#মৌমোহিনী
পর্ব-৩
“Want to meet you. Urgently!”
মেসেজটা এসেছে মনিকার নাম্বার থেকে৷ তৌকির সাহেব গাড়িতে বসেছিলেন৷ তিনি ফোন করলেন তাকে।
মনিকা ফোন ধরে কোনো সম্বোধনের আশপাশ দিয়েও গেল না৷ তীব্র অভিমানের সুরে বলল, “এই আপনার আকাশ পাতাল প্রেম? একটা সপ্তাহ ধরে না কোনো ফোন, না কোনো মেসেজ! আজ এক্ষুনি দেখা না করলে আপনার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেব বলে দিচ্ছি! সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চাইলে দ্য ওয়েস্টিনে চলে আসুন এক ঘন্টার মধ্যে। আমি অপেক্ষা করছি।”
তিনি এখন কোথায়, কী করছেন, হাতে সময় আছে কি না কিছুই জিজ্ঞেস করল না মনিকা। ফোন কেটে দিল। তৌকির সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রাইভারকে বললেন, “গাড়ি ঘোরাও।”
এদিকে তার ফোনে অনবরত প্রিয়াঙ্কার কল আসছে। আজ তিন্নির জন্মদিন। পার্টি অর্গানাইজ করা হয়েছে বাড়িতেই। প্রিয়াঙ্কার ইচ্ছে ছিল তিন্নির দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বড় করে কিছু করতে৷ কিন্তু তৌকির সাহেবের হাতে টাকাপয়সার টান পড়েছে৷ বড় একটা এমাউন্ট খরচ হয়েছে থাইল্যান্ডে গিয়ে। ফেরার পরেও সেই মেয়ের চাহিদার শেষ নেই। এটা ওটা প্রয়োজন তো আছেই। তৌকির সাহেব তাই বলে দিয়েছেন ছোটোখাটো প্রোগ্রাম রাখতে। প্রিয়াঙ্কার মেজাজ খিঁচড়ে আছে সে কারনে। তার ওপর সারাদিন তিনি ছিলেন মিটিংয়ে। একটা কাজেও সাহায্য করতে পারেননি প্রিয়াঙ্কাকে। এখন তার বাড়ি ফেরার কথা৷ কিন্তু এর মাঝে আবার প্রেমিকার অভিমান ভাঙাতে যেতে হচ্ছে! এত ঝামেলায় তার মাথা গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে! একবার মনে হলো মনিকাকে ব্লক করে দিয়ে বাড়ি চলে যেতে। কিন্তু আবার মেয়েটা হাতছাড়া হয়ে যাবে ভাবলেই বুকটা কেমন করছে, মন চাইছে দুনিয়াদারি ছেড়ে ওর কাছেই চলে যেতে।
পুরো সপ্তাহ তার কেটেছে দৌড়ের ওপরে৷ কোনোদিকে তাকানোর সময় পাননি। আজ বৃহস্পতিবারেও তিনটা মিটিং ছিল। সর্বশেষ আমেরিকান ক্লায়েন্টদের সাথে কথাবার্তা ফাইনাল হবার পর তার ছুটি হয়েছে৷ আবার রবিবারে ছুটতে হবে আরেক কাজে। তিনি সদ্য মেইলে আসা ভূতাত্ত্বিক সার্ভে ডেটার ফাইলটা ওপেন করে পড়ে নিলেন৷ আবার কখন সময় পাওয়া যায় বলা যায় না।
****
কাচের ওপাশে ঢাকা শহরের গিজগিজে দালানগুলোতে আলো জ্বলে উঠছে। সন্ধ্যার প্রকৃতিতে আজ কোনো রঙের বালাই নেই। বিষন্ন ছাইরঙা আকাশে ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে আঁধার। সদ্য হোটেলরুমে ঢুকেছেন তৌকির সাহেব৷ তার অস্থির লাগছে কেন যেন৷ পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল মনিকা৷ “হচ্ছেটা কী হ্যাঁ? বাইরের দৃশ্য বুঝি আমার চেয়ে বেশি সুন্দর?”
ঘুরে তার দিকে ভালো করে চাইলেন তৌকির সাহেব৷ স্বল্পবসনা মনিকাকে আজ অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। মেরুন রঙের শোল্ডারলেস টাইট ফিটিং টপটা হাঁটুর অনেক ওপরেই শেষ হয়ে গেছে। দুই পা ক্রস করে রেখেছে সে। গাঢ় লিপস্টিক মাখা ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। “এতক্ষণে দেখলে বুঝি?”
তৌকির সাহেব এগিয়ে গেলেন তার দিকে। মনিকা পিছিয়ে গেল। “উহু, একটু পর। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। আমি ডাকলে ওয়াশরুমে ঢুকবে। ততক্ষণে একটু ড্রিঙ্ক করে নাও।”
মনিকা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলে তিনি কয়েক মুহূর্ত বিহ্বলের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তার মনে হতে লাগল কী যেন একটা নেই৷ তবে কী সেটা মনে করতে পারলেন না।
তৌকির সাহেব ড্রিঙ্ক করেন খুব কম৷ তবে ভালো পানীয় পেলে আর নিজেকে আটকে রাখেন না। ঘরের একপাশে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা জনি ওয়াকার ব্লু লেবেলের বোতলটা চোখে পড়ল। এটা তার সবচেয়ে প্রিয় ব্লেন্ডেড স্কচ হুইস্কি। সাথে আছে দুটো ক্রিস্টাল গ্লাস, আইস বাকেট, লেবুর টুকরো আর প্লেটে সাজানো হানি কোটেড নাটস। রূপালী আইস বাকেট থেকে ধোঁয়া ওঠা ঠান্ডা কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ছে কাচের টেবিলে। তিনি কেমন মোহগ্রস্থের মতো এগিয়ে গেলেন৷ গ্লাসে ঢাললেন গাঢ় সোনালী পানীয়। হালকা মধু মিশ্রিত সুগন্ধ ধাক্কা দিল নাকে। গলায় ঢেলে দিলেন গ্লাসের সবটুকু তরল। হেলান দিলেন সোফার নরম গদিতে।
পুরো শরীর গ্রাস করে নিচ্ছে আরামদায়ক এক নেশার ঘোর। শরীর চনমনে লাগছে। তিনি বোতল তুলে নিলেন আবার। ঠিক তখনই ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেল। ভেতর থেকে মনিকার গলা ভেসে এলো।
“ডার্লিং! ভেতরে আসতে পারো।”
তৌকির সাহেব বোতল রেখে উঠে পড়লেন৷ স্যুট, টাই খুলে রেখে দিলেন সোফার ওপর। ওয়াশরুমে ঢুকে থমকে গেলেন তিনি৷ নরম আলো জ্বলছে ভেতরে। ধোঁয়াটে বাথরুমের ভেতরটায় এক অদৃশ্য মাদক কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। বাথটাবের ভেতর আধশোয়া হয়ে আছে মনিকা। স্বচ্ছ পানির ভেতর দিয়ে ওর চমৎকার শরীরটা দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব সুন্দর শরীরে একটা সুতোও নেই। তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনিকা লজ্জা পাবার ভান করল। ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, “আসবে না?”
তৌকির সাহেব বাকি জামাকাপড় ছেড়ে নেমে পড়লেন বাথটাবে। তার জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাময় একটা সন্ধ্যা তিনি কাটালেন অত্যন্ত আমোদের সাথে।
মনিকার থেকে বিদায় নিয়ে বের হবার আগে বেডসাইড টেবিলে নিজের মোবাইল ফোনটা চোখে পড়ল। বুকটা ধ্বক করে উঠল তার। তখন যে মনে হচ্ছিল কিছু একটা নেই, সেই কিছু একটা ছিল তার মোবাইল ফোন, যেটাতে প্রিয়াঙ্কার লাগাতার কল আসায় ভাইব্রেশন হয়ে চলেছিল। তিনি হলপ করে বলতে পারেন এখানে আসার পর তিনি মোবাইল বের করেননি। বেডসাইড টেবিলের এদিকে তো জামাকাপড় ছাড়ার সময় আসেনওনি। তাহলে এটা এখানে এলো কেমন করে? কী হয়েছিল মনে করার চেষ্টা করলেন তিনি।
মনিকা এসে তাকে জড়িয়ে ধরার পর তিনি আর ফোনটার অস্তিত্ব টের পাননি৷ ভয়ানক ব্যাপার! খুব সুক্ষ্ম প্ল্যান করা হয়েছে। তার মাথা ঝিমঝিম করছে এখনো। ড্রিংকে কি কিছু ছিল? চিন্তা ভাবনা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
মনিকার দিকে তাকালেন তিনি। ড্রেস পরে এখন মেকআপ করছে সে। চোখে খুব যত্ন করে আইলাইনার পরছে। যেন কোনো পার্টিতে যাবে এখুনি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “বাড়িতে ড্রপ করে দেব তোমাকে?”
মনিকা হাসল। “নাহ, আমার ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টি এটেন্ড করতে যাব। লোকেশন তোমার বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে। আজ আর আমার জন্য কষ্ট করতে হবে না। আমি ঠিক চলে যাব।”
তৌকির সাহেবের বুকটা খামচে ধরল কিছু একটা। তিন্নির জন্মদিন আজ! তার বাড়িতেও পার্টি হচ্ছে। তিন্নি তাকে ছাড়া কেক কাটবে না কিছুতেই। মনিকার সাথে দেখা হবার পর তিনি নিজের অতি আদরের মেয়েকে এভাবে অবহেলা করে যাচ্ছেন? এটা কেমন করে সম্ভব?
তার কান্না পেয়ে গেল। মোবাইলটা অন করলেন তিনি। আটান্নটা মিসড কল। শেষটা বিশ মিনিট আগে। বোধহয় তিনি আর ফোন তুলবেন না ভেবে ক্ষান্তি দিয়েছে প্রিয়াঙ্কা।
“কী হলো তোমার? আপসেট লাগছে হঠাৎ?” জিজ্ঞেস করল মনিকা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৌকির সাহেব বললেন, “বাড়ি থেকে কল আসছে। যেতে হবে। আমি গেলাম।”
*****
গাড়িতে বসে তৌকির সাহেব ভাবতে চেষ্টা করলেন তার এখন ঠিক কী করা উচিত৷ বুঝে উঠতে পারলেন না কিছুতেই। মনিকা তাকে ধোঁকা দিয়েছে! এখন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ইনিয়ে বিনিয়ে তার প্রোজেক্টের ব্যাপারে জানতে চাওয়া, মেইলে লিংক পাঠানো, মোবাইল ঘাটাঘাটি করা, এসব কিছুই ইঙ্গিত করে তার থেকে তথ্য হাতানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু মনিকা কাদের হয়ে কাজ করছে? কতটুকু জানে সে? তার থেকে কতটুকু নিতে পেরেছে?
তার যে ইমেইল আইডি মোবাইলে লগইন করা সেটাতে কিছুই নেই। অফিসের সবকিছুই অফিশিয়াল ইমেইল আইডিতে থাকে যেটা শুধু তার ল্যাপটপ আর ডেস্কটপে লগইন করা আছে। ভাগ্যিস ল্যাপটপের ব্যাগটা তিনি গাড়িতেই রেখে গিয়েছিলেন৷ এমনিতে কখনো এই কাজ করেন না তিনি। আজ এত ঝামেলায় ভুলে গিয়েছিলেন।
তিনি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, “গাড়িতেই ছিলে তো পুরোটা সময়?”
“জি স্যার।”
ব্যাগটা দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে না এটাতে কারো হাত পড়েছে। যাক! এদিক দিয়ে আশ্বস্ত হওয়া গেল!
ভাবতে ভাবতে বাড়িতে পৌঁছে গেলেন তিনি। পার্টি তখনো শেষ হয়নি। কেক কাটা বাকি। তিন্নি গাল ফুলিয়ে বসে আছে। প্রিয়াঙ্কা তাকে দেখে চোখ কটমটিয়ে তাকাল। ওর চোখে কী ফুটে আছে? অবিশ্বাস? হতাশা? নাকি ঘৃণা?
তিন্নিকে কোলে তুলে নিয়ে অনেকটা সময় ধরে মাফ চাইলেন তিনি। জন্মদিনের দিন খুব বেশিক্ষণ রাগ করে থাকা যায় না। ঝলমলে আলোমাখা পরিবেশে তিন্নিও রাগ ধরে রাখতে পারল না৷ হেসে বাবার গালে চুমু খেল।
তৌকির সাহেব তিন্নিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বললেন, “চলো কেক কাটি।”
এটুকু বলতে গিয়েই কন্ঠ রূদ্ধ হয়ে এলো তার। একটু আগেই মনিকা তার গালে চুমু খাচ্ছিল। এখন সেখানটাতেই তিন্নির নিষ্পাপ চুমু তাকে প্রচন্ড অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে৷ নিজেকে নোংরা একটা পোকার মতো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার পুরো শরীরটাই অসূচী। কিছুতেই এই শরীর নিয়ে পবিত্র মেয়েকে ছোঁয়া যায় না।
পার্টির প্রায় শেষের দিকে যখন সবাই বিদায় নিচ্ছে, তখনই আরিফের দিকে চোখ পড়ল তার৷ আরিফকে তিনি এতক্ষণ খেয়ালই করেননি।
আরিফ তার বন্ধু আর কাজিন। একই সাথে পড়াশুনাও করেছে তারা। আরিফ তার থেকে অন্তত তিনগুণ বেশি বুদ্ধিমান। সে গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করছে বহুদিন হলো৷ আরিফকে কি ঘটনা খুলে বলা যায়? সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগল না তার। হ্যাঁ বললে আরিফকেই বলা যায়৷
তিনি জানেন না জল কতদূর গড়িয়েছে৷ যদি তার কারনে সরকারের সিক্রেট প্রোজেক্টের তথ্য ফাঁস হয়ে যায় তবে সেটা যে শুধু তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেবে তা নয়, বরং তীব্র রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও তৈরির সম্ভাবনা আছে। সামনে নির্বাচন। এমনিতেই দেশের লোকজন উত্তেজিত হয়ে আছে। এর মধ্যে তার কারনে একটা কেলেঙ্কারি হলে সর্বনাশের শেষ থাকবে না।
তিনি আরিফের হাত ধরে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিলেন৷
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু