#মৌমোহিনী
পর্ব-১৪
“I lost my mind when you left me
And I didn’t have much of that
But you were so quick to reject me
So I’ll take my time being sad
I fell so hard, I’ll admit it
The feeling wasn’t mutual
So I’m back to live on my lonely
In the city of El Paso…”
গানটা বেজে চলেছে উইন্ডশিল্ডে আছড়ে পড়া বৃষ্টিধারার সাথে তাল মিলিয়ে। অন্য সময় হলে কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতেন আরিফ। দুঃখের গানগুলো তার আজীবনকার সঙ্গী। জীবনটাকে তিনি যতটা পারেন সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দিয়েছেন। সবাই দেখলে ভাবে একটা মানুষ কত গোছানো হতে পারে, কতটা রুচিশীল হতে পারে! এদের কেউই সত্যিকারের মানুষটাকে বুঝতে চেষ্টা করে না, কেবল বাইরেটা দেখে মন্তব্য ঝেড়ে দেয়।
তবে এখন তার মাথায় এসব কিছুই কাজ করছে না৷ তিনি ফিরছেন অফিসে৷ একগাদা কাজ পড়ে আছে। সব বাদ দিয়ে তিনি বসেছিলেন মনিকার কেসটা নিয়ে। ওটা যদিও মাথা থেকে সরানো সম্ভব না, কিন্তু অফিসের কাজ করতেই হবে, নইলে চাকরিটা হয়তো বাঁচানো যাবে না। পরে দেখা যাবে মরিচীকার পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি।
তবুও ঘুরেফিরে মনিকার ব্যাপারটাই মাথায় আসছে। রুশদির সাথে তিনি পেরে উঠবেন না কিছুতেই। ক্ষমতায় তো নয়ই, এখন মনে হচ্ছে বুদ্ধিতেও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। রুশদি ওদিকে একটার পর একটা চাল চেলে বাজিমাত করে যাচ্ছেন। এদিকে তিনি যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন৷ হাতে এত বড় বড় এভিডেন্স থাকার পরেও কিছুই করা যাচ্ছে না। মাছটা পিছলে যাচ্ছে বারংবার৷ কিন্তু তিনি নিজেও হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নন৷ এর শেষ না দেখা পর্যন্ত তার শান্তি হবে না।
এখন শুধু মনিকার লা শ টা খুঁজে বের করা বাকি। কোথায় থাকতে পারে সেটা? এত বড় শহরে একটা লাশ লুকানো কতটা কঠিন বা কতটা সহজ? খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতো কি? একদিন না একদিন তো সেটা বের হবেই৷ কিন্তু সেই দিনের কথা ভেবে কি রিস্ক নেবে রুশদি? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ আগাথা ক্রিস্টির একটা গল্প মনে পড়ে গেল, এবিসি মার্ডার্স! এরকুল পোয়ারোর সেই উক্তি, খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার চেয়েও বেশি কঠিন অনেকগুলো সূঁচের ভেতর থেকে একটা নির্দিষ্ট সূঁচ খুঁজে বের করা৷ একটা লা শ লুকানোর সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো অনেকগুলো লা শের মধ্যে লুকিয়ে ফেলা। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব তা কিছুতেই মাথায় এলো না তার৷ কেবল তিনি তার সোর্সকে খুঁজতে বললেন এই কয়েকদিনে ঘটা এমন কোনো ঘটনা যেখানে একাধিক মানুষ মা রা গেছে।
ঢাকায় ঢোকার পর এতক্ষণে তার মনে পড়ল তৌকির একবার তাকে ফোন করে কিসের যেন অসুস্থতার কথা বলছিলেন৷ তার তখন ওই অচেনা মেয়েটার লা শ দেখার পর মন খুবই বিক্ষিপ্ত ছিল বলে তখন ওর কথা মাথায় ঢোকেনি৷ গাড়িটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে তিনি ফোন করলেন তৌকির সাহেবকে। তৌকির ফোন ধরলেন না৷ তিনি বার কয়েক চেষ্টা করলেন, কাজ হলো না। তৌকিরের বাসায় দুটো কাজের লোক আছে। তিনি বাসার ল্যনলাইনে ফোন করলেন৷ তবুও কেউ ধরল না। অদ্ভুত তো!
তিনি তৌকির সাহেবের বাসার দিকে গাড়ি ছোটালেন। মনটা কেমন খচখচ করছে।
তৌকিরের ফ্ল্যাটের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেকবার কলিংবেল বাজানোর পরেও কেউ দরজা খুলছে না দেখে আরিফ ভয় পেয়ে গেলেন৷ দরজার লক ভেঙে ভেতরে ঢোকার কথাটা তার মাথায় এলো এতক্ষণে৷
******
হিশাম মাহমুদ চৌধুরী আজ বাড়ি থেকে বের হননি। তার শরীর, মন কিছুই ভালো নেই। সবচেয়ে বড় কথা কুলাঙ্গার মেয়ের জামাইয়ের চেহারাটা তার দেখতে ইচ্ছে করছে না। ওর কথা ভাবলেও রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে।
তিনি মোবাইল বন্ধ করে চুপচাপ সারাদিন বসেছিলেন রকিং চেয়ারে। তেমন কিছু খেতেও পারেননি। বিকেলের দিকে কাজের চিন্তা তার মাথায় ভর করল। না, এভাবে বসে থেকে তার মতো মানুষের জীবন চলবে না। সবচেয়ে বড় কথা, তার কাজের সাথে শুধু তার না আরও অজস্র মানুষের জীবন জড়িত আছে৷ এমন কাজে থেকে দুঃখবিলাস তো মানায়ই না।
তিনি মোবাইল অন করলেন। আজকের কাজকর্ম যতটুকু পারা যায় মোবাইলে সেরে নিয়ে কাল অফিসে গিয়ে পুরোদমে লেগে পড়তে হবে। নির্বাচন এগিয়ে আসছে রকেটের গতিতে।
মোবাইল অন করতেই অজস্র নোটিফিকেশন এসে ভরে গেল। তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু লোকের সাথে কথা সেরে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলেন। আজকাল ফেসবুক দেখলে বোঝা যায় জনতার মন কোনদিকে ঘুরছে। আগে অভ্যাস না থাকলেও ইদানীং তিনি সোশ্যাল মিডিয়াকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং এদিক দিয়েও ইমেজ বিল্ডিংয়ের চেষ্টা করছেন৷ এই ব্যাপারে অবশ্য তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে রুশদি। তিনি বুঝলেন, রুশদি আসলে তার ডান হাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওকে কেটে ফেললে তিনি নিজে অচল হয়ে পড়বেন।
ফেসবুকে ঢুকে তার চোখ কপালে ওঠার জোগাড় হলো। সবটা জুড়ে রুশদির গুনগান চলছে। কেন এই অবস্থা সেটা বুঝতে তার কিছুটা সময় লাগলেও কিছুক্ষণের মধ্যে পুরোটা জানা হয়ে গেল তার। কিছুদিন আগে একটা পডকাস্টে গিয়েছিল রুশদি। অনেকদিন ধরেই এটা নিয়ে কাজ করছিল সে। কী বলবে কিভাবে বলবে সেসব নিয়ে বেশ চর্চা করছিল। যার শো-তে যাবে তার সাথে বার দুয়েক রিহার্সালও করে নিয়েছিল। রেকর্ডিং শেষে এসে বলেছিল এটা সেদিন রিলিজ হবে সেদিন ফাটাফাটি ব্যাপার হবে। হয়েছেও তাই৷
ওর কথার বিভিন্ন অংশ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে আলোড়িত করেছে। যেমন তরুণ প্রজন্মের জন্য পড়াশুনার পাশাপাশি পার্ট টাইম চাকরি, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা, বিভিন্ন দিকে স্কিল ডেভেলপমেন্টের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনার পাশাপাশি এসব সেক্টরে ভালো পরিমাণে ইনভেস্ট করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে কথাগুলো সে টিপিক্যাল রাজনীতিবিদের মতো না বলে এমনভাবে বলেছে যেন সে তাদের আপন বড় ভাই। তাদের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য পারলে জান দিয়ে দেবে। ওর কথায় হিশাম সাহেবের নিজেরই গলে যেতে ইচ্ছে হয়, তরুণেরা তো একেবারেই নবীন।
তবে ওর সবচেয়ে বেশি ভাইরাল হওয়া ক্লিপটা হচ্ছে সম্পর্ক নিয়ে বলা কথাগুলো। নারী পুরুষের সম্পর্ক, সেটা প্রেমিক প্রেমিকা হোক, বা স্বামী স্ত্রী, সেখানে বিশ্বাস কতটা জরুরি, বন্ধুত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো নিয়ে বেশ গুছিয়ে বলেছে। তবে রিলসে সবচেয়ে ভাইরাল হওয়া অংশটা হচ্ছে হাসতে হাসতে বলা কয়েকটা লাইন,
“ওয়াইফের সাথে ঝগড়া হলে আমি কোণ আইসক্রিম নিয়ে আসি৷ সে না খেয়ে থাকতে পারে না। আইসক্রিম মুখে দিয়ে মাথা একটু ঠান্ডা হয়ে এলে আমি গিয়ে ভাগ বসাই। এক আইসক্রিম ভাগ করে খেলে রাগ পড়ে যায়, ভালোবাসা বাড়ে। ট্রাই করে দেখতে পারেন। অব্যর্থ ট্রিকস।”
হিশাম সাহেব বুঝতে পারলেন না এরকম পলকা একটা কথা ইয়াং জেনারেশন পাগলের মতো কেন শেয়ার করছে৷ তখন তার মনে হলো, তিনি বুড়ো হয়ে গেছেন৷ তরুণদের পালস তার পক্ষে ধরা সম্ভব না। রুশদি যে তার জন্য কত জরুরি সেটা আরেকবার প্রমাণ করে দিল সে নিজেই।
******
বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি বড় প্রিয় নাঈশার। বাপের বাড়িতে থাকতে শৌখিন বৃষ্টিবিলাস তার জীবনের অন্যতম একটা অংশ ছিল। তাদের তিনতলা বাড়ির টেরেসটা পুরোটা সাজানো ছিল বাগানবিলাসে। অন্য কোনো গাছ নয়, কেবল নানা রঙের নানা জাতের বাগানবিলাসে ছাদ ভর্তি। সবটাই নাঈশার পছন্দের। একটা সময় ছিল যখন তার ইচ্ছে হওয়ামাত্র সবটা হয়ে যেত। নাঈশার মনে হতো তার বাবা তার জন্য রাতকে দিনও করে দিতে পারে। বৃষ্টির দিনগুলোতে তার টেরেসটা বড় বেশি মনে পড়ে। তবে যখন তখন ছুটে চলে যাওয়া যায় না চাইলেই। যেতে যে কোনো বাঁধা আছে তা নয়, কেন যে যেতে পারে না বোঝে না নাঈশা৷ সে ফারহানকে পছন্দ করে বিয়ে করার পরপর বাবার সাথে একটা অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হয়েছে তার। এই দূরত্ব বাবার পক্ষ থেকে তৈরি হয়েছে নাকি তার নিজের পক্ষ থেকে সে জানে না। হয়তো দু’জনের দিক থেকেই হয়েছে।
“যত বড় বাবার মেয়েই হও না কেন, দিনশেষে একটা সময় উপলব্ধি করবে তুমি একা।”- কথাটা তাকে বলেছিল তার এক বান্ধবী দিশা। দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পপতিদের একজনের মেয়ে সে৷ বাবার ব্যবসায়ীক বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছিল তার। বিয়ের কিছুদিন পরেই দিশা ফিরে গিয়েছিল বাবার বাড়ি, মানিয়ে নিতে পারেনি৷ কিন্তু বাবা তার সম্মান আর বিজনেসের খাতিরে মেয়েকে আবার তুলে দিয়ে এসেছে জামাইয়ের হাতে। নাঈশার হয়তো ভয় হয় তার বাবাও এমন করবে। ফারহান আগে কিছুই ছিল না, কিন্তু এখন তার বাবার দলের অন্যতম অংশ। তাকে ছাড়া বাবার চলবে না।
যদি নাঈশার সাথেও তার বাবা দিশার মতো কিছু করে তবে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। তারচেয়ে নিজে থেকেই ফারহানের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে সে। অন্তত বাবাকে সে স্বার্থপর রূপে দেখতে চায় না৷ সে এখনো কল্পনা করতে ভালোবাসে, ঠিক আগের মতো বাবা তার জন্য প্রিন্সেসের আসন খালি করে বসে আছেন। সে ছুটে গেলেই জড়িয়ে নেবেন তাকে।
নাঈশার দিন দিন মনে হয় সে কোনো ঘোরের মাঝে চলে যাচ্ছে, কোনো কল্পনার জগতে বাস করছে, যেখানে সে একা, আর কেউ নেই। আজ সকালেই চিঠিটা পেয়েছে সে। মেইল আইডিটা সে নিজেই একদিন ফেসবুকে শেয়ার করেছিল তার সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম হিসেবে। অনেকেই মেইল পাঠায় বিভিন্ন কারনে। তবে আজকে যেটা দেখেছে সেটার ঘোর থেকে সে কিছুতেই বেরুতে পারছে না। ওরা পড়ে প্রচন্ডভাবে বিষ্ফোরিত হবার কথা ছিল তার, কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, সে স্বাভাবিক আছে। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করেছে। বিকেলের চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখেছে। ভেতরের তোলপাড়, ভেঙেচুরে আসা অস্তিত্ব কেন যেন বাইরে প্রকাশ হচ্ছে না। কই আগে তো এমন হয়নি। এতদিন ছোটো ছোটো বিষয়ে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছে সে।
চিঠির প্রতিটা শব্দ তার মাথায় ঘুরছে। ফুটন্ত পানিতে বুদবুদের মতো একেকটা শব্দ ভেসে উঠছে, আবার নেমে যাচ্ছে। নাঈশা দুই হাতে মাথা চেপে ধরল। মাথা ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়।
“অপ্রিয় নাঈশা,
আপনি যখন এই চিঠিটা পাবেন তখন হয়তো আমি আর পৃথিবীতে থাকব না। আপনি জানেন না আপনি কতটা সৌভাগ্যবতী। পৃথিবীতে কিছু মানুষ না চাইতেই এমন মূল্যবান কিছু পেয়ে যায় যে সে জিনিসটার মূল্য কোনোদিন বুঝতে পারে না। আপনি তেমনি একজন। আপনি জগতের সামনে চেঁচিয়ে বলতে পারেন আপনি ফারহান রুশদির স্ত্রী। আমি তা পারি না। আপনি জানেন না এটুকু বলতে পারা কারো আজন্মের স্বপ্ন হতে পারে। না, আমি তাকে ফেসবুকে ফলো করা হাজারো মেয়েদের একজন না৷ আমি তাকে পেয়েও না পাওয়া একজন। আমি তাকে শারীরিকভাবে পেয়েছি, তার মনটাও হয়তো ছুঁয়ে দিতে পেরেছি দুয়েকবার। কিন্তু তার জীবনে আমার কোনো জায়গা নেই। আমি জানি সে আমার হবে না৷ আমি জানি আমি বাজারের মেয়ে। তবে আমার ভালোবাসা সত্য।
আপনি চিঠি পড়ে হাসতে পারেন, ভাবতে পারেন এমন মেয়েরা কেমন করে ভালোবাসতে পারে? জানি না বিশ্বাস করবেন কি না, কিন্তু আমি তাকে আপনার থেকেও বেশি ভালোবাসি৷ আমি ভালোবাসায় অন্ধ বলেই সে আমাকে বারবার ব্যবহার করে। তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আজ রাতে সে আমাকে মে রেও ফেলবে জানেন? তার চোখ দেখেই আমি সেটা পড়ে ফেলেছি৷ সে এই মুহূর্তে আমার সাথেই আছে। পাশে নেই, ওয়াশরুমে গেছে। অনেকক্ষণ ওয়াশরুমে কাটায় সে, এই সুযোগেই লিখছি। পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে খুব। আমাকে মা রার পর সে সব ধুয়েমুছে সাফ করবে। ভাবলে কেমন একটা লাগছে!
তার মধ্যে এমন পুরুষত্ব আর সম্মোহনী শক্তি আছে যে পৃথিবীর তাবৎ নারীকে সে আঙুলের ইশারায় নাচাতে পারবে। সে হাসলে, কথা বললে, আদর করলে আমার এত পাগল পাগল লাগে! ইচ্ছে হয় নিজ হাতে প্রাণটা তাকে তুলে দিয়ে দিতে।
আপনাকে আমি কেন চিঠি লিখছি সেটা জানি না। হয়তো আমি যে যন্ত্রণায় পুড়েছি সেই যন্ত্রণার আগুনে আপনাকেও পোড়াতে চাই বলে। আগুনটা আরেকটু উষ্কে দেই কেমন? আপনার স্বামী আগেও এক মেয়েকে খু ন করেছে। মেয়েটা সন্তানসম্ভবা ছিল। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি নিজেও সন্তানসম্ভবা। তাকে বলেছি কথাটা৷ সে ভীষণ খুশি হবার ভান করেছে। আমায় জড়িয়ে ধরেছে, চুমু খেয়েছে গভীরভাবে। বলেছে বাচ্চাটার ভবিষ্যত নাকি অসম্ভব সুন্দর হবে।
খুব খারাপ লাগছে পড়তে, তাই না? ভাববেন না, আমাদের বাচ্চাকে স্বীকৃতি না দিলেও আপনার গর্ভের সন্তানকে কিন্তু সে পাগলের মতো ভালোবাসবে। তবে সেই সুযোগ সে পাবে কি না তা জানি না।
ভালো থাকবেন। আর তারচেয়েও জরুরি কথা হলো, বেঁচে থাকবেন৷ আমার মতো ভালোবাসায় আত্মহুতি দেবেন না।
ইতি
মোহিনী (এটা আমার অসংখ্য নামের মধ্যে একটা প্রিয় নাম)”
নাঈশা উঠে দাঁড়াল। আর পারছে না সে৷ বেসিন পর্যন্ত যেতে পারল না, বমি করে ফেলল। শরীর প্রচন্ড দুর্বল লাগছে। হাত পা কাঁপছে। পুরো পৃথিবীটা ঘুরছে। সে ধপ করে বসে পড়ল মেঝেতে। কে যেন দৌড়ে এসে তাকে ধরল। তুলে শুইয়ে দিল বিছানায়। তার চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একটু আগে সে রুশদির পডকাস্ট দেখছিল। সে রাগ করলে নাকি রুশদি আইসক্রিম নিয়ে আসে। কিন্তু এমন তো কোনদিন তাদের জীবনে ঘটেনি। তাহলে সে কেন বলল? নাঈশা রাগ হলে তো সে কথার জাল বিছিয়ে দেয়৷ কিভাবে যেন তাকে জালে ফেলে, তারপর আস্তে আস্তে জালটা গুটিয়ে নেয়। নাঈশার আবার বমি পাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা একটা করে মৌমাছি ছুটে ছুটে এসে ঘিরে ধরছে তাতে। কানের সামনে একনাগাড়ে গুনগুন গুনগুন করেই চলেছে। এর মধ্যেই সে শুনল তার ফোন বাজছে।
এক গৃহকর্মীর গলা শোনা গেল, “আপনার বাবা ফোন করছে ম্যাডাম।”
“কথা বলব। দাও।”
ফোনটা তার কানে ধরল মেয়েটা৷
“হ্যালো বাবা!”
“কী হয়েছে তোমার মা?”
“আমাকে তুমি নিয়ে যাও বাবা, আমি এখানে থাকলে ম রে যাব।”
*******
তৌকির সাহেবকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আরিফ তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখেছেন তিনি ফ্লোরে পড়ে আছেন, মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়ে অবস্থা খারাপ। ডাক্তাররা জানিয়েছেন আরেকটু দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যেত। এখন রিকভারি সম্ভব, তবে রিস্ক রয়েই গেছে। আরিফের নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। তখন তৌকিরের কথায় গুরুত্ব দিয়ে সরাসরি ওর বাড়িতে গেলে বা অন্য কাউকে পাঠিয়ে ওকে হাসপাতালে নিতে পারলে এই অঘটন ঘটত না। কিন্তু চোর পালানোর পর বুদ্ধি বেড়ে কী লাভ?
আরিফ তখন থেকে প্রিয়াঙ্কার নাম্বারে কল করে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু পারছেন না৷ প্রিয়াঙ্কার বাপের বাড়িতে অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন৷ যদি তাদের মারফত প্রিয়াঙ্কা জানতে পারে তো ভালো৷ জানলে নিশ্চয়ই আসবে৷
আরিফের খুব অপরাধবোধ হচ্ছে। সবদিক থেকেই নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। কেন মনে হচ্ছে তিনি নিজেও জানেন না৷ সবটা চোখের সামনে থাকলেও তিনি কোনোদিকই সামাল দিতে পারেননি, এটাই বুঝি তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
ফোনকলের শব্দে চিন্তার সুতো কেটে গেল তার। স্ক্রিনে ভেসে উঠল সোর্সের নামটা।
“বল।”
“একটা বাস এক্সিডেন্ট হইছিল এইখানে সেই বৃষ্টির রাতে। দশ বারোজন মর ছিল। তার মধ্যে চারজনের নাম ঠিকানা পাওয়া যায় নাই। লা শ চারটা এখনো মর্গে আছে। দুইটা মেয়ে, দুইটা পুরুষ।”
“আচ্ছা!”
আরিফের মাথায় একটা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। খুব জটিল সম্ভবনা। কিন্তু হতেও তো পারে! তার ইচ্ছে হলো এখুনি ছুটে মর্গে চলে যেতে৷ কিন্তু তৌকিরকে এই অবস্থায় ফেলে কী করে যাবে!
সুমাইয়া আমান নিতু