নারকেল ফুলের মালা পর্ব-০৪

0
7

#নারকেল_ফুলের_মালা
#ফারহানা_কবীর_মানাল

৪.
তিন্নি খুব সাবধানে বিছানা ছেড়ে নামল। এগুল দরজার দিকে। তার ভীষণ ভয় লাগছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সে তার ভয়টাকে অনুভব করতে পারছে না। থেমে থেমে শরীর কেঁপে উঠছে ঠিকই তবে পা ফেলছে খুব শান্ত ভঙ্গিতে। দরজার কাছ পর্যন্ত পৌছুতেই এক ঝাপটা শীতল বাতাস তার শরীর ছুঁয়ে গেল। হীম ধরানো শরীর বাতাস। সে দু’হাতে নিজের শরীর জড়িয়ে ধরল। দরজা খোলা। হোসেন দরজা খুলে রেখে গিয়েছে।

তিন্নি সুমনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। সুমনের ঘরের দরজা লাগালো। ভেতরে আলো জ্বলছে না। সে খুব সর্তক চোখে চারপাশ দেখতে লাগল।

দোতলা বাড়ি। নিচতলায় শোয়ায় ঘর চারটে, প্রতি ঘরের সাথে বাথরুম। বসার জন্য চার ঘরের মাঝে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা আছে। একপাশে রান্নার জায়গা। দোতলায় উঠার সিঁড়ি ঘরের ভেতর থেকে গিয়েছে। উপরে খুব ছোট ছোট দু’টো রুম আছে। ওগুলো প্রায় সময়ই বন্ধ থাকে। স্টোররুমের মতো করে ব্যবহার করা হয়। আকরাম সাহেব প্রায়ই বলেন, “দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি ঘরের বাইরে হলে ওই দু’টো রুম ভাড়া দেওয়া যেত।”

সরিফা খুব আনন্দিতবোধ করেন। পরক্ষণেই নিভে যান। বাসা ভাড়া দেওয়া হবে না। বাইরের লোক ঘরের ভেতর থেকে যাতায়াত করবে এমন বিশ্রী ব্যাপার আকরাম সাহেব মেনে নিতে পারেন না।

তিন্নি খুব সাবধানে সিঁড়ির পাশে সরে গেল। কেউ নামছে। পায়ের শব্দ এড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করে পা ফেলছে। তবুও শব্দ এড়াতে পারছে না। সে শুকনো ঢোক গিলল। হোসেন এখন ঘরে ঢুকবে। গিয়ে দেখবে তিন্নি সেখানে নেই। তারপর কী হবে? সে আর ভাবতে পারল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামতে লাগল।

হোসেন ঢুকল সুমনের ঘরে। তার দরজায় ছিটকিনি দেওয়া ছিল না। একটু জোর লাগিয়ে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। তিন্নির কাছে এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর নেই। সে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। তড়িঘড়ি করে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। প্রায় তার সাথে সাথেই হোসেন এলো। তিন্নির দিকে তাকিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। শব্দ শোনা গেল স্পষ্ট।

জানালার একটা অংশ থেকে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকছে। এত উজ্জ্বল জোছনা শেষ কবে দেখেছে মনে করতে পারে না তিন্নি। হঠাৎই তার মনে পড়ল আজ পূর্নিমা। সে হোসেন দিকে তাকাল। হোসেনের বাম হাতের তর্জনী আঙুলে লাল রং লেগে আছে। এই লাল রং কিসের? সিঁদুরের নাকি র’ক্তের?

গতদিনের মতো আজকেও বাড়ি খালি হয়ে গেল। হোসেন কলেজে যাবে। খুব জরুরি ক্লাস। সুমনের স্কুল। আকরাম সাহেব সরিফাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন। কয়েকটা টেস্ট দেওয়া ছিল। ওগুলোর রিপোর্ট দেখিয়ে ওষুধ লেখিয়ে আনবেন। তারা চলে যেতেই তিন্নি তার মা’কে কল দিলো। ভাবল– সবকিছু খুলে বলবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কী একটা ভেবে আর কিছু বলল না। সাধারণ কথাবার্তা বলে কল কেটে দিলো। ফোন রেখে দোতলায় চলে গেল। দু’টো রুমের দরজায় বড় সাইজের তালা ঝুলছে। তালার চাবি কোথায় সে কথা তিন্নির জানা নেই। সে তৎক্ষনাৎ নিচে চলে এলো। চাবি খুঁজল। পেলো না। তার নিজেকে বদ্ধ উ’ন্মা’দ মনে হচ্ছে। সে সুমনের ঘরে ঢুকল। কালকের বাজে গন্ধটা আজ নেই। তার বদলে খুব সুন্দর একটা সুঘ্রাণ ভাসছে বাতাসে। তবুও সে সেই বাজে পঁচা গন্ধটা পেল। খুব হালকা তবে আছে। তিন্নি সুমনের ঘরের আলনা সরালো। গোলাপি রঙের ফাঁকা দেয়াল। সে দেয়ালের উপর হাত বুলিয়ে দেখল। নাহ! তেমন কিছু নেই।

ওয়ারড্রব সরানোর শক্তি তার নেই। তবুও খানিকক্ষণ ঠেলাঠেলি করল। আর ঠিক তখনই তার নজরে পড়ল উল্টোদিকে থাকা টেবিলের দিকে। সে আলনা ঠিক করে রেখে টেবিল সরালো। এই দেয়ালে খুব সূক্ষ্ণ একটা ছিদ্র আছে। তিন্নি ছিদ্রের সামনে নাক রাখল। এই জায়গা থেকে সুঘ্রাণটা আসছে, পঁচা গন্ধও আছে। সে এক চোখ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল৷ তবে কিছু দেখতে পেল না। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এই দেয়ালের ওপাশে কিছু একটা আছে। কিন্তু কী আছে? সে দেয়াল সরানোর চেষ্টা করতে লাগল। দেয়াল সরছে না। সাধারণ উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা বাড়িতে এত রহস্য কীভাবে?

দেয়াল সরানো গেল না। তিন্নি হতাশ ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে পড়ল। হাত রাখল দেয়ালের সাথে। ঠিক তক্ষুনি দেয়াল সরে গেল। একটা দরজা। দেয়ালের একটা অংশ স্লাইড করে ওপেন হয়। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না। তিন্নি ভেতরে ঢুকল।

রুমের আকৃতি মাঝারি ধরনের। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ঘর অন্ধকার না। অসংখ্য মোমবাতি জ্বলছে। একটা একপাশে জুড়ে একটা মেয়ের ছবি টানানো। মেয়েটিকে অস্বাভাবিক রকমের স্নিগ্ধ লাগছে৷ গোসল করার পরপট ক্ষণস্থায়ী যে স্নিগ্ধতা চোখমুখ ছড়িয়ে থাকে সেই স্নিগ্ধতা। অন্যপাশের দেয়ালগুলোতে আঁচড় কে’টে মানুষের চেহারা আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। সে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেহারাগুলো চেনার চেষ্টা করল এবং পারল। দু’টো চেহারা চিনতে পারল। একটা তার নিজের অন্যটা সুমনের। মেঝের একপাশে বড় বড় দু’টো তালাবদ্ধ বাক্স। পাশে একটা পাত্রে লাল রঙের তরল। এই তরল থেকে সেই বিশ্রী গন্ধটা ছাড়ছে। পঁচা র’ক্তের গন্ধ। তিন্নির গা গুলিয়ে উঠল। কী হয় এই ঘরে? কা’লো’জা’দু? কে করে? হোসেন এসবের সাথে জড়িত? দেয়ালে আঁচড় কে’টে কে তার চেহারা এঁকেছে?

সে আর ভাবতে পারল না। চোখ মুখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিতে চেষ্টা করল। চোখ খুলে দেখল অবিশ্বাস্য দৃশ্য। ছবির সেই মেয়েটি কাঁদছে। কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। খুব ক্ষীণ তবে স্পষ্ট কানে লাগে। কী হচ্ছে তিন্নির? সে কী পা’গ’ল হয়ে গিয়েছে? তার কী হেলুসিনেশন হচ্ছে? সে এখন কী করবে?

কী করবে ভাবতে সময় নিলো না তিন্নি। তড়িঘড়ি করে ঘরে থেকে বেরিয়ে গেল। যে কোন মুহুর্তে আকরাম সাহেব ফিরে আসবেন। সে তাকে এখানে দেখলে খুব বড় ঝামেলা হয়ে যাবে। এতদিনের সাধনা বাঁচাতে তাকে খু’ন করে ফেলতেও দ্বিধা করবেন না নিশ্চয়ই। সে ঘরের অবস্থা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। সবকিছু গুছিয়ে ফেলার পর মুহুর্তেই কলিংবেল বেজে উঠল। সুমন এসেছে। তিন্নি আজ আর ভণিতা করল না। সরাসরিই কথাটা বলল। বলল বেশ স্পষ্ট গলায়।

“সুমন, এই বাড়িতে আসার পর থেকে তোমার সাথে যা যা হয়েছে। সবকিছু আমায় বলো। একদমই সব বলবে। কিচ্ছু লুকাবে না।”

সুমন বিস্মিত মুখে তাকাল। সরল গলায় বলল, “কী কথা বলব?”

“দেখো সুমন, তুমি ছোট হতে পারো। কিন্তু এমন নয় যে আমার কথা বুঝতে পারছ না। বরং তুমি ভয় পাচ্ছ। ভয় পেয়ো না। ভয় পেলে কোন কিছুর সমাধান হবে না। রাতের পর রাতের বাজে স্বপ্ন দেখা থেকে মুক্তি পেতে চাও তো? তাহলে আমাকে সব খুলে বলো।”

সুমনের চোখমুখের বিস্মিতভাব সরল না। সে ওভাবেই চেয়ে রইল। তিন্নি হাত ধরে তাকে ঘরে নিয়ে গেল। সুমন বলল, “আমি কিছু জানি না। তবে একটা ব্যাপারে বলতে পারি।”

“কী ব্যাপারে?”

“এখানে আসার পর থেকে ওই একটা স্বপ্নই আমি রোজরোজ দেখি। প্রথম দিকে স্বপ্নটা আবছা ধরনের ছিল। সময়ের সাথে গাঢ় হয়েছে। এখন স্বপ্ন নাকি বাস্তব এটাই বুঝতে পারি না।”

“আর কিছু বলবে?”

“গত দুই রাত আমি কোন স্বপ্ন দেখছি না। শান্তিতে ঘুমাতে পারছি।”

“তোমায় পায়ে এমন করে ফোসকা পড়ছে কীভাবে?”

সুমন আর কিছু বলতে পারল না। কলিংবেল বাজচ্ছে। তিন্নি ভেবেছিল তার শ্বশুর শাশুড়ি ফিরেছে। তবে তারা না। হোসেন এসেছে। সে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল। ঢুকতে ঢুকতে বলল, “ভাত বেড়ে দাও। খেয়ে একটা জায়গায় যেতে হবে। খুব জরুরি কাজ। দেরি করার সময় নেই।”

বিপদের চরম মুহূর্তে মানুষের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ভুল বলা হলো। মস্তিষ্কের কাজ বন্ধ হয় না, বরং জরুরি বাঁচার মোডে কাজ করে। শরীরে অ্যাড্রেনালিন হরমোন দ্রুত নিঃসৃত হয়। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, শ্বাস দ্রুত হয়, পেশীতে শক্তি জমা হয়। তবে তিন্নি ভেতর থেকে নিজেকে খুব শান্ত অনুভব করল। বুদ্ধির কাজ ছিল পুলিশকে কল দিয়ে সবকিছু জানিয়ে দেওয়া। কিন্তু সে তেমন কিছুই করল না। সিদ্ধান্ত নিলো নিজেই এই রহস্যের কিনারা খুঁজবে। তাছাড়া তার হাতে এমন কোন প্রমাণ নেই। পুলিশ তাকে বিশ্বাস করবে না।

হোসেন বলল, “কী ভাবছ তুমি?”

তিন্নি চমকে হোসেনের দিকে তাকাল। মেকি হেসে বলল, “কিছু না। সুমন স্কুল থেকে ফিরেছে। ওকে কী খেতে দেব সেটাই ভাবছি।”

“মা আব্বা কোথায়?”

“আব্বু আম্মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছে।”

হোসেনের চেহারা বদলে গেল। যেন সে খুব বেশি বিস্মিত এবং আ’হ’ত হয়েছে। খাওয়া শেষে সে আর কোথাও গেল না। বিছানায় পিঠ এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “শরীরটা ভালো লাগছে না। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।”

তিন্নি বলল, “আপনি না বললেন আপনার জরুরি কাজ আছে।”

“কাজটা এমনও জরুরি কিছু না। ব্যাচের ছেলেমেয়েগুলোর পরীক্ষা নেব। সেই প্রশ্ন তৈরির করার ছিল। পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে তেমন কিছুই হবে না।”

“ওহ আচ্ছা!”

“বহুদিন হয়ে গেল তোমার সাথে ভালো করে কথা বলা হয় না। গল্পগুজব করা হয় না। যেন নিজেদের জন্য কোন সময়ই নেই।”

তিন্নি তার কথার জবাব দিলো না, হাসল। হোসেন বলল, “একটা প্রশ্ন করব?”

“হ্যাঁ, বলুন।”

“তুমি আমায় ভালোবাসো?”

তিন্নি একটু অন্যরকম হয়ে পড়ল। অন্যদিন হলে তার মন খুশিতে নেচে উঠত। আজ উঠল না। এসব প্রশ্নের অর্থ সে জানে। হোসেন তাকে ভুলিয়ে রাখতে চাইছে। সে তাকে সুমনের সাথে একা রাখতে চায় না। এমনকি কোন সময়ই একা রাখতে চায় না৷ সেজন্যই দু’দিন ধরে সে তার কাছে ঘুমোচ্ছে। হোসেনের উদ্দেশ্য অন্য। হুট করে তাকে বিয়ে করে ফেলার পেছনেও নিশ্চয়ই কোন কারণ ছিল। তিন্নিকে এসব কারণ খুঁজে বের করতে হবে।

“কী ভাবছ তুমি?”

“ইম! তেমন কিছু না।”

“কথার জবাব দিলে না যে।”

“কী যে বলেন না আপনি! এসব কথা কী মুখে বলা যায়?”

“কেন যাবে না? আমাদের বিয়ে হয়েছে। অনেক কথাই বলা যায়। এটা তার তুলনায় খুবই নগন্য।”

তিন্নি লজ্জা পাওয়া ভঙ্গিতে বলল, “আপনিও না।”

হোসেনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে বেশ তৃপ্ত গলায় বলল, “এজন্যই তোমাকে বিয়ে করেছি। তুমি অন্যদের চেয়ে আলাদা। অন্যরকমের।”

তাদের কথাবার্তা এগুল না। তিন্নি সুমনকে ভাত বেড়ে দিতে চলে গেল। হোসেন সন্ধ্যা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে রইল। তিন্নিকেও তার পাশে বসিয়ে রাখল।

আকরাম সাহেব ফিরলেন সন্ধ্যার পর। সরিফার চেহারা খুব করুণ দেখাচ্ছে। ক্লান্তি যেন তার শিরা-উপশিরায় বয়ে যাচ্ছে। হোসেন বলল, “তোমাদের ফিরতে এত দেরি হলো কেন?”

আকরাম সাহেব বললেন, “তোর মায়ের টেস্টের রিপোর্ট হারিয়ে ফেলেছিল। সেটা খুঁজতে গিয়ে খানিকক্ষণ, তারপর আবার নতুন করে সে-সব টেস্ট করতে হলো। বসে থেকে থেকে রিপোর্ট করিয়ে ওষুধ লিখিয়ে নিয়ে এলাম। খুব ধকল গিয়েছে।”

“ওহ আচ্ছা!”

হোসেন বেরিয়ে গেল। আকরাম সাহেব বললেন, “বউ মা, আমায় এক কাপ চা বানিয়ে দাও।”

তিন্নি চায়ের পানি চাপালো। সে খুব যত্নসহকারে চা বানালো। আকরাম সাহেব তপ্ত ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। নিচু গলায় বললেন, “কৌতুহল মানুষকে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। তোমার নিজের কৌতুহল নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। এটাই সবার জন্য ভালো।”

তিন্নি তার কথার জবাব দিলো না, হাসার চেষ্টা করল। সে নিজেকে শান্ত দেখানোর চেষ্টা করছে। পারছে না। তার শরীর অল্প অল্প কাঁপছে।

চলবে।