নারকেল ফুলের মালা পর্ব-০৮

0
7

#নারকেল_ফুলের_মালা
#ফারহানা_কবীর_মানাল

৮.
এমনই এক বর্ষার রাতে সরিফাকে ঝুপড়ি ঘরে আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। সরিফার গায়ে টকটকে লাল রঙের শাড়ি জড়ানো, কোমরের কাছে শুকনো লতা বাঁধা। তিনি সরিফার এই কাজে যতটুকু বিরক্ত হওয়া সম্ভব ততটুকু বিরক্ত হলেন। শরীরের হিম ধরানো ঠান্ডা গলায় বললেন, “এসব কী?”

সরিফা তার কথার জবাব দিলেন না। মাথা নিচু করে রইলেন। আকরাম সাহেব বললেন, “এরপর যদি কখনো এসব করতে দেখি তাহলে তার ফল ভালো হবে না। তুমি আমাকে জানো। আশা করি বুঝবে, প্রাণের মায়া রাখবে।”

আকরাম সাহেবের কঠিন শাসনে সরিফার কিছু হলো না। তিনি নিজের মতো করে কাজ চালিয়ে গেলেন। এ-সবে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে আকরাম সাহেবের আর কিছু করা ছিল না। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। সরিফার মুখ থেকে হাত সরিয়ে কোমল গলায় বললেন, “দীর্ঘদিন দু’জনে একই ছাঁদের নিচে বাস করেছি। সুখ-দুঃখের আড়ালে আবডালে ভালোবাসা জমেছে কি-না জানি না। তবে মায়া আছে। সেই মায়ার জোরেই একবার তোমায় বাঁচিয়েছিলাম। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তোমাকে বাঁচিয়ে ছিলাম। কিন্তু এবার আমি আর সে ভুল করব না। কেন করব না জানো? তুমি আমার কথা রাখনি। তুমি আমার কথা রাখনি।”

আকরাম সাহেব একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল স্পষ্ট। তার চোখ জ্বলছে। চোখে পানি আসার আগে এমন করে চোখ জ্বা’লা করে। নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। যেন বুকের কোথাও পু’ড়’ছে। তবে তিনি কোন কিছুই গায়ে মাখলেন না। সরিফাকে টেনেহিঁচড়ে গোপন ঘরে নিয়ে গেলেন। মেঝেতে পড়ে থাকা র’ক্ত মুছলেন। খুব যত্ন নিয়ে গুছিয়ে সবকিছু পরিষ্কার করলেন। ফ্যান ছেড়ে ভেজা ভাব শুকতে দিয়ে আবারও গোপন ঘরে ঢুকলেন। সরিফা তখনও শ্বাস নিচ্ছেন। তার বাঁচার সম্ভাবনা হারিয়ে যায়নি। খুব ক্ষীণ হলেও রয়ে গেছে। চোখ পিটপিট করছে। আকরাম সাহেব সরিফার দিকে ঝুঁকলেন। তরল গলায় বললেন, “সেই রাতের কথা মনে পড়ে? যে রাতে তুমি শ’য়’তা’নি শক্তি পাওয়ার আশার ঝড়ের মধ্যে তালগাছের নিচে দাঁড়িয়েছিলে। সেদিন খুব বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। ঘনঘন বাজ পড়ছিল। আশেপাশের কয়েকটা তালগাছের মাথায় তো আ’গু’নই ধরে গিয়েছিল। আমি বারবার করে তোমাকে নিষেধ করেছিলাম। তুমি আমার নিষেধ শোনোনি। সেই রাতে আর একটু হলে তোমার গায়েও বাজ পড়ত। আমি গিয়ে তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলাম। সেদিনের বজ্রপাতে আমি মা’রা যায়নি৷ তবে ওইটুকুর জোরে বলেছিলাম– সবকিছু ছেড়ে দিতে। ছেলে নিয়ে তিনজনের সুখের একটা সংসার সাজাতে। তুমি কথা রাখোনি।”

সরিফা শুনলেন কি-না বোঝা গেল না। আগের মতোই চোখ পিটপিট করতে লাগলেন। আকরাম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তার গলা ধরে গিয়েছে। বাইরে এখনো বৃষ্টি পড়ছে। খুব জোরেই পড়ছে। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। তিনি উঠে গিয়ে ছোট্ট দু’টো কাঠের বাক্স বের করলেন। বাক্স খুললেন স্বযত্নে। বাক্সের ভেতরে শুকনো মালা। নারকেল ফুলের মালা। তিনি বিস্মিত চোখে মালা দু’টোর দিকে চেয়ে রইলেন। চিকন গলায় বললেন, “তোমাদের মা ছেলের স্বপ্ন পূরণ হবে না। আমি কখনো এমন করতে দেব না।”

তিনি মালা দু’টো ছিঁ’ড়ে ফেললেন। শুকনো ফুলগুলো হাতের চাপে সহজেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। মালা দু’টো নষ্ট করেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না। আ’গু’ন জ্বালিয়ে পু’ড়ি’য়ে দিলেন। মিনমিনে করে বললেন, “তোদের ক্ষমতা শেষ করে দিলাম।”

সরিফা মেঝেতে পড়ে আছেন। তার সারা শরীরের অসহ্য ব্যাথা। গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পিপাসা এমন যেন এক নদী পানি খেয়ে ফেলতে পারবেন। তিনি একটু নড়তে চেষ্টা করলেন। পারলেন না। শরীরে অসম্ভব ব্যাথা নিয়ে পড়ে রইলেন।

হোসেন বাড়ি ফিরল দু’দিন পর। পাহাড়ি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সে কিছু পায়নি। কাঙ্ক্ষিত বস্তু হাতে পায়নি বিধায় মন মেজাজ খারাপ। চোখ-মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। সে রুক্ষ ভঙ্গিতে ঘরের ভেতর ঢুকল। শক্ত গলায় বলল, “তিন্নি, এক গ্লাস পানি দাও।”

ভেতর থেকে তিন্নির আওয়াজ পাওয়া গেল না। আকরাম সাহেব পানির গ্লাস হাতে বেরিয়ে এলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, “সুস্থ আছিস?”

“আছি। শরীর ভালো। মন ভালো না। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শুধুশুধু অতো দূর থেকে ঘুরে এলাম।”

“সবসময় কাজ হতেই হবে এমন কোথাও লেখা নেই। ঘোরাঘুরির দরকার আছে।”

“তা আছে। কিন্তু সবাই তো সবকিছু পছন্দ করে না। যাইহোক, মা কোথায় সুমন কোথায়?”

আকরাম সাহেব প্রশ্নের জবাব দিলেন না। কথা ঘুরিয়ে বললেন, “আমার হাঁটুতে প্রচন্ড রকমের ব্যাথা। হাঁটুর জন্য ভালো কোন ডাক্তারের সন্ধান দিতে পারিস?”

“আপাতত জানি না। খোঁজ নিয়ে বলতে হবে।”

হোসেন নিজের ঘরে ঢুকল। পরিপাটি করে সাজানো ঘর। টেবিলের উপর জগ ভর্তি পানি। চেয়ারের সাথে গামছা ঝুলিয়ে রাখা। হোসেন একটু অবাক হলো। তিন্নি গামছা ঝুলিয়ে রাখে না। এত দিনের সংসারে একবারের জন্যও সে এমন করেনি। তবে আজ কী হলো? হোসেন ব্যাপারটা সহজ ভেবে উড়িয়ে দিতে চাইল। পারল না। তার মনের ভেতরে খচখচ করতে লাগল।

আকরাম সাহেব ঘরে ঢুকলেন। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, “আমার একটু কাজ আছে। বাইরে যাব। ফিরতে দেরি হবে। টেবিলে খাবার-দাবার রাখা আছে। খিদে পেলে খেয়ে নিস।”

“মা কোথায়? কাউকে দেখছি না কেন?”

তিনি কথার জবাব দিলেন না। বেরিয়ে পড়লেন। হোসেন তোয়ালে হাতে বাথরুমে ঢুকল। ঘেমেটেমে এককার অবস্থা তার। বাসে এক মেয়ের পাশে বসেছিল। মেয়েটা খানিকক্ষণ বাদে বাদে তার দিকে তাকিয়েছে। শেষ মুহূর্তে বাস থেকে নামার আগে মোবাইল নম্বর চেয়ে রেখেছে। কী আশ্চর্য! মেয়েটাকে নম্বর দিতে গিয়ে তার তিন্নির কথা মনে পড়ছিল। মন বলছিল– তিন্নি জানলে কষ্ট পাবে।

হোসেন মাথা দুলিয়ে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে চাইল। মগ ভরে পানি উঠিয়ে গায়ে ঢাকলে শুরু করল। পানি ঠান্ডা। গরমে এমন পানি দিয়ে গোসল করতে আরাম লাগে। সে সময় নিয়ে গোসল শেষ করল।

টেবিলে খাবার সাজানো। আয়োজন ভালো। কাতলা মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, খাসির রেজালা, সরু চালের ভাত, সালাদ। খাবার মুখে দিতেই তার মনে কা’ম’ড় দিয়ে উঠল। এসব খাবার বাড়িতে রান্না হয়নি। সামনে হোটেলের। তালেব ভাই ছাড়া এমন রান্না কেউ করতে পারে না। হোসেন ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করল। খাওয়া শেষে প্লেটে হাত ধুয়ে ফেলল।

গোপন ঘরের দরজা লাগানো। তীক্ষ্ণ নাকে শুঁকলে একধরনের লোহার মতো ধাতব গন্ধ পাওয়া যায়।
হোসেন কপাল কুঁচকে দরজা খুলল। সরিফা তখনও মেঝেতে পড়ে আছে। সে নিজের হাত কা’ম’ড় ধরল। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য অবস্থা মায়ের পাশে বসে পড়ল৷ নাকের কাছে হাত নিয়ে নিঃশ্বাস চলছে কি-না পরীক্ষা করল। তার কুঁচকে থাকা কপাল ক্রমশ মসৃণ হতে শুরু করেছে। তবে চেহারার ভাব পরিবর্তন হলো না।

আকরাম সাহেব ফিরলেন রাত দশটার পরে। হোসেন সোফায় বসে আছে। বুকের কাছে হাত গুঁজে মাথা নিচু করে রেখেছে। সে আকরাম সাহেবকে দেখে মাথা তুলল না। বরফ শীতল কণ্ঠে বলল, “মায়ের এই অবস্থা কে করেছে?”

আকরাম সাহেব বিচলিত হলেন না। শান্ত গলায় বললেন, “জানি না। যতক্ষণে দেখেছি ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাঁচানোর অবস্থায় ছিল না।”

“মিথ্যে বলবেন না আব্বা। মিথ্যে বললে আপনি ধরা পড়ে যান, আপনার চোখ জ্বলজ্বল করে।”

“মিথ্যে বলার প্রয়োজন মনে করছি না।”

“আচ্ছা বেশ। তিন্নি কোথায়? সুমন কোথায়?”

“জানি না। বাড়িতে ফিরে ওদের কাউকে দেখতে পাইনি।”

“খোঁজার চেষ্টা করেননি?”

“করেছি। পাইনি। পুলিশের সহায়তা নেওয়ার মত পরিস্থিতি ছিল না। যতটুকু পারি চেষ্টা করেছি।”

“আমাকে জানাননি কেন?”

“প্রয়োজন মনে করিনি। তুই একটা কাজে গিয়েছিস। সেখানে তোকে কল করে এসব জানালে বিচলিত হয়ে পড়তে পারিস– এই ভেবে তোকে আর কিছু বলিনি।”

“ভালো করেছেন। খুব ভালো করেছেন।”

আকরাম সাহেব চুপ করে রইলেন। হোসেন মাথা উঁচু করে তার দিকে দেখল। অত্যন্ত স্পষ্ট গলায়, “মায়ের মৃত্যুতে আপনার কষ্ট হচ্ছে না?”

“কষ্ট হচ্ছে। প্রচন্ড রকমের কষ্ট হচ্ছে।”

“কিন্তু আপনাকে দেখে তা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আপনি বেশ সুখে আছেন। তালেব ভাইয়ের হোটেল থেকে খাসির রেজালা কিনে খাচ্ছেন। শোক পেলে মানুষ এমন করতে পারে না।”

“মনে লাগলেও গায়ে লাগেনি। তাছাড়া একদিন সবার ম’র’তে হবে।”

“তাহলে আমি আপনাকে মে’রে ফেলি?”

হোসেনের গলার স্বর অন্যরকম শোনালো। তবে সে কিছু করল না। পকেট হাতড়ে মোবাইল বের করল। তিন্নির নম্বরে ডায়াল করল। ফোন বন্ধ। হোসেনের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো৷ হিসহিসিয়ে বলল, “পালিয়ে বাঁচতে পারবে না তিন্নি৷ তোমাকে আমার কাছে আসতেই হবে। স্বামীকে ছাড়া কোন বউ থাকতে পারে না। তুমিও পারবে না।”

সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। গেল সোজা সুমনদের বাড়িতে। সদর দরজা থেকে সুমনের নাম ধরে চিৎকার করতে করতে ঘরের ভেতরে ঢুকল। সুমনের মা বললেন, “হোসেন তুই! হঠাৎ কী মনে করে?”

“সুমন কোথায় মামানি?”

“কোথায় আবার? তোদের বাড়িতেই। এখানে আসেনি।”

“সুমন আমাদের বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে জানি না।”

“কী বলিস! আমিও তো কিছু জানি না।”

“ওহ আচ্ছা!”

হোসেন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বিস্মিত গলায় বলল, “আসলেই জানেন না? নাকি ভান করছেন?”

ভদ্রমহিলা মুখ কালো করে ফেললেন।

“এসব কী কথা বলছ? ভান করব কেন?”

তার কন্ঠে বিরক্তি ছাপ স্পষ্ট। হোসেন বলল, “আপনার ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না– অথচ আপনি একটুও বিচলিত নন। এই ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”

“আমিও তোমার কথাবার্তা বুঝতে পারছি না। আপা কোথায়? তোমার বউ কোথায়?”

“তাদেরকেও পাওয়া যাচ্ছে না। কত জায়গায়ই তো খুঁজলাম। পেলাম না।”

“চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে৷ সুমন হয়তো আপার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুমি দেখনি “

“হতে পারে।”

“দাঁড়িয়ে কথা বলছ কেন? বসো। পানি এনে দেব? চা করে দেব?”

“সময় নেই। অন্য একদিন খাবো।”

সে বেরিয়েই যাচ্ছিল। হঠাৎই থমকে দাঁড়ালো। হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। শব্দ আসছে তালাবন্ধ করে রাখা পাশের ঘর থেকে। হোসেন বলল, “এই ঘরে কে?”

“তেমন কিছু না। এমনি ইদুর।”

“চাবি দেন আমাকে। খুলে দেখতে চাই।

ভদ্রমহিলার মেরুদণ্ডের মধ্যে নিয়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পাশের ঘরে তিন্নি আর সুমন। তিনি তাদেরকে রেখেছেন। পরিস্থিতি ভাল না। যে কোন সময়ে ধরা পড়ে যাবে। হোসেন পরিস্থিতি বুঝল। গম্ভীর গলায় বলল, “চাবি নিয়ে এসুন।”

চলবে।