#আমার_হায়াতি
পর্ব : ২৭
লেখিকা : #Nahar_Adrita
( নতুন প্রেমের সূচনা… 🫢🧛♀️)
ক্লিওকে খেতে দিয়ে হায়াত আস্তে করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। গেস্ট রুমে দরজাটা খুলতেই চোখ গেলো ঘুমন্ত আরাবির দিকে। হায়াত আরাবিকে ডাকতে লাগলো, কিন্তু সে একটু নড়ে চড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। হায়াত মিন মিন করে বললো,
– ইস আমার বেস্ট ফ্রেন্ডটা যদি আমার দেবরের বউ হতো তাহলে আমাকে আর একা থাকতে হতো না। হাহ কি করার আসিফ ভাইয়ার তো এক সপ্তাহ পরেই বিয়ে, ধুর আগে জানলে আরাবিকেই ঠিক করে রাখতাম ভাইয়ার জন্য।
হায়াত চুপচাপ রুমে থেকে বের হয়ে গেলো। নিচে গিয়ে বাড়ির দরজা খুলে দিলো। একটু পরই বাড়ির কাজের লোক রোজি খালা এসে পড়লেন। হায়াত এক গাল হেসে দরজার পাশে দাড়ালো, রোজি দাতঁ বের করে হাসলো,
– মা আইজকা কি রান্না করুম কইয়া দেও।
– রান্না পড়ে করবেন খালা,আগে দুই কাপ চা করে দিন আর এক কাপ কফি।
– আইচ্ছা মা।
হায়াত পা টিপে টিপে নিজের রুমে প্রবেশ করলো। আদিব এখনো ঘুমাচ্ছে।আস্তে আস্তে আদিবের মাথার কাছটাতে বসলো হায়াত। আদিবের চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে, ঠোঁট গুলো কেমন বাচ্চাদের মতো ফুলিয়ে রেখেছে। হায়াত লোভ সামলাতে না পেরে ঝুঁকে পরলো আদিবের অধরের কাছে,ছোট করে একটা চুমু খেতেই আদিব চোখ খুলে ফেললো, হায়াতের লজ্জায় মরে যাওয়ার মতো অবস্থা।
আদিব চুলে হাত চালাতে চালাতে এক হাত দিয়ে খপ করে ধরলো হায়াতকে। জড়িয়ে ধরে নিজের ওপরে শুইয়ে দিল। হায়াত মিন মিন করে বললো,
– জান আমি জদি না জন্মাতাম, তাহলে আপনি কাকে হায়াতি বলে ডাকতেন ?
– এটা কেমন প্রশ্ন ভাই….
– না বলুন আপনি।
– যদি হায়াত নামে অন্য কারো সাথে বিয়ে হতো তাকে ডাকতাম।
– বাহ জান বাহ,তারমানে আপনি আমাকে ছাড়াও অন্য কাওকে বিয়ে করতে চান।
এই বলে হায়াত আদিবের পেটের ওপর সটান হয়ে বসে পড়লো, হায়াতের কাধ ধরে শুইয়ে দিয়ে হায়াতের ওপর চড়ে বসলো আদিব,
– বেয়াদব একটা ! দিন দিন তোমার মুখ কিন্তু একটু বেশিই চলছে হায়াত।
– আচ্ছা আপনি কি আমাকে বাইক চালানো শিখিয়েছেন ?
– হ্যাঁ আমি তো একটা মাকাল, তাই তোমাকে বাইক চালানো শেখাবো।
– তাহলে চুপ থাকুন আমি যেটা চালাচ্ছি সেটাই চালাতে দিন, বাইক চালানো যেহেতু শেখাতে পারবেন না, হুহ।
হায়াতের কথা শুনে আদিব হা হয়ে গেলো। লাইক সিরিয়াসলি এটা সেই হায়াত যে কথায় কথায় কিনা লজ্জা পেতো। আদিব কপাল স্লাইড করে বললো,
– যাও কফি নিয়ে আসো।
– হ্যা রোজি খালা নিয়ে……
হঠাৎ করেই আদিবের ফোনটা হাত থেকে হায়াতের নাকের ওপরে পড়লো,সঙ্গে নাকের ডগাটা লাল হয়ে গেলো। হায়াত কিছু বলার আগেই আদিব তার অধর নিজের আয়ত্তে এনে ফেললো।প্রায় চল্লিশ মিনিট ওষ্ঠের সাধ নিতে লাগলো দুজন। একটু পর ছেড়ে দিতেই জুড়ে জুড়ে হাঁপাতে লাগলো হায়াত। আদিব আহ্লাদী স্বরে বললো,
–
জান ব্যাথা কমেছে তো।
– হ্যা কমেছে, এক মিনিট আপনি ব্যাথা কমানোর জন্য কি এতোক্ষণ চুমু খেলেন নাকি।
– হ্যা বউ।
দুজনের কথার মাঝেই ঘুমু ঘুমু চোখে আরাবি আসলো রুমে। হায়াত আদিবকে যে এভাবে দেখবে তা চিন্তার বাইরে ছিলো।
চোখ বন্ধ করে বললো,
– স্যরি দোস্ত আমি জানতাম না , তোরা যে সকালে রোমাঞ্চ করিস, নাহলে আরো পরে আসতাম।
আদিব তাড়াতাড়ি করে হায়াতের ওপর থেকে নেমে গেলো। হায়াতও গলায় ওড়না পেঁচিয়ে বিছানায় থেকে ওঠে গেলো। হায়াত আরাবিকে নিয়ে নিচে চলে গেলো আর আদিবও ওঠে ফ্রেশ হতে গেলো।
——
সকাল ঠিক আটটা বাজতেই বাড়ির ডাইনিং রুমে টুকটাক শব্দ শুরু হয়ে গেলো। আরাবি আর হায়াত দুজনেই রান্নাঘর থেকে একে একে সব খাবার তুলে এনে টেবিলে সাজাচ্ছিলো। প্লেটে গরম ভাতের ভাপ উঠছে, পাশে রঙিন সবজি আর সুগন্ধি তরকারির ঘ্রাণ পুরো ঘরটাকে ভরিয়ে তুলেছে। টেবিলের চার কোণায় কাঁচের গ্লাসে পানি সাজানো, যেন সকালের পরিপাটি এক আয়োজন সম্পূর্ণ হয়।
এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো আদিব। গম্ভীর অথচ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে, পরিপাটি অফিসিয়াল পোশাকে যেন আলাদা এক আভিজাত্য ছড়িয়ে পড়লো তার চারপাশে। কালো কোট, সাদা শার্ট আর গলায় বাঁধা টাই—সব মিলিয়ে যেন নিখুঁত এক প্রফেশনাল লুক। সিঁড়ির ধাপগুলোয় তার পায়ের শব্দ পড়তে পড়তে যেন জানান দিলো, দিনের ব্যস্ততা শুরু হতে চলেছে।
টেবিলে বসে পড়তেই হালকা হেসে আরাবির দিকে তাকিয়ে আদিব বললো,
– তোমরা রান্না করেছো নাকি শালিকা।
আরাবি আর হায়াত চোখাচোখি করে হাসলো,
– হ্যা ভাইয়া আমরাই করলাম,রোজি খালাকে হায়াত সব গুলো রুম পরিষ্কার করতে বলেছে।
হায়াতও মাথা নাড়িয়ে বললো। তারপর ধীরে ধীরে সকালের নাস্তার আয়োজন তার সামনে বাড়িয়ে দিলো।
খাওয়া শেষ করে আদিব গ্লাসে এক চুমুক পানি খেলো। টেবিলের চারপাশে তখনো সকালের উষ্ণতা লেগে আছে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হায়াতের দিকে তাকালো সে। মুহূর্তটুকু যেন কিছুটা ধীর হয়ে এলো—আদিব এগিয়ে গিয়ে আলতো করে হায়াতের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। হায়াত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো, চোখে হালকা প্রশান্তির ছায়া।
অন্যদিকে আরাবি এতো সুন্দর মূহুর্ত দেখে মিটি মিটি হাসলো, এরপর আবার কাওয়াই মনোযোগ দিলো।
তারপর আদিব হাতে তুলে নিলো গাড়ির চাবি। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলো আদিব,
পেছনে দাঁড়িয়ে হায়াত শুধু নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো, যতক্ষণ না গাড়ির শব্দ ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেলো।
আরাবি এসে হায়াতের কাধে হাত রাখলো,মজার ছলে নিশ্বাস ফুঁকে বললো,
– হাহহ,হাই আফসোস ! আমার জানু তার জামাই নিয়ে সারাদিনই লালালা করে আর আমি কিনা সিঙ্গেল।
– হ্যা দোস্ত আয়, আমার কপালের সাথে একটা ঘষা দে।
দুই বান্ধবী অট্ট হাসিতে মেতে ওঠলো এমন সময় গেটের সামনে গাড়ির শব্দ আসলো।
চৌধুরী বাড়ির গাড়িগুলো একে একে গেটের ভেতরে প্রবেশ করতেই চারপাশ জমে উঠলো কোলাহলে। একে একে সবাই গাড়ি থেকে নামতে লাগলো। হায়াত দ্রুত ঘোমটা টেনে নিয়ে সবার সামনে এগিয়ে এসে ভদ্র ভঙ্গিতে সালাম জানালো। তার পাশে দাঁড়িয়ে আরাবিও একইভাবে সালাম করলো।
পরিবারের সবাই আরাবিকে চিনলেও, একজন ছিল নতুন—আসিফ। গাড়ির দরজা ঠেলে যখন সে নামলো, মুহূর্তটুকু যেন থমকে গেলো। হায়াতকে সে কিছুটা বুঝতে পারলো এটাই আদিবের স্ত্রী,
– আসসালামু আলাইকুম ভাবিমনি।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।কেমন আছেন।
– হ্যা আলহামদুলিল্লাহ, তুমি দেখছি খুব পিচ্ছি ভাবিমনি।
হায়াতের সাথে কথা বলতে বলতেই ঠিক সেই সময়ই চোখ অনিচ্ছায় পাশে ঘুরে এলো।
সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল শ্যামবর্ণের অষ্টাদশী কিশোরী—আরাবি। এক পলকেই দৃষ্টি আটকে গেলো তার দিকে। আসিফ যেন মুহূর্তেই ভুলে গেলো চারপাশের কোলাহল, শুধু তাকিয়েই রইলো বিস্ময়ে।
অন্যদিকে, আরাবিও চুপ হয়ে গেলো। এমন আকর্ষণীয়, এমন প্রাণময় সৌন্দর্যের পুরুষ সে আগে দেখেনি কখনো। অজান্তেই তার চোখ হা হয়ে তাকিয়ে রইলো আসিফের দিকে।
কিন্তু পরক্ষণেই দুজনের মনেই আঘাত হানলো এক তিক্ত সত্য—আসিফের বিয়ে তো অন্য কারও সাথে ঠিক হয়ে গেছে। হঠাৎই বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠলো। এক মুহূর্তের স্বপ্ন ভেঙে পড়ার মতো, আরাবি দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো মাটির দিকে।
বাতাসে যেন এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো, যা শুধু দুজনের ভেতরের অনুভূতিকে আরও জটিল করে তুললো।
সকলের পেছন থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন রাহেলা চৌধুরী—চৌধুরী বাড়ির প্রবীণতম অভিভাবক, আদিবের দাদি। বয়সের ভারে পা একটু কাঁপছিলো, কিন্তু চোখে-মুখে এখনো ছিলো এক ধরণের দৃঢ়তা আর রাজকীয় আভিজাত্য।
গেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা সবাইকে এক নজর করে দেখলেন তিনি। আর যখন দৃষ্টি এসে পড়লো হায়াতের ওপর, মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন।
ঘোমটার আড়াল থেকেও যেন ঝলসে উঠছিলো হায়াতের সৌন্দর্য। লাজুক ভঙ্গিতে সবার সাথে মিশে দাঁড়িয়েছিলো সে, তবু চারপাশের ভিড়ে তাকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যাচ্ছিলো সহজেই।
রাহেলা চৌধুরীর চোখে বিস্ময়ের ঝলক ফুটে উঠলো—
“আদিবের স্ত্রী এতটা সুন্দরী মাশাল্লাহ ”
মনে মনে অবাক হলেও ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক অদৃশ্য হাসি, যেন নীরব স্বীকৃতি। ঘরের নতুন বৌমার প্রতি মমতা মাখা সেই দৃষ্টি অনায়াসেই সবার নজরে পড়লো।
রাহেলা চৌধুরীর বিস্মিত দৃষ্টির পর মুহূর্তটুকু নীরবতায় ভরে গেলো। তারপরেই হায়াত লাজুক ভঙ্গিতে সবাইকে ভেতরে আসার ইঙ্গিত করলো। মৃদু কণ্ঠে বললো,
– চলুন সবাই, ভেতরে আসুন।
তারপর এগিয়ে গিয়ে নিজেই দরজা খুলে দিলো। চৌধুরী পরিবারের সবাই ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করতে লাগলো। আরাবি পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করছিলো রাহেলা চৌধুরীকে ভেতরে প্রবেশ করতে।
মিসেস অরোরা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো ড্রয়িংরুমের কোনায় দাড়িয়ে থাকা হায়াতের দিকে। তিনি একগাল হেঁসে হায়াতকে জড়িয়ে ধরলো।
– এই তো আমার মেয়েটা আগের মতো হাসি খুশি হয়ে গিয়েছে।
এই বলে কপালে চুমু খেলেন।
– যাও আম্মু রোজিকে শরবত বানাতে বলো সবার জন্য, সকলে খুব ক্লান্ত।
– আচ্ছা আম্মু।
রান্নাঘরে ঢুকতেই রোজি খালা এগিয়ে এলো।
– মা শরবত আমি বানিয়ে দিমু,আপনারা শুধু নিয়ে যান।
হায়াত মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। রোজি খালা মুহূর্তেই লেবু কেটে, চিনি মিশিয়ে, বরফ দিয়ে ঠান্ডা শরবত বানিয়ে রাখলো। গ্লাসগুলোতে টলমল সবুজাভ ঝলক, দেখে যেন কারওই আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করে না।
হায়াত আর আরাবি একসাথে হাতে ট্রে তুলে নিলো। ধীরপায়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই সবার দিকে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিতে লাগলো তারা। ঘরের ভেতরে তখন হালকা গল্পগুজব আর হাসির রোল বয়ে চলেছে।
কিন্তু সেই ভিড়ের মধ্যেই যেন এক অদ্ভুত নীরবতা তৈরি হলো। আরাবি যখন ট্রে থেকে এক গ্লাস তুলে আসিফের হাতে দিলো, মুহূর্তেই তাদের চোখ এক হয়ে গেলো।
দুজনের দৃষ্টি মিলতেই সময় যেন থমকে গেলো। আরাবির শ্যামল মুখ লালচে আভায় ভরে উঠলো, আর আসিফের ভেতর যেন অজানা টান খেলে গেলো। চারপাশে এত মানুষ, এত শব্দ, অথচ দুজনের কানেই কিছু শুনতে পেলো না—শুধু সেই নীরব চোখাচোখির ভাষা।
পরক্ষণেই আরাবি হকচকিয়ে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো, ট্রে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। মনে পড়লো আসিফের বিয়ের কথা। আর আসিফও ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত এক অস্বস্তি নিয়ে নিঃশব্দে গ্লাসটা ঠোঁটে তুলে নিলো।
হায়াত একপাশে বসেছিলো লাজুক ভঙ্গিতে। তার চারপাশে বসে থাকা ফুপু-শাশুড়ী আর ননদরা একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে যাচ্ছিলো—
– কোন স্কুলে পড়েছো?রান্নাবান্নায় কতটুকু হাত আছে তোমার?
হায়াত নরম গলায়, বিনয়ের সাথে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে তার লাজুক হাসি ফুটে উঠছিলো, যা সবার মনোযোগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।
ঠিক তখনই ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন রাহেলা চৌধুরী। বয়সের ছাপ থাকা সত্ত্বেও তার পদক্ষেপে ছিলো রাজসিক দৃঢ়তা। হায়াতের কাছে এসে তিনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর নিজের গলা থেকে সোনালি চেইনটি খুলে নিয়ে আলতো করে হায়াতের গলায় পরিয়ে দিলেন।
ঘরের ভেতর মুহূর্তেই নীরবতা নেমে এলো। সকলে অবাক হয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলো।
চেইনটি শুধু একটি অলংকার নয়, বরং ছিলো পরিবারের আস্থার প্রতীক। রাহেলা চৌধুরীর এই অপ্রত্যাশিত আচরণ যেন সবার চোখে হায়াতকে এক নতুন মর্যাদায় বসিয়ে দিলো।
আর হায়াত হতবাক বিস্ময়ে হাত বাড়িয়ে চেইনটা ছুঁয়ে দেখলো, চোখে অজান্তেই জমে উঠলো এক ফোঁটা অশ্রু—কৃতজ্ঞতা আর সম্মানের অশ্রু।
রাহেলা চৌধুরী স্মিথ হেসে বললো,
– আমি সহজে কাউকে কিছু দেই না, তোমাকে আমার ভারী পছন্দ হয়েছে দাদুমনি , আমার নাতিকে সামলিয়ে রাইখো।
– ইনশাআল্লাহ দাদি।
—
দুপুর ঠিক বারোটা বিশ। দীর্ঘ মিটিং শেষ করে নিজের কেবিনে বসে আছে আদিব। সামনের টেবিলে ছড়ানো ফাইলপত্র, একপাশে আধভরা কফির কাপ। জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলো তার ক্লান্ত মুখে পড়ছে, কিন্তু চোখে তবুও জ্বলজ্বল করছে সাফল্যের দীপ্তি।
ঠিক তখনই হঠাৎ কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো রাজ।
রাজ—আদিবের ফুফাতো ভাই, সেইসাথে শৈশবের সেরা বন্ধু। বন্ধুত্ব আর আত্মীয়তার এই মিশ্র সম্পর্ক দুজনের মাঝে যেন এক অদৃশ্য বন্ধন গড়ে তুলেছিলো বহু আগে থেকেই।
রাজকে দেখে মুহূর্তেই বদলে গেলো কেবিনের পরিবেশ।
ডেকে উঠলো রাজ,
– জিগার, আমার দোস্ত। সাদাদদদদদদদদদদ।
আর পরক্ষণেই ছুটে গিয়ে পাগলের মতো আদিবের গলায় ঝাঁপিয়ে পড়লো।
অপ্রস্তুত হয়ে আদিবও এক মুহূর্ত থমকালো, তারপর হেসে উঠলো উচ্চস্বরে। আনন্দে সে-ও লাফিয়ে উঠে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাজকে।
সদ্য শেষ হওয়া মিটিংয়ের সব চাপ, ক্লান্তি, গম্ভীরতা—এক নিমিষে মিলিয়ে গেলো। যেন অফিস কেবিনটা মুহূর্তেই রূপ নিলো দুই পুরনো বন্ধুর মিলনমেলায়।
”
”
”
এদিকে বিকেল সাড়ে চারটা। গেস্ট রুমে এসে দরজা ভেজিয়ে দিলো আসিফ। দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার জন্য গলার বোতামগুলো একে একে খুলে ফেললো, তারপর শার্ট খুলে আলগোছে চেয়ারের পিঠে ছুঁড়ে রেখে দিলো। খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসছিলো বিকেলের আলো, হাওয়ার স্পর্শে পর্দাগুলো দুলছিলো মৃদু মৃদু।
আসিফ বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো। চোখ অর্ধেক বুজে এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, হয়তো এই ভিড়ভাট্টা থেকে কিছুটা নিঃশ্বাস নেওয়া যাবে।
ঠিক সেই সময় হালকা শব্দে দরজা খুলে গেলো।আরাবি গুন করে গান গাইছে,
– তোরে জামাই বানামু,গোটা দেশরে জানামো…………
আরাবি, বেখেয়ালে, যেন বোকার মতো ভেতরে প্রবেশ করলো। হাতে ছিলো পানির জগ, মনে হচ্ছিলো হয়তো ভুল করে অন্য কারও জন্য আনতে গিয়েছিলো। ঘরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়লো শার্টবিহীন আসিফকে।
এক মুহূর্তেই তার শ্বাস আটকে এলো, মুখ লাল হয়ে উঠলো। পা যেন মাটিতে থেমে গেলো।
আর আসিফও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেলো—শুধু দু’জনের চোখের নীরব প্রশ্ন আর অজানা স্রোত বয়ে যেতে লাগলো বাতাসে।
হঠাৎ করে দৃশ্যটা বুঝে উঠতেই আরাবির চোখ কপালে উঠে গেলো। হাতে ধরা পানির জগ কেঁপে উঠলো, আর মুহূর্তের মধ্যে সে মুখ ঢেকে উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলো—
– নাউজুবিল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ! আল্লাহ গো, আমি তো এই পুরুষের ইজ্জত দেখে ফেললাম! আল্লাহ, আমারে মাফ করো!
তার গলার শব্দে ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে গেলো। পর্দা দুলে উঠলো বাতাসে, যেন পরিবেশও অবাক হয়ে গেলো এ হঠাৎ ঘটনার তীব্রতায়।
আসিফ বিস্ময়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখে-মুখে এমন এক তাজ্জব ভাব, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না কী শুনলো এখনই।
মুহূর্তে ঘর ভরে উঠলো আরাবির লজ্জা আর আতঙ্কের অদ্ভুত মিশ্রণে। অন্যদিকে আসিফের মনে খেলে গেলো এক অজানা অনুভূতি—এ লাজুক অথচ সরল মেয়েটি যেন হঠাৎ করেই অদ্ভুতভাবে তার হৃদয়কে নাড়া দিয়ে গেলো।
আসিফ নিজের চোখে-চোখ রেখে আরাবিকে দেখলো। ভেতরের কিছুটা অবাক ভাব ঝাপসা হয়ে গেলো, আরেকটু শক্ত করে নিশ্বাস নিয়ে সে বললো—
– চুপ, আমি কি মেয়ে নাকি যে আমার কিছু দেখে ফেলছো তুমি।
তার কণ্ঠে ধমকের সুর, কিন্তু সহনশীলতার আভা মিশে ছিলো। চোখে দৃঢ়তা, মুখে সামান্য কঠোরতা—সব মিলিয়ে যেন বোঝাচ্ছিলো, এটা কোনো সাধারণ হুমকি নয়, বরং সতর্কবার্তা।
আরাবি মুহূর্তে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হৃদয় দ্রুত ধুকপুক করছে, লাজুক চোখে অজান্তে তাকিয়ে আছে আসিফের দিকে। তার ধমক যেন শুধু সাবধান করছে না, বরং সম্পর্কের ভেতরের আবেগকেও অনায়াসে স্পর্শ করছে।
——
ড্রয়িংরুমের বাতাসে তখন হালকা কোলাহল। হায়াত সবার সঙ্গে বসে ছিলো, চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে ছোটখাটো আলাপচারিতায় মেতে আছে। হাসি, কথোপকথন, আর হালকা ফিসফিস—সব মিলিয়ে ঘরটা প্রাণবন্ত।
হঠাৎ দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো আদিব আর রাজ। দুজনেই অফিসের পোশাকে, অথচ মুখে হালকা হাসি আর প্রাণবন্ত চাহনি।
মুহূর্তে ঘরের সব চোখ যেন তাদের দিকে গেলো—কিন্তু তিনজনই, হায়াত, আরাবি আর রাজ, একযোগে একজন অন্যজনকে লক্ষ্য করে স্থির হয়ে গেলো। তাদের দৃষ্টি যেন এক অদ্ভুত বিন্দুতে আটকে গেলো।
ঠিক সেই সময় রিয়া বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল,
– ভাইয়া, ভাবি, আর আরু আপি তোমরা কি একে অপরকে চেনো?
আদিবও একটু হেসে, কিন্তু একই প্রশ্ন করলো,
– হ্যাঁ, সত্যি? তোমরা কি একে অপরকে চেনো হায়াত ….?
ঘরে অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। চারপাশে থাকা সবাই তাকিয়ে রইলো, কারণ এখন শুধু প্রশ্নই নয়, বরং প্রত্যেকের চোখে অনিশ্চয়তার ছায়া ফুটে উঠেছে।
#চলবে