নারকেল ফুলের মালা পর্ব-১২

0
7

#নারকেল_ফুলের_মালা
#ফারহানা_কবীর_মানাল

১২.
তিন্নি তার কথার জবাব দিলো না, হাসল। সরল গলায় বলল, “মাত্রই ছেলেকে যে-সব কথা বললেন সেগুলো আমার ফোনে রেকর্ড করে নিয়েছি। শুনতে চান?”

আফিফা চমকে উঠলেন। আমতা আমতা করে বললেন, “কী রেকর্ড আছে?”

তিন্নি তাকে রেকর্ড চালু করে শোনাল। বরফ শীতল গলায় বলল, “নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি আপনাকে ছেলেকে বাঁচিয়েছি। সাহায্য করেছি। সেই রাতে যদি আমি ওকে ওখানে রেখে পালিয়ে যেতাম তাহলে আজ আপনি ছেলের কান ভাঙাতে পারতেন না। কেন এমন করছেন? আমার সাথে আপনার কিসের শত্রুতা?”

আফিফা কেঁদে ফেললেন।

“ছেলেকে হারানোর ভয় একজন মা’কে দিয়ে অনেক কিছুই করাতে পারে মা। আমি আমার ছেলেটাকে হারাতে হারাতে ফিরে পেয়েছি। এখন আর পুলিশের ঝামেলায় ফেলতে চাই না।”

“সেজন্য আমাকে দোষী বানিয়ে ফেলবেন?”

“তোমার দোষ না দিলে ওরা আমার ছেলেকে ধ’রে নিয়ে যাবে। খু’নের শা’স্তি অনেক ভয়ংকর। ফাঁ’সিও হতে পারে। কীভাবে নিজের ছেলেকে এমন বিপদের মধ্যে ফেলি?”

তিন্নি তার কথার জবাব দিলো না, হাসল। তাচ্ছিল্যের হাসি। আকরাম সাহেব বেরিয়ে এসেছেন। তিনি তাদের দিকে এগিয়ে এলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, “থানায় যেতে হবে। নাইম কল দিয়েছিল। জরুরি কথা বলার আছে।”

আফিফা একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালেন। আঁড়চোখে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বললেন, “রেডি হয়ে আসছি।”

তিন্নি সুমনের হাত ধরল। কঠিন মুখে বলল, “এখানেই দাঁড়াও।”

সুমন ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকাল। কোন কিছু বলল না।

থানার ঘরে কথাবার্তা নেই। তবে পরিবেশ নিঃশব্দ নয়। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানের শব্দ কানে লাগছে। নাইম চেয়ারে বসে টেবিলের উপর হাত ছড়িয়ে রেখেছে। তার চোখ-মুখ শান্ত। আকরাম সাহেব বললেন, “কিছু বলছেন না কেন?”

“বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছি না।”

“আমাদেরকে কেন ডেকেছেন?”

“মুখ দেখতে।”

তিন্নি একটু ভড়কে গেল। তরল গলায় বলল, “বুঝলাম না।”

নাইম বলল, “কী বুঝলেন না?”

“আপনার কথার মানে বুঝলাম না।”

“আমিও আপনার ভাবসাব বুঝতে পারছি না। গতকাল রাতেই আপনার স্বামী মা’রা গিয়েছে। অথচ তার জন্য বিন্দুমাত্র শোকতপ্ত নেই। সহজ মুখে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। চেহারাও ঠিকঠাক। চোখের নিচে ফোলা ভাব নেই। আশ্চর্যের ব্যাপার!”

“যে স্বামী স্ত্রীকে খু’ন করতে চায়, সেই স্ত্রী কীভাবে শোক পালন করবে?”

“বুঝতে পারলাম না।”

“বুঝতে পারলেন না নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছেন? সেদিন নিজের চোখে আপনি সবটা দেখেছেন। হোসেন আমাকে মা’রার জন্য মামাদের বাড়িতে গিয়েছিল। মামির গলা চে’পে ধরেছিল।”

নাইম একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। গম্ভীর গলায় বলল, “দেখেছি। সবকিছুই দেখেছি। খোঁজ খবর করেছি। তবে একটা প্রশ্নের উত্তর পাইনি।”

“কী প্রশ্ন?”

“লোকের কথা অনুযায়ী আপনাদের সম্পর্ক ভালো ছিল। তাহলে আপনার স্বামীর ক্ষোভের জায়গা কোথায়?”

“জানি না। আমি এসবের কিছুই জানি না।”

নাইম কিছু বলবে তার আগে আকরাম সাহেব তাকে থামিয়ে দিলেন। স্বাভাবিক স্বরে বললেন, “এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে। দূর্ভাগ্যবশত হোসেন কালো জা’দুর চর্চা শুরু করেছিল। জানেনই তো এসব ব্যাপারে ন’র’ব’লির ব্যাপারটা আছে। অ’শু’ভ শক্তি পাওয়ার লোভে সে এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে আত্মীয় পরিবার সবকিছু ভুলে বসেছিল। সে একে একে আমাদের সবাইকে মে’রে ফেলত। ওর মাকে দিয়ে শুরু করেছিল।”

নাইম গম্ভীর হয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শান্ত ভঙ্গিতে এক গ্লাস পানি পান করল। জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে বলল, “তদন্ত চালু থাকবে। কাল পরশুর মধ্যে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে আসবে। সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার আদালত নিবে। তবে আমি কিছুটা ক্লিয়ার করে দিচ্ছি– এখন পর্যন্ত যা কিছু প্রমাণিত হয়েছে তাতে হোসেন সরিফা বেগমকে খু’ন করেছে। হোসেন নিজেও এখন মৃ’ত। পুলিশের সামনে মা’রা গিয়েছে। এই কে’স খুব বেশিদূর এগোবে না।”

আফিফা কথা বলে উঠলেন।

“এগোবে না?”

নাইম ভ্রু কুঁচকে বলল, “এগোনোর মত কোন কথা জানেন?”

তিনি মিইয়ে গেলেন। নরম গলায় বললেন, “না না। তেমন কিছু না। কৌতুহল থেকে প্রশ্ন করেছি।”

কথাবার্তা এখানেই থেমে রইল। আকরাম সাহেব থানা থেকে বেরিয়ে এলেন। তার পিছনে বাকিরাও বেরিয়ে এসেছে। তিন্নি চোখ-মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। আকরাম সাহেব বললেন, “এত চিন্তা করার কিছু নেই। ঘটনা এখানেই থেমে থাকবে। এই কে’স নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি হবে না। চিন্তা করো না।”

“কীভাবে বুঝলেন?”

“এই দেশে প্রতিদিন অসংখ্য খু’ন হয়, চুরি হয়, ধ’র্ষ’ণ হয়। আজ পর্যন্ত কোন কিছুর বিচার হতে দেখেছ? আবরার ফাহাদ মা’রা গিয়েছে কত বছর হতে চলল সেই খু’নের বিচার কার্যকর হতে দেখেছ? তোফাজ্জল? আসিফা? কারোর বিচার হতে দেখেছ তুমি?”

আকরাম সাহেব হাঁপাচ্ছেন। কথা বলতে গিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তাকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে। তিন্নি কথা বাড়াল না। চুপ করে রইল। আফিফা বললেন, “তিন্নি তুমি এখন কোথায় যাবে? তোমার বাপের বাড়িতে যাবে নাকি?”

তিন্নি তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারল না। আকরাম সাহেবের দিকে তাকাল। আকরাম সাহেব বললেন, “তিন্নি আমাদের বাড়িতে থাকবে। তোমরাও এসো। লা’শ ফেরত পাওয়ার পর না হয় যে যার বাড়িতে চলে যাবে।”

শেষ পর্যন্ত তার কথাই রইল। সবাই আকরাম সাহেবের বাড়িতে এসেছে। বাড়ি ফিরে আফিফা বেগম রান্নাঘরে ঢুকলেন। ফ্রিজ থেকে মাছ মাংস বের করে রান্না চাপালেন। বিশেষ কিছু নেই। যা আছে ওই দিয়ে এ বেলা পার করে দেওয়া যাবে। তিন্নি তার আশেপাশে ভিড়ল না। ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইল। হঠাৎই তার খুব খারাপ লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। তার জীবন তো এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। সে তো কখনো এমন জীবন চায়নি। চেয়েছিল– স্বামীর সাথে সুখে শান্তিতে সংসার করবে। ভালোবাসায় ভরা জীবনে সবকিছুর অভাব থাকলেও এক জোড়া বিশ্বস্ত হাত থাকবে। কই! সে-সবের কিছুই তো সে পেল না। যারা অল্পতেই খুশি হয়ে যায় তারা সেই অল্পটুকুই পায় না। ভাগ্য তাদের সাথে উপহাস করে চলে।

বহুদিন বাদে তিন্নি তার মা’কে কল দিলো। মলিন গলায় বলল, “কেমন আছো তুমি?”

মাজেদা বিবি বললেন, “ভালো আছি। কাজের চাপে বেশ কিছুদিন তোর খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি। দু’বার কল দিয়েছিলাম রিসিভ করিসনি। যাইহোক তুই কেমন আছিস?”

মায়ের কথার জবাব দিতে তিন্নির গলা ধরে এলো। জড়ানো গলায় বলল, “আমি কী তোমাদের কাছে বোঝা ছিলাম? এতদিনে এক বারও আমার কথা মনে করলে না। কীভাবে পারলে?”

ওপাশ থেকে উত্তর শোনা গেল না। তিন্নি শক্ত হাতে চোখের পানি মুছল। কঠিন স্বরে বলল, “হোসেন মা’রা গিয়েছে। আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছে। পুলিশ তার লা’শ নিয়ে গেছে। পোস্টমর্টেমের জন্য, লা’শ ফেরত দেওয়ার পর জানাজা। শাশুড়িও মা’রা গিয়েছে।”

সে কল কে’টে দিলো। তার খুব কাঁদছে ইচ্ছে করছে। চোখ থেকে পানি বের হচ্ছে না। শুকনো হয়ে আছে। তিন্নি এলোমেলো ভঙ্গিতে খাট থেকে নামল। রান্নাঘরে গিয়ে দুই গ্লাস পানি পান করল। তার বুক ধড়ফড় করছে। দম আটকে আটকে আসছে। জীবনের কোন কিছুই যেন আর বাকি নেই। ম’রে যেতে পারলেই হলো।

দিনটা নিরবে কেটে গেল। রাতে খাওয়ার সময় আফিফা বললেন, “ভাইজান, তিন্নি মা বাপের ভাবসাব দেখেছেন? এত কিছু হয়ে গেল। অথচ তাদের কোন হেলদোল নেই। খোঁজ খবর নেই।”

আকরাম সাহেব খাওয়া থামিয়ে তিন্নির দিকে তাকালেন। কোমল গলায় বললেন, “তোমার আব্বা কল দিয়েছিলেন। সবকিছু জিজ্ঞেস করেছেন। শুনে অনেক দুঃখও পেয়েছেন। আজকেই আসতে চাইছিলেন। আমি নিষেধ করলাম। বললাম সবকিছু গুছিয়ে কাল সকালে আসুন। কয়েকটা দিন এখানে থাকবেন। তোমার মা খুব কাঁদছিল। বলল তুমি তার কল রিসিভ করছ না।”

তিন্নি মলিন হাসল, কথার জবাব দিলো না। আকরাম সাহেব বললেন, “মন খারাপ করো না। মা বাবা সবসময় মা বাবা-ই হয়। হয়তো তারা ভেবেছে তুমি ভালো আছো। তেমন কিছু হলে তাদের জানাবে।”

তিন্নি এবারও কিছু বলল না। তার গলা ধরে এসেছে। আফিফা বললেন, “তারপরও! কেমন মা বাপ কে জানে! আর তোমাকেও বলিহারি বাপু! এতকিছু হয়ে গেল নিজের মা বাপকে একবারও জানালে না? কীভাবে পারলে?”

তিন্নি তবুও কিছু বলল না। কী বলবে! নিজের উপরে বিরক্ত হওয়া মানুষের কোন কথা থাকে না। তারা সবসময়ই নিজেদের দোষ দেয়। নিজের সাথে লড়ে। তিন্নির অবস্থাও তাই। সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ভীষণ ক্লান্ত। এখন আর কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে না। বলতেও ইচ্ছে করছে না। কতই বা বয়স তার? এই বয়সে এতকিছু সহ্য করা যায়?

রাতে ঘুমানোর সময় প্রায় শেষ। খানিকক্ষণ পর ফজরের আজান হবে। তিন্নির চোখে ঘুম নেই। সে বিছানায় শুয়ে হাস ফাঁস করছে। বিছানায় উঠে বসছে, আবার শুয়ে পড়ছে। ঘুমতে না পারলে রাতকে অনেক বড় মনে হয়। বিশাল সমুদ্রের মতো বড়। তিন্নি দু’হাতে নিজেকে জড়িয়ে ধরল। শান্ত ভঙ্গিতে শ্বাস নিতে লাগল। বিড়বিড়িয়ে বলল, “আল্লাহ আমার কষ্ট কমিয়ে দেন। দয়া করুন আমার উপর।”

ভোরের দিকে তার চোখ লেগে এসেছিল। ঘুম ভাঙল বেলায়। কাঁচা ঘুম। সে চোখ ঢলতে ঢলতে বিছানায় উঠে বসল। খটখট শব্দ হচ্ছে। কে কী করছে? মা বাবা এসেছে নাকি? সে বিছানা ছেড়ে নামল। উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে বসার ঘরের দিকে গেল। আকরাম সাহেবের ঘর থেকে খটখটানি শব্দ আসছে। দরজা ভেজানো। সে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকল। আফিফা চমকে তিন্নির দিকে তাকালেন। মেকি হেসে বললেন, “জানোই তো পরার জন্য সাথে করে কিছু নিয়ে আসা হয়নি। তাই একটা শাড়ি দেখছিলাম।”

তিনি হাসার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। তিন্নি পারল। সে বেশ চওড়া হাসি হাসল। অন্যরকম গলায় বলল, “এ কারণে আমাকে ফাঁসাতে চেয়েছেন?”

“কি বলতে চাইছ তুমি?”

“বুঝতে পারছেন না নাকি বুঝতে চাইছেন না?”

“তোমার কথাবার্তা বুঝতে পারছি না।”

“আচ্ছা বেশ বুঝিয়ে বলছি। আপনি শাশুড়ি মায়ের সকল শাড়ি গহনা দখল করতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন আমি না থাকলে খুব সহজে এগুলো আপনার হয়ে যাবে। যতদূর জানি শাশুড়ি মায়ের শাড়ির কানেকশন ভালো। তার আলমারিতে পঞ্চাশ হাজার টাকার শাড়িও আছে। ওগুলো দেখে লোভ সামলানো সহজ না।”

আফিফা চট করে কিছু বলতে পারলেন না। তিনি এমনটাই ভেবেছিলেন। আকরাম সাহেব এসব শাড়ি গহনার দিকে নজর দিবেন না। এ ব্যাপারে তিনি আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন। কথায় কথায় একবার জিজ্ঞেসও করেছিলেন– ভাইজান আপা শাড়ি, গহনা কী করবেন? কিছু তো কম নেই।

আকরাম সাহেব খুব সহজ জবাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন– ওসব কিছু তিন্নিকে দিয়ে দেব। আমার জীবনে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সংসার এখন আর ভালো লাগে না। জমিজমাও বিক্রি করে দেব। বাড়িটা থাকবে। সবকিছু গুছিয়ে মক্কায় চলে যাব। বাকিটা জীবন যদি ওখানে কাটাতে পারি। জীবনে পা’প তো কিছু কম করিনি। আল্লাহর দয়ায় যদি মাফ করে দেয়।

আফিফা এতটুকু শুনে ক্ষান্ত হননি। আবারও প্রশ্ন তুলেছেন– তিন্নি এসব নিতে না চাইলে কী করবেন? গরিবদের দিয়ে দেবেন?”

“তুমি রেখো দিয়ো। সরিফার গহনাগাঁটি খুব বেশি নেই। ভরি দুয়েকের মত আছে। ওসব আমি আর নিতে চাই না।”

সেই থেকেই তার মাথায় এই পরিকল্পনা বাসা বেঁধেছে। তিন্নিকে কোনভাবে সরাতে পারলে সবকিছু তার হয়ে যাবে। আকরাম সাহেব সরিফার সোনার হিসেবেটা সঠিক জানেন না। ছেলের কাছ থেকে টাকা চেয়ে চেয়ে সরিফা বেশ কয়েকটা সোনার গহনা গড়িয়ে নিয়ে ছিলেন। শুনলে নানান কথা বলতে পারে ভেবে সরিফা স্বামীকে এসবের কিছু বলেননি। বলেছিলেন আফিফাকে। আফিফা সে কথা ভুলতে পারেননি। মুফতে এত সোনা গহনা, শাড়ি কাপড় কেউ ছাড়তে পারে নাকি? তাছাড়া কে’সের তদন্ত শেষ হয়নি। খু’নটা তার ছেলেই করেছে। পুলিশ কোনভাবে সুমনের নাম বের করে ফেললে ছেলেকে হারাতে হবে। আর কিছু না হোক এরচেয়ে পরের মেয়ের কাঁধে দোষ চাপিয়ে দিলে দু’দিকের লাভ। সোনা গহনা, শাড়ি কাপড় সব পাওয়া হলো। ছেলের চিন্তাও রইল না। আফিফা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করলেন। তিন্নি বলল, “চুপ করে গেলেন কেন?”

“ভুলভাল কথা বললে কী জবাব দেব?”

“আমি ভুল কিছু বলিনি। ঠিক কথা বলেছি। ভুল কথার অনেক জবাব হয়। ঠিক কথার জবাব থাকে না।”

আফিফা কিছু বলবেন তার আগে আকরাম সাহেব ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। আলমারি খোলা দেখে ভীষণ বিস্মিত হলেন। আশ্চর্য গলায় বললেন, “তোমরা এখানে কী করছ?”

আফিফা বললেন, “তেমন কিছু করছি না। শাড়ি নিতে এসেছিলাম। গোসল সেরে পরব।”

“শাড়ি নিতে আলমারি খুলতে হবে কেন? আলনায় অনেক শাড়ি রাখা আছে। তাছাড়া তুমি আমাকে না বলে আলমারির চাবিতে হাত দিলে কেন?”

তিনি কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। আমতা আমতা করতে লাগলেন। তিন্নি পুরো ব্যাপারটা বলল। যা কিছু তার সন্দেহ হয়েছে সব বলল। সব শুনে আকরাম সাহেব ভীষণ রেগে গেলেন। কর্কশ গলায় বললেন, “নাইমকে কল দিচ্ছি। এই মহিলার একটা শিক্ষা হওয়া উচিত।”

আফিফা বুঝলেন অবস্থা খারাপ। আকরাম সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছু করে ফেলবেন। আফিফা ঝুঁকি নিলেন না। তিন্নির হাত চেপে ধরলেন। ভেজা গলায় বললেন, “লোভে পড়ে ভুল করে ফেলেছি মা। তুমি আমাকে মাফ করে দাও।”

তিন্নি অল্প হাসল। অন্যরকম গলায় বলল, “আপনাকে মাফ করে দিলে নিজের সাথে বেইমানি করা হবে।”

সে আর কিছু বলল না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আকরাম সাহেবও কিছু বললেন না। শক্ত মুখে তাকিয়ে রইলেন।

নাইমের কল এলো বেলা বারোটার দিকে। পোস্টমর্টেম শেষ। লা’শ বুঝে নিতে হবে। স্বজনদের হাতে লিখিতভাবে লা’শ বুঝিয়ে দেওয়া হবে। আকরাম সাহেব কাপড় বদলে নিলেন। বের হবেন ঠিক সেই মুহুর্তে মহিবুল সাহেব বাড়িতে ঢুকলেন। মাজেদা বিবি তার সঙ্গে এসেছেন। তার চোখ-মুখ ফোলা। যেন অনেক কেঁদেছেন। আকরাম সাহেব বললেন, “আপনারা বসুন। আমার একটু কাজ আছে। দারোগা সাহেব ডেকেছেন।”

মহিবুল সাহেব তার সাথে বেরিয়ে গেলেন। বসলেন না। মাজেদা বিবি তিন্নি কাছে গেলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, “কেমন আছিস মা?”

তিন্নি মলিন হাসল। জড়ানো গলায় বলল, “একটা কথা বলবে মা? আমি কী তোমাদের বোঝা ছিলাম?”

মাজেদা বিবি উত্তর খুঁজে পেলেন না। চোখ মুছতে ব্যস্ত হয়ে রইলেন।

চলবে