আমার হায়াতি পর্ব-০৯

0
10

#আমার_হায়াতি
পর্ব : ৯
লেখিকা : #Nahar_Adrita

মৃদু আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকেছে, কিন্তু সেই আলো আজ হায়াতের চোখে যেন কুয়াশা। বালিশে মুখ গুঁজে কিছুক্ষণ শুয়ে ছিল, নিঃশব্দে। ঘুমটা কখন ভেঙেছে মনে নেই, শুধু বুকের ভেতরকার ভারটা আরও খানিকটা বেড়ে গেছে মনে হলো।বাবার বাড়ির ঘরটা পরিচিত, খুব চেনা। এই বালিশ, এই জানালা, এই পর্দা—সব কিছু আগের মতোই। তবু হায়াতের মনে হলো, সব কিছু বদলে গেছে। আগে এই ঘর ছিল নিরাপদ, শান্তির আশ্রয়। এখন এটা যেন একটা স্মৃতির কারাগার।

হঠাৎ মায়ের কণ্ঠ ভেসে এলো,

– হায়াত,মা উঠো ? নাশতা রেডি।

হায়াত সাড়া দিল না। মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো, মা জানে—তাঁর মেয়েটা আজ ভাঙা।

গতকাল আদিবের সেই কথাগুলো এখনও কানে বাজছে—
তারপর ব্লক। সব যোগাযোগ ছিন্ন।
হঠাৎ করেই শেষ।

হায়াত জানে, সে কিছু ভুল করেনি। তবু কেন যেন তার দিকেই সব আঙুল উঠেছে। আদিবের চুপ করে থাকা, আর শেষে ওই ঠাণ্ডা বিচ্ছেদ… কষ্টের চেয়েও বেশি অবাক করেছে তাকে।

ঘর থেকে নেমে আসতে আসতে তার মনে হচ্ছিল,
এই বাড়িতে সে যেন অতিথি হয়ে গেছে।
সকলের সামনে মুখ দেখানোই কঠিন, যেন সবাই জানে—তাকে ছেড়ে যাওয়া হয়েছে।

মা চুপচাপ তার প্লেটে নাশতা তুলে দিচ্ছিলেন। চোখে-মুখে চিন্তা, দুঃখ—কিন্তু জিজ্ঞাসা নেই। মা বুঝে গেছেন, প্রশ্ন করলে হয়তো কান্না ভেঙে পড়বে তার একমাত্র মেয়ে।

হায়াত মুখ নামিয়ে ধীরে ধীরে বললো,

– আম্মু, আমি ঠিক আছি।

কথাটা বলে সে নিজেই বুঝলো—এই একটা মিথ্যে বলতেই তার সবটা কেঁপে উঠল।
– তুই ঠিক নেই মা,,,,,আমি জানি তো।
– উহু আমি একদম ঠিক আছি।
– মায়ের সাথে মিথ্যা বলে পাড় পেয়ে যাবি বোকা, হায়াত চুপ করে মাকে জড়িয়ে ধরলো।

মন ভাঙা এই সকালটা যেন চিরকাল লেগে থাকবে তার মনে।হয়তো সময়ের সাথে সব ঠিক হবে, কিন্তু আজ…
আজ হায়াত শুধু একটু চুপচাপ থাকতে চায় নিজের মতো।

——————–

আদিবের ঘুম ভেঙে যায় সূর্যের আলোয় নয়, বুকের ভিতরের জ্বালায়।
চোখে লাল রেখা, রাতভর একটুও ঘুমায়নি।
ঘরের এক কোণায় পোড়া কাপড়ের গন্ধ এখনো টিকে আছে, ঠিক যেমন টিকে আছে হায়াতের স্মৃতির ছাই।

চেয়ারে বসে চুপচাপ তাকিয়ে আছে জানালার ফাঁক দিয়ে—বাইরে রোদ উঠেছে, কিন্তু তার ভিতরে একটুকুও আলো নেই।মাথার ব্যান্ডেজটা যেন আরও ভারি হয়ে উঠেছে।হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে, ক্ষতটা যেমন ছিল, তেমনি আছে—কেবল বেড়েছে ভেতরের যন্ত্রণা।

একটা পুরনো মগে কফি ঢেলে নেয়, কিন্তু চুমুক দেয় না।
চোখে কেবল হায়াতের মুখ।
মনে মনে বলে উঠে,
— তুই কেমন করে পারিস, হায়াত? আমি তো আর কিছুই না, তাই না?

বাইরে পাখির ডাক, আর ভিতরে নিঃশব্দ এক মৃত্যু।
এভাবেই কাটে আদিবের সেই সকাল—
একটা শেষ হয়ে যাওয়া গল্পের পর,নতুন শুরুর আগের শোকের প্রহর।

আদিব ধীরে ধীরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
চোখ দুটো লাল হয়ে আছে জ্বলে ওঠা আগুনের মতো।
মাথায় ব্যান্ডেজ, ভ্রু কুঁচকে আছে…
মুখে এক অদ্ভুত বিকৃত হাসি—যেটা কোনো মানুষ নয়, যেন পশুর মুখাবয়ব।

সে আয়নার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— দেখ, হায়াত… তোর আদিব কই গেছে ?
তোর আদিব মরে গেছে।
এখন আমি যা আছি, তা শুধু ধ্বংস… আগুন… প্রতিশোধ।

এক ঝটকায় আয়নার কাচে ঘুষি মারে আদিব।
চকিতে রক্ত বের হয়ে আসে হাত থেকে।
তবুও হাসে।
রক্তমাখা হাতটা তুলে কাচ ভাঙা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বে ছুঁয়ে দেয়।

— ভালোবাসি বলেছিলি না ?
ভালোবাসি মানেই ফেলে যাওয়া ?

হঠাৎই কণ্ঠ গর্জে ওঠে—
এক পশুর মতো চিৎকার করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেরই ছায়াকে ধমক দেয়:

— চিৎকার কর হায়াত!
তোর মুখে একবার বল… ‘আমি তোর কিছুই না!'”

তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে আয়নার সামনেই।
পেছনে পোড়া জামার গন্ধ, সামনে ভাঙা আয়নায় নিজের দানবীয় ছায়া।

আদিব ধীরে ধীরে আলমারির দরজা খুললো।
হায়াতের রেখে যাওয়া শাড়ি, ওড়না, প্রিয় সব পোশাক এখনো গন্ধ ছড়ায়—একটা শান্তির গন্ধ, যেটা এখন আদিবের কাছে বিষ।
হঠাৎ একটা জামা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে গন্ধ শুঁকে নেয়।
তখনই চোখের কোণে অগ্নিশিখা জ্বলে ওঠে।

— তুই নেই, তোর ছায়াগুলোও রাখব না আমি!

একটা একটার পর এক কাপড় ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচে ফেলে।
ঘরের মাঝখানে একটা লোহার ট্রে টেনে আনে।
তার ভেতর হায়াতের শাড়িগুলো গুটিয়ে রাখে।

তারপর হঠাৎই লাইটারের আগুন জ্বালায়—
শুরুতে একটুখানি শিখা, তারপর তা লেলিহান হয়ে পোড়ে জামার সুতায়, স্নেহে, স্মৃতিতে।

আগুনের দিকে অপলক চেয়ে থাকে আদিব।
চোখে পানি নেই, মুখে ব্যথার চিহ্ন নেই—শুধু পাথরের মতো ঠান্ডা অভিমান।

— ভালোবাসলে এভাবে কেউ ছেড়ে যায় হায়াত ?আম্মু ভুল ছিলো আম্মু ক্ষমা চেয়েছে, আর তুই…………
তুই কাপড়ে ছিলি… আমি পোড়ায়ে ফেললাম…
কিন্তু তোর স্মৃতি… কই রাখি ওটা ?
পুড়তে পুড়তে একসময় পুরো ঘর ধোঁয়ায় ঢেকে যায়।
রুমের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে পোড়া সুতো আর হারানো ভালোবাসার গন্ধ।

সব পোশাক পুড়ে গেছে। ঘরের মাঝখানে এখনো ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ।
আদিব নিঃশব্দে এগিয়ে গেলো আলমারির নিচের খোপের দিকে—
সেখানে একটা সাদা খামে লুকিয়ে রাখা একটা ছবি…
হায়াত, হেসে আছে, চোখে মায়া, ঠোঁটে চেনা ভাঙা ভাঙা হাসি।

আদিব ছবিটা দু’হাতে তুলে ধরে দেখে,
চোখে অশ্রু জমতে শুরু করে।

— তুই কীভাবে পারিস, হায়াত…তুই কীভাবে এমন করে চলে যেতে পারিস…?

আচমকা সে ছবিটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে,
মেঝেতে বসে পড়ে হু হু করে কাঁদতে থাকে—
পাগলের মতো, যেন কেউ তার বুক চিরে সব কিছু ছিনিয়ে নিয়েছে।

— তুই বলেছিলি, আমি তোর দুনিয়া… তাহলে আমাকে ভাঙলি ক্যান ?
আমি কি তোর মতো করে ভালোবাসি নাই…?
আমি তোরে ছাড়া থাকতে পারি না হায়াত… আমি পারি না…
চুলের গোছা এলোমেলো, গলার স্বর ভেঙে যাচ্ছে, চোখ ফেটে জল পড়ছে।
ছবিটার ওপর ঝরে পড়ে এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা অশ্রু।
তবু সে ধরে রাখে… আঁকড়ে ধরে… যেন এটুকুই হায়াতের শেষ ছোঁয়া।

একসময় কান্নার দমক গিয়ে পৌঁছায় এক নিস্তব্ধতায়।
আদিব কাঁদতে কাঁদতে বলে,

— তুই ফিরে আয় হায়াত… আমি সব ছেড়ে দিবো…
শুধু তুই একবার আয়…

——–

এক মাস পর…

বাড়ির উঠোনটা শান্ত, সকালটা হালকা রোদে ঝলমল করছে।
দোয়ারে বসে আছে হায়াত, চোখে সামান্য ক্লান্তি আর মন মরমর করছে নিঃশব্দ ভালোবাসায়।
এক হাতে ওড়না ধরে আছে, আর অন্য হাতে ছুটে আসা বাবার পা শব্দ হয় মাটিতে।

বাবা ধীরে ধীরে কাছে এসে বসে, নরম কণ্ঠে বলে—

– আম্মু, তুই প্রতিদিন কলেজে যাবি। কেন লুকিয়ে থাকবি, আদিব যদি নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে তুই কেনো পারবি না,

হায়াত মৃদু হাসে, মাথা নিচু করে বলেই,
– বাবা, আমি ভয় পাচ্ছি।তাদের সামনে গিয়ে আমি কিভাবে ঠিক থাকবো। আর সে,,,,,

বাবা মৃদু চোখে তাকিয়ে বলে,
– তুই যেমন, তেমনই থাকবে।তারা যা বলুক, তোর জন্য আমরা আছি।শক্ত হও, আম্মু।

হায়াত চুপ করে থাকে, তারপর হাত দিয়ে বাবার হাত ছুঁয়ে নেয়।ছোট্ট সেই ছোঁয়ায় বাবার চোখে একটা উষ্ণতা জ্বলে উঠে।

বাড়ির উঠোনে সেই ছোট্ট আলাপ চলে,
যেখানে আশা আর সাহস মিশে আছে নতুন দিনের পথে।
——-
সোমবার সকালে কলেজের গেটের সামনে হায়াত ধীরে ধীরে হাঁটছিলো। মনটা একটু কাঁপছিলো, হাত দিয়ে ওড়নার এক কোণা আঁকড়ে ধরে রাখছিলো যেন নিজের সাহস বাড়ায়।

হঠাৎ, গেটের সামনের ফাঁকে এক পুরুষের সাথে ধাক্কা লাগলো তার।
হায়াত তত্ক্ষণাত্ মাথা উঁচু করে তাকালো আর দেখলো—সে পুরুষ আর কেউ না, আদিব!

গলায় ঝুলানো আইডি কার্ডে বড় করে লেখা—
“Guest Teacher
সাদাদ আদিব চৌধুরী।”

আদিব কিছুটা অবাক হয়ে হায়াতের চোখে চোখ রাখলো।
তাদের চোখের মধ্যে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা ঘুরে গেল,
যেমন সব কষ্ট আর অভিমান এখনো বুকের ভেতরে জমে আছে।শব্দটা নরম, ভাঙা, আর ভেতরে এক সমুদ্র অপেক্ষা।মনে হলো পুরো পৃথিবী যেন থেমে গেল এক মুহূর্তের জন্য।

আদিব ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করল, তার চোখে কিছু অনুভূতি অশ্রুত থাকলেও মুখে একধরনের শান্ত ভাব।
হায়াত তার দিকে কিছু বলতে চাইলো, গলা কাঁপলো, কিন্তু শব্দ বের হলো না।
সে শুধু চেয়ে রইল, মনের মধ্যে এক জটিলতা ঝড়ে গেলো—অভিমান, আগ্রহ, আর ভয়ের মিশেল।

পেছন থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় হায়াত বলে উঠলো—
— শুব্ শু্ শুনুন…….

আদিব পেছন ফিরে না দেখেই চলে গেলো, গলায় টাঙ্গানো আইডি কার্ডটা হাওয়ায় হালকা দোল খাচ্ছিলো।
চলেই গেল…
হয়তো ইচ্ছে করেই না শোনার ভান করল,
হয়তো সত্যিই শুনেও শুনলো না।

হায়াত কেবল দাঁড়িয়ে রইল, মৃদু নিশ্বাস নিয়ে নিজের হৃদয়ের গভীরে গুঞ্জরিত কথাগুলো মেনে নিলো।
কিন্তু আদিব থামলো না।হায়াত দাঁড়িয়ে রইলো নিঃশব্দে,তার চোখে জমে থাকা জলের ফোঁটাগুলো ওড়নার কিনারে এসে ঝিম মেরে বসে থাকলো।
সে নিচু গলায় শুধু ফিসফিস করে বলল নিজের কাছেই
– আমি তো শুধু একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম
এক পলকও ফিরিয়ে তাকালেন না।
——

হায়াত চোখের পানি ওড়নার কোণ দিয়ে চুপচাপ মুছে নিল।প্রাণপণ চেষ্টা করলো যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারে।

ধীরে পা ফেলেই ক্লাসরুমে ঢুকলো।
পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসতেই আরাবি পাশ থেকে ফিসফিস করে বললো,

– এই এক মাস কোথায় ছিলি ? তুই একদম বদলে গেছিস, হায়াত।

হায়াত তাকিয়ে একটা ক্লান্ত হাসি দিলো, যেন বহু কথা আটকে আছে গলার ভেতর।

আরাবি আর চুপ থাকতে পারলো না,
– বলে ফেল না সোনা … তোর চোখ সব বলে দিচ্ছে।

হায়াত আস্তে করে বললো, কণ্ঠটা কেঁপে যাচ্ছে,
– আরাবি… আমার আর আদিব স্যারের বিয়ে হয়েছিলো।
– হু আমি তখন তো গ্রামের বাড়ি ছিলাম।
– আমাদের একমাস আগে ভুল বুঝাবুঝির জন্য আমি গ্রামে চলে যায়, ওনার আম্মু আমাকে ওনার ছেলের যোগ্য না…………….এরপর হায়াত আরাবিকে সব খুলে বললো। আরাবি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
তারপর হাত দিয়ে হায়াতের হাতটা শক্ত করে ধরলো,
– তুই একা না, আমি তোর পাশে আছি। শোন সব ঠিক করে নে স্যারের মাও তো মেনে নিয়েছে। যা হয়েছে, তা ভুল না… কিন্তু তুই এইভাবে ভেঙে পড়িস না, প্লিজ।”

হায়াত মাথা নিচু করে বসে থাকে, কিছু বলার শক্তি নেই। মিহি স্বরে বললো,
– হু আমি সব ঠিকঠাক করে ফেলতে চাই,কিন্তু ওনি…….
– তুই পারবি পাখি চিন্তা করিস না।

ঠিক তখনই দরজার কাছে চুপ করে দাঁড়ায় এক চেনা ছায়া আদিব।হালকা খাকি কালারের শার্টে, চোখে নির্লিপ্ততা।সে ধীরে ধীরে ক্লাসরুমে ঢুকলো।
চোখ একবার সবার উপর বুলিয়ে নিয়ে হঠাৎ থেমে গেল হায়াতের দিকেই।

হায়াতও মাথা তুলে তাকালো…
দুই চোখের মাঝখানে এক চুপচাপ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।

আরাবি বুঝে গেল, এই ক্লাস শুধু পড়াশোনার না—এই ক্লাসে আজ হৃদয়ও পরীক্ষা দিচ্ছে।
এই দৃশ্যটা দারুণ নাটকীয় — যেখানে হায়াত নির্দোষ, তবু আদিবের অভিমান-ঘৃণা-মিথ্যে নির্লিপ্ততা একত্রে ফেটে পড়ে তার উপর।
………..

হায়াত একদম চুপচাপ বসে ছিলো।
চোখ তার বইয়ের পাতায়, কিন্তু মন যেন একেবারে হিম—একদিকে আদিবের উপস্থিতি, আরেকদিকে বুকের ভেতর কাঁপুনি।

আদিব বোর্ডে কিছু একটা লিখছিলো, তারপর হঠাৎ পিছনে ঘুরে তাকালো।

তার চোখ সরাসরি গিয়ে পড়লো হায়াতের উপর।
ক্লাসে এক ফোটা শব্দ নেই, কিন্তু তার কণ্ঠ গর্জে উঠলো,

— you ! Stand up ! Why are you talking in class ?

হায়াত চোখ তুলে তাকালো—চোখে বিস্ময়, কণ্ঠে কাপুনি।

— আ আব্… আমি তো কথা বলিনি…

আদিব একটুও দয়া না করে ঠান্ডা গলায় ধমক দিয়ে বললো,
— Don’t argue ! Just get out of the class right now !

হায়াত থমকে গেলো।
তার বুকের মধ্যে যেন কেউ শিল-পাথর মেরে থেতলে দিলো।
পাশ থেকে আরাবি চুপচাপ ফিসফিস করে বললো,
— হায়াত কিছু বলিস না, প্লিজ…

কিন্তু হায়াত উঠে দাঁড়ালো।
চোখে পানি আসার আগে সে মাথা নিচু করে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে গেলো ক্লাস থেকে।

আদিব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো দরজার দিকে, মুখে একটুও অনুশোচনা নেই…পুনরায় ক্লাসে মনোযোগ দিলো।

দারুণ… এই মুহূর্তটা যেন নিঃশব্দে চিৎকার করা একটা দৃশ্য—
হায়াতের হেঁটে চলে যাওয়া মানে শুধু ক্লাস ছেড়ে যাওয়া না, এটা একরাশ ভালোবাসার অপমান সয়ে নেওয়া, মাথা নিচু না করে বেরিয়ে যাওয়া।

হায়াত কিছু না বলে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এলো।
চোখে পানি, কিন্তু তা গড়িয়ে পড়েনি—বরং চোখের কোণ ভিজে আছে নীরব অভিমান আর অপমানে।
সে একদম ধীরে ধীরে পায়ে পায়ে হাঁটছে…
চারপাশের কেউ কিছু বলছে না, কেউ কিছু বোঝে না।
তবুও যেন সবাই টের পাচ্ছে, হায়াতের কাঁধে আজ একটা দুঃখ গেঁথে আছে।
কলেজের করিডোর, সিঁড়ি, মাঠ—সব পেরিয়ে সে এসে দাঁড়ায় মূল গেটের সামনে।একবারও পেছনে তাকায় না।

হাওয়া একটু জোরে বইছে, ওড়নাটা হালকা উড়ছে পেছনে।
কিন্তু হায়াতের মুখে অদ্ভুত এক নিরবতা।
চোখে জল, ঠোঁটে চাপা ব্যথা, আর মনে একটাই কথা ঘুরছে,

— আমি তো কথা বলি নি…যত অভিমান রাগ সব ওনারই আছে,আমি তো মানুষ না হুহ।

গেটের চৌকাঠ পেরিয়ে সে হাঁটতে থাকে…না থেমে, না বলেই, না ফিরেই।
অসাধারণ… এখন সময় আদিবের দৃশ্যের—
বাইরে সে ঠান্ডা, রাগী, দৃঢ়…
কিন্তু ভিতরে?
তীব্র টান, না বলা কথা, আর অস্বীকার করে যাওয়া ভালোবাসার অস্থিরতা।

আদিব ক্লাস শেষ করে চুপচাপ টেবিল থেকে বইগুলো গুছিয়ে নিলো।
চারপাশে তখনও কিছু ফিসফাস চলছে—হায়াতকে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়ার পর সবার মুখে একটু চাপা বিস্ময়।

কিন্তু আদিবের মুখ একেবারে পাথরের মতো।
সে কারও দিকে না তাকিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলো করিডোর পেরিয়ে কলেজ গেটের দিকে।

পায়ের নিচে ধাপ পড়ে যেন সে নিজেকেই বোঝাচ্ছে—
“ঠিক করেছি… আমি ঠিক করেছি… আমি দুর্বল হবো না…”
কিন্তু হৃদয়ের গভীরে একটানা একটা প্রশ্ন ঘুরছে—
ও চলে গেল,একটুও দাঁড়ালো না?এতো অভিমান…

গেট পেরিয়ে সে বাইকের কাছে এসে দাঁড়ালো।
হাতের ব্যাগটা রাখতেই এক মুহূর্ত থেমে গেলো।

হাওয়ায় ভেসে আসছে হায়াতের গন্ধ… তার নীরব চোখ… কাঁপা গলায় বলা—
“আ… আমি তো কথা বলিনি…”

আদিব চোখ বন্ধ করে গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেললো।
মনে মনে বলে উঠলো—

— তুই কথা বলিস নি, আমি তোর মুখ চুপ করিয়ে দিলাম…

তারপর একটুও পেছনে না তাকিয়ে বাইকে উঠে বসলো।
গিয়ার ঘোরানোর শব্দ উঠলো,
আর এক মুহূর্তেই আদিব ছুটে গেলো বাড়ির পথে—
বুকের ভেতরে এক বোবা ব্যথা নিয়ে।

ঘরের জানালা দিয়ে পড়ছে পড়ন্ত বিকেলের আলো।
হায়াত নিচে পাটি পেতে বসে আছে, মা পেছনে বসে ধীরে ধীরে চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন।

চুলে মায়ের আঙুলের স্পর্শে যেন কিছুটা প্রশান্তি খুঁজে পাচ্ছে হায়াত।
মা মাঝে মাঝে চুপচাপ বলে উঠেন,
— তোর চুল তো আগের মতোই ঘন আছে… মানুষ কষ্ট পাইলেও চুলের যত্ন কমিয়ে দেয় রাগ করে।

হায়াত মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করে, কিন্তু হাসির নিচে চাপা কান্না লুকিয়ে আছে।

ঠিক সেই সময় বাড়ির গেট থেকে একজনের উচ্চস্বরে কথা শোনা যায়।একটু পর দরজার কাছে এসে দাঁড়ান মিসেস অরোরা।

সাজানো চুল, শাড়িতে ভদ্র অথচ দৃঢ় মুখাবয়ব।
চোখে আগুন নয়, বরং আজ যেন অন্যরকম কিছু।

হায়াতের মা অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ান,
– বেয়াইন আপনি। আপনি যে আসবেন…..
– হ্যা বেয়াইন আসলাম আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে।

মিসেস অরোরা ঘরে পা দিয়ে এগিয়ে আসেন হায়াতের দিকে।
হায়াত ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকায়…
চোখে বিস্ময়, ভয় আর চাপা কষ্ট।

কিছুক্ষণের নীরবতা ভেঙে মিসেস অরোরা বলেন—

– তোমার সাথে একটু কথা আছে, হায়াত।

মিসেস অরোরাকে নিয়ে হায়াত রুমে আসলো,তিনি ধীরে ধীরে এসে হায়াতের সামনে দাঁড়ালেন।
চোখে আজ রাগ বা অভিযোগের কোনো ছায়া নেই—
আছে একরাশ দ্বিধা, হয়তো ভেতরে চুপচাপ স্বীকারোক্তি।

কিছু না বলে তিনি হায়াতের হাত ধরে ফেললেন।

— “চলো, হায়াত… বাড়ি চলো। আমি নিজে নিতে এসেছি তোমায়।”

ঘরে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেল।
হায়াত কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো…
তারপর শাশুড়ী মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে, ধীরে কাঁপা গলায় বললো—
– আম্মু আপনার ওপর কোনো রাগ নেই আমার,আপনি তো মা আপনার কষ্ট লাগতেই পারে৷
– তাহলে….

তারপর মিসেস অরোরার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আপনি আমার শাশুড়ি… আমি আপনার সম্মান করি…
কিন্তু আমি এইভাবে যেতে পারি না।

মিসেস অরোরা অবাক হয়ে তাকালেন।
হায়াত একটু গভীর গলায় বললো,
– আমাদের বউ-শাশুড়ির মাঝে কোনো সমস্যা নেই, তাই না?তাহলে এই সম্পর্কটা অসম্পূর্ণ কেন থাকবে?

তারপর নিচু গলায়, একদম স্থিরভাবে বললো—

– তিনি আসবেন… নিজে।যদি এই সম্পর্কটা সত্যি হয়, যদি ভালোবাসায় অপমান নয়, সম্মান থাকে…
তাহলে উনিই আসবেন আমাকে নিতে।
আমি অপেক্ষা করবো, কিন্তু নিজেকে হালকা করবো না।

ঘরের বাতাস ভারী হয়ে যায়।
হায়াত মাথা নিচু করে না, গলার কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণে রাখে,
আর মিসেস অরোরা তার চোখে তাকিয়ে যেন এক নতুন হায়াতকে দেখে ফেলেন।

হায়াতের মাথায় হাত রেখে বলেন,
– তোমাকে আদিব নিতে আসবে দেখো,ছেলেটা আমার ভেতর থেকে শেষ, কিন্তু বাহিরে থেকে তোমার প্রতি অভিমান।

বিকেলের রোদ নরম হয়ে এসেছে।
হায়াত ক্লাস শেষে চুপচাপ এসে বসে বটগাছটার নিচে।
পাশে আরাবি। বাতাসে শিরশির করছে, কিন্তু হায়াতের চোখে এক ধরনের শান্ত বিষাদ।
একদম ঠিক! গল্প এখন গভীর জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে—
মিসেস অরোরা চুপচাপ চলে গেছেন, আর হায়াত তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে ছয়দিন পর আবার কলেজে ফিরে যাচ্ছে।
একটা দীর্ঘ অপেক্ষা, অনেক কথা জমে আছে, কিন্তু মুখে নেই কোনো অভিযোগ।

——
সকালের রোদটা আজ একটু বেশিই নরম।
আকাশে হালকা মেঘ, কিন্তু হায়াতের চোখে আজ দৃঢ়তা।
সাদা-হালকা নীল সালওয়ার-কামিজে তার মুখে প্রশান্ত একরাশ কষ্ট লুকানো।ছয়দিন পর কলেজে ফিরছে সে—
না চোখ লুকিয়ে, না মাথা নিচু করে।
আজ তার পায়ে জেদ, আর মনে সাহস।

কলেজ গেট পেরিয়ে হাঁটছে ধীরে ধীরে।
পেছনে না তাকিয়ে, কারও মুখ না দেখে।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে বুকটা ঢিপঢিপ করছে।

করিডোরে পা দিতেই কয়েকজন কৌতূহলী চোখ তার দিকে তাকালো।
কেউ ফিসফিস করলো, কেউ চোখ ফিরিয়ে নিল।

কিন্তু হায়াত আজ চুপচাপ, ভেতরে যেন নিজেকেই বলছে—
“তুই ভেঙে পড়বি না… আজও না।”

হঠাৎ আরাবি ছুটে এসে পাশে দাঁড়ালো,

– তুই আইছোস হায়াত! এই ছয়দিন তো একদম নিখোঁজ!
হাসির ভেতর উদ্বেগ লুকিয়ে ছিল।

হায়াত শুধু একটুকু হেসে বলল,
— ফিরেছি… কারণ আমি পালিয়ে থাকবো না।

ঠিক তখনই ক্লাসরুমের দরজার পাশ দিয়ে হেঁটে যায় এক চেনা ছায়া—
আদিব কিছুটা দূর থেকে হায়াতের দিকে একবার তাকায়…
তবে চোখে কোনো গর্জন নেই,
শুধু একরাশ চাপা প্রশ্ন, যার উত্তর হয়তো কেবল হায়াত জানে।
……..

বিকেলের রোদ নরম হয়ে এসেছে।
হায়াত ক্লাস শেষে চুপচাপ এসে বসে বটগাছটার নিচে।
পাশে আরাবি। বাতাসে শিরশির করছে, কিন্তু হায়াতের চোখে এক ধরনের শান্ত বিষাদ।

আরাবি বলে উঠলো,
– আমি পানি খেয়ে আসি রে, এই গরমে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তুই বস।

হায়াত মাথা নাড়লো, চোখ বন্ধ করে গাছটার ছায়ায় বসে রইল।

আরাবি চলে গেলে হঠাৎ পাশ দিয়ে তিনজন ছেলে ওদিকে আসে।
তাদের মধ্যে একজন ফিসফিস করে কিছু বলে, বাকিরা হাসে।

হঠাৎই এক ছেলেটা সাহস করে হায়াতের পাশে বসে পড়ে।

– এই যে সুন্দরী, একা বসে আছো কেন ?

হায়াত চমকে উঠে তাকায়,
– দয়া করে দূরে যান… আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে চাই না।

কিন্তু তারা পিছিয়ে না গিয়ে উল্টো আরেকজন বলে,
– কী ব্যাপার? গেস্ট স্যারের গার্লফ্রেন্ড বলে অনেক গল্প শুনি তো!

তিনজন ছেলে এসে দাঁড়ায় একটু দূরে।
তাদের হাসির মধ্যে অশালীনতা, চোখে স্পষ্ট খারাপ উদ্দেশ্য।

একজন ফিসফিস করে বলে,
– এইটাই তো স্যারের বউ গফ না ?
আরেকজন বাঁকা হেসে বলে,
– ধুর বাল বউ না, এখন তো একা।

একজন এগিয়ে আসে, সরাসরি হায়াতের ওড়না টেনে নেয়,
– এতো লাজলজ্জা কীসের?”

আরেকজন হাত বাড়ায় হায়াতের বুকে স্পর্শ করার জন্য।

হায়াত চিৎকার করতে চায়, কিন্তু গলা আটকে যায়।
চোখ ফেটে জল আসে, সে হাত দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে থাকে।

ঠিক তখনই…

— YOU MOTHER———!!
এক গর্জনে কাপিয়ে তোলে চারপাশ।

আদিব।
চোখ রক্তবর্ণ, গলার রাগে আগুন।
সে দৌড়ে আসে, এক ছেলেকে সজোরে ঘুষি মারে,
ছেলেটা পড়ে যায় মাটিতে।

— “Don’t you dare touch her! You fing animals!”*

আরেকজনকে কলার ধরে দেয়ালে ঠেকে মারে—
ঘুষি, লাথি, চিৎকার…

– তুই কার দিকে হাত বাড়িয়েছিস কুত্তার বা**, আবা’ল।

হায়াত স্তব্ধ, চোখে জল, ওড়না আঁকড়ে ধরে পেছনে সরে আসে।

এক সময় বাকি ছেলেগুলো ভয় পেয়ে দৌড়ে পালায়।

আদিব একদম নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে হায়াতের দিকে তাকায়—
তার চোখে এখনো আগুন, কিন্তু ভিতরে কাঁপন।সে ধীরে ধীরে কাছে এসে হঠাৎ থেমে যায়।চোখে হায়াতের জল… তার অসহায়তা।

কয়েক মিনিট পরে…

হায়াত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে জল, কাঁধে টানটান ওড়না।
আদিব তখনো কাঁপছে রাগে—কোনো কথায় নিজেকে থামাতে পারছে না।

সে হঠাৎ হায়াতের সামনে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠে বলে:

– এই আবা’ল কি ভাবিস নিজেকে, তুই কেনো এখানে একা বসে থাকবি আর কেনোই বা তোর বুকে কেউ স্পর্শ করতে চাইবে।আমি মুক্তি দিয়েছি বলে, এইভাবে একা ঘুরে বেড়ানো যাবে? আমার স্ত্রী হয়ে এইভাবে পড়ে থাকবি ক্যাম্পাসে?

হায়াত চমকে তাকায়। কিছু বলার আগেই আদিব আবার বলে ওঠে—
– তোর জন্য আমার রেপুটেশন শেষ! তুই কী চাস ?

হায়াত ধীরে গলা কাঁপিয়ে বলে,
— আমি তো চুপচাপ বসে ছিলাম… আমি কিছুই করিনি…

আদিব সেই কথায় যেন আরও ক্ষেপে যায়,
এক মুহূর্তের মাথায় রাগের মাথায় একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় হায়াতের গালে।

— “Shut up!”

হায়াত স্তব্ধ। গালটা লাল হয়ে গেছে, চোখে জল চিকচিক করছে।
কিন্তু সে কিছুই বলছে না—শুধু তাকিয়ে আছে এক মানুষকে, যাকে একসময় সে ভালোবেসেছিলো প্রাণ দিয়ে।

আদিব পেছনে দু’পা হাঁটছে, কিন্তু থেমে যাচ্ছে বারবার।
তার বুকের ভেতর যেন বিস্ফোরণ, এবং সে নিজেকে থামাতে পারছে না।

তারপর আবার ঘুরে দাঁড়ায়, চিৎকার করে—

— তুই কী ভাবিস নিজেকে, হ্যাঁ?বড় হইছিস? সাহস হইছে? বাল খা গা ! তুই আমার ইজ্জত ধূলায় দিছিস!

হায়াত কেঁপে উঠলো।
এতটা অপমান, এতটা শব্দের আঘাত—
তার চোখ ফেটে গেল, কিন্তু সে মাথা নিচু করলো।

আদিব এবার পাগলের মতো ফোঁপাচ্ছে রাগে, মুখ দিয়ে বের হচ্ছে শুধুই যন্ত্রণার ছায়া।
সে আরেক পা সামনে এগিয়ে বলে—

— তুই কেনো আসিস কলেজে, ওড়না না সামলাইয়া, সামনে সামনে ঘুরিস! লোকজন কি করবে না তোকে ?

হায়াত এবার কাঁপা গলায় বলে:

– আব্ আমি ওড়না সামলি..
– চুপ।

এক পলক নীরবতা…
চারপাশে পাখির ডাক থেমে গেছে যেন।

আদিবের চোখে তখনো রাগ, কিন্তু ভেতরে দহন।
সে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো, কিন্তু হায়াত বুঝে গেছে,
এই মানুষটা ভেতরে খুব ভেঙে গেছে, তাই ভালোবাসাকে আঘাতে রূপ দিচ্ছে।

হায়াত আর দাঁড়ায় না।
সে চলে যায়…
কাঁদে না, শুধু ভিতরে প্রতিজ্ঞা করে—
‘আর কখনো এই মানুষের সামনে আসবো না।’
দারুণ মোড়!
এখানে হায়াতের ভাঙা মন, অভিমান, অপমান—সবকিছুর পরেও আদিবের ভেতরের টান আর অধিকারবোধ তাকে থামাতে বাধ্য করে।
আর হায়াত?
সে আজ দুর্বল না—সে প্রতিবাদ করবে, আর নিজেকে ভাঙতে দেবে না।
——
হায়াত হনহনিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
চোখে জল ঝরছে না, কিন্তু মনে যেন আগুন জ্বলছে।

ওড়না আঁকড়ে ধরা, মুখ শক্ত—
আর কানে বাজছে আদিবের অপমানজনক কথা।

সে পিছনে তাকায় না, দ্রুত পায়ে গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ঠিক তখনই…

পেছন থেকে দৌঁড়ে এসে আদিব হায়াতকে কোলে তুলে নেয়।
হায়াত হতভম্ব! সে নিজেকে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে, গলা কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠে—

– আপনি একটা বা’ল।
– আয় বা’ল খা।
– আমাকে নামান! আমি যাবো না! সরুন!

আদিব কোনো কথা না বলে তাকে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে থাকে।
হায়াত চিৎকার করতে থাকে, হাত-পা ছুঁড়ে বলে—

— আমি আর আপনার কিছু না ! আমাকে জোর করে নিতে পারেন না,

আদিব থেমে দাঁড়ায়।
তাকায় হায়াতের চোখে, চোখে জল, কান্না, অভিমান, বিদ্রোহ।

মুখ নিচু করে হায়াতের ঠোঁটে ঠোঁট পুড়ে নিল, এক মিনিট পর বললো নিচু গলায়—

– তুই আমার কিছু না ?আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তাও বলতে পারিস?

হায়াত ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে—

— আপনি আমাকে অপমান করেছেন… আঘাত করেছেন… আমাকে ডিভোর্স দিবেন বলেছেন,আমি কোনো জবাব চাই না, আমি শুধু দূরে থাকতে চাই… নিজের মতো।

আদিব আস্তে করে তাকে গাড়ির সিটে বসিয়ে বলে—

– এইবার আমি তোর পাশে বসব না… শুধু নিয়ে যাবো…
– যাব না আমিইইই।
– তুই যাবি আর তোর বা’লও যাবে।

চলবে…..