#বিনিময় (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
“আপনি কাঁদছিলেন কেন?”
মেয়েটির প্রশ্নে সাবিনা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে৷ তার আবারও আলতাবের সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার কথাটি মনে পড়ে যায়। সে ডিভোর্সের পেপারটির দিকে তাকায়। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে মেয়েটিও তাকায়। অতঃপর বলে,“আপনার ডিভোর্স হয়েছে?”
“তোমার এসব জেনে কোন কাজ নেই।”
এটা বলে সাবিনা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মেয়েটি মুচকি হাসি দিয়ে বলে,“একটু নাহয় জানলাম।”
“কেন?”
সাবিনার প্রশ্ন শুনে মেয়েটি মুখের হাসি ধরে রেখেই বলে,“একটু নাহয় আপনার দুঃখের গল্পগুলো আমার সঙ্গে করলেন। ক্ষতি তো নেই।”
“অন্যের দুঃখের গল্প শুনতে বুঝি তোমার ভালো লাগে?”
এটা শুনে মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে বলে,“না।”
“তবে অন্যের দুঃখের গল্প শুনতে চাও কেন?”
“আমার জীবনে অনেক সুখ তো। তাই আমি অন্যের দুঃখের সঙ্গে আমার সুখটা বিনিময় করি।”
মেয়েটির মুখে এই কথা শুনে সাবিনা কিছুটা চমকে যায়। সে মেয়েটির হাসি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক মূহুর্তে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠে,“স্নিগ্ধ, মিষ্টি এক মুখ।”
“কিছু বললেন?”
“না।”
সাবিনার মুখে এটা শুনে মেয়েটি তার হাত বাড়িয়ে দেয়। সে খুব মিষ্টি করে বলে,“আমি মেঘা। চলুন না আমরা পরিচয় হই কাকী মা।”
“হাঁটুর বয়সী একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।”
এটা বলে সাবিনা উঠে দাঁড়ায়। সে কথা বাড়াতে চায় না। মেঘা মুখের হাসি ধরে রেখেই বলে,“হাঁটুর বয়সী একটি মেয়ের সঙ্গে নাহয় সুখ-দুঃখ বিনিময় করলেন। ক্ষতি নেই তো।”
”আমার দিকে তাকাও। আমার সেই বয়সটা আছে যেই বয়সে তোমার সঙ্গে এমন খেলা করা যায়। আমার মনে হয় তোমারও নেই। তাই বলবো এসব বাচ্চামো বাদ দিয়ে নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করো।”
“সেটা তো করছিই কাকী মা।
আপনি আমাকে যতটা বাচ্চা ভাবছেন। আমি কিন্তু ততটাও বাচ্চা নই। বয়স পঁচিশ পেরিয়ে গেছে। আর হ্যাঁ আমি কোন বাচ্চামো কথাও বলছি। কী লাভ অন্যের জন্য কেঁদে? তার চেয়ে একটু নাহয় আমার সুখে আপনিও সুখী হলেন।”
মেঘার সঙ্গে কথা বললে সময় নষ্ট হবে ভেবে সাবিনা রুমালটি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,“নাও।”
“রেখে দিন।”
মেঘার মুখে এই কথা শুনে সাবিনা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে,“তোমার জিনিস আমি রাখবো কেন?”
”আপনার যখন দুঃখ পাবে তখন এটা দেখে নাহয় একটু ভাবলেন যে এই রুমালের মালিকটি খুব সুখী। দুঃখের সময় একজন সুখী মানুষের অস্তিত্ব থাকা ভালো।”
মেঘার এমন কথাবার্তায় সাবিনা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে কথা না বাড়িয়ে রুমালটি হাতে নিয়েই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যেতে নেয়। মেঘা এটা দেখে ছুটে তার পাশে আসে। অতঃপর বলে,“চলে যাচ্ছেন যান। কিন্তু দুঃখ পাবেন না। যার জন্য কেঁদে আপনি নিজেকে অসুস্থ করবেন, সে কিন্তু আপনার অসুস্থতায় বিন্দু পরিমান খোঁজ নিবে না আপনার। একদম নিবে না।”
“তুমি কী এখন আমার সঙ্গে যাবে নাকি?”
সাবিনা প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে কথাটি বলে৷ মেঘা তার বিরক্তি বুঝে বলে,“আমার মতো মিষ্টি একটি মেয়েকে আপনার বিরক্ত লাগছে। তাহলে নিশ্চয় চোখের পানি খরচা করতে গিয়ে আপনি পাওয়ার হারিয়েছেন। নয়তো আমার এত সুন্দর মুখটা দেখে কেউ বিরক্ত হতে পারে। একদমই পারে না।”
“তুমি আমার পিছু নিচ্ছো কেন?”
সাবিনা দাঁড়িয়ে যায়। সে মেঘার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে। প্রথমে অবশ্য মেঘা ঘাবড়ে যায়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বলে,“সত্যি বলবো?”
“মিথ্যা আমি পছন্দ করি না।”
সাবিনার এই কথা শুনে মেঘা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বলে,“আমার যে এই মাথাটা আছে না। এটায় না প্রচুর গন্ডগোল রয়েছে৷”
এটা বলে আঙুল দিয়ে মাথাটা দেখায়। অতঃপর একটু থেমে আবার বলে,“একবার যখন এই মাথাটা ঠিক করে যে কারো সঙ্গে সুখ-দুঃখ বিনিময় করবে তখন এটা করেই ছাড়ে।”
”বাচাল মেয়ে।”
এটা বলে সাবিনা বিরক্তি নিয়ে চলে যায়। মেঘাও তার পিছু নিয়ে তার বাড়ি অব্দি আসে। এই পার্ক থেকে সাবিনার বাড়িটা কাছেই। সাবিনা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলে মেঘা হতভম্ব হয়ে নিজেই নিজেকে বলে,“আমি এভাবে তার বাড়ি অব্দি কেন আসলাম? মাথাটা সত্যি গেল?”
এটা ভেবে নিজেই আপনমনে হাসে।
____
সাবিনা বাড়ি ফিরতে রিমা তাকে জড়িয়ে ধরে। তার কপালে চুমু খেয়ে বলে,“তুমি কোথায় গিয়েছিলে মা?”
রিমার কন্ঠে উদ্বিগ্নতা ছিলো। সে বাবা, মায়ের বিচ্ছেদের পর এভাবে মাকে ঘরছাড়া দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। তার মনের মাঝে এই ভয়টা কাজ করছিলো, যদি মা কিছু করে দেয়। মেয়ের চিন্তা বুঝতে পেরে সাবিনা বলে,“আমার জীবন তো শেষই। এই বয়সে এসে নিজেই নিজেকে শেষ করে আর পাপ করতে চাই না রে মা। তাই ভয় পাস না। আমি ভুল কিছু করবে না।”
“প্লীজ মা থামো।
তোমার জীবন শেষ হয়নি। তুমি প্লীজ এভাবে ভেবো না। কষ্ট পেও না। বাবার মতো মানুষের জন্য একদমই কষ্ট পেও না। ওনার মতো মানুষ তোমার ভালোবাসা ডিজার্ভ করে না৷ তবুও তুমি তাকে ভালোবেসে গিয়েছো। এটাই অনেক।”
রিমার কথা শুনে সাবিনা চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। সে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কান্না করতে থাকে। সেই সময়ে রানা এসে তাদের পাশে দাঁড়ায়। সে নরম গলায় বলে,“রিমা তুই কিছুদিন মায়ের কাছে থাক। আমার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। পড়ালেখার ভীষণ চাপ। এই মূহুর্তে বাসায় থাকা সম্ভব নয়। সামনে এক্সাম। বাসায় তো সেই পরিস্থিতিও নেই যে শান্তিতে পড়তে পারবো।”
রিমার নাম নিলেও কথাগুলো রানা সাবিনাকেও বলে। সাবিনা বুঝতে পেরে বলে,“তোরা দুজনেই হোস্টেলে ফিরে যা। এভাবে পড়ালেখার ক্ষতি করে লাভ নেই।”
”কিন্তু মা…।”
রিমাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে সাবিনা বলে,“যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমি ঠিক আছি। আমি এখানে ঠিক নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু তোরা আমার জন্য পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়িস সেটা আমি মেনে নিতে পারবো না। তাছাড়া এখানে থাকলে নানান লোকে তোদের নানান কথা বলবে। আমি চাই না আমার সন্তানরা এমন কিছুর সম্মুখীন হোক।”
মায়ের কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে রিমা চুপ করে যায়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বলে,“না মা। তোমাকে আমরা এভাবে এখানে একা ফেলে রাখতে পারবো না। তাছাড়া বাবা এসে যদি আবার ঝামেলা করে।”
“করবে না।
তোর বাবা আমাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে তার নতুন ভালোবাসার কাছে গিয়েছে। এখানে আর আসবে না। আসলেও লাভ নেই। এই বাড়িতে ওর জায়গা হবে না।”
একটু থেমে সাবিনা আবার বলে,“তোরা চিন্তা করিস না। সবটা আমি সামলে নিতে পারবো। তোরা হোস্টেলে ফিরে যা।”
সাবিনা বেশ খানিকটা সময় নিয়ে নিজের ছেলে মেয়েকে বোঝায়। বিশেষ করে মেয়েকে। সে বলে,“তোরা পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হ এটাই আমি চাই। এখন তোদের নিয়েই আমার সব স্বপ্ন, আশা ভরসা। তোরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো। প্রতিষ্ঠিত হলে আমি খুশি থাকবো।”
অবশেষে রিমাও হোস্টেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে মায়ের মনের অবস্থা ভেবে এখনো তার চিন্তা হচ্ছে। সাবিনা চিন্তা করতে বারণ করে।
____
আলতাব খুশিমনে তার প্রেমিকার বলা স্থানে এসে বসে রয়েছে। বেশ খানিকটা অপেক্ষা করার পর সে তাকে ফোন দেয়। প্রথমবার রিং হয়ে বেজে যায়। কেউ ফোন ধরে না। আলতাব কিছুটা অবাক হলেও দ্বিতীয়বার ফোন দেয়। এবার ধরে। ফোনটা ধরতে আলতাব বলে,“প্রিয়া কোথায় তুমি?”
“বাসায় ঝামেলা হয়ে গেছে। আজ আমি আসতে পারবো না। তুমি আপাতত কোন একটি হোটেলে রাত কাটাও। কাল এসে আমি সবটা বলছি।”
আলতাব প্রিয়ার কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ে। প্রিয়া তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,“চিন্তা করো না। আমি তোমারই আছি। তোমারই থাকবো। কাল যথা সময়ে চলে আসবো।”
“এই ভরসাই তো সব ছেড়ে তোমার কাছে আসছি। প্রিয়া আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি জানি তুমিও আমাকে খুব ভালোবাসো।”
আলতাবের কথা শুনে প্রিয়া মুচকি হাসে। সে জবাবে ‘ভালোবাসি’ বলে। অতঃপর ফোন রাখে। প্রিয়া ফোন রেখে মুচকি মুচকি হাসে। মনেমনে বলে,“খুব ভালোবাসি গো।”
অন্যদিকে আলতাব ফোন রেখে আশেপাশে ভালো হোটেল কোথায় রয়েছে সেটা খুঁজতে থাকে। সেই সময়ে অবশ্য রানা তাকে ফোন দেয়। কিন্তু সে ধরে না। সে সব পিছুটান ছেড়ে চলে এসেছে৷ এখন আর পিছু ফেরার উপায় নেই।
’
’
চলবে,