয়াট দ্য হেল ওয়ার ইউ থিংকিং? ডু ইউ হ্যাভ আ ডেথ উইশ অর সামথিং?”
সামনের চেনা মুখটির দিকে তাকায়। তবে জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। ওকে নিরুত্তাপ দেখে জোড়াল শ্বাস ফেলে গলার স্বর নামিয়ে বলল,
-” আর ইউ ওকে? এভাবে রাস্তা পার হচ্ছিলে! একটুর জন্য কী ঘটতে পারত, ভাবতে পারছো? তোমার আরেকটু কেয়াফুল হওয়া দরকার। না হলে কবে বড়সড় দূর্ঘটনা ঘটে যায়।”
প্রত্যাশা ধাতস্থ হতে একটু সময় নেয়। ও খেয়াল করে, লোকটা এখনো ওর বাহু শক্ত করে ধরে আছে। প্রত্যাশা ঝারি মে’রে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে তেজি কণ্ঠে বলল,
-” হাত ছাড়ুন। আর দুই হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে কথা বলুন। পৃথিবীর সব পুরুষই এক; লুচু, ক্যারেক্টারলেস। মেয়ে দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছে করে! যতই ভালো সাজার চেষ্টা করুক না কেন, তাদের ভেতরের রূপটা এক। খালি বাহানায় মেয়েদের স্পর্শ করার ধান্দা।”
মুখটা তেতো করে প্রত্যাশা। সার্থক শব্দ হারিয়ে ফেলে। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। নিজেই নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে ওর। জীবনে উপকার করতে গিয়ে এমন অপমান পাবে ভাবেনি কখনও। হেল্পের বিনিময় ছোট্ট একটা ধন্যবাদ না পেয়ে উল্টো ঝারি শুনতে হচ্ছে। তাও আবার ক্যারেক্টারলেস বলে ফেলল। একটু চুপ থেকে নরম গলায় বলল সার্থক,
-” স্যরি। আমি বাসায় ফিরছিলাম হঠাৎ তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে গাড়ি থামিয়ে দিলাম। আর তারপর যা হলো সেটা তো তুমি দেখলে। সেই মুহূর্তে তোমাকে বাঁচানো ছাড়া আর কিছু ভাবিনি, বিশ্বাস করো। আই হ্যাড নো আদার ইন্টেনশন।”
প্রত্যাশা কোনো উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। সার্থক এবার একটু চিন্তিত হয়ে তাকায় ওর দিকে। তীক্ষ্ণ চাহনিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” তোমাকে কেমন যেনো লাগছে! না মানে তোমাকে স্বাভাবিক লাগছে না। কিছু মনে না করলে, লিফট নিতে প__”
কথার মাঝেই প্রত্যাশা ছ্যাত করে উঠে বলল,
-” আরে থামেন তো। দরকার নেই। নো নিড লিফট-টিফট।”
সার্থকের মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে এল। কী মেয়ে রে বাবা! ভালো কথায়ও ছ্যাতছ্যাত করে উঠছে। সার্থক আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইতস্তত করে বলল,
-” তোমাকে আজ একটু অন্যরকম লাগছে। তাই তোমাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না বলেই মনে হচ্ছে। সো, ইফ ইউ ওয়ান্ট, আই ক্যান ড্রপ ইউ। তুমি যদি ইনসিকিউওর ফিল করো। আমি আশ্বস্ত করতে পারি; অ্যাট লিস্ট, অ্যাবাউট মাইসেলফ। বিলিভ মি।”
‘বিশ্বাস’–শব্দটাই প্রত্যাশার বুক চিরে একটা ক্ষত খোঁচা দিচ্ছে। যে বিশ্বাস একটু আগেই ওর ভেতরটা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। প্রত্যাশার দৃষ্টি নেমে আসে মাটির দিকে। এবারে গলার স্বর মিইয়ে আসলো,
-” আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমার জন্য চিন্তা করারও দরকার নেই। হেল্পের প্রয়োজন নেই, আমি একাই চলে যেতে পারব।”
সার্থক নিচু গলায় বলল,
-” একটু আগে হেল্প না করলে তো… এতক্ষণে কী হতো?”
প্রত্যাশা হালকা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-” সেটাই বোধহয় ভালো হতো।”
-” হোয়াট?”
-” নাথিং।”
আর বাড়তি কথা না বলে হাঁটতে শুরু করে প্রত্যাশা। সার্থক তাকিয়ে থাকে পিছন দিকে সরে যাওয়া ছায়ার দিকে। এমন সময় একটা খালি রিকশা চোখে পড়ে। রিকশাওয়ালাকে ডাকে, তারপর প্রত্যাশাকে,
-” প্রত্যাশা? ওয়েট।”
প্রত্যাশা বিবর্ণ, বিরস মুখে থামে। সার্থক এগিয়ে এসে বলে,
-” আমার গাড়িতে যেতে হবে না। এই রিকশাটাই নাও। অন মাই রিকুয়েস্ট, এবার অন্তত না বলো না…. প্লীজ।”
প্রত্যাশা একপল চুপচাপ তাকিয়ে পরপর রিকশায় চেপে বসল। রিকশা গতি নেয়, সার্থক চেয়ে রয়। যতদূর দেখা গেল সার্থক চেয়ে থাকল। প্রত্যাশাকে আজ একটু অন্যরকম লাগল। এই নিয়ে ভাবতে লাগল সার্থক।
____________
পড়ার টেবিলে বই সামনে নিয়ে বসে আছে প্রত্যাশা। দৃষ্টিজোড়া বইয়ের পাতায় থাকলেও মন-মস্তিষ্ক উদাস। ভেবেছিল প্রথমে মা’কে জানাবে। কিন্তু বাড়িতে ফিরে কিছু বলার আগেই যা শুনল, তাতে আর জানাতে ইচ্ছে করল না। মা আপুর সাথে ফোনকলে ব্যস্ত। শুনল–মাহবুব সাহেব নাকি অসুস্থ। ক’বছর আগে হার্টে রিং পড়ানো হয়। তারপর বয়স বাড়ার সাথেসাথে কিছু রোগ জেঁকে ধরেছে, হাই প্রেশার, ডায়াবেটিস। হঠাৎ বিকেলে হালকা বুকে ব্যথার সাথে প্রেশার বাড়ায় ডক্টরের কাছে চেকাপ করতে নিয়ে যায়।
ও বাড়ির সবাই আন্তরিক। তারপর এই লোকটার ব্যবহার, আদর প্রত্যাশার প্রতি খুব বেশিই ছিলো। উনি অসুস্থ। এখন এসব খবর শুনলে আরো অসুস্থ হতে পারেন ভেবে প্রত্যাশা আর কাউকে জানাল না।
.
.
বাবার টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে ডক্টরকে দেখিয়ে ফিরতে ফিরতে নীরবের রাত সাড়ে নয়টা বেজে যায়। শাওয়ার নিয়ে কাবার্ড খুলে টিশার্ট বের করতে গিয়ে হঠাৎ সাদা শার্টটায় নজর পড়ল। সাদা শার্টের কলারে লাল লিপস্টিকের একজোড়া ঠোঁটের ছাপ। সাথে সাথে প্রত্যাশার সেদিনের পাগলামির দৃশ্য মানসপটে ভেসে উঠল নীরবের। অধর কোণে একফালি হাসি ফুটল ওর। আঙুল ছুঁয়ে দিল রঙিন জায়গাটায়।
এইযে বিয়ের পর দু’বার এসেছে, প্রতিবারই এটাসেটা ফেলে যায়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে হেয়ার ব্যান্ড, ক্লিপ আরো ছোটছোট সাজগোজের জিনিস। নীরব সেগুলো সযত্নে গুছিয়ে রেখেছে। পরপর গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে পরিপাটি হয়ে কাংখিত নম্বরে ডায়াল করল নীরব।
বইয়ের উপর মাথা রেখে চোখবুঁজে আছে প্রত্যাশা। চোখের পাশে শুকনো দাগ, নিঃশব্দে, নীরবে কান্নার সাক্ষী। নিস্তব্ধ কক্ষে ভাইব্রেট থাকা ফোনটা বুমবুম শব্দ তুলে কাঁপছে। প্রত্যাশা ধীরেধীরে চোখ মেলে তাকায়। প্রথম বার কল কে’টে দ্বিতীয় বার ফের বাজতে লাগল। প্রত্যাশার ফোন তুললে রুচিতে বাঁধল। ও জানে ওই মানুষটার সাথে ওর আর স্বাভাবিক কথা কখনোই হবে না। আংকেল সুস্থ হলেই ও সবাইকে সবটা জানাবে। তারপর এই সম্পর্কটা থেকে মুক্তি চাইবে।
তৃতীয় বার কলের পর প্রত্যাশা ফোনের পাওয়ার অফ করে ফোনটা শব্দ করে নামিয়ে রাখল। ওই লোকের দেওয়া সবকিছু যেদিন মুখের উপর এভাবে ছুঁড়ে ফেলবে সেদিন ওর একটু হলেও শান্তি মিলবে। যে স্পর্শগুলো স্বর্গীয় সুখানুভূতি দিয়েছিল, এখন সেটা ওর গা ঘিনঘিনের কারন মনে হচ্ছে। মনে পড়লেই সমস্ত শরীর বি’ষে নীল হয়ে যাওয়ার মতো বিষিয়ে উঠছে।
.
ফোন বন্ধ শুনে নীরবের মেজাজটাই তেতো হলো। ভাবল- প্রত্যাশা যে কেয়ারলেস নিশ্চয় চার্জ নেই, তাই একাই ফোন অফ হয়ে গিয়েছে।
_____________
পরেরদিন…
লাঞ্চ শেষে অফিসে ফিরে নিজের কক্ষে বসে একগুচ্ছ ফাইলে চোখ বুলাচ্ছিল নীরব। হালকা বিরক্ত চোখে হাতঘড়ির দিকে তাকাল; তিনটা বেজে সাত মিনিট। ফাইলটা বন্ধ করে একপাশে সরিয়ে রাখল। তারপর প্রত্যাশার নম্বরে কল দিতেই সুইচড অফ আছে শুনে ভ্রু কুঁচকে গেল নীরবের। আজ প্রায় দুদিন হতে চলল প্রত্যাশার সাথে কথা হয় না। অস্থিরতা, একরকম শুন্যতা মনকে আঁকড়ে ধরেছে। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিল না ও। একরকম নিরুপায় হয়েই ফোন করল অধরাকে। সালাম দিয়ে ভদ্রভাবে সৌজন্যতা মেইনটেইন করে। তারপর লজ্জা ইতস্তত বোধকে একপাশে ঠেসে রেখে বলল,
-” আন্টি, প্রত্যাশার ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। ও কি বাসাতে আছে?”
অধরা কিঞ্চিৎ অবাক সুরে বলেন,
-” ফোন বন্ধ?”
একটু থেমে বললেন,
-” হ্যাঁ বাবা, ও তো রুমেই আছে। আমি ডেকে দিচ্ছি, একমিনিট।”
ঘরটা আধো অন্ধকার, পর্দা টানা। বাইরে দুপুর হলেও ঘরের ভেতরটা যেন বিষণ্ন অন্ধকারে ঢাকা। অধরা ডেকে উঠলেন,
-” প্রত্যাশা, তোর ফোন বন্ধ কেন? নীরব ফোন করেছে।”
প্রত্যাশা বালিশে মুখ গুঁজে ছিল। ঝিম ধরা গলায় বলল,
-” চার্জ শেষ হয়ে গেছে বোধহয়।”
নীরব লাইনেই আছে।
-” এই নাও, কথা বলো।”
অধরা ফোনটা প্রত্যাশার হাতে দিয়ে প্রস্থান করে। মায়ের সামনে কিছু বলতে না পেরে অনিচ্ছা নিয়ে ফোনটা কানে তুলল প্রত্যাশা। ওপাশ থেকে শান্ত কণ্ঠে ডাক এল,
-” প্রত্যাশা?”
ডাকটার ভেতরে কী ছিল জানে না প্রত্যাশা, কিন্তু বুকের ভেতরটা হঠাৎ করে হাহাকার করে উঠল। প্রত্যাশা নিরুত্তর রইল। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে এলো। নীরব আবার জিজ্ঞেস করল,
-” প্রত্যাশা, তুমি শুনতে পাচ্ছো?”
নিস্তেজ উত্তর দিল,
-” হুঁ।”
-” কী হয়েছে তোমার? ফোন দাও না, আমি দিলে ধরো না, আর এখন তো কথাও বলছো না। তুমি আজকাল বড্ড জ্বা’লাচ্ছো আমায়।”
প্রত্যাশা চোখ বন্ধ করে ফেলল। রাগ, ক্ষোভ আর ঘৃ’ণা ওকে ভেতর থেকে জর্জরিত করে দিচ্ছে। একটা মানুষ এত নিখুঁত অভিনয় কী করে করতে পারে? সেদিন রাতে নীরবের বলা সব কথাই মিথ্যে ছিলো? সবই অভিনয়? প্রত্যাশা তাচ্ছিল্য হেসে ত্যাড়া সুরে বলল,
-” সমস্যা নেই….আপনার তো কথা বলার লোকের অভাব নেই, তাই না?”
নীরব কপাল কুঁচকে বলল,
-” মানে?”
প্রত্যাশা হঠাৎ আচমকা জিজ্ঞেস করল,
-” নীরব আপনার লাইফে, ভালোবাসি কথাটা সর্ব প্রথম কাকে বলেছেন?”
মেয়েটা ইমম্যাচিউর। তাই ওর এহেন প্রশ্নে অবাক না হয়ে নীরব হাসল। নিঃশব্দে হেসে বলল,
-” আমার বউকে?”
-” আমাকে নয়। রাইট?”
-” ও প্রত্যাশা হেঁয়ালিপূর্ণ কথা বন্ধ করো। তুমি ছাড়া আমার আর কটা বউ আছে শুনি?”
-” সেটার সঠিক হিসাব আপনি জানেন। আমি জানি না। ভবিষ্যতে সংখ্যা বাড়লেও অবাক হবো না।”
-” তুমি নিশ্চয়ই কিছু একটা নিয়ে অভিমান করেছো। প্লিজ স্পষ্ট করে বলো। না বললে আমি বুঝব কী করে?”
প্রত্যাশা নিরুত্তাপ থাকল। নীরব ভাবল বন্ধুরা বলে– মেয়েরা বিয়ের প্রথম প্রথম বরের সাথে একান্তে থাকতে চায়, বরের সাথে সময় কাটাতে চায়। সত্যিই তো ব্যস্ততা, কাজ, ঝামেলা সবমিলিয়ে প্রত্যাশাকে একদমই সময় দেওয়া হয়নি। নীরব হালকা কেশে বলল,
-” প্রত্যাশা সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থেকো। আমরা লং ড্রাইভে যাব। তারপর ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে। আমি তোমার বাসায় ফোন করে বলে রাখব। সো ঠিক সন্ধ্যে সাতটার আগেই রেডি হয়ে থেকো। বাই।”
রাগে আর অদ্ভুত এক হতাশায় প্রত্যাশার শরীর কাঁপছিল। একদম নিঃশব্দে ফোনটা নামিয়ে রাখে ও।
_____________
নীহারিকা কিচেন থেকে পায়েশের বাটি এনে টেবিলে নামিয়ে রাখতেই দরজার কলিং বেলটা বেজে উঠল। পরী ছুটিতে, শর্মিলা আনিশাকে নিয়ে পার্কে, মাহবুব সাহেব হাঁটতে গেছেন, ছেলেরা বাইরে, বাড়িতে শুধু তিনি আর নীলা। শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে দরজা খুলতেই চোখ কপালে উঠল। একরাশ বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলেন,
-” তুমি?”
উত্তর আসার আগেই আরেক দফা চমকালেন। প্রত্যাশার পাশে গোলাপি রঙের ফ্রক পড়ে একটা আদুরে পুতুলের মতো দেখতে বাচ্চা মেয়েকে দেখে। নীহারিকা ইশারা করে বললেন,
-” বাচ্চা মেয়েটাকে কে? আর তুমি এই সময় হঠাৎ?”
-” বাচ্চা মেয়েটা আপনার ছেলের খুব পরিচিত।”
-” নীরবের পরিচিত?”
-” জ্বী।”
প্রত্যাশার হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে নীহারিকার বদনে বিরক্তির ছায়া গাঢ় হয়। বলা নেই কওয়া নেই! প্রত্যাশার হঠাৎ আগমনে মনেমনে অসন্তুষ্ট হোন নীহারিকা। কিছু বলতে গিয়েও চুপ রইলেন। শেষে শোনা যাবে, নীরবই এনেছে। প্রত্যাশার ছোঁয়া নীরবের মধ্যেও লেগেছে। নীরবও আজকাল কান্ড জ্ঞানহীন হয়ে পড়েছে। ইচ্ছে গোলগোল চোখ করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকিছু দেখছে। নীহারিকা বাচ্চা মেয়েটার রাজ্যের মায়ামাখা মুখটায় চেয়ে থাকলেন। ইচ্ছে প্রশ্ন করল,
-” তুমি বললে, পাপার কাছে আনবে। কই পাপা?”
-” একটু অপেক্ষা করো। চলে আসবে এক্ষুনি।”
নীহারিকা জিজ্ঞেস করলেন,
-” নীরবের কোনো বন্ধুর মেয়ে? নীরব তোমাদের নামিয়ে দিয়ে গেছে? কোথায় ও এখন?”
-” চলে আসবে এক্ষুনি। এতক্ষণে রাস্তায় আছে হয়তো। আপনার ছেলে আসলেই মেয়েটার আসল পরিচয় জানতে পারবেন।”
উত্তর শুনে মেজাজ চটল নীহারিকার। ইচ্ছে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
-” পানি….পানি কাবো।”
নীহারিকা পানির গ্লাস এনে ধরে খাওয়িয়ে দিলেন। মেয়েটার জোড়া ভ্রু, সরু নাক, চোখদুটো কেমন চেনাচেনা মনে হচ্ছে। আর অদৃশ্য একটা আত্মার টান কাজ করছে নীহারিকার মধ্যে। আদুরে স্বরে বললেন,
-” পায়েস খাও? আনবো? খাবে তুমি?”
ইচ্ছে ঘাড় কাত করে বলল,
-” হুম।”
বাটিতে পায়েস এনে চামুচে তুলে খাওয়িয়ে দিতে থাকে। এরমধ্যে নীলা এসে প্রত্যাশাকে দেখে থমকায়। জিজ্ঞেস করেও প্রত্যাশা নিরুত্তাপ থাকে। হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে আছে ও। শাশুড়িকে আদর করে বাচ্চাটাকে খাওয়িয়ে দিতে দেখে নীলা ঠোঁট উল্টে ভাবল– এটা আবার কে? প্রত্যাশা কই থেকে আমদানি করল? ও যেমন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, এটাও তেমন হবে না তো!
প্রত্যাশাকে ঝিম মে’রে বিমর্ষ হয়ে বসে থাকতে দেখে নীহারিকা পানসে মুখে বললেন,
-” শরীর খারাপ লাগছে কী তোমার? খারাপ লাগলে রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”
মিহি স্বরে জবাব দেয়,
-” ঠিক আছি আমি।”
ইচ্ছের মুখ পানি দিয়ে ধুয়ে তারপর নিজের আঁচল দিয়ে যত্ন করে মুছে দিলেন নীহারিকা। ইচ্ছে থেকে থেকে দু একটা কথা বলছে, এটা-ওটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে। নীলা প্রত্যাশার হাবভাব কিছুই ঠাওর করতে পারছে না। প্রত্যাশা এত চুপচাপ? ও তো এত চুপচাপ থাকার মেয়ে নয়।
.
তখন নীরবের সাথে কথা বলার পর প্রত্যাশা সিদ্ধান্ত নেয়; ও আর টাইম ওয়েস্ট করবে না। আর নীরবের সাথে ঘুরতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। যদি মুখে বলি, কেউ বিশ্বাস করবে না। নীলার মতো সবাই বলবে, প্রত্যাশাই রং। নীরব লয়্যাল, এরকম কিছু হতেই পারে না। তারপর প্রীতিকেও জানাতে হবে। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার দিন শেষ করতে হবে। তাই প্রত্যাশা প্রাইভেটে যাওয়ার নাম করে ইচ্ছেদের বাসায় যায়। ইচ্ছে গার্ডেনে মনার সাথে খেলছিল। প্রত্যাশা ইচ্ছেকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে নিজের সাথে আনে। মনা দিবে না। ম্যাডাম, স্যার রক্ষে রাখবে না। প্রত্যাশা নিজের ফোনে নীরবের ছবি দেখিয়ে বলে–উনি নিতে বলেছে। আরো হ্যানোত্যানো বুঝ দিয়ে ইচ্ছেকে নিয়ে আসে। তারপর সেকেন্ড কাজ ছিলো নীরবকে মেসেজ দেওয়া। প্রত্যাশার বিশ্বাস নীরব সন্ধ্যার আগেই আসবে। ইচ্ছে বারবার জিজ্ঞেস করছে,
-” অ্যাই….পাপা কই? আমি বাসায় যাব। মাম্মা ব’ক’বে।”
-” একটু অপেক্ষা করো সোনা। তোমার পাপা আসবে, মাম্মাও আসবে।”
ইচ্ছের মা আসবে। মেয়েকে খুঁজতে নিশ্চয় আসবে। মনার কাছে এএসপি নীরবের ঠিকানা দিয়ে আসছে প্রত্যাশা। আজ সবাইকে মুখোমুখি হতে হবে। ইচ্ছে, প্রীতি; এদের সামনে নীরবকে সত্যিটা বলতে হবে। প্রত্যাশার কথা তখন আর কেউ হেসে উড়িয়ে দিতে পারবে না। যেমন বিয়ের দিন ছবিটার কথা বলেও কোনো লাভ হয়নি। আজ ছবি নয়, জলজ্যান্ত প্রমাণ সামনে থাকবে।
কিছুক্ষণ পর বেল বাজতেই নীলা দরজা খুলে দেয়। নীরব সৌজন্যমূলক কথা বলে ভেতরে আসতে থাকে। ইচ্ছে নীহারিকার সাথে গল্প করছে। নীহারিকা কথার ফাঁকে প্রত্যাশাকে পর্যবেক্ষণ করছে। নীরব এগিয়ে আসতেই ইচ্ছে লাফিয়ে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,
-” ওই তো পাপা এসেছে!”
এক গাল হেসে ইচ্ছে এলোমেলো পা ফেলে দৌড়ে গেল। নীরব অবাক! ইচ্ছে দুই হাতে নীরবের কোমড় জড়িয়ে ধরল। মাথাটা উঁচিয়ে বলল,
-” পাপা….”
নীরব ঝুঁকে দুই হাতে ইচ্ছের গাল আজলে ধরল। অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,
-” ইচ্ছে! তুমি এখানে…”
বলতে বলতে দৃষ্টি গেল সোফায় বসা প্রত্যাশার দিকে। দুই হাতে কপাল চেপে ধরে আছে। ইচ্ছের এরুপ সম্বোধনে নীহারিকা, নীলা দু’জনেই তা’জ্জব বনে যায়। নীলা বিড়বিড় করে আওড়ায়,
-” লে বাবা! আমার পরে বিয়ে হয়ে নীরব-প্রত্যাশা এত বড় বাচ্চা পেল কই থেকে?”
পরপর জিভ কা’মড়ে ফের বিড়বিড় করে বলল,
-” ধূরু! আমিও না কী যা তা বো’কার মতো ভাবছি। বাই দ্য ওয়ে বাচ্চা মেয়েটা নীরবকে পাপা ডাকছে কেনো? হুয়াই?”
#চলবে