বিনিময় পর্ব-০১

0
9

#বিনিময় (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

পঁচিশ বছর একসঙ্গে ঘর করার পর স্বামীর মুখে ‘তালাক’ শব্দটা শুনে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় সাবিনা বেগমের। সে একদম স্তব্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার তার স্বামী মুখ দিয়ে আবার একই শব্দ উচ্চারণ করতে নিলে সাবিনা তার মুখ চেপে ধরে। নরম গলায় বলে,“আল্লাহর দোহাই লাগে আর এই নিকৃষ্ট শব্দটি উচ্চারণ করো না। আর না।”

কথাটি বলতে গিয়ে সাবিনা বেগম কান্না করে দেয়। তার চোখের পানি তার স্বামীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। সে যে চাইলেও তার স্বামীকে ছাড়তে পারবে না সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। এটা দেখে সাবিনা বেগমের স্বামী আলতাব হোসেন মুখের থেকে হাত সরিয়ে বলে,“মুখে শব্দটা উচ্চারণ করতে বাঁধা দিলেই বুঝি মন থেকে শব্দটি মুছে যাবে। সেটা তো যাবে না। তুই কেন বুঝতে পারছিস না, আমি তোর সঙ্গে থাকতে চাই না। একদমই না।”

“তুমি পাগল হয়ে গেছো?
আমাদের এত বছরের সংসার জীবন। দু’জন সন্তান রয়েছে। আর তুমি এই বয়সে এসে বলছো তোমার আমাকে ভালো লাগে না। তোমার ডিভোর্স চাই। পাগল হয়েছো?”
সাবিনার কথা শুনে আলতাব রাগান্বিত গলায় বলে,“একসাথে পঁচিশ বছর কাটিয়েছি বলেই যে সারাজীবন কাটাতে হবে এমন তো কথা নেই। তাছাড়া এত বছর আমি তোমার সঙ্গে জোর করে ছিলাম। তুমি আমার কাছে বিরক্তি অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিলে। তবুও আমি জোর করে তোমার সঙ্গে ছিলাম। এটাই অনেক নয়।”

“মেয়েটা কে?”
সাবিনার এই কথা শুনে আলতাব কিছুটা অবাক হয়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বলে,“কোন মেয়ে?”

“যার জন্য আজ তুমি এত পাগল হয়ে গেছো। আমাকে নিজের জীবন থেকে সরাতে উঠেপড়ে লাগছো। সেই মেয়েটা কে?”
সাবিনার কথা শুনে আলতাব কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে। সে অস্বীকার করার চেষ্টা করে। তবে সাবিনা উচ্চশব্দে এবং স্পষ্ট গলায় বলে,“তোমার স্বভাব আমি ভালোই জানি। পঁচিশ বছরে কম তো দেখলাম না। এবার বলো এখন আবার কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছো। যার জন্য সব ভুলে মরিয়া হয়ে উঠেছো।”

“সে যেই হোক তোমার মতো নয়।”
এটা শুনে সাবিনা বিরক্ত হয়ে বলে,“ওহ তাই। অবশ্যই সেই মেয়েটা খুবই জঘন্য নয়তো তোমার বাইশ এবং আঠারো বছরের দুইজন ছেলে মেয়ে আছে জেনেও, তোমার বউ আছে জেনেও তোমার পিছনে পড়েছে। সেই মেয়ে আমার চেয়ে জঘন্যই হবে। হয়তো কোন পাড়ার বে…..।”

“সাবিনা….।”
আলতাব চিৎকার করে উঠে। এটা শুনে সাবিনাও চিৎকার দিয়ে উঠে। সে বলে,“চুপ। গলা নামিয়ে। খুব প্রেম জেগেছে মনে তাই না? প্রেমের টানে একদম পাগল হয়েছিস। সব ভুলে গেছিস বুঝি। তোর মনে নেই। তু…।”

“আমার সব মনে আছে।
শোনো সাবিনা আমি আমার জীবনের সত্যিকারের ভালোবাসা পেয়ে গেছি। সেজন্য তোমার ব্লাকমেইলে আর ভয় পাচ্ছি না। আর পাবোও না। আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। আমি এখন শুধু তাকে চাই। সেই মানুষটাকে যে আমাকে মানসিক শান্তি দিতে পারবে। শুধুমাত্র সেই পারবে।”
আলতাবের মুখে এই কথা শোনার জন্য সাবিনা প্রস্তুত ছিলো না। আলতাব সবকিছু ছাড়ার জন্য প্রস্তুত। এটা শুনে সাবিনা কিছুটা উপহাস করে বলে,“আচ্ছা। মেয়েটাকে গিয়ে এসব বলো। দেখবে তোমার মানসিক শান্তি তোমাকে ফাঁকি দিয়ে উড়াল দিচ্ছে। যাও একবার গিয়ে সত্যিটা বলো। আমি জানি, এই সত্যি তাকে বলোনি। বলবেও না। তবে হ্যাঁ এটা আজ নয় তো কাল সে জানবেই। জানলে নিশ্চয় তোমার সঙ্গে থাকবে না।”

“সে তোমার মতো নয় সাবিনা। সে আমাকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। সে সবকিছু মেনেই আমাকে চায়। আর হ্যাঁ তাকে আমি অলরেডি সব বলে দিয়েছি। সে শুধু আমাকেই চায় বলেছে। আমি যাতে তার কাছে যাই।”

“সব জেনেও সে তোমাকে এই কথা বলেছে?”
সাবিনা ভীষণ অবাক হয়। আলতাব মাথা নাড়ায়। সাবিনা রাগ নিয়ে বলে,“অসম্ভব।”

“সম্ভব। সত্যিকারের ভালোবাসায় সব সম্ভব।
তাছাড়া আমি বলবো তুমি আমাদের নিয়ে না ভেবে বরং ডিভোর্স নিয়ে ভাবো। আমি খুব শীঘ্রই তোমাকে ডিভোর্স লেটার দিতে চলেছি।”
এটা শুনে সাবিনা পুরো হতাশ হয়ে যায়। সে আলতাবকে বোঝাতে চায় কিন্তু সে তার কথা না শুনেই চলে যায়। সাবিনা সেখানেই বসে পড়ে। আলতাবের কথাবার্তা আচরণে সাবিনা বুঝতে পারে এই মানুষটা তাকে কখনো ভালোই বাসেনি। শুধুমাত্র সে একাই তাকে ভালোবেসে গিয়েছি। সাবিনা এই মূহুর্তে কী করবে ভেবে না পেয়ে তার ছেলে, মেয়েকে ফোন দেয়। যারা পড়াশোনার জন্য হোস্টেলে থাকছে। তাদের ফোন দিয়ে সাবিনা বাসায় আসতে বলে।

___

রিমা এবং রানা হোস্টেল থেকে বাড়ি আসতে সাবিনা তাদের সব খুলে বললো। বাবার কান্ড শুনে রিমা এবং রানা দু’জনেই হতভম্ব হয়ে যায়। বাবা বাড়ি ফিরলে রাতে চারজনে মিলে আলোচনায় বসে। রানা কিছুটা রাগ নিয়ে কথা বললে রিমা তাকে থামিয়ে শান্ত গলায় বলে,“বাবা তুমি আমাদের কথা ভাববে না। এই বয়সে এসে যখন আমাদের বিয়ের সময় সেই মূহুর্তে তুমি মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবছো। আমাদের কথা না হোক মান সম্মানের কথা তো ভাববে। এসব জানাজানি হলে আমাদের কত সমস্যায় পড়তে হবে তুমি বোঝ না?”

“লোকের কাজ লোকে করবে। তাদের জন্য তো আমি আমার জীবনটা শেষ করতে পারি না।”
আলতাবের এমন মন্তব্য শুনে রিমা হতাশ হলেও সে বোঝানোর চেষ্টা করে। আলতাব কোন কিছু না বুঝে বলে,“দেখ তোদের মায়ের সঙ্গে আমার মনের মিল কখনোই ছিলো না। আমাদের বিয়েটা এমনিতেও টেকার নয়। তাই অহেতুক কথা বাড়াস না। আমি জানি, এই মূহুর্তে তোদের আমার সিদ্ধান্তকে ভুল মনে হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, একটা সময় পর তোরা বুঝতে পারবি আমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেইনি।”
একটু থেমে আলতাব পুনরায় বলে,“প্রত্যেক মানুষেরই ভালো থাকার অধিকার আছে। আমি আমার ভালো থাকা যদি খুঁজে নেই তবে তোদের সমস্যা কোথায়। সমস্যা হওয়ার তো কথা নয়।”

এটা শুনে রানা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,“বুড়ো বয়সে ভিমরতি ধরেছে। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। এখন এই বয়সে এসে পর কীয়ার মতো নোংরামিতে যুক্ত হয়েছো। নিজের স্ত্রী, সন্তান কারো কথা ভাবছো না৷ লজ্জা করে না আবার বড় মুখ করে এসব কথা বলছো। তোমার কী বিন্দু পরিমান লজ্জা লাগছে না এসব বলতে?”

“না। কারণ আমি জানি আমি যা করছি বা বলছি সবটাই ঠিক।”

“বাবা।”
চিৎকার করে রানা তেড়ে আসে। রিমা এবং সাবিনা থামিয়ে দেয়। সাবিনা আলতাবের কাছে হাতজোড় করে বলে,“আমার কথা না ভাবো। দয়া করে একটু ছেলে মেয়ের কথা ভাবো। প্লীজ ভুল পথ থেকে ফিরে আসো।”

“শোনো সাবিনা যতই ছেলে মেয়েকে বাসায় ডেকে এনে আমার নামে বিচার বসাও, কাজ হবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। তোমার সঙ্গে গত পঁচিশ বছরে থেকে আমি শুধু আমার জীবনটা নষ্টই করেছি। এছাড়া কিছু নয়। এখন জীবন যখন আমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছে। এই বয়সে এসে যখন আমি আমার ভালো থাকা খুঁজে পেয়েছি তখন কেন ভালো থাকাটা বেছে নিবো না।”
একটু থেমে এবার আলতাব হাতজোড় করে। তারপর বলে,“তুমি আমার উপর দয়া করো। চুপচাপ আমাকে ডিভোর্সটা দিয়ে দাও। সব ঝামেলা শেষ করো। আমি আমার জীবনটা সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিচ্ছি। তুমিও তোমারটা নাও।”

এটা বলে আলতাব শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। রিমা, সাবিনা, রানা হতাশ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। রানা তো রাগান্বিত গলায় বলে,“বাবার ভিমরতি আমি ছোটাচ্ছি মা। তুমি শুধু আমাকে অনুমতি দাও। কয়েক ঘা পিঠে পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“হবে না।
গত পঁচিশ বছরে কম তো চেষ্টা করিনি। তার স্বভাব বদলানো না। এখন এই বয়সে এসেও মৃ ত্যুর ভয়টাও কাজ করছে না। আমি তোদের ডেকেছিলাম বড় আশা নিয়ে। ভেবেছিলাম তোদের দিকে তাকিয়ে হলেও তোদের বাবা নিজের ভুলটা বুঝতে পারবে। কিন্তু মনে হয় না বুঝবে। এই মানুষটা শুধরানোর নয়।”
কথাগুলো থেমে থেমে বলছিলো সাবিনা। তার গলা দিয়ে শব্দ বের হতে চাচ্ছে না৷ তবুও বহুকষ্টে বের করছে সে৷ এই সময়ে এসে আলতাবের এমন পাগলামি দেখতে হবে সেটা সাবিনা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। রিমা মাকে জড়িয়ে ধরে। রানাও যথা সম্ভব সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে।

____
কয়েকদিন পর। হাতে ডিভোর্স পেপার নিয়ে একটি পার্কের নিরিবিলি এক স্থানে থাকা বেঞ্চের উপর বসে রয়েছে সাবিনা। সাবিনা এবং তার সন্তানরা আলতাবকে কিছুতেই বোঝাতে পারলো না। সে সাবিনাকে ডিভোর্স দিয়েই দিলো। গত পঁচিশ বছরের পথচলার ইতি টানলো। সাবিনা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অতীতের কিছু স্মৃতির কথা ভাবে। তার অজান্তেই তার চোখ দিয়ে অশ্রুর ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সেই মূহুর্তে কেউ একজন তার দিকে রুমাল এগিয়ে দিয়ে বলে,“বয়স তো কম হলো না। এই বয়সে অন্যের কথা ভেবে দুঃখ পেয়ে চোখের পানির অপচয় কেন করছেন কাকী মা।”

সাবিনার কানে কথাগুলো যেতে সে বাস্তবে ফিরে আসে। অবাক দৃষ্টিতে সামনে তাকায়। তার সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি তাকে রুমালটি নিতে ইশারা করে বলে,“আপনি যার জন্য কান্না করছেন, গিয়ে দেখুন সে আপনার এই চোখের পানিতেই নিজের সুখের গল্প সাজাচ্ছে। তাই বলছি চোখের পানির অপচয় করবেন না।”
এটা বলে মেয়েটি সাবিনার পাশে বসে পড়ে৷ কিছুটা জোর করে রুমালটি হাতে ধরিয়ে দেয়। সাবিনা রুমাল হাতে কয়েক মূহুর্ত ভাবে, অতঃপর চোখের পানি মুছে নেয়। অতঃপর মেয়েটি বলে….



চলবে