#আমার_হায়াতি
পর্ব : ১৮
লেখিকা : #Nahar_Adrita
( লেখিকার নাম ছাড়া কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ 📌)
আদিব হায়াতের ওষ্ঠে নিজেকে মিশিয়ে দিল, সেই মুহূর্তে যেন সময় থমকে গেল। আবেশে হায়াতের আঙ্গুল জড়িয়ে ধরলো আদিবের চুলের মাঝে, নিঃশব্দে অনুভব করলো গভীর এক টান।
অনেকক্ষণ নিঃশব্দে আবিষ্ট হয়ে থাকার পর আদিব আস্তে করে পিছু সরলো। চোখে মায়া মাখিয়ে বললো,
– যাও পাখি, এবার খাবার নিয়ে আসো।
– হু।
হায়াত আস্তে আস্তে রুমের দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে বেরোল।
চোখে ছিলো মেঘলা ক্লান্তি, ঠোঁটে অনুচ্চারিত কিছু কথা।
শাড়ির আঁচল হঠাৎ পায়ের নিচে এসে জড়িয়ে গেল।
এক মুহূর্ত…
আর কিছু বোঝার আগেই সিঁড়ির ধাপে পা ফসকে গড়িয়ে পড়লো সে নিচে!
“আল্লাহ গো!”
আর্তনাদ করে উঠলো হায়াত, কণ্ঠে ধ্বনিত হলো ভয় আর ব্যথার মিলনস্বর।
ধাপের পর ধাপ গড়িয়ে নিচে এসে থেমে গেল নিস্তেজ শরীরটি।
নাক ও মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে র’ক্ত… সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে রক্তের ছিটে ছড়িয়ে পড়েছে যেন সময় থেমে গেছে চারপাশে।
এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে কান্না, চিৎকার আর পদচারণার শব্দে ভরে উঠলো বাড়ির পরিবেশ।
ঘরের মানুষজন ছুটে এলো—কেউ চিৎকার করছে, কেউ বাকরুদ্ধ।
আদিব ছুটে এলো উন্মাদের মতো।
হায়াতকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তার বুকটা যেন চিরে গেল!
কণ্ঠ ফেটে চিৎকার করে উঠলো—
“হায়াত!”
তীব্র যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে হায়াত চোখ মেলে তাকাতে চাইল, কিন্তু ঘোলাটে দৃষ্টিতে শুধু আদিবের অস্থির মুখটাই অস্পষ্ট দেখলো… তারপর নিস্তেজ হয়ে গেল শরীর।
আদিব দুই হাতে হায়াতকে কোলের মধ্যে তুলে নিলো।
তার চোখ অশ্রুভেজা, কণ্ঠ কাঁপছে বেদনায়।
– কি হলো জান… চোখ খুলো… কথা বলো না প্লিজ… হায়াত! একটা শব্দ বলো…তুমি তুমি না আমাকে খাইয়ে দিবে। ওঠো প্লিজ, জান।
কিন্তু হায়াত নিস্তব্ধ, ঠোঁট ফাঁকা, নিঃশ্বাস ক্ষীণ।
পেছন থেকে মিস্টার চৌধুরীর কণ্ঠ বজ্রের মতো ভেসে এলো,
– আদিব, পাগলামি করিস না বাজান ! এখনি ওকে হাসপাতালে নিয়ে চল।
দেরি না করে আদিব হায়াতকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে গাড়ির দিকে দৌড়ে গেল।
গাড়ির পেছনের সিটে বসে পড়লো সে—হায়াতের নিস্তেজ দেহটা কোলে।
পাশে বসেছে নেহা, কাঁপা হাতে হায়াতের তালু ঘষছে বারবার,
মুখে ফিসফিস করছে—
– কিছু হবে না পিচ্চি, তুমি চোখ তোলো প্লিজ…
গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসেছে আদনান, গতি যেন পলকহীন।
পাশে বসে রাকিব চৌধুরী, ফোনে ডাক্তারকে জানাচ্ছেন সব কিছু।
পেছনের গাড়িতে চৌধুরী পরিবারের বাকিরা—প্রতিটি চোখে ভয়, মুখে অশ্রু, হৃদয়ে একটাই প্রার্থনা।
হাসপাতালের দিকে ছুটে চলছে দুটি গাড়ি…
আর আদিবের কোলের মধ্যে পড়ে আছে হায়াত, নিস্তব্ধ, রক্তমাখা…
জীবন যেন এক পাতার ওপর ভারসাম্য ধরে রেখেছে—ঝড়ে উড়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।
_______
গাড়িটি দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে, জানালার বাইরে অন্ধকার একনাগাড়ে পেছনে সরে যাচ্ছে।
সাভারের সীমানা পেরিয়ে যেন জীবন-মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে সময়।
আদিব নিজের কোলের দিকে তাকালো —
হায়াত নিস্তেজ, চোখ দু’টি বন্ধ, মুখ রক্তে ভেজা।
এক অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠলো তার হৃদয়।
সে কাঁপা হাতে পকেট থেকে নিজের রুমালটা বের করলো,
সযত্নে, যেন ফুলের পাপড়ি ছোঁয়া হয় — সেই মমতায় মুছে দিতে লাগলো হায়াতের নাক-মুখের রক্ত।
– জান… চোখ তোলো না প্লিজ, আমার সাথে কথা বলো…এই বউ কথা না বললে মাইর দিব।
তার কণ্ঠ ভেঙে যাচ্ছে, কান্না আর ভালোবাসা একসাথে গলে পড়ছে প্রতিটি শব্দে।
আদিব নিঃশব্দে হায়াতের কপালে এক চুম্বন রাখলো।
তারপর গালে একের পর এক চুম্বনে আঁকতে লাগলো প্রার্থনা।
যেন প্রতিটি চুম্বন তার জীবনের বিনিময়ে হায়াতকে ফিরিয়ে আনতে চায়।
নেহা এক কোণে বসে চোখ মুছছে, আর চুপচাপ তাকিয়ে আছে সেই ভালোবাসার নীরব দৃশ্যের দিকে।
গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দের মাঝেও হায়াতের নিঃশ্বাস যেন আরও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে…
আর আদিব তার কোলের দিকে তাকিয়ে বারবার বলছে—
– তুমি যাবে না… আমি কিছুতেই তোমাকে হারাতে পারবো না,বউ জান…
***
সাভার সুপার হসপিটালের সামনে এসে থামলো গাড়িটি।গাড়ির দরজা খুলতেই তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলো সাদা ইউনিফর্ম পরা নার্সেরা।
হায়াতের নিথর দেহটি স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে গেল তারা—
সরাসরি অপারেশন থিয়েটারের দিকে।
ওটি-র লাল বাতি জ্বলে উঠলো।
আর বাইরে ভেঙে পড়লো এক প্রেমিক হৃদয়…
আদিব হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো হাসপাতালের মেঝেতে,
চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে, গলা ধরে এসেছে কেঁদে।
তার কণ্ঠ ফেটে বেরিয়ে এলো—
– আল্লাহ… আমার হায়াত… ওকে ফিরিয়ে দাও…আল্লাহ…… আমাকে তুমি নিয়ে যাও, কিন্তু ওকে ফিরিয়ে দাও।
তার সেই আর্তনাদ ভেদ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিসেস অরোরা।
– আল্লাহ, আমার ছেলের এই অবস্থা আমি সহ্য করতে পারছি না…
নেহা এগিয়ে গিয়ে মিসেস অরোরার কাঁধে হাত রাখলো,
চোখের জল আটকে শক্ত থাকার চেষ্টা করছে,
কিন্তু গলার কাঁপুনি জানিয়ে দিচ্ছে, সে নিজেও ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ছে।
আদনান এসে ধীরে ধীরে আদিবকে ধরে একটি চেয়ারে বসালো।
– ভাই, শক্ত থাকো… আমাদের হায়াত লড়ছে, তুমি ভেঙে পড়লে চলবে না…
রাকিব চৌধুরী রিসেপশনে গিয়ে বিল সংক্রান্ত সব কাগজপত্র আর টাকা হস্তান্তর করছেন,
চোখে তাঁরো চিন্তার ছাপ—
একটা প্রিয় মুখের জন্য সবার রাতটা যেন থমকে গেছে।
আদিব পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করলো…
হায়াতের সেই হাসিমাখা ছবিটি খুলে ফেললো…
তারপর নিঃশব্দে ছবির পর্দায় বারবার চুম্বন করতে লাগলো।
– তুমি কথা দিয়েছিলে না, আমায় ছেড়ে যাবে না…
সে ফিসফিস করে বললো, চোখ থেকে চুপচাপ ঝরে পড়লো জল।
রাত গভীর হলো…
হাসপাতালের করিডোরে নিঃশব্দে হাঁটছে সময়।
কেউ কিছু খায়নি, কেউ ঘুমায়নি—
কিন্তু সবচেয়ে অচল হয়ে আছে একজন — আদিব।
সারারাত সে শুধু একটাই কথা ভাবছে,
আমার হায়াত এখনো ওটিতেই… আমি কবে ওর চোখে আবার প্রাণ দেখতে পাবো ?
—-
সকাল সাতটা।
রাতজাগা অস্থিরতার পর প্রথম সূর্যরশ্মি জানালার কাঁচে এসে পড়েছে।
হাসপাতালের করিডোরে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে, কেবল দুচোখে জমে থাকা আতঙ্কে থমকে আছে সবাই।
হঠাৎ, ‘অপারেশন থিয়েটার’-এর লাল বাতি নিভে গেল।
দরজাটা খুলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার সাহেব। মুখে ক্লান্তি আর গম্ভীরতা।
আদিব এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো।
পাগলের মতো ছুটে গেলেন তাঁর দিকে।
– ডাক্তার! আমার হায়াত কেমন আছে ? সে ঠিক আছে তো ? দয়া করে বলুন…
ডাক্তার চোখ নামিয়ে একটু থেমে, ধীরে বললেন,
– দেখুন মিস্টার আদিব, আপনার স্ত্রী হায়াতের মাথায় গুরুতর চোট লেগেছে। স্কাল ফ্র্যাকচার হয়েছে। যদি মাথার ওপরটা ফেটে রক্ত পড়তো, তাহলে এতটা ঝুঁকি থাকতো না…
আদিব নিঃশ্বাস আটকে শুনছে, ঠোঁট কাপছে।
ডাক্তার আবার বললেন:
– চোটটা ব্রেইনের ভেতরের অংশে। এই কারণে… সি’রিয়াস নিউরোলজিক্যাল কম্প্রেশন হয়েছে। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত আমরা নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারি না, তবে…
তিনি একটু থেমে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
– দুঃখিত, তার স্মৃতিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
আদিব যেন কিছু শুনেই না… শুধু দাঁড়িয়ে আছে… এক দৃষ্টি নিয়ে।
তার কণ্ঠ ফেটে এলো:
– স্মৃতি…? মানে… ও আমাকে চিনবে না…? আমাদের কথা, আমাদের ভালোবাসা, সব ভুলে যাবে…?
ডাক্তার চুপ করে থাকলেন।
এই নিরবতাই যেন হাজার শব্দের চেয়েও ভারী।
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মিসেস অরোরা চোখে হাত চাপা দিয়ে কান্না শুরু করলেন।
নেহা এগিয়ে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলো।
আদনান পাশে এসে দাঁড়িয়ে আদিবের কাঁধে হাত রাখলো —
– ভাই, আল্লাহর কাছে দোয়া করো… এখন ওর জেগে ওঠাটাই সবচেয়ে বড় দরকার।
আর আদিব?
সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে… যেন সময় থেমে গেছে তার জন্য।
তার শুধু একটাই প্রার্থনা এখন—
– হায়াত… শুধু একবার চোখ তোলো… শুধু একটা বার… আমার নামটা বলো…
—
সকাল সাতটা কুড়ি।
একটি চাকার শব্দ… হালকা গুঞ্জন…
তারপর ওটি’র দরজাটা ধীরে খুলে গেল।
একটি স্ট্রেচারে ধীরে ধীরে বের করে আনা হলো হায়াতকে।
মুখ ফ্যাকাশে, ঠোঁট রক্তশূন্য, চোখ দুটি গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে— যেন আর কখনও জাগবে না।
সাদা চাদরে মোড়ানো শরীরটা নিঃসাড়…
হৃদপিণ্ডের গতি বোঝার জন্য মন ভয়ে ধুকপুক করছে প্রত্যেকের।
নার্সেরা নিঃশব্দে কেবিনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো তাকে।
করিডোরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল আদিব।
হঠাৎ তার পা যেন মাটিতে গেঁথে গেল।
চোখ বড় হয়ে উঠলো, ঠোঁট শুকিয়ে এলো, কণ্ঠ রুদ্ধ।
সে তাকিয়ে আছে…
তার হায়াত…
যে প্রতিদিন কানের পাশে ফিসফিস করে বলতো “জান”…
আজ সে নিশ্চুপ।
নার্সদের ভিড় পেরিয়ে হায়াত চলে যাচ্ছে…
আর আদিব দাঁড়িয়ে আছে সেই এক মুহূর্তে…
এক নিঃশ্বাসে, এক হাজার বছরের নিস্তব্ধতা যেন।
কেউ হাত ছুঁয়ে দিলো তার কাঁধে—
হয়তো নেহা, হয়তো আদনান…
কিন্তু আদিব কোনো অনুভূতি পেল না।
সে শুধু তাকিয়ে থাকলো…
চোখে জল, কিন্তু মনে একটাই প্রশ্ন — “এই আমার হায়াত? নাকি কেবল তার ছায়া?”
কেবিনের বাইরে টানা অপেক্ষার পর,
একজন নার্স এসে মৃদু কণ্ঠে বললো,
– আপনারা একজন ভিজিটর যেতে পারবেন পেশেন্টের কাছে।
চারপাশে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল সকলে।
বুঝতে বাকি রইলো না… কে যাবে।
আদিব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো।
পায়ের ভার যেন কয়েকশো মন…
তবুও সে এগিয়ে গেল—
চোখে ধোঁয়াশা, বুকের ভেতরটা খালি।
কেবিনে ঢুকে দেখা গেল হায়াত নিঃশব্দে শুয়ে আছে।
মাথার পাশে স্যালাইন, রক্তের ব্যাগ কাঁপছে হালকা বাতাসে।
হাতে কেনোলা, ঠোঁটে নীলচে ছায়া…
মনে হয় যেন জীবনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে সে।
আদিব পাশে রাখা চেয়ারটা টেনে হায়াতের মাথার পাশে বসল।
তার চোখ দিয়ে নীরব অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে।
একটুখানি থেমে, হঠাৎ সে কাঁপা গলায় ফুঁপিয়ে উঠলো—
– হায়াত… পাখি… একবার শুধু চোখ তোলো…
তার কণ্ঠে করুণ মিনতি, নিঃশ্বাসে ভেজা ভালোবাসা।
– তুমি বলেছিলে না, আমি তোমাকে লাল শাড়ি পরিয়ে আবার বিয়ে করবো ?তুমি তো চাইতে, ধুমধাম করে বিয়ে… নাচ-গান… মেহেদির গন্ধ…
আদিব হায়াতের হাতটা নিজের দু’হাতের মাঝে চেপে ধরলো।
ঠোঁট কেঁপে উঠলো…
– আসো পাখি, এবার ঠিক তেমন করেই হবে। এইবার আমি কথা দিচ্ছি… শুধু তুমি চোখ তোলো… ফিরে এসো…
চুপচাপ হায়াত শুয়ে আছে…
কোনো সাড়া নেই…
তবুও আদিব তার হাতে চুমু খেয়ে বসে থাকে…
একটা নিশ্বাস… একটা চোখের পাতার নড়াচড়া… সেই অপেক্ষায়।
হায়াতের নিঃসাড় মুখের দিকে তাকিয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না আদিব।
চোখের জল থামানো অসম্ভব হয়ে উঠলো।
সে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো, কেবিনের দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে গেল বাইরে।
হাসপাতালের করিডোর এখনো নিস্তব্ধ।
আলো-আঁধারিতে ভেসে আসছে ওটোর শব্দ, নেহা-আদনানের ফিসফাস, কিন্তু সে সব কিছুই নিঃশব্দ হয়ে যায়, যখন আদিব এগিয়ে এসে মিস্টার চৌধুরীর বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফেলে।
আর ঠিক তখনই—
ফেটে পড়ে তার কান্না।
অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে শিশুর মতো বললো—
– বাবা… আব্বু… দেখ না, হায়াত আমার পিচ্চিটা কথা বলছে না…
তার কণ্ঠ কেঁপে উঠছে, শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে গলায়।
মিস্টার চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ।
তার বয়সী একজন পিতা…
আর বুকে মাথা রেখে ভেঙে পড়া তার ছেলেটা—
একটা ভালোবাসার মানুষকে হারানোর আশঙ্কায় কাঁদছে বুক ভেঙে।
আদিব আবার ফিসফিস করে উঠে বলে—
– বাবা… দেখো না, ওকে কেমন লাগছে… সাদা হয়ে গেছে… ঠোঁটে রঙ নেই…ও তো আমার পাখি… আমার পিচ্চি… কথা বলছে না কেন বাবা? আমি তো ওকে ডাকছি… শুনছে না কেন ?
মিস্টার চৌধুরী কোনো কথা বলেন না,
শুধু ছেলের মাথায় হাত রাখেন…
আঙ্গুলগুলো হালকাভাবে চুলে বুলিয়ে দেন।
চোখের কোণে জল জমে… কিন্তু মুখে ঠান্ডা সান্ত্বনার চেষ্টা:
– আল্লাহ ভালো করবে বাজান… তুই তো বলেছিলি ওকে ধুমধাম করে আবার বিয়ে করবি… ও কি তোর কথা রাখবে না ?
আদিব চুপ করে থাকে…
কিন্তু বুকের ভেতর সেই কান্না থামে না…
সে শুধু প্রার্থনা করে, চোখ তুলে তাকায় আকাশের দিকে…
‘আল্লাহ… আমার হায়াতকে ফিরিয়ে দাও।
দুপুর বারোটা।
ঘড়ির কাঁটা যেন ধীর গতিতে এগোচ্ছে।
করিডোরজুড়ে এক ধরনের ক্লান্তি আর উদ্বেগ ঘোরাফেরা করছে—
চোখে ঘুম নেই, মুখে হাসি নেই…
শুধু অপেক্ষা।
হঠাৎ এক নার্স ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে নরম কণ্ঠে বললেন,
– মিস্টার আদিব ?
আদিব চমকে তাকালো।
নার্সের মুখে একটা শান্ত, কিন্তু স্পষ্ট বার্তা—
– পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।
মুহূর্তের জন্য সময় যেন থমকে গেলো।
আদিব কিছু বললো না, শুধু তাকিয়ে রইলো নার্সের মুখের দিকে—
বিশ্বাস করতে পারছিল না।
নেহা বললো,
– হায়াত… হায়াত জেগেছে!
আদিব ধীরে ধীরে দাঁড়ালো।
পায়ের নিচে কেমন এক কাঁপুনি, বুকের ভেতর যেন হৃদপিণ্ডটা উল্টে যাচ্ছে।
তারপর দৌড়ে গিয়ে মিস্টার চৌধুরীর গলা জড়িয়ে ধরলো,
– আব্বু! হায়াত জেগেছে… আমার পাখিটা জেগেছে!
সবার চোখে আনন্দের জল।
মিসেস অরোরা চুপচাপ সেজদায় গিয়ে বসে পড়লেন মেঝেতেই—
– আলহামদুলিল্লাহ… আল্লাহ তো কৃপা করলেন!
আদিব নার্সের সাথে কেবিনের দিকে হাঁটতে লাগলো,
প্রতি ধাপে যেন হৃদয়ের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে।
কেবিনের দরজার সামনে এসে সে কিছুক্ষণ থেমে রইলো,
দম নিয়েই ধীরে ধীরে দরজাটা খুললো…
আর ভিতরে—
সাদা বালিশে মাথা রেখে শুয়ে থাকা সেই পরিচিত মুখ,
কান্না ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে…
আদিবের দিকে।
হায়াত…
জেগে আছে।
আদিব ধীরপায়ে কেবিনে ঢুকে হায়াতের পাশে বসল।
হায়াত চোখ খুলে তাকিয়ে আছে—
চোখে দুর্বলতা, কিন্তু এক চেনা উষ্ণতা জ্বলজ্বল করছে।
আদিব হাত বাড়িয়ে হায়াতের কপালে আলতো ছোঁয়া দিলো।
তার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো হায়াতের কপালের ওপর।
হায়াতের ঠোঁট হালকা কাঁপছে,
সেই কাঁপন যেন হাজার মাইল দূর থেকে ফেরা কোনো স্মৃতির ঢেউ।
অথচ এখন,
অস্পষ্ট কণ্ঠে, নিস্তেজ ঠোঁটে,
সে ফিসফিস করে বলে ওঠে—
– আমার… আদি…আমার….
একটু হাসির চেষ্টা করে যেন,
আর তারপরই…
চোখদুটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসে।
হাতটা অবশ হয়ে পড়ে।
আদিব আঁতকে উঠে চিৎকার করে—
– হায়াত ! হায়াত! না পাখি, চোখ খোলো! আমি এখানে আছি… আমি আছি হায়াত !
হাসপাতালের মনিটরে দপদপ শব্দ চলছে,
তবু আদিবের ভেতরে আবার সেই ভয় কাঁপতে থাকে—
যেন কোনো দুঃস্বপ্ন তাকে পিছু টানছে।
নার্স আর ডাক্তার দৌড়ে আসেন।
আদিবকে সরে যেতে বলা হয়।
ডাক্তারের মুখে উদ্বিগ্নতা,
আর আদিবের বুকের ভিতরে ঝড়—
হায়াত একবার বলেছিলো “আমার আদি,আমার ,
আর সেই শব্দই এখন তাঁর জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডাক্তার কিছুক্ষণ হায়াতের নাড়ি ও চোখ পরীক্ষা করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন।
আদিবের বুক ধড়ফড় করছে—প্রতিটি নিঃশ্বাসে শুধু একটাই প্রশ্ন:
– হায়াত কি আমাদের চিনবে? হায়াত কি আবার আগের মতো হাসবে?
ডাক্তার ধীরে সুস্থে মুখ তুললেন।
মৃদু হাসি তাঁর ঠোঁটে—
– মিস্টার আদিব চৌধুরী… আলহামদুলিল্লাহ। আপনার ওয়াইফের স্মৃতিশক্তি ফিরেছে। একেবারে ঠিক আছেন তিনি।
আদিব চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিলো—
মনে হলো, দুনিয়ার সব ওজন যেন এই এক বাক্যে হালকা হয়ে গেছে।
কিন্তু ডাক্তার তখনই গম্ভীর গলায় যোগ করলেন—
– তবে একটা কথা মনে রাখবেন। উনাকে অন্তত এক মাস সম্পূর্ণ বেড রেস্টে রাখতে হবে।
এটা শুধু মানসিক না, শারীরিকভাবেও উনার বিশ্রাম দরকার।
আদিব চিন্তিত চোখে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাচ্ছেন, ডাক্তার ?
ডাক্তার স্পষ্ট করলেন,
– মানে হলো, কোনো রকম উত্তেজনা, মানসিক চাপ বা শারীরিক ক্লান্তি—কিছুই চলবে না।
নাহলে মাথায় আবার চাপ পড়লে উনি জ্ঞান হারাতে পারেন, এমনকি আরও জটিল অবস্থাও তৈরি হতে পারে।
এখন থেকে তাঁর প্রতিটি দিন শান্তিতে কাটাতে হবে।”
আদিব চুপ করে রইলো,
হায়াতের নিস্তেজ মুখের দিকে তাকিয়ে,
নিজেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো—
“তোমাকে আবার হাসতে দেখবো পাখি,
তোমার লাল শাড়ির স্বপ্ন আমি রোজ পূর্ণ করবো,
তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের পাহারাদার হবো আমি…”
—
চার দিন কেটে গেছে হাসপাতালের সেই রাত থেকে।
সন্ধ্যা ছয়টা বাজে, জানালার ফাঁক গলে কমলা আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে হায়াতের সাদা কপাল।
আজ তার রিলিজ।
মিসেস অরোরা এক বাটি সুপ হাতে নিয়ে কেবিনে ঢুকলেন। আদর মাখা কণ্ঠে বললেন,
– মা, একটু মুখে দাও তো… ওষুধ খেতে হবে।
কিন্তু হায়াত মুখ ফিরিয়ে নিলো, শিশুর মতো একরোখা স্বরে বললো,
– আমি খাবো না… আমার উনি কোথায় ?
মিসেস অরোরা একচোট হাসলেন।
– আরে, আদিব তো নিচে রিসেপশনে গেছে বিল মেটাতে। এই তো আসছে…
ঠিক তখনই দরজাটা খুলে গেলো।
আদিব ঢুকলো ক্লান্ত, কিন্তু চোখে প্রশান্তির দীপ্তি।
হায়াতকে দেখে মুখে আলতো হাসি ফুটলো তার।
হায়াত অভিমানী কণ্ঠে বললো,
– উনি না এলে আমি খাবো না।
আদিব এগিয়ে এসে পাশে বসল, একচুলে তার মাথা ঠিক করে দিলো।
– বউ, জেদ করে না… সুপটা খেয়ে নাও, না হলে আবার জ্বর উঠে যাবে।
হায়াত তখন ধীরে ধীরে আদিবের কানের কাছে মুখ নিয়ে গেলো—
একটা কোমল শ্বাস ফেলে ফিসফিসিয়ে বললো,
– আগে চুমো দিন, না হলে খাবো না…
আদিব থমকে গেলো।
চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো—
– কিহ ?
হায়াত চোখ নামিয়ে নিয়ে শিশুর মতো গাল ফুলিয়ে বললো,
– হু সত্যি, না দিলে আমি রাগ করবো… সবার সামনে না, কানে কানে বলেছি…
আদিব অপ্রস্তুত, কিন্তু মুগ্ধ।
তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক লাজুক হাসি—
একটা দুষ্টু হাসি, আরেকটা প্রেমের প্রতিজ্ঞা।
নিরবে হায়াতের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আদিব।
আর হায়াত যেন সেই চুম্বনের উত্তাপে মুখ নামিয়ে সুপের দিকে হাত বাড়ালো।
নেহা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে হেসে ফেললেন—
– আদিব, তোমার পাখিটাকে তুমি ভালোই সামলাচ্ছো…
#চলবে….