#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৫৪|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
সার্থক ব্যর্থ হয়ে মাহবুব সাহেবের দিকে এগোয়। হাতজোড় করে অনুনয়ের সুরে বলল,
-” আংকেল প্লীজ, একটিবার শুধু একটিবার দেখার সুযোগটা দিন। এই মুহূর্তে আমার বোনের মানসিক অবস্থাটাও একটু কনসিডার করুন। একটা মানুষ অনুতপ্ত হলে, তাকে সুযোগ দেয়া যায় না? মানুষ রাগে জিদে অন্ধ হয়ে অনেক ভুল করে বসে। সেই ভুলের মাশুলও তাকে গুণতে হয়। একটু অনেস্টলি ভাবলে দেখবেন, সবচেয়ে ক্ষতিটা কিন্তু আমার বোনেরই হলো। যদিও এটা ওরই কৃতকর্মের ফল। তবুও নিজের বোন তো, সহ্য করা যায় না।”
নীরব পাশ থেকে উচ্চস্বরে বলল,
-” তোমার বোনের ভুল কোনো সাধারণ মামুলি ভুল নয়। তোমার বোন একটা খু*নি।”
মাহবুব সাহেব ভেজা চোখজোড়া মুছে নিলেন। নিচু স্বরে বললেন,
-” নীরব থামো। হ্যাঁ, ও অপরাধ করেছে, অন্যায় করেছে। তবুও একজন মানুষ তার স্বামীকে শেষবারের মতো দেখার অধিকার রাখে। আমরা ওর সেই অধিকারটুকু কেড়ে নিতে পারি না।”
নীরব তৎক্ষণাৎ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠল,
-” একজন খু*নির কোনো অধিকার থাকে না বাবা। ওর দেখার অধিকার নেই। সেই অধিকার ও নিজে শেষ করেছে। ও সাইলেন্ট কিলার, একজন অভিনেত্রীও। দিনের পর দিন আমার ভাইয়ের সাথে অভিনয় করে গেছে। ও একটা বিশ্বাসঘাতক, নীরবঘাতক। শি ইজ বোথ ডাইরেক্টলি অ্যান্ড ইন্ডাইরেক্টলি রেসপন্সিবল ফর নীবিড়’স ডেথ। সো নো মার্সি।”
মাহবুব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গলার স্বর কঠিন করে বললেন,
-” নীরব আমি যা বলছি শুনো। সময় ন*ষ্ট হচ্ছে। একটা নজর দেখতে দিলে এমন কিছু হবে না। শেষবারের মতো শেষ দেখাটা রোধ করলে অন্যায় করা হবে। আশাকরি আমার উপর দিয়ে আর কিছু বলবে না তুমি।”
নীরব আঙুলগুলো পাকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করল। দাঁত চেপে বলল,
-” ওকে দয়া দেখাতে যেয়ো না বাবা। ও সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য নয়।”
মাহবুব সাহেব ছোটো ভাইকে ইশারা করতেই ছোটো চাচ্চু নীরব কে টেনে ওপাশে নিয়ে গেল। বাবার কথার উপর দিয়ে আর কিছু বলে বেয়াদবি করতে চাইল না নীরব। উল্টোদিক ঘুরে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলাল।
এরমধ্যে মাহবুব সাহেব নিভানকে ডেকে উঠলেন,
-” নিভান?”
নিভান তাকাতেই বাবার নিঃশব্দে করা আদেশ বুঝে নিল। নিভান বাঁধনটা খুলতে থাকে। চোখের পানি টপটপ করে পড়তে লাগলো ওর। বুকের পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে ভাই হারানোর বেদনায়।
সার্থক প্রীতিকে আগলে ধরে এগিয়ে আনে। মুখের উপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে দেয়া হয়। আর সরিয়ে দিতেই ফর্সা মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। দুই টুকরো সাদা কাপড় নাকে দেয়া, চোখের ঘন পাপড়ি মুদে আছে। একদম নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রশান্তির সহিত ঘুমে বিভোর।
প্রীতির বুকটা ধক করে উঠল। সেদিন হাসপাতালে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গিয়েও হাতটা নামিয়ে নিয়েছিল। অদ্ভুতভাবে আজ কেনো জানি একবার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, হায়! আফসোস! এই প্রথম মন থেকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে জাগলেও, ইচ্ছেটা পূর্ণ করার সাহস বা অধিকারবোধ কোনোটাই জোগাতে পারল না প্রীতি। চোখের কোল ঘেঁষে উষ্ণ নোনতা জল গড়িয়ে পড়ল নিঃশব্দে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না প্রীতি। পাশে দাঁড়ানো ভাইয়ের বুকে মাথাটা গুঁজে নিল।
মাহবুব সাহেব ইশারা করতেই সার্থক বোনকে টান দিয়ে দূরে সরে গেল। চোখের পলকে খাটিয়া কাঁধে নিয়ে সবাই বেরিয়ে গেল। যতদূর দেখা গেল প্রীতির চোখদুটো ওই খাটিয়ার দিকে চেয়ে রইল। প্রীতি শব্দ করে কাঁদে না। শুধু নিঃশব্দে অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল। অবচেতন মনটা বলতে চাইল,
-” মাফ করে দিও নীবিড়। জানি, আমার শব্দগুলো তোমার কাছে পৌঁছবে না। তবুও বলতে চাই, আজ আমি অনুতপ্ত। আমার কারণে তুমি এত অকালেই চলে যাচ্ছ। আফসোস আমাদের মেয়েটার জন্য। তার পা’পী মা তাকে এতিম করল। বাবার স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে। এ-ও জানি এত এত পা”পের কোনো ক্ষমা নেই। তবুও যে আমি আজ ক্ষমাপ্রার্থী।”
___________
ছোট্ট ইচ্ছে অতকিছু বোঝে না। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা কীই-বা বুঝবে। নিভান তখন কোলে করে নিয়ে শেষবারের মতন বাবার মুখটা দেখিয়েছিল। বলেছিল– পাপাকে আদর করে দাও।
দিদুন ভেতরে চিৎকার করে কান্না করছিল। সবার কান্নাকাটি দেখে তার ছোট্ট মনটা খারাপ করছে। মিষ্টি মুখটা শুকনো করে ফ্যালফ্যাল চোখে কিছুপল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখটা ভার করেই বড় পাপার কথা রাখতে হোক আর অদৃশ্য টানেই হোক ইচ্ছে বাবার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। উফ্! শেষবারের মতন ছুঁয়ে দেয় বাবাকে। শেষ আদরটুকু আঁকে
বাবার কপালে। আফসোস! বাবা টেরই পেলো না। অনুভব করতে পারল না।
.
ইচ্ছে মন খারাপ করে ভেতরে এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলো। এরমধ্যে আনিশা বাইরে থেকে দৌড়ে আসে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
-” ইচ্ছে তোমার মাম্মা এসেছে।”
ইচ্ছের চোখ চকচক করে উঠল।
-” মাম্মা?”
-” হ্যাঁ তোমার মাম্মাকে দেখলাম।”
-” কোথায় মাম্মা? আমি যাব মাম্মার কাছে।”
আনিশা চোখদুটো সরু করে ঘনঘন বলতে থাকে,
-” তোমার মাম্মা বাইরে। জানো বাইরে পুলিশ আবার পুলিশের গাড়িও আছে।”
পরের কথাগুলো কানে পৌঁছায় না ইচ্ছের। মাম্মা বাইরে আছে শুনেই ও ছোটে।
প্রীতির আসা নিয়ে আত্মীয় স্বজনরা এটাওটা বলে ফিসফিস করছে। কেউ আবার মুখে যা আসছে তাই সামনের উপর বলে দিচ্ছে। নীহারিকার জ্ঞান নেই। ছেলেকে নেয়ার আগে মা’কে আরেকবার দেখানো হয়। সেই তখন জ্ঞান হারিয়েছেন। আত্মীয়-স্বজন মাথায় পানি দিচ্ছে।
প্রত্যাশা ওখানেই ছিল। এরমধ্যে নীলাশা এগিয়ে ইশারায় প্রত্যাশাকে ডাকল। প্রত্যাশা এগিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াল। রুমভর্তি মহিলা মানুষে। নীলাশার চোখদুটো ফোলা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলল,
-” শুনেছিস তো..”
কথার মাঝেই প্রত্যাশা নিচুস্বরে বলল,
-” হ্যাঁ শুনেছি। সবাই এখানে বলাবলি করছে। নীরব নাকি দেখতে দিচ্ছে না। উনাকে একটু বুঝিয়ে বলো দেখতে যেন দেয়। সবাই অনেক কিছুই বলবে এটা জেনেও যখন দেখতে আসছে, তখন নিশ্চয় মন থেকেই আসছে। আর আপু, আত্মীয় স্বজন মানুষগুলোও না কেমন মুখের উপর যাচ্ছে না তাই নাকি বলতিছে।”
-” হুম, অনেকেই অনেক কিছু বলেছে। আর বলার কথাই। যাগগে বাদ দেই। বাবা নীরবকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেখতে দিয়েছে। শোন যা বলার জন্য ডাকলাম, ইচ্ছে বাইরে ওর মায়ের কাছে গেছে। ইচ্ছে তো তোর কথা শোনে, তুই একটু নিয়ে আয় না। নিভানরা সবাই চলে গেছে। আর মনেহয় না ইচ্ছে আমার কাছে আসবে। তুই একটু যাবি?”
প্রত্যাশা মাথা নেড়ে বলল,
-” আচ্ছা, যাচ্ছি।”
মাথার উপর থাকা ওড়নাটা ভালো করে টেনে পা বাড়াল।
.
প্রীতিকে পুলিশের জিপে তোলা হবে। এরমধ্যে পিছুন থেকে বাতাসের সাথে ভেসে এল মিষ্টি কণ্ঠস্বর,
-” মাম্মা…..আআআআআআআ।”
বাঁধ ভাঙা ঢেউয়ের মতো ছুট্টে আসছে ইচ্ছে। যেন কোনো বেড়িবাঁধ, বাঁধা তাকে থামাতে পারবে না। মেয়ের কণ্ঠস্বর কর্ণযুগলে পৌঁছাতেই প্রীতি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। মেয়ে দৌড়ে এল। সামনে থামল। দুইহাত হাঁটুতে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘনঘন বললো ইচ্ছে,
-” মাম্মা, ও মাম্মা… আমাকে রেখে তুমি এতদিন কোথায় গিয়েছিলে?”
মুখটা উঁচু করে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। বাচ্চা মেয়েটার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে খুশির ঝিলিক দেখা গেল। প্রীতির চোখ ঝাপসা হয়ে এল চোখের বাঁধ ভাঙা বন্যায়। ইশশ্! কানে বাজছে, এত আদুরে ডাক—‘ মাম্মা, ও মাম্মা।’ প্রীতি নিজেকে সামলাতে পারল না। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। মেয়েকে একটানে বুকের সাথে চেপে ধরল। শব্দ করে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। মায়ের কান্নার শব্দে ইচ্ছে ভড়কাল। ভীতু স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
-” মাম্মা তুমি কাঁদছো কেনো? সবাই আজকে কাঁদছে। দিদুন, দাদুভাই, বড় পাপা, পাপা, মামণি সব্বাই। আমার না খুউব মন খারাপ হচ্ছে। একটুও ভালো লাগছে না। একটুও না।”
মাথা নেড়ে নেড়ে বলতে থাকে ইচ্ছে। প্রত্যাশা এতক্ষণে এসে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়েছে। ভেজা চোখে তাকিয়ে রইল। প্রীতি কান্নার বেগ থামিয়ে নাক টেনে নিল। মেয়ের আদুরে মুখটা দু’হাতে আগলে ধরে চুমু খেতে লাগল। সারা মুখে চুমু খেয়ে ভরিয়ে দিল। ইচ্ছে একের পর এক প্রশ্ন করছে। প্রীতি কিছুই বলতে পারছে না। গলায় যেন বেড়ি পড়ানো এমন ঠেকছে। ওদিকে বরাদ্দ সময় শেষের দিকে তাড়া দিচ্ছে। সার্থক এগিয়ে বোনের কাঁধের উপর হাত দিল। মৃদুস্বরে ডাকল,
-” প্রীতি?”
প্রীতির বুঝতে বাকি রইল না। শেষবারের মতন মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। একদম চেপে ধরল। পরপর ছেড়ে দিয়ে মেয়ের ছোট্ট হাত দুটো এক করে ধরল। তারপর সেই হাতের উপর চুমু খেল। উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল। ঠিক প্রত্যাশার সামনে দাঁড়াল। আচমকা প্রত্যাশার একটা হাত ধরে, সেই হাতের উপর ইচ্ছের হাতটা রাখল। প্রত্যাশা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। প্রীতি একটাও শব্দ উচ্চারণ করল না। সোজা উল্টো ঘুরে লম্বা কদমে এগিয়ে যায়। ইচ্ছে পিছুন থেকে ডাকে,
-” মাম্মা, কোথায় যাচ্ছো মাম্মা? তুমি আবার চলে যাচ্ছ মাম্মা? দিদুন বলে তুমি অফিসের কাজে গিয়েছো? আমিও যাবো তোমার সাথে।”
প্রীতি আর ফিরে তাকায় না। ইচ্ছের এবারে কান্না পাচ্ছে। ছুটে যেতে নিয়ে বাঁধা পায়। প্রত্যাশা ওর হাতটা ধরে আছে। ইচ্ছে হাত ছুটানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
-” মামণি ছাড়ো, আমি মাম্মার কাছে যাব।”
মূহুর্তেই জিপটা দূরে চলে যেতে লাগল। ইচ্ছের কান্নার বেগ বাড়ল। চিৎকার করে বলল,
-” মাম্মা…..ও মাম্মা…আআআআআ।”
নিমিষেই জীপটা ধুলো উড়িয়ে চোখের আড়াল হয়ে যায়। ইচ্ছে কাঁদতে থাকে। প্রত্যাশা আগলে ধরে বলে,
-” কাঁদে না সোনা। মাম্মা আসবে, কাজ শেষ হলেই আসবে।”
ইচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” মামা, মামা ওরা মাম্মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মামা আমি যাব মাম্মার সাথে।”
সার্থক এগিয়ে এল। ইচ্ছের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-” তোমার মাম্মার কাজ শেষ হলেই তোমার কাছে আসবে। সোনামণি তুমি না গুড গার্ল। আর গুড গার্লরা তো এভাবে জিদ করে না সোনা। তুমি তো মাম্মার ভালো মেয়ে। বলো ভালো মেয়ে না তুমি?”
ফুপাতে ফুপাতে মাথা নেড়ে -‘হ্যা’ বোঝায় ইচ্ছে। সার্থক বলল,
-” ভালো মেয়ে হলে মাম্মার কথা শুনবে। মাম্মা বলেছে; দাদু বাসার সবার কথা শুনে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকতে। এখন গুড গার্ল হয়ে মামণির সাথে ভেতরে যাও তো।”
আরো এটাসেটা বুঝিয়ে বলার পর ইচ্ছে নাক টেনে ফুপাতে ফুপাতে প্রত্যাশার সাথে ভেতরে আসে।
অদ্রিকা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সার্থক গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভেতরে বসে সে। সার্থক চুপচাপ ড্রাইভিং করছে। অদ্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-” ইচ্ছের জন্য খুব বেশি খারাপ লাগছে। বাচ্চা মেয়েটা খুব সাফার করবে।”
সার্থক দৃষ্টিজোড়া পিচের রাস্তায় রেখেই বলল,
-” ইচ্ছে এখানে খুব ভালো থাকবে। ওর ফ্যামেলি বাবা-মায়ের শুন্যতা টের পেতে দিবে না। নীরব আছে, তারপর বাড়ির প্রতিটি সদস্যও ইচ্ছেকে আগলে রাখবে। তবে যখন বড় হবে সব সত্য জানলে কষ্ট পাবে। মায়ের প্রতি এখন যে ভালোবাসাটা আছে, তখন হয়তো সেটা ঘৃ’ণা’য় পরিণত হবে। আফসোস! প্রীতি চাইলেই জীবনটা সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে পারতো। রাগ, জিদ, বেপরোয়া ইগো ওকে ধ্বং*স করে দিয়েছে। এখন হয়তো টের পাচ্ছে। সব শেষ করে উপলব্ধি করার চার আনারও মূল্য নেই। যার জলজ্যান্ত উদাহরণ প্রীতি।”
_________
সবাই একে একে ফিরতে নেয়। সাড়ে তিনহাত মাটির ঘরে ভাইকে একলা ফেলে যেতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এতই কষ্ট প্রবল যে নীরবের পা দুটো যেন গেঁথে গেল। লাল টকটকে চোখজোড়া অশ্রুতে টলমল করতে থাকল। আকস্মিক নীরবের কানে বাজছে উচ্ছাস নিয়ে ভাইয়ের বলা কিছু কথা, কিছু মূহুর্ত। যা এখন ভাইয়ের স্মৃতি। রেজাল্ট দেয়ার পর উল্লাস নিয়ে বলেছিল নীবিড়,
-” এই নীরব তোর থেকে এবারে আমার সিজিপিএ বেশি। যদিও তুইও হ্যান্ডসাম সিজিপিএ তুলেছিস। তবুও তোর থেকে এবারে এগিয়ে কিন্তু আমি। তোর থেকে তিন মিনিট আগে হলেও পৃথিবীতে এসেছি। তিন মিনিটের হলেও বড় আমি। তাই রেজাল্টের মতন সবকিছুতে এভাবেই এগিয়ে থাকতে হবে, হুম।”
বলেই কলারে হাত রেখে ভাব নেয়ার অ্যাক্টিং করে নীবিড়। মায়ের মুখ থেকে শোনা কত সময়ের ব্যবধান দু’জনের ভূমিষ্ঠ হওয়ার।
ভাইয়ের খুনসুটি গুলো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে নীরবের। আর করছে বলেই খুব পীড়া দিচ্ছে। নীরব ধপ করে কবরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। শরীর কাঁপছে, চোখদুটোতে অঝোরে বর্ষণ নামছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল,
-” নীবিড় তুই বলেছিলি সবকিছুতে এগিয়ে থাকবি। কিন্তু এই এগিয়ে থাকা তো আমি কোনোদিনও চাইনি। আগে জানলে বলতাম; তুই সবসময় আমার থেকে পিছিয়ে থাকিস। দুজনের আসার ব্যবধান যদি তিন মিনিটই হয়, তবুও কেন এত দ্রুত ছেড়ে গেলি?”
নিভান ভাইয়ের পাশে বসে কাঁধের উপর হাতটা রাখল। ভেজা গলায় বলল,
-” নীরব, উঠ। ভাই বাসায় চল।”
আঁটকে রাখা কান্না এবার ছিটকে যেন বেরিয়ে এল। ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল নীরব। এক ঝটকায় বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। নিভানও নিজেকে সামলাতে পারল না। ভাই বিয়োগের বেদনার কান্নায় চারপাশ ভারী হয়ে উঠল।
বৃদ্ধা বাবা বুকে হাহাকার নিয়ে মরহুম ছেলের জন্য দোয়া করতে থাকলেন। এ ছাড়া যে আর কিছুই করার নেই। আত্মীয়-স্বজন এগিয়ে এসে ওদের দুইভাইকে সামলে নিয়ে ফিরতে থাকে।
___________
কারো জন্য কোনো কিছুই থেমে থাকে না। যে যাওয়ার সেই যায়। রেখে যায় কেবল স্মৃতি, যা প্রিয়জনের বেদনা বাড়িয়ে দেয়। তবুও সময়ের সাথে সাথে মানুষের দুঃখ ফিকে হয়ে আসে। ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে যায় অশ্রুর ভারী মুহূর্তগুলো। এরই মাঝে কে”টে গেছে আড়াইটা মাস। বাড়ির শোকের ছায়া অনেকটা সরে গেছে। আগের মতো না হলেও সবাই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে।
প্রত্যাশার সাড়ে সাত মাস চলছে। ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা। ইবনে সিনা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওয়েটিং চেয়ারে প্রত্যাশা আর নীরব পাশাপাশি বসে। চেকআপের জন্য প্রত্যাশাকে আনা হয়েছে। গাইনোকলজিস্ট এটাসেটা টেস্ট দিয়েছে। টেস্টের জন্য স্যাম্পল হিসেবে ব্লাড, আর ইউরিন কালেক্ট করা হয়েছে। এখন আল্ট্রাসাউন্ড বাকি আছে।প্রত্যাশার হাতে ফ্রেশ এর মিনারেল ওয়াটার বোতল। মুখের সামনে ধরে দু ঢোক গিলে মাথাটা নীরবের কাঁধের উপর রাখল। শরীর দূর্বল লাগছে। অনেকক্ষণ বসে থেকে কোমরও ধরে গেছে। বিরক্ত সুরে বলল,
-” নীরব আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকব? আমার বিরক্ত লাগছে। তাড়াতাড়ি বলুন না।”
নীরব কিছু বলার আগেই আল্ট্রাসাউন্ড রুমে প্রবেশের জন্য প্রত্যাশার নাম ডাকা হলো।
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৫৫|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
দমকা হাওয়ায় জানালার পর্দা ফরফর করে উড়ছে। রুমের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে। এমন সময় ভেজানো দরজা একহাতে ঠেলে ভেতরে এলেন অধরা। হাতড়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালাতে জ্বালাতে বললেন,
-” নীলা, ঘরটা এমন অন্ধকার করে রেখেছিস কেনো? সেই কখন সন্ধ্যে হয়েছে, আলো জ্বালাসনি যে।”
বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে ছিল নীলাশা। তিন-চার দিন হলো এসেছে সে। লাইটের ফকফকা আলো চোখের উপর পড়তেই চোখের পাতা কুঁচকে এল ওর। অধরার একহাতে বোলের মধ্যে নারিকেল, আটা, চিনি আর তালের রস দিয়ে বানানো তেলে ভাজা পিঠা। বোলটা বেডটেবিলে নামিয়ে মেয়ের মাথার পাশটায় বসলেন। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে উৎকণ্ঠিত হয়ে শুধালেন,
-” শরীর খারাপ লাগছে? এই অসময়ে শুয়ে আছিস যে।”
নীলাশা পাশ ফিরল। মিছেমিছে ঘুম ভাঙার অভিনয় করে জড়ানো স্বরে বলল,
-” শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে চোখটা লেগেছিল টেরই পাইনি। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
হাত বাড়িয়ে মেয়ের কপালে গলায় চেক করলেন অধরা। না জ্বর-টর আসেনি। তবে মেয়ের এইযে ভালো থাকার অভিনয় মায়ের চোখ এড়ায়নি। মেয়েটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। মুখে একরত্তি হাসি ফোটে না। সবসময় মন ম*রা হয়ে থাকে। যেটুকু হাসে জোর করে। ভেতরে ভেতরে মেয়েটা গুমরে ম’র’ছে। বুকের ভেতর হাহাকার চেপে নরম স্বরে বললেন অধরা,
-” তালের পিঠা করেছি। তোর না খুব প্রিয়। উঠে চোখেমুখে পানি দিয়ে খেয়ে নে।”
পেটের একসাইডে ঘুচিয়ে সরে থাকা শাড়ির আঁচলটা টেনে ভালো করে জড়িয়ে নিল নীলাশা। প্রত্যুত্তরে বলল,
-” রেখে দাও, পরে খাব।”
-” ইদানীং সবকিছুর উত্তর তোর এই পরে খাব। তারপর সেই পরে আর আসে না। এখনই খেয়ে নে।”
নীলাশা মাথাটা তুলে মায়ের কোলের উপর রাখল। ভাঙা স্বরে বলল,
-” ভালো লাগছে না এখন। পরে খাব, সত্যি বলছি।”
অধরা আর কথা বাড়াল না। আলগোছে মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। মেয়ের এই ভালো না লাগা, মন খারাপ হয়ে থাকা; এসবের কারন যে অজানা নয়। মেয়ের অসহায়ত্বের জন্য মনটা খুব করে পোড়ে। মেয়ের কষ্ট লাঘবের জন্য কিছুই করার উপায় যে নেই। কয়েকপল নিশ্চুপ থেকে নীলাশা মিহি স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
-” তখন প্রত্যাশার সাথে কথা বললে শোনা গেল। ওরা হাসপাতাল থেকে ফিরেছে?”
-” নাহ, এখনো ফেরেনি। রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরতে একটু দেরি হবে নাকি।”
-” ওহ্।”
পরক্ষণেই কণ্ঠে জিজ্ঞাসা নামিয়ে ফের বলল নীলাশা,
-” প্রত্যাশাকে আনবে না?”
-” আনার কথা বলব বলব করছি, তবে তোদের বাড়ির অবস্থা বিবেচনা করে বলে উঠতে পারছি না। কেবল এতবড় একটা শোক গেল। তার রেষটা একটু কাটুক। তারপর দেখি তোর শাশুড়ির কাছে ফোন করে আনার কথাটা তুলব। আবার এত আগেই নীরব আসতে দিবে কি-না প্রত্যাশার থেকে শুনতে হবে।”
-” ওহ্।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অধরা অকস্মাৎ বলে উঠলেন,
-” নীলা, একটা কথা বলব?”
-” বলো।”
-” কত গরীব মানুষ আছে, বাচ্চাকে কীভাবে মানুষ করবে, কী খাওয়াবে, এইসব দুশ্চিন্তায়, আবার কেউ তো সাংসারিক কলহের জন্য অ্যাবরশন করে ফেলে। হাসপাতালে প্রায়ই এরকম গর্ভবতী মহিলা পাওয়া যায়। চাইলে নিভানকে বলিস খোঁজ রাখতে। খরচাপাতি সব দিয়ে তারপর কিছু টাকা-পয়সাও হাতে গুঁজে দিয়ে বাচ্চাটাকে একবারে নিয়ে নিবি।”
নীলাশা কিছুটা বিরক্ত সুরে বলল,
-” বাদ দাও তো আম্মু। এখন এসব শুনতে চাইছি না।”
মায়ের কোমর দুহাতে জড়িয়ে পেটে মুখ গুঁজল নীলাশা। টলমলে চোখজোড়া বুঁজে নিল। অবচেতনে আওড়ালো,
-” সবার সামনে যতই শক্ত থাকার ভান করি, ভেতরে প্রতিদিন, প্রতিটা মুহূর্তে ভেঙে যাচ্ছি। আমার জীবনে কোনোদিন মা ডাক আসবে না। কোলভরা বাচ্চার হাসি শোনা হবে না। আজও এই কথাটা মেনে নিতে পারি না আমি। বুকের ভেতর যেন আ*গু*ন জ্ব’লে। যখন অন্য কারো কোলে ফুটফুটে বাচ্চা দেখি, তখন বুকটা মোচড় মা”রে। মনে হয় আমি কেনো পারলাম না? আমি কেনো পারব না? এতটা শুণ্য, অসহায় নিজেকে লাগে, সেটা কাউকে বোঝাতে পারব না। নিজেকে আমার একটা অপূর্ণ মানুষ মনেহয়।”
কান্না গুলো গলায় দলা পাকিয়ে এল নীলাশার। নিজেকে সামলে নিল। কিছুপল রুম জুড়ে নিস্তব্ধ নীরবতা চলল। অতঃপর নীরবতার সুতো ছিঁড়ে নীলাশা ডেকে উঠল,
-” আম্মু।”
আঁচল টেনে চোখের পানি মুছে অস্ফুটে বললেন অধরা,
-” হুঁ।”
-” আচ্ছা আম্মু তুমিই বলো, মা না হওয়ার পূর্ণতা কী অন্যের বাচ্চা পালন করে পাওয়া যায়? তুমি বাচ্চা এডপ্ট নেয়ার কথা বলছো, এতে না হয় কাগজে কলমে মা হওয়া যাবে। কিন্তু হৃদয়ে কী যায়? অন্যের সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো যায়? নিজের র*ক্ত না থাকলে সেই টান কি কোনোদিন আসবে? অন্যের বাচ্চাকে কি আমি নিজের র*ক্তের মতো অনুভব করতে পারব? বলো আম্মু পারব?”
অধরা সহসাই বললেন,
-” মা হওয়া শুধু র*ক্তের টানেই হয় না রে মা। মায়ের মানে হলো যত্ন, ভালোবাসা, বুক ভরে আগলে রাখা। যাকে মানুষ নিজের কোলের কাছে টেনে নেয়, সেই বাচ্চাই তার সন্তান হয়ে ওঠে। কোলেপিঠে করে বড় করতে গিয়ে মাতৃসুলভ সেই টান, সেই মায়া আপনাআপনি বুকে জন্মে যায়। মনে হয় নিজেরই বাচ্চা।”
যদিও নীলাশার কথাটা একেবারেই ভুল নয়। নিজের সন্তান, মা হওয়ার প্রতিটি ধাপ যাতে আলাদা অদ্ভুত এক স্বর্গীয় অনুভূতি মিশে থাকে। মাতৃত্বের স্বাদ পেতে প্রতিটি মেয়েই চায়। অধরা সেটা জানেন। তবে এ-ও সত্যি একটা বাচ্চাকে আদর যত্ন দিয়ে আগলে রাখতে রাখতে অদৃশ্য বন্ধন, টান, মায়া জন্মায়। সেটা রক্তের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অধরা মেয়েকে বোঝানোর সুরে বলে গেলেন,
-” এইযে দ্যাখ, তোকে আর প্রত্যাশাকে কখনো আলাদা করে দেখেছি? প্রত্যাশার আদর, যত্নে, স্নেহে এতটুকু খামতি রেখেছি? প্রত্যাশার প্রতি ভালোবাসা, টান এতটাই ছিলো ওকে কখনো টেরই পেতে দেইনি। আর সত্যি বলতে, প্রত্যাশা আমার নিজের মেয়ে নয়; এটা কখনো ভাবিওনি।”
__________
আত্মীয়-স্বজন অনেকে বলে সমস্যা না হলে ঘনঘন আলট্রা করো না। বারবার আলট্রাসাউন্ড নিলে নাকি ক্ষতি হয়, ত্বকের জন্যও ভালো নয়। তবে ডাক্তার বলেছিলেন, আলট্রাসাউন্ডে কোনো রকম রেডিয়েশন নেই। মা ও বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে অযথা ঘনঘন করার দরকার নেই। যখন প্রয়োজন তখনই করা ভালো।
সেই যে প্রথম মাসে আলট্রা করা হয়েছিল আর করা হয়নি। অবশ্য দু-তিনবার ডাক্তারের কাছে এসে রুটিন চেকাপ করা হয়েছে। তারপর বাড়িতে শোক গেল। নীরব বারবার ডাক্তারের কাছে আনার কথা বললেও প্রত্যাশা একটু এড়িয়ে যায়, পরে পরে করে। অবশেষে আজকে আসা হলো।
বুকের ভেতর হালকা দুশ্চিন্তা, নার্ভাস লাগছে প্রত্যাশার। পাশ থেকে নার্স এগিয়ে এসে পেটের উপর ঠাণ্ডা জেল মাখিয়ে দিল। মহিলা রেডিওলজিস্ট হাতে আলট্রাসাউন্ড প্রোব নিয়ে আলতোভাবে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। মনিটরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-” প্রথম বাচ্চা।”
প্রত্যাশা হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল
-” হুঁ।”
ডাক্তার মুখে সুকোমল হাসি টেনে অমায়িক স্বরে বললেন,
-” ডাবল ফিটাস। টুইনস বেবি হবে।”
শব্দগুলো শ্রবণ হতেই কর্ণকুহরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল প্রত্যাশার। মস্তিষ্কের নিউরনে সাড়া জাগাতেই অবিশ্বাস্য ঠেকল। পরক্ষণেই প্রত্যাশা চোখ বড় বড় করে চমকে তাকাল। নিশ্চিত হতে জিজ্ঞাসা করল,
-” ম্যাম, আর ইউ শিওর?”
এক সেকেন্ড থেমে তড়িঘড়ি করে বলল প্রত্যাশা,
-” না মানে আগে একবার আলট্রা করা হয়েছিল। সেখানে তো সিঙ্গেল ফিটাস লেখা ছিল। তবে কী ভুল ছিলো?”
-” কত সপ্তাহে করা হয়েছিল?”
-” উমম! পাঁচ সপ্তাহের দিকে।”
ডাক্তার অমায়িক গলায় বললেন,
-” একদম শুরুর দিক ছিল। তবে প্রথমেই তো ধরা পড়ার কথা। প্রেগন্যান্সির শুরুর দিক হলেও জমজ বাচ্চা ধরা পড়ে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে পরে স্পষ্ট বোঝা যায়। এটা খুবই রেয়ার কেস। কখনো কখনো স্ক্যানের সময় বাচ্চার অবস্থান বা ছবির এঙ্গেল ঠিকমতো ধরা না পড়লে এমন ভুল হয়ে যেতে পারে। আবার কোনো কোনো সময় রেডিওলজিস্টের অদক্ষতার কারণেও এ রকম ভুল হতে পারে। দুশ্চিন্তার কিছু নেই।”
টুইনসের কথা শুনে প্রত্যাশার চোখমুখে হাসি ফুটল। একমুঠো আনন্দ, ভালোলাগায় ছেয়ে গেল তনুমন। পরপরই মাতৃত্বের ছাপ ফুটে উঠল চোখমুখে। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে আলতো গলায় প্রশ্ন করল,
-” বাচ্চারা সুস্থ আছে তো? সব কিছু ঠিক আছে?”
-” হ্যাঁ, দুজনই ভালো আছে। সবকিছু নরমাল আছে।”
প্রত্যাশার পাতলা ঠোঁটজোড়া অস্ফুটে নড়ল,
-” আলহামদুলিল্লাহ।”
প্রত্যাশা ঘাড় ঘুরিয়ে মনিটরের দিকে তাকাল। ওর চোখে মনে হচ্ছে যেন সমুদ্রের ভেতর ঢেউ খেলছে। তীব্র ঢেউ হচ্ছে। ছবি বোঝা না গেলেও বুক ভরে উঠলো অদ্ভুত সুখে। প্রথম বাচ্চা, তারপর টুইনস আনন্দটা একটু বেশিই হচ্ছে। আনন্দের আতিশয্যে চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। প্রত্যাশার ইচ্ছে করল জিজ্ঞেস করতে কী বাচ্চা? আবার খেয়াল হলো এখন নাকি বলা বারণ। অগত্যা কৌতুহলটা দমিয়ে রাখতে হলো প্রত্যাশার।
এদিকে আলট্রা রুম থেকে বেরিয়ে প্রত্যাশা নীরবকে জানাল না। ভাবল– রিপোর্ট তো কিছুক্ষণের মধ্যেই দিবে। রিপোর্টটা খুলে যখন নীরব দেখবে, ওর রিয়াকশন কেমন হয় দেখবে।
আধা ঘণ্টার আগেই আলট্রা রিপোর্ট হাতে আসে। বাকি রিপোর্টগুলো আসতে এখনো কিছুটা দেরি আছে। রিপোর্ট এনে ওয়েটিং চেয়ারে বসে নীরব। বলল,
-” দেখি তো বাচ্চার ওয়েট কত হয়েছে।”
প্রত্যাশার চোখমুখে মিটমিট হাসি। রিপোর্টটা বের করে চোখ বুলাতে থাকে নীরব। ঠিক তক্ষুনি নীরবের চোখজোড়া স্থির হয়,
‘Two intrauterine live fetuses seen. (Double Fetus)’
অবিশ্বাস্য চোখে নীরব বারকয়েক পলক ফেলল। একবার দুই হাতে ধরা রিপোর্টের দিকে তাকালো তো আবার প্রত্যাশার মুখের দিকে। প্রত্যাশার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই প্রত্যাশা সব বলল। ডক্টর যা যা বলেছেন সবটা। প্রথম বাবা হচ্ছে। একসাথে দু’টো প্রাণ আসছে। নিজের অংশ, নিজের রক্ত, নিজের অস্তিত্ব। নীরব যেন কিছুক্ষণ নিজের ভেতরেই গিয়ে হারিয়ে গেল। প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দটা এমনিতেই বিশাল, তার উপর একসাথে দুটো প্রাণ।
দু’টো প্রাণ ঘর আলো করে আসছে ভাবতেই বুকের ভেতর হঠাৎ অন্যরকম কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ল নীরবের। মাথার ভেতর ঝড়ের মতো ঘুরপাক খেতে থাকল। নাজুক দুটি প্রাণ আসছে। কীভাবে তাদেরকে সামলাবে? কীভাবে যত্ন নেবে? ডাবল দায়িত্ব। ভয়ও লাগছে, আবার অদ্ভুত এক শান্তি আর আনন্দ ভরে দিচ্ছে মনটাকে। অবচেতনে বলে উঠল,
-” আলহামদুলিল্লাহ! সত্যিই আমি ভাগ্যবান।”
নীরবের ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি ফুটে উঠল। তবে আনন্দে আত্মহারা হওয়া নীরবের ঠোঁটের কোণের হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কয়েকপল পরে এক নিমিষেই হাসিটুকু গায়েব হয়ে যায়। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। নীবিড়ের কথা খুব করে মনে পড়ল। আবার টুইনস। উফ্! খবরটা শুনে সবাই নিশ্চয় খুব খুশি হতো। কিন্তু এখন সেই খুশির জায়গায় সুক্ষ্ম একটা বেদনা ছড়াবে। বাড়িতে জোড়া বাচ্চা দেখলেই মায়ের নীবিড়ের কথা মনে পড়বে।
নীবিড়ের কথা মনে উঠতেই আনন্দটা ক্ষণিকের জন্য চাপা পরে গেল নীরবের। শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হয়ে এলো। নীরবের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে প্রত্যাশা অনুধাবন করতে পারল। তাই তো কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল মেয়েটা।
____________
পড়ন্ত বিকেল। প্রত্যাশার হাতে বাবলের বোতল। স্টিকটা মুখের সামনে ধরে ঠোঁট চেপে হালকা ফুঁ দিতেই বাবলগুলো ধীরেধীরে গোলগোল হয়ে বাতাসে উড়ে গেল। হালকা ঝিকিমিকি রঙের বাবলগুলো বাতাসে খেলতে খেলতে উড়ছে। ইচ্ছে খিলখিল করে হাসছে। মাথা উঁচু করে লাফিয়ে লাফিয়ে বাবলগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। কণ্ঠে উল্লাস নিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
-” ইয়েএএএ! ফাটিয়ে দিয়েছি। মামণি আরও কর, আরও। এবার বিশাল বড় বড় করবে, হ্যাঁ?”
প্রত্যাশা হেসে মাথা নেড়ে বলল,
-” ওকে ওকে কিউটি। এবার দেখো ইয়া বড় করছি।”
নীহারিকা রুম থেকে বেড়িয়ে এসব দেখেই হইহই করে উঠলেন
-” ইয়া আল্লাহ! রুমের মধ্যে এসব কী করছো? ফ্লোর ভিজে উঠছে তো।”
শাশুড়ির গলা পেয়ে থমকে দাঁড়াল প্রত্যাশা। নীহারিকা গম্ভীর মুখে বললেন,
-” প্রত্যাশা তোমার কোনো কান্ডজ্ঞান হবে না। ভেতরে এসব কেউ খেলে। আর এইযে দেখো ফ্যানা পরে টাইলস ভিজে উঠছে। এটা খুব পিছলে হয়। আল্লাহ না করুক, যদি পা পিছলে যায়। তখন, তখন কী হবে?”
কিছুটা রাগী গলায় বললেন নীহারিকা। প্রত্যাশা মাথা নিচু করে বলল,
-” স্যরি মা।”
পরপর ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বলল ঝটপট,
-” ফ্লোরটা আমি এক্ষুনি মুছে দিচ্ছি।”
নীহারিকা ধমকের সুরে বললেন,
-” তোমাকে ফ্লোর মুছতে বলিনি। বোঝাতে চেয়েছি যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন? দূর্ঘটনা তো বলে কয়ে আসে না। আর একবার কিছু ঘটলে ফিরে আসবে না। তাই সচেতন হতে বলছি। বলি এক আর বোঝো আরেক।”
পাশ থেকে ইচ্ছে বলে উঠল,
-” দিদুন তুমি মামণিকে এত বকছো কেনো গো? আমিই তো মামণিকে বাবল ফোলাতে বললাম।”
নীহারিকার মুখের আদল নিমিষেই পরিবর্তন হয়ে এল। গম্ভীর মুখটা সরল করে নাতনির দিকে তাকালেন। কণ্ঠটা মিইয়ে বললেন,
-” বকছি না তোমার মামণিকে একটু সচেতন থাকতে বলছি শুধু। সে তো আবার সবসময় একটা না একটা ঝামেলা পাকিয়েই থাকে। তাই একটু ভয় হয়। যাগ গে, এবার তুমি বলো তোমাকে এটা কে দিলো?”
দুইহাত কোমরে রেখে ঘন লম্বা চোখের পাপড়ি নেড়েনেড়ে বলল ইচ্ছে,
-” বড় পাপা দিয়েছে।”
-” ওহ্। দাদুভাই এটা নিয়ে রুমে খেলতে হয় না। বাইরে খেলতে হয়।”
ইচ্ছে ছটফটে গলায় বলল,
-” মামণি তাহলে বাইরে চলো।”
প্রত্যাশা শাশুড়ির দিকে ভীতু চোখে তাকাল। নীহারিকা বললেন,
-” আজ রাখো, আনিশা নানু বাসা থেকে আসলে ওর সাথে খেলবে।”
ইচ্ছের মুখটা ভার হয়ে এলো। এরমধ্যে নীলাশা এসে বলল,
-” ইচ্ছে চলো আমার সাথে। আমি বাবল তৈরি করে দেবো।”
ইচ্ছের চোখদুটো ফের চকচক করে উঠল,
-” সত্যিই?”
নীলাশা ঠোঁটে হাসি টেনে বাবলের বোতলটা প্রত্যাশার হাত থেকে নিয়ে ইচ্ছেকে বাইরে নিয়ে গেল। প্রত্যাশা মুখভার করে রুমের দিকে পা বাড়ায়।
প্রত্যাশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নীহারিকার চোখ জলে ভিজে এল। ছোটো ছেলের ঘর আলোকিত করতে দু’টো বাচ্চা খুশির আলো নিয়ে আসছে। দাদি হিসেবে তার তো খুশি হওয়ার কথা। অথচ খুশির মধ্যে কেমন একটা নীল বেদনা ঘিরে ধরছে। নিজের জান বাচ্চাটাকে খুব মনে পরে। আহা, কোল আলো করে যখন দু’টো জমজ ছেলের জন্ম হলো। মনেহলো আকাশ থেকে চাঁদ খসে পড়েছে তার কোলে। তাও দু’টো। দু’টো বাচ্চার আলোয় কোল ঝলমল করে ওঠে। সেই বাচ্চার অকাল বিয়োগ কী মেনে নেয়া এতই সহজ? অঝোরে নিঃশব্দে এখনো লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে নীহারিকা। মনে উঠলেই আত্মা ছিঁড়ে যাওয়া ব্যথা অনুভব হয়।
_____________
বিকেলে হঠাৎ শাড়ি পড়ার ভূত চাপে প্রত্যাশার। আর চাপতেই ফট করে পরে নেয়। সচরাচর শাড়ি পরা হয় না। মাঝেসাঝে একটু আকটু পড়ে এই। ফোন সামনে ধরে কোয়েলের কথা বলছিল। কোয়েল ওপাশ থেকে বলল,
-” তুই অনেকটা শুকিয়ে গেছিস প্রত্যাশা। চোখদুটো কেমন ডেবে গেছে।”
-” কই? এখন তো সবার জোরাজুরিতে বেশি বেশি খাই। আগের থেকে কিছুটা গোলুমলু হয়েছি, হুঁ।”
সন্ধ্যা সাতটা চল্লিশ বাজে। অফিস থেকে ফিরে রুমে পা ফেলতেই নীরবের দৃষ্টি আটকায় বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোনালাপে ব্যস্ত প্রত্যাশার দিকে। গাঢ় লাল রঙের শাড়ি, চওড়া পাড়ে সোনালি স্টোন বসানো, সঙ্গে ম্যাচিং লাল ব্লাউজ। ব্লাউজের হাতা কনুইয়ের থেকে একটুখানি উপরে আঁটসাঁট হয়ে আছে। চুলের খোঁপায় ঝিলমিল কাঠি, ডাগরডাগর মায়াবী চোখে চিকন কাজল। সব মিলিয়ে প্রত্যাশাকে অপার্থিব সৌন্দর্যে আবৃত মনে হচ্ছে। লাল শাড়িতে একদম লাল টুকটুকে রাঙা বউ লাগছে। নীরবের চোখের পলক নড়তে ভুলে গেল। একদৃষ্টে অপলক চেয়ে রইল।
হঠাৎ হাসির ঝংকারে নীরবের সম্বিত ফেরে। ওপাশ থেকে কোয়েল কিছু বলতেই প্রত্যাশা শব্দ করে হেসে ফেলে। প্রত্যাশার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নীরব মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে এগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। প্রত্যাশা একপল তাকিয়ে ফের ফোনে গল্পে ডুব দিল।
নীরব ইউনিফর্মের বাটন খুলতে খুলতে চোখ ক্রমে প্রত্যাশার দিকে ফেরাল। ফোন আর ফোনের ওপাশের মানবীর উপর নীরবের জেলাসি হলো। বর ফিরেছে কোথায় ফোন রেখে এটাওটা জিজ্ঞেস করবে, তা না বউ এখনো গল্পে ব্যস্ত।
ইউনিফর্মটা শব্দ করে সোফায় রেখে ফ্রেশ হতে ওয়াশ রুমে ঢোকে নীরব। বেড়িয়ে থমথমে মুখে গায়ে সাদা রঙের টিশার্ট জড়াতে থাকে নীরব। প্রত্যাশা ফোন থেকে মুখ তুলে নীরবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
-” কিছু লাগবে আপনার?”
-” হুঁ, লাগবে। তোমাকে লাগবে।”
কথাটা মনেমনে বললেও দাঁতে দাঁত চেপে ভদ্রতা দেখিয়ে বলল,
-” নাহ ঠিক আছে। তুমি কথা শেষ করো।”
সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে সোফায় গা এলিয়ে বসল নীরব। টেবিলের উপর থেকে ইংরেজি ম্যাগাজিনটা হাতে নিল।
ভিডিও কলের ওপাশ থেকে কোয়েল বলল,
-” প্রত্যাশা রে তুই তো সবার আগে শাশুড়ি হয়ে যাবি। মেয়ে হলে আরো আর্লি জামাইয়ের শাশুড়ি হবি।
-” ভালো তো।”
-” উইশ করি একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে আসুক তোর।”
প্রত্যাশা মিষ্টি হেসে বলল,
-” তোর দোয়াটা যেন লাগে ভাই। আমিও সেটাই চাই।”
কোয়েল ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে বলল,
-” অ্যাই প্রত্যাশা তোর এএসপি সাহেব তো প্রথমেই ডাবল সেঞ্চুরি করল। প্রথম বাচ্চাই টুইনস।”
প্রত্যাশা মনেমনে বিড়বিড় করল,
-” বাসর রাতে এএসপি সাহেবের ডাবল আদরের কামাল।”
গলা ঝেড়ে প্রত্যাশাও দুষ্টামি করে বলল,
-” তুই রোহানকে বলবি, বাসর রাতে ট্রিপল আদর করতে। দেখা যাক তোরা দু’জন হ্যাট্রিক করতে পারিস কিনা।”
ওদিকে ভিডিও কলে কোয়েলের কথা হালকা কানে যেতেই নীরবের বেষম লাগে। শুকনো গলায় খুকখুক করে কেশে উঠল। তারপর প্রত্যাশার কথা শ্রবণ হতেই বেচারার মনে হলো পা’গলের কারখানায় পরেছে সে। ত্রস্ত ওঠে ব্যালকনিতে চলে যায় নীরব।
এদিকে কথা শেষ করে প্রত্যাশা ব্যালকনিতে গেল। দুই হাত ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে সটান দাড়িয়ে ছিল নীরব। প্রত্যাশা কফির মগ বাড়িয়ে বলল,
-” কফি নিন।”
নীরব গম্ভীর মুখে তাকাল। বলল,
-” ফাইনালি ম্যাডামের ফোনালাপ শেষ হলো।”
ধোঁয়া ওঠা কফির মগ হাতে নিল নীরব। প্রত্যাশা দুইহাত বুকে ভাঁজ করে বলল,
-” আপনার কী হিংসে হচ্ছিল? মুখটা অমন থমথমে করে রেখেছিলেন যে।”
নীরব সরল স্বীকারোক্তি করে বলল,
-” হুম। জেলাসি হচ্ছিল। একটু-আধটু নয়, অনেক বেশি।”
পিঠটা গ্রিলে ঠেকিয়ে প্রত্যাশা ঠিক নীরবের সামনাসামনি দাঁড়াল। বলল,
-” আচ্ছা, সব বাদ দিয়ে বলুন শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে।”
কফির মগে ঠোঁট ডোবাল নীরব। কফিটুকু গলাধঃকরণ করে প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-” মারাত্মক সুন্দর লাগছে! অবর্ণনীয়!”
প্রত্যাশা পেটের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,
-” ধূর মিথ্যে বলছেন। পেটটা কত উঁচু। এই অবস্থায় শাড়ি পড়ে মোটেই সুন্দর লাগছে না। কেমন কেমন লাগছে।”
কফির মগ পাশে নামিয়ে প্রত্যাশার কোমর জড়িয়ে কাছে টানল নীরব। তীব্র বিরোধিতা করে বলল,
-” ইউ রং। তোমাকে এই অবস্থায়ই বেশি সুন্দর লাগছে!”
প্রত্যাশার হাত দু’টো নীরবের কাঁধে ঠেকল। একহাতে প্রত্যাশার পিঠ জড়িয়ে ধরে নীরব। ওর অন্যহাতটা প্রত্যাশার শাড়ির ফাঁক গলে পেট ছুঁয়ে দিল। প্রত্যাশার শরীর মৃদু কেঁপে উঠল। আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে নরম স্বরে বলল নীরব,
-” আমার চোখে এই মুহূর্তের তুমিটাই সবচেয়ে বেশি সুন্দর! এই যে পেটটা উঁচু, এটাই তো আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর চিহ্ন। আমাদের ফার্স্ট বেবি। আমাদের পবিত্র ভালোবাসার চিহ্ন, সাক্ষী।”
প্রত্যাশা আপ্লুত হলো। দুহাতে নীরবের গলা জড়িয়ে ধরল। চোখমুখে একগুচ্ছ স্বপ্ন নিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
-” নীরব জানেন, আমি চাই আমাদের বেবিরা আপনার মতো দেখতে হোক। ঘন জোড় ভ্রু, কুচকুচে কালো চোখের মণি, সরু নাক, দুধের মতো ফর্সা গায়ের রং। আমার চাওয়াটা বললাম, এবার আপনার পালা।”
নীরব স্মিত হাসল। প্রত্যাশার নাকে নাক ছুঁইয়ে বলল,
-” বেবি তোমার কিউট ফেসটা যেন পায়।”
প্রত্যাশা বলল,
-” না আপনার মতো যেন হয়।”
-” তোমার মতো হলেই চলবে। শুধু।”
প্রত্যাশা মুখটা তুলে তাকাল। ভ্রু উঁচু করে ইশারায় বোঝাল,
-” শুধু কী?”
নীরব গলাটা খাঁকারি দিয়ে একটু গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
-” হ্যাঁ, শুধু তোমার থেকে যদি ব্রেনটা সামান্য শার্প আর বাকপটুতা একটু কম হয়, তাহলেই পার্ফেক্ট।”
প্রত্যাশা সাথে সাথে গাল ফুলিয়ে ফেলল। কোমর থেকে নীরবের হাত সরিয়ে দিল। রাগী কণ্ঠস্বরে বলল,
-” নীরব আপনি বলছেন আমি বেশি কথা বলি, আবার বুদ্ধিতেও ঘাটতি আছে? তাই তো? বাহ্, বাহ্ , ধন্যবাদ।”
বলেই উল্টো ঘুরে পা বাড়ায় প্রত্যাশা। নীরব শুকনো ঢোক গিলল। বলে যেন ফ্যাসাদে পড়ল সে। বউয়ের অভিমান ভাঙাতে চট করে হাত ধরে আস্তে করে টান দিল। পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরে থুতনিটা প্রত্যাশার ঘাড়ে ঠেকাল। হিম শীতল কণ্ঠস্বরে বলল,
-” স্যরি, স্যরি। ওভাবে মিন করতে চাইনি।”
বলেই প্রত্যাশাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় নীরব। দুই হাতে প্রত্যাশার মুখটা আঁজলা করে ধরে কপালে চুমু খেল। বলল আলতো স্বরে,
-” আমাদের বেবি হবে তুমি-আমি মিলিয়ে তৈরি সবচেয়ে সুন্দর ক্রিয়েশন। তোমার-আমার মিশ্রনে তৈরি, পৃথিবীর সবচেয়ে আদুরে বেবি।”
#চলবে