#আমার_হায়াতি
পার্ট : ৮
লেখিকা : #Nahar_Adrita
হসপিটালের সন্ধ্যা। কেবিনে নিস্তব্ধতা। বাইরে হালকা আলো জ্বলছে, নার্সদের চুপচাপ চলাফেরা, দূরে কোথাও ওষুধের ট্রলির শব্দ মাঝে মাঝে কানে আসছে।
হায়াত কেবিনের সাদা বিছানায় নিঃশব্দে শুয়ে আছে। চোখ দুটো ছাদের দিকে স্থির, যেন খুব গভীর কোনো ভাবনায় ডুবে গেছে। বুকের উপর রাখা হাত যেন কিছু বোঝাতে চাইছে—কষ্ট, কিংবা হয়তো তীব্র এক নীরব চিৎকার।তার পাশে টেবিলে ফুলের তোড়া, তবু সেগুলোর গন্ধ পর্যন্ত যেন আজ অনুপস্থিত, কোনো মেসেজ আসেনি।হায়াত যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। তার ভেতরে চলছে এক যুদ্ধ—স্মৃতির, ভুলের, ভালোবাসার আর বিষাদের।
আদিব আর তার মা ধীর পায়ে কেবিনে প্রবেশ করলো। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু মনিটরের ক্ষীণ শব্দ আর স্যালাইনের ফোঁটার টুপটাপ।
হায়াত বিছানায় শুয়ে, চোখ দুটি ছাদের দিকে স্থির, টেরই পায়নি কেউ এসেছে।
মিসেস অরোরা থেমে গেলেন দরজার কাছে। তাঁর চোখে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি—অভিমান, অনুশোচনা, হয়তো একটু মায়াও।
এই সময় দরজার বাইরে একসাথে কয়েকজনের চঞ্চল শব্দ।
– হায়াত ! মা…!
গ্রাম থেকে হায়াতের মা-বাবা আর খালা এসে গেছে।
মা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে হায়াতকে জড়িয়ে ধরলেন।
বাবা চোখের চশমা খুলে মুখে পানি দিলেন—
– আফরা তুই ঠিক আছিস মা ?
হায়াত একটা হালকা হাসি দিয়ে বলে,
– আমি ভালো আছি মা,আব্বু। তোমরা এসেছো তাই তো শান্তি লাগছে।
তার গলার সুর মোলায়েম, চোখে মায়া।
খালা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– আমার মা এত শুকিয়ে গেছে কেন? কিসের এত কষ্ট ?
হায়াত নরম গলায় শুধু বললো,
– সব ঠিক হয়ে যাবে খালা।
নরম পায়ে এগিয়ে আসে আদিব।চারপাশের মানুষদের নীরবতা যেন আরও ঘন হয়ে যায়।কেউ কিছু বলে না, কেউ ঠেকায় না।আদিব ধীরে হায়াতের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।এক মুহূর্ত থেমে থেকে, সে হালকা করে হায়াতের কপালে একটি চুমু দেয়, সবার সামনে।
হায়াতের চোখের পাতা কাঁপে না একটুও।
সে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,
– আম্মু, আমি বাড়ি যাবো। এখান থেকে বের হয়ে যেতে চাই।
আদিব নরম স্বরে বললো,
– জান জাবে তো,আমরা একটু পরই রিলিজ হলেই রওনা দেব।
– আম্মু আমি তোমাদের সাথে যাবো।
হায়াতের মা অবাক হয়ে বলে,
– আফরা এই অবস্থায় কোথাও যাওয়া যাবে না।গ্রাম তো দূরে,কিছুদিন….
মা কে থামিয়ে হায়াত শুধু বলে,
– এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমি নিজের ঘরে যেতে চাই।
আদিব সেই মুহূর্তে একপাশে সরে যায়।
তার কপালে রাখা নিজের ঠোঁট যেন পুড়ে যাচ্ছে এখন।
হায়াতের আচরণ এমন—যেন সে আদিবকে কোনোদিন দেখেইনি।আদিব কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
– জান তুমি কি বলছো এব্ এসব,তুমি গ্রামে যাব্ যাবে মানে।
– আম্মু ওনাদের বলে দাও,আমি ওনাদের মুক্তি দিলাম,আমার জন্য ওনাদের ঝামেলাতে পড়তে হবে না। আমি তাদের বাড়ির যোগ্য নই।
কেবিনের ভেতরে বাতাস ভারী হয়ে আসে।
সবাই বোঝে, কিছু একটা ভেঙে গেছে—যা আর আগের মতো হবে না।
হায়াতের বাবা রাগে কাঁপছে—
– আর এক মুহূর্তও না ! এই হাসপাতাল থেকে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাবো,যেখানে আমার মেয়ের কোনো মূল্য নেই, ভালোবাসার নামে শুধু কষ্ট আর অপমান জুটেছে… সেখানে তাকে আর এক সেকেন্ডও থাকতে দেবো না আমি!
তিনি উঠে দাঁড়ালেন, মেয়ের কপালে হাত রেখে বললেন,
– তুই আমার গর্ব হায়াত, তোকে কেউ ভাঙতে পারবে না,তোর বাবাই তোকে আগলে রাখবে।আমি মানলাম গরিব ওদের মতো টাকা নেই,যোগ্যতা নেই,তবে আমার মেয়েকে আমি কখনো কষ্ট করে মানুষ করি নি।
হায়াতের বাবা যখন রাগে ফুসে উঠে কেবিনের দরজা খুলতে যাচ্ছেন, হঠাৎ পেছন থেকে আদিব ধাক্কা দিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখে আগুন, গলায় কাঁপন।
আদিব চিৎকার করে উঠলো—
– না! আমি আমার বউকে যেতে দিবো না,হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি, আমি ওকে সবার সামনে ছোটো করেছি….. কিন্তু এখন বুঝেছি, প্লিজ লক্ষি জান এমন করে না, বাড়ি চলো।
সবার মুখে হতবাক ভাব। হায়াতের মা, নার্সরা, এমনকি হায়াতের বাবা কিছুটা থমকে গেলেন।
আদিব কাঁপা কণ্ঠে হায়াতের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল—
– আব্বু আফরাকে নিতে চান ঠিক আছে, কিন্তু যাওয়ার আগে আমি শেষবার ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলতে চাই—আমি ওকে ভালোবাসি, আমি ওকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমি ওকে ফেরত চাই… নয়তো আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।
তারপর সে হাঁটু গেড়ে হায়াতের পাশে বসে পড়ে, হাত ধরে চোখের জল ফেলতে থাকে।
– জান,বউ,লাজুক পাখি,হায়াত… একবার শুধু চোখ তুলে তাকাও… প্লিজ, তুমি চাইলে আমি তোমার পায়ের নিচে পড়ে থাকবো… কিন্তু তুমি চলে যেও না…
সাবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। সময় যেন থমকে গেছে।
হায়াত তখনও চুপচাপ… কিন্তু চোখের কোণে যেন অল্প একটু কাঁপুনি,হায়াত রাগে জবাব দেয়—
– না! আমি যাবো না আদিব স্যারের সাথে !ভালোবাসা মানে শুধু বলা নয়, বুঝিয়ে দেওয়া। আপনি শুধু বললেন, কিন্তু কখনও বোঝালেন না।আমার সম্মান যখন পদদলিত হচ্ছিলো, আপনি কই ছিলেন? এখন চিৎকার করে ভালোবাসা বলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে?
কেবিনের ভেতরে থমথমে পরিবেশ।
আদিব স্তব্ধ, তার চোখে পানি জমে উঠেছে।
হায়াত উঠে বসে বলে—আমি যাচ্ছি আমার বাবার সাথে,যেখানে আমাকে সম্মান দেয়, ভালোবাসা দেয়—অপমানের ছায়ায় আমি আর ফিরবো না!
হায়াতের বাবা সামনে এসে মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন।
– চল মা, এবার তুই নিজের পথ নিজে বেছে নিচ্ছিস। তোর বাবার গর্ব তুই।
আদিব প্রচন্ড রাগে দেয়ালে ঘুষি মারে।
“ধড়াম!”
আদিবের ঘুষির শব্দে পুরো কেবিন কেঁপে উঠলো। দেয়ালে রক্তের ছিটে—তার মুঠোটা কেটে গেছে।
চারপাশে থাকা নার্স, হায়াতের মা, এমনকি হায়াতের বাবা পর্যন্ত থমকে গেলেন।
সকলে আতকে উঠলো আদিবের রক্তাক্ত হাত দেখে।
“আদিব!” চিৎকার করে উঠলেন হায়াতের মা।
তাঁর চোখে একসাথে বিস্ময়, ভীতি আর মায়া।
নার্সরা দৌড়ে এলো, একজন টিস্যু আর ব্যান্ডেজ আনতে ছুটলো।
কেউ একজন বলল,
– স্যার আপনি এটা কী করলেন! এত রক্ত… আপনাকে এখনই ড্রেসিং রুমে নিয়ে যেতে হবে!
কিন্তু আদিব দাঁড়িয়ে রইলো, পাথরের মতো। চোখ শুধু দরজার দিকে, যেদিক দিয়ে হায়াত চলে গেছে।
তার ঠোঁট থেকে একটাই ফিসফিসে শব্দ বের হলো—
– ও যদি আমার না থাকে… তবে এই ব্যথাগুলোই আমার শাস্তি…
হায়াত কিছুটা দূরে গিয়ে পেছনে তাকালেও, চোখ সরিয়ে নেয়।
সে জানে—এই মুহূর্তে তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলেও, নিজেকে ভাঙতে দেওয়া চলবে না।
হায়াতের শেষ কথাগুলো যেন আগুন ঢেলে দেয় আদিবের রক্তে।
সে ঝাঁপিয়ে এসে হায়াতের গাল চেপে ধরে, চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলছে।
– আহ লাগছে।
– চুপ আবা’ল ! একদম চুপ করবি!তুই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমারই মা, আমার ভালোবাসা, আমার সবকিছুকে নিয়ে এত বড় কথা বলিস?
তার কণ্ঠ হুংকারে ভরে যায়।
চারপাশে থাকা সবাই হতবাক, নার্স এগিয়ে আসতে গিয়েও থেমে যায়।
– ভেবেছিস আমি কিছু বলবো না ? ভেবেছিস তুই যা ইচ্ছা বলবি, আর আমি চুপ করে দেখবো?
হায়াত চোখে চোখ রাখে, গাল চেপে ধরা অবস্থাতেই কাঁপে না।
আদিব আবার ফিসফিসে গর্জে ওঠে—
– তুই শুধু আমার নামটাকে না, আমার পুরো অস্তিত্বটাকেই পুড়িয়ে দিয়েছিস, হায়াত!
তারপরে হঠাৎ হাতটা আলগা করে দেয়।
আদিব দু’ধাপ পিছিয়ে যায়, চোখ দুটো ভিজে উঠেছে—কিন্তু গলায় আগুন ঝরে।
– তুই চাইলে গালি দে… ঘৃণা কর… তবু এতটুকু মিথ্যা বলিস না… কারণ আমি এখনো তোকে… ভালোবাসি।
আদিবের কণ্ঠে “আমি এখনো তোকে ভালোবাসি” কথাটা বের হতে না হতেই—
হায়াত এগিয়ে এসে এক ঝটকায় তার হাতটা সরিয়ে দেয় মুখ থেকে।
চোখে আর জল নেই, শুধু আগুন।
– ভালোবাসা?
তার কণ্ঠে বিদ্রুপ। – ভালোবাসা যদি এমন হয়, তাহলে ওই শব্দটারই মুখে থুতু দিই!
এক ধাপ এগিয়ে দাঁড়িয়ে হায়াত সোজা আদিবের চোখে চোখ রাখে।
– দরকার নেই এমন ভালোবাসার—
যেখানে মায়ের অপমান হয়,
আত্মসম্মান পদদলিত হয়,
আর আপনি কেবল নিজের রাগ দেখিয়ে যান!
ভালোবাসা যদি শুধু নিজের অধিকার নিয়ে চেঁচানো হয়, তাহলে সেটা ভালোবাসা নয়—এটা মালিকানা,
হায়াতের গলা কাঁপছে, কিন্তু সে থামে না।
আপনি যাকে ভালোবাসা বলছেন, আমি তাকে ভয় পাই। বুঝেছেন ? ভয়!
তারপর সে ঘুরে দাঁড়ায়।
“এবার আমি যাচ্ছি, আর ফিরে তাকাবো না। এবার হাহ আপনি আসলেই হারালেন আমাকে। চিরতরে।”
ঠাস!
আদিবের হাতে হায়াতের গালে সজোরে একটা চড়।
শব্দটা যেন পুরো কেবিনের নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে ফেলে।
হায়াত থমকে যায়, মুখ ঘুরে যায় এক পাশে।
তার চোখ জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু এখনো কাঁদছে না।
সেই মুহূর্তেই হায়াতের বাবা বজ্রগম্ভীর গলায় গর্জে ওঠেন—
– আমার সামনেই আমার মেয়ের গায়ে হাত তুললে ?
“তোমাকে মানুষ ভেবেছিলাম, জানোয়ার না!”
তিনি এগিয়ে আসেন এক পা, চোখে তীব্র রাগ আর গলা কাঁপছে।
আদিব ঘাড় শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। বুক ফুলিয়ে, চোখে আগুন।
– হ্যাঁ! মেরেছি! কারণ ও আমার স্ত্রী!”
সবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
কেবিনে উপস্থিত নার্সরাও থমকে যায়।
– আইন দিয়ে, সমাজ দিয়ে, ধর্ম দিয়ে—ও আমার বউ!”
“আর আমি আমার স্ত্রীর সাথে কীভাবে কথা বলবো, সেটা শেখাবে না কেউ!
হায়াতের গালে লাল ছাপ, কিন্তু তার গলা ঠান্ডা ও কাঁপা—
– আব্ আপনি শুধু স্বামী নন, আপনি এখন আমার জীবনের এক ভয়ংকর ভুল!
হায়াতের বাবা এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না।
তিনি সামনে এসে আদিবের কলার চেপে ধরেন—
– স্ত্রী মানে কি মালিকানার কাগজ? মেয়েকে মারার লাইসেন্স?
চড়ের ঘটনার পর সবকিছু যেন থেমে যায় কিছু মুহূর্তের জন্য।
আদিব স্তব্ধ।
হায়াতের বাবা কাঁপা হাতে মেয়ের গালে ছুঁয়ে দেখেন, তারপর পেছনে সরে দাঁড়ান।
ঠিক তখনই কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে ঢোকেন মিসেস অরোরা—আদিবের মা আর চাচী ।
চোখে বিস্ময়, ভয়, আর চাপা দুঃখ।
আদিবের চাচী ধীরে হায়াতের সামনে এসে দাঁড়ান, হাতটা ধরে ফেলেন।
– বাবু, প্লিজ… আমি মাফ চাই মা,আমাদের ছেলের রাগ হয়, আমরা জানি… কিন্তু তুমি তো জানো ও তোমায় কতটা ভালোবাসে। একটা ভুল—তাও তুমি ক্ষমা করে দিতে পারো না ?
আদিবের বাবা এবার বলেন—
– মেয়েরা সম্পর্ক ভাঙার জন্য না, টিকিয়ে রাখার জন্য হয়। ছেলেটার রাগ আছে, কিন্তু মনটা তো তোমারই!
হায়াত ধীরে ধীরে চোখ তোলে। ঠোঁটে হালকা কাঁপা হাসি,তার কণ্ঠ দৃঢ় হয়ে ওঠে।
– আমার যোগ্যতা নেই আর আজ যখন আমার গায়ে হাত উঠলো, তখন আমি বুঝেলাম —এই সম্পর্ক আর আমার সম্মান একসাথে বাঁচে না।
মিসেস অরোরাও মাফ চাইলেন হাত ধরে,হায়াত হাত আলতো করে ছাড়িয়ে নেয়।বললো,
– আপনারা ভালো, আপনি আমাকে মায়ের মতো স্নেহ দিয়েছেন। কিন্তু এবার ক্ষমা করবেন—এই মেয়েটা আর ফিরছে না।সরি… আর সম্ভব না।
হায়াত চোখ নামিয়ে চলে যায়—ধীর পায়ে, কিন্তু স্থির সিদ্ধান্তে।
———-
হায়াতকে নিয়ে বাবা-মা ধীরে ধীরে বাসের দিকে এগোতে লাগলো।
কারো মুখে কথা নেই, শুধু বুকে একাকার বিষাদ আর নীরবতা।
বাসের ধোঁয়া উঠে উঠলো, যাত্রা শুরু হলো।
হায়াতের বাবা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন, মন ভারাক্রান্ত।
মিসেস অরোরা পাশে থেকে হায়াতের হাতে আলতো করে হাত রাখলেন, চেষ্টা করলেন কিছু বলার—কিন্তু কথা গুলো গলায় আটকে গেল।
হায়াত চুপচাপ বসে আছে, চোখে আকাশের দিকে দূরের কোনো ভাবনা।
ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা, যা সময়ের সঙ্গে একটু একটু করে জমতে লাগছে।
বাস ধীরে ধীরে শহরের কোণে ঢুকছে, আর হায়াতের জীবনও যেন একটা নতুন অধ্যায় শুরু করছে—যেখানে ঠিক কতদূর যেতে হবে, সে নিজেও জানে না।
—
হায়াত চলে যাওয়া মাত্রই কেবিনে যেন বিস্ফোরণ ঘটে আদিবের ভিতরে।
সে হঠাৎই পিছনের দেয়ালে গিয়ে সজোরে নিজের কপাল ঠুকিয়ে দিল—
ধড়াম!
রক্তের দাগ এবার কপালেও।
চারপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
আদিব! চিৎকার করে ওঠে মিসেস অরোরা।
নার্সরা দৌড়ে আসে। হায়াতের বাবা এক পা এগোতে গিয়েও থেমে যান।
আদিব কাঁপা কাঁপা হাতে দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
চোখে রাগ নয়, শুধু ভয়ংকর শুন্যতা।
সে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে—
– যা! কেউ সামনে আসবি না!আমার ভুল আমার শাস্তি… কেউ দয়া দেখাতে আসবে না!মা তুমি চলে যাও।
তার কণ্ঠ ফাটতে বসেছে। নিঃশ্বাসগুলো কাঁপছে।
হঠাৎ পকেট থেকে ফোন বের করে দ্রুত কিছু টাইপ করতে করতে সে আবার বলে—
আফরা সিকদার হায়াত…তোকেই তো বলেছিলাম—তুই যদি আমার না হোস, এই ব্যথাগুলোই হবে আমার শাস্তি…তোর কাছে আমার ভালোবাসা ভয়ের নাম—তাই ঠিক আছে। আমি তোকেও ভয়মুক্ত করে দিচ্ছি।
“ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেবো। চিরতরে মুক্তি…”
তার কণ্ঠ ভেঙে পড়ে, কিন্তু চোখের জল কোথাও নেই।
শুধু একটা ফাঁকা হাসি।
“তুই বাঁচ… কিন্তু আমাকে নিয়ে আর কোনো চিন্তা না করিস। কারণ আমি তো মরে গেছি, ঠিক ওই চড়টার সঙ্গে সাথেই…”
—-
অন্যদিকে, বাসের কোণে বসে ছিল হায়াত। তার চোখ ভেজা, কাঁদা অশ্রু মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ধীরে ধীরে বড় করে কান্না শুরু করল।হঠাৎ করেই ফোনের স্ক্রিন আলো করে উঠলো—
হায়াত হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো মেসেজ গুলোর দিকে।
হাত কাঁপছে, চোখ ছলছল করছে…
– এটা কেমন কথা? ডিভোর্স….
কিছু লেখার আগেই—
“You can’t reply to this conversation anymore.”
চোখ কুঁচকে দেখলো হায়াত…
আদিব ব্লক করে দিয়েছে!
মনটা ধক করে উঠলো।
আবারও চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এলো সবকিছু।
এক মুহূর্তে যেন সমস্ত জগৎটা থেমে গেলো।
মায়ের কোমল হাতগুলো আলতো করে তার চুলে ছুঁয়ে দিচ্ছিল, যেন বলতে চায়—সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
মায়ের কণ্ঠে কাঁপন,
“সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, মেয়ে, একটু ধৈর্য ধরো। আমি আছি তোমার পাশে।”
হায়াত শুধু কান্না করে, থামতে পারে না। তার চোখে শুধু মায়া আর একেক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার ভয়।
কিন্তু এই কান্নার মধ্যেই যেন নিজের নতুন জীবনের প্রথম নিঃশ্বাস খুঁজে পাচ্ছে সে।
হঠাৎ করেই ফোনের স
—
আদিবের মুখ থেকে বেরোলো অস্পষ্ট, গর্জনসদৃশ আওয়াজ—যা রাগ আর বিদ্বেষের মিশ্রণ।
– হায়াত… বাস্টার্ড… তোকে আমি কখনো মাফ করবো না…
তার চোখে আগুন, গলা কাঁপছে ব্যথায়।
অজান্তেই ফোঁটা ফোঁটা রক্ত টপকাচ্ছে কপালের ফাটল থেকে, কিন্তু সে কাঁদছে না, শুধু
নার্সরা তার পাশে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করল তাকে শান্ত করতে,
কিন্তু আদিবের মন এখন শুধুই রক্তক্ষরণ আর অব্যক্ত ঘৃণায় বদ্ধ।
—
বাস ধীরে ধীরে ধামরাইয়ের কাছে এসে পৌঁছালো।
সুদূর পাহাড়ের নীলিমায় মিশে থাকা সুতিপারার পথে পাড়ি দিতে যেতে এখনও কিছুক্ষণ বাকি।
হায়াত চুপচাপ বসে ছিল, চোখ মুছে-মুছে কান্না করছিল।
তার গলা ভেঙে ভেঙে উঠছিল, নিঃশ্বাসও কষ্টকর হয়ে উঠেছিল।
বাবা পাশে এসে আলতো করে হাত রাখলেন হায়াতের কাঁধে,
মায়ের কণ্ঠও কোমল কিন্তু দৃঢ়—
– শোন মেয়ে, সবাই জীবনে কঠিন সময় পায়। একটু ধৈর্য ধরো, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
– তুমি একলা নও, আমরা তোমার পাশে আছি, বললেন বাবা।
হায়াত তাদের কথায় একটু শান্ত হলো,
তবুও চোখের কোণে জল জমে থাকা থামছিল না।
বাস চলতে থাকলো, পথের গাছপালা ধীরে ধীরে পেছনে ফিকে হতে লাগলো,
আর হায়াতের মন যেন সেতার সুরের মতো ব্যাথায় বাঁধা।
কিন্তু সেই ব্যথার মধ্যেও কিছুটা আশা জেগে উঠল—জীবনের এই পথটাও শেষ হয়ে যাবে একদিন,,,,তবুও
হায়াতের কান্না থামছিল না, গলা ভেঙে কাঁদতে কাঁদতে সে বাবার দিকে তাকালো।
– বাবা… আদিবের কি কিছু হবে না তো?তার কণ্ঠে অজানা ভীতি আর অসহায়তা ভেসে উঠল।
হায়াতের বাবা দৃঢ় হয়ে বললেন,
– না, মেয়ে। ডাক্তাররা অনেক যত্ন নিচ্ছেন। ও সবার নজরে আছে। আল্লাহ ভালো রাখবেন, তুমি চিন্তা করো না।
মায়ের চোখও ছিল দোয়ার অজস্র তরলে ভেজা।
সে আলতো করে হায়াতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“তুমি শক্ত হয়ে ওঠো। আমরা সবাই একসাথে আছি।”
হায়াত ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে করল।
তবুও ভেতরে একটা আশঙ্কা থাকল—কেন যেন মনে হলো, এই যুদ্ধের শেষ এখনও দূরে।
—
রাত নয়টা। আদিবের বাবা ধীরে ধীরে পাশের চেয়ারটায় বসে বললেন,
– বাবু, আমি শীঘ্রই হায়াতকে তোমার কাছে নিয়ে আসবো। তুমি একটু ধৈর্য ধরো।
কিন্তু আদিব মুখ ঘুরিয়ে নিলো, চোখের কোণে অজান্তেই জল জমতে লাগল।
– আমি এখন কিছুই চাই না, বাবা… সময়ই সব ঠিক করবে, ফিসফিস করে বলল সে,
তার কণ্ঠে ছিল এক মিশ্র ব্যথা আর গোপন রাগ।
আদিবের বাবার মুখে চিন্তার ছাপ, আর আদিবের চুপ থাকার মাঝে যেন এক কঠিন যুদ্ধ চলছে।
তবে সেখানে কেউ কেউ জানতো—এই মুহূর্তগুলো পার করলেই হয়তো এক নতুন শুরু অপেক্ষা করছে।
#চলবে