আমার হায়াতি পর্ব-১৪

0
7

#আমার_হায়াতি
পর্ব : ১৪
লেখিকা : #Nahar_Adrita

এলার্ট……..🚫

হায়াতের কোলেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে আদিব। তার মুখের রঙ ফ্যাকাসে, নিঃশ্বাস যেন খুব ধীর আর ভারী। হায়াত চোখে পানি নিয়ে আদিবের মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে রেখেছে। গাড়ির গতি বেড়েই চলেছে।

ড্রাইভার কাকা চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
– মামণি, আর একটু কষ্ট করেন, সাভার সুপার হসপিটাল চলে এসেছি।

গাড়ি থামতেই হায়াত দরজা খুলে চিৎকার করে উঠলো,
— কেউ একজন প্লিজ হেল্প করুন! আমার হাজবেন্ড… ও নিস্তেজ হয়ে গেছে !

দুজন গার্ড আর এক জন নার্স দৌড়ে এসে স্ট্রেচার নিয়ে আসলো। হায়াত কাঁপা হাতে আদিবকে নামাতে সাহায্য করলো, তার কণ্ঠ কেঁপে উঠলো,
— বাঁচান ওনাকে… প্লিজ, ওনার কিছু হলে আমি…!

নার্স দ্রুত বললো,
— ম্যাডাম, চিন্তা করবেন না। আমরা দেখছি। আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন।

হায়াত দৌড়ে গেলো পেছনে স্ট্রেচারের পাশে। চোখে শুধু প্রার্থনা— আল্লাহ, তুমি আমার আদিবকে কিছু হতে দিও না…

হায়াত কাঁপা হাতে ফোনটা বের করলো। চোখে ঝাপসা পানি, ঠোঁট কাঁপছে। আদিবের নিস্তেজ মুখটা একবার দেখে আবার ফোনের স্ক্রিনে তাকালো। শশুর-শাশুড়ীর নামটা দেখে বুকটা হু হু করে উঠলো। সে “আব্বু” নামটা ট্যাপ করলো।

রিং হতে না হতেই ফোনটা রিসিভ করলেন মি. চৌধুরী।
— হায়াত মা, সব ঠিক আছে তো ?

হায়াত কান্নায় ভেঙে পড়লো, কণ্ঠ কাঁপা, গলা রুদ্ধ হয়ে আসছে।
— আব্বু… আদিব… ওনি কিছু বলছে না… আমি… আমি হসপিটালে এনেছি… প্লিজ আপনারা আসেন… প্লিজ…

ওপাশে কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দ। এরপর মিসেস চৌধুরীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা গেলো,

— হায়াত ? মা কী হয়েছে ? আদিব কই ? প্লিজ ঠিকঠাক বলো!

হায়াত কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— সাভার সুপার হসপিটালে আছি আম্মু… ডাক্তাররাও কিছু বলেনি এখনো… আম্মু ওর অবস্থা ভালো না…

মি. চৌধুরী এবার গম্ভীর গলায় বললেন,
— হায়াত, মাথা ঠাণ্ডা রাখো মা, আমরা এখনই রওনা দিচ্ছি। তুমি ওর পাশে থাকো, সাহস হারাবে না। কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে জানিও।

হায়াত ফোনটা বুকের কাছে চেপে ধরলো, চোখ দিয়ে থেমে থেমে অশ্রু ঝরছে। স্ট্রেচারটা ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে— আর হায়াত দৌড়ে আবার আদিবের পিছু নিলো। মনে শুধু একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে— ওনার কিছু হলে আমি বাঁচবো না…
হাসপাতালের করিডোরে টানটান উত্তেজনা। হায়াত স্ট্রেচার যেদিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেদিকেই বারবার তাকিয়ে বসে আছে। তার চোখ ফুলে উঠেছে কান্নায়, ঠোঁট কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে। শশুর-শাশুড়ী তখনো আসেনি, শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস যেন সারা হাসপাতালের বাতাস ভারী করে রেখেছে।

———–

ঘন্টা খানেক পর কেবিনের দরজা খুলে বের হলেন ডাক্তার। হায়াত তখন কেবিনের বাইরে এক কোণে বসে, দুহাত জড়িয়ে ধরে কাঁপছিলো। ডাক্তারের পা দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়ালো।

— ডাক্তার ! ওনি কেমন আছেন ? প্লিজ বলুন না… গলা কেঁপে উঠলো হায়াতের।

ডাক্তার গম্ভীর মুখে বললেন,
— আপনার হাজবেন্ডের অবস্থা এখন স্থিতিশীল, কিন্তু একটু সিরিয়াস ছিল। মাথার সামনের দিকে ধাক্কা লেগেছে— আঘাতটা বাইরে থেকে বড় মনে না হলেও ভেতরে মাইল্ড নিউরোলজিক্যাল প্রেশার তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, উনি হঠাৎ মানসিকভাবে ভীষণ চাপের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন, আর সেটাই তার ব্রেইনে বড় ধাক্কা দিয়েছে।”

— মা্ ম মানে… ওনার ব্রেইনে কিছু হয়েছে ?” — হায়াত চোখে পানি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

— না, রক্তক্ষরণ হয়নি, কিন্তু ওর মানসিক অবস্থা খুব ভঙ্গুর। আমরা এখন মানসিক স্ট্রেস পর্যবেক্ষণ করছি। তার উপর বাঁ হাতের গভীর কাটা ক্ষতও ছিল— আমরা সেলাই করে বেন্ডেজ করে দিয়েছি।”

হায়াত ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।
— এখন আমি কি করলে ওনি সুস্থ থাকবে….

ডাক্তার সহানুভূতির কণ্ঠে বললেন,
— আপনি ওর পাশে থাকুন। কথা বলুন, ওকে বুঝতে দিন— সে একা না। এক্ষেত্রে পরিবার আর মানসিক সাপোর্টই সবচেয়ে বড় ওষুধ।

দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে হায়াত কেবিনের দরজার সামনে রাখা চেয়ারে বসে পড়লো। চোখদুটো লাল, ক্লান্তি আর কান্নায় শুকিয়ে যাওয়া মুখ। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। হাসপাতালের করিডোরে লোকজন আসা-যাওয়া করছে, কিন্তু হায়াত যেন কিছুই দেখছে না। তার সব মনোযোগ এখন দরজার ওপারে, আদিবের নিস্তব্ধ ঘুমন্ত মুখের দিকে।

ঠিক সেই মুহূর্তে করিডোরের একপ্রান্তে হঠাৎ কিছু কোলাহল শোনা গেলো।

— “ওনারা আসছে…” — হায়াত আস্তে বললো নিজের মনে।

হাসপাতালের স্লাইডিং গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন আদিবের বাবা-মা, সঙ্গে চাচা-চাচীও। মিসেস অরোরা ছুটে এসে হায়াতকে জড়িয়ে ধরলেন।

— আমার বাচ্চা কই মা,আদিব কই? কেমন আছে সে, গলায় আতঙ্ক ও কান্না মিলিয়ে একটা ঝাঁপসা কণ্ঠ।

হায়াত নিজেকে শক্ত করে বললো,

— আম্মু…ওনার মাথায় আঘাত লেগেছে… আর মানসিক চাপও… হাতেও গভীর কাটা ছিল… এখন ওনি ঘুমাচ্ছেন… ডাক্তার বলেছে ক্রিটিকাল না, কিন্তু বিশ্রাম দরকার।

মি. চৌধুরী কপাল চেপে ধরে নিচু গলায় বললেন,

— আমার ছেলেটা তো মুখ ফুটে কিছুই বলে না… সব নিজের ভেতর জমিয়ে রাখে… এমন একদিন তো হতেই হতো…

– আসলে আব্বু আজ আমাদের মাঝে ঝগড়াও……

মিসেস অরোরা হায়াতকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

– হুসস আম্মু এখন এসব বলো না,বাড়ি গিয়ে শুনবো।

চাচা চাচীও উদ্বিগ্ন মুখে কেবিনের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। চাচী বললেন,

— হায়াত মা, তুই অনেক সাহসের কাজ করেছিস… ঠিক সময়ে ওকে হাসপাতালে এনেছিস। তুই না থাকলে আজ কি হতো…

হায়াত চোখ মুছে কাঁপা গলায় বললো,
— হু।

মিসেস অরোরা হায়াতের মুখটা হাত দিয়ে ধরলেন।

— মা, তুমি ওর কাছে থাকো… আমরা সবাই আছি… এখন ওর জন্য শুধু ভালোবাসা, ধৈর্য আর পাশে থাকার দরকার…

হাসপাতালের করিডোরে তখন নীরবতা। কেবল ঘড়ির কাঁটার টিকটিক আর প্রত্যাশা— কখন আদিব চোখ খুলবে।হাসপাতালের করিডোরে সবাই যখন কেবিনের বাইরে ভীড় করে উদ্বিগ্নভাবে দাঁড়িয়ে, তখন হঠাৎ মিসেস অরোরা চারপাশে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বললেন,
— এক মিনিট… নেহা কোথায়, তোমাদের সাথে আসেনি ?

হায়াত আস্তে ধীরে সবকিছু খুলে বললো সবাইকে। মিসেস অরোরা যেনো থমকে গেলো। কি বলবে, কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবা কিছু বুঝে ওঠতে পারলেন না।

মিসেস অরোরা হতবাক, হায়াতের চোখে চোখ রেখে অপরাধবোধে গুম হয়ে আছেন। করিডোর জুড়ে নীরবতা।ঠিক তখনই করিডোরের এক প্রান্তে হঠাৎ হইচই শুরু হলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছে তিনজন— আদিবের ফুপাতো দুই বোন। জান্নাত, শম্পা আর তার স্বামী।

জান্নাত রাগে গজগজ করতে করতে বলছে,

— এখানে যা হচ্ছে সব শুনেছি আমরা, আদিব ভাই হাসপাতালে, আর দোষ দেয়া হচ্ছে নেহা আপুকে! এটা তো বরদাশত করা যায় না,

খালিদ গলা চড়িয়ে বললো,

— হায়াত সব নাটক করছে। ও-ই মানসিক চাপ দিয়েছে ভাইয়াকে। এখন আবার দোষ চাপাচ্ছে নেহা আপুর ওপর।

শম্পা দুই হাতে কোমর ধরে বললো,
— একজন মেয়ে হয়ে আরেক মেয়েকে এত নিচে নামায়? একটু লজ্জা থাকা উচিত হায়াত তোমার!

হায়াত মাথা নিচু করে বসে ছিল। কথা শুনে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। তার চোখ লাল, কিন্তু মুখে অদ্ভুত এক শান্তি।

— আপনারা কী শুনেছেন জানি না, কিন্তু আমি কোনো গল্প বানাইনি। আমি যা শুনেছি ওনার মুখে, তাই বলেছি।

জান্নাত এবার ঠাস করে বললো,

— তাই নাকি, এখন তুমি একাই সত্যি আর বাকিরা সব মিথ্যে?

ঠিক তখনই মিসেস অরোরা উঠে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠলেন,
— চুপ করো সবাই! হায়াত যা বলেছে, আমি বিশ্বাস করি। আজ আমি বুঝেছি, আমার ছেলেটা একা ছিল— কারণ ওর পাশে থাকার ভান করেছিলো তোমরা….নেহা ও একটা বেহায়া….

সবাই থমকে গেল। চাচা গম্ভীর গলায় বললেন,

— অরো আপা, এই মুহূর্তে দরকার নয় এসব তর্কের। ওর জীবন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কার দায়, কার সম্মান— সেটা পরে দেখা যাবে।

হায়াত নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার কেবিনের দিকে তাকালো— তার চোখে এখন আর দুর্বলতা নেই, আছে আগুন।

——-

রাত ১টা। হাসপাতালের করিডোরে আলো ম্লান, সবার চোখে ক্লান্তি। আদিব তখনও ঘুমে অচেতন, স্যালাইন চলছে শান্তভাবে। বাইরে ভারী নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে নার্সদের ধীর পায়ের শব্দ।

মিসেস অরোরা চেয়ার থেকে উঠে এসে হায়াতের পাশে বসলেন। হায়াত তখনও ওর কপাল ধরে বসে আছে, চোখ লাল, কাপড় মলিন, হাতে স্যালাইনের পাইপ লেগে ছিল বলে ওর হাতেও কেটে গেছে, হালকা রক্তের দাগ।

— মা, চলো… তুমি একদম বিধ্বস্ত হয়ে গেছো। এই অবস্থায় তুমি ওর পাশে থাকতে পারবে না। আমার এক বান্ধবীর বাসা এখানেই কাছাকাছি। চলো, গোসল করে একটু পরিষ্কার হও, ওর জন্য কিছু দরকারি জিনিসও আনতে হবে।

হায়াত ক্লান্ত গলায় বললো,
— আমি ওনাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না আম্মু।

মিসেস অরোরা হাত ধরে বললেন,
— আমি আছি তো মা… তুমিই যদি দুর্বল হয়ে পড়ো, তাহলে আদিব কার ওপর ভরসা করবে ? একটু সময় দাও নিজেকে।

শেষমেশ হায়াত রাজি হলো।

তারা দুজনেই গাড়িতে উঠলো। চারপাশ নিস্তব্ধ, শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর এক ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে গাড়ি থামলো। দরজা খুললেন মিসেস অরোরার বান্ধবী, একজন শান্ত-স্বভাবের মহিলা।

— ওহ্, হায়াত তো একদম ভেঙে পড়েছে… তুমি ভেতরে এসো মা।

হায়াতকে আলাদা একটা বাথরুমে নেওয়া হলো। পরিষ্কার জামা, তোয়ালে, অল্প গরম পানি— সব প্রস্তুত। গোসল শেষে হালকা ধবধবে একটা সালোয়ার কামিজ পড়িয়ে দেওয়া হলো ওকে। হায়াতের হাতে নিজে ব্যান্ডেজ করলেন মিসেস অরোরা, যেখানটায় নার্সিং পাইপে কেটে গিয়েছিল।

একটা ব্যাগে তারা দরকারি কিছু জিনিস ভরলেন— চুলের ব্রাশ, ওড়না, আদিবের জন্য একজোড়া জুতো ও পাতলা চাদর।

ফিরতি পথে গাড়ির জানালায় হায়াত চুপচাপ তাকিয়ে ছিল। শহরের আলো-আঁধারিতে তার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল শুধু একটাই কথা—যতদিন আদিব শ্বাস নেয়… আমি ওর পাশে থাকবো…

রাত প্রায় ২টা। হায়াত আর মিসেস অরোরা দরজার সামনে এসে পৌঁছালো— সদ্য গোসল সেরে, হাত ব্যান্ডেজ করা, পরিপাটি হায়াত একটু শান্ত কিন্তু চোখে গভীর ক্লান্তি।

কেবিনের দরজার সামনে অদ্ভুত এক হট্টগোল। একজন চিৎকার করছে— আর নার্সরা চারপাশে তাকিয়ে।

হঠাৎ করেই সবার চোখ ধাঁধিয়ে এক চেহারা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলো… নেহা! মুখ লাল, চোখ পাগলের মতো, চুল এলোমেলো। সরাসরি দৌড়ে এসে হায়াতের সামনে দাঁড়াল।

— এই ফকিন্নি! তোর জন্যই আমার আদিব আজ হাসপাতালে,তুই বউ না, বিষ!— বলে সজোরে হায়াতের কাঁধটা ধাক্কা দিল।

হায়াত হতবাক হয়ে পিছিয়ে গেল। মিসেস অরোরা হতচকিত। চারপাশ থমকে গেল মুহূর্তে।

নেহা এবার ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজিতে চিৎকার শুরু করলো,

— “You low-class attention seeker! You trapped Adib and now you’re playing the victim? You’re just a pathetic little—”

ঠাসসসসসসসসস!!
এক তীব্র শব্দ বাতাস কেটে ছড়িয়ে পড়লো করিডোরে।

মিসেস অরোরা সজোরে এক চড় বসালেন নেহার মুখে।

সবাই স্তব্ধ।

— “Enough, Neha, — গর্জে উঠলেন তিনি, চোখে অগ্নি।Shame on you! তুমি কীভাবে এতটা নিচে নামলে? এই মেয়েটি আজ আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছে, আর তুমি? তুমি তার জীবনের বিষ! তুমি আমার বোনের মেয়ে বলে সব সহ্য করেছি— আজ আর না।

নেহা চোখে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। চড় খাওয়ার পর যেন হুঁশ ফিরেছে।

মিসেস অরোরা এগিয়ে গিয়ে হায়াতের হাত ধরলেন।
— এই মেয়েটা, হায়াত, আজ যা করেছে… আমি জীবনেও শোধ দিতে পারবো না। আজ থেকে সে শুধু আমার ছেলের বউ না— আমার মেয়েও।

হায়াতের চোখ দিয়ে নীরব অশ্রু গড়াতে লাগলো।
নেহা একবার চারপাশে তাকিয়ে চুপচাপ সরে যেতে লাগলো— মুখের সেই দম্ভ, অহংকার, সব যেন থেমে গেছে এক চড়ের ঝড়ে।

চাচা ধীরে বলে উঠলেন,
— সত্যি আজকে দাঁতের মধ্যে থেকে বিষ বের হয়ে গেছে…

আর করিডোরে আবার সেই নিস্তব্ধতা নেমে এলো— এবার অনেক হালকা, শান্ত।নেহার মুখ রাগে তেতে আছে, চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে, ঠোঁট কাঁপছে সংবরণ করতে না পারা ক্ষোভে। মায়ের চড়ের পরেও সে থামেনি— বরং আরও ফুসে উঠেছে।

— আমি আর এক মুহূর্তও এই বাড়িতে থাকবো না… এখনই গ্রামে চলে যাবো, এখনই ! — বলে চিৎকার দিয়ে রুমালটা চোখে চেপে ধরলো সে।

হাসপাতালের করিডোরে সবাই স্তব্ধ, কেউ আর নেহার চোখে চোখ রাখতে পারছে না। একমাত্র রাগী নিঃশ্বাসেই তার জেদ টের পাওয়া যাচ্ছে।

মি. চৌধুরী, যিনি এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, ঠান্ডা গলায় বললেন,
— ঠিক আছে নেহা, তুমি যেতে চাইলে যাও। আমি গাড়ি দিচ্ছি, ড্রাইভার রেডি থাকবে।

নেহা একবার তাকালো তার আঙ্কেলের দিকে— কিছুটা হতবাক, কারণ সে হয়তো আশা করছিল কেউ তাকে থামাবে, আদর করে বোঝাবে।

কিন্তু কেউ না… কেউ একটা শব্দও করলো না।

— ঠিক আছে… আমি যাচ্ছি। তোমরা সবাই মিলে এখন ও ফকিন্নিকে বউ বানাও… আমার কিছু যায় আসে না! — বলে দ্রুত পেছনে ঘুরে হাঁটতে লাগলো।

মিসেস অরোরা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেন— যেন একমাত্র উত্তর এটুকুই, “তোমার সিদ্ধান্ত, তোমার পরিণতি।”

একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেললেন হায়াত, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না।

একজন কাজের লোক এসে জানালো,
— গাড়ি নিচে দাঁড়িয়ে গেছে, ম্যাডাম।

নেহা নিচে নেমে গেলো………

হাসপাতালের করিডোর তখন একদম স্তব্ধ। নেহা চলে গেছে, সবাই যেন নিঃশ্বাস চেপে আছে। হায়াত চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে, মিসেস অরোরা তার পাশে হাত রেখে দাঁড়ানো।

এমন সময় কেবিনের দরজা খুলে একজন নার্স বেরিয়ে এলেন। মুখে হালকা হাসি।

— স্যার, ভালো খবর। মিস্টার আদিবের জ্ঞান ফিরেছে।

সবাই একসাথে নড়ে উঠলো। মিসেস অরোরা বিস্মিত হয়ে বললেন,
— ” জ্ঞান ফিরেছে আমার বাবুর ?

হায়াত যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। চোখ বড় বড় করে নার্সের দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়াল কেবিনের দরজার দিকে।

চাচা, চাচী, জান্নাত, খালিদ, শম্পা— সবাই দুশ্চিন্তায় থাকলেও মুখে একটা স্বস্তির ছাপ।

মিসেস অরোরা হালকা হেসে হায়াতের কাঁধে হাত রাখলেন,
— চলো মা……

হায়াত একবার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে সকলের সাথে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

আদিবের চোখ একটু একটু করে খুলে আবার চারপাশে তাকাল। সবাই দাঁড়িয়ে, কারো মুখে উদ্বেগ, কারো চোখে জল। হায়াত তার পাশে বসে হাত ধরে রেখেছে।

হঠাৎ আদিব আস্তে করে নিজের হাত নাড়াতে গেল, তখনই মুখটা কুঁচকে উঠলো — ব্যথা! গভীর ক্ষতের জ্বালা তীক্ষ্ণভাবে মনে করিয়ে দিল তাকে।

— “আঃ…” — আদিব দাঁতে দাঁত চেপে শব্দ করলো।

তারপর চোখ মেলে রাগী ভঙ্গিতে চেয়ে বললো,

— এই বা’লের কেনোলা খুলে দাও! কেমন প্যাঁচিয়ে রাখছে… আর সবাই বাড়ি যাও।আমি একদম ঠিক আছি, হায়াত থাক, বাকিদের দরকার নাই এখানে,তোমরা বাড়ি যাও।

ঘর হঠাৎ থম মেরে গেল। সবাই বিস্ময়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে। এমন ভাষা, এমন ধাঁচে কথা — আদিবের অভ্যাস নয় সাধারণত, কিন্তু যন্ত্রণার সাথে মানসিক ধাক্কাও যে এসেছে, তা স্পষ্ট।

মিসেস অরোরা একটু গম্ভীর স্বরে বললেন,
— আদিব, এইভাবে কথা বলতে নেই বাজান, তুমি অসুস্থ।

আদিব কাঁপা কাঁপা গলায় বললো—
— আমার মাথা ধরছে, হাত ব্যথা করছে, প্লিজ… আমার হায়াত থাকুক, বাকিরা একটু সময় দাও আমাকে…

মি. চৌধুরী মাথা নেড়ে সবাইকে ইশারা করলেন।
— চলো সবাই, ছেলেটা একটু নিজের মতো থাকুক।”

চাচা, চাচী, খালিদ, শম্পা— সবাই একে একে বেরিয়ে গেলেন।
মিসেস অরোরা হায়াতের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
— ওর খেয়াল রাখিস মা…

হায়াত নীরবে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালো।

দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। কেবিনে এখন শুধু হায়াত আদিব আর নার্স। আদিব নার্সকে দেখেই একটু মুচকি হেসে বললো,

— আপনি তো অনেক সুন্দর, তবে আমার বউটা আরও বেশি সুন্দর।

তারপরে কেমন ধ্বনিতে মিষ্টি হাওয়ার মতো গলায় যোগ করলো,
– এখন আমার বউকে খাবো আমি, আপনিও আপনার স্বামীর কাছে যান।

নার্স হঠাৎ থমকে গেলেন, চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলেন, আর মৃদু লজ্জিত হয়ে হালকা হেসে বললেন,
— স্যার… আমি তো তো… আমার স্বামী…

এই কথায় হায়াতও পাশে একটু বিস্ময়ে কাঁপলো। ওর চোখে মিশে গেলো মৃদু রাগ আর লজ্জার ছাপ।

আদিব শান্ত গলায় বললো,
— দেখছো, সবাই নিজের জায়গায় থাকা ভালো।

আদিব হাতের কেনোলা খুলে একটা ওয়ান টাইম টেপ লাগিয়ে নিলো হাতে, আদিব হায়াতের দিকে তাকালো,সাদা পরী লাগছে, মানুষ চিন্তা করলে শুকিয়ে যায়, আর তার বউকে দ্বিগুণ সুন্দর লাগছে। কিছু একটা ভেবে নার্স কল বাটন চাপলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সাদা অ্যাপ্রোন পরা নার্স এসে দাঁড়াল কেবিনে।

আদিব কাঁপা গলায় কিন্তু রাগ চেপে বললো,
— একটা কথা কানে তুলে নেন। সকাল না হওয়া পর্যন্ত এই কেবিনে যেন কেউ না আসে। কেউ না, দরকার হলে বাইরে গার্ড বসিয়ে দিন।

নার্স একটু থতমত খেয়ে বললো,
— আচ্ছা স্যার… কিন্তু…

আদিব চোখ বড় করে তাকালো,

— কত টাকা লাগবে বলুন! কত টাকায় আপনারা শান্তি কিনে দেন এই হাসপাতালটায় ? হিসাবটা বলেন, দিয়ে দিচ্ছি। শুধু আমাকে আর আমার বউকে একা থাকতে দিন ।

আদিব হায়াতের চোখে তাকালো— সেখানে কষ্ট, ভয় আর ভালোবাসা একসাথে মিশে আছে। একটু নরম গলায় বললো,
— “আমার মাথা আর কিছু নিতে পারছে না হায়াত… শুধু তুমি থাক, আর কেউ না…ডক্টরও না।

নার্স ধীরে মাথা নেড়ে বললো,
— ঠিক আছে স্যার, আমি ইনচার্জকে জানিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আপনার রেস্ট দরকার।

নার্স বেরিয়ে গেলে দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।
এখন চারপাশটা নিঃস্তব্ধ। কেবিনে শুধু হালকা আলো আর আদিব-হায়াতের শ্বাসের শব্দ।

আদিব একটু দুষ্টু হেসে বললো,
— লাজুকপাখি, তোমাকে এখনই খাবো।

হায়াত চোখ বড় করে তাকিয়ে রেগে বললো,
— আপনি তো অসুস্থ !

আদিব মুখে মৃদু হাসি রেখে বললো,
— তুমিই তো আমার ওষুধ, তুমি থাকলে সব যন্ত্রণা ভুলে যাই… অসুস্থতা তো কিছুই না।

হায়াত একটু লজ্জা পেয়ে থমথমে গলায় বললো,
— কিন্তু… সত্যি, একটু বিশ্রাম করুন,শরীরের খেয়াল রাখুন।

আদিব হাত বাড়িয়ে হায়াতের গালে হালকা স্পর্শ করলো,
— তু্মি না থাকলে এই সব অসম্ভব… এখন আমার দরকার শুধু তোমাকে। আদিব ফিসফিস করে বললো,
– ব্যাথা হাতে আর মাথায়, ওখানকার সব ঠিকি আছে।আদিব আস্তে আস্তে হায়াতকে বুকে চেপে ধরলো, হায়াত এক ফালি হাসি ঝুলিয়ে আদিবের সাড়া মুখে চুমু খেতে লাগলো। আদিব হায়াতের গলায় জুড়ে জুড়ে ঠোঁট ছুইয়ে দিতে লাগলো, মূহুর্তের মধ্যেই গলায় দাগ হয়ে গেলো,আদিব ওড়না সড়াতে যাবে তার আগেই হায়াত নিজেই ওড়নাটা বুকে থেকে ফেলে দিলো, আদিব ভ্রু কুচকে বললো,
– বা’লের চিন্তা করে ছোট করে ফেললে,এখন বড় করতে হবে।
– ইসস ওনি নাকি অসুস্থ।
হায়াত আদিবের চুল হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিলো। হায়াত কামিজটা খুলে ফেললো, আদিব হায়াতের বক্ষঃস্থলে মুখ ডুবিয়ে দিলো। আদিব হায়াতের চুল ধরে জুড়ে চাপ দিলো,হায়াতের চোখে পানি এসে পড়লো, হায়াত কাঁশতে লাগলো,
– খেলমু না সরেন।
– কেনো পাখি কি হয়েছে।
– গলায় ব্যাথা, এ্যাাাআআআআআআআ।
– আচ্ছা সরি বউ, আসো এবার আমি।

আদিবের আঙুল ছুঁয়ে গেল সাড়া শরীরে যেখানে হায়াতের নিঃশ্বাস এলোমেলো হয়ে ওঠে, শরীর যেন নিজের ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। আদিব আস্তে আস্তে সর্বাঙ্গে মুখ ডুবিয়ে দিলো,হায়াতের হাত আপনা আপনিই আদিবের চুলে চলে গেলো। আদিব জুড়ে জুড়ে নিশ্বাস নিয়ে ঘ্রাণ নিতে লাগলো, হায়াত ব্যাথায় মুখ দিয়ে আহহহহহহহহহ মূলক শব্দ উচ্চারণ করলো,আদিব তাড়াতাড়ি করে ঠোটে ঠোঁট পুড়ে নিল। কেবিনের সাদা চাদর সাক্ষী হলো তাদের কুসুম গুচ্ছের আবরণের।

————

সকাল ছয়টা,হাসপাতালের করিডোরে হালকা আলো ফুটেছে।বাইরে গাড়ির শব্দ, একের পর এক কাক ডাকছে দূরে কোথাও।
এই সময়ই হায়াতের মোবাইলে বেজে উঠলো কল—চৌধুরী বাড়ি থেকে গাড়ি এসে গেছে, ওদের নিতে।

হায়াত ধীর পায়ে আদিবের কেবিনে ঢুকলো।
আদিব জানালার পাশে তাকিয়ে ছিলো চুপচাপ। হায়াত বললো,
“চলুন, গাড়ি এসে গেছে… বাড়ি যাই…”

আদিব একবার হায়াতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো,
“তুমি থাকলে, যেকোনো জায়গাই আমার বাড়ি…”

হায়াত চোখ নামিয়ে ফেললো লজ্জায়।

মিনিট দশেক পর নার্স এসে ছাড়পত্র দিয়ে গেলো।
মিসেস অরোরা, মি. চৌধুরী বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
আদিব হায়াতের কাঁধে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটলো—গায়ে এখনও হাসপাতালের গন্ধ লেগে।
গাড়ির দরজায় উঠে বসার আগে আদিব শেষবারের মতো হাসপাতালের দিকে তাকালো,
যেন কিছু স্মৃতি রেখে যাচ্ছে সেখানে—
ব্যথা, অভিমান, আর হায়াতের ভালোবাসার নিঃশব্দ সাক্ষ্য।

গাড়ি ধীরে ধীরে চৌধুরী বাড়ির পথে রওনা দিলো…
গাড়ির ভেতর হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে, কিন্তু আদিবের শরীর যেন ঘামছে অকারণে।

হাতটা এক পাশে রেখে হেলান দিয়ে বসলো সে, তবুও ব্যথাটা যেন হাড়ের ভেতরেও কাঁপুনি ধরাচ্ছে।
হায়াত পাশে বসে চুপচাপ তাকিয়ে, চোখে উৎকণ্ঠা—মুখে কিছু বলছে না, কিন্তু হাতটা ধরে রেখেছে শক্ত করে।

আদিব হঠাৎই একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হাফসাফ করতে লাগলো।
মুখ থেকে নিঃশ্বাস যেন ভারী হয়ে বেরোচ্ছে, চোখ দুটো আধবোজা, ক্লান্ত আর অস্থির।

হায়াত উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
— আপনি ঠিক আছেন ?
আদিব ধীরে মাথা নাড়িয়ে বললো,
— কিছু না জান.. মাথাটা ভার লাগছে, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে…

হায়াত তৎক্ষণাৎ পানির বোতল তুলে ধরলো,
“এই নিন, একটু পানি খান…

আদিব এক চুমুক খেয়ে বললো,
“সব ঠিক হয়ে যাবে তো, হায়াত ?

হায়াত চোখের কোণে জল চেপে রেখে হাসার চেষ্টা করলো,
— হ্যাঁ, ইনশাআল্লাহ… আমি আছি তো আপনার পাশে… সব ঠিক হয়ে যাবে।

হঠাৎ গাড়ির ভেতরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।

আদিব হালকা কেশে উঠলো, তারপর এক ঝটকায় হায়াতের কোলের দিকে হেলে পড়ে গেল—
পরক্ষণেই তার মুখ থেকে এক প্রবল বমি!
হায়াত আঁৎকে উঠলো, আচমকা উষ্ণ, ভারি বমির স্পর্শে শিউরে উঠলো সে।

তারপর নিজেকেও সামলাতে না পেরে, চোখ-মুখ চেপে ধরেও পারলো না—
হায়াত নিজেও বমি করে দিলো।

ওয়াকককককককককককক….

এক মুহূর্তের ভেতর গাড়ির ভেতরটা যেন ভরে উঠলো ঘৃণ্য, বিব্রতকর, এক অসহ্য গন্ধে।

মিসেস অরোরা সামনে থেকে ঘুরে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন,
– বাজান!

রাকিব চৌধুরী সামনের সিট থেকে ফিরে তাকিয়ে গেলেন হতবাক চোখে—
সেকেন্ডখানেক কিছু বুঝতেই পারলেন না তিনি।
তারপরই দ্রুত বললেন,
— গাড়ি থামাও ! এখনই !

ড্রাইভার কাকা ঝটপট ব্রেক কষে গাড়ি এক পাশে দাঁড় করালেন।
মিসেস অরোরা দরজা খুলে হায়াতকে টেনে বের করলেন গাড়ি থেকে,
আর রাকিব চৌধুরী নিজে হাতে ধরে আদিবকে বের করলেন।

হায়াত কাঁপা গলায় বললো,
— ওনার মাথা ঘুরছিল, আমি… আমি জানতাম না…

মিসেস অরোরা তৎক্ষণাৎ ওড়না দিয়ে হায়াতের মুখটা মুছে দিলেন,
— শান্ত হও মা, ওর কিছু হয়নি। মাথায় চোট খেয়েছে, বমি হতেই পারে…

আদিব তখনো চোখ আধখোলা, একরাশ ক্লান্তি আর দুর্বলতা নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— হায়াত… দূরে যেও না…প্লিজ।

হায়াত ওর হাত ধরে বললো,
— না, কোথাও যাবো না… আমি আছি।

কিছু বলার আগেই বাবাকে ফেলেই আদিব গাড়িতে এসে হায়াতের ঠোঁটে ঠোঁট পুড়ে নিল, তবে মিসেস অরোরা বা রাকিব চৌধুরী তা দেখলো না।গভীর চুম্বনে লিপ্ত হলো দুজন।যেনো তাদের মাঝে কোনো ঘৃণ্য নেই।

————–

বাড়িতে ফিরে এসেছে সবাই—একটা অস্থির, বিশৃঙ্খল সকাল পেরিয়ে।
হায়াত আর আদিবকে আলাদা করে রুমে নিয়ে যাওয়া হলো।
মিসেস অরোরা আর কাজের মহিলা দ্রুত নতুন কাপড়, তোয়ালে, ওষুধপত্র এনে দিলেন।

হায়াত আদিবকে ধরে বাথরুমের দিকে নিয়ে গেলো—হাঁটছে সে ধীরে ধীরে, কিন্তু চোখ দুটোতে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।

বাথরুমের দরজা বন্ধ হলো,
ভেতরে শুধু দুজন—জীবনের সবচেয়ে এলোমেলো একটা রাত আর সকালে পড়ে একে-অপরের পাশে থাকা দুটো মানুষের নিঃশব্দ বোঝাপড়া।

হায়াত কল ছেড়ে দিলো, হালকা গরম পানি পড়ছে।
আদিব চুপচাপ দাঁড়িয়ে, একবারও হায়াতের চোখে তাকায়নি।

হায়াত ধীরে ধীরে ওর গায়ে পানি ঢালতে লাগলো, স্নানের মতো নয়, যেন যত্ন করে ওর ক্ষতগুলো ধুয়ে দিচ্ছে।

হায়াতের কণ্ঠ কাঁপছিল,
— আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম… আপনি জানেন?

আদিব মৃদু স্বরে বললো,
— তুমি না থাকলে… আমি আর উঠতেই পারতাম না বোধহয়…

এক মুহূর্ত, হায়াত ওর বুকের কাছে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো নিঃশব্দে।
আদিব ওর চুলে হাত রাখলো,
— তুমি এখন কাঁদো না, গোসল শেষ হলে তোমাকে জড়িয়ে ঘুমাবো।
– ধ্যাত।
– আসেন বউজান, একটু আদর করি।
– কিহহ, আবার….

কিছু বলার আগেই আদিব জুড়ে জুড়ে ঠোঁট দিয়ে বক্ষস্থলে চাপতে লাগলো। হায়াত আদিবের মুখে চুমু দিতে লাগলো, ব্যাথায় কান্না করতে লাগলো,আদিব হায়াতকে কুলে নিয়ে সুখের সাগরে আবার তলিয়ে গেলো।

তিন ঘন্টা পর….

– এই পজিশন কেমন জান।

হালকা হাসি ফুটলো হায়াতের ঠোঁটে,
জবাব দিলো না—শুধু দু’জনের নিঃশ্বাসের শব্দ মিশে গেলো পানি ঝরার শব্দে।এই ফরজ গোসল শুধু শরীর ধোয়ার নয়,এ যেন একে-অপরের ভাঙা মুহূর্তগুলো ধুয়ে ফেলার প্রার্থনা।

——

গোসল শেষ করে একসাথে রুমে ফিরে এলো হায়াত আর আদিব।
বিছানায় দু’জন বসতেই মিসেস অরোরা দরজায় টোকা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন।
হাতে রাখা ট্রেতে গরম ভাত, মুরগির ঝোল, আর একগ্লাস দুধ।
তিনি একটু হাসি দিয়ে বললেন,
— খাওয়াদাওয়া করে নিও… ওষুধ খাওয়ার আগে কিছু খেতে হবে।

হায়াত মাথা নাড়লো,
— জ্বী আম্মু, আমি খাওয়াচ্ছি ওনাকে।

মিসেস অরোরা চলে যেতেই হায়াত আদিবকে হালকা করে ঠোঁট কামড়ে ভাতের লোকমা এগিয়ে দিলো।
আদিব চুপচাপ খাচ্ছিল… একমুহূর্ত পরে হায়াতের হাতটা একটু সামনে এলো আদিবের মুখের কাছে।

হঠাৎ করেই আদিব হায়াতের এক আঙুলে হালকা কামড় দিয়ে দিলো।

হায়াত হতবাক!
— উহহহহ,এই! ব্যথা পেলাম তো! কেন কামড় দিলেন ?

আদিব শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে মুচকি হেসে বললো,
— তুমি এমন করে খাওয়ালে, আমি তো খেতে খেতে তোমাকেই খেয়ে ফেলতে পারি…

হায়াত ওর কাঁধে একটা থাপ্পড় দিলো হালকা করে,
— আপনি না… এখনো পুরো ভালো হননি, আবার শুরু করলেন…তাও কালকে থেকে শুরু করেছেন।

আদিব চোখ খুলে তাকালো হায়াতের দিকে,
— তোমার কাছে থাকলে সব ভুলে যাই… ব্যথাও জান।

হায়াত একটু লজ্জা পেলেও, হাসল মুখ নিচু করে।
তারপর আদর করে আবার লোকমা তুলে বললো,
— চুপ করে খান এবার, ঔষুধ খেতে হবে… কথা বলবেন না।

হায়াত আদিবকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলো ধীরে ধীরে।
আদিব একসময় চুপ করে গেল। মুখে ভাত রেখেই চিবাচ্ছে না।

হায়াত জিজ্ঞেস করলো,
— কি হলো? খাচ্ছেন না কেন ?

আদিব চোখ ছোট করে কাত হয়ে তাকিয়ে বললো,
— ভাত চিবিয়ে দাও… না হলে খাবো না।

হায়াত থমকে গেল, এক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো।
তারপর একটু রাগ দেখিয়ে বললো,
— আপনি কি ছোট বাচ্চা?

আদিব মুখ ভার করে চোখ ঘুরিয়ে নিলো,

— আমার এখন মন খারাপ… দুর্বল লাগছে… তুমি চিবিয়ে দিলে ভালো লাগতো।

হায়াত ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে বললো,
— আচ্ছা বাচ্চা, মুখ খোলেন, ম্যাডাম হায়াত চিবিয়ে খাওয়াচ্ছেন,,,

এমন খুনসুটির মধ্যেই হায়াত নিজের মুখে একটু ভাত নিয়ে চিবিয়ে আদিবের ঠোঁটে এগিয়ে দিলো।

আদিব হাসিমুখে বললো,
— এই তো আমার হায়াত… আমার মতো পাগল!

হায়াত চোখ পাকিয়ে বললো,
— আপনি পাবনার পাগল হলেন কিভাবে…

হায়াতকে কথা বলতে না দিয়ে আদিব হায়াতের দিকে ঝুঁকে ঠোঁটে ঠোঁট পুড়ে নিল।

#চলবে….