#নারকেল_ফুলের_মালা
#ফারহানা_কবীর_মানাল
৬.
তিন্নি বলল, “তেমন কিছু না। সুমনের জ্বর কমছে না। আম্মা বলছিলেন যদি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া যেত।”
আকরাম সাহেব সরু চোখে তাকালেন। থমথমে গলায় বললেন, “ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন কী? ডাক্তারকেই বাড়িতে ডাকলে হয়। ভবতেশ বাবুকে কল দিলে এক্ষুনি চলে আসবে।”
“তাহলে উনাকে আসতে বলুন। সুমনের জ্বর একশ চার এর আশেপাশে। ক্রমাগত জলপট্টি দিয়েও জ্বর পড়ছে না।”
তিনি পকেটে হাতড়ে ফোন বের করলেন। মুখের থমথমে ভাব কমালেন না। বরং আর একটু বাড়িয়ে নিলেন।
ভবতেশ বাবু দেখতে ভালো। ছিপছিপে লম্বা গড়ন। চিবুকের কাছে কয়েক গোছা দাঁড়ি ঝুলছে। আগে তার মুখে কোন দাঁড়ি ছিল না। কোথাথেকে শুনছে দাঁড়ি রাখলে যৌবন শক্তি বজায় থাকে। তারপর থেকে দাঁড়ি রাখা শুরু করেছেন। ঘরে ঢুকেই তিনি ছটফট করতে লাগলেন। এক দৌড়ে গিয়ে সুমনের পাশে বসে কপালে হাত রাখলেন। আৎকে ওঠা গলায় বললেন, “হায়! হায়! বহুবছর এমন জ্বর চোখে পড়েনি। এই ছেলের অবস্থা ভালো না।”
তিনি ওষুধ লিখলেন না। র’ক্ত পরীক্ষা দিলেন। পান চিবুতে চিবুতে বললেন, “সকালের মধ্যে জ্বর না কমলে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। অসুখ হেলাফেলার করার মতো কোন জিনিস না।”
আকরাম সাহেব বললেন, “আপনি ওষুধ লিখে দেন। যেন ওগুলো খেলেই ঠিক হয়ে যায়।”
“ওষুধ তো ভাই মুখের কথা না। এমন জ্বরে যেনতেন ওষুধ দেওয়া যাবে না। নরমাল প্যারাসিটামল খাওয়ান। তবে আমার মনে হয় না তাতে কোন কাজ হবে।”
“তাহলে কাজ হবে কিসে?”
“সাপোসিটার দিতে পারেন। লিখে দিচ্ছি। ওষুধের দোকান থেকে কিনে নিয়ে আসুন।”
আকরাম সাহেব মাথা দোলালেন। ভবতেশ বাবু সাদা কাগজে ওষুধের নাম লিখে দিয়ে গেলেন। চোখ-মুখ বিরক্তি নিয়ে বললেন, “রিপোর্ট না দেখে ওষুধ লেখা যায় না।”
তারপর দু’দিন কে’টে গেল। সুমনের জ্বর ছাড়ল না। আকরাম সাহেব শুধু সাপোসিটার আর প্যারাসিটামল কিনে ক্ষ্যান্ত হননি৷ ওষুধের দোকানদারকে বলে নানান রকমের ওষুধ কিনে এসেছেন। সেসব ওষুধ খুব নিয়ম করে সুমনকে গেলানো হচ্ছে। তবে এতসব ওষুধপত্র খেয়ে একটুও কিছু হয়নি। বরং জ্বরটা আরও জাঁকিয়ে বসেছে। গায়ের তাপমাত্রা কখনো কমে না। র’ক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে। রিপোর্ট খুব স্বাভাবিক। কোথাও রোগের চিহ্নমাত্র নেই। সরিফা ভীষণ উদ্বীগ্ন হয়ে আছেন। সারাক্ষণ সুমনের মাথার কাছে বসে থাকেন। থেমে থেমে গা মুছিয়ে দেন। তিন্নি ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। সে আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। সুমনের অসুস্থতার কথা কেউ তার মা বাবা জানাচ্ছে না। কী আশ্চর্য! ছেলের অসুস্থতার খবর মা বাবার জানার অধিকার নেই নাকি? দু’বেলার ভাত কী এই অধিকার কেঁ’ড়ে নিতে পারে? আজ দুপুরে খাওয়ার সময় সে এই ব্যাপারটা তুলেছিল। আকরাম সাহেব বললেন, “এই সময়ে সবার এমন জ্বর হয়। দু’দিন পর সেরেও যায়। এটা নিয়ে এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই।”
সে আর কোন প্রশ্ন করেনি। চুপচাপ সরে এসেছে। তার মনে অদ্ভুত একটা ব্যাপার খচখচ করছে। এই জ্বর স্বাভাবিক তো? ডাক্তার ওষুধে কমবে তো?
বেলা পড়ে এসেছে। রোদ নেই। ছাঁদে কাপড় শুঁকতে দেওয়া। তিন্নি চুলা বন্ধ করে দিলো। রাতের রান্নার এই শেষ পদ। টক দিয়ে মসুরের ডাল। ইদানিং হোসেন ডাল ছাড়া ভাত খেতে পারছে না।
সরিফা বললেন, “সন্ধ্যা নেমে যাবে। কাপড় নিয়ে এসো।”
তিন্নি অল্প হাসল। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে ছাঁদে চলে গেল। কাপড় শুঁকিয়ে গিয়েছে। সে একটা একটা করে কাপড় তুলে হাতের উপর সাজাতে লাগল। হঠাৎই তার নজরে পড়ল ছাঁদের কোণে রাখা টবের দিকে। ধুতুরা গাছ। গাছটা নেতিয়ে গেছে। শুধু এই একটা গাছই এমন করে নেতিয়ে পড়েছে, বাকিগুলো স্বাভাবিক এবং সতেজ।
নিচ থেকে সরিফার গলা শোনা গেল। তিন্নি গাছের থেকে মন সরিয়ে কাপড় তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সন্ধ্যা নামার আগ মুহুর্তে আকরাম সাহেব বাইরে গেলেন। সুমনের জ্বরের ওষুধ শেষ। তিনি বেরিয়ে যেতেই তিন্নি সরিফার কাছে ছুটল। গাছের কথা তুলে বলল, “আম্মা, আমার মনে হয় সুমনের জ্বর স্বাভাবিক কোন জ্বর না।”
সরিফা ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “এ কথা কেন বলছ?”
“জানি না মা। বিকেলে যখন কাপড় তুলতে ছাঁদে গিয়েছিলাম দেখলাম টবের ধুতুরা গাছটা নেতিয়ে পড়েছে। পরে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেছি– এই গাছ কা’লো’জা’দুতে ব্যবহার করা হয়।”
“তুমি কী বলতে চাইছ? সুমনকে কেউ কা’লো’জা’দু করেছে? ওর এই জ্বরের কারণ?”
তার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। তিন্নি বলল, “আম্মা, আমার মনে হয় আপনি সব জানেন। সবকিছু না জানলেও অনুমান করতে পারেন। দয়া করে আর চুপ করে থাকবেন না আম্মা। সুমন একটা বাচ্চা ছেলে। আপনার ভাইয়ের ছেলে। আপনি কী ওকে এইভাবে শেষ হতে দেখতে পারবেন? পারবেন বলুন?”
সরিফা চোখমুখ কালো করে ফেলল। করুণ গলায় বলল, “না মা। আমি ওকে এইভাবে শেষ হতে দেখতে পারব না। কিন্তু কী করব বলো? আমার হাত পা যে বাঁধা।”
“বুঝতে পারলাম না।”
“শতাধিক ব’দ’জ্বি’ন আমায় পাহারা দিয়ে চলে। মুখ খুললেই ওরা আমাকে মে’রে ফেলবে।”
তিন্নি বিস্মিত চোখে তাকাল। তার চোখ-মুখে অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। তবুও সে কথাগুলো বিশ্বাস করার চেষ্টা করল। সরু গলায় বলল, “গাছটা তুলে ফেলব?”
“শুধু গাছ তুললে হবে না। এর সাথে আরও কিছু কাজ করতে হবে। জাদু কা’টা’নোর এই একটা পদ্ধতি আমার জানা আছে।”
“বলুন আমাকে। কী করতে হবে?”
“এতে তোমার জীবনের ঝুঁ’কি থাকতে পারে। শেষ মুহুর্তে মা’রা পড়তে পারো। সুমনের জন্য কী তুমি এত বড় ঝুঁকি নিতে পারবে?”
তিন্নি হাসল। অত্যন্ত স্পষ্ট গলায় বলল, “আমার হায়াত, আমার রিজিক সবটাই আল্লাহর হাতে নির্ধারিত। তিনি না চাইলে গোটা পৃথিবী মিলেও আমার কোন ক্ষ’তি করতে পারবে না। আপনি বলুন।”
সরিফা বিস্মিত হলেন। প্রকাশ করলেন না। তিন্নিকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। যে কোন মুহুর্তে আকরাম সাহেব চলে আসবেন। তিনি নিজের জীবনের কোন ঝুঁকি নিতে চান না।
তিন্নি তার কথা শুনল। পাক-পরিত্র হয়ে গোসল করল। সাদা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে সোনার গহনা খুলে ফেলল। রাত নেমে গিয়েছে। আকাশে চাঁদ তারা নেই। চারপাশে বিদঘুটে অন্ধকার। সে অন্ধকার মাড়িয়ে ছাঁদে চলে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ধুতুরা গাছটা তুলে ফেলল। শেকড়সহ তুলল। গুণে গুণে এক চল্লিশ পা ফেলে সুমনের পাশে এসে বসল। গাছের পাতাগুলো সুমনের গায়ে ছুইছে গোপন ঘরে ঢুকল। ঘরের ভেতরে আবছা ধরনের আলো। মোমের সংখ্যা কম। সে কাঙ্খিত বস্তু খুঁজতে শুরু করল। আলোর পরিমাণ খুব সামান্য। ভালো করে কিছু দেখা যায় না।
হঠাৎই আলো বাড়তে লাগল। তিন্নি সর্তক চোখে চারপাশে তাকাল। সরিফা মোমবাতি জ্বালছেন। তিন্নি বলল, “আম্মা আপনি?”
“তোমায় সাহায্য করতে এলাম।”
“আপনি না বললেন সবকিছু আমার একার করতে হবে?”
“বলেছিলাম বুঝি? কই আমার তো মনে পড়ছে না।”
তিন্নি হতভম্ব মুখে চেয়ে রইল। সরিফা বললেন, “বুঝলে মা, তোমার নিজের উপর অনেক বিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস ভালো, তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস মরিচীকার মতো মিথ্যে। তুমি ফেঁ’সে গিয়েছ।”
“এ কথার মানে কী আম্মা?”
“তুমি কী তোমার পরনের কাপড় খেয়াল করেছ?”
তিন্নি নিজের পোশাকের দিকে তাকাল। সরিফা বললেন, “তোমার পরনে সাদা রঙের সাধারণ কোন শাড়ি নয়। এটা কা’ফ’ন। কা’ফ’নের সাদা কাপড় পরে আছো তুমি?”
“কী করতে চাইছেন?”
“তোমাকে ব’লি দিতে চাইছি।”
“কেন করছেন এমন? আমি আপনার কী ক্ষ’তি করেছি?”
“তুমি কিছুই করোনি। নিষ্পাপ ধার্মিক একটা মেয়ে। এজন্যই তো তোমায় এখানে নিয়ে এসেছি।”
তিন্নি পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছে। এসব তার কাছে সত্যি মনে হচ্ছে না। স্বপ্নের মতো লাগছে। খুব বাজে কোন দুঃস্বপ্ন। এক্ষুনি ঘুম ভেঙে যাবে। সে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসবে। তার শরীর ঘামে ভেজা। হৃৎস্পন্দন শোনা যাচ্ছে। তবে তেমন কিছু হলো না।
সরিফা বললেন, “কী চিন্তা করছ? আজ তুমি এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে না। জীবনের শেষ সময়ে অহেতুক চিন্তা না করে নিজের পা’পের জন্য ক্ষমা চাও।”
তিন্নি শান্ত চোখে তাকাল। অস্ফুটস্বরে বলল, “জীবনের শেষ ইচ্ছে হিসেবে আমি সব জানতে চাই।”
সরিফা ঘড়ির দিকে তাকালেন। এক মুঠো নারকেল তিন্নি গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, “ঢের সময় বাকি আছে৷ শুনেছি শেষ ইচ্ছে নিয়ে ম’র’লে মানুষের আ’ত্মা অতৃপ্ত হয়ে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। ঘাড় ম’ট’কা’য়। আমি তোমায় সে সুযোগ দিতে চাই না।”
“সত্যিটা বলুন। যা কিছু জানেন, যা কিছু জেনেও না জানার ভান করছেন। সবকিছুই বলুন।”
সরিফা হেঁসে ফেললেন। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, “ওইখানটায় গিয়ে বসো।”
মেঝেতে সিঁদুর রাঙা লাল রঙের বৃত্ত আঁকা। র’ক্ত পঁচা গন্ধ লাগে না। তিন্নি সে-সবে গ্রাহ্য করল না। সেখানে গিয়ে বসল।
সরিফা বললেন, “জানতেই যখন চাইছ। প্রথম থেকে বলি– বারো বছর বয়সের সময় আমার বিয়ে হয়। গ্রামের সাদাসিধে সরল এক মেয়েকে বাবা হুট করেই অচেনা এক লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে চলে এলাম। তোমার শ্বশুরের সাথে আমার সম্পর্ক বেশ স্বাভাবিক। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে দু’জনে দু’দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে পড়ি। কথাবার্তা হয় ওই আলগোছে। আমাদের থাকার ঘরের পেছনে ঝুপড়ি মতো ছোট একটা ঘর ছিল। তোমার শ্বশুর সারাদিন সেখানেই বসে থাকত। পুরনো বইপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করত। আমাকে এটা ওটা ধুয়ে দিতে বলত। ফুল কুড়িয়ে দিতে বলত। আমি তার কথা শুনতাম। সে মুখ উঁচিয়ে হাসত। বেশ ভালোই চলছিল। তারপর হঠাৎই একদিন…”
“কী হলো?”
“আমার মা আমাকে সেই প্রশ্নটা করে বসল। তার নাতিনাতনি কবে হবে। বিস্মিত গলায় বললাম– নাতিনাতনি কীভাবে হয়?
মা আমায় সবকিছু বুঝিয়ে বললেন। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে আবিষ্কার করলাম স্বামীর সাথে আমার সম্পর্ক আর পাঁচটা মেয়ে মতো না। সে কখনো আমায় স্পর্শ করে না। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানলাম– সে তন্ত্রের সাধনা করে। নির্দিষ্ট একটা বয়স পর্যন্ত তাকে নারীস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। আমাকে বিয়ে করেছেন কারণ সাধনার কাজে তার একজন কুমারী মেয়ের প্রয়োজন ছিল। সে শুধু সত্যি বলল না, রীতিমতো শা’সি’য়ে দিলো যেন এ কথা কাউকে না বলি। বললে সে আমাকে জানে মে’রে ফেলবে।”
তিন্নি চোখ-মুখে বিস্ময়। সরিফা থামলেন না৷ একটু হেসে নিয়ে বললেন, “তারপর থেকে আমি তার সাহায্যকারী হিসাবে রয়ে গেলাম।”
“সবকিছুর পেছনে আব্বার হাত আছে? উনি আপনাকে এসব করতে বলেছেন?”
“নাহ! এখন আর সে এসব পছন্দ করে না।”
“আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।”
“ধৈর্য না ধরলে কীভাবে বুঝবে?”
তিন্নি তার কথার জবাব দিলো না। শান্ত ভঙ্গিতে বসে রইল। সরিফা বললেন, “বহুবছর তন্ত্র সাধনার পর হঠাৎই তোমার শ্বশুর একটা ভুল করে ফেলল। বর্ষার রাত। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চাল ফুটো হয়ে যাবে এমন বৃষ্টি। মাঝরাতে হঠাৎ সে আমার গায়ে হাত রাখল। হোসেনের জন্মের পর থেকে তোমার শ্বশুর বদলে যেতে শুরু করে৷ তা’বি’জ-ক’ব’চের উপর থেকে তার মন উঠে যায়। হোসেনের বয়স যেদিন পাঁচ, সেদিন সে ওই ঝুপড়ি ঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়। চিরতরের জন্য সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে আসে। তোমার শ্বশুর সবকিছু ছাড়তে পারলেও আমি পারিনি। ওই বইপত্র, মানুষের মাথার খুলি, ওই সবকিছু যেন আমাকে চুম্বকের মতো টানতো। কিছুতেই সেই টান অগ্রাহ্য করতে পারতাম না। শেষ পর্যন্ত নিজেই সাধনা শুরু করলাম। তোমার শ্বশুর আমাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে। পারেনি।”
“কেন পারেনি?”
“মৃ’ত্যু’ভ’য় মানুষের মুখ বন্ধ করে দেয়। বহুবছর আগে সে আমাকে যে ভয় দেখিয়েছিল আমিও তাকে সেই ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দিলাম।”
তিন্নি ভয় পাচ্ছে না। তার শরীর অল্প অল্প কাঁপছে। ভেতর থেকে অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছে। সে বলল, “সুমনের ব্যাপারটা কী?”
“সাধনার যত উন্নতি করতে লাগলাম শ্রেষ্ঠত্বের লোভ আমার র’ক্তে মিশে গেল। হোসেনকে আমি আমার মতো করে বড় করেছি। ছোট থেকেই ওকে এসব শিক্ষা দিয়েছি যেন কখনো আমার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে না পারে।”
“মা হলে নিজের ছেলেকে এমন শিক্ষা দিলেন কীভাবে?”
“খারাপ শিখিয়েছি বলছ? কিন্তু এতে খারাপের কী আছে? এই পৃথিবীর সবাই ক্ষমতা চায়। আমি আমার ছেলে অন্যরকমের শক্তিশালী করে বড় করেছি। সে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো না। মাঝরাতে ছায়া দেখে আৎকে ওঠে না। অদৃশ্যকে আয়ত্তে করতে জানে। এতে খারাপের কী আছে?”
“সুমনের ব্যাপারটা কী?”
“সর্বোচ্চ শক্তি পেতে আমার দু’জন মানুষকে ব’লি দিতে হবে। মিন রাশিধারী নাবালক বাচ্চা এবং তুলো রাশিধারী নিঃসন্তান নারী।”
“সুমনের মিন রাশি?”
“ঠিক ধরেছ। সুমনের মিন রাশি। ব্যাপারটা আমি কিছুদিন আগেই জেনেছি। হোসেনকে বলে ওকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছি যেন আমি আমার মনোবাসনা পূর্ণ করতে পারি।”
“এই জ্বর?”
সরিফা হাসলেন। রহস্যময় কুটিল হাসি। রসালো গলায় বললেন, “তুমি বেশ বুদ্ধিমান। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। সুমনের জ্বর কোন সাধারণ জ্বর না। এটা ওর ম’র’ণ জ্বর। ধীরে ধীরে এই জ্বর ওর অন্ত্রে পৌঁছে যাবে৷ ওর সমস্ত জীবনীশক্তি শুষে ফেলবে। সুমন যতই মৃ’ত্যু কাছাকাছি যাবে, আমার শক্তি ততই বাড়বে। ও যত কষ্ট পাবে, ততই আমার লাভ।”
“আর আমি?”
“তোমায় এত কষ্ট পেতে হবে না। হুট করে মে’রে ফেলব। তুলা রাশির বিবাহিত নিঃসন্তান নারীকে হুট করেই মে’রে ফেলতে হবে। বইয়ে এমনই লেখা আছে। এজন্যই তো এত কাঠখড় পো’ড়া’নো।”
“বুঝতে পারিনি।”
“বুদ্ধিমান লোকেরা হঠাৎ করে বোকা কথা বললে ভালো লাগে না। বিরক্তিকর শোনায়। তবে তোমার ব্যাপার ভিন্ন। মস্তিষ্কের ভেতরে মৃ’ত্যু’ভ’য় কাজ করলে সবকিছু কেমন গুলিয়ে যায়। যাইহোক, হোসেনকে আমিই বলেছিলাম তুলো রাশি মেয়ে খুঁজতে। তারপর হঠাৎই একদিন সে তোমার কথা বলল। বলল– ওই বিশেষ তা’বি’জের প্রভাবে তোমার হাত চলে। হাতের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। সে নিজের চোখে দেখেছে। আমি আর দেরি করিনি। তড়িঘড়ি করে হোসেনকে বলে তোমাকে এই বাড়ির বউ করে নিয়ে এলাম। বাকিটা তো তুমি জানোই।”
“হোসেন এসব জানে?”
“জানে। সবই জানে।”
“সে কোথায়?”
“এখানে নেই। আজ রাতে আর আসবেও না। তোমার শ্বশুর আকরাম সাহেবও আসবে না।”
“কেন আসবে না?”
“উফফ! বড্ড প্রশ্ন করো তুমি। বোধহয় ম’রার আগে রিজিকে লেখা সব কথা শেষ করে যেতে চাইছ। তাহলে শোনো হোসেনকে আমি এক বিশেষ ধরনের গাছ খুঁজতে পাঠিয়েছি। এতক্ষণে সে পাহাড়ের উদ্দেশ্য বহুপথ চলে গেছে। আর তোমার শ্বশুর, তার সাথে কী করেছি জানো? বিকেলে চায়ের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছি। দেখো গিয়ে! কোন দোকানের বেঞ্চিতে বসে ভোস-ভোস করে ঘুমচ্ছে।”
সরিফা হেসে উঠলেন।
আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। থেমে থেমে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাতাস বইছে। বৃষ্টি নামবে। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাস চলছে। বেশ জোরেই চলছে। খোলা জানালা গলে চোখ-মুখে বাতাসের ঝাপটা এসে পড়ছে। হোসেন বাইরে দিকে তাকিয়ে খানিকটা অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ল। হঠাৎই তার কিছু ভালো লাগছে না। অদ্ভুত রকমের অস্বস্তি হচ্ছে। তিন্নির কথা মনে পড়ছে। মেয়েটা কী ঠিক আছে? এতক্ষণে একবারও তাকে কল করল না। তিন্নি তো এমন করে না। হোসেন খুব বিরক্ত হলো। সে এসব কী ভাবছে? তবে কী সে তিন্নির উপরে দূর্বল হয়ে পড়েছে? কিন্তু কীভাবে? সে জানে তিন্নি মাত্র কয়েকদিনের অতিথি। তার খেলার সামান্য একটা গুটি মাত্র। ওকে ব’লি দিতে পারলে সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী জাদুকরদের একজন হয়ে যাবে। এই আধুনিক যুগের মানুষেরা যেখানে এসব বিশ্বাস করে না, কুসংস্কার মনে করে সেখানে সে এসবকে বুকে লালন করেছে। প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করেছে। দেশের এ প্রান্তে ও প্রান্তে ছুটে ছুটে শক্তিশালী হয়েছে৷ হোসেনের চোখ জ্ব’লে উঠল। মনের মধ্যে পুষে রাখা লালসা তার বুকে ছো’ব’ল দিচ্ছে। লালসার সাপ এতদিন অনেক বড় হয়েছে। হোসেন খুব স্বপ্ন– সে একদিন এই আধুনিক বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবে। দেশ বিদেশে থেকে নানান লোক তার ক্ষমতা দেখতে আসবে। তাকে সমীহ করে চলবে।
হোসেনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। হিসহিসিয়ে বলল, “আমার এত চিন্তা করার কিছু নেই। মা আছে। মা-ই তিন্নিকে দেখে রাখবে। আর তো মাত্র ক’টা দিন। তারপরই ওকে….”
হোসেনের হাসি চওড়া হয়ে উঠল। ঠিক সেই মুহূর্তেই কাছে কোথাও বাজ পড়ার শব্দ হলো। সে আবারও হাসল।
চলবে