মৌমোহিনী পর্ব-০৫

0
10

#মৌমোহিনী
পর্ব-৫

তৌকির সাহেব মনিকার বাসা থেকে বের হয়ে নিজের গাড়িতে উঠে বসলেন। ড্রাইভার শঙ্কিত মুখে বলল, “স্যার, ম্যাডাম আমারে ফোন করছে কম কইরা হইলেও পঞ্চায় বার। আপনি মানা করছেন দেইখা ধরি নাই।”

তৌকির সাহেবের বুক কাঁপছে৷ বাড়িতে কী বলবে? আরিফকে কী বলবে? তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘেমে একাকার হয়ে গেলেন।

ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, “স্যার, বাড়ির দিকে যাব?”

“না না, দাঁড়াও একটু।”

তৌকির সাহেব ফোন করলেন আরিফকে। আরিফ ফোন ধরে খেঁকিয়ে উঠলেন, “ফাজলামি পাইছিস? সমস্যা কী তোর? আবার ওই মেয়ের ফাঁদে পড়ে যাস নাই তো? তোর কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নাই? প্রিয়াঙ্কা পাগল হয়ে গেছে! আমাকে ফোন করে করে পাগল বানায় দিচ্ছে! আমি এদিকে তোর ফোন নাম্বার ট্রেস করে দেখি তুই ওই মেয়ের সাথেই আছিস। আমি তো একবার মন চাইছে প্রিয়াঙ্কারে বলেই দেই সব। ও আমাকে প্রেশার দিচ্ছে তোকে খুঁজতে। আর একটা কলও তুই ধরলি না কেন? সমস্যাটা কী?”

তৌকির সাহেব বললেন, “কী হয়েছে পরে বলব। আগে প্রিয়াঙ্কাকে কী বলব সেটা বল।”

আরিফ একটা গালি দিয়ে ফোন কেটে দিল। তৌকির সাহেব ড্রাইভারকে বাড়ির দিকে যেতে বলে প্রিয়াঙ্কাকে ফোন করলেন নিজেই।

প্রিয়াঙ্কা ভয়ার্ত সুরে বলল, “তুমি ঠিক আছো তো? কোথায় ছিলে তুমি? এত দেরি করে তো কোনোদিন ফেরো না৷ ফোন কেন ধরোনি?” বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন তিনি।

তৌকির সাহেব বললেন, “একটা জটিল সমস্যায় ফেঁসে গিয়েছিলাম৷ তোমাকে ফিরে সব বলছি।”

“কখন ফিরবে?”

“ফিরছি, আমি রাস্তায়।”

“ড্রাইভার ফোন ধরেনি কেন?”

তৌকির সাহেব একটু আমতা আমতা করে বললেন, “ওকে নিষেধ করেছিলাম৷ তুমি চিন্তা করো না, আমি আসছি৷ এসেই সব বলব।”

প্রিয়াঙ্কা মেয়েকে নিয়ে একা ফ্ল্যাটে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছেন সেই কখন থেকে! রাতে খাওয়া হয়নি, মেয়েকে একটু খাইয়েছেন। তাকে অস্থির দেখে মেয়েও অস্থির হয়ে গেছে। এখন স্বামীর সাথে ফোনে কথা বলে একটু সুস্থির লাগছে। তৌকির সাহেব ফিরতে ফিরতে প্রিয়াঙ্কা তিন্নিকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন৷ কী আবোল তাবোল গল্প বললেন জানেন না৷ এক রাজার দুই রাণীর গল্প। একসময় নিজেরই অদ্ভুত লাগল। মেয়ে ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিচে গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। প্রিয়াঙ্কা দৌড়ে বারান্দায় গেলেন৷ হ্যাঁ তৌকিরের গাড়ি ঢুকছে।

*****

তৌকির সাহেবের কখনো নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না৷ যুবক বয়সে তিনি ছাত্র রাজনীতি করেছেন৷ রক্ত গরম করা বক্তৃতা দিয়েছেন৷ ছাত্র সংসদের ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন। কত বড় বড় লোকের সাথেও পরিচয় ছিল। শেষের দিকে বাম রাজনীতির দিকেও ঝুঁকেছিলেন। তবে তার লক্ষ্য থেকে তিনি বিচ্যুত হননি একটুও। আজকে তিনি যে অবস্থানে আছেন সেখানে আসতে যতটুকু চৌকস হতে হয়, যতটুকু যোগ্যতা থাকতে হয়, তার সবটাই তার ছিলো।

কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন না আজকে এখানে তিনি ঠিক কেন দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়েটা একটা স্পাই জেনেও তিনি কেন ওর জালে জড়িয়ে গেলেন আবার নতুন করে? ওর শরীর কি তবে এতই টানছে তাকে? এই মোহ ত্যাগ করা কি তার পক্ষে সম্ভব না? কিন্তু কেন? তার তো পরকীয়ার বাতিক কখনো ছিল না৷ নাকি ছিল? ষড়রিপুর ছয়টি রিপুই কি মানুষের মধ্যে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে রয়েছে? কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য। কোনটা নেই তার মাঝে? হয়তো সবকটাই আছে!

ভাবতে ভাবতে গাড়িটা বাড়িতে ঢুকল। এখনো তিনি বুঝে উঠতে পারেননি প্রিয়াঙ্কাকে ঠিক কী বলবেন।

লিফটের বাইরে পা দিয়ে বুকটা খানিকটা কেঁপে উঠল তার। দরজা খুলে প্রিয়াঙ্কা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি পা ঘষটে ঘষটে চললেন। মাথাটা কেমন করছে!

দরজার কাছে আসতেই প্রিয়াঙ্কার ঠান্ডা দৃষ্টি চোখে পড়ল। তার সাথে কোনো কথা না বলে সরে গেলেন তিনি। তাকে ভেতরে ঢুকতে দিলেন।

তৌকির সাহেব জামাকাপড় ছাড়লেন, গোসল করে নরম একটা জামা পরলেন। প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞেস করলেন, “খাবে?”

“উঃ! হ্যাঁ।”

প্রিয়াঙ্কা দু’জনের জন্য ভাত বাড়লেন। দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখের কোল বেয়ে। আগে তিনি না খেয়ে স্বামীর জন্য বসে থাকতেন। তৌকির ফিরলে দু’জন গল্প করতে করতে খেতেন৷ একটা সময় এলো যখন তৌকির তার খাওয়া না খাওয়ার খোঁজ নেয়া বন্ধ করে দিলেন৷ ফিরলে নিজের মতো খেয়ে তিন্নিকে নিয়ে খেলতে বসেন কিংবা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। জিজ্ঞেসও করেন না প্রিয়াঙ্কা খেয়েছেন কি না। শুরুর দিকে প্রিয়াঙ্কা রাগ করে না খেয়ে থাকতেন। কিছুদিন পর বুঝতে পারলেন বৃথাই নিজেকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ? নিজেকে নিজের আগে ভালোবাসতে হবে।

খাবার টেবিলে দু’জন চুপচাপ খেয়ে নিলেন। শোবার সময় তৌকির সাহেব প্রিয়াঙ্কাকে বললেন, “তুমি কি খুব রাগ করেছ? আসলে…”

প্রিয়াঙ্কা ঠান্ডা গলায় বললেন, “আমার রাগ করা না করায় কিছু যায় আসে না। সব বলেছে আমাকে আরিফ।”

বুকটা ধ্বক করে উঠল তৌকির সাহেবের। “ক…কী বলেছে?”

“এটাই যে বন্ধুদের সাথে বসে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে হুশ জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলে। হবেই তো এমন৷ তোমার এখন টাকা আছে, ক্ষমতা আছে, একটু আধটু মদ তো খাবেই।”

তৌকির সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। যাক আরিফ শেষ পর্যন্ত তাকে অনেকটা বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রিয়াঙ্কার পরের কথাটা তার বুকে গিয়ে বিঁধল।

“মদ ধরেছ, মেয়েমানুষ ধরোনি?”

তৌকির সাহেব ভীত চোখে চেয়ে দেখলেন প্রিয়াঙ্কার চোখ লাল। সে কি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছে নাকি রাগের মাথায় বলে ফেলেছে? ঠাহর করতে পারলেন না তিনি।

প্রিয়াঙ্কা বিছানা গুছিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তৌকির সাহেবও শুয়ে পড়লেন৷ প্রিয়াঙ্কার আশঙ্কা ছিল তার রাগ ভাঙাবার জন্য হয়তো তৌকির তাকে জড়িয়ে ধরতে আসবে। কিন্তু এলো না। প্রিয়াঙ্কা কিছুটা স্বস্তি পেলেন তাতে৷ আজ তৌকিরের ওপর সত্যিই ঘৃণা হচ্ছে! আবার একই কারনে তিনি যে কষ্টও পেলেন তা লুকিয়ে রাখলেন নিজের কাছেই।

******

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে বেশ বড় একটা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। আমেরিকা, চীন আর ভারতের তিনটি কোম্পানি সেখানে কাজ করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে৷ এখনো কেউ জানে না ঠিক কোন জায়গায় গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। সবগুলো দেশের প্রপোজাল বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকার সাথে কাজ করা হবে।

এদিকে বাংলাদেশের ওপর আমেরিকার প্রভাব ভারত বা চীন কেউই পছন্দ করবে না। তাই চারদিকে ব্যালেন্স করে চলার জন্য প্রোজেক্টের শুরুটা খুব গোপনে করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। গোপনেই এগিয়ে যাচ্ছিল সবটা।

খবরটা শুধু বাইরে লিক হলে যে সমস্যা তা নয়। দেশের ভেতরের রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়তে পারে তাতে। আমেরিকার সাথে কাজ করা মানে দেশে আমেরিকান ঘাঁটি স্থাপন করা। একটা বড় সংখ্যক জনতা আমেরিকার আধিপত্য মেনে নেবে না। অপজিশন পার্টি যদি এই ব্যাপারে কোনো গন্ধ পায় তাহলে খবর ছড়িয়ে দেবে, সরকার দেশের সম্পদ আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে।

সামনে নির্বাচন, ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এই ইস্যু নিয়ে। বিশেষ করে আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় যে হারে খবর আর খবরের সাথে সাথে ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুতের চেয়েও দ্রুতগতিতে তাতে ভয়ের যথেষ্ট কারন আছে। এত কোটি কোটি টাকার প্রোজেক্ট বাতিল হয়ে যেতে পারে জনগনের চাপে।

এসবই বসে বসে ভাবছিলেন তৌকির সাহেব। মনিকা কতটুকু জেনেছে? সে কোথায় খবর পাচার করছে? মনিকাকে সেদিন তিনি মাথা গরম করে কী বলে এসেছিল মনে নেই এখন আর। মেয়েটা তারপর আর ফোন করেনি। তিনিও করেননি। আরিফ কাজ করছে ওর ব্যাপারটা নিয়ে। তিনি আরিফকে কল করলেন।

আরিফ ফোন ধরে বললেন, “বল।”

“কতটুকু জানলি?”

“খুব বেশি না। মেয়েটা ওই ফ্ল্যাটে থাকে দুই বছর ধরে। সেখানেই আছে এখনো। তুই সেদিন বেরিয়ে আসার পর সে আর বের হয়নি বাসা থেকে। বাইরে থেকে বাজার সদাই, খাবার অর্ডার করেছে। ওর যে নাম্বার তোর কাছে আছে, মানে আমি ট্রেস করছি সেটা দিয়ে তুই ছাড়া আর কারো সাথে যোগাযোগ করা হয় না। নতুন সিম৷ রেজিস্ট্রেশন করা নেই।”

“ওহ।”

“ওর দিকে চব্বিশ ঘন্টা নজর আছে আমার। ওর আসল নাম্বার জোগাড় করার চেষ্টা করছি। পেয়ে গেলে আশা করি অনেক কিছুই জানা যাবে।”

“প্লিজ একটু চেষ্টা কর।”

“করছি।”

একটু পর একটা জরুরি মিটিং ডাকা হলে তৌকির সাহেব উপস্থিত হলেন সেখানে। মিটিংয়ে বসে ঘটনা শুনে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো। ভারত থেকে নতুন করে প্রপোজাল এসেছে। আগে তারা যেসব সুযোগ সুবিধা দিতে চেয়েছিল এখন দিচ্ছে তারচেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ওপরমহলে চাপ দেয়া হচ্ছে প্রোজেক্টটা তাদের দেবার জন্য।

অত্যন্ত গোপনীয় এই প্রোজেক্টের খবর কোনোভাবে বেরিয়ে গেছে। পৌঁছে গেছে দিল্লির কান পর্যন্ত। আরও কতদূর গেছে কে জানে! ব্যাপারটার সুরাহা না হলে যারা এখন প্রোজেক্টে আছে সবাইকে বাতিল করে দিয়ে নতুন করে কাজ শুরু হবে। সাথে তদন্ত কমিটি গঠন হবে কেমন করে গোপন তথ্য বেরিয়ে গেল, আর ঠিক কতটুকু বেরিয়েছে। প্রোজেক্টের কাজ আপাতত স্থগিত করা হয়েছে পরবর্তী সিদ্ধান্তের আগ পর্যন্ত।

তৌকির সাহেব নিজের রুমে ফিরে এসে ধপ করে বসে পড়লেন৷ শেষ পর্যন্ত তিনিই এই বিশ্বাসঘাতকতাটা করলেন। তাহলে কী লাভ হলো সারাজীবন সৎ থেকে?

*****

সেদিন বাড়ি ফিরে তৌকির সাহেবের ব্লাড প্রেশার বেড়ে অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। কেবল ছটফট করতে লাগলেন। আরিফ খবর শুনে দেখতে এলেন তাকে। তার অবস্থা দেখে তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বললেন, “তুই চিন্তা করিস না৷ সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তৌকির সাহেব তাকে খুলে বললেন সবটা৷ আরিফ শুনে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে তিনি বললেন, “তুই নিজেকে সামলে নে। অনেক কাজ আছে৷ ঠিকমতো করতে পারলে বড় কিছু হবার আগেই সামলে নেয়া যাবে। আমার মনে হয় না জল বেশিদূর গড়িয়েছে।”

“মানে?”

“মানে তুই রাতটা শান্তিমতো ঘুম দে। সকালে আমি আবার আসব। তখন বিস্তারিত বলব।”

“ঠিক আছে।”

“নিজেকে শক্ত কর। যেই কূয়োয় তুই পড়েছিস সেটা থেকে তোকে টেনে তোলার ক্ষমতা কারো নেই। নিজেরই নিজেকে টানতে হবে। সেজন্য সুস্থ হয়ে ওঠা চাই।”

“হুম।”

“আর শোন, এর মাঝে মেয়েটার ফোন আসলে ধরে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলবি।”

“আচ্ছা।”

আরিফ চলে গেলেন। তিনি যাবার আধঘন্টার মধ্যেই মনিকার কল এলো। মনিকার নাম্বার তৌকির সাহেব মোবাইলে ‘জুনিয়র অফিসার মৌ’ লিখে সেভ করে রেখেছিলেন৷ মোবাইলটা দূরে ছিল৷ ঘুমের ঔষধ খাওয়ায় তৌকির সাহেবের চোখ লেগে আসছিল। প্রিয়াঙ্কা দেখলেন কল আসছে তৌকিরের মোবাইলে। সাইলেন্ট করা ছিল ফোনটা। অফিসের কাউকে জানানো উচিত ভেবে কলটা ধরলেন তিনি।

“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। আমি তৌকির আহমেদের ওয়াইফ বলছি। উনি একটু অসুস্থ বলে এখন কথা বলতে পারছেন না।”

ওপাশে মনিকা অবাক হয়ে গেল কথাগুলো শুনে। সে কোনোমতে বলল, “ঠিক আছে।” তারপর কল কেটে দিল।

প্রিয়াঙ্কা একটু অবাক হলেন৷ কী হয়েছে তাও জিজ্ঞেস করল না৷ অদ্ভুত তো!

মনিকার মাথায় তখন অন্য প্ল্যান ঘুরছে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু