মৌমোহিনী পর্ব-১১

0
9

#মৌমোহিনী
পর্ব-১১

কেয়ারটেকারের কাছ থেকে ফারহান রুশদির ফোন নাম্বার নিতে গিয়ে আরিফ লক্ষ্য করলেন তার মোবাইলে অজস্র মিসড কল ভাসছে। তার মধ্যে কয়েকটা অফিসের হলেও বাকি সবগুলো এসেছে তৌকিরের নাম্বার থেকে। মোট একশো আটটা মিসড কল!

এই বাড়িতে ঢোকার আগে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলেন আরিফ। এই কয়েক ঘন্টার মাঝে এমন কী হয়ে গেল? মনিকার ব্যাপারটা নিয়ে কি কিছু? তৌকিরও কি জড়িয়ে গেল এসবে?

এদিকে তার অনেক কাজ। স্থানীয় পুলিশ দিয়ে বাড়িটাকে সিল করতে হবে, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ডিএনএসহ যাবতীয় এভিডেন্স যাতে কালেক্ট হয় ঠিকমতো সেই ব্যবস্থা করতে হবে৷ একটুও দেরি হলে কোথায় কী গড়বড় হয়ে যায় তার ঠিক নেই।

তবুও তিনি দ্রুত কল করলেন তৌকির সাহেবকে। তৌকির সাহেব ফোন ধরে প্রায় কেঁদে ফেললেন, “আরিফ তুই কোথায়? তোকে আমি কখন থেকে…” কথা আটকে গেল তার৷

আরিফ হকচকিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হইছে তোর? কী সমস্যা?”

“প্রিয়াঙ্কা… প্রিয়াঙ্কা…”

“প্রিয়াঙ্কা কী?”

“চলে গেছে।”

“কোথায় চলে গেছে?”

“জানি না।”

“জানি না মানে?”

“জানি না।”

“কী হয়েছে সেটা ভালোমতো বল।”

“কাল রাতে ওই শয়তান মেয়ে আমাদের যত ক্লোজ ছবি ছিল সব প্রিয়াঙ্কার মোবাইলে পাঠিয়ে দিয়েছে। সব… যত রকমের ছবি… তুই জানিস না কী ভয়ানক ছবিগুলো… আমি যে কেন তুলেছিলাম…”

“তারপর? তারপর কী হয়েছে?”

“প্রিয়াঙ্কা অনেক কাঁদল। সারারাত কাঁদল দরজা বন্ধ করে। তারপর…”

“তুই পুরোটা বলবি নাকি ছাগলের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে থাকবি?”

“আমি শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে গেছিলাম। বৃষ্টিও থেমে গিয়েছিল। ভোরে উঠে দেখি ও বাসায় নাই। তিন্নিও নাই…”

“কোথায় গেছে?”

“জানি না।”

“আরে ব্যাটা ওর বাপের বাড়িতে খোঁজ নে। বন্ধুবান্ধবের কাছে ফোন কর। আমি এক জায়গায় ফেঁসে আছি, আমি কেমনে ওর খবর জানব?”

“ও কোথাও যায় নাই। সব জায়গায় খোঁজ নেয়া শেষ৷ সব জায়গায় ফোন করা শেষ…”

“আচ্ছা তুই শান্ত হ। আমি দেখছি।”

“আমি থানায় যাব ভাবছি। তুই থাকলে…”

“আগেই যাস না৷ আমি খুঁজে দেখি।”

“তুই আমার বাসায় আয়…”

“আমি মুন্সিগঞ্জ৷ রওনা দিচ্ছি কাজ সেরে। তুই চিন্তা করিস না এত। তিন্নিকে যখন নিয়ে গেছে তখন ওরা সেফই আছে আশা করি। আমি এসে দেখছি।”

“আচ্ছা। তাড়াতাড়ি আয় প্লিজ। আমার আর কেউ নাই…”

আরিফ বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিলেন৷ তৌকির কাঁদছে৷ ওর সমস্যাটা কী? ওই মেয়ের সাথে জড়িয়ে বোধহয় ওর পার্সোনালিটির পার্মানেন্ট ড্যামেজ হয়ে গেছে।

আরিফ এবার দারোয়ানকে ভালোমতো বুঝিয়ে দিলেন যেন সে এখান থেকে একচুলও না নড়ে আর কাউকে ঢুকতে না দেয়৷ তারপর রওনা দিলেন থানার দিকে। থানায় গিয়ে পুলিশ ফোর্স নিয়ে বাড়িতে এলেন৷ তিনি এই জায়গার খোঁজ কিভাবে পেয়েছেন এসব খোলাখুলি বললেন না৷ তবে তার পরিচয়ের জোরে পুলিশ বাড়ি তল্লাশি, প্রমাণ সংগ্রহ আর বাড়িটা সিল করার ব্যবস্থা করল।

আরিফ তারপর বেরিয়ে পড়লেন ঢাকার দিকে। তার প্রচন্ড চিন্তা হচ্ছে। মৃ ত মনিকা চাইতে জীবিত প্রিয়াঙ্কা আর তিন্নি অনেক বেশি ইম্পর্টেন্ট।

গাড়ি চালাতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর তার মনে হতে লাগল এতখানি রাস্তা তিনি গাড়ি চালিয়ে যেতে পারবেন না। মাথাটা ঘুরছে। সারারাত চিন্তা আর উত্তেজনায় কাটিয়ে সকাল থেকে এতকিছুর চাপ সামলে এখন শরীরটা অসাড় হয়ে আসছে। কিন্তু কেন? এরচেয়ে অনেক বেশি চাপ তিনি সহ্য করে অভ্যস্ত৷ আজ এত ক্লান্ত লাগছে কেন? এত অস্থির লাগছে কেন?

কিছু খাওয়া দরকার৷ দুপুর পার হয়ে গেছে৷ কিছু খেয়ে এক কাপ চা আর একটা সিগারেট খেলে মাথাটা পরিষ্কার হবে। ভাববার সুযোগও পাওয়া যাবে। তিনি রাস্তার পাশে একটা খাবারের হোটেল খুঁজে গাড়ি দাঁড় করালেন৷

খাবারের অর্ডার দিয়ে মনিকার মোবাইলটা বের করলেন৷ ভিডিওটা ছাড়া আর কিছু দেখা হয়নি। এতে নিশ্চয়ই আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাওয়া যাবে।

কললিস্টে গিয়ে ফারহান রুশদিসহ আরো বহু মানুষের নাম্বার পাওয়া গেল। মেসেজ অপশনে রুশদির সাথে নোংরা সব মেসেজ চালাচালি চোখে পড়ল। রুশদি যেহেতু ওর সাথে কথা বলত, তাহলে মোবাইলটা সে খুঁজল না কেন? অদ্ভুত তো! ভিডিও না থাকলেও মোবাইলটা ঘাটলেও তার এই ঘটনার সাথে সংযুক্তি প্রমাণ হয়ে যেত।

আচ্ছা লোকটা কি নার্ভাস ছিল? ডেস্পারেট ছিল? নইলে এই সময়ে এরকম ব্লান্ডার একটা বুদ্ধিমান মানুষের কখনোই করার কথা না। তবে এই লোক যেহেতু নিজে মনিকাকে হ ত্যা করেনি, মনিকা নিজেই নিজেকে শেষ করেছে, তাই সে বেঁচেও যেতে পারে। ভালো উকিল ধরতে পারলে বেঁচেই যাবে হয়তো। তাছাড়া এদের অঢেল টাকা। টাকার জোর তো আছেই। তাকে ফাঁসাতে আরো জোরালো প্রমাণ দরকার। চিঠিটা গুরুত্বপূর্ণ। তবুও মনে হচ্ছে আরো কিছু পেলে ভালো হতো।

গ্যালারিতে অনেক ছবি আছে। তৌকিরের সাথে ছবি, অন্য কয়েকটা লোকের সাথেও ছবি আছে। তবে রুশদির সাথে নেই। এত বুদ্ধিমান লোক শেষে কি বোকার মতো একটা মেয়ের জন্য ফেঁসে যাবে? এই পর্যায়ে এসে আরিফের মনে হলো লোকটা হয়তো খু ন করতে আসেনি৷ মনিকা ওভারথিঙ্কিং করছিল। হয়তো এমনি রাত কাটাতে এসেছিল। কিন্তু তাহলে ঝড়ের রাতে কেন? আর লা শ টা লুকালো কেন? সম্মানের ভয়ে? নাকি ফেঁসে যাবার ভয়ে? হিসেবে কোথাও গন্ডগোল হচ্ছে।

হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে দেখা গেল প্রিয়াঙ্কার নাম্বারে অনেকগুলো ছবি গেছে। বলা বাহুল্য, ছবিগুলো মনিকা আর তোকিরের অন্তরঙ্গ ছবি।

টেবিলে খাবার সার্ভ করা হলো। কিন্তু আরিফের খিদে মরে গেছে। ছবিগুলো দেখে বমি চলে আসছে তার। প্রিয়াঙ্কা কী ভয়ানক ধাক্কা খেয়েছে তা আন্দাজ করতে পারলেন না তিনি। শুধু মনে হতে লাগল সব এলোমেলো হয়ে গেছে৷ সব চুরমার হয়ে গেছে।

প্রিয়াঙ্কাকে ছবি কেন পাঠাল মনিকা? এই করে কি সে তৌকিরকে শাস্তি দিতে চেয়েছে? নাকি প্রিয়াঙ্কাকেই? নাকি ভেবেছে এটা করলে প্রিয়াঙ্কা বেঁচে যাবে একটা ভুল সম্পর্ক থেকে?

নিজের নাম্বার থেকে প্রিয়াঙ্কাকে বার কয়েক ফোন করেও রিচ করতে পারেননি তিনি। খুব সম্ভবত প্রিয়াঙ্কা তার নাম্বার ব্লক করে দিয়েছে। আর তৌকিরেরটাও ব্লক করেছে। তিনি এবার মনিকার মোবাইল থেকে কল করলেন প্রিয়াঙ্কাকে। কল ঢুকলেও রিসিভ হলো না৷

ফারহান রুশদির নাম্বার যেটা কেয়ারটেকারের থেকে পাওয়া গেছে সেটা তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অফিসে। এবার মনিকার মোবাইল থেকে পাওয়া নাম্বারটা পাঠালেন। ফোনের লোকেশন ট্রেস করে জানতে হবে লোকটা কোথায় আছে।

খেয়েদেয়ে সিগারেট হাতে গাড়িতে বসতেই অফিস থেকে কল এলো। রুশদির দুটো নাম্বারেরই বর্তমান লোকেশন গুলশান। ওর বাড়িও ওখানেই। সম্ভবত যা করার করে নিয়ে এখন বাড়িতে গিয়ে লম্বা ঘুম দিচ্ছে। রাগে আরিফের ইচ্ছে করছে ওর গ লা চেপে ধরতে।

ঢাকায় ঢোকার পরপরই তিনি আবার মনিকার নাম্বার থেকে ফোন করলেন প্রিয়াঙ্কাকে৷ কয়েকবার রিং হলো। তারপর ওপাশ থেকে শোনা গেল,

“হ্যালো।”

“কোথায় তুমি?”

এই নাম্বার থেকে যাওয়া কলে আরিফের গলা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন প্রিয়াঙ্কা।

“আরিফ! তুমি!”

“হ্যাঁ। কোথায় তুমি?”

প্রিয়াঙ্কার সব কৌতুহল যেন উধাও হয়ে গেল হঠাৎ করেই। বললেন,

“বেঁচে আছি।”

“কোথায় আছো সেটা বলো।”

“জানতে হবে না। তোমার ভাইকে বলতেও হবে না যে আমি তোমার কল ধরেছি।”

আরিফ তাকে বোঝানোর ধারকাছ দিয়েও গেলেন না। নাম্বারটা অফিসে পাঠিয়ে দিলে লোকেশন ট্র্যাক করার জন্য।

সেখান থেকে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলেন তিনি। ফারহান রুশদির মোবাইলের লোকেশন কাল রাতের পুরোটা সময়ে একই জায়গায় ছিল। কাল বিকেল থেকেই নাম্বারদুটো গুলশান থেকে নড়েনি। তার মানে লোকটা মোবাইল বাড়িতেই ফেলে এসেছে। লোকটার বুদ্ধিশুদ্ধি মোটেও লোপ পায়নি। কিন্তু তবুও হিসেব মিলছে না…

প্রিয়াঙ্কার লোকেশন ট্রেস করে বের করার প্রয়োজন হলো না৷ সে নিজেই কল করল একটু পর। ওপাশ থেকে কাঠ কাঠ গলা শোনা গেল।

“ঠিকানা দিচ্ছি, চলে এসো। তবে কাউকে বলবে না।”

আরিফ সেদিকে গাড়ি ঘোরালেন।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু