বিনিময় পর্ব-০৪

0
8

#বিনিময় (৪)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

“রিমা এটা আংকেল না?”
রিমার বান্ধবী কথাটি বলে ভিডিওটি দেখায়। আলতাবের কান্ড দেখে রিমা পুরো হতভম্ব হয়ে যায়। তার বান্ধবী কিছুটা উপহাস করে বলে,“ছিঃ। এই বয়সে তোর বাবা এসব করে বেড়াচ্ছে।”

অন্য এক বান্ধবী পাশ থেকে বলে উঠে,“ভালোই হয়েছে কখনো তোর বাড়ি যাইনি। তোর বাড়ি গেলে তো আমাদের রক্ষে ছিলো না। তোর বাবার যা চরিত্র। আমাদের সঙ্গে না কিছু করে বসতো।”

রিমা তাদের কথা শুনে নির্বাক হয়ে যায়। কোন উত্তর দেওয়ার ভাষা পায় না। সেই সময়ে রানা ফোন দেয়। রিমার প্রথমে সাহস হয় না ফোনটা ধরার। বারবার ফোনে রিং বাজায় বাধ্য হয়ে ফোনটা ধরে। রিমা ফোনটা ধরতে রানা মলিন গলায় বলে,“দেখেছিস বাবার কান্ড?”

“হ্যাঁ।”
রিমা মনমরা কন্ঠে জবাব দেয়। রানা রাগান্বিত গলায় বলে,“লোকটা আমার বাবা আমার ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে। তার জন্য এখন আমি বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না। পরিবারের সঙ্গে যত ছবি পোস্ট দিয়েছি সব ডিলেট দিয়েছি। তাও সবাই জেনে গেলে। এই লোকটা আমাদের শান্তি দিবে না। আমার তো এখন ইচ্ছে করছে গিয়ে জানে মে রে ফেলি।”

“বাবা এমন কাজ করতে পারে সেটা আমিও ভাবতে পারছি না। অবশ্য যে লোক এত বছরের সংসারের ইতি টানতে পারে পরকীয়ার জন্য সে সব পারে। আমরাই আমাদের বাবাকে ভালো ভাবতাম।”
এটা বলে রিমা এবার কান্না করে দেয়। রানাও মলিন গলায় বলে,“হ্যাঁ। এই ঘটনার পর তো এখন আমি ক্লাসে যেতে পারছি না। আমার বারবার মনে হচ্ছে ক্লাসের সবাই আমাকে দেখে হাসবে।”

“মা জানে?”
রিমার এই প্রশ্ন শুনে রানা জানায় সে মাকে ভিডিওটা পাঠিয়েছে। তার মা হয়তো দেখেছে। রানা এবং রিমা একে-অপরকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। এই মূহুর্তে তাদের ভরসা দেওয়ার কেউ নেই। হয়তো তাদের মা এটা দেখে ভেঙে পড়েছে। আর তারা যেখানে আছে সেখানে তো সবাই তাদের নিয়ে হাসাহাসি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই এখন দুই ভাই বোনের ভরসা দুজনেই।

_____

সাবিনা তার স্বামীর এসব কাজ দেখে পুরো হতভম্ব হয়ে যায়। আলতাবের চরিত্রের দোষ আছে তাই বলে এতটা জঘন্য সে। সাবিনা এটা মেনে নিতে পারলো না। সে ফোন হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার কান্নার শব্দ শুনে পাশের ঘর থেকে মেঘা বেরিয়ে আসে। সে এসে সাবিনার পাশে বসে। তার কাধে হাত রাখতে সাবিনা তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মেঘা কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সাবিনা তাকে ফোনে থাকা ভিডিওটা দেখিয়ে বলে,“এটা আমার স্বামী।”

মেঘা সবটা বুঝতে পেরে শান্ত গলায় বলে,“যার সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে সে কিভাবে স্বামী হয়? আর আপনি এই লোকটার জন্য কান্না করছেন? এত জঘন্য এক লোকের জন্য কান্নাও বা করছেন কেন আপনি? এটা তো ঠিক নয়। চোখের পানি এমন অপচয় কেন করছেন?”

মেঘার কথা শুনে সাবিনা চুপ হয়ে যায়। তবে কান্না থামে না। শব্দহীন কান্না করতে থাকে। মেঘা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,“আপনার খুশি হওয়া উচিত এমন একটি মানুষের সঙ্গে আপনার নামটা আর জুড়ে নেই সেটা ভেবে। আপনাদের ডিভোর্সের পর আপনি তার এসব নোংরামি দেখতে পেয়েছেন।”

“একটা কাগজের সইয়ে বুঝি সব শেষ হয়ে যায়?”
সাবিনার মুখে এই কথা শুনে মেঘা জবাব দিতে পারে না। সে প্রসঙ্গ বদলে বলে,“আমি আমার খাবারের ব্যবস্থা নিজে করবো নাকি আপনি আমাকে খাওয়াবেন। তার বিনিময়ে টাকাটা নিয়ে নিলেন।”

“আচ্ছা আমিই খাওয়াবোনি।”
এটা শুনে মেঘা কিছুটা গভীর নজরে তাকিয়ে বলে,“আপনি আমাকে খাওয়াবেন কিভাবে? কান্না করার পর রান্না করার সময় পাবেন? মনে তো হয় না সময় পাবেন। আপনার এই কান্না তো থামার নয় দেখছি।”

এটা শুনে সাবিনা ম্লান হাসে। মেঘার মজার স্বরে অন্যরকম ভাবভঙ্গি নিয়ে বলা কথা তার খারাপ লাগছে না। মেঘা বুঝতে পেরে আবার বলে,“চুল তো পেকেই গেল। এই বয়সে এসে কান্না করেই যদি সব সময় নষ্ট করেন তবে নিজের ভুলের জন্য অনুশোচনা করে সঠিক পথে হাঁটা শুরু করবেন কিভাবে?”

“ভুল?”
সাবিনা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। মেঘা মাথা নাড়িয়ে বলে,“ভুল মানুষকে জীবনে বেছে নেওয়া, তার জন্য অনবরত চোখের পানি ফেলা। এগুলো বুঝি ভুল নয়?”

“তুমি ঠিকই বলেছো। আমি সত্যি আলতাবকে জীবনে বেছে ভুল করেছি। চরম ভুল।”
এটা বলে সাবিনা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। সে কিছু একটা ভাবছিলো। সেই মূহুর্তে কলিংবেল বেজে উঠে। সাবিনা নিজেকে সামলে চোখের পানি মুছে এসে দরজা খুলে। মেঘাও পিছনে আসে। সাবিনা দরজা খুলে আলতাবকে দেখে প্রচন্ড রেগে যায়। সে আলতাবের গালে থাপ্পড় মারতে যায় সেই মূহুর্তে আলতাব কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ সে কাঁদতে কাঁদতে বলে,“আমি মস্তবড় ভুল করে ফেলেছি সাবিনা। মস্তবড় ভুল করেছি।”

“তুমি কোন সাহসে আমার বাড়িতে পা রেখেছো। তোমার ঐ নোংরা মুখ নিয়ে আমার বাড়ির দরজা এসে দাঁড়াতে লজ্জা করলো না বুঝি।”
সাবিনা কঠিন গলায় কথাটি বলে। সেই সময়ে আলতাব হাতজোড় করে বলে,“সাবিনা আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমার তো কিছু নেই। আমার যা আছে সবই তো তোমার কাছে। এখন তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিলে আমি কোথায় যাবো।”

“কেন আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সময় মনে ছিলো না? তখন তো খুব বলছিলে তোমার ভালোবাসা তোমাকে জায়গা দিবে। সে ভালো চাকরি করে। তোমাদের সংসার সুন্দর চলে যাবে। এখন আমার দরজায় এসে আবার দাঁড়িয়েছো কেন?”
সাবিনা এবং আলতাবের কথোপকথনের মাঝে মেঘা বলে উঠে,“আপনি এই নোংরা মানুষটার সঙ্গে কথা বলছেন কেন কাকী মা? দরজা বন্ধ করে দিন মুখের উপর। এই ধরনের মানুষ আপনার মুখ দেখার যোগ্য নয়।”

আলতাবের নজরে এবার মেঘা আসে। তার কথা শুনে রেগে সে বলে,“এই মেয়েটা কে? আর এসব ভুলবাল কথা বলছে কেন?”

এতক্ষণে সাবিনাকে এড়িয়ে আলতাব ঘরে প্রবেশ করে। সাবিনা কঠিন গলায় বলে,“ও কোন ভুল বলেনি। তোমার মতো মানুষের মুখ দেখাও পাপ। তাই এখনই আমার বাড়ি থেকে বের হও। দ্রুত বের হও।”

“সাবিনা দেখো, আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো। আমি একজন প্রতারকের ফাঁদে পড়েছি। যা হয়েছে ভুল হয়েছে। আমি বলছি তো।”

“চুপ। তোমার মুখটা দেখতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। তাই ভালো হয় তুমি আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও। এটাই তোমার জন্য ভালো হবে। তুমি নিজে বেরিয়ে না গেলে আমাকে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। সেটা হয়তো তোমার জন্য ভালো হবে না।”
সাবিনার মুখে এই কথা শুনে আলতাব বলে,“অন্য ব্যবস্থা মানে?”

“দারোয়ান ডেকে ঘর থেকে বের করে দিবো।”
সাবিনার এই কথায় মেঘা তাল মিলিয়ে বলে,“ওনার জন্য এটাই ঠিক।”

“এই মেয়ে চুপ করো।
আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোন কথা বলবে না।”
আলতাবের এই কথায় সাবিনা প্রতিবাদ করে। সে বলে,“তুমি ভুলে যাচ্ছো আমরা আর স্বামী, স্ত্রী নই।তাই ভালোয় ভালোয় বের হও নয়তো দারোয়ান ডাকবো।”

“ওহ আচ্ছা তাই। আমিও ভালোভাবে ক্ষমা চেয়েছিলাম। যেহেতু তুই সেটা মানছিস না। তাহলে এবার আমাকেও নিজের স্বরূপ দেখাতে হয়।”

“তুমি আর কী দেখাবে? তোমার স্বরূপ সবাই ইতিমধ্যে দেখেছে।”
এভাবে এক কথা দুই কথায় সাবিনা এবং আলতাবের ঝগড়া বেঁধে যায়। তর্কের মাঝে সাবিনা বারবার তাকে ঘর থেকে বের হতে বলে। এটা সাবিনার বাড়ি। আলতাবের সব সম্পত্তিই সাবিনার নামে। সেজন্যই এতকাল নিজের নোংরা চরিত্র প্রকাশ করতে পারেনি আলতাব। অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালেও কাউকে বিয়ে করতে পারেনি। কারণ বিয়ে করলে সব হারাতে হবে। মেয়েরাও এটা জেনে তাকে ছেড়ে দেয়। এবার প্রিয়া অর্থাৎ মৌমিতা সব জেনেই তাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিয়ে দুজনার ডিভোর্স করিয়ে দিয়েছে৷ আলতাব জানে সাবিনার বাড়ি তাই সাবিনা তাকে বের করে দিতে পারে। এখানে সে জোর করে থাকতে পারবে না। তাই সে বলে,“আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। তবে হ্যাঁ এবার আমি রানা এবং রিমার কাছে যাচ্ছি।”

“মানে?
তুমি ওদের কাছে কেন যাবে? যা করেছো তাতে ওরা এখন কোন পরিস্থিতিতে আছে তার ঠিক নেই। তোমার জন্য হয়তো বন্ধুদের সামনে ওরা মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সেখানে তুমি ওদের কাছে গিয়ে ওদের মনের জ্বা লা বাড়াতে চাও?”
এটা শুনে আলতাব শয় তানি এক হাসি দিয়ে বলে,“ওরা ওর বাবার আসল রূপটা দেখলো। তাতেই ওদের লজ্জায় মুখ দেখানোর জায়গা নাই। ভাবো তো মায়ের রূপটা দেখার পর কেমন হবে?”

এটা শুনে সাবিনা হতভম্ব হয়ে যায়। সেই সঙ্গে মেঘাও অবাক হয়। আলতাব ঠান্ডা গলায় বলে,“আমাকে এখানে থাকতে না দিলে আমি ওদের কাছেই যাবো এবং তোমার রূপটা সুন্দরভাবে দেখিয়ে আসবো। এবার বলো আমি এখানে থাকবো নাকি চলে যাবো?”

“না।”
সাবিনা কয়েক পা পিছিয়ে যায়। পড়ে যেতে নেয় মেঘা ধরে ফেলে। সাবিনা বাধ্য হয়ে আলতাবকে এখানেই থাকতে বলে। এটা দেখে মেঘা অবাক হয়ে বলে,“আপনি এমন এক জঘন্য লোককে বাড়িতে থাকার অনুমতি দিলেন?”

সাবিনা কোন কথা না বলে শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আলতাবও অন্য ঘরে চলে যায়। মেঘা পুরো হতবাক হয়ে যায়। আলতাব সাবিনার সম্পর্ক এমন কী জানে যেটা সন্তানদের কাছে প্রকাশ পেতে দিতে চায় না সাবিনা৷ যার জন্য এই লোকটাকে বাসায় থাকতে বললো। মেঘা এসব ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে আসলো। এই ঘরের একটি রুম তার জন্য ছেড়ে দিয়েছে সাবিনা। সে তার সেই ঘরটিতে এসেই বসে। অবশ্য এজন্য অগ্রিম ভাড়াও নিয়েছে সাবিনা। তবে বিছানা সহ কিছু জিনিস ফ্রী পেলো মেঘা। অন্য কোথাও ভাড়া থাকলে এসব অবশ্য পেতো না। তাই তার জন্য ভালোই হলো। তার ঘরের সেই বিছানায় বসেই সে ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেল৷ সেই মূহুর্তে কেউ একজন তাকে ফোন দেয়। ফোনটা ধরে মেঘা বলে,“হ্যাঁ বাসা পেয়ে গেছি।”
এটা বলে ফোনটা কেটে দেয়। সে আর কথা বাড়ায় না। তার মাথায় আলতাব এবং সাবিনার রহস্য ঘুরছে। সে বসে বসে ভাবছিলো সেই সময়ে মানুষের শোরগোলের শব্দ কানে আসলো। সে শব্দ শুনে বাহিরে বের হলে দেখে এই বিল্ডিং এ ভাড়া থাকা সবাই এসে জড়ো হয়েছে। মেঘা সবাইকে দেখে অবাক হয়ে যায়।


চলবে,