আমার হায়াতি পর্ব-১৩

0
9

#আমার_হায়াতি
পর্ব : ১৩
লেখিকা : #Nahar_Adrita

রাগ করে হায়াত রুমে এসে বোরখা খুলে ডিভানের এক কোণে গম্ভীর মুখে বসে রইলো। চোখে জল থেমে থাকলেও মনটা ফুঁসে উঠছে। আদিব ধীরে ধীরে রুমে ঢুকলো, চোখে অনুশোচনার ছায়া। কিন্তু হায়াত মুখ ফিরিয়ে নিলো, একবারও চাইল না ওর দিকে তাকাতে।

আদিব কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বললো,
– হায়াত, কি হয়েছে।
– কচু হয়েছে, খাবেন।
– এটা কেমন কথা জান।কি হলো হঠাৎ এমন করছো।
– বা’ল করেছি।
– থাপ্পড় খাবা, কথায় কথায় গালি দেওয়া শিখেছে।

আদিব নিজের রাগ সংযত করে স্মিথ হেসে বললো,

– চলো গোসল করে আসি৷
হায়াত রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,
– আপনি করেন গা, যাকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন তার সাথে করেন গা।
– আরে এটা নিয়ে রাগ করছো কেনো। নেহা আমার খালাতো বোন আর তাছাড়া নেহা বিদেশি কালচারে বড় হয়েছে,এজন্য জড়িয়ে ধরেছে।
– আমি কিছু বলেছি।

আচ্ছা ওর হয়ে আমি সরি বলছি,চলো গোসল করবো, এই বলেই হায়াতকে কোলে তুলে নিল। হায়াত কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তার আগেই আদিব জুড়ে জুড়ে ঠোঁটে ঠোঁট চালাতে লাগলো। বিছানায় শুইয়ে দিলো হায়াতকে। হায়াত আদিবের চুল খামচে ধরলো। আদিব শার্ট খুলবে এমন সময় দরজায় নক করলো কেউ। বাইরে থেকে নেহার কন্ঠ ভেসে আসলো,
– আদিব দরজাটা খুলো।
হায়াত ওঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো, আদিব কি বলবে কিছু বুঝতে পারলো না,দরজা খুলে দিতেই নেহা আদিবের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো,
আকস্মিক ঘটনায় আদিব কিছুটা হতবাক হয়ে গেলো,নেহা চোখ ভিজিয়ে আদিবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো,
– আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না আদিব… প্লিজ ফিরে আসো… আমি আর পারছি না…
– নেহা, হায়াত…. ও এখন আমার স্ত্রী, প্রেম, মায়া ভালোবাসা,মহব্বত, সবই এখন সে।
– আমি কিচ্ছু জানি না,আমার তোমাকে লাগবেই ব্যাস।

ঠিক সেই মুহূর্তে ওয়াশরুমের দরজাটা খুলে গেল।
হায়াত চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেলো দরজার চৌকাঠে। ভেজা মুখ, শুকনো চোখ, আর বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দৃশ্যটার দিকে।

নেহা তখনও জানে না যে হায়াত পিছনে দাঁড়িয়ে। আদিব বুঝে গেলো, চোখাচোখি হলো হায়াতের সঙ্গে।
হায়াতের মুখে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু চোখে এক ধরনের স্তব্ধতা — না রাগ, না কান্না — কেবল একরাশ হতাশা।

হায়াত ধীরে ধীরে পেছন ফিরে চলে যেতে লাগলো, একবারও কিছু না বলে।

আদিব শুধু ফিসফিস করে বললো,
— হায়াত…

কিন্তু হায়াত থমকালো না। গলায় যেন কাঁটা গেঁথে গেছে।

নেহা এবার পেছনে তাকিয়ে হায়াতকে দেখে ফেললো।বাঁকা হাসলো,হাত সরিয়ে নিলো আদিবের বুক থেকে, কাঁপা গলায় বললো,
— হায়াত… আমি….

হায়াত কিছু না বলেই দৌড়ে ছাদে উঠে গেলো। গা থেকে পানি পড়ছে, চুলগুলো এলোমেলো, ওড়নাটাও ঠিক করে নি। ছাদের এক কোণায় গিয়ে বসে পড়লো সে। বুক ফেটে কান্না আসছিল, কিন্তু গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিল না—শুধু নিঃশ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছিল।

মনে হচ্ছিল বুকটা ফেটে যাবে।

আদিব আর নেহা আপু……..

নিজের মনেই কথা বলছিল হায়াত।
তার মনে পড়ে যাচ্ছিল, কতো ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে এসেছিল তারা… তাহলে আজ এই?

নিহত আত্মবিশ্বাস, অপমান আর ভালবাসার ভাঙা টুকরোগুলো মিলিয়ে এক অদ্ভুত বেদনায় ভরে গেছে মন।

হঠাৎ ছাদের দরজাটা খোলার শব্দ হলো।
হায়াত চোখ মুছে পেছন ফিরে তাকালো না, শুধু ঠোঁট শক্ত করে বসে রইলো।

পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে কাছে আসছে।

ছাদের দরজাটা আস্তে করে বন্ধ হলো—পেছনে না তাকিয়েও হায়াত বুঝে গেল, এটা আদিব না… নেহা।

নেহা আস্তে আস্তে পাশে এসে বসলো, ঠোঁটে বাঁকা একটা হাসি। চোখে অদ্ভুত তৃপ্তি।

– আদিব শুধু আমার, নেহা ফিসফিস করে বললো, রাস্তার দুই পয়সার মেয়ে রুপ দেখিয়ে বিয়ে করলি,,
তুই তো আদিবকে পটিয়ে বিয়ে করেছিলি, হ্যাঁ? হা হা… খুব চালাকি করেছিলি, ভাবলি আমি হেরে গেলাম ?

হায়াত থমকে গেলো। গলা শুকিয়ে আসছিল তার।

এরপর আচমকা,
নেহা হায়াতের চুলের মুঠি ধরে জোরে টেনে ধরলো।
হায়াত ব্যথায় একটু চিৎকার করলো,
– নে… হা আপু, আ… ছেড়ে দিন, লাগছে।

নেহা দাঁত কিঁচিয়ে বললো,
– আজ না তো কাল আদিব আমার কাছেই ফিরবে। ও আমার ছিল, আছে, থাকবে। আদিব তোকে দেহের খু’ধা মিটানোর জন্য তোকে রেখেছে, আমি এসে গিয়েছি এখন আর তোর প্রয়োজন নেই।

হায়াত চোখে পানি নিয়ে নেহার দিকে তাকালো, কিন্তু এবার চোখে ভয় না—
চরম অপমান আর অসম্মানের আগুন।

হায়াত ঠাণ্ডা গলায় বললো,
– পৃথিবীতে জোর করে শরীর পাওয়া যায় … মন নয়। ওনি যদি তোমারই হয়, তো ভয় কিসের, নিয়ে যাও আমি বাধা দেবো না,,, নেহা আপু।

নেহা থমকে গেলো এক মুহূর্ত।

ছাদের হাওয়াটা যেন থেমে গেল।

নেহা হায়াতের গালটা জোরে চেপে ধরলো। আঙুলের চাপ এতটাই শক্ত ছিল, হায়াত চোখ বন্ধ করে ফেললো ব্যথায়।

নেহা নিচু গলায় ফিসফিস করে বললো,
— আজ থেকে তুই আদিবের কাছ থেকে দূরে থাকবি… বুঝেছিস? ও আমার ছিলো… আমার থাকবে। আমরা তো চার বছর আগেই ফিজিক্যাল ইনটিমেট ছিলাম। তোকে শুধু বিয়েটা করে জোড় করে জায়গা করে নিতে হয়েছে।”

হায়াতের চোখ হঠাৎ বড় হয়ে গেলো। সে থমকে গেলো। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। গলা শুকিয়ে গেল। চোখে জল জমে উঠলো, কিন্তু সে চিৎকার করলো না, কাঁদলো না—শুধু নিঃশব্দে নিঃশ্বাস আটকে গেল কিছু সময়ের জন্য।

সে চেয়েছিল বিশ্বাস করতে—আদিব ওকে সম্মান করে, ভালোবাসে।
কিন্তু এই কথা? এত সরাসরি, এত বিষাক্ত?

হায়াত ধীরে ধীরে নেহার হাতটা সরিয়ে দিলো নিজের গাল থেকে।
চোখ দুটো জ্বলছে, কিন্তু তাতে ভয় নেই—আত্মসম্মানের দাবী আছে।

সে কাঁপা গলায় বললো,
– তুমি যা বলছো, সেটা যদি সত্যি হয়,ঠিক আছে তাহলে , ওনি আমার নয় আজ থেকে তোমার,আগেও ছিলো আর এখনো । আমি কারো শরীর চেয়ে ভালোবাসি নি, বিশ্বাস চেয়েছি।

ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আদিব হাঁপাচ্ছে—তাড়াহুড়ো করে ছুটে এসেছে।
ভেতর থেকে ঝামেলার আওয়াজ, হায়াতের কাঁপা গলার চিৎকার… আর দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ।

সে ধাক্কা দিলো একবার, দুবার—দরজা নড়লো না।

তখনই সে চিৎকার করে উঠলো—
“Neha! Open the fing door right now!”*
“What the hell are you doing in there? Have you completely lost your damn mind?”

আওয়াজ ভেতরে পৌঁছায়।
নেহা ভেতর থেকে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগোয়। মুখে ঠাণ্ডা এক হাসি, আর ঠোঁটে বিদ্রুপ।

— “Why are you shouting, Adib? I was just talking… nicely.”

আদিব দরজার ও পারে দাঁড়িয়ে রাগে ফেটে পড়ে,
“Talking? You call hurting her ‘talking’? Open the door, Neha. I swear to God, if you don’t…”

“What, you’ll break it?”
নেহা হাসে।
“Go ahead. Break it for her.”

এই কথাটা যেন আগুন ঢেলে দিল আদিবের রক্তে।
সে এক ধাক্কায় দরজায় ঘুষি মারলো—
“You crazy psycho! Don’t make me hurt you. Open the fing door before I do something you’ll regret!”*

ভেতরে তখন হায়াত চুপচাপ দাঁড়িয়ে, চোখে অশ্রু জমে আছে।
নেহা তাকায় হায়াতের দিকে, তারপর বিরক্ত মুখে দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়।

“Fine. Let your hero come rescue you.”
সে দরজাটা খুলে সরে দাঁড়ায়।

দরজা খুলেই আদিব এক ঝটকায় ছাদে ঢুকে আসে। চোখে রাগ, দম ফাটছে।
সোজা গিয়ে হায়াতের সামনে দাঁড়ায়।ছাদে ঢুকেই আদিব থমকে গেলো।হায়াত এক কোণায় মুখ গুঁজে বসে আছে, গালের একপাশটা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। কাঁধ কাঁপছে হালকা, কান্না চেপে রাখার স্পষ্ট চেষ্টা।

এই দৃশ্য দেখে আদিবের ভেতরটা যেন মুহূর্তেই বিস্ফোরিত হলো।

সে ঘুরে দাঁড়িয়ে নেহার দিকে এগিয়ে গেলো—চোখে রাগের আগুন।

নেহা কিছু বলার আগেই —
ঠাসসসসসসসসসসসসসসসসসস।

প্রথম থাপ্পড়।

নেহার মুখ ঘুরে গেলো একপাশে।

ঠাসসসসসসসসসসসসসসসসসস।

দ্বিতীয় থাপ্পড়—আরো জোরে। নেহা হতবাক।

“আদিব! তুমি আমা—”
ঠাসসসসসসসসসসসসসসসসসস।

তৃতীয়টা থাপ্পড় পড়ে তার কথার মাঝখানে।

“I trusted you! I treated you like family!”
আদিব গর্জে উঠলো।

ঠাসসসসসসসসসসসসসসসসসস।

চতুর্থটা পড়ে গেলো — এত জোরে যে নেহা হালকা কেঁপে উঠলো।

সে মুখে হাত দিয়ে পেছনে সরে গেল, চোখে অবিশ্বাস আর অপমান। মুখের একপাশ কেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে।

আদিব দাঁড়িয়ে, বুক উঠানামা করছে রাগে।

তার কণ্ঠ ঠাণ্ডা, কিন্তু গা শিউরে ওঠে এমন বিষে ভরা —
“That was for touching her. For talking about her like that. For making her cry.”

“You’re disgusting, Neha. I never want to see your face again.”

নেহা এবারও কিছু বলার চেষ্টা করলো, কিন্তু আদিব আর এক সেকেন্ডও তাকাল না তার দিকে।

আদিব যখন হায়াতের গালে লাল ছাপ দেখে ছুটে আসে নেহার দিকে, তখন তার ভেতরের সব কষ্ট আর রাগ যেন একসাথে বিস্ফোরণ ঘটায়।

সে এক এক করে চারটা থাপ্পড় মারার পর, দাঁতে দাঁত চেপে নেহার দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলো চুলের মুঠি ধরে বললো —

You fing psycho!**
You’re nothing but a disgusting, jealous b*tch!
Touch her again, and I swear I’ll ruin you!
You think this is love? You’re just a desperate, attention-hungry slut!

নেহা থমকে দাঁড়িয়ে গেলো—চোখ বিস্ফারিত, মুখ কাঁপছে, অপমানে স্তব্ধ।

আদিব আর এক পলকও তাকালো না তার দিকে। যেন নেহা এখন তার কাছে কেবল ঘৃণার নাম।

Get out of my sight before I really lose it.

তারপর সে ধীরে ধীরে হায়াতের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে, নিচু গলায় বললো—
– লাজুকপাখি … look at me, jaan… I’m here now… for you… only you.

*******
ছাদে বাতাস বইছে হালকা, কিন্তু হায়াতের ভেতরের অনুভূতিরা যেন ঝড় হয়ে বইছে। সে চুপচাপ বসে আছে, গালে লাল দাগ—তবে শরীরের চেয়ে তার মন অনেক বেশি পুড়ছে।
– চার বছর আগে… আদিব আর নেহা… ফিজিক্যাল ইন্টিমেট…….

এই একটা কথা তার মাথায় বারবার ঘুরে চলেছে।
আদিবের থাপ্পড়, তার রাগ, তার পাশে এসে বসা—এসব যেন কিছুই পৌঁছাচ্ছে না হায়াতের কাছে।

সে শুধু পাথরের মতো বসে আছে।
রাগ, ঘৃণা, অপমান, বিশ্বাসভঙ্গ—সবকিছু একসাথে জমে গেছে তার চোখে, কিন্তু কান্না এক ফোঁটাও নেই।

আদিব ধীরে ধীরে পাশে বসে তার কাঁধ ছুঁতে যায়,
— হায়াত, প্লিজ… কিছু বলো…বউ, এমন করছো কেনো,,,৷৷

কিন্তু হায়াত সেই স্পর্শও উপেক্ষা করে—তাকে ঠেলে দেয় না, ফেরায়ও না… শুধু বসে থাকে, একদৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে।

ওদিকে নেহা ফুসতে ফুঁসতে ছাদ থেকে বেরিয়ে যায়।
চোখে অপমান, গালে রক্তের ছাপ, আর ঠোঁটে তীব্র বিষ।

নিজের রুমে গিয়ে দরজাটা ধাম করে লাগিয়ে দেয়।
—এই চড়ের বদলা আমি নেবো, আদিব… তুমি আমাকে অপমান করলে, ওকে আমার ওপর জিতিয়ে দিলে … আমি ছেড়ে দেবো না।

নেহার চোখে তখন প্রতিশোধের আগুন।

এদিকে ছাদে হায়াত আর আদিব—
একজন চুপ, ভাঙা বিশ্বাস নিয়ে; আর একজন অনুতপ্ত, ভীত, কাঁপতে থাকা হাতে পাশে বসে।
হায়াত ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালো আদিবের দিকে।

চোখে পানি নয়, বরং একধরনের ভাঙা আস্থা আর নিঃশেষ অনুভূতি।

তার কণ্ঠ অস্পষ্ট, কাঁপা…
— আব্ আপনি… খারাপ…

এই দুইটা শব্দ যেন আদিবের বুক চিরে ঢুকে গেলো।

ঠিক তখনই হায়াতের চোখ উল্টে গেলো, শরীর ঢলে পড়লো একপাশে।

– আফরা….
আদিব চিৎকার করে উঠে পড়লো।

সে ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়াতকে কোলে তুলে নিলো—পাথরের মতো নিস্তেজ হয়ে গেছে ও।
আদিবের মুখে তখন একটাই কথা:

– হায়াত না! না না না… চোখ খোলো! প্লিজ! আমি তোমাকে হারাতে পারবো না…এমন করছো কেনো পাখি, ওই জান,লাজুকপাখি৷

পাগলের মতো কোলে করে হায়াতকে ছাদ থেকে নামিয়ে আনতে লাগলো সে। সিঁড়ি দিয়ে দৌঁড়ে নিচে নামছে, পা কাঁপছে, চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে।

রুমে এসে বিছানায় শুইয়ে দিলো হায়াতকে।
ওর গালে পানি ছিটিয়ে দিলো, কপাল টিপে ধরলো, ধুক ধুক করে ডাকছে—

— হায়াত… প্লিজ… চোখ খোলো… একবার শুধু বলো তুমি ঠিক আছো…

আদিবের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে।আদিব কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে তাড়াহুড়ো করে নম্বর ডায়াল করলো।

– হ্যালো,ডক্টর হাসিব ! প্লিজ, একটু তাড়াতাড়ি আসেন… আমার ওয়াইফ… ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। না না, মাথায় কিছু হয়নি… কিন্তু ওর অবস্থা খুব খারাপ… প্লিজ!হঠাৎ কি হলো বুঝতে পারছি না।

ডাক্তার আসতে সময় নেয়নি। মিনিট পনেরোর মধ্যেই ছুটে আসে।
হায়াত তখনো নিস্তেজ, চোখ বন্ধ।

ডাক্তার স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে হায়াতের নাড়ি, প্রেসার, রেসপিরেশন চেক করে বললো:

– ঘাবড়াবেন না, মি. আদিব। ওর মাথায় কোনো বড় শারীরিক আঘাত নেই। তবে…

আদিব তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো,
– তবে কী ডাক্তার?”

ডাক্তার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ওর ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ পড়েছে। একধরনের mental breakdown বলা যায়। খুব সম্ভবত হঠাৎ চাপ, অভিমান আর কোনো ইমোশনাল শকে ওর সিস্টেম একেবারে ক্ল্যাশ করেছে।এই ধরনের ‘emotional overload’ থেকে সাময়িকভাবে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে। শরীরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মানুষ।

আদিব নিচু গলায় ফিসফিস করে বললো,
– তাহলে… এখন কী করবো?

ডাক্তার ওষুধ দিয়ে বললো,
– ওকে এখন রেস্ট দিন। ওষুধটা দিয়ে দিন ঘুমানোর আগে। একটানা ঘুম দরকার। এরপর আপনি ওর সাথে কথা বলবেন, ওকে বোঝাবেন… ভয় বা কষ্ট না দিয়ে। এখন মনটা ভীষণ ভেঙে গেছে ওর।

আদিব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো,
গলায় কাঁপুনি,
– সব আমার দোষ…

ডাক্তার হালকা করে পিঠে হাত রাখলো,
– ভালোবাসা থাকলে মেরামত সম্ভব। সময় দিন ওকে, সময় দিন নিজেকে।

ডাক্তার চলে গেল।

হায়াত তখনো নিঃশব্দে শুয়ে, নিস্তেজ, নিঃশ্বাস ধীর।
আদিব পাশে বসে কপালে হাত রাখলো, নরম গলায় বললো—
– প্লিজ হায়াত… একবার শুধু জেগে উঠো… আমি সব ঠিক করে দেবো…

হায়াত নিঃশব্দে শুয়ে আছে বিছানায়, চোখ দুটো বন্ধ, মুখটা ক্লান্ত আর ফ্যাকাশে।
আদিব তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে—আঙুলের ছোঁয়ায় থাকছে অপরাধবোধ, অনুশোচনা আর একরাশ ভালোবাসা।

— তুমি কিছু বলো না, কিন্তু আমি বুঝি হায়াত… আমি জানি, আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু প্লিজ, আর না… আমি তোমার মুখের এই নীরবতা সহ্য করতে পারছি না…

কথাগুলো হায়াত শুনছে কি না, জানা নেই—তবু আদিব বলে যাচ্ছে।

******

প্রায় দশ মিনিট পর, আদিব নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল।
একবার ফিরে তাকালো হায়াতের দিকে, তারপর ধীরে ধীরে পা টিপে নেহার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

মুহূর্তখানেক দাঁড়িয়ে থেকে দরজায় টোকা দিলো।

ভেতর থেকে কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর দরজাটা খোলা হলো।

নেহা দাঁড়িয়ে, চোখে পানি শুকিয়ে গেছে, গালে আদিবের থাপ্পড়ের দাগ স্পষ্ট। চোখে ঘৃণা আর জেদ—কিন্তু একটা অদ্ভুত আশা যেন তার দৃষ্টিতে জমে আছে।

সে ঠাণ্ডা গলায় বললো—
— এতক্ষণে মনে পড়লো আমার কথা? এবার কি আমায় ‘আরও’ অপমান করতে এসেছো?”

আদিব গভীরভাবে নেহার চোখে তাকিয়ে বললো—
— হুম তোমার সাথে কথা বলতেই এসেছি। শেষবারের মতো একটু ছুঁয়ে দেখলে মন্দ হয় না।

আদিব দরজাটা জোরে ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লো।
ধাম! করে দরজা বন্ধ করে দিলো পেছনে। প্যান্টের বে’ল্ট খুলে হাতে পেচিয়ে নিলে।

নেহা একটু কেঁপে উঠলো।

– তুমি কী করছো, আদিব ?

নেহার চুল গুলো শক্ত করে মুঠো করে,বে’ল্ট দিয়ে আঘাত করলো আদিব, গভীর গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

– ন’ষ্ট মহিলা তুই কী ভেবেছিলি ? আমি চুপ করে সব সহ্য করবো ? তুই এক অমানুষ স্বামী রেখে এখানে এসেছিস আমার আর হায়াতের সংসার ভাঙতে ? তুই একটা সাইকো! নিজের সংসার ভুলে এখন প্রাক্তনের নামে নাটক করতে এসেছিস ?

একার পর এক চড় পরলে নেহার গালে, ঠোঁট শুকিয়ে গেলো তার , ব্যাথায় যেনো গলায় কোনো শব্দ বের হলো না।
– আহহহ লাগছে আদিব।

আদিব আঙুল তুলে চিৎকার করে বললো,
-আমি হায়াতকে ভালোবাসি! ও-ই আমার স্ত্রী, আমার বর্তমান, আমার ভবিষ্যৎ! আর তুই,হাহহহ তুই একটা বিষাক্ত অতীত, যা আমি অনেক আগেই ফেলে এসেছি!

নেহা এবার কেঁদে ফেললো,
– আমি তোমাকে ভালোবাসি আদিব… এখনো ভালোবাসি… এতটাই যে নিজেকে থামাতে পারি না…

এই কথা শুনে আদিব থমকে দাঁড়ালো। তারপর চোখের দৃষ্টিতে একধরনের অশ্রদ্ধা আর তীব্র ঘৃণা জমে উঠলো।
সে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে গর্জে উঠলো,
– love ? You call this love ?

“You’re fing delusional!”*
“You ruin people’s lives, you break families, and you dare call it love? You sick, selfish, manipulative b*tch!”

তার কণ্ঠে আগুন, গলা রুদ্ধ হয়ে আসছে রাগে।

“Stay the hell away from me, from my wife, and from my goddamn life!”

নেহা হতবাক, কেঁপে উঠলো আদিবের চেহারা দেখে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু এবার কোনো নাটক নেই—
এটা ছিলো তার চরম পরাজয়।

আদিব একদম দরজার দিকে ফিরে গেল,
শেষবারের মতো বললো—
— “You’re a f***ing mistake I’ll never repeat. And now… you’re done.”

হায়াাত ওঠলেই বুঝতে পারবো কি বলেছিস, ওর মুখেই শুনবো।

দরজা খুলে বেরিয়ে গেল সে, পেছন ফিরে তাকায়ওনি।

——–
আদিব ধীরে ধীরে, আলতো পায়ে হায়াতের রুমে ঢুকলো। চারপাশ নিঃশব্দ, কেবল ফ্যানের ঘুঙ্ঘুঙ আওয়াজ।বিছানার ওপর শুয়ে আছে হায়াত। চোখ খোলা, কিন্তু দৃষ্টি স্থির—সোজা মাথার ওপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে।তার হাতটা ধীরে ধীরে কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে, যেন মাথার ভেতরের ভার লাঘব করার চেষ্টা করছে। ঠোঁট নীলচে, মুখটা ক্লান্ত আর ভাবলেশহীন।

আদিব দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ, দরজার কাছে। তারপর ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে নরম গলায় বললো,

– হায়াত… তুমি জেগে গেছো…

হায়াত তার চোখ নামায় না। ফ্যানের দিকে তাকিয়েই থাকে।
আদিব নরম স্বরে বললো,
– পাখি কথা বলো,এভাবে চুপ করে থাকলে আরো খারাপ লাগবে। আদিব আস্তে করে হায়াতের কপালে চুমু খেয়ে মৃদু স্বরে বললো,
— জান, একটু কথা বলো না… প্লিজ।

হায়াত চোখ নামিয়ে রাগ চেপে গলায় ঝাঁঝ এনে বললো,
— সামনে থেকে সরুন। আপনি যা চান, সবই তো হয়… আমার কথা শোনার দরকার হয় না, তাই না।

আদিব এক পা পেছনে সরে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলো হায়াতের দিকে। তারপর নিচু গলায় বললো,
— তোমার কষ্ট আমি বুঝতে পারছি হায়াত… কিন্তু আমি ঠিক করতে চাই সবকিছু।

হায়াত মুখ ঘুরিয়ে নিলো, চোখের কোণ ভিজে উঠছে কিন্তু সে চেষ্টা করছে না দেখানোর।
— সবকিছু ঠিক করার আগেই তো ভেঙে ফেলেছেন… এখন কিসের চেষ্টা?
এই বলে হায়াত হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো।
আদিব এক লাফে এগিয়ে এসে তার হাত ধরে ফেললো।

— হায়াত, প্লিজ… থামো।

কিন্তু হায়াত ততক্ষণে রাগে ফেটে পড়েছে।
চিতকার করে বলে উঠলো,
— হাত ছাড়ুন! বলছি না হাত ছেড়ে দিন!

তার গলা কাঁপছিলো, চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে উঠেছে।
আদিব ভীত চোখে তাকিয়ে ছিলো, আর তখনই হায়াত জুড়ে জুড়ে চিতকার করতে লাগলো —আপনি সবকিছু শেষ করে দিয়েছেন! আপনি বিশ্বাস ভেঙেছেন! আমি আর পারছি না!

সেই মুহূর্তে ড্রেসারের ওপর রাখা ফোনটা তুলে নিলো সে,
সজোরে ছুঁড়ে মারলো ডিভানের উপর —
একটা বিকট শব্দে ফোনটা আছড়ে পড়লো, স্ক্রিনে ফাটল ধরে গেলো।

রুমটা নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলো ফোন ভাঙার শব্দে।
আদিব থমকে গেলো, হাত এখনো হায়াতের কব্জিতে আটকে…
হায়াত ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছিলো, চোখে পানি জমে উঠেছে।
হায়াত জুড়ে জুড়ে চিতকার করে উঠে গেলো, চোখে পানি, মুখে তীব্র যন্ত্রণা।
তারপর হঠাৎ টেবিল থেকে একটা কাচের গ্লাস তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো আদিবের দিকে—

কাঁচ ভেঙে ছড়িয়ে গেলো, আর আদিবের কপাল দিয়ে টুপটুপ করে রক্ত ঝরতে লাগলো।

আদিব এক হাতে কপাল চেপে ধরলো, কিন্তু পিছু হটলো না।
হায়াত তখন আর নিজেকে থামাতে পারছে না।

ড্রেসার, চেয়ার, বইয়ের র‌্যাক— একে একে যেটা সামনে পড়ছে, সেটা সে ছুঁড়ে ফেলছে, ধাক্কা দিচ্ছে, ভাঙছে।
ঘর যেন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলো।

আদিব কাঁপা গলায়, কিন্তু শান্ত স্বরে বললো,
— ফাইন, হায়াত। সব ভেঙে ফেলো। যা যা ভেতরে জমেছে, সব বের করে ফেলো।তুমি যদি এতে শান্ত হও, তবে ভাঙো… আমি থামাবো না।

হায়াত থমকে দাঁড়ালো এক মুহূর্ত।
তার চোখে যেন ধোঁয়া… কুয়াশা… আর অসহায় যন্ত্রণা।

— আপনি বুঝবেন না, কী ভাঙলো আমার ভেতরে…
আপনি শুধু এই দেয়ালগুলোর শব্দ শুনছেন… আমার চিৎকার শুনছেন, কিন্তু আমার নীরব কান্না কেউ শোনে না!

সে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে, মুখে হাত চাপা দিয়ে কাঁদতে থাকে।
আদিব ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, রক্তে ভেজা কপাল, কণ্ঠটা কাঁপছে, তবুও সাহস করে হায়াতের পাশে বসতে চাইল।

সে কাঁপা কণ্ঠে বললো,
— হায়াত… আমি জানি, অনেক কষ্ট দিয়েছি… কিন্তু আম….

ঠাস!!
হঠাৎই হায়াত সজোরে ধাক্কা মারলো আদিবকে।

আদিব ভারসাম্য হারিয়ে একপাশে পড়ে গেলো। তার হাত থেকে রক্ত ঝরছে, কিন্তু সে থমকে তাকিয়ে রইলো হায়াতের দিকে।

ঠিক তখনই হায়াত নিচে পড়ে থাকা ভাঙা কাচের টুকরো তুলে নিলো।
তার চোখে অন্ধকার, তার মুখে আতঙ্ক আর যন্ত্রণা—

এক ঝটকায় সে নিজের হাতের তালুতে কাচ ঢুকিয়ে দিলো।

— না!! হায়াত!!— আদিব চিতকার করে উঠলো, গলার স্বর ফেটে যাচ্ছিল যন্ত্রণায়।

রক্ত ছুটে বেরিয়ে এলো হায়াতের হাতে।
সে কেঁপে উঠলো, চোখ বুঁজে ফেললো ব্যথায়, কিন্তু তবুও কাঁদতে কাঁদতে বললো—
— আপনি আমাকে বারবার মেরে ফেলেছেন… আমি শুধু একবার মরতে চেয়েছি… একবার নিজের মতো করে।

আদিব দৌড়ে এসে তার হাত ধরে ফেললো,
— না হায়াত! তুমি এটা করতে পারো না… আমি… আমি সবকিছু হারাতে পারি, কিন্তু তোমাকে না!

আদিব হায়াতের রক্তাক্ত হাত দুটো নিজের হাতে চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো।

সে অসহায়ের মতো কাঁদতে কাঁদতে হায়াতকে জড়িয়ে ধরলো,
— আমি তো শুধু চাইছি তোমাকে ফিরে পেতে… আমি তো শুধু ভালোবেসেছি, হায়াত… ভুল করেছি, কিন্তু ইচ্ছে করে না… প্লিজ আমাকে একটা সুযোগ দাও…

সে কাঁপা ঠোঁটে হায়াতের কপাল, গাল, চোখ, ঠোঁটের কোণে একের পর এক চুমু খেতে লাগলো—
ভালোবাসার নয়, ভেঙে পড়া এক অপরাধীর ক্ষমাপ্রার্থনা যেনো।

ঠিক তখনই হায়াত সজোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে দূরে ঠেলে দিলো,
চিতকার করে উঠলো—

— আপনি একটা কাপুরুষ! একটা প্রতারক!
বিয়ের আগে আপনি নেহা আপুর সঙ্গে ফিজিক্যাল ইন্টিমেট হয়েছিলেন, তাই না ?

আদিব থমকে গেলো।
চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো হায়াতের দিকে— যেন কেউ হঠাৎ তার ভেতরকার কফিন খুলে দিয়েছে।

কোনো শব্দ বের হলো না তার মুখ থেকে।
শুধু ঠোঁট কাঁপছে, চোখে শূন্যতা।

— চুপ করে গেলেন কেন? উত্তর দিন! আমি জেনে গেছি সব কিছু। আপনি আমার সঙ্গে বিয়ে করলেও, আপনার ভেতরটা এখনও নেহা আপুর কাছে বাঁধা। আপনি ওকে ছাড়তেও পারেন না, আমাকে ভালোবাসতেও পারেন না !

আদিব ধীরে ধীরে নিচু হয়ে বসে পড়লো মেঝেতে।
তার চোখে পানি, ঠোঁটে কাঁপুনি।

আদিব কাঁপা কণ্ঠে বললো,
— হায়াত… তুমি ভুল ভাবছো… প্লিজ বিশ্বাস করো, সব কিছু এতটা সোজা না। যা তুমি ভাবছো, সেটার পুরোটা সত্যি না…।

এই কথা শুনে হায়াত যেন আরও ভেঙে পড়লো।
সে দুহাতে মুখ ঢেকে জোড়ে চিতকার করে কাঁদতে লাগলো।

— সব মিথ্যে! সবকিছু,আমার চারপাশের সব ভেঙে গেছে! আপনি আমার জীবনটাকে একটা মজা বানিয়ে দিয়েছেন!
ভালোবাসা বলে কিছু নেই! আপনি শুধু আমাকে ব্যবহার করেছেন, আর নেহা আপুকে ভালোবেসেছেন!

সে হঠাৎ মাথা নিচু করে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকলো।
শরীরটা কাঁপছে কান্নায়, আর মুখ থেকে বেরোচ্ছে দম বন্ধ করা আর্তনাদ।

আদিব চুপচাপ তাকিয়ে রইলো তার দিকে—
তার নিজের চোখ থেকেও পানি ঝরছে, কিন্তু সে বুঝে উঠতে পারছে না কীভাবে ছুঁতে হবে হায়াতকে আবার…
কীভাবে বোঝাবে, এই মেয়েটা ছাড়া তার সব কিছু শূন্য।

একটা থমথমে নীরবতা ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো,
শুধু হায়াতের কান্নার আওয়াজ আর ব্যথার নিঃশ্বাস ঘরের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে।
হায়াত অঝোরে কাঁদছে, আর আদিব স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
এক মুহূর্ত যেন অনেক দীর্ঘ হয়ে দাঁড়ায়।

হঠাৎ আদিব উঠে দাঁড়ালো, দৌড়ে গেলো আলমারির দিকে।
সে তাড়াহুড়ো করে আলমারির দরজা খুলে কোরআন শরিফ বের করলো।

তার চোখ ভিজে, মুখ কাঁপছে —
সে কোরআন শরিফটা দুহাতে ধরে হায়াতের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।

অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— এই যে কোরআন শরিফ, হায়াত… আমি কসম করে বলছি, আল্লাহর নামে বলছি…
আমার আর নেহার মাঝে কিছুই হয়নি। কিছুই না।তুমি বিশ্বাস না করলে করো না,কিন্তু একবার… একবার আমার কথা শোনো, তারপর আমাকে ঘৃণা করো, যা খুশি করো।
কিন্তু এর আগে না… প্লিজ, হায়াত…

তার কণ্ঠে এতটুকু অভিনয় নেই,
শুধু অসহায়তা, সত্যের আকুতি, আর ভালোবাসার ভাঙা ছায়া।

হায়াত থেমে গেলো এক মুহূর্তে।
তার চোখ কাঁপছে, সে হতবাক, অস্পষ্ট কণ্ঠে বললো—
— কোরআন ছুঁয়ে…

আদিব কাঁদতে কাঁদতে কোরআন বুকের সঙ্গে জড়িয়ে বললো,
— না হায়াত… আমি জানি আমি ভুল করেছি জীবনে,
কিন্তু এই একটা বিষয়ে আমি গর্ব করে বলতে পারি— আমি শারীরিকভাবে কাউকে ছুঁইনি তোমার আগে।
নেহার সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো, কিন্তু সেটা মনের দুর্বলতা ছিলো, পাপ নয়।

———-
চারবছর আগে……

আদিব কোরআন শরিফ বুকের সঙ্গে চেপে ধরে কাঁপা গলায় বললো—

— “চার বছর আগে আমি আমেরিকা গিয়েছিলাম খালার বাসায়। ওখান থেকেই বাকি পড়াশোনা শেষ করি।সেই সময়… হ্যাঁ, নেহা আর আমার মাঝে একটু ভালো লাগা জন্মেছিল।একসাথে থাকতাম, হাসতাম, গল্প করতাম… স্বাভাবিকভাবে একধরনের মায়া তৈরি হয়েছিলো।আমি ভেবেছিলাম, হয়তো ওটাই ভালোবাসা।

আদিব কোরআন শরিফটা এক পাশে রেখে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো, গলা কাঁপছে, চোখে জমে থাকা কান্না ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে—

— আর হ্যা… হায়াত… তুমি যেটা শুনেছো, সেটা পুরোটাই সত্যি না।

নেহা একদিন আমাকে সরাসরি বলেছিলো ফিজিক্যাল ইন্টিমেট হওয়ার কথা।
কিন্তু আমি রাজি হইনি। আমি চেয়েছিলাম সম্পর্ক হোক সম্মান আর ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে, শরীরের উপর নয়।

তারপর… মাস খানেক নেহা আমার সাথে কথা বলেনি।
আমি পাগলের মতো কথা বলতে চেষ্টা করতাম, একেকদিন ওর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম,
মেসেজ করতাম, ফোন দিতাম… কিন্তু ও বুঝতেই চাইত না আমি তাকে কতোটা গুরুত্ব দিচ্ছি।

আমি ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছিলাম হায়াত… আর সেসব অভিমান নিয়ে একদিন দেশে ফিরে এলাম।
আর কিছুদিন পর হঠাৎ নেহার ভাই নোহান আমাকে বললো—
‘ভাইয়া, নেহা এখন আদনান নামের এক ছেলের সাথে রিলেশনে।’

আমি তখন একদম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
যে মেয়েটার জন্য আমি নিজেকে ভেঙে ফেলেছিলাম, সে এত সহজে চলে গেলো…
সেদিন বুঝেছিলাম, যা ছিলো, তা টিকতো না… আর আমি হয়তো মন থেকে কিছুতেই ওকে ভালোবাসিনি, যেটুকু ছিলো মোহ মায়া।

আদিব কাঁপা কণ্ঠে হায়াতের দিকে তাকিয়ে, ভেজা চোখে নিজের কথাগুলো শেষ করতে থাকে—

— তারপর একদিন শুনলাম, আদনান আর নেহার বিয়ে ঠিক হয়েছে।
আমি তখন ভেতর থেকে আবারও একবার ভেঙে পড়লাম…
যে মেয়েটার জন্য একসময় আমি সবকিছু ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম, সে আরেকজনকে বেছে নিলো।

একটা বছর কেটে গেলো…
শুনলাম, ওদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি শুরু হয়েছে।
আদনান নেহাকে বোঝে না, আর নেহা নিজের ইগো আর জেদের মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে…
এক সময় পুরোপুরি বদলে গেলো।

নেহা ধীরে ধীরে সাইকো হয়ে উঠলো…
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না, কথায় কথায় চিতকার, জিনিসপত্র ভাঙচুর, কান্না…
সে আস্তে আস্তে আদনানকে ভুলে যেতে শুরু করলো, কিন্তু…আমাকে ভুলতে পারলো না।

আজও নেহা আমার নাম শুনলে কেঁপে ওঠে।
আদনান এখনো তাকে চায়, কিন্তু নেহার মন আজও আমার কাছে আটকে আছে।

কিন্তু হায়াত…

আমি ওকে চায়নি…যখন শুনলাম ও নতুন জীবন শুরু করেছে, আমি ওকে আর ভালোবাসিনি… আর হায়াত… সেই ব্যর্থতা, সেই কষ্ট… আমাকে একদিন তোমার দিকে নিয়ে এসেছিলো।
তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি প্রথমবার সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝেছিলাম…
তোমার স্পর্শে আমি বুঝি, এই মানুষটার জন্য আমি জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি।”

আদিব হায়াতের সামনে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকলো।

হায়াত নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে তার দিকে… চোখে অশ্রু, মনে ঢেউ।
আদিবের কাঁপা কণ্ঠে বলা প্রতিটি শব্দ যেন হায়াতের বুকের গভীরে গিয়ে আঘাত করছিলো।
তার চোখ দিয়ে চুপচাপ গড়িয়ে পড়ছিলো অশ্রু,
কিন্তু এবার সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।

আদিবের সামনে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো হায়াত।
তার মুখে আর আগের মতো রাগ নেই,
শুধু একটা ভাঙা মানুষ, যে অবিশ্বাস আর অভিমানের দেয়াল পেরিয়ে এখন বুঝতে চাইছে—
ভালোবাসা আসলে সত্যি ছিলো।

এক পা, দুই পা…

আদিব নিচু মাথায় বসে ছিলো তখনও, দম বন্ধ করা অপেক্ষায়।
হঠাৎ সে অনুভব করলো…

দু’টো নরম হাত এসে তার গলা জড়িয়ে ধরলো।
হায়াত তাকে আটকে ধরেছে বুকের মধ্যে, শক্ত করে, কাঁদতে কাঁদতে।

— আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না… আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম…
তাই আপনাকে কষ্ট দিয়েছি, অনেক কষ্ট…
কিন্তু আপনি যদি সত্যি বলে থাকেন… তাহলে আমিও আর দূরে থাকতে পারবো না…

আদিব স্তব্ধ হয়ে গেলো এক মুহূর্ত।
তার চোখে জল, ঠোঁটে এক ফালি হাঁসি, আদিব হায়াতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো, যেন সেই স্পর্শেই সে বেঁচে আছে।
তার কান্না ধীরে ধীরে থেমে আসছিলো, শুধু নিঃশ্বাসে আর হৃদস্পন্দনে লেগে ছিলো আবেগের ঝড়।

– ভালোবাসি জান,লাজুকপাখি, #আমার_হায়াতি আমার সব।

হায়াত যখন মাথা তুলে আদিবের চোখে তাকালো,
আদিব আর নিজেকে আটকাতে পারলো না।ধীরে ধীরে সে এগিয়ে এলো,তার ঠোঁট হায়াতের ঠোঁটে ছুঁয়ে গেলো— এক গভীর, নিঃশব্দ, ব্যথাভরা চুম্বন।

একটা দীর্ঘ মুহূর্ত…
সময়ের ধারা যেন থেমে গিয়েছিলো সেই অনুভবের মাঝে।
হৃদয়ের ভাষা, চোখের ভাষা… সব মিলেমিশে এক হয়ে গেলো।

মিনিট পাঁচেক পর, হঠাৎ হায়াত অনুভব করলো কিছু ভারী যেন তার গায়ে ভর করছে।
সে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো—

আদিব নিঃশব্দে তার বুকের উপর ঢলে পড়েছে।

– কি হলো আপনার, শুনছেন — হায়াত ভয় পেয়ে চিতকার করে উঠলো।

সে বুঝতে পারলো, আদিবের শরীর নিস্তেজ… কপাল ভিজে আছে ঘাম আর শুকনো রক্তে।
তাদের ভেতরে চলা এই আবেগ আর কষ্টের ধাক্কায় আদিবের শরীর আর টিকতে পারেনি।

হায়াত কাঁপা হাতে আদিবের মুখটা তুলে ধরলো, গলা ধরে কাঁদতে লাগলো—
— না না না,ওঠুন না প্লিজ ! আমার কথা শুনুন! আমি তো আপনাকে ছেড়ে দিইনি!আমার ভুল হয়ে গেছে… প্লিজ, চোখ খুলুন!
হায়াত ভয় আর কাঁপুনি নিয়ে এক ঝটকায় আদিবকে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
তার বুক ধড়ফড় করছিল, গলা দিয়ে কান্না উঠে আসছিল, কিন্তু সে নিজেকে শক্ত রাখলো।

দৌড়ে গিয়ে গ্লাসে পানি এনে আদিবের মুখে ছিটাতে লাগলো,
– চোখ খুলুন প্লিজ… আমি আপনাকে কিছুই বলতে দিইনি… আপনি এভাবে যেতে পারেন না!

একটু পরে আদিবের চোখ কেঁপে উঠলো, মুখে অস্পষ্ট স্বর…

— আফরা… আব্ আমার… খারাপ লাগছে…
তার কণ্ঠ যেন অনেক দূর থেকে আসছিল, খুব দুর্বল… নিঃশেষ।

হায়াত থমকে গেলো।
তার চোখ ভরে উঠলো পানি, তবুও সে দ্রুত নিচতলায় কাজের লোকের দিকে দৌড়ে গেলো।
— আলী চাচা! দয়া করে গাড়িটা বের করুন… আদিব ভাইকে হসপিটালে নিতে হবে, এখনই!

আলী চাচা দেরি না করে গাড়ি বের করতে ছুটে গেলো।

হায়াত আবার ঘরে ফিরে এল, আদিবের গা থেকে ওড়না দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বললো—
— আমি সাথে আছি, কিছু হবে না… আপনি কথা দিন, কিছু হবে না…

গাড়ি এগিয়ে চললো হাসপাতালে দিকে,
আদিব হায়াতের কোলের ওপর মাথা রেখে অর্ধচেতন অবস্থায় ফিসফিস করে বললো—
— তুমি আছো তো… তাই আমি ভয় পাই না…

হায়াত আদিবের সাড়া মুখে চুমু দিতে লাগলো৷

#চলবে..