তোর মন পাড়ায় পর্ব-০১

0
8

#তোর_মন_পাড়ায়
সূচনা পর্ব
#ইস্পিতা_রহমান

“ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার একটা স্বামী আছে,আমার বিয়ে হয়েছিলো,আর আজকে আসছে দেখো স্বামীর অধিকার দেখাতে।”

আপাদমস্তক সামনে থাকা সুদর্শন পুরুষটির দিকে চোখ বুলিয়ে উপরক্ত কথাটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল ১১বছর বয়সে বিয়ে হওয়া স্বামীকে।যখন পুরুষটির বয়স ছিলো ১৯।মৃত্যু শয্যাগত দাদার শেষ ইচ্ছে পুরণে এত ছোট বয়সে দুজন কিশোর কিশোরীকে বিয়ে দেয়া হয়েছিলো।বিয়ে কি জিনিস বোঝার আগেই অপরিণত বয়সে এই বিয়ে দুজন কিশোর-কিশোরীর মনে এই বিয়ের কোন প্রভাবই পরে নি।

“এ্যাহ,কে স্বামীর অধিকার নিয়ে আসছে রে!”আর কিসের স্বামীর অধিকার!কবে কোন ছোটবেলায় বিয়ে হয়ছে,কি না হয়ছে। সেই বিয়ের আবার অধিকার।ধুর।আমাকে কি তোর হ্যাংলা মনে হয় রে?দূর হো,ছেমরি। ”

কথাটা বলেই অর্কভ গটগট পায়ে চলে গেলো।ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে অর্কভের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো রায়াত।রাগে তার সারা শরীল রি-রি করছে ওর।ভাবে,এতো বছর পর কি দেখতে আবার মামার বাড়ি পা রেখেছেন উনি?

আজ থেকে ৯বছর আগের কথা।শিকদার বাড়ির কর্তা ইরফান শিকদার মৃত্যু শয্যাশায়ী।এক মাত্র ছেলের এক মাত্র মেয়ে রায়াত ইফতা।মৃত্যুর আগে ইরফান শিকদারের শেষ ইচ্ছা নাতনীটির বিয়ে দেখে যাওয়া।কিন্তু রায়াত তো এখনো অনেক ছোট।সবে এগারো বছর বয়স,ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠে ।নতুন স্কুল,নতুন ক্লাস,নতুন বই নিয়ে কতই না মজাই আছে রায়াত।কিন্তু তার দাদা ইরফান শিকদার হুট করেই সিদ্ধান্ত নেয় নাতনী বিয়ে দেবে।ছেলে সাদেকুর রহমান ও এক মাত্র মেয়ে আঞ্জুমান আরা কে ডেকে নিজের শয্যার পাশে বসিয়ে ইরফান শিকদার তার ইচ্ছার কথা বলে।পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সব শুনছে সাদেকুর রহমানের স্ত্রী রমেনা বেগম।বাবার কথার অবাধ্য হতে পারে না সাদেকুর রহমান।ছোট মেয়ে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে না থাকলেও বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে সে রাজি হয়।হঠাৎই আঞ্জুমান আরা বলে,
–আইনে এতো ছোট মেয়ে বিয়ে দেয়ার নিয়ম নাই।এইটা তো বাল্যবিবাহ হবে।
ইরফান শিকদার তখন বলে– বিয়ে কাজি ডেকে কলমা পড়িয়ে বিয়ে দিলেই হবে এখন।রায়াত দিদিভাইয়ের যখন আঠারো বছর বয়স হবে তখন না হয় আইন মোতাবেক রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হবে।

রমেনা বেগম তখন বলে উঠে– কিন্তু আমার এতো ছোট মেয়ের জন্য পাত্র পাওয়া যাবে কোথায় বাবা?
ইরফান শিকদার তখন চিন্তায় পরে যায়।আসলেই এত ছোট মেয়ের জন্য পাত্র কোথায় পাওয়া যাবে।সেইদিনকার মত এসব আলোচনা বন্ধ হয়ে গেলো।এ কথা চারদেয়ালের মধ্যে এই চারজনের মধ্যেই রয়ে গেলো।কিন্তু দুদিন পর আবার ইরফান শিকদার সবাইকে নিজের রুমে ডাকলেন।সবাইকে আসার পর ইরফান শিকদার বলে–
–অনেক ভাবার পর আমি দেখলাম,পাত্র তো আমাদের ঘরেই আছে।তাহলে এতো চিন্তা কিসের।
সাদেকুর রহমান,রমেনা বেগম,আঞ্জুমান আরা অবাক হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।তারপর ভ্রুকুচকে তিনজনি সুধায় তিনি কি বলতে চাইছেন।তখন ইরফান শিকদার বলে,
–আমাদের অর্কভ দাদুভাইই তো আছে।
তিনজনই জেনো আকাশ থেকে পড়ে।অর্কভ হলো আঞ্জুমান আরার এক মাত্র ছেলে।স্বামী মারা যাওয়ার পর আঞ্জুমান আরা স্বামীর সংসার ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে বাপের বাড়ি থাকে।ইরফান শিকদার এবার আঞ্জুমান আরাকে বলে সে রাজি কিনা।আঞ্জুমান আরা এক কথায় রাজি হয়ে যায়।ব্যাস সেই রাতেই বিয়ের আয়োজন করা হয়।একদম সাদা মাটা বিয়ে।শুধু কাজি আসবে আর বিয়ে পড়াবে।তাই হয়ে যাবে।

আঞ্জুমান আরা রায়াতকে ওর মায়ের বেনারসি পড়িয়ে নিজ হাতে সাজিয়ে দিচ্ছে।ছোট্ট শিশুসুলভ মনে এসবের কিছুই ওর বুঝে আসে না।যে যেভাবে বলছে সেভাবেই রয়েছে।বিয়ে কি জিনিস,স্বামী কি এসব পুতুল খেলা এই বয়সে ওর কাছে পুতুল বিয়ের মতই মনে হচ্ছে।তাই নিজেকে পুতুল পুতুল ভেবে খুশি মনে সাজিয়ে নিচ্ছে।
ইরফান শিকদারের ঘরেই ওদের বিয়ে পড়ানো হয়।নিজের চোখের সামনে নাতীটির বিয়ে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।মনে মনে শান্তি পাই মরার আগে নাতনীটির একটা গতি করে যেতে পেরেছে।দুচোখ ভরে দেখে প্রাণভরে দোয়া করে ওদের দুজনকে।
বিয়ে শেষে নিজের রুমে পাইচারি করতে থাকে অর্কভ।রাগে,ক্ষোভে,দুঃখে ওর সব কিছু তছনছ করতে মন চাইছে।রায়াত এই বয়সে কিছু না বুঝলেও অর্কভের ত ১৯বছর বয়স।সবে এইচ এস সি পাশ করেছে।চোখে কত স্বপ্ন ভার্সিটিতে পড়বে,ভালো চাকরি করবে।কিন্তু তার আগেই নানার ইচ্ছা পূরণ করতে তাকে ব*লির পাঠা বানানো হলো।একটুকু পুঁচকে মেয়ের সাথে তাকে বিয়ে দিয়ে দিলো।আর যা হোক যে তো বুঝে বিয়ে কি?তাই বলে ওইটুকু এক মেয়ের সাথে বিয়ে দিবে।অন্তত পনেরোষোলো বছর হলেও এক কথা ছিলো।যে মেয়ের এখনো পিরিয়ডই শুরু হয় নি সেই বাচ্চা মেয়েকে তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।মায়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে প্রথমে অমত করলেও তার মা তাকে বোঝায়,নানার ঘাড়ে বসে এতোদিন ধরে খাচ্ছে তারা।তার নানার শেষ ইচ্ছাটা অন্তত পূরণ করুক ছেলে।মায়ের অনুরোধে বিয়েটা করে।কিন্তু বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর অর্কভ কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে তার সাথে এত পিচ্চি মেয়েরবিয়ে হলো।তাই পরের দিন সকালেই ব্যাগপাটরা নিয়ে বের হয়।ওর মা আঞ্জুমান আরা ওকে ওভাবে বেরোতে দেখে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছে ও।তখন অর্কভ বলে–
–তোমারা কেউ আমার ভালো চাও না।দাদাজান ঠিকি বলতো,এখানে থাকলে আমার কোন ভবিষ্যৎ নেই।বার বার উনার কাছে চলে যেতে বলেছেন আমাকে।আমি যদি আগেই চলে যেতাম তবে গতকাল রাতে ওই অঘটনটা ঘটতো না।আমি আর এক মুহূর্ত এ বাড়িতে থাকবো না।আমি দাদু বাড়ি চলে যাবো।
রান্নাঘর থেকে কথাগুল শুনে বেড়িয়ে আসে রমেনা বেগম।ছলছল নয়নে অর্কভকে বলে–
–এসব কি বলছিস তুই অর্কভ?আমার মেয়েটার কি হবে?
–ওসব বিয়ে টিয়ে আমি মানিনা মামিমা।নানাজানের সামনে ওসব বিয়ে করার নাটক করেছি।মন থেকে আমি বিয়ে করি নি।
আঞ্জুমান আরা গিয়ে ছেলের গালে চড় মেরে দেয়।আর বলে,এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোকে এতোদিন?

অর্কভ এবার রাগে দুঃখে আর কোন কথা বলে না।তার নিজের মা তাকে মারলো।তাও ওই পিচ্চি মেয়েটার জন্য। ব্যাগপাটরা নিয়ে হাটা ধরে অর্কভ।পেছন থেকে অনেকবার ডাকে ওরা কিন্তু কারোর কথা কানে তুলে অর্কভ।দরজা ধরে এতোক্ষণ এসব দেখছিলো রায়াত।ওর মধ্যে নেই কোন হেলদোল নেই কোন অনুভূতি।ভাবে অর্কভ ভাই কেনোই রাগারাগি করছে আর কেনোই বা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো?

চলবে।