#মৌমোহিনী
পর্ব-২
“মৌ, আরেকটা দিন থাকা যায় না?” মনিকার চুল নিয়ে খেলতে খেলতে জিজ্ঞেস করলেন তৌকির সাহেব। মনিকার ডাকনাম মৌটুসী। সেটার সংক্ষিপ্ত ভার্সন মৌ। তৌকির সাহেবের অবশ্য ওকে ‘বৌ’ বলে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু একবার ডাকাতেই মনিকা এমনভাবে চোখ গরম করে তাকিয়েছে যে তার আর সাহস হয়নি। তাছাড়া এই মেয়েকে বিয়ে করার সাহস বা সুযোগ এমনিতেও তার নেই।
মনিকার চোখে দুষ্টুমির হাসি ঝিলিক দিয়ে গেল। সে বলল, “বেশি খেলে সবচেয়ে পছন্দের খাবারটাও আর মজা লাগে না, জানো তো?”
“বেশি খাব না, অল্প একটু খাবো।”
মনিকা শোওয়া থেকে উঠে বসল। আধবুড়ো লোকটার সাথে তিনদিন থেকেছে তাই যথেষ্ট। আর রুচি হচ্ছে না। স্যুটকেস ভর্তি হয়েছে শপিং করে। বডি মাসাজ করেছে। আর কী করবে?
দুই হাত তুলে শরীরটা টানটান করে নিয়ে মনিকা জানালার বাইরে চেয়ে বলল, “আরে আরে, আকাশটা কী সুন্দর লাগছে দেখো! চলো তো ওদিকে!”
তৌকির সাহেবের হাত ধরে সে টেনে নিয়ে গেল জানালার পাশে। ঝলমলে গাঢ় নীল আকাশটা দিগন্তে মিশে গেছে সুনীল সাগরের সাথে। মনিকা মোবাইলের ক্যামেরা অন করে বলল, “চলো সেলফি তুলি।”
তৌকির সাহেব হায় হায় করে উঠলেন। “এভাবে খালি গায়ে?”
মনিকা হাসল। দু’জনের পরনেই স্বল্প পোশাক। সে বলল, “এভাবেই কি আমাদের সবচেয়ে ভালো মেমোরি তৈরি হয়নি? আমরা তো মেমোরি জমাতে এসেছি তাই না? তাছাড়া এগুলো কেউ দেখবে নাকি? শুধু তুমি আর আমি।”
পটাপট ছবি তুলতে লাগল সে। নানা ভঙ্গিমায়, নানারকম আজব আজব ফিল্টার দিয়ে।
“তোমাকে কী হট লাগছে!” ছবি তোলার ফাঁকে বলল মনিকা।
তৌকির সাহেব খুশিতে লাল হয়ে গেলেন। মনিকা মনে মনে হাসল। ব্যাটা বিশ্বাস করল নাকি? সে নিজেকে এখনো হট মনে করে? একসময় সে সুপুরুষ ছিল বটে! তবে এখন খানিকটা ভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। শরীরটা ঢলঢলে হয়েছে৷ কলকব্জা কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছে। তাই মেইন কোর্সের সময়ে অল্পতেই হাঁপানি ওঠার অবস্থা হয়েছে৷ তবুও মনিকা এমন ভাব করেছে যেন সে সুখে মরে যাচ্ছে!
ছবি তোলা শেষে মনিকা বলল এগুলো একটা নতুন আইডির গুগল ড্রাইভে সেভ করে সেটার এক্সেস পাঠিয়ে দেবে তৌকির সাহেবকে। মোবাইল থেকে মুছে ফেলবে সব। তৌকির সাহেব শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন।
মনিকা তার দুই গালে হাত রেখে বলল, “আর বায়না করো না লক্ষীটি, আমার পরীক্ষা সামনে জানোই তো, সবাই এই তিনদিনের ছুটিতে কত পড়া এগিয়ে রেখেছে! আমি তো আনন্দ ফুর্তিতেই শেষ! রেজাল্ট খারাপ করলে বাড়ি থেকেই বের করে দেবে!”
“দিলে তো ভালোই। আমার সাথে থাকবে।”
মনিকা তৌকির সাহেবের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আর এসব কথা নয়। রাতেই তো চলে যাচ্ছি। এই বেলাটা সুইমিং পুলে কাটিয়ে আসি চলো।”
****
তৌকির সাহেবের মেয়ে তিন্নি এবার ক্লাস ফোরে উঠেছে। বাবা বাড়ি ফিরতেই সে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে এসে বাবার কোলে চড়ে বসল। কোলে চড়ার বসয় তার নেই এটা সে মানতেই চায় না। মা বকলেও বাবা কিছু বলে না বলে বাবার কোলে সময় অসময়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে।
তৌকির সাহেব মেয়ের গালে চুমু দিয়ে তাকে নিয়ে সোফার ওপর নামিয়ে দিলেন৷ এটুকুতেই হাঁপিয়ে উঠেছেন। প্রিয়াঙ্কা মেয়েকে বকতে বকতে এগিয়ে এলেন। “কতবার বলেছি কোলে চড়বি না! বাবা কতটা জার্নি করে এসেছে খেয়াল আছে?”
তৌকির সাহেব হেসে বললেন, “আহা! বকছো কেন ওকে? আমাদের ছোট্ট তিন্নির বুঝি কোলে চড়তে ইচ্ছে করে না?”
প্রিয়াঙ্কা কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ট্যুর কেমন কাটল?”
“ভালোই।”
“মিটিং ঠিকঠাকমতো হলো?”
“সব ঠিকঠাক। কিন্তু এত ব্যস্ত ছিলাম যে তোমাদের জন্য কিছু আনতেও পারিনি। শুধু চকোলেট এনেছি।”
“চকোলেট!” লাফিয়ে উঠল তিন্নি। “দাও দাও দাও!”
মেয়ের আদর আহ্লাদের পালা শেষে তৌকির সাহেব গোসল করে খেয়েদেয়ে লম্বা ঘুম দিলেন৷ ঘুম থেকে উঠে দেখলেন মনিকা একটা ইমেইল পাঠিয়েছে৷ দুটো লিংক। প্রথমটায় ঢুকে নিজের আইডিতেই ফেরত চলে এলেন তিনি৷ বুঝতে পারলেন না সমস্যা কী৷ পরের লিংকে গিয়ে অবশ্য ছবিগুলো পেলেন। মনিকার সামনে তাকে বেশ ম্লান দেখাচ্ছে, তবুও দু’জনের অন্তরঙ্গ ছবিগুলো দেখে শরীরজুড়ে শিহরণ বয়ে গেল।
তিনি সাথে সাথে মনিকাকে মেসেজ পাঠালেন, “এরপর আবার কবে দেখা হচ্ছে?”
মনিকা উত্তর দিল, “আমার পরীক্ষার পর।”
*****
তৌকির সাহেব এরপর কিছুদিনের জন্য কাজে ডুবে গেলেন পুরোপুরি। খুব চাপ যাচ্ছে ইদানীং। বাংলাদেশ সরকার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রোজেক্টে হাত দিয়েছে। এটা সফল হলে জিও পলিটিক্যাল দিক দিয়ে দেশের অবস্থান অনেকটাই বদলে যাবে৷ তৌকির সাহেবকে এই প্রোজেক্টের বেশ খানিকটা অংশ সামলাতে হচ্ছে। রাতদিন মিটিং আর নানারকম ছোটাছুটিতে কেটে যাচ্ছে সময়।
প্রিয়াঙ্কা কিছুদিন অভিযোগ করেছেন, “তুমি বাড়ির দিকে ফিরেও তাকাচ্ছো না এখন!”
তৌকির সাহেব আহত চোখে চেয়ে বলেছেন, “তুমি আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে কত ধানে কত চাল!”
প্রিয়াঙ্কা মুখ বাঁকায়। অতীতের দিনগুলো মনে পড়ে যায় তার। তৌকির আর সে ব্যাচমেট ছিল। ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষ থেকে তাদের প্রেম। প্রিয়াঙ্কা সুন্দরী ছিল। বাড়ি থেকে তার বিয়ের জন্য ছেলে দেখা শুরু হয়েছিল তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর থেকেই। সে সম্বন্ধগুলো নানা ছুতোয় কাটিয়ে গেছে। ওদের অনার্স মাস্টার্স শেষ হবারও পাঁচ বছর পর তৌকিরের ভাগ্য ফিরেছে। বেকার একটা ছেলের হাত ধরে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে একের পর এক ভালো ভালো সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিয়ে এতগুলো বছর কাটানো কতটা মানসিক চাপের ছিল তা বলে বোঝাবার নয়। প্রতিনিয়ত তাকে পরিবার, আত্মীয়স্বজন আর সমাজের কটুক্তিতে বিদ্ধ হতে হয়েছে। তবুও তৌকিরের মুখটা দেখলে তার মনে হতো, পুরো পৃথিবীটাই এর সামনে তুচ্ছ!
তখন ওদের খুব ভালো সময় কাটত। চাকরি হবার আগ পর্যন্ত তৌকিরের হাতে যথেষ্ট সময় থাকত প্রিয়াঙ্কাকে দেবার। সেই সময়টা কষ্টের ছিল, তবুও সুখের ছিল। বিয়ের পরের কয়েকটা বছর আরো বেশি আনন্দের ছিল। ছিল ভীষণ সুখের।
তারপর বেশকিছু বছর কেটে গিয়েও সন্তান না হবার দরুন এক অন্যরকম মানসিক যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল৷ তখনো তৌকির তাকে অসম্ভব রকমের সাপোর্ট করেছে৷ দেশ বিদেশের ডাক্তার দেখিয়ে এক করেছে৷ প্রচুর ট্রিটমেন্টের পর প্রিয়াঙ্কার কোল জুড়ে তিন্নি এসেছে। কোল আলো হলেও তারপর থেকেই কেমন করে যেন ওদের কানায় কানায় পূর্ণ ভালোবাসার সাগরের জল শুকিয়ে যেতে শুরু হলো। ভাটার টান পড়ল তাতে। তৌকির আরো বেশি করে কাজে ডুবে গেল, আর প্রিয়াঙ্কা ব্যস্ত হয়ে পড়ল মেয়ে নিয়ে।
এখন তো তৌকিরের দম ফেলারও সময় নেই। কতদিন হয়ে গেল তাকে সে একবার জড়িয়েও ধরেনি। ওর বোধহয় ইচ্ছেও করে না৷ প্রিয়াঙ্কা ভাবে, তার নিজেরও যদি আর ইচ্ছে না করত, তাহলেই ভালো হতো।
*****
এক বিকেলে মনিকার মেসেজ এলো, “আমার তো পরীক্ষা শেষ। আপনার কোনো খবর নেই৷ ভুলে গেলেন নাকি আমায়? এত দ্রুত ফুরিয়ে গেল সব প্রেম?”
তৌকির সাহেব ফোন করলেন ওকে। “ফ্রি আছো নাকি?”
“খুব আছি! একটা নতুন ব্লাউজ বানিয়েছি কাস্টোমাইজ করে। ব্যাংককে থাকতে একবার ব্লাউজের স্টাইল নিয়ে তোমার ফ্যান্টাসির কথা বলেছিলে মনে আছে?”
“অবশ্যই আছে।”
“তাহলে সময় বের করো।”
তৌকির সাহেব হিসেব করে দেখলেন পরের এক সপ্তাহে তিনি বিন্দুমাত্র সময় বের করতে পারবেন না। আজই হাতে একটু কম কাজ আছে। তিনি কাজগুলো যথাসম্ভব গুছিয়ে ফেলতে লাগলেন৷ এই মেয়ের আবার সস্তা জায়গা চলবে না। বিলাসবহুল হোটেলে নিতে হবে।
ঘন্টা দুয়েক পর দেখা গেল আরামদায়ক হোটেল কক্ষে শুয়ে দু’জন ক্লান্ত শরীরে টুকটাক গল্প করছে৷ এতক্ষণ ঝড় বয়ে গেছে এখানে। মনিকা অভিযোগের সুরে বলল, “আমি ভেবেছিলাম আমাকে ভুলেই গেছ। এত কী নিয়ে ব্যস্ত ছিলে?”
“কত কাজ থাকে!”
“খুব জরুরি কাজ?”
“হুম।”
“ইশ! তোমার কাজ তো শুধু ফাইল হাতে নেয়া আর সাইন করা!”
তৌকির সাহেব মনিকার নাক টিপে দিয়ে বললেন, “এত্ত সহজ নাকি? জরুরি একটা প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করতে করতে শরীরের সব তেল বের হচ্ছে।”
“কী প্রোজেক্ট?”
“আছে, আন্তর্জাতিক প্রোজেক্ট৷ খুব গোপনীয়। এখনই খোলাসা করা যাবে না।”
মনিকার ঠোঁটে রহস্যময় হাসি খেলে গেল। “তাই নাকি? তা তোমার এমন গোপনীয় কী আছে যা আমি দেখিনি?”
তৌকির সাহেব মুখ টিপে হাসলেন, “তুমি আরো বেশি দুষ্টু হয়েছ।”
“আহা বলো না কী প্রোজেক্ট? আমিও তো সরকারি চাকরি করব৷ একটু ধারণা হতে হবে না?”
“তোমার অত কষ্টের কাজ করতে হবে না। তুমি বরং যেটা ভালো পারো সেটাই করো।”
মনিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লোকটাকে যত গোবেচারা ভেবেছিল ততটা সে না৷ হাতে এসেও পিছলে যাচ্ছে!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু