আমার হায়াতি পর্ব-১৭

0
7

#আমার_হায়াতি
পর্ব : ১৭
লেখিকা : #nahar_Adrita

কিচেন রুমে সামান্য নিরবতা, আদিব হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হায়াতের পানে,আর হায়াত বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে গ্যাসের চুলার ওপর পুড়ে যাওয়া দুধের কড়াইটার পানে। আদিব মুখে ‘চ’ শব্দটা উচ্চারণ করে হায়াতের বক্ষঃস্থল থেকে হাত সরিয়ে বললো,

– উফফ লাজুক পাখি তুমি তো আমাকে একদম ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে,আমি ভাবলাম আমার কিউট কিউট বাচ্চাদের খাওয়ার জিনিস পুড়ে গেলে কি খাবে তারা,আর তাদের বাবা…..হায় আল্লাহ এই সাদাদ আদিব চৌধুরীর কি হতো তখন,কি খেতাম আমি, আল্লাহ তোমার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া, আমার বাচ্চাদের খাবারের যে কিছু হয় নি।
– এক মিনিট,বাচ্চা তারা আবার কোথা থেকে আসলো,আমার জানা মতে আমি তো কনসিব করি নি, তাহলে ?
– ধুর বউ কি যে বলো না,তুমি চাইলে আমি তো আজ থেকেই প্রসেস শুরু করতে পারি, কিন্তু… তুমি যে ছোট,সবে ১৮ এখনই বেবি নেওয়া বড্ড রিস্ক তোমার জন্য, আর তোমার কিছু হলে আমি মরে যাবো,এইটুকু খানি শরীরে এখনই বাচ্চা কুলাবে না তোমার,তাছাড়াও ওরা তোমাকে জ্বালালে তখন আমিও তো এসব পারি না, আগে আদনান ভাই আর নেহা তারপর আমরা ওকে।
– আচ্ছা বুঝলাম, কিন্তু আপনি যে বুড়ো হয়ে জাচ্ছেন তার বেলায়।
– কিহ এটা অন্যায় বউ,আমি মোটেও বুড়ো নয় আমি সবে ২৭ বছরের তাগড়া যুবক, আমাকে বুড়ো বলবা না একদম।আমার পিছে কতো মেয়ে পড়ে থাকে যানো, শুধু তোমার জন্য আমি ওসব কাজের বেডি রহিমাদের পাত্তা দেই না,আর আমি বুড়ো হবোও না কখনো, তোমার সুধা পান করে করে আরও সুদর্শন হয়ে যাবো।
– সরুন তো কাজ করতে দিন, আর আপনি ছিহহহহহহহ,এখনো গোসল করেননি। এভাবেই সাড়া বাড়ি ঘুরঘুর করছেন,সরুন এখান থেকে।
– আরে আরে বউ রাগছো কেনো,আমি তো ভেবেছিলাম তোমাকে একটু আদর করবো তারপর গোসল করে, অফিস যাব।আর তুমি এখানে দু’দু পোড়াচ্ছ থুক্কু দুধ পোড়াচ্ছ। ছ্যাহহহ বউ।

হায়াত রেগে লাল হয়ে গেলো,মিসেস অরোরা পাশেই গরুর মাংস চুলায় চাপিয়ে গিয়েছেন, গরম খুন্তিটা হাতে নিয়ে আদিবের দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকালো হায়াত।বললো,
– বাজে বকবকানি বন্ধ করে রুমে যান,গোসল করে রেডি হয়ে আর নিচে নামবেন।

আদিব বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বললো,
– দিবা না তো করতে,দিবা না তো ধরতে, বলো দিবা না ?
– নাআআআআআআআআআআ।সরুন গরম খুন্তির বাড়ি নাহলে একটাও নিচে পড়বে না।

আদিব দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে টেডি স্মাইল দিয়ে বললো,
– ওই জান, একটুই করবো প্লিজ আসো,এতোক্ষণ ঠিক থাকলেও এখন দেখো বাঘ জেগে গিয়েছে,তোমাকে একটু খাবো প্লিজ।
– আদির বাচ্চাআআআআআআ।

এই বলে হায়াত তেড়ে গেলো আদিবের দিকে,হায়াতের এক হাতে খুন্তি অন্য হাত দিয়ে ওড়নাটা আধ ঘোমটা দিয়ে ধরে রেখেছে।রাগে শরীর জুড়ে যেনো আগুন ঝড়ছে। আদিব ”আল্লাহ গো” বলে ভো দৌড় দিয়ে ডইংরুমে গেলো।ডইংরুমে সকলে বসে চা খাচ্ছিলো।আদিবকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে সকলে চিন্তিত হয়ে গেলো।
মি. রাকিব চৌধুরী বললেন,
– বাজান কি হয়েছে,হায়াত ঠিক আছে তো,,,,, এভাবে দৌড়ে আসলে যে।

আদিব হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
– না আব্বু, হায়াত ঠিক নেই।

মিসেস অরোরা চিন্তিত গলায় বললেন,
– কি হয়েছে আমার মেয়ের, চুপ থেকো না বলো আদিব।

এমন সময় হায়াত আসলো, রাগে ফুস ফুস করে বললো,
– কি হবে আমার,কি হওয়ার বাকি রাখেন ওনি,আমি রান্না করছি ওনি আমাকে গিয়ে বিরক্ত করছে।

নেহা ঠোঁট চেপে হেসে বললো,
– ইসসস হায়াত তোমাকে দেখে প্রথমদিন জানো খুব হিংসা হচ্ছিলো, এতো কিউট তুমি উফফ।সত্যিই তুমি আদিবের জন্য পারফেক্ট,আর আজ.. আজ এমন লুকে হ্যাব্বি লাগছে তোমাকে,পাঁচ ফিটের পিচ্চি হায়াতি আমাদের।
– নেহা আপু আমার রাগ ওঠেছে আর তুমি এসব বলছো এখন।

আদনান হো হো করে হেসে বললো,
– আরে হায়াত ছোট্ট পুতুলটা শোন, রাগ করে না বনু,তোমাকে আমার বোনের জায়গা দিয়ে ফেলেছি দেখো, আমার আর তোমার নাকটা একদম সেইম,আমরা ভাই বোন বুঝেছো।

মিসেস অরোরা চিন্তিত গলায় বললেন,
– আম্মু তুমি তো শুধু আদিবের কারণে রেগে নেই,আর কি হয়েছে আমাকে বলো….
– আম্মু চুলায় দুধ ছিলো সব পুড়ে গিয়েছে,আর সেখানে গিয়ে ওনি তামাশা করছে।
– চলো আম্মু কতো দুধ এই নিয়ে মন খারাপ করতে হয় না,চলো আর বাকি রান্নাও করে ফেলবো।

নেহাও এক গাল হেসে বললো,
– হ্যা হায়াত পাখি চলো তোমাকে হেল্প করছি।

হায়াত আর মিসেস অরোরাও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, এমন সময় আদিব চেঁচিয়ে উঠলো,
– বাবা আমি কিন্তু খুব রাগ করেছি।
– কেনো বাজান কি হয়েছে,,,,,,,
– হায়াতকে হয় রুমে পাঠাও,,, নাহলে.. নাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।

হায়াতও কম কিসে রেগে কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
– আম্মু ওনাকে বলে দিন আমি এখন কাজ করবো,ওনার সাথে ওসব লালালালা করতে পারবো না।

মিসেস অরোরা চিন্তিত ভ্রু কুচকে বললেন,
– লালা কি আম্মু।
– উফ আম্মু এতো কিছু জানতে হবে না,আপনি শুধু ওনাকে বলে দিন আমি এখন অযথা রুমে যাবো না।

নেহা কিছু একটা চিন্তা করলো,মিনিট কয়েক পর বুঝতে পারলো হায়াত আর আদিবের আসল ব্যাপারটা,একটু মুচকি হেসে বললো,
– হায়াত আদিবের কিন্তু খুব রাগ, যাও আপুনি রুমে যাও,,,,
সহসাই সকলেই নেহার কথায় সম্মতি জানালো, কিন্তু হায়াতের রাগ যেনো সপ্তম আকাশ অব্দি পৌঁছে গেলো,রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,
– না আমি কাজ করবো,আমার সংসার এটা আমি কাজ করবো আম্মুর কাছ থেকে শিখবো। হুহহহ।
নেহা ইশারায় সবাইকে কিছু বলতে না করলো,আর সকলে চুপও হয়ে গেলো।
আদিব রাগে লাল টুকটুকে হয়ে গেলো, মুখে ‘চ’ মূলক শব্দ করে বললো,
– যাবে কি না ?
– না যাবো না। আমি কাজ করবো,একটু পর মেহমান আসবে।
– ওকে ফাইন, না আসো আমিও গেলাম।
– তো যান না,, না করেছে কে ?
– লাস্ট বার বলছি যাবে ?
– না নুন যবর না।
হায়াতের বলাও শেষ আর আদিব ঠিক সেই মুহূর্তে হনহনিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গেলো। হায়াতও আনমনে কিচেন রুমে চলে গেলো, সকলে একটু চিন্তিত হয়ে পড়লো ওদের নিয়ে।
———
রান্নাঘরের ভেতর তখন এক আলাদা রকমের প্রাণচাঞ্চল্য। মিসেস অরোরা সবজি কাটছিলেন, হায়াত মসলা বাটছিলো আর নেহা মাঝে মাঝে ডিম ফেটাতে গিয়ে ছিটিয়ে ফেলছিলো চারপাশে। সবাই মিলে হাসাহাসি, ঠাট্টা-তামাশার এক দারুণ পরিবেশ।

নেহা হেসে বললো,
– আন্টি, আমি যে ডিম ফাটাতে গেলেই দুর্ঘটনা ঘটে,পড়ে আমাকে দোষ দিও না।

মিসেস অরোরা মজা করে বললেন,
– তুমি যদি রান্না করতে আর শিখতে, তাহলে আদনান হয়তো এত দিনে বিয়ে করে ফেলতো।

এই কথা শুনে হায়াত আর নেহা হেসে লুটোপুটি। হায়াত পেয়াজ,কাজুবাদাম বাটতে বাটতে বললো,
– আম্মু , তাহলে এখন থেকে আপুর হাতে শুধু ডিম আর আলু—সেই দিয়েই শিখুক !

মিসেস অরোরা হালকা চোখ রাঙিয়ে বললেন,
– তোমরা দুইজন একসাথে হলে তো রান্নাঘর নয়, যেন নাটকের মঞ্চ !
হাসি-ঠাট্টার মাঝে হঠাৎ মিসেস অরোরা একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। হাতের কাজ থামিয়ে রান্নাঘরের খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে যেন কিছু ভাবলেন। তারপর হায়াতের দিকে ফিরে মৃদু গলায় বললেন,

– হায়াত মা, ফোনে তোমার আব্বুর নাম্বারটা একটু এনে দাও তো। বিয়ের পর দুই মাস হয়ে গেলো, এখনো তোমার বাবা-মা একবারও আসেনি। আজই বলবো যেন দুপুরে চলে আসে। আর তোমার চাচা-চাচীকেও নিয়ে আসে।

হায়াতের মুখের হাসিটা মুহূর্তেই নরম হয়ে গেলো। সে মাথা নিচু করে বললো,
— জ্বি আম্মু, দিচ্ছি…

নেহা পাশে দাঁড়িয়ে হঠাৎ চুপ মেরে গেলো, যেন কথার ভেতর কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। হায়াত ফোনটা হাতে নিয়ে নম্বর খুঁজতে খুঁজতে বললো,
– আব্বু অনেক ব্যস্ত থাকেন, আম্মু তো একাই বাড়িতে থাকেন, উনাদের ইচ্ছে ছিলো আসবেন, আমি বলিনি কিছু…

মিসেস অরোরা হায়াতের মাথায় হাত রেখে নরম সুরে বললেন,
– মা, তুমি এখন আমাদের ঘরের মেয়েই। কিন্তু তোমার বাবা-মা আমাদেরও আত্মীয়। একবার আসা-যাওয়া হওয়া দরকার। কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকে, কিছু সম্পর্কের মায়া তৈরি হয়। এবার আমিই নিজে কথা বলবো।

হায়াত মাথা নীচু করে নম্বরটা দিয়ে দিলো, চোখে একটু পানি জমে উঠলো—কিন্তু ঠোঁটে তখনও একটুখানি শান্তির হাসি।
দুপুর বারোটা। সকালের সব কাজ শেষ হয়ে গেছে। রান্নাঘরে তখন শুধু স্নিগ্ধ তৃপ্তির একটা বাতাস। খাবার রেঁধে ফেলা হয়েছে, টেবিল গুছানো, চারপাশ পরিষ্কার—সবকিছু যেন নিখুঁত।

মিসেস অরোরা চেয়ারে বসে এক কাপ চা হাতে নিয়ে এক গাল হাসি দিয়ে তাকালেন হায়াত আর নেহার দিকে। তারপর কোমল অথচ নির্দেশনামূলক স্বরে বললেন,
– হায়াত, আজ তুমি লাল টুকটুকে জামদানি পড়বে। যেনো একদম বউ-বউ লাগে তোমাকে। আর হালকা গা ভর্তি গহনা—অত বেশি না, শুধু যতটুকু পরলে তোমাকে অপূর্ব দেখায়।

তারপর তিনি নেহার দিকে তাকিয়ে একটু চোখ কুঁচকে মজা করে বললেন,
– আর তুমি মিস মডার্ন ! আজ আর কোনো ওয়েস্টার্ন না পড়ে সালোয়ার কামিজ পরবে, ঠিক আছে? আমাদের বাঙালি ঘরের মেয়ে হিসেবে মানায় না নাকি তোমায় ?

নেহা একগাল হেসে মাথা নেড়ে বললো,
– ঠিক আছে, আন্টি! আজ আমি পুরো দেশি সাজে থাকবো !

হায়াতও নরম গলায় সম্মতি জানিয়ে বললো,
– আম্মু, আপনার পছন্দটাই আমার জন্য সবচেয়ে সুন্দর।আপনি একটু সাহায্য করলেই পড়তে পারবো।

তিনজনের মাঝে তখন এক অদ্ভুত স্নেহ, হাসি আর ভালবাসার মধুর সমঝোতা। যেন মনের ভেতরেও সাজসাজ রব—কিছু একটা ঘটতে চলেছে, যার জন্য দিনটা আলাদা করে সুন্দর করে তুলতে হবে।

হায়াত ধীর পায়ে রুমে ঢুকলো। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ পড়লো ডিভানে বসে থাকা আদিবের দিকে। সে এক হাতে ল্যাপটপটা হাঁটুর ওপর রেখে গভীর মনোযোগে কোনো মুভি দেখছে। চোখে-কানে যেনো বাইরের কিছুই ঢুকছে না।

হায়াত একটু অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি গোসল করবেন না ? চলুন একসাথে করি..!

কোনো সাড়া নেই। আদিব চোখ সরাল না স্ক্রিন থেকে। হায়াত একটু দাঁড়িয়ে রইলো, ভাবলো আদিব হয়তো শুনেছে কিন্তু পাত্তা দিচ্ছে না। অথবা হয়তো মনই নেই তার কথায়।আরেকবার ডাকলো,,
– শুনছেন,,গোসল করেছেন ?

হায়াত এবার নাক কুঁচকে হালকা বিরক্তি নিয়ে পেছন ঘুরে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো। ভিতর থেকে ধীরে ব্লাউজ আর লাল পেটিকোট বের করলো। চোখে একধরনের নীরব অভিমান।

আলমারির দরজাটা আলতোভাবে বন্ধ করে সোজা চলে গেলো বাথরুমে, কোনো শব্দ না করেই। যেন নিজের মতোই সাজবে, নিজের মতোই গোসল করবে—আজ আর আদিবকে ডাকবে না।

****
হায়াত যখন বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো, একটা চাপা নিস্তব্ধতা ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়লো। ল্যাপটপে মুভিটা চলছিল ঠিকই, কিন্তু আদিবের মন সেখান থেকে অনেক দূরে।

সে স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে এক মুহূর্ত চুপচাপ ডিভানের পেছনে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। ভেতরে ভেতরে একটা ভারি কিছু গুমরে উঠছিলো।

মনে মনে ফিসফিস করে নিজের সাথেই কথোপকথন শুরু করলো—

‘ আমার কোনো রাগ নেই, তাই আমার কথারও দাম নেই… তাই না ?
একটু ডাক দিলাম, কি এমন চাইলাম ওর কাছে,বল্লাম আদর করবো—তাতেও কিছু আসে যায় না।
থাকুক সে তার সংসার নিয়ে… রান্না, জামাকাপড়, আন্টি-নেহা এসব নিয়ে।
আমি আর তোমাকে আদর করবো না মনে রেখো হায়াতি।আমি কী ভাবি, কী চাই, সেটা যেন কেউ জানতেই চায় না।
ঠিক আছে… আমি ভাববো না আর কিছু। আমি সিঙ্গেল, শেষ ! ‘

তার চোখে তখন কোনো জল ছিলো না, কিন্তু মনটা অদ্ভুত এক শূন্যতায় ভরে উঠছিল। বাইরে থেকে আদিবকে যতটাই স্বাভাবিক লাগছিলো, ভেতরে সে ঠিক ততটাই এলোমেলো।আর বাথরুমের দরজার ওপারে হায়াত জানতো না, তার “না” মূলক সকালের বলাটাই আদিবের বুকের একদম মাঝখানে গিয়ে জমে উঠেছে।
আদিব ডিভান থেকে ওঠে হনহনিয়ে রুম থেকে বেড় হয়ে গেলো।হায়াত বাথরুম থেকে ধীরে পা ফেলেই বের হলো। শরীরজুড়ে তখনো ভেজা ভেজা স্নিগ্ধতা, সদ্য গোসল করা এক ধরনের নির্মল সৌন্দর্য। পড়নে শুধু লাল পেটিকোট আর মিলিয়ে পরা ব্লাউজ—সাজতে এখনো বাকি। চুল টাওয়ালে প্যাঁচানো, কিন্তু কিছু কিছু ভেজা চুল গাল বেয়ে গলা ছুঁয়ে নেমে গেছে বুকে।

তার ফর্সা পেটের একপাশে বড় একটি কালো তিল, একদম স্পষ্ট—যা নিজের অজান্তেই নজর কাড়ে। বাথরুমের স্নানঘর থেকে বের হয়ে হায়াত আয়নার সামনে দাঁড়াতেই গলার ভেজা পানি ফোঁটা ফোঁটা করে বুকে গড়িয়ে পড়ছে।

ঠিক এমন সময়, হঠাৎ করেই দরজা খুলে রুমে ঢুকলো আদিব।

সে জানতো না হায়াত বেরিয়েছে। শুধু বাইকের চাবি নিতে এসেছিল, তাড়াহুড়ায় দৃষ্টি আগে পড়ে গেলো হায়াতের ওপর।

এক মুহূর্তের জন্য যেন সময় থেমে গেলো—দুজনের চোখাচোখি।

হায়াত চমকে একটু পেছন ফিরে গেলো, হাত দিয়ে পেটিকোট সামলাতে চাইলেও পরিণত নারীর স্বাভাবিক ছন্দে তার শরীর তখনও ভিজে, ধরা, সুন্দর।

আদিব দাঁড়িয়ে গেলো দরজার কাছে—চাবির কথা তার মনেই থাকলো না। চোখ কাঁপলো, গলার কাছে একটা শব্দ আটকে গেলো।

হায়াত কাঁপা গলায় বললো,
– আপনি… বাইরে যাচ্ছেন ?

আদিব দরজার দিকে পা বাড়িয়েই আবার থেমে গেলো। চোখের কোণটা কিছুটা লাল, ঠোঁট দুটো শক্ত করে চেপে ধরা। চোখে একধরনের জ্বালা—যেটা অভিমান আর রাগ একসাথে মিশে তৈরি করে।

সে ঘাড় না ঘুরিয়েই ঠান্ডা, রাগী স্বরে বললো,

– বাইকের চাবিটা দাও।

হায়াত একটু থমকে গেলো। হাতের কাপড়টা বুকের ওপর একটু টেনে নিলো, তারপর ধীরে ধীরে টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে চাবিটা তুলে নিলো।

নরম গলায় বললো,
— এই নিন…

চোখে চোখ পড়তেই হায়াত দেখলো, আদিবের দৃষ্টি এখনো কঠিন, ঠান্ডা, রাগে জমে থাকা।

আদিব চাবিটা নিয়ে কোনো শব্দ না করেই ঘুরে দাঁড়ালো। কিন্তু দরজার কাছাকাছি গিয়েও যেন কিছু একটা বলবে কি না, সে দ্বিধা করলো। তারপর আবার মুখ শক্ত করে বেরিয়ে গেলো—চুপচাপ, নিজের অভিমান আর অপূর্ণ কথাগুলো বুকে চেপে।

পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা হায়াত শুধু তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে… তার বুকের গভীরে তখন এক অজানা টান ধরে বসে আছে—যেন কিছুই ঠিক নেই, অথচ সে কিছু বলতেও পারছে না।

*****

দুপুর একটা। ঘর জুড়ে তখন এক রকম নরম আলো, জানালা দিয়ে ঢুকছে হালকা রোদ । হায়াত আয়নার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, আর পেছনে মিসেস অরোরা ব্যস্ত হয়ে তাকে সাজিয়ে দিচ্ছেন—নিজ হাতে, নিজের মনের মতো করে।

শুরুতে লাল টুকটুকে জামদানিটা খুব যত্ন করে হায়াতকে পরিয়ে দিলেন। আঁচলটা একপাশে ঠিক করে পিন দিয়ে সাজিয়ে দিয়ে বললেন,
– এই শাড়িটা আমি নিজে তুলে রেখেছিলাম নিজের ছেলের বউয়ের জন্য, আজ পড়ালামও।

তারপর কানের কাছে এক জোড়া ভারি সোনার ঝুমকা তুলে এনে হায়াতের কানে পরিয়ে দিলেন। চুড়ির বাক্স খুলে মোটা সোনার চুড়ি পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-আজ তোমাকে দেখতে যেনো একদম চৌধুরী বাড়ির আদুরে বউ লাগে। এমনই হোক তোমার জায়গাটা—এ বাড়িতে, আর আদিবের হৃদয়ে।

হায়াত চুপচাপ শুনছিলো, চোখে একটু কৃতজ্ঞতা, একটু আবেগ। চুলগুলো আলতো করে আঁচড়ে মিসেস অরোরা নিজেই খোপা করে দিলেন—একদম নিখুঁত, সুন্দরভাবে।

হায়াত আয়নায় তাকিয়ে নিজেকেই যেন চিনতে পারছিলো না। এক সময় যে মেয়ে লাজুক আর চুপচাপ ছিল, আজ সে নিজের মধ্যেই এক নতুন প্রকাশ দেখছে—ভালোবাসার, ঘরনির্মাণের, নিজের হয়ে ওঠার।

মিসেস অরোরা একটু পেছনে সরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকলেন হায়াতের দিকে। তারপর চোখ ভরে এক মমতাভরা হাসি দিয়ে বললেন,
– দেখেছো হায়াত, আজ তুমাকে ঠিক আমার মেয়ের মতো লাগছে… নয়, নয়… তার চেয়েও বেশি।

আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হায়াত তখন সত্যিই ছিল চৌধুরী বাড়ির গর্ব, আলো, আর মৃদু হাসিমাখা হৃদয়ের বউ।

ঠিক তখনই দরজার কাছে হালকা শব্দ হলো। দুজনেই ঘুরে তাকাতেই দেখলো—নেহা রুমে ঢুকছে। তার পরনে এক ঝকঝকে, জমকালো পাকিস্তানি জামা। মাথায় হালকা একটা ঘোমটা, যেটা আধা মুখ ঢেকে রেখেছে, আর চোখে একরকম সরল অথচ আত্মবিশ্বাসী হাসি।

সে ধীরে পা ফেলে রুমে ঢুকলো, যেন একদম নাটকীয় সৌন্দর্যে ভরে গেছে পুরো পরিবেশ।

হায়াত আর মিসেস অরোরা দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ একসাথে বলে উঠলেন,
— “মাশাল্লাহ!”

নেহা লাজুকভাবে এক গাল হেসে হায়াতের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর মুখটা এগিয়ে এনে হালকা করে হায়াতের গালে একটা চুমু দিয়ে বললো,
– মাশাল্লাহ, তুমি তো আজ সত্যিই বউদের মতো লাগছো ।

হায়াত একটু হেসে চোখ নামিয়ে নিলো বললো,
– আর তুমিও আপু,একদম আমাদের দেশের মেয়ে লাগছো।

আর মিসেস অরোরা দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে বুকভরে প্রশান্তি পেলেন। যেন এই মুহূর্তটাই ছিল তার স্বপ্নের চিত্র—দুই মেয়ের সাজসজ্জা, মায়াময়তা, আর পারিবারিক বন্ধনের এক উষ্ণ, নিখুঁত ছবি।

—-

ড্রইংরুমে নেহা তখনও ফোন স্ক্রল করছে। চারপাশে টুকটাক সাজানো শেষ, অতিথি আসার অপেক্ষায় বাড়ির পরিবেশে এক রকম চাপা উত্তেজনা।

ঠিক তখনই দরজা দিয়ে ধীরে ভেতরে ঢুকলেন এক বোরকা পরিহিত মহিলা ও এক মাঝবয়সী পুরুষ। সঙ্গে একটু লাজুক চোখে তাকানো এক কিশোর।

নেহা ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ালেন, ভদ্রমহিলাকে দেখে একটু দ্বিধা নিয়ে বললো,
— জী, কাকে চান আন্টি, খালামুনিকে ?

মহিলাটি একটু কাছে এসে স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বললেন,
– তুমি নেহা, তাই না আম্মু ? আমি আফরার মা… আমার আফরা কোথায় ?

নেহা মুহূর্তে থমকে গেলো—আফরা? সে তো কাউকে এই নামে চিনে না। তার চোখে মুখে স্পষ্ট।

মিসেস আলিয়া নরম করে হেসে বললেন,

– ওহ! তুমি তো জানো না, আমার মেয়ের আরেক নাম আফরা সিকদার। এই বাড়ির বউ… আদিবের বউ… আমার হায়াত। হায়াত কই ?

নেহা সঙ্গে সঙ্গে মুখে হাত দিয়ে জিহ্বাতে হালকা কামড় দিয়ে বললো,
— আহ্ ! আমি তো জানতামই না আন্টি, হায়াতের আরেক নাম আফরা ! আসুন… আসুন আন্টি, আঙ্কেল, বসুন। আমি এখনই ওকে নিয়ে আসছি ।

সে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে ভেতরের দিকে যেতে যেতে মনে মনে বলছিলো— আফরা ? হায়াতের আসল নাম এটা নাকি? আহা, কত্ত কিছুই জানি না!

আর বসার ঘরে তখন হায়াতের মা-বাবা আর ছোট ভাই রাব্বি বসে আছেন—চোখে সেই চেনা মুখ দেখার অধীর অপেক্ষা, আর মনের ভেতর কেবল ভালোবাসা মাখানো স্মৃতি।

সিঁড়ির ধাপ ধাপ নিচে পা ফেলে ধীরে নামছিলো হায়াত। পাশে মিসেস অরোরা আর নেহা—দুইজনই একরকম গর্ব আর ভালোবাসায় ভরে তাকিয়ে ছিলেন ওর দিকে। হায়াতের পরনে লাল জামদানি শাড়ি, খোপা করা চুল, কানে ঝুমকা, হাতে সোনার চুড়ি—আজ সে যেনো সত্যিই চৌধুরী বাড়ির বউ।

হায়াত শাড়ির কুচিটা অতি সাবধানে দু’আঙুলে ধরে নিচে নামছিলো। চোখে একরকম জলের রেখা, ঠোঁটে থমকে থাকা আবেগ। ড্রইংরুমে ঢুকেই চোখে পড়লো—বাবা বসে আছেন, একটুখানি চিন্তিত ভঙ্গিতে, পাশে মা আর রাব্বি।

হায়াত এক মুহূর্ত থেমে গেলো, তারপর কুচিটা তুলে আরও এগিয়ে গিয়ে সোজা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

তারপর এক ঝটকায় কেঁদে উঠার আগে-পরের সেই সংবরণ করা আবেগ নিয়ে বাবার গলায় ঝাঁপিয়ে পড়লো।
— আব্বু…

আব্দুল সিকদার প্রথমে থমকে গেলেন। তারপর হায়াতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। একটা হাত মেয়ের পিঠে, আরেক হাতে চোখের কোণটা চুপচাপ মুছলেন।

— আমার মাইয়া… আমার আফরা… তুই তো আসলেই বাড়ির বউ হইয়া গেছস…

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিসেস অরোরা আবেগ চেপে মুখে হাসি ধরে রাখলেন, আর নেহা চোখ নামিয়ে মুখে এক প্রশান্তির ছায়া রেখে বললো,
— “মাশাল্লাহ।”

রাব্বি শুধু তাকিয়ে রইলো, তার আপু এখন শুধু তার ‘আপু’ না—একটা ঘরের দায়িত্বশীল, পরিপূর্ণ রূপ পাওয়া মানুষ।
হায়াত বাবাকে জড়িয়ে ধরে যখন একটু আলগা হলো, তখনো চোখে ছিলো জলছোঁয়া আবেগ, আর মুখে এক অপূর্ব শান্তির হাসি। সে এক গাল হেসে সোজা এগিয়ে গেলো মায়ের দিকে।

মিসেস আলিয়া হাত বাড়িয়ে দিলেন, আর হায়াত তার বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
মা-মেয়ের এই মুহূর্তটা যেনো সময়কে থামিয়ে দিলো।

মিসেস আলিয়া চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,
— আমার আফরা… আমার মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে… একেবারে ঘরের বউ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।

হায়াত চোখ বন্ধ করে বললো,
— আমি ভালো আছি, আম্মু। কিন্তু তোমাকে না দেখে মনটা একদম খালি খালি লাগতো…

তারপর মা’র আঁচল থেকে মাথা তুলে সোজা গেলো ছোট ভাই রাব্বির দিকে।

রাব্বি খানিকটা লজ্জায় ছিলো, আবার আবেগেও চোখ একটু চিকচিক করছিলো।
হায়াত কাছে গিয়ে হেসে বললো,
— এই যে রাব্বি সিকদার ! আমার জন্য কিছু আনোনি ?

রাব্বি মুখ নামিয়ে হালকা হাসলো, তারপর পকেট থেকে এক ছোট্ট চকলেট বের করে বললো,
– এই নাও আপাই তোমার জন্য চকলেট এনেছি। তুমি খুশি তো।

হায়াত হেসে হাত বাড়িয়ে চকলেটটা নিলো, আর রাব্বির মাথায় চুমু দিয়ে বললো,

– হুম অনেক খুশি আমার জান।

হায়াত আর রাব্বি তখনো কথায় ব্যস্ত। হায়াত রাব্বির গালে হালকা টোকা দিয়ে বলছে,
— তুই না এখনো আগের মতোই, শুধু একটু লম্বা হয়েছিস।

রাব্বি মুচকি হেসে উত্তর দিচ্ছিল,
— আপাই তুমি তো এখনও পিচ্চিই রয়ে গেলে,এতো সুন্দর বাড়ির বউ, তোমাকে দেখলে কেউ বলবেই না চকলেট খাও!

দুজনের এই খুনসুটি-ভরা মুহূর্তে হঠাৎ ড্রইংরুমের দরজার কাছে ভেসে এলো এক চেনা, নরম অথচ দুষ্টু সুরে ভরা কণ্ঠস্বর—

— ভেরি ব্যাড শালা বাবু…

সবার চোখ একসাথে ঘুরে গেলো দরজার দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আদিব। পরনে হালকা পাঞ্জাবি, চুলটা হালকা এলোমেলো, চোখে-মুখে চেনা স্নেহ, আর ঠোঁটে এক রকম মজা-মাখা অভিযোগ।

— শুধু তোমার আপাইয়ের জন্য আনলে, আর আমি? আমার কথা বুঝি একটুও মনে পরে না।

রাব্বি প্রথমে একটু থমকে গেলো, তারপর মাথা চুলকে হালকা হেসে বললো,
– আরে ভাইয়া আপনি যে আপাইয়ের মতো চকলেট খান এটা তো আমি জানতামই না।

তাদের কথোপকথনের রেশ যেনো হঠাৎ ছিন্ন হয়ে গেলো।

আদিব সম্মানপূর্বক শ্বশুর-শাশুড়িকে সালাম জানিয়ে হাসিমুখে কিছু সৌজন্যমূলক কথা বললো। আব্দুল সিকদার মাথা নেড়ে প্রশ্রয় দিলেন, আর মিসেস আলিয়া হালকা হেসে বললেন,
— ভালো জামাই পেয়ে আলহামদুলিল্লাহ।

হঠাৎই হায়াত নরম স্বরে আদিবকে লক্ষ্য করে বললো,

– আপনি গোসল করে আসুন , আমি আপনার অফ হোয়াইট পাঞ্জাবি বের করে দিচ্ছি…

কথাটা শেষ হতেই আদিবের চোখ একবার ছলকে উঠলো রাগে, ঠোঁট শক্ত করে চেপে, কোনো উত্তর না দিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে হায়াতের দিকে তাকালো। মুহূর্তটা যেনো জমে গেলো। তারপর সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো—চুপচাপ, নিঃশব্দে, যেন কোনো অভিযোগ বুকের ভেতর পুড়ে চলছে।

হায়াত হঠাৎ থমকে গেলেও, নিজের অজান্তেই আদিবের পেছনে পেছনে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলো। তার চোখে অপরাধবোধ, কণ্ঠে নীরব অনুশোচনা। এই নিঃশব্দ দূরত্বটা হয়তো দুজনেই অনুভব করছে, কিন্তু মুখে কেউ কিছু বলছে না।
একটা মৌন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, তারা আবার নিজেদের মতো করে একে অপরকে বোঝার পথে এগিয়ে চলেছে…

রুমে ঢুকেই আদিব সজোরে ডিভানের এক পাশে লাথি মারলো। কাঠের শব্দে রুম কেঁপে উঠলো যেন। হায়াত চমকে উঠে দাঁড়ালো, চোখে ভয় আর অজানা আশঙ্কা।

আদিব উত্তপ্ত চোখে হায়াতের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠে হায়াতের গলা চেপে ধরে বললো,

– কি সমস্যা পেছন পেছন ঘুরছিস কেনো বা’ল।
– আহহহহ,লা..গছে লাগছে, আব্ আমি তো পাঞ্জাবি দিতে এসেছিলাম।
– চুপ বেড়িয়ে যা রুম থেকে, যাহ তোর সংসার সামলা।

আদিবের রাগ যেনো আর ধরে রাখা গেলো না। হঠাৎই সে হায়াতকে ধাক্কা দিলো—হালকা নয়, এমন ধাক্কা যাতে শরীরটা কিছুটা পিছিয়ে যায়। হায়াত পড়ে না গেলেও নিজেকে সামলাতে গিয়ে এক হাত দেয় দেয়ালে, অন্য হাতে আঁচলে চোখের পানি মুছে নেয়।

তার চোখে হতাশা, দুঃখ আর অপমানের মিশ্র চেহারা। কিছু বলার মতো মুখ খোলে, কিন্তু কণ্ঠ আটকে যায়।

কিছু না বলেই সে ধীরে ধীরে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো… শাড়ির কুচি টানতে টানতে… মাথা নিচু, চোখে অঝোর অশ্রু।

রুমে রয়ে গেলো শুধু এক চাপা নীরবতা—আর এক অপরাধবোধে ভরা, গলিয়ে দেওয়া রাগী মুখ, আদিবের।

নিচে নেমে আসতেই চারদিকে এক উৎসবের আমেজ—
মেহমানরা সবাই এসে গেছেন, বসার ঘর আলোকিত হয়ে উঠেছে মুখরতায়। নেহার দাদা-দাদি একপাশে বসা, চোখে উজ্জ্বলতা, মুখে হাসি। পাশেই দাঁড়িয়ে নেহার চাচাতো ভাই আরিয়ান, পাঞ্জাবির উপর ওয়েস্টকোট, গম্ভীর মুখে চারপাশ দেখছে।

এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে নামলো আদিব—
সাদা অফ হোয়াইট পাঞ্জাবি, গা ছুঁয়ে থাকা সুগন্ধ, চেহারায় এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। তাকে দেখে মুহূর্তেই সবাই থমকে গেলো।

নেহার দাদি মুখে হাত দিয়ে বলে উঠলেন,
— মাশাল্লাহ !

আরিয়ান একপাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুটা বিস্ময়ে।

পেছনে এসে দাঁড়ালো হায়াত—
সাজে যেন রাজরানী, লাল জামদানিতে মুখটা ঝলমল করছে। মাথায় শাড়ির আঁচল, কানে ভারি ঝুমকা, মুখে লাজুক হাসি। সকল মেহমানের সামনে মাথা নিচু করে সালাম দিলো।

সবাই প্রশংসায় ভরে উঠলো—

– এই তো চৌধুরী পরিবারের মানানসই বউ,ইসস আমাদের আদিবের পছন্দ আছে বলতে হয়।হায়াত তো একেবারে ছবির মতো লাগছে !

আর মিসেস অরোরা একটু পেছনে দাঁড়িয়ে নিজের বউমা আর ছেলেকে দেখে শুধু এক গাল হাসলেন—
“এবার শুরু হোক নতুন গল্প…”

হায়াত আড়চোখে তাকাঁলো আদিবের দিকে, আদিব তখন আদনানের সাথে কথা বলছে।

——
রাত নয়টা বেজে পঁচিশ মিনিট…. চারদিকে ঝুম বৃষ্টি। সন্ধ্যায় সবাই ঠিক করলো এই মাসের ২৫ তারিখ থেকে নেহা আর আদনানের বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে। সকল মেহমান চলে গেলে মিসেস অরোরার সাথে সকল বাসন মাজা- কাজ কর্ম সব হাতে হাতে করেছে হায়াত আর নেহা। নেহা যেন একদিনেই বাড়ির সদস্য হয়ে গিয়েছে,এতো গুলো বছর বিদেশ থেকেও খালামুনিকে নিজের দ্বিতীয় মায়ের জায়গা দিয়ে ফেলেছে সে । নেহার মা অসুস্থ হলেই নেহাকে সামলাতে আমেরিকায় পাড়ি জমান মিসেস অরোরা, আর এখন নিজের মেয়ের জায়গা দিলেন আবার এই বাড়িতেই আদনানকে কোম্পানিতে জবের ব্যাবস্থা দিলেন সাথে এক ছাদের নিচে থাকারও।

এদিকে সারাদিন হায়াতের, আদিবের কথা খেয়ালে না আসলেও এখন ভীষণ পুড়ছে মনটা।সেই সন্ধ্যায় গাড়ি নিয়ে বেড় হয়েছে আদিব,কিন্তু এখনও আসার নাম নেই। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে হায়াতের। সহসায় কাঁপা কাঁপা হাতে কল করলো আদিবকে। দুইবার রিং হলো,কিন্তু আদিব হায়াতের ফোন রিসিভ করলো না,হায়াত দীর্ঘ নিশ্বাস ফুঁকে আরেকবার কল করলো, আদিব এবার রিসিভ করলো, হায়াত কাঁপা গলায় বললো,

– আসসালামু আলাইকুম, কোব্ কোথায় আব্ আপনি।

ওপাশ থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে আসলো,
– কেনো কি হবে আমাকে দিয়ে..
– না মানে বাইরে অনেক বৃষ্টি… সকলে টেনশন করছে,বাড়ি কখন আসবেন।
– কালকে।
– মানে….
– ঘুমিয়ে পড়ো আমার সময় হলে আসবো আমি।

হায়াত এবার ডুকরে কেঁদে উঠে বললো,
– এমন করছেন কেনো, বাড়ি আসুন না… প্লিজ।এতো বৃষ্টি আমার খুব ভয় হয়।
– দেখছি।
হায়াত ফ্লোরে বসে মুখ গুজে কান্না করতে লাগলো। রাত দশটা বেজে গেলো হায়াতের কান্না পর যেটুকু হেঁচকি ছিলো তাও কমে গেলো।হায়াত ওঠে বসলো বাহিরের বৃষ্টি কিছুটা কমে গিয়েছে। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে কিছুটা পরখ করলো লাল শাড়ি হাতে কানে গহনা চোখ দু’টো সামান্য ফুলে ওঠেছে। দীর্ঘশ্বাস ফুঁকে দরজার দিকে তাকালো আর আঙ্গুলে চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে রুমে প্রবেশ করলো আদিব।দুজনের মাঝে হালকা চোখাচোখি হলো। আদিব একবার ভালো করে পরখ করলো হায়াতকে। মনে মনে ভাবলো,আচ্ছা ওকে এমন দেখাচ্ছে কেনো বিকালেও তো কতো উৎফুল্ল নিয়ে সকলের সাথে হাসি তামাশাতে মেতে ছিলো। আদিবের ভাবনার সুতো ছিড়ে হায়াত কাঁপা গলায় বললো,
– খাবেন না চলুন, ডাইনিং হলে আম্মু সব কিছু বেড়ে রেখেছে।
– না খিদে নেই।

হায়াত পেছন থেকে আদিবকে জড়িয়ে ধরে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
– এমন করছেন কেনো আচ্ছা সরি সকালের জন্য।আমার যে আর সহ্য হচ্ছে না প্লিজ।
– সরো আমার রাগ নেই।

হায়াত আঁচল মুখে চাপা দিয়ে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
— উহু… আমি জানি সকালে আপনাকে ফিজিক্যাল ইন্টিমেট হই নি তাই আপনি রাগ করেছেন…

এই কথা শুনে আদিবের চোখে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠলো।

ঠাসসসসসসসসসসসসস। হায়াতকে কষিয়ে এক থাপ্পড় দিলো আদিব। সে হঠাৎ সামনে এসে হায়াতের দুই কাঁধ ধরে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
—তোর কি মনে হয় ভালোবাসা মানেই শুধু ওইসব,
তার গলা ভাঙা, অভিমানে ভরা।
— পাগল ! আমি রাগ করেছিলাম কারণ, আমি একবার বললাম রুমে আসতে… তুই আসলি না… আমি ভেবেছিলাম তোর কাছে আমার কথার দাম নেই।

হায়াত থমকে গেলো। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে।
আদিব ধপ করে পাশের বিছানায় বসে পড়লো, মাথা নিচু করে ফিসফিসিয়ে বললো—
— ভালোবাসা যদি বুঝতেই না পারিস, তবে ওইসব ছুঁয়ে থাকা দিয়ে কী হবে বা*ল…

হায়াত ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে তার পাশে বসলো। মাথা নিচু করে বললো—
— আমি বুঝিনি… আমি সত্যিই বুঝিনি…

আদিব হায়াতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। হায়াত একটু অবাক হলেও ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।

আদিব আদুরে গলায় বললো,
— যাও বউ… খাবার নিয়ে আসো, আজ তোমার হাতেই খাবো…

হায়াত মাথা নিচু করে লাজুক ভঙ্গিতে বললো,
– আর রাগ করবেন না তো ?

আদিব হায়াতের কপালে একটা নরম চুমু দিয়ে বললো,
– উহু পাখি আর কখনো রাগ করবো না। এখন আসো চুমু খাবো তারপর ভাত।

#চলবে