#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২৯|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
রাত্রি এগারোটা দশ। প্রত্যাশা জানালার গ্রিল দু’হাতে ধরে দাঁড়িয়ে। আকাশে কালো মেঘের ভেলা বাতাসের সাথে যেনো উড়ছে। মূহুর্তেই মিটিমিটি আলো ছড়ানো চাঁদটাকে গ্রাস করে নিল একদল মেঘেরা। প্রত্যাশার মনেও ঘনকালো মেঘ জমেছে। বিষণ্ণতায় ডুবে আহত হৃদয়ে ছলছল চোখে শুণ্যে তাকিয়ে মেয়েটা। কাল রাতে নীরবের বলা প্রতিটি কথা সূচের মতো বুকে বিঁধছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
রুমের ভেতরটা অন্ধকার। ভেজানো দরজার ফাঁক ফোকর গলে আবছা আলো রুমে ঢুকছে। সেই আলোয় প্রত্যাশাকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে অধরার ভ্রু বেঁকে যায়। একহাতে সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই ঘরটা ফকফকা আলোয় ঝলমল করে ওঠে। চমকে ওঠে চকিতে ঘুরে তাকায় প্রত্যাশা। অধরা এগিয়ে এসে ভাতের প্লেট, গ্লাস বেড টেবিলে রেখে শুধালেন,
-” প্রত্যাশা? লাইট নিভিয়ে, ঘর অন্ধকার করে ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে?”
প্রত্যাশা তড়িঘড়ি করে চোখের জল মুছল। গলা সামলে আমতা আমতা করে বলল,
-” ই-ইয়ে মানে, জানালার পর্দা ঠিক করছিলাম।”
-” অন্ধকারে পর্দা ঠিক করতে গেলি?”
মা’কে কোনো কিছু বুঝতে দিতে চায় না প্রত্যাশা। তাই নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক দেখাতে মিথ্যে বলল,
-” শুতে যাচ্ছিলাম, তখন খেয়াল হলো। তাই…”
-” আচ্ছা হয়েছে হয়েছে। এবার আয় তো খেয়ে নে। সেই দুপুরে কী একটু খেলি, দেখলাম না। আবার এখন বলছিস পেট ভরা, খাবি না।”
প্রত্যাশা মুখটা ছোট করে বলল,
-” আম্মু খা….”
অধরা কথা কেড়ে নিলেন। শাসিয়ে উঠলেন,
-” একদম বেশি কথা বলবি না। আয় আমি খাইয়ে দিচ্ছি। তোর পছন্দের সর্ষে ইলিশ করেছি আজ। তোর না খুব পছন্দ!”
আম্মু শুনবে না তাই অগত্যা প্রত্যাশা বিছানার একপাশে চুপটি করে বসল। অধরা ভাত মাখিয়ে এক লুকমা তুলে গালের সামনে ধরলেন। মেয়ের মুখটা স্বাভাবিক লাগলো না। সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
-” মুখটা ওমন শুকনো লাগছে, মন মরা ঠেকছে, কিছু হয়েছে কী? হ্যাঁ রে প্রত্যাশা সবকিছু ঠিক আছে তো?”
বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল প্রত্যাশার। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে বলতে ইচ্ছে করল— আম্মু সবকিছু ঠিক নেই। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। উনি আমায় বিশ্বাস করলেন না। কত কী বললেন। আমি সেসব মেনে নিতে পারছি না। আমার ভেতরটা কষ্টে ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। ভ’য় হচ্ছে, সবাই আমাকেই দোষারোপ করবে, অবিশ্বাস করবে। কেউ আমায় বুঝবে না। আর আমি জানি না, আমি কীভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবো? আমার কী করা উচিত আমি সেটাও বুঝতে পারছি না।
নিজেকে সামলাল প্রত্যাশা। কথাগুলো বলতে পারল না। সবটা দু’জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইল। দৃঢ় মনোবল আর বিশ্বাস নিয়ে মনটাকে শক্ত করল। কতটুকু শক্ত হলো জানে না। তবুও মন বলছে—- যেহেতু আমি জানি, আমি সজ্ঞানে কোনো অন্যায়, পাপ করিনি। তাই একদিন না একদিন সত্যিটা সামনে আসবেই। মিথ্যে বিলুপ্ত হবে। সেদিন অবিশ্বাস ভাঙ্গবে। তারপর ক্ষতও হয়তো শুকাবে। তবে শুকালেও ক্ষ’তের ফলে থেকে যায় যে একটা সুক্ষ্ম দাগ। সে দাগটা কী পুরোপুরি মিলানো সম্ভব?
পৃথিবীতে হাজারো কষ্ট-বেদনা, গুমরে ম*রা, ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া, আড়ালে কান্নার স্রোত বয়ে ফেলা, এসব কিছুকে আড়াল করার একমাত্র হাতিয়ার—হাসি। হাসির আড়ালে সকল কষ্ট, যাতনা নিমিষেই অন্যদের অগোচরে রাখা যায়। সব কষ্ট ভেতরে ঠেসে প্রত্যাশা ফট করে ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে নিলো। বলল গমগমে স্বরে,
-” কই না তো, কিছু হয়নি তো। আর মন ম’রা লাগবে কেনো, এইতো আমি হাসছি, খাচ্ছি। ঠিকই তো আছে সব।”
নিজ হাত দিয়ে মায়ের হাতটা মুখের সামনে ধরল প্রত্যাশা। চটজলদি খাবার মুখে নিলো। অধরা হঠাৎ বললেন,
-” নীরব আজ ভেতরে এলো না যে? দেখা করেও তো যেতে পারতো।”
-” ইচ্ছে সাথে ছিলো। ইচ্ছেকে দিয়ে উনাকে অফিসে যেতে হবে। তাই নামলেন না।”
-” ওহ্।”
ফের কিছু মনে পড়ার ভঙিতে বললেন অধরা,
-” সেই সকালে এসে থেকে তোকে চুপচাপ দেখছি। বাইরেও বের হচ্ছিস না। আমি ভাবলাম ও বাড়ির কেউ কিছু বলেছে নাকি।”
প্রত্যাশা জোর করে মুখের হাসিহাসি ভাব ধরে রাখল। ব্যথাতুর হৃদয়টা ভেঙে যাচ্ছে নিঃশব্দে। তবুও বলল ভেঙে ভেঙে,
-” ও বাড়ির সবাই কত ভালো না? ওরা কিছু বলবে, আম্মু তোমার মাথা ঠিক আছে! ওনারা সবাই তো আমাকে কত আদর করে।”
অধরা প্রশান্তির সহিত হাসলেন। সায় দিয়ে বললেন,
-” হ্যাঁ নিভানদের ফ্যামেলিটা খুব ভালো। ছেলে ভালো, ফ্যামেলি ভালো, সবকিছু পজেটিভ দেখেই তো নিভানের বাবা বিয়ের প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে গেলাম। নইলে কী আমার পা’গ’লি মেয়েটাকে এত তাড়াতাড়ি পরের বাড়ি পাঠাতে রাজি হতাম?”
প্রত্যাশার মুখটা নিমিষেই মিইয়ে গেল। আকস্মিক মনে উঠল— নীরব কীসের দয়া দেখিয়েছে?
মনে মনে উত্তর সাজাল। নিজেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেই আওড়ায় —-আমি কোনো দিক থেকেই উনার যোগ্য নই। শুধুমাত্র বাবার কথায় বিয়েটা করে দয়া দেখিয়েছেন, উনি হয়তো এটাই বলতে চেয়েছেন?
কথাটা প্রত্যাশার বুকের এফোঁড়ওফোঁড় বিঁধে আছে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এলো।
.
প্লেট রেখে হাত ধুয়ে মেয়ের রুমে ফের এলেন অধরা। দরজার ওপার থেকেই হাঁক ছেড়ে বলতে বলতে আসলেন,
-” প্রত্যাশা দ্যাখ তো, কোন ডিজাইনটা তোর মনে ধরে।”
প্রত্যাশা বিছানার হেডে গা এলিয়ে বসেছিল। সোজা হয়ে বসে মায়ের দিকে প্রশ্নবোধক চাউনিতে তাকাল। অধরা পাশে বসে ফোনটা ধরলেন মেয়ের সামনে। একটা একটা পিক বের করলেন আর জিজ্ঞেস করলেন—কোন ডিজাইনটা বানাতে দিবেন। প্রত্যাশা নির্বাক। ও কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। অধরা উৎসুক চোখমুখে বললেন,
-” ছবির ডিজাইন দেখে বল। ভেবেছি দুএকদিনের মধ্যেই গহনা বানাতে দিবো। যেগুলো আছে সেসব কেমন পুরোনো ডিজাইন মনেহয়। নতুন করে একসেট না বানালে চলে? আর হাতে বেশি সময়ও নেই। এই তো পরের সপ্তাহ থেকে তোর পরীক্ষা শুরু। দেখতে দেখতে, চোখের পলকে পরীক্ষার দিনগুলো চলে যাবে। তারপরই তো বিয়ের অনুষ্ঠান। তখন তাড়াহুড়োর মধ্যে ভালো হবে না, তাই এক্ষুনি ধীরেসুস্থে সব এগিয়ে রাখছি।”
থেমে ফের বললেন,
-” কালকে নীলা আসবে। ওর সাথে স্বর্ণকারের কাছে যাবো। তুই এখন বল কোনটা পছন্দ হলো?”
ফোনের স্ক্রিনে চোখজোড়া থাকলেও মন আছে শুণ্যতায়। প্রত্যাশার এসব কিছু ভালো লাগছিলো না। যেখানে নীরব নিজে বলেছে, সম্পর্কটা অনিশ্চিত। সেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান, গহনা-গাটি সবকিছু প্রত্যাশার কষ্টকে দ্বিগুণ করল। ফাপরে পরার মতো শ্বাস ফেলল। বলল অধৈর্য হয়ে,
-” আম্মু, যেকোন একটা চুজ করো তো। আমার ভালো লাগছে না।”
অধরা কিছুটা হতাশ হলেন। মুখ গোজ করে বললেন,
-” তোর জন্য গড়াচ্ছি, তুই নিজে পছন্দ করবি না?”
যে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সেখানে এসব নিয়ে আদিখ্যেতা করতে ইচ্ছে করল না। নিজেকে সামলে, বলল কোন রকমে,
-” এবারের মতো আমার পছন্দটা তোমার আর আপুর উপর দিয়ে দিলাম। তোমরা একটা পছন্দ করে নিও। তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ।”
অধরা বললেন,
-” আচ্ছা, ঠিক আছে। এইযে দেখালাম, হাজারবার পইপই করে বললাম। পাছে পছন্দ না হলে কিছু বলতে পারবি না কিন্তু।”
এই বলে অধরা উঠে দাঁড়ালেন। চলে যেতে শশব্যস্ত হলেন। তন্মধ্যে প্রত্যাশা শুণ্যে তাকিয়ে আচমকা অন্যমনস্ক হয়ে বলে উঠল,
-” আম্মু, একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে? যা বলবে ভেবে সত্যি করে।”
অধরা চিন্তিত বদনে চাইলেন।
-” হুঁ, বলবো। তবে কী কথা?”
-” রাগের সময় যা বলা হয়, সেসবই কী মনের কথা থাকে? মুখ ফস্কে সত্যিটাই কী বেরিয়ে আসে?”
অধরা মেয়ের মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন। না বুঝলেও কিছু অনুমান করলেন। পর মূহুর্তে পাশে বসে ধীরে ধীরে শান্ত গলায় বললেন,
-” না মা, সব কথা ধরে নিতে নেই। রাগের সময় মানুষ অনেক কিছু বলে ফেলে; যা তার মনেও ছিল না, এমনকি যার অর্থ কী, সেটাও ভাবে না। তখন মাথা গরম থাকে, হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। নিজের কথার ওজন বুঝে ওঠার মতো অবস্থায় থাকে না সে।”
একটু থেমে আদর করে প্রত্যাশার মাথায় হাত রাখলেন। মৃদু হেসে বললেন,
-” এইযে দেখিসই তো রাগ হলে ঝ’গড়ার সময় তোর আব্বুকে কীভাবে ঝাড়ি।”
থেমে সিরিয়াস ভাবে ফের বললেন,
-” তোর আব্বুকে রেগে অনেক কিছু বলে ফেলেছি জীবনে। কিন্তু তার মানে এই না, আমি সব সত্যি মনে করেই বলেছি। সম্পর্ক থাকলে রাগারাগি, ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়। যা রাগের মাথায় বলা সেসবই সত্যি নয়। রাগের মাথায় বলা কথা ধরলে এই পৃথিবীর ৯০% নারী পুরুষের সংসার টিকতো না। রাগের সময়কার কথা না ধরে, ভালো ভালো বিষয় বড় করে ধরতে হয়। দেখতে হয় সে শুধু রাগই করে, নাকি তার ভালো, যত্ন, আগলে রাখা এসব ব্যাপারও আছে। সব মিলিয়ে একজনকে বাছবিচার করতে হয়। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”
নিজের জীবনের উদাহরণ টেনে মেয়েকে বুঝালেন অধরা। তবে জিজ্ঞেস করলেন না। মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, স্বামী স্ত্রীর মনোমালিন্য হতেই পারে। কোনো সমস্যা হলে দুজনেই মিটমাট করে নিবে। মেয়ে যেহেতু নিজ থেকে কিছু বলছে না, তাই আগ বাড়িয়ে আর কিছু শুধালেন না। মেয়ের বুদ্ধি বাড়ুক, বুঝ আসুক, সুখে-শান্তিতে থাকুক — মনেমনে শুধু এই প্রার্থনাটুকুই করলেন।
প্রত্যাশার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল—-নীরবের কেয়ারগুলো। বিয়ের পর থেকে নীরবের এক্টিভিস্ট গুলো আওড়ালো। সেখানে সেই শুরু থেকে নীরবকে ওর প্রতি যথেষ্ট কনসার্ন কেয়ারিং পেয়েছে। সেদিন সবার সামনে নিজেকে খাটো করেছে, কথা শুনেছে। তবুও প্রত্যাশাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে দেয়নি।
প্রত্যাশার নিজের এক্টিভিস্টের খাতায় নিজেকে শুণ্যে পেলো। এখন অবধি নীরবের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করেছে কী? আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্ত্রী সুলভ আচরণটুকু কখনো শো করেছে কী? হয়তো ওভাবে সুযোগ আসেনি। তবে উনি যে সার্থককে পছন্দ করেন না তা বোঝানো হয়েছে, বলাও হয়েছে। তবুও প্রত্যাশা বোঝার চেষ্টাটুকু করা দূর আরো যেনো হেসে উড়ে দিয়েছিলো। ইশশ্! নীরবের সেই কথাটা শুনলেই তো আজ এতদূর আসে না। হয়তো এই সমস্যাটুকু আসতো না জীবনে।
_____________
রাত গভীর। বাড়ির সবাই ঘুমের অতলে তলিয়ে আছে। ঘুম নেই নীরবের চোখের পাতায়। হাতে কফির মগ। এইতো মাত্র সে নিজে বানিয়ে আনল। কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে। সিম সার্থকের এনআইডি দিয়ে খোলা। সিম বন্ধ থাকার জন্য সিমের মালিকের অবস্থান ট্্যাক করা যায়নি। তবে সিমটা সার্থকের নামে রেজিষ্ট্রেশন করা থাকায় সমীকরণ দাঁড়াচ্ছে—- সার্থক নিজেই কী তবে নীরবকে খাটো করতে, নীরব-প্রত্যাশার সম্পর্কে ফাটল ধরাতে ছবিগুলো পাঠিয়েছে?
যেহেতু সার্থক প্রত্যাশাকে পছন্দ করতো। তাই সবকিছুর নীল নকশাকারী স্বয়ং সার্থক হবে এটা অস্বাভাবিক নয়। এখন কুয়াকাটায় সেদিন কী ঘটেছিল? কীভাবে ঘটেছিলো? ঘটানো হয়েছিলো? সব উত্তর জানতে কুয়াকাটা যাওয়া জরুরী। অতবড় নামকরা বিলাসবহুল হোটেলের কোণায় কোণায় নিশ্চয় সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। সেসব চেক করে যদি কিছু পাওয়া যায়।
এদিকে অফিশিয়াল ডিউটি থাকায়। সামনের দু-তিন নীরব খুব ব্যস্ত থাকবে। তাই দু-তিনের মধ্যে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। আবার এমন একটা ব্যাপার অন্যের উপর দায়িত্বও দেওয়া যায় না। নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারটা নীরব নিজেই দেখবে। হোক একটু দেরি।
মাথার মধ্যে ভনভন করছে দুশ্চিন্তা। নীরবের নিজেকে এলোমেলো লাগছে। ভালো লাগছে না কোনো কিছুই। কোনো কিছুতেই এক দন্ড শান্তি মিলছে না। কিছু একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। উফ্! প্রত্যাশার ক্রন্দনরত মুখটা চোখের সামনে ভাসছে বারবার।
ঠান্ডা, তেতো, স্বাদহীন শেষ কফিটুকু এক চুমুকে গিলে নেয় নীরব। চারিপাশের নিস্তব্ধতা গুমোট হয়ে মাথার ভেতর শব্দ তুলছে। আকস্মিক ভাবল প্রত্যাশার রেখে যাওয়া প্রশ্ন নিয়ে —–
-” উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া মেয়ের সংজ্ঞা কী?”
চোখ বন্ধ করে ভাবল। প্রত্যাশার মুখ ভেসে উঠল—
না, ওকে একেবারেই সেরকম বলা যায় না। ও চঞ্চল, আবেগপ্রবণ। বয়স অনুযায়ী একটু বেশিই ইম্যাচিউর বটে, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া বলা যায় না। বুঝিয়ে বললে ও শোনে। তবে নিজের প্রতিই ও সচেতন নয়। প্রত্যাশা খুব সরল। সরলভাবে দুনিয়া দেখে। আর দেখে বলেই সবসময় বিপদের মধ্যে হেঁটে যায়। বারবার বিপদে জড়িয়ে পড়ে।
প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ভাবে নীরব— ওর বয়স অল্প, কিন্তু অভিজ্ঞতার ঘাটতি যেমন অনেক। দুঃখের বিষয় ও কিছুতেই শিক্ষা নেয় না। নিজেই নিজেকে বিপদে ফেলতে উস্তাদ।
নীরব ক্লান্ত ভঙিতে চোখদুটো বুঁজে নিল। চেয়ারের হেডে কাঁধ এলিয়ে মনেমনে বলে ওঠে,
-” যদি সত্যিই ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়, তবু এক ফোঁটা দোষ হলেও ওর আছেই। আমি ওকে কতবার বলেছি, সাবধান হতে। বুঝিয়েছি ইভেন বলেছি সার্থকের থেকে দূরে থাকতে। আজ আমার এই কথাটা অন্তত শুনলে, আজ এতবড় অঘটন ঘটে না।”
এই কথাটা মনে উঠলেই নীরবের প্রচন্ড রাগ হয়। তখন পজিটিভ চিন্তাগুলোও কেমন দূর্বল হয়ে আসে। ভেতর থেকে রাগ-ক্ষোভ হতাশা আবার বেরিয়ে এল,
-” একটা মেয়ের বেসিক কিছু কমন সেন্স থাকে, যা প্রত্যাশার নেই। একটা ছেলের চোখের ভাষা মেয়েরা খুব সহজেই পড়তে পারে। এটা বোঝার একধরনের সহজাত প্রবৃত্তি থাকে মেয়েদের। এদিকে প্রত্যাশা মাত্রারিক্ত নির্বোধের পরিচয় দিয়ে থাকে। ওর নিজের প্রতি কোনো রকম সতর্কতা নেই। কোনো প্রটেকশন নেই। বরং প্রত্যাশা এমন পরিবেশ তৈরি করে ফেলে, যেখানে অপরপক্ষ আরও এগিয়ে আসার সুযোগ পায়। একটু নিজের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকলেও আজ এই পরিস্থিতি আসত না।”
_____________
সকাল থেকেই আষাঢ়ের আকাশ ভারী মেঘে ঢাকা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। বায়োলজির প্র্যাকটিক্যাল খাতায় স্বাক্ষর নিতে প্রত্যাশা কলেজে এসেছিলো। পরনে আকাশি-সাদা ইউনিফর্ম, পিঠে ব্যাগ, মাথার ওপর ব্যান্ড দিয়ে চুলগুলো ঝুঁটি করে বাঁধা। এক হাতে ছাতা ধরে ফুটপাত ধরে হাঁটছিল।
হঠাৎ ওর চোখ পড়ল— দেয়াল ঘেঁষে বসে থাকা এক পা’গ’লী মা তার কোলের ছোট্ট শিশুকে ছেঁড়া, ময়লা ওড়নার নিচে লুকিয়ে রাখছে। বৃষ্টির পানিতে যেন ভিজে না যায়। দৃশ্যটা হৃদয় ছুঁয়ে গেল। প্রত্যাশার মনে হালকা কষ্টের স্রোত বয়ে গেল। অস্ফুটে ‘আহারে’ বলে ছাতাটা পা’গ’লীর মাথার ওপর ধরে বলল,
-” এটা তুমি রাখো। একটু হলেও কাজে লাগবে।”
পাগ’লীটি কিছু বলতে পারল না, তবে তার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ল একরাশ প্রশান্তি ও কৃতজ্ঞতার হাসি। একটু দূরের একটি টং দোকান থেকে প্রত্যাশা পাউরুটি আর কলা কিনে এনে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে ফের হাঁটতে শুরু করল।
আজ দু-তিন হতে চলেছে না নীরব ফোন দিয়েছে আর না তো প্রত্যাশা। এরমধ্যে দুজনের দেখা, কথা কিছুই হয়নি। সবার সামনে স্বাভাবিক আচরণ করলেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। নাম না জানা ব্যথায় হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে।
বিষণ্ণ চিত্তে হাঁটছে প্রত্যাশা। রিকশার দেখা মিলছে না। বৃষ্টির শব্দ ততক্ষণে তীব্র হয়েছে; গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির জায়গায় এখন ঝমঝমিয়ে ঝরছে। ভিজে যাচ্ছিল প্রত্যাশা, অবশেষে এক চায়ের দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়াল।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে উঠল। হঠাৎ চোখ পড়ল সাদা জুতোর দিকে, এক পায়ের ফিতেটা খুলে গেছে। হাঁটু মুড়ে বসে ফিতা বাঁধতে লাগলো প্রত্যাশা। এমন সময় রাস্তার পাশে জমে থাকা কাঁদা পানির উপর দিয়ে ছুটে এলো একটি বাইক। ছিটকে উঠে কাদা পানি প্রত্যাশার পোশাকে আর মুখে লাগে।
প্রত্যাশা রাগি দৃষ্টিতে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। বাইকে তিনজন হ্যাংলা-পাতলা ছেলে। বাইকটা সামনে গিয়ে থামল। তারা হুড়মুড় করে ছাউনির তলায় ঢুকে পড়ল। প্রত্যাশা রাগে গজগজ করলেও মুখে কিছু বলল না।
ছেলে তিনটেকে দেখতেই বখাটে লাগছে, একজনকে অবশ্য চেনে প্রত্যাশা। ওদের সাথেই পড়ে, তবে নামকা ওয়াস্তে পড়ে। বখাটেপনাই করে বেড়ায়। ছেলেগুলো ঠোঁটে সিগারেট ধরিয়ে প্রত্যাশাকে স্ক্যান করতে থাকে। মূহুর্তেই সিগারেটের ধোঁয়ায় চারিপাশ ছেয়ে যেতে থাকল। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে একজন হেরে গলায় গান ধরল, আরেকজন সিটি বাজাতে লাগালো। প্রত্যাশা খুকখুক করে কাশল। ওর অস্বস্তি হচ্ছে।
.
নীরবকে সিভিল ড্রেসে পাঠানো হয়েছে একজন ব্যবসায়ীর সাথে দেখা করতে, যে কিনা গোপনে মা’দক পা’চারের সাথে জড়িত বলে গোয়েন্দা সূত্রে সন্দেহ করা হয়েছে। পু’লিশ সরাসরি গ্রেপ্তার না করে আগে প্রমাণ সংগ্রহ করতে চায়। নীরব ক্লায়েন্ট সেজে সেই ব্যক্তির সাথে কফিশপে কফি খেতে খেতে কথার ছলে সন্দেহভাজনের থেকে তথ্য জোগাড় করছে।
বিদায় নিয়ে কফিশপের থেকে বের হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল নীরব। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কালো প্যান্টের উপর কালো শার্ট ছেড়ে দিয়ে পড়া। চোখে কালো সানগ্লাস। কানে এয়ারপড। হাতঘড়িতে সময় দেখে কানের এয়ারপডটা নাড়ল। ফিসফিসিয়ে কিছু বলল। শেষে বলল,
-” তিনটার দিকে*** এলাকায় পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে দিতে হবে। সব রেডি রাখতে হবে।”
-” ওকে স্যার।”
এরমধ্যে আচমকা নীরবের দৃষ্টিজোড়া খানিকটা দূরে পড়ল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
.
প্রত্যাশা একপাশে সিটিয়ে দাঁড়িয়ে। একজন হঠাৎ বলে উঠল,
-” কি আপু, বৃষ্টি ভালো লাগে? না কি ছায়া বেশি পছন্দ? নাকি ঝলমলে রোদ?”
আরেকজন ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
-” আপু কিছু বলছেন না যে, কী খাবেন বলুন? এক্ষুনি অর্ডার করছি।”
তৃতীয়জন বলল,
-” ঠান্ডার দিনে হট-হট কিছু দে রে। আপুও হট হোক আমরাও…..”
প্রত্যাশার মুখ লাল হয়ে যায় রাগে। গর্জে ওঠে,
-” ভদ্র ভাষায় কথা বলুন।”
ছেলেগুলো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। একজন আরেকজনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
-” ওরে ম্যাডাম রেগে গেছে দ্যাখ! আহারে।”
প্রত্যাশার ভীষণ খারাপ লাগলো। মনে হচ্ছে ভাগ্যই খারাপ। সবসময় সমস্যা ওর কাছে আসে না, ওই যেনো সমস্যার কাছে এগিয়ে আসে। কান্না পেল প্রত্যাশার এখানে এক মূহুর্তও দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো না। বৃষ্টির মাঝে রাস্তায় নেমে পড়ল। লম্বা কদম ফেলে এগিয়ে যেতে নিয়ে হঠাৎ হাতে টান পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে…
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩০|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
ঘাড় ঘুরিয়ে নীরবকে দেখে এক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ময়ে জমে গেল প্রত্যাশা। অবিশ্বাস্য চোখে একবার হাতের বাঁধনের দিকে চাইল, পরপর মুখ তুলে নীরবের মুখের দিকে। কোনো কিছু ঠাহর করার আগেই নীরব এক ঝটকায় টান দিয়ে প্রত্যাশাকে ছাউনীর তলায় নেয়। নীরবের গায়ের কালো শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। ভেজা চুল থেকে টুপটাপ পানি ঝরছে। নীরব প্রত্যাশার হাত ছেড়ে চুল ঝাড়তে লাগল।
রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ চারদিক ঢেকে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু ছেলেগুলোর ভেতরকার শয়’তানি যেন মেঘের গর্জনের মতো গুঁড়গুঁড় করে উঠছে। একজন চোখমুখ কুঁচকে হেসে বলল,
-” এইযে ম্যাডাম একটু আগেই না খুব ভাব দেখালেন। আরে আমরা তো কেবল মুখ দিয়ে একটু ইয়ার্কি করেছিলাম মাত্র, এখন যে আরেকজন সোজা হাত ধরল। তাও কিছুই বললেন না। তখন যে খুব ভালো সেজে চেতে উঠলেন।”
সাথে সাথে প্রত্যাশাদের সাথে পড়া ছেলেটা বলে উঠল,
-” আরে মনেহয় ছোঁয়াতে সুখ পেয়েছে। আর এ বলবে কী! যে কী না কলেজ থেকে ট্যুরে গিয়ে হারিয়ে যায়। নাগরের সাথে সারাদিন কাটিয়ে…..”
প্রত্যাশা অস্বস্তি, অপমানে জড়সড় হয়ে দৃষ্টি নুইয়ে নিল। এরমধ্যে ঠাস, ঠাস শব্দে চারিপাশ কেঁপে উঠল। নীরব দুটোর গালেই সজোরে চ’ড় বসায়। চ’ড় খেয়ে কথা হারিয়ে ছেলেটি ধড়ফড় করে একপাশে কাত হয়ে পরে। আরেকজন গালে হাত দিয়ে রা’গি দৃষ্টিতে তাকায়। সামনাসামনি বুক চওড়া করে নীরব দাঁড়াল। চোখদুটো রাগে লাল টকটক করছে, চোয়াল কঠিন করে বলল,
-” আরেকটা শব্দ বলবি তো দাঁত ভেঙে ফেলবো। মেয়ে দেখলেই তোদের মাথা খারাপ হয়ে যায়, না? অ’শ্লী’ল বলার জন্য জিভ লকলক করে? জিভ টেনে ছিঁড়ে মেয়েদের টিজ করার সাধ মিটিয়ে দিবো।”
তৃতীয়জন বুক টানটান করে এগিয়ে এসে বলল,
-” এই আপনে সাহস পান কই থেকে? আমার বন্ধুদের চ’ড় মারেন। কথা নাই বার্তা নাই গায়ে হাত তুলেন। আবার শাসাচ্ছেন, হিরোগিরি দেখাচ্ছেন?”
কফিশপের সামনে থেকে প্রত্যাশাকে লক্ষ্য করে নীরব। ছেলেগুলো যে টিজ করছিলো বোঝাই যাচ্ছিলো। দ্রুত আসে, এদিকে প্রত্যাশা কোনোদিকে না তাকিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই চলে যেতে নেয়।
ছেলেটা সাহস দেখিয়ে তেড়ে আসতে নিতেই নীরব নাক বরাবর দিল এক ঘু’ষি। মূহুর্তেই গলগল করে র”ক্ত বেরোল। ছেলেটি একহাতে নাক চেপে ধরল। চোখ থেকে কালো সানগ্লাস খুলে শার্টের সাথে গুজল নীরব। তারপর কলার চেপে ধরে বলল,
-” ওকে নিয়ে মজা নিচ্ছিলি, না? টিজ করছিলি। এখন এই মুহূর্তে ওর পা ধরে ক্ষমা চাইবি। স্টুডেন্ট মানুষ তাই দয়া করে জেলে পুরলাম না। এবারের মতো দয়া করলাম।”
এই বলে কলার ধরেই প্রত্যাশার পায়ের কাছে ফেলল। প্রত্যাশা তো চমকে উঠে দু’পা পিছাল। নীরব বাকি দুটোর দিকে তাকিয়ে আঙুল নাচিয়ে ইশারা করে, ছুঁড়ে ছুঁড়ে বলল,
-” তোরা দু’টো দাঁড়িয়ে কেনো? বে’য়াদবির জন্য পা ধরে মাফ চা। বাঁচতে হলে যা বলছি ফাস্ট তাই কর। কুইক।”
দু’জনের একজন শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে এক পা এগিয়ে কণ্ঠে তেজ নিয়ে বলল,
-” কোন হে চ্যাটের বা’ল তুমি? তোমার কথা শুনতে হবে। তিনজন মিলে ধরলে না পালানোরও সুযোগ পাবে না।”
নীরব শান্ত ভঙিতে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করল। পরপর আইডি কার্ড বের করে সামনে ধরতেই ওদের গলা শুকিয়ে আসে। চৌদ্দ শিকে যাওয়ার ভয়ে প্যান্ট ভিজে যাওয়ার জোগাড় হলো। নীরব ধ’ম’কিয়ে উঠল,
-” সে স্যরি… ফাস্ট, বিফোর আই লুজ মাই পেইশেন্স।”
ধ’ম’কে কেঁপে ওঠে ওরা তিনজন হাঁটু মুড়ে প্রত্যাশার সামনে বসল। মাথা নুইয়ে বলল,
-” স্যরি আপু, ভুল হয়েছে।”
নীরব কাটকাট গলায় বলল,
-” এভাবে নয় পা ধরে।”
নীরবের কথায় প্রত্যাশা স্তম্ভিত। ও ইতস্তত করছে। ছেলেগুলো নিরুপায়। পুলিশ ধরলে রক্ষে নেই, পুলিশের বারির কথা স্মরণ হতেই আত্মা শুকিয়ে এলো। সময় ন’ষ্ট না করে তিনটেই একসাথে হাত বাড়িয়ে প্রত্যাশার পা ধরতে গেলে প্রত্যাশা চট করে পিছিয়ে যায়। বলল তড়িঘড়ি করে,
-” এই থাক থাক পা ছুঁতে হবে না।”
নীরব এক হাত পকেটে গুঁজল। অন্যহাতে চুল ব্যাক ব্রাশ করতে করতে বলল,
-” উঁহু! এভাবে কোমল স্বরে আপু বলে স্যরি বললে চলবে না। মুখটা সর্বোচ্চ অসহায় বানিয়ে বল– আম্মা ভুল করেছি, মাফ করে দিন।”
প্রত্যাশার চোখ ছানাবড়া। নীরব নির্লিপ্ত। প্রত্যাশা একবার নীরবের দিকে তাকিয়ে ফের ছেলেগুলোর দিকে তাকাল। ওরা অসহায় মুখ বানিয়ে কাঁদো কাঁদো সুরে আপু থেকে আম্মাতেই আসলো,
-” আম্মা, মাফ করে দ্যান। ভুল হয়েছে আমাদের। দয়াকরে তাড়াতাড়ি মাফটা দিয়ে দিন।”
প্রত্যাশা হাত নেড়ে বলল,
-” হয়েছে হয়েছে, আর মাফ-টাফ চাইতে হবে না। করেছি মাফ।”
তিনটেই ঘাড় তুলে শুকনো ঢোক গিলে নীরবের দিকে তাকাল। একদম মিহি স্বরে ভ’য়ে ভ’য়েই বলল,
-” স্যার এবার যাই।”
-” যা। তবে আজকের কথা যেনো মনে থাকে। নেক্সট কখনো কোনো মেয়েকে অসম্মান করতে দেখলে সোজা লকাআপে ভরব। আর হ্যাঁ, আজকের থেকে শিক্ষা নিবি।”
ছেলেগুলো মাথা কাত করে সায় দিয়ে দ্রুত ওঠে দাঁড়ায়। তারপর তুরন্ত তিনজন বাইকে চেপে মূহুর্তেই প্রস্থান করে।
প্রত্যাশা রাস্তা বরাবর তাকিয়ে ছিলো, এরমধ্যে নীরব টিস্যু পেপার প্রত্যাশার সামনে ধরে। প্রত্যাশা প্রশ্নাত্মক চাউনিতে তাকায়। নীরব বলল শান্ত কণ্ঠে,
-” মুখটা মুছে নাও।”
মুখের ডানপাশে তখনকার কাঁদা পানি শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে। প্রত্যাশা মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারল না। নিঃশব্দে টিস্যুটা নিলো। প্রত্যাশার অবচেতন মনটা বলে উঠল— আসলেই উনাকে বোঝা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। আমার দেওয়া ওনাকে মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবল নামটা যথার্থ।
নীরব ত্রস্ত কল লিস্ট থেকে কল লাগাল। রিসিভ হতেই ব্যস্ত স্বরে বলল,
-” তানভীর তুমি কোথায়?”
-” স্যার, আমি তিন রাস্তার মোড়েই আছি।”
-” আচ্ছা, তুমি যেহেতু ওখানে আছোই। আমার একটা হেল্প লাগবে। যত দ্রুত সম্ভব একটা অটো বা সিএনজি***** পাঠিয়ে দাও।”
-” ওকে স্যার।”
-” থ্যাংকস।”
কোনো এক অদৃশ্য জড়তায় প্রত্যাশা কিছুই বলতে পারল না। নীরবও কিছুই না বলে ফোন স্ক্রল করতে লাগলো। প্রত্যাশার তীব্র মন খারাপ হলো। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগলো— এখানে আমি ছাড়া অন্য মেয়ে থাকলেও কী উনি একই রকম আচরণ শো করতেন? পাশে দাঁড়াতেন? নাকি আমি ওনার বউ বলে ওই ছেলেগুলোকে শা”স্তি দিলো! যদি এটাই হবে উনি কিছুই বলছেন না যে।
অভিমানী মন ভাবল — এখনো হয়তো ঘৃ’ণা করেন আমায়। তাই তো কিছুই বলছেন না।
এরমধ্যে একটা সিএনজি আসল। নীরব প্রত্যাশাকে ইশারা করে বলল,
-” যাও, ওঠো।”
তারপর ভাড়া মিটিয়ে দিলো নীরব। প্রত্যাশা সিএনজিতে উঠে বসল। নীরব ড্রাইভারকে আদেশ স্বরুপ বলে পরপর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে— ঠিকঠাক যেনো পৌঁছে দেয়। কোনো সমস্যা হলে খবর আছে। নীরব এপাশে সরে প্রত্যাশার দিকে একপল তাকাল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তন্মধ্যে ভারী স্বরে হঠাৎ বলে উঠল প্রত্যাশা,
-” ঘৃ’ণাই যখন করেন, তখন এত ভালোবাসা দেখানোর কি দরকার ছিলো? এ__”
প্রত্যাশার কথার মাঝেই নীরব বলল,
-” ভালোবাসা দেখাইনি তো, এটা আমার দায়িত্ব ছিলো।
-” বাকিটা জীবন আমি কী শুধুই আপনার দায়িত্ব হয়ে রয়ে যাবো?”
-” যেদিন এই সম্পর্কটা থাকবে না, সেদিন আমার দায়িত্বটুকুও থাকবে না।”
প্রত্যাশার বুক কেঁপে উঠল। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেল।এরমধ্যে সিএনজি চলতে শুরু করে।
নীরব ফোন বের করে অনলাইনে টিকিট কাটল। আজ রাত বারোটার গাড়িতে কুয়াকাটা যাবে সে। যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়। তারপর সূত্র ধরে সবটা প্রুভ করা। ঠান্ডা মাথায় ভেবে নীরব একটা কথায় স্থির হয়— প্রত্যাশা সহজ-সরল, বোকাসোকা। তাই ওকে দিয়ে যে কেউ অনায়াসেই নিজের স্বার্থ হাসিল করে নিতে পারে।
নীরব এ-ও মনেমনে ভাবে—- প্রত্যাশার একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। ওর সাথে এখনই মিশে গেলে, ও সব ভুলে যাবে। আদর পেলে মানুষ পূর্বের খুঁটিনাটি সব ভুলে যায়, কিন্তু অবহেলা শেখায় কোথায় ভুল হচ্ছিল, কারনটা কী ছিলো! ঠিক যেমন ঘা না লাগলে কেউ শরীরের দুর্বল জায়গাটুকু টের পায় না।
______________
আষাঢ়িয়া বারিতে গাছগাছালি সিক্ত। গাছের সবুজ পাতা বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ করে পড়ছে। নীলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, এক হাতে গ্রিল খুটছে আর অন্য হাতে ফোন ধরে কথা বলছে। নীলার মন ভার। ওপাশ থেকে নিভান বলল,
-” নীলাশা তুমি এত আপসেট কেনো হচ্ছো? এক্ষুনি টেনশনের কিছু হয়নি। আমাদের সামনে আরো দীর্ঘ সময় পরে আছে।”
-” ধূর, এবারে আশা করেছিলাম কিছু একটা হবে। তেমন কিছুই হলো না। এ মাসেও হতাশ হলাম।”
-” ব্যাপার না সামনে হবে।”
-” শোনো, আমি ভেবেছি আজকে আমরা ডক্টরের কাছে যাবো। চেকাপ করাবো।”
-” নীলা আরেকটু দেখি?”
নীলা তেতে ওঠে বলল,
-” না, না, নাহ। আমি আর দেখতে-টেকতে পারব না। তুমি তো দুপুরে আসছোই। সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবে। ব্যস!”
নিভান শান্ত গলায় বুঝিয়ে বলল,
-” নীলা শোনো, আমি আমার এক ডক্টর ফ্রেন্ডের সাথে আলোচনা করেছিলাম, সে গাইনোকোলজিস্ট। ওর কথায় যা বুঝলাম, অনেকে কোনো ফ্যামিলি প্ল্যানিং ছাড়াই প্রথম দিকেই কনসিভ করে। আবার অনেকের ছয়-আট মাস বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। এটা নরমাল রেঞ্জের মধ্যেই পড়ে। এমনকি মেডিকেলি ধরা হয়; নিয়মিত ইন্টিমেন্ট এবং কনট্রাসেপশন ছাড়াই এক বছরের মধ্যে যদি গর্ভধারণ না হয়, তখন সেটা ইনফার্টিলিটি হিসেবে ভাবা যায়। আমাদের তো বিয়ে হয়েছে সাত মাসও হয়নি। তাই এই মুহূর্তে চিন্তা করার বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আরেকটা মাস দেখে নিই। তারপর যদি না হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা পরবর্তী ধাপে যাবো। কেমন?”
বান্ধবী তারপর ভাবি-টাবিদের থেকে শুনেছে নীলা বরেরাই বাচ্চা বাচ্চা করে পা’গল বানিয়ে দেয়। নীলা অধৈর্য হয়ে ভাবল — নিভান এর কোনো হেলদোল, আগ্রহ নেই। আর অধৈর্য হলো বলেই ঝারি মে’রে বলল,
-” কেমন গো তুমি, তোমার কোনো শখ আহ্লাদ নেই। তোমার ছোট এক ভাইয়ের পাঁচ বছর বয়সী এক মেয়ে। নীরব প্রত্যাশার কখন জানি খবর আসে; বাচ্চা হবে। এদিকে তুমি বড় হয়ে আঁটকুড়ে হয়ে থাকো। প্রত্যাশা মা হোক আমি হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।”
নিভান খুকখুক করে কেশে উঠল। সামলে বলল,
-” নীলা তুমি কীসব বাচ্চামো কথাবার্তা বলছো! আশ্চর্য! কনসিভ করা নিয়েও তুমি মনেমনে প্রত্যাশার সাথে কম্পিটিশনে নেমেছো।”
নীলা কাটকাট গলায় বলল,
-” আমি অতশত জানি না। তুমি আসছো, আর আজই আমরা ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। দ্যাটস ফাইনাল।”
নিভান হাসল। হেসে বলল,
-” ওকে ওকে জান। তবে আমার কী মনেহয় জানো?”
-” কী?”
নিভান ফাজলামির সুরে বলল,
-” ডক্টরের উচিত প্রেসক্রিপশনে মোটা দাগে লিখে দেওয়া —- আপনার বরকে বেশি বেশি আদর করার সুযোগ দিন। যখন আবদার করবে, না করা চলবে না। তাহলেই অতিসত্বর আপনি মা হতে পারবেন….”
নীলার গাল লজ্জায় লাল হলো। লজ্জা আড়াল করতে রাগ দেখিয়ে বলল,
-” নিভান, আজেবাজে কথা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে আসো।”
-” নিশ্চয় জান। তুমি কিন্তু রেডি থেকো।”
-” ফা’জি’ল একটা।”
নিভানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নীলা কল কা’ট’ল।
.
.
লাঞ্চ আওয়ারে শফিক সাহেব বাড়ি এসেছেন। অটো থেকে নেমে বাসায় ঢুকতে গিয়ে হালকা ভিজে গিয়েছেন। অধরা তোয়ালে এনে দিলেন। শফিক সাহেব তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন,
-” প্রত্যাশা কী করে?”
নীলা টিভি দেখছিলো। বিড়বিড় করল— এসেই ওর কথা জিজ্ঞেস করা লাগে। যত্তসব, আদিখ্যেতা। আব্বু-আম্মুকে দেখে মনেহয় আমিই কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। আর প্রত্যাশাই ওদের আপন পেটে ধরা মেয়ে।
অধরা ঘড়ির দিকে একবার তাকালেন তারপর দরজার দিকে। কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করে বললেন,
-” প্রত্যাশা কলেজে গিয়েছে। এখনো ফিরল না। এত বৃষ্টি হচ্ছে, মেয়েটা কোথাও আটকে আছে না তো। একবার ফোন দিয়ে দেখো তো কোথায় আছে?”
শফিক সাহেব পকেট থেকে ফোন বের করলেন। চুলোয় তরকারি থাকায় অধরা ত্রস্ত কিচেনে গেলেন। কল দিবেন এমন সময় নীলা বলে উঠল,
-” ওইযে এসেছে।”
দরজাটা খোলা ছিলো। প্রত্যাশা বিবর্ণ মুখটা নিয়ে এগিয়ে আসছে। কপালের উপর থাকা ছোট ছোট চুলের ডগা বেয়ে টপটপ পানি পড়ছে। শফিক সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” প্রত্যাশা মা ভিজে গেছো দেখছি। যে বৃষ্টি হচ্ছে আসতে কোনো সমস্যা হয়নি? রিকশা পেয়েছিলে? বৃষ্টির দিনে রিকশা, অটোদের তো আবার হাইপ বেড়ে যায়। খালি বসে থাকবে, ভাড়া তো দ্বিগুণ বলবেই তারপরও তোষামোদ করতে হয়।”
প্রত্যাশা শুকনো হেসে বলল,
-” না আব্বু সমস্যা হয়নি।”
-” জলদি মাথা মুছে নাও। নইলে আবার জ্বর সর্দি হবে। সামনে পরীক্ষা এখন জ্বর-টর হলে বিপদ।”
তোয়ালে বাড়ালেন মেয়ের দিকে। প্রত্যাশা পিঠ থেকে ব্যাগ নামিয়ে সোফায় রাখল। তোয়ালে নিয়ে মাথা মুছতে লাগলো। শফিক সাহেব আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
-” প্রত্যাশা পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন? আজ ক’দিন তো সবসময় বই নিয়েই বসে থাকতে দেখি। তা এবারে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে তো।”
প্রত্যাশা উত্তর দিলো না। বাবার গা ঘেঁষে বসল। হঠাৎ বলে উঠল,
-” আমি জানি এই পরীক্ষার রেজাল্ট খুব ভালো হবে না। কারন আমি আগে কখনোই সিরিয়াস হইনি। তবে আব্বু আমি কথা দিচ্ছি এরপর থেকে পড়াশুনায় মনোযোগ দিবো, খুব খুব সিরিয়াস হবো। আমি পাবলিকে চান্স পাবো না, আমার সে মেধা নেই। আব্বু তুমি কী আমাকে প্রাইভেটে ভর্তি করাবে? আমি দূরে ভালো কোথাও ভর্তি হতে চাই। সেখানে আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ দিবো, চেষ্টা করব। চেষ্টা করলে নাকি মানুষ সব পারে। আমি সেই চেষ্টাটুকু করতে চাই। কিন্তু প্রাইভেটে তো খরচ বেশি।”
নীলা শব্দ করে হেসে উঠল। বলল খোঁচা মে”রে,
-” এ আমি কী দেখছি। মনে হচ্ছে ভূতের মুখে রাম রাম শুনছি। ইয়া আল্লাহ! পড়াশোনায় সিরিয়াস হবি তুই? যেখানে আম্মু ছোট থেকে পিটিয়েও পারেনি। যেটুকু পড়েছিস ফেল ঠ্যাকাতে, ক্লাস বাই ক্লাস উঠতে। সে নাকি এখন শেষকালে এসে সিরিয়াস হবে। হাউ ফানি!”
শফিক সাহেব বির’ক্ত মুখে বললেন,
-” আহ্ নীলা মা হাসার কী হলো! আর ছোটবোনকে কোথায় আরো উৎসাহ দিবে, তা না হাসিঠাট্টা করছো।”
নীলা হাতের রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করল। ঘুরে বসে সিরিয়াস গলায় বলল,
-” শোনো আব্বু আমার কথা মিলিয়ে নিয়ো। প্রত্যাশাকে প্রাইভেটে ভর্তি করে শুধু শুধু টাকা নষ্ট করা ছাড়া কিছুই হবে না। ও পড়বে, সেই পড়া দিয়ে কিছু করবে? ওকে অক্সফোর্ডে ভর্তি করলেও লাভ হবে না। কথায় আছে না যে লাউ সেই কদু। প্রত্যাশাটা আজীবন অমনই থাকবে।”
প্রত্যাশার চোখ ভিজে এলো। অধরা খুন্তি হাতে রান্নাঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জোরেশোরে বললেন,
-” এসএসিতে গোল্ডেন, ইন্টারে প্লাস, অনার্স – মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে তুই মনেহয় খুব কিছু করে ফেলেছিস। প্রথমবার বিসিএস দিতে গিয়েই প্রিলিমিনারি থেকেই আউট হলি। এখন তো সেসবের চেষ্টাও বাদ দিয়ে সংসার করবি বললি। সেই সংসারটাও কতটুকু মন দিয়ে, সবার সাথে মিলেমিশে, সবার মন জয় করে করছিস শুনি?”
নীলার মুখটা ভোঁতা হলো। অধরা প্রসঙ্গ বদলিয়ে শফিক সাহেবকে বললেন,
-” শুনছো, বিরিয়ানির মসলা দেখছি নেই। একটু এনে দিবে তাড়াতাড়ি।”
শফিক সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
-” নীলা মা ছাতাটা এনে দাও তো।”
নীলা মুখ কালো করে বলল,
-” প্রত্যাশার কাছেই তো ছাতা আছে। এখন ওরটা নিয়েই যাও।”
প্রত্যাশা বলে উঠল,
-” আমার ছাতা টা তো নেই।”
নীলা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
-” নেই মানে। সকালেই তো নিয়ে বেরোলি।”
প্রত্যাশা আমতা আমতা করে বলল,
-” ওটা একজনকে দিয়েছি।”
সবশুনে শফিক সাহেব বললেন— ঠিক আছে, ভালো করেছো। অধরা ভেতর থেকে আরেকটা ছাতা আনতে গেলেন। নীলা নাকমুখ কুঁচকে বলল,
-” অন্যের টাকার কেনা জিনিস তো, কোনো দরদ নেই। তোর কী, একটা দিলে আব্বুকে বললে আরেকটা নতুন পাবি। অন্যের টাকা পয়সা দিয়ে হাতেম তাঈ সাজার অভ্যেস তোর যাবে না। নিজের কিছু দান করে দেখিয়ে দিস।”
প্রত্যাশা বলল,
-” আমার নিজের বলতে তেমন কিছুই নেই। তবে থাকলে, কেউ চাইলে আমি নিশ্চয় দিবো। যদি আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে।”
নীলা ভেংচি কে’টে বলল,
-” আচ্ছা, আচ্ছা আজ যে বড় করে বললি, কোনোদিন সময় এলে দেখবো। দেখবো কতটা উদার আর মহৎ তুই।”
অধরা ছাতা স্বামীর হাতে দিয়ে দু’টোকে ধমক দিলেন। সবসময় তর্কাতর্কি। শফিক সাহেবকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন,
-” বড় জামাইকে ফোন করে দাওয়াত দিয়েছো। ছোট জামাইকে আবার বলেছো তো? নাকি খেয়াল নেই!”
-” হ্যাঁ, দু’জনকেই ফোন করে বলেছি। তবে নীরব বলল— ও ডিউটিতে আছে। খুব ব্যস্ত। তাই আসা সম্ভব হবে না।”
কথাটা বলতে বলতে শফিক সাহেব বেড়িয়ে গেলেন। প্রত্যাশা ব্যাগ হাতে তুলে রুমে যাবে বলে দাঁড়িয়েছে। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে—- ওনাকে তো একটু আগেই ক্যাসুয়াল ড্রেসে দেখলাম। হয়তো আসবে না বলেই ডিউটির অজুহাত দিয়েছে।
____________
একদিন পর..
মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে প্রত্যাশার। অস্থির ঠেকছে। অস্থিরতায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ গেছে। প্রচন্ড তেষ্টা পাচ্ছে। রুমের ওয়াটার বোতলটা ফাঁকা দেখে ডাইনিংয়ে আসে। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে নজরে এলো, নীলা আম্মু-আব্বুর রুমের দরজার সামনে। ওদিকে চেয়ে গ্লাসটা হাতে নেয় প্রত্যাশা। নীলা কম্পিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
-” আ-আম্মু, আব্বু নিভান ফোন দিয়েছিলো।”
অধরা এগিয়ে এসে চোখেমুখে চিন্তার ছাপ ফেলে শুধালেন,
-” নীলা, কী হয়েছে? এত রাতে, কারো কোনো সমস্যা হয়েছে? নিভান ফোন দিয়েছিলো তোর শ্বশুরের কিছু হয়েছে? ভদ্রলোক ঠিক আছেন তো?”
প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে ওদিকে চেয়ে। বোঝার চেষ্টা করছে। নীলা জোরেজোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। ও বলল কোন রকমে,
-” আম্মু, নীরবের এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
কথাটা শ্রবণ হতেই প্রত্যাশার মাথাটা যেন চক্কর দিলো। হাতটা কেঁপে ওঠে, হাত খসে গ্লাসটা ফ্লোরে পড়ে যায়। মূহুর্তেই কাঁচ ভেঙে মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পরে। শব্দ শুনে অধরা আর নীলা একসাথে ডায়নিংয়ে তাকায়।
#চলবে